রবিবারই প্রয়াত হয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। উত্তর কলকাতার এই প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন অপরাজেয়। কখনও ভোটে হারেননি। শেষ দশ বছর সামলেছেন রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা দফতর। শুধু সামলেছেন বললে ভুল বলা হয়, ক্রেতা সুরক্ষা দফতরকে লালন করে স্বাবলম্বী করে তুলেছিলেন সাধন। বাংলারর সাধারণ মানুষকে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন সাধন পাণ্ডে। ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছেন কিন্তু এখনও হস্তান্তরিত হয়নি চাবি? গ্যাসের লাইন পেতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন? কম্পিউটার কিনতে গিয়ে ঠকে গেলেন? এই সব নানান অভিযোগের সমাধান করে ক্রেতা সুরক্ষা দফতর। উপভোক্তা বা ক্রেতাকে সঠিক পরিষেবা পাইয়ে দেওয়াই ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের কাজ।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রক সামলাতেন সাধন পাণ্ডে। প্রতিবারই তাঁকে ক্রেতা-সুরক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্ত্রী হিসেবে রাজ্যে জনপরিষেবাকে আরও উন্নত করেছিলেন। সাধন পাণ্ডের নেতৃত্বেই ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের কাজের প্রশংসা হয়েছিল রাজ্যজুড়ে। ১৯৯৯ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই মন্ত্রকের জন্ম হয়। সে’সময় কৃষি ও কৃষি বিপণন দপ্তরের সঙ্গেই কাজ করত ক্রেতা সুরক্ষা বিভাগ। বাম আমলে ফ্রন্টের শরিক ফরওয়ার্ড ব্লকের হাতেই থাকত ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রকটি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই ক্রেতা সুরক্ষার বিভাগটিকে নিয়ে পৃথক ও স্বাধীন দফতর গড়েন। দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রবীণ রাজনীতিক সাধন পাণ্ডেকে। এই দফতরের কাজ সম্পর্কে রাজ্যের মানুষের কোন ধারণাই ছিল না।
এরপর গুরুদায়িত্ব পেয়ে কাজে নেমে পড়েন সাধন। যেহেতু এই দফতরের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে জনপরিষেবা, তাই সবার আগে মানুষকে জানানোর কাজ শুরু করেন সাধন পাণ্ডে। সচেতনামূলক প্রচার, বিজ্ঞাপন সব কিছুতেই অভিনবত্ব নিয়ে আসেন। সাধারণ মানুষকে দিয়ে সরকারি দপ্তরের বিজ্ঞাপন দেওয়ার পথিকৃৎ ছিলেন সাধন। সাধারণের কথা সাধারণ বলার ফলে মানুষের কাছে পৌঁছান আরও সহজ হত। যেমন ধরা যাক; এক ছাপোষা কেরানি সাতেপাঁচে থাকেন না৷ দোকানে আটা কিনতে গিয়ে ঠকে গেলেন তিনি৷ স্ত্রীর কাছে ধমক খেয়ে ছুটলেন ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে মামলা ঠুকতে৷ ফলও পেলেন হাতেনাতে৷ ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের তত্পরতায় অচিরেই ক্ষতিপূরণ মিলল৷ উপরি পাওনা, বিভিন্ন এফএম রেডিওতে সাক্ষাত্কার দেওয়ার সুযোগ৷ ঠিক কী ভাবে তিনি ঠকেছিলেন, এবং কী ভাবেই বা ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের সহায়তায় ক্ষতিপূরণ পেলেন, তারই বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি৷
পাশাপাশি, উপকার পাওয়া ক্রেতাদের রেডিও চ্যানেলে বসানোই হোক বা সমাধান সরকার নামে কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করে সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করার কৌশল, বিজ্ঞাপনী অভিনবত্বে সাধন পাণ্ডের টেক্কা দিয়েছিলেন। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ‘জাগো গ্রাহক জাগো’ মর্মে দফতরের হোর্ডিং, ক্ষতিপূরণ পাওয়া ক্রেতাদের সাক্ষাত্কার এফএম রেডিওয় শোনানো, শহরের রাস্তায় উপকৃত ক্রেতাদের ছবিসহ তাঁদের বক্তব্যও হোর্ডিং আকারে রাখার পরিকল্পনা সবেতেই তৎপর ছিলেন সাধন পাণ্ডে। যত প্রচার বাড়তে থাকে তত বেশি পরিমাণে অভিযোগ জমা হতে শুরু হয়। প্রতারিত জনগণ সুবিচার পেতে শুরু করেন। দফতরের আয়ও বাড়তে থাকে।
এছাড়া, রাজ্যের মানুষ কোনও পণ্য কিনে প্রতারিত হলে সহজেই যাতে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও সাধনের আমলেই করা হয়। সঙ্গে জেলাস্তরেরও ক্রেতা সুরক্ষা বিভাগের বিভিন্ন শাখাকে সক্রিয় করে তোলেন তিনি। পরিষেবাকে নাগরিকদের আরও কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কলকাতা শহরের প্রত্যেকটি বাজারে ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের কমপ্লেন বক্স বসানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। ক্রেতা সুরক্ষা মেলা প্রচলনও হয়েছিল সাধন পাণ্ডের হাত ধরে। প্রত্যেক মহকুমায় ক্রেতা সুরক্ষা অফিস খোলার পরিকল্পনাও তাঁরই মস্তিস্কপ্রসূত। রাজ্যজুড়ে অজস্র ক্রেতা সুরক্ষা আদালত তৈরি করেছিলেন, তাঁর আমলে আইন পড়ুয়ারাও দফতরের অভিযোগের শুনানিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সর্বতভাবে ক্রেতা সুরক্ষা দফতরকে সাধারণের নাগালের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন সাধন পাণ্ডে। সহজ থেকে সহজতর করে তুলেছিলেন দফতরের পরিষেবাকে। সাধারণ মানুষকে সরকারি দফতরের থেকে কাজ হাসিল করতে যে জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে যায়, সেই বহুল প্রচলিত মিথও ভেঙে দিয়েছিলেন সাধন।