১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে, ‘২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ি’ ছেড়ে মনের মত বাড়ি করে ‘১০০নং গড়পাড় রোডে’ চলে যান উপেন্দ্রকিশোর। সেই সময় থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করে, দুরারোগ্য ‘ডায়াবেটিসে’ আক্রান্ত হন তিনি। ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের’ মাদকতায় তখন ইউরোপের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত, বাণিজ্যিক আদান প্রদানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরই ফলে এদেশে বিভিন্ন রোগের ওষুধ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলস্বরূপ নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ডাক্তারদের পরামর্শে তাঁকে ‘গিরিডি’তে বায়ু পরিবর্তনের জন্য গিয়েও কোন লাভ হয় নি। ‘গিরিডি’র ভাড়াবাড়িতে দু’দিন রোগযন্ত্রণায় একদম অচৈতন্য হয়ে ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। এরপরে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। আসতে চাইছিলেন না, তবুও। ‘অতিরিক্ত শারীরিক আর মানসিক পরিশ্রমে’ তাঁর স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করেছিল অনেক আগেই। তিনি যখন ‘মধুমেহ’ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তখনও ‘ইনসুলিনের’ আবিষ্কার হয়নি। আর বিদেশ থেকে তাঁর জন্য যে ওষুধ আসত, প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে সেই ওষুধ আর আসছিল না। প্রাণপ্রিয় ‘গিরিডি’তে সেই ছিল তাঁর শেষ যাওয়া। তিনি উঠেছিলেন ‘ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের’ ‘রুবি লজ’ বাড়িতে। ‘কনিষ্ঠ পুত্র সুবিমল রায়’ পরে লিখেছিলেন, “বাবার অসুখ কিছুতেই সারছিল না, তাই তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হল। বড় বড় ডাক্তারেরা দেখলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। কঠিন অসুখের মধ্যেও বাবা শান্ত থাকতেন। বলতেন, “আমি খুব আনন্দে আছি।” যে দু-দিন তিনি অজ্ঞান-অচৈতন্য ছিলেন, সেই দুটো দিন “সকল যন্ত্রণাবিমুক্ত হইয়া আমি কী আনন্দে বাস করিয়াছি – কী অমৃতের আস্বাদ পাইয়াছি – তোমরা তাহা জানো না।’’ – মৃত্যুর ছায়া-আচ্ছন্ন এই আনন্দ-অভিজ্ঞতার কথা তিনি নিজেই বলেছিলেন; পরে তাঁর জবানিতে লিখেছিলেন তাঁর ‘জ্যেষ্ঠ পুত্র সুকুমার রায়’। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন ছিল রবিবার। সেদিন ভোরবেলা, ছোট ছোট দুটো পাখি জানালার ধারে এসে কিচির-মিচির করছিল। মৃদুকণ্ঠে উপেন্দ্রকিশোর প্রায় বিড়বিড় করে বলেছিলেন, “পাখি কী বলে গেল তোমরা শুনেছ? পাখি বলল, পথ পা, পথ পা।’’ এরপরে সকাল থেকে দুপুর হয়ে বিকেল গড়িয়ে ছিল। আশার দীপ ক্রমশঃ ক্ষীণ হচ্ছিল। তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা জড়ো হতে শুরু করেছিলেন ‘গড়পারের বাড়িতে’। উপেন্দ্রকিশোরের শেষ সময় উপস্থিত দেখে তাঁর শেষশয্যার পাশে ঊষালোকে ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ শুরু করেছিলেন স্বজনেরা, “জানি হে যবে প্রভাত হবে, তোমার কৃপাতরণী লইবে মোরে ভবসাগরকিনারে …’’ তখনও তাঁর মৃদুকম্পিত ঠোঁট দুটি যেন এই গানের সঙ্গে যোগ রক্ষা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই কম্পন। প্রভাত-আলোয় দয়াময়ের কৃপাতরণী উপেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে যাত্রা করেছিল ভবসাগরের তীরের দিকে। সাল-তারিখ ছিল ১৯১৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর বহু পরে, ‘লীলা মজুমদার’ তাঁর ‘সুকুমার রায়’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘‘বাইশ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ির ‘বাঁ দিকে একটা গলি। সে-ধারে ছাপাখানার শিক-দেওয়া একটা ছোটো জানলা ছিল। রোজ বিকেলে একপাল ছোটো ছেলে ওই জানলার বাইরে প্রত্যাশী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। লক্ষ্মী হয়ে অপেক্ষা করলে, একজন রাগী প্যাটার্নের ভদ্রলোক ছোটো জানলাটি খুলে সকলকে একটা করে রঙিন ছবি দিতেন।’’ সেই ‘রাগী প্যাটার্নের ভদ্রলোক’টিকে ঘিরে গল্পের শেষ নেই। বিবেকানন্দ আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে একই বছরে জন্ম হয়েছিল তাঁর, ওদিকে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও প্রফুল্লচন্দ্রের থেকে দু’বছরের ছোট। মাত্র বাহান্ন বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু ঊনিশ শতকে ‘বাংলার নবজাগরণের’ অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর (১৮৬৩-১৯১৫) মতো বর্ণময় চরিত্রের জুড়ি মেলা ভার। জীবনের শেষ দুই দশকে তিনি এক দিকে ‘বাঙালির কারিগরি উদ্যোগকে’ একা হাতে, কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াই আন্তর্জাতিক মানে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, অন্য দিকে ‘গানবাজনা’, ‘শিশুসাহিত্য রচনা’, ‘শিশুপত্রিকা সম্পাদনা’, ‘বই ও পত্রিকা অলংকরণ’, ‘চিত্রশিল্প’, ‘মুদ্রণ ও প্রকাশনা’ এত বিচিত্র পথে হেঁটেছিলেন, পথ তৈরি করে নিয়েছিলেন আর পরবর্তী পথিকদের জন্য পথ করে দিয়েছিলেন যা শুধু বিস্মিত করে না, অভিভূত করে। এর মধ্যে একমাত্র ‘কারিগরি উদ্যোগ’ তাঁকে অবশ্যই কিছুটা ‘আর্থিক সাফল্য’ এনে দিয়েছিল, আর বাকিটা ছিল ‘‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’’। এত ‘অলাভজনক’ প্রয়াসে এত বিপুল প্রতিভার স্ফুরণ এ তো ‘অপচয়’ বলেই গণ্য হয়। যেমন হয়েছিল ‘হাসিখুসি’-র লেখক ‘যোগীন্দ্রনাথ সরকারের’ ক্ষেত্রে। উপেন্দ্রকিশোরের থেকে দু’বছরের ছোট এই মানুষটিই প্রথম ‘নীতিশিক্ষার আগড়’ ভেঙে শিশুদের আনন্দ দিতে সারা জীবন লেখালিখি আর বই প্রকাশ করেছিলেন। আত্মীয়-শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বড়ভাই ‘ডাক্তার নীলরতন সরকারের’ সঙ্গে তুলনা করে ছোট করতেন। আর উপেন্দ্রকিশোরের বেলায় কী ঘটেছিল? ‘ব্রাহ্মদের’ সঙ্গে মেলামেশা থেকে শেষে ‘ব্রাহ্মধর্ম’ নেওয়া, ‘পিতৃশ্রাদ্ধ’ না করা এ সবের জন্য পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার সামনে তাঁকে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু ‘মুন্সি শ্যামসুন্দর’ যেমন ‘বিধবাবিবাহ’ সমর্থন করতে দ্বিধা করেননি এবং তারপরেও তাঁকে ‘একঘরে’ করতে কেউ সাহস পায়নি, ছেলে ‘উপেন্দ্রকিশোর’ও সামাজিক বন্ধন ছিন্ন না করেও নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে পেরেছিলেন। কলকাতায় ‘ব্রাহ্মসমাজ’ তাঁকে বেড়ে ওঠার যে পরিসর দিয়েছিল, সেখানে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিকাশে কোনও সমস্যা হয়নি। ‘১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের’ বিশাল বাড়িতে এক দশক কাটিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ‘সমাজতাড়িত ব্রাহ্মরা’ অনেকেই সেখানে ছিলেন। সেখানেই থাকতেন ‘অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়’ আর তাঁর স্ত্রী ‘ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়’, তাঁদেরই মেয়ে ‘বিধুমুখী’র সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয়েছিল। তাঁর ছয় ছেলেমেয়ের পাঁচজনের জন্মই হয়েছিল সেখানে। তাঁর মেয়ে ‘পুণ্যলতা’র স্মৃতিকথা ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ থেকে জানা যায় ছোটদের পড়ায় আনন্দ কী ভাবে মিশিয়ে দিতেন উপেন্দ্রকিশোর। বইয়ের বাইরে মনগড়া অদ্ভুত জীবের গল্প শোনাতেন,
“মোটা ‘ভবন্দোলা’ কেমন হেলেদুলে থপথপিয়ে চলে, ‘মন্তুপাইন’ তার সরু লম্বা গলা কেমন পেঁচিয়ে গিঁট পাকিয়ে রাখে, গোলমুখ ভ্যাবাচোখো ‘কোম্পু’ অন্ধকার বারান্দার কোণে দেওয়ালের পেরেকে কেমন বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে।”
কচিকাঁচাদের আনন্দ-কোলাহল এতই লেগে থাকত যে লোকে বলত, ‘‘এই বাড়িটা যেন সবসময় হাসছে’’। আর এই ভাবেই ছোটদের কল্পনার জগৎকে প্রসারিত করে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। এক দিকে ছোটদের মনভোলানো ‘উপকথা ও ছড়া’, ‘পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতের গল্প’, অন্য দিকে ‘প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তু’ আর ‘কোটি যোজন দূরের নভোমণ্ডলের বৃত্তান্ত’। দূরের কথা জানতে গিয়ে ‘ঘাসের উপর শিশিরবিন্দু’ না হারিয়ে যায়, ‘শিশুর ঘরের গল্প’, ‘প্রতিবেশীর গল্প বেড়ানোর গল্প’ – কিছুই বাদ দেননি তিনি, এমনকী ‘শিশুর আধো আধো বুলি’ও যে লেখার বিষয় হতে পারে এমনটি আর কে-ই বা ভেবেছিলেন! ‘কলম-তুলির টানে’ যেন শিশুদের চার পাশের সব দেওয়াল সরিয়ে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ‘বুদ্ধদেব বসু’র কথায় পাওয়া যায় তারই প্রতিধ্বনি – ‘‘সুখের চরম ছিলো সেই দুটি বই ‘ছোট্ট রামায়ণ’ আর ‘ছেলেদের মহাভারত’বার-বার ফিরে এসেছি তাদের কাছে; যেমন মা, যেমন মাঝে-মাঝে খাওয়া আর ঘুমোনো এও তেমনি অনতিক্রম্য।”
শুধু পড়ানো কি লেখা নয়, ‘সময়’, ‘পরিশ্রম’, এমনকী ‘অর্থব্যয়ে’ অকুণ্ঠিত উপেন্দ্রকিশোর পরম ধৈর্যে ও যত্নে ছোটদের ‘সংগীত’ শেখাতেন। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক ‘রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে কেদারনাথ’ যে লিখেছিলেন, ‘‘তিনি ছোটদের আনন্দে এতদূর সন্তুষ্ট হইতেন যে অন্য কিছু লাভের কথা তাঁহার মনে স্থানও পাইত না’’, তা নিছক ‘প্রশস্তিবাক্য’ ছিল না। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করে তাঁর আদৌ লাভ হয়নি, বরং নিজেরই ‘অর্থব্যয়’ করতে হয়েছিল। কিন্তু রোগশয্যাতেও যত দিন পেরেছিলেন লিখে, ছবি এঁকে সন্দেশকে সাজিয়েছিলেন। ‘গিরিডি’তে বেড়াতে গিয়ে ‘উশ্রীর বালুচরে’ ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলায় মেতে উঠতেন, যেন তিনি ওদের সমবয়সী বন্ধু। এমনকী রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তাঁর ‘নদী’ কবিতার যে অলংকরণ করেছিলেন, সেখানেও সেই আনন্দের নির্ঝরিণী স্বপ্রকাশ পাওয়া যায়।
বাংলা শিশু সাহিত্য ‘সন্দেশ’ একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। ছোটদের জন্য এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল প্রমোদাচরণ সেনের ‘সখা’ (১৮৮৩), ভুবনমোহন রায়ের ‘সাথী’ এবং ‘সখা ও সাথী’ (১৮৯৪), শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’ (১৮৯৫) ইত্যাদি। ১৮৮৫-তে ‘বালক’ প্রকাশিত হলেও তার স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র এক বছর। ‘সন্দেশে’র রূপকার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ‘সখা’ ও ‘মুকুল’-এ নিয়মিত লিখতেন। এ দুটি পত্রিকায় তাঁর ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার মাধ্যমেই তিনি পত্রিকা ‘সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে’ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। হয়ত তখন থেকেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য মনের মত একটি পত্রিকা প্রকাশ করার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। বহুদিন ধরে ছোটদের লেখা লিখে উপেন্দ্রকিশোর বুঝেছিলেন যে রচনার সঙ্গে চিত্রের যথাযথ সংযোগ ঘটলে বিষয়বস্তুটির কল্পিত রূপ মনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যায় এবং রচনাটি পাঠকের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ‘সন্দেশ’ পত্রিকাটির মূল বিশেষত্ব এতে মুদ্রিত ‘ব্যঞ্জনাময় চিত্রাবলি’ যা সহজেই ছোটদের মনকে এক আনন্দঘন কল্পলোকের সন্ধান দেয়। তখন পত্রপত্রিকায় যে সব ছবি ছাপা হত তার অধিকাংশই ছিল ‘কাঠে খোদাই করা ব্লক’ থেকে প্রস্তুত। উপেন্দ্রকিশোর তাঁর লেখা ‘ছোটদের রামায়ণ’-এর জন্য এভাবে ছবি ছাপাতে গেলে অনেক ছবি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই তিনি ছবি ও মুদ্রণের উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হন এবং ‘হাফটোন’ পদ্ধতিতে ‘ব্লক’ তৈরিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনিই ছিলেন এদেশে ‘হাফটোন ব্লকের জনক’। এর জন্য তাঁর ‘বিজ্ঞান চেতনা’ তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। এ প্রসঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের মেজোমেয়ে ‘পুণ্যলতা চক্রবর্তী’ তাঁর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’তে লিখেছিলেন – “হাফটোন ছবি কি করে তৈরি করতে হয় সে বিষয়ে অনেক বই আনিয়ে বাবা পড়লেন, তারপর হাফটোন ছবি তৈরি করবার ক্যামেরা ও অন্যান্য সরঞ্জাম আনবার