‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’, আজকের তারিখ, অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী উদযাপিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের নেপথ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির রক্তক্ষয়ী আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের আজকের দিনেই; ৮ই ফাল্গুন, ১৩৫৮ সনে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শহীদ হয়েছিলেন রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকতেরা। বাংলা ভাষার জন্য জন্ম হল একটি নতুন দেশের। সেই বলিদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেই, আজ বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় মাতৃভাষা দিবস। কিন্তু কেবল পশ্চিমবাংলা বা বাংলাদেশ নয়; সুদূর আফ্রিকাতেই স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা ভাষা। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলবর্তী একটি ছোট্ট দেশ হল সিয়েরা লিওন রিপাবলিক। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ের এই দেশটিতে বহু ভাষা এবং সংস্কৃতির সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
উল্লেখ্য, সিয়েরা লিওনে প্রায় ১৬টি জনজাতি বসবাস করে। যাদের সবার নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি আছে। ১৬ টি জনজাতি বসবাস করলেও, তাদের মধ্যে দুটি বৃহত্তম ও প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী হল তেমনে ও মেন্দে সম্প্রদায়। সিয়েরা লিওনের উত্তরাঞ্চলে তেমনে জাতিগোষ্ঠীর প্রাধান্য রয়েছে, আর দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলটি মেন্দে জাতিগোষ্ঠী প্রভাবিত। দেশের আয়তন ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার, দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ৭৬ লক্ষ। টাইটানিয়াম এবং বক্সাইট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে সিয়েরা লিওনের সুনাম রয়েছে। তাছাড়াও সোনা ও হীরে উৎপদনেও সিয়েরা লিওন এগিয়ে। তাই একে হীরের খনির গরিব দেশ বলা হয়।
বিগত ১৯৬১ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় সিয়েরা লিওন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন স্যার মিলটন মারগাই। কিন্তু ১৯৬৪ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে মারা গেলে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। কিন্তু এ সবের পরেও দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র দুর্দশার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতেন। এরপর স্বাধীনতার ৩০ বছরের মাথায়, ১৯৯১ সালে দুর্নীতি এবং দেশের সম্পদ অপব্যবহারের প্রতিবাদে সিয়েরা লিওনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এছাড়াও ১৬টি উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ লেগেই থাকত। জনগণের মধ্যে জমতে থাকা ক্ষোভ আর অসন্তোষের ফলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ১৯৯১-তে কিছু বিদ্রোহী দল চেষ্টা করে রাষ্ট্রপতি জোসেফ মোমাহ-কে পদচ্যুত করতে। রক্তাক্ত হয়ে ওঠে সিয়েরা লিওন। কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ঘরছাড়া হয়ে পড়েন লক্ষ লক্ষ মানুষ।
এরপর ২০০২ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে। গৃহযুদ্ধ থামাতে রাষ্ট্রসঙ্ঘ হস্তক্ষেপ করে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশি সৈনিক সিয়েরা লিওনে আসেন। রাষ্ট্রসংঘের পাঠানো প্রথম দলে ৭৭৫ জন বাংলাদেশি সেনা ছিলেন। পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে আরও সেনা পাঠানো হয়। ১২ হাজার বাংলাদেশি সৈন্য পা রাখেন সিয়েরা লিওনের মাটিতে। যুদ্ধ থামাতে স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টায় সেদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান সৈনিকেরা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি স্থানীয় মানুষেরা আকৃষ্ট হন, অনুষ্ঠানে বাংলা গানের ব্যবহার শুরু হয়। উপজাতিগুলোর মধ্যে সম্প্রীতির বাঁধন তৈরি করেন বাংলাদেশি সৈন্যরা। শেষ পর্যন্ত শান্তি ফেরে সিয়েরা লিওনে। বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ২০০২ সালের ১২ই ডিসেম্বর বাংলা ভাষাকে সাম্মানিক সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন সিয়েরা লিওনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আহমেদ তেজান কাব্বা। পরের বছরই রাষ্ট্রপতি তেজান কাব্বা বাংলাদেশ সফরও করেন। তবে এই স্বীকৃতি কেবলই সাম্মানিক। সেদেশে সরকারি কাজকর্ম হয় ইংরেজি এবং ক্রিওল ভাষায়। পৃথিবীর বুকে পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশ ব্যতীত আরও একটি দেশ রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিয়েছে; সারা বিশ্বে এ এক অনন্য নজির।