গত ১৯ জুলাই সংসদে বাদল অধিবেশন শুরুর আগের দিনই সামনে চলে আসে পেগাসাস কাণ্ড। তার ফলে বাদল অধিবেশনের প্রথম দিন থেকেই এই ইস্যুতে উত্তাল লোকসভা ও রাজ্যসভা। কার্যত অচলই ছিল সংসদের দুই কক্ষ। আর এতেই রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে বেঙ্কাইয়া নায়ডুর। বুধবার রাজ্যসভায় কেঁদে ফেলেন তিনি। কিন্তু বেঙ্কাইয়ার দশাকে পরিহাস হিসেবেই দেখছেন বিরোধী সাংসদরা। তাঁদের অভিযোগ, বিরোধী থাকাকালীন হামেশাই সংসদে হাঙ্গামা করতেন তৎকালীন বিজেপি সাংসদরা। আপত্তি তুললে বলতেন, সংসদ চালানোর দায়িত্ব সরকারের, বিরোধীদের নয়। বিজেপির দেখানো পথেই তারা হাঁটছেন বলে দাবি বিরোধীদের।
প্রসঙ্গত, বিরোধীদের ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ ঘিরে গোড়া থেকেই উত্তাল সংসদের বাদল অধিবেশন। তাই শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষা না করে, বুধবারই লোকসভায় বাদল অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন স্পিকার। বিরোধীদের আচরণে গণতন্ত্রের মন্দির সংসদ ভবন কলুষিত হয়েছে বলে বুধবার রাজ্যসভায় মন্তব্য করেন নায়ডু। তাতেই তাঁকে অতীত স্মরণ করাচ্ছেন বিরোধীরা। তাদের দাবি, ২০১৪ সালে সরকার গড়ার আগে পর্যন্ত সংসদে বিজেপিই সবচেয়ে বেশি হট্টগোল করেছে। ইউপিএ আমলে দিনের পর দিন সংসদে বিরোধীদের হট্টগোলের বিষয়টি উঠে এসেছে সংসদীয় বিষয় নিয়ে গবেষণাকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পিআরএস লেজিসলেটিভ রিসার্চের পরিসংখ্যানে, যা নিয়ে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’ একটি প্রতিবেদনে করেছে।
২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ইউপিএ দ্বিতীয় সরকারের সময়কার যে হিসেব তুলে ধরেছে তারা, তাতে দেখা গিয়েছে, ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য মনমোহন সিংহ জয়ী হওয়ার পর ৯৩ শতাংশ সময়ই বিনা বাধায় কাজ হয়েছিল লোকসভায়। কিন্তু ২০১৩ পর্যন্ত তা নামতে নামতে ৪৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। ১০২ শতাংশ থেকে ২০১৩ সালে রাজ্যসভায় নেমে আসে ৫৮ শতাংশে। ২০১৪ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। ২০১৪ সালে লোকসভায় ৮৪ শতাংশ সময়ই বিনা বাধায় কাজ হয়েছে।
এরপর ২০১৯ সালে সেই হার একধাক্কায় বেড়ে ১৩৫ শতাংশে ঠেকে। ২০২০ সালে ১৫৩ শতাংশ সময়ই বিনা বাধায় কাজ হয়েছে লোকসভায়। তাই বিরোধীদের অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে সংখ্যার জোরে সংসদে একের পর এক বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে মোদী সরকার। বিরোধীদের আলোচনার সময় পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এমনকি পেগাসাস নিয়ে বিক্ষোভের মধ্যেও একের পর এক বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে কেন্দ্র। বিরোধীদের আপত্তি জানানোর সময় দেওয়া তো দূর, এক একটি বিল পিছু গড়ে মাত্র সাত মিনিট সময় খরচ করা হয়েছে, সংসদের ইতিহাসে যা কার্যত নজিরবিহীন।
বিরোধীদের হাঙ্গামায় সংসদ অচল থাকায় ১৩০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে কেন্দ্র। এর জবাব দিতে গিয়ে মোদী সরকারের প্রয়াত দুই মন্ত্রী তথা সময়কার বিজেপি সাংসদ অরুণ জেটলি এবং সুষমা স্বরাজের মন্তব্যও টেনে এনেছেন অনেকে, যেখানে ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট জেটলিকে বলতে শোনা যায়, ‘সংসদ সব কিছু নিয়ে আলোচনার জায়গা। কিন্তু অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এড়িয়ে যায় সংসদ। সেই পরিস্থিতিতে অধিবেশনে বাধা সৃষ্টি করা হয়, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে শুভ। সংসদে বিক্ষোভ দেখানো একেবারেই অগণতান্ত্রিক আচরণের মধ্যে পড়ে না।’
২০১২ সালের ২৬ আগস্টও জেটলিকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘সংসদে বিক্ষোভ হলে, তা দেশের পক্ষে মঙ্গলই। কারণ সরকার সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে না, বিরোধী হিসেবে তা হতে দেওয়া যায় না। কোনও রকম আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারে না সরকার।’ কয়লা খনির বরাত দেওয়া নিয়ে ২০১২ সালে বাদল অধিবেশন তদানীন্তন বিজেপির বিক্ষোভে যখন উত্তাল, সেই সময় ৭ সেপ্টেম্বর সুষমা স্বরাজ বলেন, ‘সংসদ অচল করে রাখাও গণতন্ত্রেরই একটি রূপ…তা ছাড়া, সংসদ সচল রাখা সরকারের দায়িত্ব, বিরোধীদের নয়।’ তাই পেগাসাস নিয়ে মোদী সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে আঙুল তুললেও, জেটলি এবং সুষমার মন্তব্যকেই ঢাল করছেন তারা।