জন্য বিলেতে অর্ডার দিলেন … বিলেত থেকে মালপত্র এসে হাজির হল … একটা ঘরে বাবা স্টুডিও তৈরি করলেন, আরেকটা ঘরে ছোট একটা ছাপার প্রেস বসল। অন্য একটা ঘরে আর বড় বারান্দায় নানারকম যন্ত্রপাতি রাখা হল। একটা স্নানের ঘরকে করা হল ডার্ক রুম। … বাবা বই পড়ে পড়ে আর নিজের হাতে তা পরীক্ষা করে সব শিখতে লাগলেন। এমনি করে আমাদের দেশে হাফটোন ছবি তৈরির সূত্রপাত হল।” ‘বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের’ জেরে যখন নানা জায়গায় ‘স্বদেশি মেলার’ আয়োজন হচ্ছিল। ‘কংগ্রেস অধিবেশন’ উপলক্ষে ‘পিজি হাসপাতালের উল্টো দিকের মাঠে’ ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কালচারাল এগজ়িবিশন’ নামের একটি মেলা শুরু হয় ১৯০৬-এর ২১শে ডিসেম্বর। চলেছিল একুশ দিন। ১০০০ প্রদর্শক এতে অংশ নিয়েছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর সেখানে তাঁর ‘হাফটোন ছবি’ এবং আবিষ্কৃত ‘স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর যন্ত্র’টির জন্য মোট ‘তিনটি স্বর্ণপদক’ পেয়েছিলেন।
‘সন্দেশ’-এর রূপকার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্ম হয়েছিল ১৮৬৩ সালের ১২ই মে ‘অবিভক্ত বঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে’। পিতা ‘কালীনাথ’ ও মাতা ‘জয়তারা’। পাঁচ পুত্রকন্যার মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন মধ্যম। পিতৃদত্ত নাম ছিল ‘কামদারঞ্জন’। তাঁর মাত্র চার বছর বয়সে ‘কালীনাথের জ্ঞাতিভাই জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী’ রীতিমতো যাগযজ্ঞ করে ‘কামদারঞ্জন’কে ‘দত্তক’ নিয়েছিলেন। নাম রেখেছিলেন ‘উপেন্দ্রকিশোর’ – নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। ইতিপূর্বে ‘হরিকিশোরের দুই স্ত্রী’ পরপর মারা গিয়েছিলেন। তাঁদের সন্তানাদি ছিল না। তৃতীয় বার বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী’র নাম ছিল ‘রাজলক্ষ্মী’। তাঁরও সন্তান হল না দেখে ‘জ্ঞাতিভাই কালীনাথের মেজ ছেলেকে’ ‘দত্তক’ নিয়েছিলেন তিনি। এটা ছিল ১৮৬৮ সালের কথা। ‘ব্রহ্মপুত্র নদের’ তীর ছুঁয়ে ‘মসুয়া গ্রাম’। ‘ময়মনসিংহ জেলায়’। আগে এই গ্রামের নাম ছিল ‘খুকুরপাড়া’। এই অঞ্চলের বাসিন্দা ‘রামনারায়ণ রায়’ খ্যাতি–প্রতিপত্তিতে ছিলেন প্রবল প্রতাপান্বিত। ‘রামানারায়ণেরই বংশধর’ ‘কালীনাথ’, ‘হরিকিশোর’ ও ‘শিবেন্দ্রকিশোর’। তিন জ্ঞাতি ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে অবস্থাপন্ন ছিলেন ‘হরিকিশোর’। ‘ওকালতি’ করে আর পৈতৃক আয় বাড়িয়ে বিশাল সম্পত্তি করেছিলেন তিনি। উপেন্দ্রকিশোরকে ‘দত্তক’ নেবার দুই বছর পর হরিকিশোরের তৃতীয় পত্নী এক পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন।
‘ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের’ সব শিক্ষকই বালক উপেন্দ্রকিশোরকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। ভালবাসতেন। তবে তাঁদের অভিযোগ ছিল একটাই। ছেলেটি ক্লাসে প্রতিদিন পড়া পারে, পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয় না, দুরন্ত মেধা আর প্রতিভা, কিন্তু স্কুলের পাঠ্যবিষয়ে তার একদম আগ্রহ নেই। রাতে এক অক্ষরও পড়ে না সে। এর কারণ কী? বালকটি উত্তর দিয়েছিল, “শরৎকাকা আমার পাশের ঘরেই থাকে। রোজ সন্ধ্যায় সে চিৎকার করে করে পড়া মুখস্থ করে। ওতেই আমার পড়া হয়ে যায় যে!” শিক্ষকেরা আর কোনও কথা খুঁজে পাননি। ওদিকে ‘প্রবেশিকা পরীক্ষা’ আসন্ন প্রায়। এ দিকে তখন কিশোর উপেন্দ্রকিশোর মজে ছিলেন ‘বেহালা আর রংতুলিতে’। স্কুলের প্রধানশিক্ষক ‘রতনমণি গুপ্তের’ শরণাপন্ন হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র রায়। এত ভাল ছেলেটি, অথচ পড়ার বই নিয়ে বসেই না! শিক্ষক ‘রতনবাবু’ ছাত্রকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “তোমার উপর আমাদের অনেক আশা। তুমি আমাদের হতাশ কোরো না।” শিক্ষকমশাইয়ের এ কথায় উপেন্দ্রকিশোর অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে এসে সাধের বেহালাটি দিয়েছিলেন ভেঙে। প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গিয়েছিল পনেরো টাকা বৃত্তি পেয়েছেন উপেন্দ্র। পুরো টাকা দিয়েই বন্ধুদের নিয়ে এক ‘ব্রাহ্ম দোকান’-এ গিয়ে ভোজ দিয়েছিলেন। শুধু পড়াশুনো নয়, ছোট থেকে ভাল ছবিও আঁকতেন উপেন্দ্রকিশোর। কারও কাছে যে শিখেছেন, তা নয়। সাহায্যও নেননি কোনও দিন। একবার ময়মনসিংহ জেলা স্কুল পরিদর্শনের জন্য এলেন স্যর অ্যাসলি ইডেন। ক্লাসে ছাত্ররা মন দিয়ে সাহেবের কথা শুনছে, নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। হঠাৎ ইডেন সাহেব খেয়াল করলেন প্রায় পিছনের দিকের বেঞ্চিতে বসা একটি ছেলে তাঁর কোনও কথাই শুনছে না, মাথা নিচু করে আপন মনে সে কিছু একটা করছে। শিক্ষকমশাইরা তো ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, না জানি সাহেব কী মনে করবেন। সন্তর্পণে ইডেন ছেলেটির কাছে এসে দেখলেন তাঁর খাতায় একটি প্রতিকৃতি এঁকেছে সে। পেনসিল স্কেচে খাতার বুকে জ্বলজ্বল করছে স্যর অ্যাসলি ইডেনের পোর্ট্রেট। খুব খুশি হলেন সাহেব। উপেন্দ্রকিশোরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বিশেষ উৎসাহিত করে বললেন, “আঁকা কখনও ছেড়ো না। এটাই চালিয়ে যেয়ো তুমি।” ‘ছবি আঁকিয়ে’ উপেন্দ্রকিশোরকে স্মৃতিকথায় তুলে এনেছেন পুত্র সুবিমল রায় – “ছেলেবেলায় আমরা তাঁর সঙ্গে দার্জিলিং গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম যে বাবা ছবি আঁকতে আঁকতে মধ্যে মধ্যে পিছিয়ে এসে শান্তভাবে ছবিটার দোষ-গুণ দেখছেন, আবার এগিয়ে ছবির কাছে গিয়ে দরকার বুঝে কয়েকটা দাগ বা টান বা একটু তুলির কারুকার্য জুড়ে দিয়ে ছবিটাকে আরো সুন্দর করে তুলছেন। ছবির চেয়ে বাবার সেই চেহারাটাই বেশী মনে পড়ে— কী শান্ত, সজীব আনন্দময় সে চেহারা। গিরিডিতে শালবনের দিকে তাকিয়ে তিনি যখন ছবি আঁকতেন তখন তাঁকে দেখে মনে হত যেন তপোবনের একজন মুনি।” উপেন্দ্রকিশোরের ছবিকে আক্রমণ করেছিলেন এক দল সমালোচক। তাঁদের কথায় এই সব ছবি ‘মেকী এবং বিদেশীর অনুকরণে অঙ্কিত’। উপেন্দ্রকিশোর কোনও প্রতিবাদ করেননি। মৃদু হাসির সঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল – “শিল্পের জগৎ খুব বড় ও মহৎ।” স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। উপেন্দ্রকিশোরের সহপাঠী সেখানে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। পরে যিনি পরিচিত হন ‘বাংলার বাঘ’ নামে। আশুতোষ চমৎকার ‘নোটস্’ তৈরি করতেন। তার জন্য অন্য ছেলেরা তাঁকে ভারী জ্বালাতন করত। ক্রমাগত সেই ‘নোটস্’ চেয়ে নিয়ে যেত, তাঁর নিজের দরকারে তিনি পেতেন না। আশুতোষ তাই চুপিচুপি উপেন্দ্রকিশোরের কাছে নোটের খাতা রেখে দিয়ে বলতেন, “তুমি তো এ সব পড় না বলেই সবাই জানে, তোমার কাছে থাকলে কেউ খোঁজ পাবে না।” উপেন্দ্রকিশোর যত্ন করে রেখে দিতেন সেই খাতা, কোনও দিন খুলে দেখবারও প্রয়োজন বোধ করেননি।
