শুক্রবার মকর সংক্রান্তি। আবহমান প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সূর্য এদিনই ধনু রাশি থেকে প্রবেশ করে মকর রাশিতে। এখান থেকেই মকর সংক্রান্তি তিথিটির উৎপত্তি। তিথিটিকে ঘিরেই প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে উদযাপন। মকর সংক্রান্তিই ঐক্যবদ্ধ করেছে বৈচিত্র্যময় ভারতকে; পশ্চিম ভারতে এটি ‘মকর সংক্রান্তি’, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ‘পোঙ্গাল’, উত্তর ভারতে ‘লোহরি’, অসমে ‘ভোগালি বিহু’, কর্ণাটকে ‘ইল্লুবিল্লা’ এবং ‘মকর সংক্রমণা’, উত্তরপ্রদেশে ‘খিচড়ি’, গুজরাটে ‘উত্তরায়ণ’, হরিয়ানা ও হিমাচল প্রদেশে ‘মাঘী’, মহারাষ্ট্রে ‘তিলগুল’, বিহার-ঝাড়খন্ডে ‘সকরাত’, কাশ্মীরে ‘শায়েন-ক্রাত’ নামে পরিচিত। পাশাপাশি দেশের বাইরেও এর প্রচলন রয়েছে। নেপালে, এই সময়ে মাঘে সংক্রান্তি পালিত হয়, থাইল্যান্ডে সোংক্রান, কাম্বোডিয়ায় মোহা সোংক্রান, মায়ানমারে থিংইয়ান, লাওস-এ এর নাম হল পি মা লো। মূলত ফসলী উৎসব এটি। কথায় বলে, ‘অন্নচিন্তা চমত্কারা’। এই অনির্বচনীয় উৎসবে অদ্ভুত এক সারল্য রয়েছে, মিঠে পল্লীবাংলার ছোঁয়া রয়েছে। মা-ঠাকুমার স্নেহের স্পর্শ রয়েছে, পিঠে-পুলির গন্ধ রয়েছে। এমন এক পরব, যা পরিবারে নিয়ে আসে সমৃদ্ধি। একটি সংক্রান্তি এক সূত্রে বেঁধেছে সারা দেশকে।
উল্লেখ্য, পৌষের সংক্রান্তির কথা উঠলেই ভেসে ওঠে পিঠে, পুলি, পায়েস দিয়ে পেটপুজো। পিঠে-পুলির পার্বণই তো পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। পিঠে আমাদের সংস্কৃতি, লোকাচারের মধ্যে মিশে একাকার। বাঙালি বাড়িতে এক সময় শত শত পিঠে প্রস্তুত হত। আজ সেই রেওয়াজ অনেকটাই ম্যাড়মেড়ে। কেনা পিঠে দিয়েই পৌষ পার্বণে রসনাতৃপ্তি ঘটায় বেশিরভাগ শহুরে বাঙালিরা।
এবার কিছু ঐতিহ্যময় পিঠের ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক :
১) রসনারঞ্জন :
এই পিঠে আলু দিয়ে তৈরি হত। প্রথমে আলু সিদ্ধ করে নিয়ে তারপর তাকে ভাল করে চটকে নিতে হবে। এবার এর মধ্যে ময়দা দিয়ে বেশ আঠালো ভাবে মেখে নিতে হবে। এবার ঐ মাখা থেকে পুলি বা অন্য কোনো আকারের পিঠে গড়ে নিতে হবে। তার মধ্যে কড়াইশুঁটির পুর দিতে হবে। কড়াইশুঁটির দানাগুলোকে হালকাভাবে সিদ্ধ করে নিতে হবে। তারপর ঐ কড়াইশুঁটি সিদ্ধর মধ্যে মৌরি, গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে তেলের উপর নেড়ে নিতে হবে। তারপর ঐ পুর পিঠের মধ্যে ভর্তি করে ঘিয়ের উপর ভেজে নেওয়া যাবে।
২) দুধে আওটানপুলি :
