আগামীকাল নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধন। আর সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মোদী সরকারের তরফে রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ না জানানোয় তৈরি হয়েছে বিতর্ক। কংগ্রেস-সহ একাধিক বিরোধী দল এই অনুষ্ঠানকে বয়কটের ডাক দিয়েছে। এদিকে, নয়া সংসদ ভবনের জন্য বাতিল হতে চলা বর্তমান সংসদ ভবনের বয়স এখনও একশো-ও পেরোয়নি। স্যার এডুইন লুটিয়েন্স এবং হার্বার্ট বেকারের নেতৃত্বে এই ভবন গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯২১ সালে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স আর্থার। প্রায় পাঁচ বছর ধরে কাজ চলেছিল।
১৯২৭ সালে ভবনটির উদ্বোধন করেন বড়লাট লর্ড আরউইন। তখন অবশ্য এই ভবনের নাম ছিল ‘কাউন্সিল হাউস’। ভেতরে বসত কেন্দ্রীয় আইনসভা। স্বাধীনতার পরে এই কাউন্সিল হাউসেরই নাম পাল্টে রাখা হয় সংসদ ভবন। শুরুতে তার সেন্ট্রাল হলে বসত সুপ্রিম কোর্টের আদালত। পরে তা সরে যায় নতুন ভবনে। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই সংসদ ভবন। কিন্তু মাত্র ৯৬ বছরেই তাকে ‘ভিআরএস’ দিয়ে অবসর গ্রহণ করানো হল। সত্যিই কি সংসদ ভবনের জন্য ৯৬ বছরই যথেষ্ট সময়?
মোদী সরকারের তরফে সরকারিভাবে যুক্তি রাখা হয়েছে, এই পুরনো সংসদ ভবন তৈরিই হয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার জন্য। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দ্বিকক্ষ আইনসভার কথা তখন কোনও দিক দিয়েই ভাবা হয়নি। ফলে স্থান সংকুলান হওয়াটাই এখন সমস্যার। লোকসভার আসন বাড়লে সেই আসন দেওয়ার মত জায়গা নেই। সেন্ট্রাল হলে ৪৪০ জন মাত্র বসতে পারে। ফলে যৌথ অধিবেশন হলে আসন দেওয়া নিয়ে নিদারুণ সমস্যা তৈরি হয়। ভবনটির বৈদ্যুতিন ব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয়। আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার ছিটেফোঁটাও তাতে নেই।
জলের লাইন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের লাইন, কেবল ইত্যাদি সবই বিপজ্জনকভাবে যোগ করা হয়েছে। লোকসভা ও রাজ্যসভার মাইক, স্পিকার, মনিটর সবই সেকেলে। লোকসভা ও রাজ্যসভার সচিবালয়ের বিভিন্ন কক্ষে আধুনিক ‘অফিস’ বানানোর মত কিছুই নেই। কাঠের পার্টিশন দিয়ে কাজ সারা। এমনকি ভূতাত্ত্বিকভাবেও দিল্লি এখন অনেক বেশি বিপজ্জনক ‘সিসমিক জোনে’ রয়েছে। ফলে ভূমিকম্প হলেও বিপদ বাড়তে পারে। কিন্তু একবার যদি পৃথিবীর নানা দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমী দুনিয়ার নানা উন্নত দেশে আমরা চোখ বোলাই, দেখা যাবে, ৯৬ বছর সংসদ ভবনের জন্য নেহাতই কৈশোর বয়স।
যেমন নেদারল্যান্ডসের সংসদ ভবন ‘বিনেনহফ’। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম সংসদ ভবন, যা এখনও চলছে। দ্য হেগ শহরের হোফেইভার হ্রদের তীরে তৈরি গথিক দুর্গের আদলে বানানো বিখ্যাত ডাচ সংসদ ভবন ‘বিনেনহফ’-কে বলা হয় বিশ্বের প্রাচীনতম সংসদ ভবন, যাতে এখনও একইভাবে সভা হয়। ঠিক কবে এই বিখ্যাত দুর্গ তৈরির কাজ শুরু হয়, সঠিক জানা যায় না। সম্ভবত দ্বাদশ শতকে কাজ শেষ হয়। দিল্লির সুলতান তখন ইলতুৎমিস। আজও এই ভবনেই বসে ডাচ সংসদ।
