পুরবোর্ড কিংবা বাংলার মসনদে তৃণমূলের বিকল্প যে তৃণমূলই, তা তুলে ধরতে সোমবার থেকে প্রচারে নামছে রাজ্যের শাসকদল। কেন ফের তৃণমূল, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই প্রশ্নের জবাব তারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। যে প্রচারের অনুচ্চারিত বার্তা হবে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, মমতাই ভরসা। তাঁর সরকারের ভালো কাজের সংখ্যা প্রচুর। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে কিছু প্রকল্পের। কিন্তু রাজ্যজুড়ে প্রচারটা ঠিকঠাক হয়নি বলে লোকসভায় কাঙ্ক্ষিত ফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে দল। তাই আগামিকাল থেকেই সেই ভালো কাজের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপক কর্মসূচি শুরু করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহলে প্রচুর কাজ হলেও প্রচারের অভাবে সেগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ঠিক ধরা দেয়নি। এমনকী সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিজেপি বা বামেদের তুলনায় অনেক কম সক্রিয় তৃণমূল। গত লোকসভা ভোটে তার ফলও ভুগতে হয়েছে তৃণমূলকে। লোকসভায় বিজেপির ১৮টি আসন প্রাপ্তির হিসেব কষে দলের মূল্যায়ন, সবটাই মেরুকরণের ফল নয়। বরং রাজ্য সরকারের ভালো কাজের নজিরগুলি ভোটারদের কাছে বিপণনে ব্যর্থ হয়েছে দল। তাই একুশের বিধানসভার ভোটের প্রচার খানিকটা বিপণনের ঢঙেই পুরসভা থেকে শুরু হচ্ছে।
কাল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে কয়েক হাজার দলীয় পদাধিকারীর সামনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি মূলত অভিযোগ-কেন্দ্রিক। অভাব-অভিযোগ জানানোর মঞ্চ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে নেতাদের মজবুত সম্পর্ক গড়ে তোলাও ছিল দলের উদ্দেশ্য। সেটা যেমন চলছে চলবে। কিন্তু এ বার সরকার সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরে মানুষকে জানাতে চায়, কেন পুরসভা থেকে নবান্ন, তৃণমূল ছাড়া গতি নেই কোনও।
বঙ্গ বিজয়ে মোদী-অমিত শাহরা প্রতিশ্রুতির বান ছোটাবেন। তাই দু-দফায় সরকারের সাফল্যকেই হাতিয়ার করতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস। দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রথম ৭৫ দিনের প্রচার হবে চমকে দেওয়ার মতো, যা বাংলার রাজনৈতিক প্রচারের ইতিহাসে নয়া মাইলফলক তৈরি করবে। ঘটনাচক্রে, এই আড়াই মাসের মধ্যেই কলকাতা, হাওড়া-সহ রাজ্যের শতাধিক পুরসভায় ভোট হওয়ার কথা। কিন্তু দলীয় প্রচার শুধুই সংশ্লিষ্ট পুরসভাগুলিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। একুশে ফের আস্থা অর্জনে গোটা রাজ্যেই দল নামছে কোমর বেঁধে।
আজ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রাজ্যের শাসকদল যে মেগা প্রচার কর্মসূচি ঘোষণা করতে চলেছে তার প্রধান লক্ষ্য কিন্তু কেন্দ্রের শাসক দলকে পাল্টা জবাব দেওয়া নয়। বরং রাজ্য সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরা। প্রথম আড়াই মাসের পর একুশের ভোট পর্যন্ত আরও কিছু অভিনব প্রচার চালাবে তারা। তৃণমূল মনে করছে, ২০১১-য় পরিবর্তনের ভোটে শুধু সরকারের বদল হয়নি, বঙ্গ-বদলের সূচনাও হয়েছিল। বিগত ন’বছরে দু’একটি ক্ষেত্র ছাড়া রাজ্যের হতশ্রী চেহারা অনেকটাই দূর করা গিয়েছে। তা সত্ত্বেও লোকসভায় কাঙ্ক্ষিত ভোট আসেনি। দলের এক প্রবীণ নেতা মনমোহন সিং সরকার পতনের প্রসঙ্গও টানছেন। তিনি বলেন, ‘প্রথম ইউপিএ সরকারের সাফল্যের হাত ধরেই ইতিবাচক ভোটে দ্বিতীয় বার ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন মনমোহন। দ্বিতীয় দফাতেও বেশ কিছু ভালো কাজের নজির গড়েছিলেন তিনি। কিন্তু কংগ্রেস তার সফল বিপণনে ব্যর্থ হয়েছিল।’
তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, দু-দফায় সরকারে থাকায় উন্নয়নের রিপোর্ট কার্ড ধরে মানুষ তুল্যমূল্য বিচার করবে। তাতে দলের কোনও বিপদ নেই। বরং যদি কাজের দৃষ্টান্তগুলিকে মানুষের কাছে তুলে ধরা যায় তাতে আখেরে লাভ দলেরই।
এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের হাতে মোদী সরকারের শংসাপত্রও হাতিয়ার তৃণমূলের। তৃণমূল ছাড়া গতি নেই, এমন কৌশলী প্রচারে নামার পিছনে রয়েছে আরও একটি মস্ত বড় কারণ। দল মনে করছে, নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে বিজেপি বাংলা দখলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারা প্রতিশ্রুতির ঝাঁপি মেলে ধরবে বাংলার মানুষের কাছে। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সব রাজ্যেই বিজেপি এই কৌশল নিয়েছে। এর পাশাপাশি উন্নয়ন-অনুন্নয়নের প্রশ্নে তারা তৃণমূলকে কাঠগড়ায় তুলবে। তাই রাজ্যপাটে আসীন হওয়ার পর বাংলাকে মা-মাটি-মানুষ সরকার কী কী ভালো কাজ করেছে তার খতিয়ানেই ভোট আসবে মনে করছে তৃণমূল।
দিদিকে বলো’র থেকে আসন্ন প্রচার কর্মসূচির কাঠামোও খানিক ভিন্ন। দিদিকে বলো-তে মূলত জোর দেওয়া হয়েছিল নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ এবং রাজ্য ও জেলা স্তরের প্রথম সারির নেতাদের উপরে। নয়া কর্মসূচির অংশীদার হবেন বুথ থেকে রাজ্য প্রতিটি স্তরের পদাধিকারী। নেতা-নেত্রীও হয়ে উঠবেন একজন সাধারণ কর্মী। মানুষ যে এটাই দেখতে চায়! সেই কারণেই নয়া জনসংযোগের নয়া কর্মসূচির উদ্দেশ্য হল, মমতা এবং উন্নয়ন সমার্থক-সেটা বুঝিয়ে দেওয়া।