একবার গোটা মসুয়া গ্রাম জুড়ে রটে গেল কলকাতায় গিয়ে উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন। অবশ্য এমন রটনার কারণও ছিল। ময়নমনসিংহ জেলা স্কুলে পড়বার সময়েই উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলেন। শরৎচন্দ্র রায় ছিলেন ময়মনসিংহের খ্যাতনামা ব্রাহ্ম। তিনি গগনেন্দ্র হোমকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রিয় বন্ধু উপেন্দ্রকিশোরকে ব্রাহ্মসমাজে নিয়ে আসতে হবে। এ দিকে বাড়ি থেকে উপেন্দ্রকিশোরকে বলা হয়েছে, ব্রাহ্ম মনোভাবাপন্ন গগনের সঙ্গে সে যেন কখনওই না মেলামেশা করে। অথচ উপেন্দ্রকিশোর তাঁর সঙ্গেই বেশি মিশতেন।কলকাতায় পড়তে এসে উপেন্দ্রকিশোর কলুটোলার কাছে এক মেসবাড়িতে কিছু দিন থেকে চলে এলেন সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে। সেটি আবার এক রকম ব্রাহ্ম-মেস। গগনচন্দ্র হোমও এখানে থাকতেন। গগনচন্দ্র ‘জীবনস্মৃতি’–তে লিখছেন, ‘‘বাড়ি ভাড়া করিয়া সকলে একত্রিত হইলাম। উপেন্দ্রকিশোর, হেমেন্দ্রমোহন বসু, প্রমদাচরণ সেন, মথুরানাথ নন্দী, কালীপ্রসন্ন দাস এবং আরও কতিপয় ব্রাহ্মধর্মে অনুরাগী যুবক সেখানে জুটিলেন। … ৫০ নং সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট শীঘ্রই এক ব্রাহ্ম কেল্লা হইয়া উঠিল।’’ রটনা শুনে বিচলিত পালকপিতা হরিকিশোর। পুত্রকে চরমপত্র দিলেন তিনি – ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর সম্পত্তির কণামাত্র পাবেন না। তাতেও ছেলেকে টলানো গেল না! ব্রাহ্মধর্মেই দীক্ষা নিলেন উপেন্দ্রকিশোর। ক্ষুব্ধ হরিকিশোর তাঁর সম্পত্তির মাত্র এক–চতুর্থাংশ দিলেন দত্তকপুত্রকে। হরিকিশোরের মৃত্যুর পর অবশ্য এই উইল ছিঁড়ে ফেলেন তাঁর স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী। পুত্রদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেন সম্পত্তি।
কলকাতায় উপেন্দ্রকিশোর–গগন হোমদের ব্রাহ্মধর্মের নেতা ছিলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখী দেবীকে বিয়ে করলেন উপেন্দ্রকিশোর। এর পর সপরিবার বাস করতে লাগলেন ১৩ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ‘লাহাবাবুদের বাড়ি’-তে। স্ত্রী কাদম্বিনীকে নিয়ে তিন তলায় থাকতেন দ্বারকানাথ। কাদম্বিনী দেবী ছিলেন আবার প্রথম ভারতীয় মহিলা চিকিৎসক। দোতলায় কয়েকটি ঘর নিয়ে থাকতেন উপেন্দ্রকিশোর। তাঁর ছোট দুই ভাই, বিধুমুখীর প্রতিবন্ধী ভাই সতীশচন্দ্র, বিধুমুখীর এক অবিবাহিত মামাবাবু এবং নানা প্রয়োজনে কলকাতায় আসা আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই থাকেন উপেন্দ্রকিশোরের সংসারে। তাছাড়া ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রথম পাঁচ জনেরই জন্ম এই বাড়িতে। বাড়িটির বিরাট ছাদে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করত। সন্ধেবেলা পড়াশোনার শেষে গল্প শুনত। ১৩ নম্বরের অন্যান্য বাসিন্দাদের কাছেও উপেন্দ্রর ছেলেমেয়েদের অবাধ যাতায়াত। তিন তলার একটি ঘরে ছিল ওষুধপত্র, আর একটি কঙ্কাল। ডাঃ কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই ঘরটিকে ছেলেমেয়েরা বলত ‘কঙ্কালের ঘর’।
বাড়িতে গৃহশিক্ষক আসতেন, কিন্তু ছেলেমেয়েদের সব থেকে ভাল লাগত উপেন্দ্রকিশোরের পড়া বোঝানো। ধীর স্থির উপেন্দ্রকিশোর নানা বিষয় সহজ–সরল করে বুঝিয়ে দিতেন। বড়রাও অনেকে দরজার ও পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনতেন সেই পড়া বোঝানো। নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পর্কটি ছিল ভারী অদ্ভুত। একবার মেয়ে সুখলতার খুব অসুখ করল। তীব্র যন্ত্রণা। ঘুম নেই চোখে। ঘুমের ওষুধেও কাজ হয় না। মেয়ের এই কষ্ট দেখে সব বাবা–মা উদ্বিগ্ন হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর এতটুকু বিচলিত না হয়ে, শান্ত মনে মেয়ের পাশে বসলেন। হাতে বেহালা নিয়ে একমনে বাজাতে লাগলেন। সুখলতা বাজনা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল। ‘সুখলতা’, ‘সুকুমার’, ‘পুণ্যলতা’, ‘সুবিনয়’, ‘শান্তিলতা’ এবং ‘সুবিমল’ – তিন কন্যা ও তিন পুত্রের পড়াশোনা, ছবি আঁকা, গান–বাজনার প্রতি পিতা উপেন্দ্রকিশোরের ছিল সজাগ দৃষ্টি। তবে সেখানে জোর–জবরদস্তি বা কড়া চোখরাঙানির কোনও জায়গাই ছিল না। ছবি আঁকতে উৎসাহ দিতেন। বাড়ি বয়ে আঁকবার সরঞ্জাম এনে দিতেন। আবার, ‘সুকুমার’ বিলেত যাবেন, তার জন্য উপেন্দ্রকিশোর কী না করেছিলেন! ছেলেকে টাই বাঁধা, কলার পরা শিখতে পর্যন্ত সাহায্য করেছিলেন বাবা। শুধু স্নেহময় পিতা নয়, আচার-আচরণে উপেন্দ্রকিশোর এক্বেবারে যেন সেকেলে বাড়ির বড় কর্তাটি ছিলেন। প্রতিবছর কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতেন। সদলবলে। খুড়তুতো-পিসতুতো ভাইবোন এবং স্বজন–পরিজন মিলিয়ে সে বিরাট দল! যাওয়ার জায়গাগুলি ছিল ‘মসুয়ায় দেশের বাড়ি’ কিংবা ‘পুরী’, ‘দার্জিলিং’, ‘চুনার’, ‘মধুপুর’। যেখানেই যেতেন বাড়ি ভাড়া করে সেখানে উঠতেন। দেশের বাড়ি ময়মনসিংহ যেতে প্রায় দু–দিন লেগে যেত। এ নিয়ে ‘পুণ্যলতা’ লিখেছিলেন, ‘‘রাত্রে শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনে চড়ে সকালবেলায় গোয়ালন্দে স্টিমার ধরতাম। বিকেলের দিকে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে ট্রেনে উঠতাম। রাতদুপুরে কাওরাইদ স্টেশনে নেমে নৌকায় চড়তে হতো। কাছাকাছি গভীর জঙ্গল। স্টেশন থেকে নদীর ঘাট পর্যন্ত রাস্তায় শুনতাম নাকি ‘ভয় আছে’। আলো নিয়ে, লম্বা লম্বা লাঠি হাতে, অনেক লোকজন সঙ্গে থাকত— ঘুমচোখে গিয়ে আবার নৌকার মধ্যে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়তাম। নৌকা যখন গিয়ে ঘাটে লাগত, তখনও বাড়ি অনেক দূর। ঘাটে হাতি, পাল্কি–ডুলি অপেক্ষা করত। বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হতো, কারা যেন শাঁখ বাজাত। ঠাকুরমা, পিসিমারা এগিয়ে এসে আমাদের আদর করে ঘরে নিয়ে যেতেন।’’ বেড়াতে গিয়ে উপেন্দ্রর অনেক ক’টি স্মৃতিই বেশ বিচিত্র রকমের। গিরিডির বারগেন্ডার কাহিনিটি বলা যাক। হাওয়াবদলের জন্য গিয়েছেন উপেন্দ্রকিশোর। উঠেছেন নানুবাবুর ‘নর্থ ভিউ’ বাড়িটায়। বিখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকারের ছোট ভাই এই নানুবাবু। উপেন্দ্রকিশোর এলে এখানকার ছেলেমেয়েদের আনন্দের সীমা থাকে না। জেঠু তাদের বেড়াতে নিয়ে যাবেন। চড়ুইভাতি হবে। দেশ–বিদেশের গল্প, রামায়ণ–মহাভারতের গল্প বলবেন। নদীর ধারে সবাইকে জড়ো করে রাতের আকাশের দিকে আঙুল তুলে গ্রহ–নক্ষত্র চেনাবেন – কোনটি কালপুরুষ, কোনটি সপ্তর্ষিমণ্ডল। উশ্রী নদীর বুকে যে চরা পড়েছিল, সেখানে অনেক রকমের খেলাধুলো হত বিকেলবেলা। তার মধ্যে একটি সবার খুব প্রিয় – যষ্টিহরণ – লাঠি চুরি করা। লাঠিটা জেঠামশাইয়েরই। কুড়ি–পঁচিশ হাতের একটা চক্র করা হতো বালির উপর দাগ কেটে, তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে পুঁতে রাখা হতো লাঠিটা। একজন থাকবে পাহারাওয়ালা, সে লাঠিটা পাহারা দেবে, অন্য সবাই চেষ্টা করবে লাঠিটা চুরি করে আনতে। আনতে পারলে পাহারাওয়ালার হবে শাস্তি। বিচারকের ভূমিকায় নিজেই থাকতেন উপেন্দ্রকিশোর। শাস্তিও ছিল খুব মজার – ষোলোবার জোরে জোরে লাফাতে হবে। দলের মধ্যে ছিল তেরো–চোদ্দো বছরের কয়েকজন মেয়ে। তারা লাফাতে লজ্জা পেত। তাদের শাস্তি ছিল একটা গান গাওয়া। ছোটদের সঙ্গে মেলামেশাতে উপেন্দ্র ছিলেন দড়। এমনকী ইউ রায় অ্যান্ড সন্সের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করেও তাঁর ছিল সেই শিশু-কাতরতা। আর ‘সন্দেশ’ পত্রিকাটিও তারই ফল।
মুদ্রণ শিল্পে উপেন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্য যে কী পর্যায়ের ছিল, বোঝাতে দু’-একটি কথা জানানো যাক। সেকালের মুদ্রণজগতের লোকের কাছে ‘পেনরোজ’ পত্রিকা ছিল বাইবেলের মতো। এই পত্রিকায় ১৮৯৭ থেকে ১৯১২–র মধ্যে উপেন্দ্রকিশোরের নয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। যার বিষয় ছিল ‘ছবি মুদ্রণ’। এরপরে ‘ইউ. রায়’ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ক্রমশই বড় হতে লাগল। এ বার প্রয়োজন একটা বড় বাড়ির। ১৯০১–এ উপেন্দ্রকিশোর চলে এলেন ২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে। বাড়ির একতলার সামনের অংশে অফিস, প্রেস, ছবি বানানোর নানারকম রাসায়নিক। মাঝখানে উঠোন, তার পশ্চিম ধারে ফটোগ্রাফির ডার্করুম আর উপরে যাবার সিঁড়ি। পিছনের অংশে খাবার ঘর, চাকরবাকরদের থাকবার ঘর, রান্নাঘর, উঠোন, স্নানের ঘর। ছাদের উত্তর অংশে কাচের ছাদওয়ালা স্টুডিয়ো। মেঘলা দিনে আর রাতে ছবির কাজ চালাবার জন্য আনা হয়েছিল বড় বড় আর্কল্যাম্প।।আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শিবনাথ শাস্ত্রী সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে এসেছেন নানা সময়ে। আর আসতেন কুন্তলীন–খ্যাত এইচ বোস বা হেমেন্দ্রমোহন বসু। এমনকী রবীন্দ্রনাথও। উপেন্দ্র-পুত্র সুবিমল রায়ের স্মৃতিচারণায় তার একটি বর্ণনা, “রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪০/৪১ বছর হবে। বাবা তাঁকে আগে থেকেই চিনতেন। রবীন্দ্রনাথের তখন কালো চুল, কালো দাড়ি। তিনি বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন, আর আমি অনেক দূরে দাঁড়িয়ে একটু দেখছিলাম। তিনি বাবার বেহালা শুনতে বড় ভালবাসতেন।”
ছোটদের প্রতি উপেন্দ্র ছিলেন উদার। কোমলমনা। কিন্তু নিজের বিশ্বাসে ছিলেন কঠোরপন্থী। পালকপিতা হরিকিশোর রায় মারা যাওয়ার সময়ের কথা। কিছুতেই শ্রাদ্ধশান্তি তিনি করবেন না, জানিয়ে দিলেন উপেন্দ্রকিশোর। তখন তাঁর বয়স কুড়ি। তবু নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজের নেতার শ্রাদ্ধে যত রকম আয়োজন, সমারোহ, দানধ্যান করা যায়, সবরকম ব্যবস্থা হল। শ্রাদ্ধের দিন নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা আসতে শুরু করেছেন। অনুষ্ঠান বাড়ি লোকে লোকারণ্য। এমন সময় যুবক উপেন্দ্রকিশোর বলে বসলেন, “আমি প্রচলিত দেশাচার–মতে পিতৃশ্রাদ্ধ করব না।” অনুষ্ঠান বাড়িতে যেন বজ্রপাত। আত্মীয়স্বজনেরা ক্ষুব্ধ। সমাজ তাঁর নিন্দায় সরব। এমন পাপাচারের শাস্তি কী হওয়া উচিত, কথা উঠল তা নিয়েও। তবু উপেন্দ্রকিশোরকে টলানো গেল না। তিনি কিছুতেই পিতৃশ্রাদ্ধ করলেন না।
রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে উপেন্দ্রকিশোর বরাবর দূরে থাকলেও ব্যতিক্রম ঘটেছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়। স্বদেশি আন্দোলনের প্রবল জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলেন তিনিও। ১৯০৫ সাল, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে গান। মস্ত বড় শোভাযাত্রা, নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথ। সবাই গাইছেন ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’। খোল বাজাচ্ছেন দীনু ঠাকুর। বেহালা নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর যোগ দিলেন সেই শোভাযাত্রায়। টাউন হলের ঐতিহাসিক অধিবেশনেও রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সঙ্গে বেহালা বাজিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। পুণ্যলতা লিখেছিলেন, ‘‘বাবার বেহালা বাজনার প্রতি তিনি (রবীন্দ্রনাথ) অনুরাগী ছিলেন। প্রতি বৎসর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে উৎসবের সময় বাবাকে রবীন্দ্রনাথের নতুন গানের সঙ্গে বেহালা বাজাতে হত।’’ দ্বারকানাথ ঘোষের ‘ডোয়ার্কিন’ থেকে উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গীতশিক্ষা বিষয়ক দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল – ‘শিক্ষক ব্যতিরেকে হারমোনিয়াম শিক্ষা’ এবং ‘বেহালা শিক্ষা’। প্রথম বইটি যে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল তার প্রমাণ বইটির আরও দুটি সংস্করণ। অথচ উপেন্দ্রকিশোর এর প্রকাশ বন্ধ করে দেন, কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল হারমোনিয়াম সহযোগে গান ভারতীয় সঙ্গীতের পক্ষে ক্ষতিকর। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয় এ এইচ ফক্স স্ট্র্যাংওয়েসের ‘মিউজ়িক অব হিন্দুস্তান’ বইটি। এই বইয়ের জন্য উপেন্দ্রকিশোর প্রচলিত ও জনপ্রিয় কয়েকটি রাগের ইংরেজি পরিচিতি লেখেন এবং রবীন্দ্রনাথের তিনটি গানের অনুবাদ করেন। এ ছাড়াও তিনি নানা প্রয়োজনে প্রিয় বন্ধু রবীন্দ্রনাথের বারোটি গানের স্বরলিপিও তৈরি করেছিলেন। গানবাজনার বিষয়ে তাঁর কোনও ক্লান্তি ছিল না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। বেহালা, হারমোনিয়াম ছাড়াও বাজাতেন সেতার, পাখোয়াজ, বাঁশি। ছয়টি ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। তাঁর লেখা ‘জাগো পুরবাসী’ গানটি ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনায়, খ্রিস্টানদের ধর্মোৎসবেও গাওয়া হত। বড় বড় সভা-সমিতি ও সঙ্গীত সম্মেলনে তাঁর গুরুত্ব ছিল, ছোটখাটো নানা অনুষ্ঠানেও তাঁকে অনুরোধ করে কেউ কোনও দিন নিরাশ হননি। পুণ্যলতা জানিয়েছিলেন, ‘‘আমাদের রোজ নিয়ম মতো বাবা গান বাজনা শেখাতেন, তাছাড়া কত যে তাঁর ছাত্রছাত্রী এসে জুটতো! তার উপরে ছিল মন্দিরে উৎসবের গান, স্কুলের প্রাইজের গান, কত বিয়ে ও সভা-সমিতির গান।’’ গান শিখতে বা সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে বিচিত্র লোকসমাগম হত রায়চৌধুরী বাড়িতে। এক মার্কিন যুবক, উপেন্দ্রকিশোরের ছাত্র, মেঘমন্দ্র গম্ভীর স্বরে গাইছেন ‘প্রোভাটে বিমলো আননডে’ (প্রভাতে বিমল আনন্দে), বা সিকিমের এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, মিহি মোলায়েম গলা, সুরটাও ধরেছেন ঠিকঠাক; কিন্তু ‘তা–তা–থৈ–থৈ’ কিছুতেই মুখে আসছে না। ‘তা–তা–তৈ–তৈ’ বা ‘দা–দা–দৈ–দৈ’ হয়ে যাচ্ছে। শীতকালে গড়পারের বাড়ির লাইব্রেরি ঘরে অনেক লোক জড়ো হয়েছেন। সন্ধ্যাবেলা, কাঁপুনি দেওয়া ঠান্ডা। তারই মধ্যে কংগ্রেসের গানের রিহার্সাল শুরু হল – ‘চল রে চল সবে ভারতসন্তান’। সঙ্গে অর্গান, বেহালা বাজছে, সারা বাড়িটা যেন গমগম করছে। ‘বিছানায় শুয়ে ‘এক মন্ত্রে কর জপ, এক তন্ত্রে তপ’ শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, কত রাত অবধি গান চলেছে, কিছুই জানি না।’ ছেলেবেলার স্মৃতিচারণে মণিমুক্তো তুলে এনেছিলেন পুণ্যলতা।
স্বজন-পরিজনদের নিয়ে বছরে অন্তত এক বার ঘুরতে যেতেন। ময়মনসিংহের মসুয়ায় দেশের বাড়ি ছাড়াও গন্তব্য হত পুরী, দার্জিলিং, চুনার বা মধুপুর। এই নিয়ে তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনি ‘পুরী’, ‘আবার পুরী’ ছাপা হয়েছিল শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’ পত্রিকায়। বেড়াতে গিয়ে জলরঙে বা তেলরঙে ছবি এঁকেছেন। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ আর ‘চুণার দুর্গ’ ভ্রমণ-পর্বের দুটি বিখ্যাত ছবি। শেষের ছবিটি উপহার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। ১৩০৭ বঙ্গাব্দে শিলাইদহে বেড়াতে গিয়ে যতীন্দ্রনাথ বসু রবীন্দ্রনাথের পড়ার ঘরে চুনার দুর্গের ছবিটি দেওয়ালে টাঙানো দেখেছিলেন। ছোটদের জন্য রবীন্দ্রনাথ যুক্তাক্ষর বর্জিত কবিতা ‘নদী’ প্রকাশ করলে উপেন্দ্রকিশোর সাদা-কালোয় এই বইটির জন্য সাতটি ছবি এঁকেছিলেন। একবার এক নিমন্ত্রণবাড়ির ঘটনা। ঠাকুর খাবার পরিবেশন করছে, কর্তা দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন। গণ্যমান্যদের খুব খাতির, গরিব লোকেদের কেউ যত্ন-আদর করছে না। ঠাকুরকে সদ্য-ভাজা লুচি ঝুড়িতে নিয়ে ‘গরম লুচি! গরম লুচি!’ বলতে বলতে এগিয়ে আসতে দেখে এক গরিব মানুষ বললেন, “ঠাকুর, আমাকে দু’খানা গরম লুচি দাও।” কর্তা গম্ভীর ভাবে বললেন, “পাতের ঠান্ডা লুচিগুলো ফেলে দেবেন না যেন!” বলেই উপেন্দ্রকিশোরের কাছে এসে খুব খাতির করে বললেন, “আপনাকে দু’খানা গরম লুচি দিক?” উপেন্দ্রকিশোর বিনয়ী উত্তর, “কিন্তু আমার পাতের ঠান্ডা লুচি যে এখনও ফুরোয়নি।” শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল গৃহকর্তার মুখ। এরপরে দ্রুত পেরিয়ে গিয়েছিল চল্লিশটি বছর।
‘সন্দেশে’র কথায় ফিরে আসা যাক। বিলেত থেকে প্রসেস ক্যামেরা ও ছাপাখানার অন্যান্য সরঞ্জাম আনিয়ে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩৮/১ শিবনারায়ণ দাস লেনে উপেন্দ্রকিশোর ‘ইউ. রায়’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। এখানেই শুরু হয় তার হাফটোন ব্লক তৈরির কাজ। স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ১৯০১ সাল নাগাদ ২২নং সুকিয়া স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয় সংস্থাটি। পরে ১৯১০ সালে সুকুমার রায় সক্রিয় ভাবে কাজে যোগদান করলে প্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে ‘ইউ. রায়. এন্ড সন্স’ রাখা হয়। শুধু ব্লক তৈরি নয়, প্রকাশনার কাজও এখানে হত। শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোরের বহু দিনের লালিত বাসনা বাস্তবায়িত হবার মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে। ‘সন্দেশে’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩২০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে (১৯১৩ খ্রীঃ)। প্রথম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া ফেলে দেয় ‘সন্দেশ’। ‘সন্দেশ’ যখন বেরোয়, উপেন্দ্রকিশোরের ভ্রাতা প্রমদারঞ্জনের কন্যা লীলা রায় (পরে যিনি লীলা মজুমদার নামে খ্যাত হয়েছেন) তখন বছর পাঁচেকের শিশু। পরবর্তী কালে তিনি তাঁর সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন – “সন্দেশ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি হাতে করে উপেন্দ্রকিশোর ২২নং সুকিয়া স্ট্রিটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসে বসবার ঘরের দরজার কাছে হাসিমুখে দাঁড়ালেন। অমনি ঘরময় একটা আনন্দের সাড়া পড়ে গেল। সেই সময় সেই ঘরে যে ক’জন মানুষের উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল, তারা কেউই বোধ হয় জীবনে কখনো সে সন্ধ্যার কথা ভুলতে পারবে না। সন্দেশের প্রকাশন শিশুসাহিত্যের জগতে একটা নতুন দিনের