আবার ফরাসি সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটের সভা হয় প্যারিসের লুক্সেমবার্গ প্রাসাদে। ভবনটি বানানো শুরু হয়েছিল ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে, শেষ হয় ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে। ভারতের অধীশ্বর তখন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। ফরাসি সংসদের নিম্নকক্ষ ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’-র সভা বসে সেইন নদীর ধারে, বুরবোঁ প্রাসাদে। সম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের আমলে ১৭২৮ সালে এটি বানানোর কাজ শেষ হয়। ফ্রান্সের পাশের দেশ বেলজিয়ামের সংসদ বসে ব্রাসেলসের ‘প্যালেস অফ দ্য নেশন’ ভবনে। নিওক্লাসিক ধাঁচের এই ভবন তৈরি হয়েছিল ১৭৮৩ সালে।
চেক প্রজাতন্ত্রের সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটের সভা বসে প্রাগের ঐতিহাসিক ওয়ালেস্টেইন প্রাসাদে। শোনা যায়, এই প্রাসাদ তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ১৬২৩ সালে, লেগেছিল সাত থেকে আট বছর। নিম্নকক্ষ ‘চেম্বার অফ ডেপুটিজ’-র সদস্যদের সভা হল ‘থুন প্রাসাদ’। সেও ১৭২৩ সাল নাগাদ বানানো। দুই ভবনই আজ ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক সৌধ’ বলে স্বীকৃত। আবার, প্রাচীন সভ্যতার পীঠস্থান গ্রিসের এককক্ষ সংসদ ভবন বসে এথেন্সের ‘ওল্ড রয়্যাল প্যালেস’ ভবনে। উদ্বোধন হয়েছিল ১৮৪৩ সালে। আইসল্যান্ডের সংসদ ভবন যখন তৈরি হয়, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলেরও জন্ম হয়নি তখন। ১৮৮১ সালে তৈরির কাজ শেষ হয়।
নরওয়ের সংসদ ভবনের উদ্বোধন হয়েছিল ১৮৬৬ সালে, নকশা করেছিলেন সুইডেনের বিখ্যাত স্থপতি এমিল ল্যাংলেট। ব্রিটিশ সংসদ ভবন ‘প্যালেস অফ ওয়েস্টমিনস্টার’-ও কম পুরনো নয়। সম্ভবত এটি তৈরি হয়েছিল বিনেনহফেরও আগে। কিন্তু ১৮৩৪ সালে এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে ভবনটির অনেকটাই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ১৮৭৬ সালে আবার নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়ে তাকে নির্মাণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান বোমারু বিমানের হামলার লক্ষ্য ছিল ওয়েস্টমিনস্টার। কিন্তু আজও এখানেই বসে ‘হাউজ অফ কমনস’।
প্রায় একই গল্প মার্কিন সংসদ ‘ক্যাপিটল হিল’ নিয়েও। ১৮০০ সালে বানানোর কাজ শেষ হয়েছিল। নকশা করেছিলেন উইলিয়াম থর্নটন। পরে ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ আক্রমণে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল এই ভবন। পরে আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয়। ১৮৬৬ সালে এর বিখ্যাত গম্বুজটি বানানোর কাজ শেষ হয়। আজ যেটি ওয়াশিংটন ডিসির অন্যতম ‘ল্যান্ডমার্ক’ রূপে স্বীকৃত। সারা পৃথিবীতে যেখানে দু’শো বা তিনশো বছরের পুরনো সংসদ ভবন চলছে, সেখানে মাত্র ৯৬ বছরেই নতুন সংসদের কি আদৌ দরকার ছিল? প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।