কোচবিহারের শীতলকুচি কাণ্ড নিয়ে সঠিক বিচার চেয়ে এবার নালিশ গেল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে। কেবল সেখানেই নয়, রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার বিভাগেও এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ পৌঁছেছে। মানবাধিকার সংগঠন মাসুম শীতলকুচির ঘটনা নিয়ে বিশদে তদন্ত করে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, তার ভিত্তিতেই তারা এই অভিযোগ ঠুকেছে। মাসুমের অভিযোগের প্রাপ্তিস্বীকার করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশন সূত্রের খবর, চলতি সপ্তাহেই কমিশনের ফুল বেঞ্চের কাছে এই অভিযোগপত্র পেশ করা হতে পারে তাদের সিদ্ধান্তের জন্য। ফুল বেঞ্চ মনে করলে এনিয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট তলব করতে পারে। সরকারের দেওয়া রিপোর্টে সন্তুষ্ট না হলে তারা নিজেদের অফিসারদের দিয়ে তদন্তও করাতে পারে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অবশ্য এনিয়ে কী পদক্ষেপ করছে তা প্রকাশ্যে জানায় না। তবে তারাও এ নিয়ে রিপোর্ট তলব করতে পারে ভারত সরকারের কাছে।
গত ১০ই এপ্রিল চতুর্থ দফার ভোটের দিন শীতলকুচি বিধানসভা কেন্দ্রের ১২৬ নম্বর বুথের বাইরে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে গোটা দেশে তোলপাড় চলছে। সেদিন উন্মত্ত জনতার হাত থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষার্থে নাকি কেন্দ্রীয় বাহিনী তথা সিআইএসএফ দেদার গুলি চালাতে বাধ্য হয়। যার বলি হয় চারজন নিরীহ যুবক। পেশায় তারা পরিযায়ী শ্রমিক ছিল। বাহিনীর গুলিতে আরও চারজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। বাহিনীর এই সাফাইকে অবশ্য মান্যতা দেয় নির্বাচন কমিশন। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী তথা কমিশনের এহেন ভূমিকার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। তিনি এ ব্যাপারে সরাসরি আঙুল তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দিকে। ভোটে বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী সেদিন বিনাপ্ররোচনায় গুলি করে একটি সম্প্রদায়ের নিরীহ ভোটারদের হত্যা করেছে বলে তিনি তোপ দেগেছেন। মোদী-শাহ অবশ্য পাল্টা নিশানা করেছেন মমতাকেই। তাঁদের বক্তব্য, ভোটের ঠিক আগে শীতলকুচির জনসভায় মমতা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার নিদান দিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি করতে উস্কানি দিয়েছেন।
রাজনৈতিক চাপানউতোর যাই হোক না কেন, মাসুমের তদন্তে কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা বিনাপ্ররোচনায় গুলি চালানোর অভিযোগকেই মান্যতা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে পাঠানো ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বুথের অনতি দূরে স্থানীয় বাজারে একটি ১৪ বছরের বিশেষভাবে সক্ষম কিশোরকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা মারধর করে। জখম কিশোরকে ওভাবে মারধর করার ছবি মোবাইলে তোলার জন্য তার দাদাকেও তারা পেটায়। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই গ্রামবাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এই সময় কুইক রেসপন্স টিমের গাড়িতে জনা কয়েক সিআইএসএফ জওয়ান ঘটনাস্থলে আসে। তারা গাড়ি থেকে নেমে উত্তেজিত জনতাকে ফিরে যেতে বলে। জনতা পিছন ফিরতেই তাদের মধ্যে দু’জন জওয়ান আচমকা গুলি চালাতে থাকে। তাদের ছোড়া গুলিতেই চারজন নিহত ও আরও চারজন আহত হয়। সংশ্লিষ্ট বুথে মোতায়েন থাকা সিআইএসএফ জওয়ানরা সেদিন কোনও গুলি চালায়নি। মাসুমের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম সব কিছু খতিয়ে দেখে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। কেন ১৪ বছরের কিশোরটিকে জওয়ানরা সেদিন পিটিয়েছিল, এমন কী জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল বাহিনীর ওই সদস্যরা, কেন নিহত বা আহতদের সকলের কোমরের নীচ লক্ষ্য করে গুলি চালানো হল না, জনতা আক্রমণ করে থাকলে কেন কোনও জওয়ান বিন্দুমাত্র আহত হল না, গুলি চালানোর আগে কেন লাঠিচার্জ বা কাঁদানে গ্যাসের ব্যবহার করা হল না ইত্যাদি এমন সব প্রশ্ন তুলে মানবাধিকার কমিশন ও রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে বিচার চেয়েছে মাসুম।