উদ্বোধন করে দিয়েছিল। হঠাৎ যেন একদিনের মধ্যে বাঙ্গালার শিশুসাহিত্যের সমস্ত দৈন্য ঘুচে গিয়ে সে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠল।” ‘সন্দেশ’ যে শিশুচিত্তে কতখানি আলোড়ন তুলেছিল তার আর একটি পরিচয়্ পাওয়া যায় কবি সুনির্মল রায়ের স্মৃতি চারণায় – “স্কুলে পড়াশোনায় মন লাগল না, কখন বাড়ি যাব আর ‘সন্দেশ’ পড়ব এই চিন্তা। বাড়ি ফিরে এসে ‘সন্দেশ’-এর মধ্যে ডুবে গেলাম। আর এত অদ্ভুত বইয়ের কথা তো ধারণাই করতে পারি নি, কি সুন্দর গল্প, কবিতা, ধাঁধা, আমায় যেন এক নতুন রাজ্যে নিয়ে গেল। প্রতি সংখ্যার প্রথমেই রঙিন ছবি আর ভিতরে গল্পের সঙ্গে, কবিতার সঙ্গে সব মজার মজার টুকরো ছবি, প্রতি ছবির ভিতর শিল্পীর নাম U.R. লেখা। ইনি যে উপেন্দ্রকিশোর রায় তা আর বুঝতে দেরি হল না-কারণ তাঁর আঁকা ছবি আগেও দেখেছি। এই ‘সন্দেশ’ আমার জীবনে একটা রঙিন আনন্দময় যুগ নিয়ে এল। প্রতি মাসের পয়লা তারিখে ডাকের পথ চেয়ে থাকতাম – আমাদের লোক ভোরবেলা (গিরিডির) ডাকঘরে গিয়ে চিঠি নিয়ে আসত, ‘সন্দেশ’ যদি পয়লা তারিখে তার হাতে না দেখতাম মুখ শুকিয়ে যেত। তার পরদিন আবার আকুল হয়ে প্রতীক্ষা করতাম, দূর থেকে লক্ষ করতাম লোকটার হাতে অন্যান্য চিঠিপত্রের মধ্যে উঁচু হয়ে আছে ‘সন্দেশ’-এর বাদামী মোড়ক – আনন্দে প্রাণ নেচে উঠত।”
‘সন্দেশে’র লেখকরা কোন পারিশ্রমিক নিতেন না এবং সূচীপত্রে বা রচনার শেষে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লেখকের নাম ছাপা হত না। অন্যান্য বহু পত্রিকার প্রথম সংখ্যার শুরুতেই সাধারণত: যে গুরুগম্ভীর ভাবে পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়, ‘সন্দেশে’র ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নি। বরং একটি হাস্য রসের কাহিনী দিয়ে শুরু করে পরিশেষে বলা হয়েছে – “আমরা যে সন্দেশ খাই, তাহার দুটি গুণ আছে। উহা খাইতে ভাল লাগে, আর উহাতে শরীরে বল হয়। আমাদের এই যে পত্রিকাখানি ‘সন্দেশ’ নাম লইয়া সকলের নিকট উপস্থিত হইতেছে উহাতেও যদি এই দুটি গুণ থাকে – অর্থাৎ উহা পড়িয়া যদি ভাল লাগে আর কিছু উপকার হয়, তবেই ইহার ‘সন্দেশ’ নাম সার্থক হইবে।”
প্রথম সংখ্যা ‘সন্দেশ’ শুরু হয়েছিল একটি কবিতা দিয়ে, লেখিকা শ্রীজ্যোতির্ম্ময়ী দেবী বি.এ.। এর পর ছিল – ‘সন্দেশের কথা’, ‘পৃথিবীর পিতা’ (পৌরাণিক, আখ্যায়িকা), ‘উত্তর আর দক্ষিণ’, ‘প্রথম কবি ও প্রথম কাব্য’, ‘শিশু’, ‘চাঙ’, ‘কথাবার্ত্তা’, ‘পাখীর গান’ (স্বরলিপি সহ গান), ‘শিশুদের গল্প-নূতন পয়সা আর পুরানো পয়সা’, ‘সংবাদ’। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল বত্রিশ। জ্যোতির্ম্ময়ী দেবীর প্রথম কবিতাটি ছিল –
“নূতন বরষে ভাই আমাদের ঘরে,
‘সন্দেশ’ এসেছে আজ নব সাজ প’রে।
ডাকিয়া লইব তারে আদরে সবাই,
হাসিমুখে ত্বরা করে আয় তোরা ভাই।
সরল হৃদয় তার, মধুর বচন,
শুনিব তাহার মুখে সন্দেশ নূতন।
বিভুর আশীষ বাণী তাহার মাথায়,
চাহিয়া লইব সবে, আয় তবে আয়।
এ নব সন্দেশ যেন বরষ বরষ,
জাগায় নবীন আশা, নূতন হরষ।
শুনায় নূতন বাণী, আনে নব কাজ,
কল্যাণে পুলক ভরা, – এই চাহি আজ।”
প্রথম সংখ্যায় কোন ধাঁধা ছিল না, কিন্তু দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে ‘নূতন ধাঁধা’ বিভাগটি যুক্ত হয়। পরের সংখ্যায় আগের ধাঁধার উত্তর দেওয়া হত। পত্রিকায় লেখা থাকত –
“কলিকাতা ৬৪/১নং সুকিয়া ষ্ট্রীট, লক্ষ্মী প্রিন্টিং ওয়ার্কস হইতে শ্রীললিতমোহন গুপ্ত কর্ত্তৃক মুদ্রিত ও ২২নং সুকিয়া ষ্ট্রীট সন্দেশ কার্য্যালয় হইতে শ্রীললিতমোহন গুপ্ত কর্ত্তৃক প্রকাশিত।”
‘সন্দেশে’র মান অক্ষুণ্ণ রাখতে উপেন্দ্রকিশোরকে বিরামহীন ভাবে লিখতে হয়েছিল। কঠিন ও জটিল বিষয়কে সহজ করে পরিবেশন করার অসাধারণ ক্ষমতার জন্য ‘সন্দেশ’ ছোটদের মনের মত হয়ে উঠেছিল। উপেন্দ্রকিশোরের লেখা গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘গুপী গাইন’, ‘ঝানু চোর চানু’, ‘জোলা আর সাত ভূত’, ‘কুঁজো আর ভূত’ ইত্যাদি। আর রয়েছে পুরাণের গল্প – ‘পৃথিবীর পিতা’, ‘ত্রিপুর’, ‘মহিষাসুর’, ‘শুম্ভ নিশুম্ভ’, ‘গণেশ’, ‘গণেশের বিবাহ’, ‘অগস্ত্য’, ‘গঙ্গা আনিবার কথা’। বন্য প্রাণী ও জীবজন্তু নিয়েও তাঁর লেখা কম নয়। প্রথম বর্ষেরই আষাঢ় সংখ্যায় ছাপা হয়েছে ‘বাঘের গল্প’, কার্তিক মাসে ‘সুন্দরবনের জানোয়ার’, মাঘ ও ফাল্গুনে যথাক্রমে ‘মাকড়সা’ ও ‘শুকপাখী’ এবং চৈত্রে বেরিয়েছিল ‘সাপের খাওয়া’ নামক নিবন্ধে চিত্র সহ নানা তথ্য। একটা অজগর আস্ত ছাগল গিলে খাবার পর স্ফীত অজগরের নিঁখুত ছবি নিশ্চয়ই ছোটদের কাছে আকর্ষণীয় হয়েছিল। উপেন্দ্রকিশোরকে তো বিপুল পরিমাণ লেখা লিখতেই হয়েছিল, তবে তাঁর প্রেরণায় পরিবারের অনেকেই কলম ধরেছিলেন তাঁকে সাহায্য করতে। ভাই কুলদারঞ্জন অনুবাদক হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, জুল ভার্ন ও এইচ.জি. ওয়েলসের লেখা সম্ভবতঃ তিনিই প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন। প্রথম বর্ষের কার্তিক সংখ্যা থেকে ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হয়েছিল তাঁর অনুবাদ করা ‘রবিনহুড’। আর এক ভাই প্রমদারঞ্জন ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি করতেন সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায়। জরিপের কাজে তাঁকে অনেক দুর্গম স্থানে যেতে হত এবং সে সঙ্গেই তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমেছিল জঙ্গল ও বন্য প্রাণীদের নানা খবর। তিনি ‘বনের খবর’ নাম দিয়ে সে সব দুর্গম প্রদেশের রোমাঞ্চকর কাহিনী ‘সন্দেশে’র পাঠকদের উপহার দিয়েছিলেন ‘বনের খবর’ শীর্ষক গল্পে। ধারাবাহিক ভাবে এটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম বর্ষের শ্রাবণ সংখ্যা থেকে।
