বিহারে উচ্চবর্ণের চার প্রধান সম্প্রদায়ের অন্যতম হল ভূমিহাররা। পরশুরাম জয়ন্তী উপলক্ষে সেই সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে তেজস্বী কোনওরকম রাগঢাক না করে বলেন, ‘আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। বাবা-মা যখন সরকার চালিয়েছেন, আপনাদের প্রতি তখন অনেক অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনা হয়েছে।
আমি কথা দিচ্ছি, আমাদের ফের সেবা করার সুযোগ দিন। আর অন্যায় হবে না। আমি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নতুন পথে চলতে চাই।’ এমন অনুষ্ঠানে লালুপ্রসাদের দলের কারও উপস্থিতিটাই বড় ব্যাপার। সেখানে বিহার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা লালু প্রসাদ-রাবড়ি দেবীর ছোট ছেলে তেজস্বী ওই অনুষ্ঠানে মিনিট কুড়ির ভাষণ নিয়ে বিহারের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে।
তেজস্বীর এই বক্তব্য জানাজানি হতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে বিহারে। লালুপ্রসাদ বরাবর সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতির কথা বলে এসেছেন। যে রাজনীতির মূল কথা হল, জাতপাতের সংঘাতের কারণে পিছিয়ে থাকা অংশকে সামনের সারিতে নিয়ে আসা।
সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতির শরিক নীতীশ কুমার, মুয়ায়ম সিং যাদব, শরদ যাদবরাও। তবে লালু প্রসাদের মতো তাঁরা কেউই কখনও উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে সামাজিক যুদ্ধ ঘোষণা।করেননি।
ভূ -য়ে ভূমিহার, রা-য়ে রাজপুত, বা-য়ে ব্রাহ্মণ, ল-য়ে লালা বা কায়স্থ। উচ্চবর্ণের এই চার সম্প্রদায়কেই সংক্ষেপে ভূরাবাল বলে থাকে বিহারের রাজনৈতিক মহল। তারা জনসংখ্যার সাকুল্যে ১৭ শতাংশ হলেও জমি জায়গা, স্কুল কলেজ, আইন আদালত, অফিসকাছারিতে এই চার শতাংশের দখলে একটা সময় ছিল প্রায় ৯০ ভাগ।
২০২০ তে সামান্য ব্যবধানে সরকার গড়ার সুযোগ হাতছাড়া হয় আরজেডির। তেজস্বী তাই নয়া ভোট ব্যাংক গড়ার পথে হাঁটতে চাইছেন। লালুপ্রসাদের সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতিতে যে সামাজিক সংঘাতের বার্তা রয়েছে তা সরিকে দলকে ‘সবকা সাথ’ পথে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন তিনি। সেই কারণে জেনারেল কাস্টের জন্য চাকরি, শিক্ষায় দশ শতাংশ সংরক্ষণের আগে বিরোধিতা করলেও এখন সমর্থন করেছেন।
২০০৫ থেকে বিজেপির হাত ধরে বিহার শাসন করছেন নীতীশ কুমার। নীতীশ জাতীয় কুর্মি। মধ্যবর্গীয় কুর্মি ও কৈরী সম্প্রদায় এবং অতি পিছড়া সম্প্রদায়কে নিয়ে তিনিও নিজের ভোট ব্যাংক গড়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে তাঁর জোট শরিক বিজেপির কোর ভোট ব্যাংক হল উচ্চবর্ণের লোকেরা।
বিহারে রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, নীতীশ ও লালুপ্রসাদের দল উচ্চবর্ণের মানুষের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে চাইছে বিজেপিকে ধাক্কা দিতে। নীতীশ ফের গেরুয়া শিবির ত্যাগ করে আরজেডির হাত ধরবেন, এমন জল্পনা চলছেই। তাঁদের পরিকল্পনা সফল হয়েছে হালে বোচাহা বিধানসভার উপ নির্বাচনে। সেখানে আরজেডি প্রার্থী জয়লাভ করেছে, ভূমিহারদের সমর্থন ছাড়া যা সম্ভব ছিল না।
লালুপ্রসাদ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চবর্ণের প্রভাব খর্ব করতে ‘ভূরাবাল কো খতম করো’ ডাক দেন বিহারে। সেই ঘোষণার জেরে ঘটে যায় জাতিগত সংঘর্ষের একাধিক ঘটনা। নয়ের দশক জুড়ে চলতে থাকে একের পর এক গণহত্যা। জেলে যেতে কয়েকশো ভূমিহার, রাজপুত নেতাকে। পাশাপাশি লালুপ্রসাদ গড়ে নেন তাঁর এম-ওয়াই ভোট ব্যাংক।
এম-য়ে মুসলিম এবং ওয়াই-য়ে যাদব। বিহারে জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ হল মুসলিম। আর লালুপ্রসাদের স্বজাতি যাদবরা ১৩ শতাংশ। এই ৩০ শতাংশ ভোট ব্যাংককে সম্বল করে বিহারের রাজনীতির সমীকরণ বদলে দেন লালু। ১৯৯০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তাঁকে টলাতে পারেনি বিরোধীরা।
এমনকী পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়ার পরও মুসলিম-যাদব ভোট ব্যাংকের ভরসায় জনতা দল ভেঙে নিজের রাষ্ট্রীয় জনতা দল গড়েন, স্ত্রী রাবড়ি দেবীকে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু ২০০৫ -এর পর থেকে একক শক্তিতে আর ক্ষমতায় আসতে পারছে না আরজেডি।
পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির সব ক’টি মামলায় লালুপ্রসাদ জামিন পেলেও তিনি এতটাই অসুস্থ যে বলতে গেলে দিল্লির হাসপাতালে শয্যাশায়ী। তাঁর পক্ষে আর মাঠে-ময়দানের রাজনীতিতে আসা সম্ভব হবে না। বয়সের ভারে রাবড়ি দেবীও একপ্রকার ঘরবন্দি। খাতায়কলমে না হলেও দলের কাণ্ডারি এখন তেজস্বী।
তিনি বুঝতে পারছেন, মুসলিম, যাদবরা লালুপ্রসাদের ডাকে যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তাঁর ক্ষেত্রে সেই মাত্রায় হবে না। তাছাড়া ভোটের ওই সমীকরণ যে বর্তমান পরিস্থিতিতে অচল গত ১৬-১৭ বছরের নির্বাচনী ফলাফলে তা স্পষ্ট। ২০১৫- তে দল নীতীশ কুমারের পার্টি জনতা দল ইউনাইটেডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। দু বছরের মাথায় সেই জোট ভেঙে যায়।