ভাপা পুলি যেভাবে বানানো হয়, এই পুলিও সেই একইভাবে তৈরি হয়। তবে এটিকে দুধে সিদ্ধ করতে হয়। দুধ কমে কিছুটা ঘন হয়ে এলে তার মধ্যে গুড় দিয়ে দেওয়া হয়।
৩) কলার পিঠে :
এটি বড়া জাতীয় এক পিঠে, চালের গুঁড়ো, কলা আর গুড় সহযোগে এই পিঠে তৈরি করা হয়। চালের গুঁড়ো, কলা, গুড় একটি পাত্রে নিয়ে, দুধ দিয়ে ভাল করে মেখে একটা থকথকে মিশ্রণ তৈরি করতে হয়। ইচ্ছানুযায়ী, তার মধ্যে ছোট এলাচের গুঁড়ো, নারকেল কোরা দেওয়া যেতে পারে। তবেই কয়েকগুন বেশি উপাদেয় স্বাদের সৃষ্টি হয়। তারপর ঐ মিশ্রণ থেকে তালের বড়ার ন্যায় আকারের বড়া ভেজে নিতে হয়। তেলেও ভেজে নেওয়া যায়, তবে ঘিতে ভাজলে ঐ স্বাদ বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে।
৪) আলুর বিলাতি পিষ্টক :
এই পিঠে গরম গরম খাওয়ার নিয়ম। পিঠে মানেই নিরামিষ সেই কনসেপ্টকে ইয়র্কারে বোল্ড করে দিয়েছে এই পিঠে। আলু সিদ্ধ করে তার শাস কুড়িয়ে নিতে হবে। এবার তার মধ্যে অল্প চিনি, লেবু আর দু-তিনটি ডিমের হলুদ অংশ মিশিয়ে মেখে নিতে হবে। ডিমের সাদা অংশ ফেটিয়ে ফেনা উঠলে ঐ আলুর মিশ্রণের মধ্যে দিতে হবে। সবশেষে ঘিয়ের উপর ছেকে নিলেই আলুর বিলাতি পিষ্টক।
৫) কমলালেবুর পিষ্টক :
শীতকাল মানেই কমলালেবু। তবে এই পিঠে কিন্তু ফিউশনের কথা মনে করায়। আজকের শেফেরা দাবি করেন, তারাই ফিউশন মিষ্টির জন্ম দিয়েছে। আদপে বহুযুগ আগে থেকেই বাংলা ফিউশনের আঁতুরঘর। এই পিষ্টক খেতে হলে দুধের ঘন সর নিতে হবে, এককালে যাকে ননি বলা হত। প্রথমে মোটা দানার চিনি গুঁড়ো করে সেই ননির সাথে ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর তার মধ্যে ময়দা, কয়েকটা ডিমের হলুদ অংশ এবং একটুখানি নুন দিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে। অন্য একটি পাত্রে চিনির রস বানাতে হবে, তার মধ্যে কমলালেবু খোসার ভিতরের দিকের হলুদ অংশ গ্রেড করে দিতে হবে। ঐ রস আঠালো হয়ে জমে গেলে তা থেকে কুচি কুচি করে নিতে হবে। ডিমের সাদা অংশ ফেটিয়ে ঐ কুচি কুচি টুকরোগুলো দিয়ে, ননির মিশ্রণ মিশিয়ে ইচ্ছে মতো ছাচে ঢেলে নিতে হবে। যে পাত্রে ঢালা হচ্ছে তাতে, আগে ঘি মাখিয়ে নিতে হবে। তার উপর চিনির দানা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এবার ১০ মিনিট আঁচে রাখলেই কমলালেবুর পিষ্টক রেডি।
৬) তিলের ছাঁই:
তিলের দুই প্রকার ছাঁই পাওয়া যায়। একটি কাঁচা তিলের এবং অপরটি ভাজা তিলের। তবে কাঁচা তিলের ছাঁই বেশি সুস্বাদু। সাদা তিল ভিজিয়ে অল্প পরিমাণ জল দিয়ে থকথকে করে…