১৯১১ সালের ৭ই অক্টোবর লন্ডন ও ম্যাঞ্চেস্টারে মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য সুকুমার রায় ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বৃত্তি’ নিয়ে বিলাত চলে যান। সে কারণে তিনি ‘সন্দেশে’র প্রথম দিকের সংখ্যায় তাঁর লেখা প্রকাশ করতে পারেন নি। ‘সন্দেশে’ তাঁর প্রথম আবির্ভাব ১৩২০-র শ্রাবণ সংখ্যায়, অবশ্য লেখক হিসাবে নয়, চিত্রকর হিসাবে। হাস্যরসস্রষ্টা লেখক বন্ধু কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ও তখন বিলাতে। তাঁর লেখা বিখ্যাত হাসির গল্প ‘ভবম হাজাম’-এর জন্য বিলাত থেকেই মজার ছবি এঁকে পাঠান সুকুমার। S.R. প্রতীকটি ছিল তাঁরই নামের সূচক। এখানেই সুকুমার রবীন্দ্রনাথের হাতে ‘সন্দেশ’ তুলে দেন। রবীন্দ্রনাথ পত্রিকার প্রশংসা করেন এবং লেখা দেবেন বলেন। কিন্তু নানা কারণে উপেন্দ্রকিশোর সম্পাদক থাকাকালীন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘সন্দেশে’ বেরোয় নি। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে সুকুমার দেশে ফিরে এসে প্রকাশনার কাজে পিতা উপেন্দ্রকিশোরকে নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন। এসময় থেকে পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৩২০-তেই বেরিয়েছিল তাঁর লেখা ‘বেজায় রাগ’ (কবিতা, অগ্রহায়ণ), ‘খোকা ঘুমায়’ (কবিতা, পৌষ), ‘সূক্ষ হিসাব’ (গল্প, মাঘ), ‘ওয়াসিলিসা’ (গল্প, চৈত্র)। তারপরে প্রায় প্রতি মাসেই তার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি চিত্র সহযোগে যে সব মজার কবিতা লিখেছিলেন, সেগুলি ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ‘খিচুড়ি’ (মাঘ ১৩২১), ‘আবোল তাবোল’ ( ফাঃ, চৈঃ ১৩২১), ‘কাতুকুতু বুড়ো’ (জ্যৈষ্ঠ ১৩২২) বা অন্যান্য নামাঙ্কিত হলেও পরে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে সবই ‘আবোল তাবোল’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে একত্রিত হয়ে স্থান পায়। উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারের অনেকেই লিখেছেন ‘সন্দেশে’র জন্য। বড় মেয়ে সুখলতা রাও-ও ছিলেন সে তালিকায়। সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখেছেন – “সন্দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইউ. রায়. এন্ড সন্সের হাউস ম্যাগাজিন।” তবে পরিবারের অনেকে লেখনী ধরলেও বাইরের অনেকের লেখাই পত্রিকায় স্থান পেয়েছিল। এদের মধ্যে রয়েছেন – অবনীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, প্রসন্নময়ী ও প্রিয়ম্বদা দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, কালিদাস রায়, চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, উইলিয়ম পিয়ার্সন, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা, জ্যোতির্ম্ময়ী দেবী, বিজনবালা দাসী প্রভৃতি। বৈশাখ ১৩২০ থেকে পৌষ ১৩২২-মোট তেত্রিশটি সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। পত্রিকাটি মনের মত করে তুলতে উপেন্দ্রকিশোর যত্নের কোন ত্রুটি রাখেন নি।
সন্দেশ পত্রিকার প্রাণপুরুষ উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুতে পত্রিকা কিন্তু বন্ধ হয় নি। সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায় আগেই পত্রিকা প্রকাশনায় পিতাকে নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন, এরপরে তিনি এগিয়ে এসে পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর হাতে ‘সন্দেশ’ যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ১৩২২-এর মাঘ সংখ্যায় ‘স্বর্গীয় উপেন্দ্রকিশোর’ শীর্ষক রচনাটিতে লেখা হয়েছিল – “… ‘সন্দেশের’ পাঠক-পাঠিকাগণ, যে দারুণ শোকসংবাদ বহন করিয়া এই সংখ্যার ‘সন্দেশ’ তোমাদের কাছে যাইতেছে, তোমাদের কোমল হৃদয়ে তাহা নিশ্চয়ই আঘাত দিবে। সন্দেশের সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আর ইহজগতে নাই। যিনি বহু বৎসর ধরিয়া অক্লান্ত পরিশ্রম, অজস্র অর্থব্যয়, অশেষ আদর ও যত্ন করিয়া তোমাদিগের মনোরঞ্জন করিয়াছেন, কত মজার কথা, কত সুন্দর উপদেশ, কেমন রঙ্গিন ছবি পূর্ণ করিয়া মাসে মাসে তোমাদের হাতে সন্দেশ দিয়া তোমাদিগকে সন্তুষ্ট করিতেন এবং তাহাতে নিজে কত না আনন্দ লাভ করিতেন, তোমাদিগের সেই বন্ধু তোমাদিগকে ছাড়িয়া ৪ঠা পৌষ প্রভাতে পরলোকবাসী হইয়াছেন। তোমরা অনেকেই হয় ত তাঁহাকে দেখ নাই, কেহ কেহ হয় ত তাঁর নামও জান না, কিন্তু সকলেই ‘সন্দেশ’ বা অন্যান্য মাসিক পত্রে তাঁর মজার গল্প ও কবিতা পড়িয়াছ, তাঁর হাতে আঁকা ছবি দেখিয়াছ, যেমন ভাবে বলিলে বেশ সহজে তোমরা বুঝিতে পার তেমন ভাবে লিখিত উপদেশ পাইয়াছ। …” পরিশেষে বলা হয়েছিল – “এই সন্দেশ তাঁহার স্মৃতিচিহ্ন হইয়া থাকুক। এখন হইতে যাঁহারা এই কাগজ চালাইবে তাঁহারা যেন তাহারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া, ইহাকে উপযুক্তরূপে পরিচালিত করিতে পারেন, ভগবানের নিকট এই প্রার্থনা করি।” এই ইচ্ছা সফল হয়েছিল। সুকুমার রায়ের সম্পাদনায় পত্রিকার উৎকর্ষর কোন অবনমন ঘটে নি, উপেন্দ্রকিশোরের অনুপস্থিতি কোথাও অনুভূত হয় নি। ‘সন্দেশ’কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে সুকুমার অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন।
হাফটোন ছবি মুদ্রণে স্বশিক্ষিত মানুষটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও সব উদ্ভাবনের পেটেন্ট পাননি। যেমন ৬০ ডিগ্রি ক্রসলাইন স্ক্রিন তৈরি করান উপেন্দ্রকিশোর, আর পেটেন্ট নেন শুলত্জে। অথচ ‘পেনরোজ’ পত্রিকায় এই বৃত্তান্ত যখন লেখেন তিনি, সেখানে কোনও তিক্ততা ছিল না। তাঁর কথায়, কোনও বিশেষ উদ্ভাবনের জন্য কে স্বীকৃতি পেল সেটা বড় কথা নয়। যান্ত্রিক দক্ষতাটা বাড়ল, সেটাই আসল। মুদ্রণের পার্থক্য যেখানে শতকরা এক শতাংশ লোকও বুঝবে কি না সন্দেহ, সেখানেও তিনি পরীক্ষা চালিয়েছেন। তাঁর আনুগত্য ছিল শুধু কাজের প্রতি। আর সেই জন্যেই বোধহয়, মৃত্যুর ঠিক আগেও উপেন্দ্রকিশোর বলতে পেরেছিলেন, “আমার জন্য তোমরা শোক করিও না আমি আনন্দে আছি, আনন্দেই থাকিব।”
(তথ্যসূত্র:
১- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, আনন্দ পাবলিশার্স।
২- সুকুমার সমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স।
৩- সুকুমার, লীলা মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স।
৪- দিনের শেষে, সুবিমল রায়, মৌমিতা প্রকাশনা (২০১৪)।
৫- ছেলেবেলার দিনগুলি, পূণ্যলতা চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স।
৬- The Rays before Satyajit: creativity and modernity in colonial India, Chandak Sengoopta, Oxford University Press (২০১৭)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত