কথায় বলে – ‘‘বাঙালি চায়ের কাপে তুফান তোলে’’! বাঙালির কখনও ‘‘এক কাপ চা’য়ে আমি তোমাকে চাই’’, আবার কখনও বা চায়ের পেয়ালা হাতেই বাঙালির বেদম ‘রাজনীতি’ বা ‘খেলা’ নিয়ে তর্কে মেতে ওঠে। চা বাঙালিকে অচেনা শহরে চিনিয়ে দেয়। কিন্তু বাঙালি ‘চা প্রেমী’ কোনওদিনই ছিল না। ইংরেজরা এই দেশে আসার পরেই বাঙালির রক্তে মিশেছিল চা’য়ের নেশা। চায়ের সঙ্গে বাঙালির প্রথম পরিচয়ের সেই দিনের কথাগুলি এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বিভিন্ন শহরের আনাচে কানাচে। ‘‘গরম চায়ে, চায়ে গরম পাঁচ টাকা বলে’’ ট্রেনের ভিতর খুব পরিচিত ডাক। এই মিষ্টি ডাক শুনলে বাঙালির মনটা চায়ের জন্য ‘চাঁ চাঁ’ করে ওঠে। শীতের সকালে ‘আদা দিয়ে চা’। আর সঙ্গে প্রচুর তর্ক নিয়ে ‘চায়ের কাপে ঝড়’। ব্যস্ততার যুগেও এগুলো এখনও বাঙালির খুব পছন্দের। এমন বাঙালি সংখ্যায় অতি নগন্য যিনি চা পান করেন না। আর যে বাঙালির চা অপছন্দের তাঁর যেন সমাজে ‘একঘরে’ অবস্থা হয়।
অনেক কিছুর মতো চায়ের আবিষ্কার ‘চীন’ দেশেই হয়েছিল। চায়ের ব্যবহার সন্দেহাতীতভাবে ‘চীনে’ই প্রথম শুরু হয়েছিল। চা গাছটি ‘চীন’ ও ‘জাপানে’ জন্মাত। ঐতিহাসিক আমল থেকেই ভারতে চা গাছ ছিল। কিন্তু এ গাছের ‘গুণাগুণ’ সম্পর্কে ভারতীয়রা ‘অজ্ঞ’ ছিল, গাছটি ‘বুনো’ হিসেবেই সবার চোখের আড়ালে রয়ে গিয়েছিল। ‘চীনে’ চায়ের ব্যবহার আবিষ্কার হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। পাঁচ হাজার আগের একটি ‘কাকতালীয় ঘটনা’ই আজকের ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের পর্দার পেছনের কাহিনী, যাকে আমরা বলি ‘ইতিহাস’। ‘সম্রাটদের খামখেয়ালীপনা’র শত গল্পই দেখা যায় এই ইতিহাসের পাতা ওল্টালে, কারো রাজ্য জয়-পরাজয়, কারো অদ্ভূত শখ, বা কারো গভীর প্রেম, সবকিছুই বর্তমানের কোনো না কোনোকিছুতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। তেমনি এক সম্রাট ছিলেন এই ‘শেন নাং’, চায়ের কথা বললে যার নাম বলতেই হয়! মজার ব্যপার হলো ‘চীনা ভাষায়’ ‘শেন নাং’ নামটির অর্থ হলো ‘স্বর্গীয় কৃষক’। ‘শেন নাং’ও যেনো স্বর্গ থেকে ছেনে এনেছিলেন চা নামের প্রিয় পানীয়টি! এর পাঁচ হাজার বছর আগের এই সম্রাট ছিলেন দারুণ ‘স্বাস্থ্যসচেতন’। একবার তিনি ‘ডিক্রী’ চালু করেছিলেন যে তাঁর রাজ্যের প্রজাদের সবাইকে ‘জল ফুটিয়ে পান করতে হবে’। তো একদিন বিকেলে রাজকার্যের ক্লান্তি দূর করার জন্য ‘ক্যামেলিয়া গাছের’ নিচে বসে সম্রাট ‘ফুটানো গরম জল পান’ করছিলেন, কোত্থেকে যেন তার গরম জলের পাত্রে এসে পড়েছিল কয়েকটি অচেনা পাতা! পাতাগুলো জল থেকে বের করার আগেই তার নির্যাস মিশে যেতে শুরু হয়েছিল জলের সাথে আর ভোজবাজির মত পাল্টে গিয়েছিল জলের রং! কৌতূহলী সম্রাট ‘শেন নাং’ ভেবেছিলেন এ নির্যাসও একবার পান করে দেখে নেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ, ‘নির্যাসমিশ্রিত সেই জল’ পান করার পর নিজেকে অন্যদিনের চাইতে অনেক বেশি চনমনে লেগেছিল তাঁর! ঘুম ঘুম ভাব কেটে গিয়েছিল, ক্লান্তি দূর হয়েছিল আর সম্রাটও নতুন স্বাদ পেয়ে খুশি হয়েছিলেন! এরপর অনেক খুঁজেটুজে পাওয়া গিয়েছিল পাতাটির উৎস- ‘ক্যামেলিয়া সিনেনসিস’ গাছ। ইংরেজি ‘টি’ শব্দটির উৎস ‘চীনা ভাষা’। ‘চীনা ভাষায়’ ‘তেতো গুল্ম’কে বলা হতো ‘টেয়’, এই শব্দটি থেকেই ইংরেজি ‘টি’ শব্দের উদ্ভব। আর ‘জাপানি’রা একে বলত ‘চিয়া’; যা থেকে এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত ‘চা’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে। সেই শুরু থেকে ‘চীনা’রা করে আসছেন ‘চায়ের পৃষ্টপোষকতা’, এক ‘চীনা মনিষী’ ‘লাওৎ’ সে চাকে বলেছিলেন ‘মহৌষধি’ বা ‘পরশমণি’। ‘প্রাচীন চীনারা’ তো এও বলে গেছেন, “চায়ের মত এমন প্রাকৃতিক সুঘ্রাণ আর কিছুতে নেই”। আর এ কথার জের ধরেই হয়তো আজ ‘চায়ের নির্যাসে’ তৈরী হয়েছে মোহময় বিভিন্ন সুগন্ধিও! ‘চীনে’ চা পানের প্রচলন শুরু হয়েছিল ‘ঔষধসেবন’ হিসেবে। ‘ইংল্যান্ডে’ নামকরা ‘চায়ের ব্র্যান্ড’ হলো ‘টাইফু’, ‘চীনা ভাষায়’ যার অর্থ ‘চিকিৎসক’। আর খোদ চিকিৎসকেরা বলেন, ‘চা’ নামক এই অতি পরিচিত পানীয়টিতে রয়েছে ৭% ‘থিওফাইলিন’ ও ‘থিওব্রোমিন’ যা ‘শ্বাসকষ্ট’ ও ‘হাঁপানির’ জন্য অনেক উপকারী। এতে রয়েছে ২৫% এরও বেশি ‘পলিফেনলস’, যা ‘ক্যান্সার প্রতিরোধী’। ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ‘জাপানে’ চা পানের অভ্যাসও চালু হয়েছিল মূলতঃ ‘সুস্বাস্থ্যরক্ষার’ জন্যই। ‘চায়ের ব্যবহার’ নিয়ে প্রথম গ্রন্থ ‘দুয়াকু’ লিখিত হয়েছিল ৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ‘চায়ের ভেষজ গুণাগুণ ও ব্যবহারবিধি’ নিয়ে চতুর্থ শতকে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ‘কিয়েন লুঙ’। ‘ট্যাঙ রাজত্বে’ (৬১৮-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) চা চীনের জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেই আমলে ‘লু ইয়ু’ ‘চীনের চায়ের ইতিহাস’, ‘প্রস্তুতপ্রণালি’ ও ‘ব্যবহার’ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি ‘চায়ের গুণাবলি’ নিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘এটা মেজাজ ঠাণ্ডা রাখে, মনের অস্থিরতা দূর করে, শরীরের অবসাদ-শ্রান্তি দূর করে। ঘুমঘুম কিংবা ঝিমুনিভাব চলে যায়, শরীরকে সতেজ ও কর্মক্ষম রাখে।’’ চতুর্দশ শতকে একজন বিশিষ্ট বৌদ্ধ ‘দেঙয়ো দাইশাই’ প্রথমবারের মতো চা ‘চীন’ থেকে ‘জাপানে’ পরিচিত করেন। তিনিই ‘জাপানিদের’ ‘চায়ের ব্যবহার’ শেখান। এর বহু আগে থেকেই অবশ্য ‘চীনাদের মধ্যে’ পানীয় হিসেবে চায়ের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। ‘জাপানের’ বিভিন্ন অঞ্চলে চা গাছ ছিল, তাই এটা ধারণা করা হয় যে চা গাছ আগে থেকেই ‘জাপানে’ জন্মাত এবং ‘দাইশাই’ সেখানে গিয়ে তাঁদের ‘চায়ের ব্যবহার’ শিখিয়েছিলেন। ‘চীনের সিচুয়ান প্রদেশের লোকেরা’ সর্বপ্রথম চা সেদ্ধ করে ‘ঘন লিকার’ তৈরী করতে শেখে। ১৬১০ সালে ‘ইউরোপে’ চায়ের প্রবেশ ঘটে ‘পর্তুগীজদের’ হাত ধরে এবং ১৬৫০ সালে চীনে ‘বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন’ শুরু হয়। চা উৎপাদনে ও প্রচলনে ‘ইর্ষান্বিত’ হয় ইংরেজরা। ১৭০০ সালের দিকে ‘ব্রিটেনে’ চা জনপ্রিয়তা পায় এবং ইংরেজদের মাধ্যমেই ‘ভারতীয় উপমহাদেশে’ চায়ের প্রবেশ ঘটে। চা পানের অভ্যাস জন্ম দেয় দু’টি ‘বাণিজ্যিক ত্রিভুজে’। ‘চিনি’র জন্য ‘ব্রিটেন-আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ এবং চা’পাতার জন্য ‘ব্রিটেন-চীন-ভারত’। প্রথম দিকটায় ঝোঁকের বশে ইংরেজরা ‘সোনার বিনিময়ে’ চীনের কাছ থেকে চা আমদানি করে এবং এতে করে ইংল্যান্ডের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়। এই ক্ষতি রোধ করতে ‘ব্রিটিশ সরকার’ তাদের কোম্পানির মাধ্যমে ভারতে ‘আফিম চাষ’ শুরু করে এবং ‘চীনকে’ বাধ্য করে সেই ‘আফিমের বিনিময়ে’ চা রপ্তানী করতে।
যে চা আজ ‘ভারতীয় উপমহাদেশের’ প্রায় প্রতিটি গৃহে অতিথিকে করতে চাওয়া প্রথম আপ্যায়ন, সে চা’কে কিন্তু ভারতবর্ষে ‘অতিথি’ হয়ে প্রবেশ করতে পোহাতে হয়েছিল অনেক ভোগান্তি! সেসময়ের অন্যান্য সকল নতুন বিষয়ের মতই ১৮১৮ সালে চা’কেও ভারতবর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল ‘ব্রিটিশ’রাই। ছোট ছোট দোকান খোলার উদ্দেশ্যে ‘নামমাত্র মূল্যে’, ‘বাকিতে’ এবং সর্বোপরি ‘বিনামূল্যে’ পর্যন্ত চা সরবরাহ করেছিল ‘ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো’। ‘ব্রিটিশরা’ চেয়েছিল এদেশের ‘মানুষের মর্মে’ চা’কে প্রবেশ করাতে, তাঁদেরকে চা’তে ‘অভ্যস্ত’ করে তুলতে … যাতে তাঁদের ‘নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায়’ চা স্থান পায় এবং তাদের ‘নিয়মিত চায়ের খদ্দের’ জোটে। কিন্তু চা’কে এদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বা জনপ্রিয় করে তোলাটা বোধ করি এত সহজও ছিলো না! বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপন একে করেছিল ‘সহজতর ও পরিচিত’। ‘ভারতে প্রথম চা কোম্পানী’ ‘অসম চা কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠার পরপরই ইংরেজরা এর ‘আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞাপনে’ জোর দিয়েছিল। প্রথম কাজ ছিল ‘বিশেষজ্ঞদের দিয়ে’ ‘চায়ের বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা’ বের করা, তারপর এর সাথে ‘আকর্ষণীয় ভাষার মিশেলে’ বিজ্ঞাপন তৈরি! অতীতের সংবাদপত্রে পাওয়া খুব পরিচিত একটি বিজ্ঞাপন ছিল এমনটি –
‘‘প্রাণশক্তি ও উৎসাহের উৎস ও ম্যালেরিয়ানাশক ভারতীয় চা। দরকার হলেই ভারতীয় চা ব্যবহার করে অচিরে শরীর মন সতেজ করে তোলা যায়, এ যে কত বড় সান্ত্বনা, তা বলা যায়না। সারাদিনের কঠিন শারীরিক পরিশ্রম বা মাথার কাজের পর এক পেয়লা ভালোভাবে তৈরী দেশি চা খেলেই শরীর সজীব ও মন প্রসন্ন হয়ে উঠবে। সত্যিই চা জাগ্রত জীবনীশক্তির আধার। সকালবেলা নিয়ম করে অন্তত দুই পেয়ালা ভালো দেশি চা রোজ পান করুন, জড়তা দূর হয়ে যাবে- সারাদিন শরীর মজবুত থাকবে, আবার দিনের শেষে দুই পেয়ালা চা পান করবেন- সারাদিনের খাটুনির পর মধুর বিশ্রামের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।”
কিন্তু বাঙালি ‘চাতাল’ হওয়ার দিনগুলো অন্যরকমই ছিল। তখন চা মানে ছিল ‘ওষুধ’। পরে রীতিমত ‘বিজ্ঞাপন’ দিয়ে ইংরেজরা বাঙালিকে চা খাওয়াতে শিখিয়েছিল। ঐতিহাসিকরা বলেন, এসবই ছিল ইংরেজদের ‘কারসাজি’। সে দেশে চায়ের নেশা এদেশে এসে ছাড়ে কি করে! শিখিয়ে দাও বাঙালিগুলোকে। এমনই ধরে যাবে চায়ের নেশা। ‘স্বামী বিবেকানন্দের চা প্রেমের খবর’ পাওয়া যায় তাঁর ছোট ভাই ‘মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায়’। ‘কবিগুরুর চা চক্র বা চাক্র’ ছিল বিখ্যাত। ‘অসম’, ‘দার্জিলিং’ ভরে যায় চা বাগানে।ইংরেজরা ‘নিজ স্বার্থে’ দেশীয়দের উৎসাহ দিতে থাকেন চা পান করাতে। ১৯০০ সালে তো জনৈক ‘গিরীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ ‘চা প্রস্তুত প্রণালী শিক্ষা’ নামে ১১২ পাতার বই লিখে ফেলেছিলেন। বিশের দশক থেকে স্টেশনে স্টেশনে ‘ইংরেজ রেল কোম্পানি’ ‘চায়ের স্টল’ বসায়। সেখানে সাথে থাকত ‘চা পানের উপকারিতা নিয়ে বিজ্ঞাপন’ আর ‘চা বানানোর প্রথা’। বিভিন্ন তথ্যসূত্র মারফত জানা যায়, চল্লিশের দশক পর্যন্ত এই ‘বিজ্ঞাপন দিয়ে চা খাওয়া শেখানোর বিষয়টি’ বজায় ছিল। তারপর ‘রেল কোম্পানি’ থেকে ‘ব্যাক্তিগত মালিকানায়’ চায়ের দোকানগুলো চলে আসে। সে সব ‘বোর্ড’ আর ‘বিজ্ঞাপন’ হারিয়ে যায়। ‘নৈহাটি’ আর ‘দমদমের’ ‘এক এবং তিন নম্বর প্লাটফর্মে’ এখনও বর্তমান সেই পুরনো দিনের কথা, যা অনেক ইতিহাসের কথা বলে। এখন তো মোড়ের মাথায় মাথায় ‘চায়ের দোকান’। ‘টি-জাঙ্কশন’ থেকে শুরু করে ‘গঙ্গাধরের চায়ের দোকান’। বলা যেতে পারে ‘এক কাপ চা’ ছাড়া বাঙালি অপূর্ণ। সেই প্রেমের গল্প নিয়েই এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই সমস্ত বিজ্ঞাপণগুলিও।
‘ব্রিটিশ শাসনকালে’, ভারতে চা আসত প্রতিবেশী দেশ ‘চীন’ থেকে। কিন্তু সেই চা ভীষণ দামী হওয়ায়, ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতে, নিজেদের ‘চা বাগান ও চা উৎপাদন’ করার সিদ্ধান্ত নেন। পাহাড়ের আবহাওয়া চা উৎপাদনের অনুকূল বলে, ‘দার্জিলিং’ ও ‘আসাম’কে চা উৎপাদনের জন্য বেছে নেওয়া হয়। ১৮৪১ সালে, ‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের একজন সিভিল সার্জন’, ‘আর্থার ক্যাম্পবেল’, ‘দার্জিলিঙে’ চা চাষ শুরু করেন। ১৮৪৭ সালের মধ্যে, ‘ব্রিটিশ সরকার’, চা চাষের জন্য ‘দার্জিলিঙে’ অনেকগুলি ‘নার্সারী’ খোলে। ১৮৫০ সাল থেকে ‘ব্রিটিশ সরকার’, ‘ব্যবসায়িক ভাবে দার্জিলিঙের চা’কে বিশ্বের বাজারে বিক্রির প্রস্তুতি শুরু করে। ১৮৫৬ সালে, ‘কুরসেঙ্গ এন্ড দার্জিলিং টি কোম্পানি’, ‘দার্জিলিঙের আলুবাড়ি’তে ‘প্রথম ব্যবসায়িক চা বাগান’টি খোলে। ১৮৫৪-৫৫ সালে ব্রিটিশরা ‘অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সিলেটে’ সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে ‘সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে’ শুরু হয় ‘বাণিজ্যিক চা চাষ’। ব্রিটিশদের ‘বিনা পয়সায় চা পান করানোর ঘটনা’ এখন ইতিহাস।
‘পালোয়ান রামসুক তেওয়ারী’ বাংলায় এসেছিলেন ‘ভাগ্য’ বদলাতে। ‘ভাগ্য’ বদলাতে না পারলেও শিগগিরই হয়ে গিয়েছিলেন ‘চায়ে আসক্ত’। ‘চায়ের প্রভাবে’ তিনি ‘বদহজমজনিত সমস্যায়’ আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর ‘ওজন’ হ্রাস পেতে শুরু হয়েছিল। শিশুদের জন্য লেখা এক কবিতায় ১৯৩০-এর দশকের কবি ‘কুমদরঞ্জন মল্লিক’ ‘রামসুকের পরিণতি বর্ণনা’ করেছিলেন এভাবে –
‘‘অবশেষে অসুখের সংবাদ পাইয়া
দেশ থেকে ধেয়ে এলো দেশওয়ালী ভাইয়া
করে দিল প্রথমেই চা খাওয়া-টা বন্ধ
বে-ভাষায় বললো সে কতো কী যে মন্দ …’’
গ্রামের সেই আত্মীয়ের পরামর্শ মেনে ‘রামসুক’ তাঁর ‘হারানো স্বাস্থ্য’ ফিরে পেয়েছিলেন।
‘ব্রিটিশরা’ চা মার্কেটিংয়ের জন্য বেছে নিয়েছিল ‘ট্রেন স্টেশন’সহ বিভিন্ন ‘লোকালয়’। ‘রেলস্টেশন’, ‘লঞ্চঘাট’, ‘স্টিমার ঘাট’সহ বিভিন্ন ‘পাবলিক প্লেসে’ ‘বিজ্ঞাপন ফলক’ লিখে প্রচার শুরু হয়েছিল। তখন সমাজে চা জনপ্রিয় করে তোলার জন্য ‘শহর’, ‘বন্দর’, ‘নগর’ ও ‘লোকালয়’ যেমন ‘রেল স্টেশন’ কিংবা ‘স্টিমারঘাটে’ ‘টি-স্টল’ গড়ে তোলা হত ‘কোম্পানিগুলোর উদ্যোগে’। তা ছাড়া ‘দর্শনীয় স্থানে’ বিভিন্ন ‘স্লোগান সংবলিত বিজ্ঞাপন’ দেওয়া হত। সেসব বিজ্ঞাপনে ‘চা পানের গুণকীর্তন’ করা হত। যেমন – চা পানে শরীর ‘সতেজ’ ও ‘চাঙ্গা’ হয়, ‘আমাশয়’ ও ‘প্লেগ’ রোগ সারে প্রভৃতি।
চা নিয়ে এই ‘প্রচারণার’ সমান্তরালে দেখা গিয়েছিল ‘চা-বিরোধী ব্যক্তি’ ও ‘সামাজিক প্রতিরোধ’। ১৮৮০-এর দশকে ‘চা বাগানে শ্রমিকদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে’ আন্দোলন চলছিল। বিশিষ্ট চিকিৎসক ‘সুন্দরী মোহন দাস’ (১৮৫৭-১৯৫০) ও জাতীয়তাবাদী নেতা ‘কৃষ্ণ কুমার মিত্র’ (১৮৫২-১৯৩৬) প্রতিবাদ জানিয়ে চা পান ত্যাগ করেছিলেন। ১৯৩০-এর দশকে ‘তামিলদের’ ‘বিশুদ্ধতাবাদী আন্দোলন’ তাঁদের স্থানীয় পানীয়ের পরিবর্তে চা পানের ব্যাপারে আপত্তি এবং বিতর্ক শুরু করেছিল। ‘স্বাস্থ্যগত ও নৈতিকতার মানদণ্ডে’ ‘বাংলার বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও স্বদেশী আন্দোলনের উদ্যোক্তা’ ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়’ ‘চা পানের ঘোরতর বিরোধিতা’ করেছিলেন। তাঁর কথা ছিল, চা মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে এবং ক্ষুধা নষ্ট করে। এছাড়া তার মনে আশঙ্কা ছিল, ঘরের গৃহিণীরা চায়ের প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লে তা অন্তঃপুরের পরিবেশ নষ্ট করবে। নিজের ধারণার সপক্ষে তিনি একটি ‘ব্যঙ্গচিত্র’ও এঁকেছিলেন। সেই ‘ব্যঙ্গচিত্রে’ দেখা গিয়েছিল, একজন ‘পাক্কা চা-খোর’র করুণ চিত্র। সেই ‘পাক্কা চা-খোরের’ টেবিলে ছিল একটি বড় চায়ের পাত্র আর তাঁর হাতে ছিল এক কাপ চা। ওদিকে তাঁর মুখে ছিল খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পায়ে ছিল ছিন্ন জুতা, পরনে ছিল ছেঁড়াখোড়া পোশাক, আর তাঁর চারদিকে ছড়ানো ছিল অসংখ্য সিগারেটের খোসা। সব মিলিয়ে সেটা ছিল ‘চায়ের নেশায় অকেজো এক মানুষের প্রতিচ্ছবি’। ‘দেশ’ পত্রিকার ‘তৃতীয় বর্ষ’ ‘৩ নং সংখ্যায়’ (৭ই ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত) ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের’ একটি ‘কলাম’ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘‘চা-এর প্রচার ও দেশের সর্ব্বনাশ’’। বেশ বড় আকারের প্রবন্ধে তিনি ‘ব্রিটিশদের চা নিয়ে মাতামাতির কঠোর সমালোচনা’ করে বলেছিলেন,
‘‘শীত-প্রধান দেশে চা-পানের কিছু প্রয়োজন থাকিতে পারে সত্য, কিন্তু আমাদের উষ্ণ দেশে উহার কোনই সার্থকতা নাই। সাহেবরা যখন চা পান করে, তখন তাহার সঙ্গে অনেক কিছু পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী পেটে পড়ে, কিন্তু কলিকাতা, বোম্বাই প্রভৃতি নগরের স্বল্প বেতনভুক, শীর্ণ কেরাণী আহার্য্য ও পানীয়ের উভয়বিদ প্রয়োজনে চা পান দ্বারাই মিটাইয়া থাকেন। আপিসে আসিয়া ২/১ ঘণ্টা কাজে বসিতে না বসিতেই ইহারা চা-এর তৃষ্ণায় কাতর হন। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে চা পান করিয়া ইঁহারা ক্ষণিকের জন্য কিঞ্চিত আরাম ও উত্তেজনা এবং স্ফূর্তি অনুভব করেন। আবার সেই একঘেয়ে হুড়ভাঙ্গা খাটুনি – মধ্যে মধ্যে চা-এর পেয়ালায় চুমুক – ইহাই হইল কেরাণীর দৈনন্দিন জীবন। এই প্রকারে সারা দিনরাত প্রায় পাঁচ ছয় পেয়ালা চা। এই বদ অভ্যাসের পক্ষে তিনি এই যুক্তি দেখাইয়া থাকেন যে, উহাতে ক্ষুধা নষ্ট হয়, সুতরাং ব্যয়সাধ্য পুষ্টিকর আহার্য্যেও আর প্রয়োজন পড়ে না।’’
‘চা নিয়ে ইংরেজদের বিজ্ঞাপনী ভাষার সমালোচনা করে’ তিনি আরেক জায়গায় বলেছিলেন,
‘‘অতিরঞ্জন, অতিভাষণ ও মিথ্যাভাষণ উক্ত প্রচারকার্য্যের মূলমন্ত্র। ইউরোপে চায়ের বাজার মন্দা যাইতেছে, তাই সেখানকার মন্দা এতদ্দেশে উশুল করিবার জন্য টী অ্যাসোসিয়েশন জনসাধারণের মুখে চা-এর বিষপাত্র তুলিয়া ধরিতে মরিয়া হইয়া লাগিয়াছেন। ৫/৬ কোটি ভুখারী, দারিদ্র্য ও উপবাস তাহাদের নিত্যসঙ্গী, পেট ভরিয়া আহার কাহাকে বলে জানে না, কিন্তু তাহাতে কি যায় আসে? অর্থলোলুপ স্বার্থান্বেষী ধনিক ও বণিক সমাজ স্বকার্যসাধনে কোন জীন উপায় বা চাতুরীর আশ্রয় লইতে কুণ্ঠিত হয় না। মিথ্যা প্ররোচনায় মুগ্ধ করিয়া হতভাগ্যদিগকে ঊর্ণনাভের জালে জড়িত করিতেই ইহাদের উৎসাহের কমতি নাই।’’
‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়’ আরও বলেছিলেন,
‘‘মুষ্টিমেয় নির্মম ধনিকের লালসা-বহ্নি, তাহাতে পতঙ্গের ন্যায় আত্মাহুতি দিতেছে সাধারণ জনগণ। তৎকালীন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জন ফিসারের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘হুইস্কির বোতল কিংবা চায়ের পাত্র’ ইহাদের কোনটি যে অধিকতর মারাত্মক, তাহা নিশ্চিতরূপে বলা কঠিন।’’
কিন্তু এত ‘বিরোধী প্রচারণা’ হালে পানি পায়নি, চায়ের ‘জয়যাত্রা’ অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছিল। ‘চায়ের গুণকীর্তনভরা পোস্টার’ বিভিন্ন স্থানে শোভা পেত। ‘স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা’ও এই চায়ের ব্যবসায় নাম লেখাতে শুরু করেছিলেন। ‘চা বিক্রি ও উৎপাদনের জন্য’ ‘১ লাখ টাকা মূলধন’ পরিশোধ করে অনেকে কোম্পানি খুলে বসেছিলেন। তৎকালীন ‘পূর্ববঙ্গের’ ‘ঢাকা বিভাগের মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর টি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি লিমিটেড’ ছিল এমনই একটি সফল উদ্যোগ। ‘তামিলনাড়ুতে’ ‘ব্রাহ্মণরা’ তাঁদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে চায়ের পরিবর্তে ‘কফি’কে আপন করে নিয়েছিলেন। চা ‘শ্রমজীবী ও অব্রাহ্মণদের পানীয়’ বলে তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে ‘পূর্ব ভারতে’ ‘জমিদার ও মধ্যবিত্ত’ উভয়ই ‘ব্যয়বহুল এবং ক্ষতিকর মদের পরিবর্তে’ চা’কে গ্রহণ করেছিলেন। ‘চায়ের প্রচারণায়’ ‘ধর্ম ও সামাজিক শ্রেণী’কেও মাথায় রাখা হয়েছিল। ‘মুসলিমদের’ জন্য নির্দিষ্ট করে আলাদা ‘প্রচারণা’ করা হয়েছিল। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, চা’কে ‘সমাজের অভিজাতদের হাতে’ দেখানো হত। কারণ, ‘প্রচারকরা’ চা’কে ‘মান-মর্যাদার প্রতীক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন বলেই মনে হয়। একই সঙ্গে চা’কে ‘বিলাস’ নয়, বরং ‘ডাল-রুটির মতো নিত্যপণ্য’ হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছিল। ‘এনামেল বোর্ডের’ ওপর এ রকম একটি বিজ্ঞাপনী ছবি দেখা যেত। সেই ছবিতে দেখা যেত, ‘দামি কাপড় ও ফেজ টুপি পরিহিত একজন মুসলিম অভিজাত’ চা পান করছেন। অন্যদিকে সেই ‘ছবির ক্যাপশনের কথায়’ চা’কে ‘ডাল-রুটির মতো নিত্যদিনের অনুষঙ্গ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। ১৯১০ ও ’২০-এর দশকে ‘বাংলার অভিজাত পরিবারগুলোয়’ চা তৈরি ছিল প্রায় এক উৎসব। ‘যতীন্দ্রমোহন’ ‘চা তৈরির প্রক্রিয়ার বিশদ বর্ণনা’ দিয়েছিলেন। তিনি এমনকি চায়ের জল ফোটানোর সময় পরিমাপের জন্য ‘বালুঘড়ি’ ব্যবহারের পারমর্শ দিয়েছিলেন।
সন্দেহ নেই, সেকালে ‘ব্রিটিশের পণ্য প্রসারের জন্য’ অনেক ভারী ‘চিন্তাশীল বাঙালির’ সহায়তা ছিল। সে সময় ‘আধুনিক বিজ্ঞাপন ভাষার ব্যাপ্তি’ আজকের মতো ছিল না। এখন বিজ্ঞাপনের অনেক ধারাও চালু হয়েছে। অনেক দক্ষ কর্মীরা কাজ করছেন বিজ্ঞাপনে। এটি এখন একটি ‘পূর্ণাঙ্গ ইন্ডাস্ট্রি’। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ৮-১০টি বিজ্ঞাপনও বানাচ্ছে। ‘বিজ্ঞাপনের কারণে’ জনসাধারণ উদ্দিষ্ট পণ্যটি পরিহার করে – এমন ঘটনাও আছে। কিন্তু ‘ব্রিটিশদের সময়ে’ তৈরি করা ‘চায়ের বিজ্ঞাপনের সেই আবেদন’ যেন আজও তরতাজা। ‘আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়’ আজ থেকে বহু বছর আগে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সেই সর্বনাশ হয়ে গেছে বহু আগে। আর ওই বিজ্ঞাপনের গুণেই হোক আর যেভাবেই হোক, ‘বঙ্গদেশে’ প্রতিবছর ‘চা-পায়ীর সংখ্যা’ বাড়ছে।
তবে ‘ব্রিটিশদের বসতির আগে’ বাংলায় চা-পানের প্রচলন হয়নি। তবে ‘চীনে চা-পানের ইতিহাস’ অনেক পুরোনো; বিশেষভাবে ‘তিব্বতে’। সেই ‘তিব্বতেই’ ‘সর্বপ্রথম বাঙালি’ হিসেবে চা’য়ে আপ্যয়িত হয়েছিলেন ‘অতীশ দিপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’ ১০১১ খ্রিস্টাব্দে। ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘বিক্রমপুরে’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ‘অতীশ দিপঙ্কর’। ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য’ তিনি ১০১১ সালে ‘ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায়’ গিয়েছিলেন সেখান থেকে ফেরার পথে ‘বাংলা-বিহারের রাজা মহীপালের অনুরোধে’ ভারতের বিহার রাজ্যের ‘বিক্রমশীলা বিহারের অধ্যক্ষ’ হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকে ‘নেপাল’ হয়ে তিনি ‘তিব্বতে’ যান। সেখানে তাঁকে ‘রাজকীয় সংবর্ধনা’ দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই তিনি ‘প্রথম চা পান’ করেছিলেন।
‘ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ডের’ তথ্যমতে, ‘ভারতে প্রথম চা উৎপাদিত’ হয়েছিল ১৮৩৯ সালে। ‘বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ববঙ্গে প্রথম চা উৎপাদিত’ হয়েছিল ১৮৫৪ সালে ‘সিলেটের মালনীছড়া টি এস্টেটে’। কিন্তু ঊনিশ শতকে এই চা উৎপাদন কেবল ‘ব্রিটিশদের নিজেদের ব্যবহার ও বাণিজ্যেই’ সীমাবদ্ধ ছিল। এ সময়কালে চা ভারতীয়দের মধ্যে যথেষ্ট পরিচিত ছিল না। মূলত বিংশ শতকের শুরু থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে চা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। ভারতীয়দের মধ্যে চা’কে ‘জনপ্রিয়’ করার পেছনে যারা ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান টি চেজ কমিটি’। এ কমিটির অর্থ আসত ‘ভারতের চা রফতানির ওপর আদায়কৃত কর’ থেকে। এ কমিটির প্রধান কাজ ছিল চা পানের সুফল সম্পর্কে মানুষের মধ্যে প্রচারণা চালানো। এ জন্য তারা ‘গ্রামোফোনের রেকর্ড’ও তৈরি করেছিল। একদা ‘টি চেজ কমিটির কমিশনার’ ঘোষণা করেছিলেন – ‘‘ভারতীয়রা যদি চা পানের অভ্যাস গড়ে তোলে তাহলে তাঁদের অসুখ-বিসুখ এবং মৃত্যুহার হ্রাস পাবে। জনগণের কর্মশক্তি ও উদ্যম বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া মদ্যপান বর্জন করা শ্রমিকরা দৃঢ়ভাবে দাবি করেছেন যে, চা তাঁদের মদের নেশা থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করেছে।’’ তাছাড়া আরো বলা হত যে, চায়ের জন্য জল ফোটানোর ফলে তা ‘জীবাণুমুক্ত’ হয়ে যায়। যতই আপনি মানুষকে বোঝান যে চা আপনার জন্য বিভিন্নভাবে ‘উপকারী’, যতক্ষণ না চা তাঁদের হাতের নাগালে আসছে, ততক্ষণ কিন্তু চায়ের ব্যবসায়ীদের কোনো লাভ নেই। এ পরিস্থিতিতে ভারতজুড়ে বড় বড় শহরে ‘চায়ের দোকান’ স্থাপন শুরু হয়। শুরুতে বিভিন্ন ‘আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থার মাধ্যমে’ ‘চায়ের দোকানে খদ্দেরদের আকর্ষণ’ করা হত, যার মধ্যে ছিল ‘সিনেমা’, ‘ভারতীয় অর্কেস্ট্রা’, ‘গান’, ‘ঘরোয়া খেলাধুলা’, ‘গ্রামোফোন’ ও ‘আকর্ষণীয় ডেকোরেশন’। ‘টি চেজ কমিটির প্রতিবেদন’ থেকে জানা যায়, ‘চায়ের দোকানগুলোকে’ জনপ্রিয় করার জন্য ভারতজুড়ে তারা ‘৭০০ গ্রামোফোন’, ‘স্থানীয় ভাষার আট হাজার রেকর্ড’, ‘২০০ হারমোনিয়াম’ ও ‘ঘরোয়া খেলাধুলার জন্য অসংখ্য টেবিল’ ব্যবহার করেছিল। ‘কলকারখানা’, ‘খনি’, ‘সেনাবাহিনী’ – সবখানেই চায়ের পর্যাপ্ত সরবরাহ শুরু হয়েছিল। কলকাতার বিভিন্ন ‘পাটকলে’ রাতে কাজ চললে সারা রাত ‘চায়ের দোকান’ খোলা থাকত। ‘কারখানা অঞ্চলের’ একটি ‘চায়ের দোকান’ সেই আমলেও মাসে প্রায় ১ হাজার টাকা উপার্জন করত! ‘১৯২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২১ সালের মার্চ’ পর্যন্ত ভারত ভ্রমণ করেছিলেন ‘মার্ক থর্নহিল’। তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ‘কল-কারখানা’ পরিদর্শন করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন ‘হন্টস অ্যান্ড হবিজ অব অ্যান ইন্ডিয়ান অফিসিয়াল’। এ গ্রন্থে তিনি বর্ণনা করেছিলেন, ‘‘চা পান ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যে একটি নতুন রীতি। কিন্তু নতুন হলেও শ্রমিকদের মধ্যে এ সংস্কৃতি অত্যন্ত দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে। কারখানাগুলোয় চায়ের দোকান বেশ জনপ্রিয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ দোকানগুলো সারা দিন খোলা থাকে এবং শ্রমিকরা তাঁদের ইচ্ছামতো এসব দোকানে চা পান করতে আসেন। আবার কিছু কারখানায় চায়ের দোকানে আসার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। অনেক কারখানায় চা পানের জন্য দুটি আলাদা কক্ষ থাকে – একটি হিন্দুদের, অন্যটি মুসলমানদের জন্য। অবশ্য রান্নাঘর একটিই থাকত, কিন্তু রান্নাঘরে আবার চা বানানোর জন্য একজন উচ্চবর্ণের হিন্দু ও একজন মুসলমান থাকতেন। সাধারণত পিতলের গ্লাসে দুধ ছাড়া শুধু চিনি দিয়ে এ চা পরিবেশন করা হত।’’ চা পানে অবশ্য শুধু ‘ধর্ম’ নয়, ‘লিঙ্গ’ প্রশ্নটিও চলে আসত। ‘নারী শ্রমিকরা’ চা পানের জন্য এসব দোকানে ঢুকতে পারতেন না। ততাঁরা বাইরে বসে চা পান করতেন।
প্রাথমিক সময়ে ‘ভারতে বর্ণপ্রথার কারণে’ ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে’ চা নিয়ে কিছু কুসংস্কার ছিল। হিন্দুদের বাদে ‘অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে’ চা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ‘হিন্দু’রাও একসময় ব্যাপকভাবে চা পান শুরু করেন। ভারতে ‘চায়ে দুধ মিশিয়ে পান করার রীতি’ মূলতঃ ‘হিন্দুদের হাতেই’ জনপ্রিয় হয়েছিল। গত শতকের শুরুর দিকে ‘চা নিয়ে ধর্মীয় কুসংস্কার’ কিংবা ‘সামাজিক ট্যাবু’ ভেঙে পড়তে শুরু করে এবং ‘চায়ের জনপ্রিয়তা’ বাড়তে থাকে। ‘রেলওয়ে স্টেশনগুলোয়’ যাত্রীদের জন্য ‘চায়ের দোকান’ গড়ে ওঠে। ‘রেলস্টেশনগুলো’ ‘চায়ের সংস্কৃতি বিকাশে’ ভালো ভূমিকা রেখেছিল। ‘ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ড’ ও ‘টি চিজ কমিটি’ ‘চা কোম্পানিগুলোকে’ ‘রেলস্টেশনে চায়ের ক্যান্টিন’ স্থাপনের পরামর্শ দেয়। এসব ‘ক্যান্টিনে’ ‘বিনামূল্যে চা’ পান করানো হতো। এসব ‘রেলস্টেশনে’ টাঙানো ‘বিজ্ঞাপনে’ কলকাতায় অবস্থিত ‘সেন্ট্রাল টি বোর্ডের ঠিকানা’ দেওয়া থাকত। এই ‘টি বোর্ডে’ অনুরোধ করলে ‘চা প্রস্তুতপ্রণালি নিয়ে প্রকাশিত নির্দেশিকা’ বিনামূল্যে দেওয়া হত। শুধু ‘কলকাতা শহরে চায়ের দোকানের সংখ্যার হিসাব’টা দেখলেই অনেক কিছু পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। ১৯১৫ সালে ‘কলকাতায় চায়ের দোকানের সংখ্যা ছিল ৪৪৪টি’, পরের বছরের শেষ নাগাদ দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল ‘১ হাজার ১২৪টি’। এর পর ১৯১৭ সালের শেষে চায়ের দোকানের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘১ হাজার ৪২০টি’। ভারতের অন্যান্য বড় শহরের চিত্রটাও এমন ছিল। ‘চায়ের দোকানগুলো’ ‘বেসরকারি উদ্যোগে’ চললেও সেখানে ‘টি চেজ কমিটির তত্ত্বাবধায়ন’ থাকত, যতক্ষণ না দোকানগুলো তাদের কাজে ‘দক্ষতা’ দেখাচ্ছে এবং জনগণকে ‘ভালো এক কাপ চা’ উপহার দিচ্ছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতে ‘চা ব্যবসায়’ কিছু সমস্য তৈরি হয়েছিল। ‘জাহাজের সংকট’ এবং ‘যুদ্ধসংশ্লিষ্ট আরো কিছু সমস্যায়’ ভারতে উৎপাদিত ‘চা রফতানি’ ব্যাহত হয়েছিল। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেই চা ‘ছোট ছোট প্যাকেটে’ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হবে। সে সময়ের জন্য এটা ছিল এক ধরনের অসম্ভব প্রকল্প। কারণ চা রাখতে হয় ‘বাতাস থেকে দূরে’ আর ‘কাগজের ব্যাগ’ দিয়ে সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে ‘প্যাকেট’ করার জন্য এত শ্রমিকের বেতনই বা কে দেবে। কিন্তু ‘টি চেজ কমিটি’ এসব সমস্যার সমাধান বের করে ফেলে। তারা ‘এনভেলপের মতো কাগজের প্যাকেট’ তৈরি করেন, যাতে ‘ছয় কাপ চা’ রাখা যেত। আগ্রহী ‘খুচরা চা বিক্রেতাদের’ সেই প্যাকেট সরবরাহ করা হতো। ‘ক্রেতারা’ দোকানে চা কিনতে এলে দোকানি তাঁর ‘টিন অথবা বাক্সে সুরক্ষিত চা’ বের করে ‘এনভেলপে ভরে’ বিক্রি করতেন। ‘এনভেলপের ওপরে’ ‘চারটি ভাষায়’ নিচের ‘নির্দেশনা’টি ছাপা থাকত –
‘‘ছয় কাপ চায়ের জন্য প্যাকেটের মধ্যে থাকা চা ফুটন্ত জলে ঢালুন। স্বাদের জন্য দুধ এবং চিনি যোগ করুন।’’
এভাবে ‘সরাসরি চায়ের পাতা বিক্রির পদ্ধতি বা ব্যবসা’ ১৯১৮ সালের শুরু নাগাদ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। এভাবে ১৯২০ সালের জুলাই মাস নাগাদ ভারতজুড়ে ‘সাড়ে সাত হাজার দোকানে প্যাকেটে চা’ বিক্রি শুরু হয়েছিল। একই সময়ে ‘টি চেজ কমিটি’ ‘৭০ লাখ এনভেলপ প্যাকেট’ সরবরাহ করেছিল। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, কীভাবে চা ভারতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। কলকাতার ‘কর্নওয়ালিস স্ট্রিট’ কিংবা ‘হ্যারিসন রোডে’ হাঁটলে বা ‘মফস্বলের বাজারে’ গেলে চায়ের রমরমা অবস্থার দেখা পাওয়া যেত।
’ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র’ মনে করেন, ‘‘চা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছিল। চা তাদের ক্ষমতা, আধিপত্য ও সংস্কৃতিক প্রভুত্বকে প্রকাশ করত।’’ ঊনিশ শতকজুড়ে ভারতে ‘চায়ের প্রধান ক্রেতা’ ছিল ব্রিটিশরা। তখন বিখ্যাত ‘দার্জিলিং টি’ তাঁদের কাছে ছিল ‘ডারলিঙটন টি’ আর ‘আসামের কাছাড় টি’ হয়ে গিয়েছিল ‘ক্যাচার টি’। ব্রিটিশদের কাছে ‘ভারত এবং তার পণ্য’ ছিল ‘তাঁদের সম্পদ ও ক্ষমতার অনুষঙ্গ’। ১৯২২ সালে ‘লিপটন চা কোম্পানি’র প্রকাশিত ‘ক্যালেন্ডারে’ ‘ডিউক অব কনাটের’ একটি রঙিন ছবি ছিল, ছবিতে ‘ডিউককে যুদ্ধসাজে ঘোড়ার পিঠে’ দেখা যেত। ছবিটি যে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতার প্রতীক’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, সে কথা আর বলে দিতে হবে না। কিন্তু এই ‘উপস্থাপন’ কিন্তু ‘লিপটন কোম্পানি’র শুরু থেকে ছিল না। ‘গৌতম ভদ্র’ ‘চায়ের সঙ্গে সাম্রাজ্যের ক্ষমতার সম্পর্ক’কে দেখাতে গিয়ে এ ছবিটির ‘উদাহরণ’ হিসেবে টেনেছিলেন। এর পর ‘ভদ্র’ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আরেকটি বিজ্ঞাপনের দিকে। বিজ্ঞাপনটি ঊনিশ শতকে কলকাতার বিশিষ্ট ‘স্পেনসে’স হোটেলে’ টানানো ছিল। সেই বিজ্ঞাপনে ‘কোম্পানির নামে এবং চা নিয়ে একজন পাদ্রির মন্তব্যে’ ‘রাজকীয় ছাপ’ থাকলেও ‘মূল ছবি’ ভিন্ন কথা বলত। ছবিতে দেখা যেত, একজন ঘুম থেকে জাগা বাঙালি বাবু হাই তুলছেন আর তাঁর সামনের টেবিলে এক কাপ চা থেকে ধোঁয়া উঠছে। ‘যুদ্ধসাজে ডিউকের ছবির বিপরীতে’ একেবারে ভিন্ন মেজাজের বিজ্ঞাপন। সেই সময় ‘বাংলার ধনীদের মধ্যে’ গড়ে উঠেছিল ‘চায়ের সংস্কৃতি’। ‘টেবিল’, ‘চেয়ার’, ‘চা পরিবেশনের জন্য দামি কাপ-পিরিচ’ আর ‘চা পানের অভ্যাসে’ ‘নব্য বাবুরা’ ইংরেজদের মতো হতে চেয়েছিলেন। ‘ঔপনিবেশিক আমলে’ চা, ‘সংস্কৃতির পরিমার্জন এবং সামাজিক গতিশীলতার একটি প্রতীক’ হয়ে উঠেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ২০ বছর ‘টি চেজ কমিটি’ চা নিয়ে মানুষকে আগ্রহী করতে ব্যাপক ‘প্রপাগান্ডা’ চালিয়েছিল। ‘চা তৈরির পদ্ধতি প্রদর্শন’ এবং ‘বিনামূল্যে চা বিতরণ’ ছিল সেই ‘কার্যক্রমের অংশ’। পুরুষ ও নারীরা ‘মেলা’ কিংবা ‘রেলস্টেশনে’ ‘চায়ের ব্যবহারবিধি’ প্রদর্শন করতেন। এমনকি ঘরে ঘরে গিয়েও সেই ‘প্রচারণা’ চালানো হত। ‘রেলস্টেশন’ ও ‘দোকানে’ ‘স্থানীয় ভাষায় চা প্রস্তুতের সচিত্র নির্দেশনাযুক্ত সাইনবোর্ড’ শোভা পেত। সেই সময়ে ‘প্রাইভেট কোম্পানিগুলো’ পেছনে পড়ে থাকেনি। ১৯২০-এর দশকে ‘লিপটনের’ ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ব্রুক বন্ড’ বাজারে এসেছিল ‘টিনের কৌটয়’ চা নিয়ে। তারা ‘প্রচারণা’ চালিয়েছিল যে, তাদের সেই ‘টিনের কৌট’ই ‘চা সংরক্ষণের’ শ্রেষ্ঠ উপায়। এর ফলে ‘লিপটনের’ একচেটিয়া চা ব্যবসায় ‘ব্রুক বন্ড’ যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করেছিল। এক পর্যায়ে ‘ব্রুক বন্ড’কে কুপোকাত করতে ‘লিপটন’ পাল্টা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, ‘‘আমরা চায়ের বিজ্ঞাপন দিই, টিনের পাত্রের নয়।’’ ‘বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি’ এবং ‘দুই কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ চা সারা ভারতে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। একই সাথে, কোম্পানির পাশাপাশি ‘ব্যক্তি-উদ্যোগে’ও অনেকে চা ব্যবসাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ‘বাবু সংস্কৃতির ভদ্দরলোক’দের আকর্ষণ করতে ‘লিপটন’ এক সময়ে ‘ছোট্ট প্রাতঃরাশ’ শিরোনামে রঙিন বিজ্ঞাপন দিত।
একটা ব্যাপার ‘সাদা চোখে’ই দেখা যায় যে, ভারতের সব স্থানে ‘চায়ের ব্যবহার’ একই মাত্রায় শুরু বা বিকশিত হয়নি। ১৯২০-এর দশকের শেষ দিকে ‘বেথুন কলেজের হোস্টেলে সকালের প্রাতঃরাশে’ নিয়মিতভাবে চা থাকত। অন্যদিকে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ‘সুকুমার সেন’ (১৯০০-১৯৯২) স্মৃতিচারণ করেছিলেন যে, ‘বর্ধমানে’ তাঁর নিজের বাড়িতে তিনি নিয়মিত চা পান করতেন কিন্তু যখন কলকাতায় পড়তে এসেছিলেন তখন দেখেছিলেন, সেখানে তাঁর মামার বাড়িতে চায়ের কোনো চল ছিল না। ফলে চা পান করতে তাঁকে হয় কলেজ স্ট্রিটে চায়ের দোকান, না হয় বন্ধুদের বাড়িতে যেতে হত। গ্রামীণ বাংলায় ১৯৩০-এর দশকের শেষভাগেও ‘গরিব চাষীদের কাছে’ চা ছিল ‘বিলাসী ও শখের পানীয়’। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ এমনটাই জানিয়েছেন। ১৯৪০-এর দশকের শুরু থেকেই সবাই বুঝতে পারছিলেন ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা আর খুব দূরে নয়। তাই ‘চায়ের বিজ্ঞাপন’, ‘প্রচারণা’তেও এর ছাপ পড়েছিল। সেই সময় থেকে ‘চায়ের প্রচারণায়’ ‘ব্রিটিশ থিমের’ বদলে ‘ভারতীয় ধারণা’ প্রাধান্য পেতে শুরু করেছিল। ব্রিটিশদের করা ‘আদমশুমারির তথ্য’কে ব্যবহার করে ‘ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সংস্কৃতি এবং ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জনসংখ্যার হিসাব মাথায় রেখে’ ‘চায়ের বিজ্ঞাপনের ভাষা ও থিম’ নির্ধারণ করা শুরু হয়েছিল। ১৯৪০-এর দশকে সেই পরিবর্তন ‘ভারতের বিজ্ঞাপন শিল্পে’ও এক ধরনের ‘গতিশীলতা’ এনেছিল। ‘ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ডের প্রচারণায়’ অনেক প্রতিভাবান ‘চিত্রশিল্পী’ তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ভারতের ‘বাণিজ্যিক শিল্প নির্দেশনার’ অন্যতম পথিকৃত ‘আনন্দ মুনশী’ (১৯০৫-১৯৮৫ খ্রি.) তাঁর তুলির এক ছোঁয়ায় ‘চায়ের বিজ্ঞাপনচিত্রে’ ব্রিটিশ আখ্যানকে সরিয়ে সেখানে বসিয়ে দিয়েছিলেন ‘চরকা এবং এক ভারতীয় গৃহবধূর হাতে এক কাপ চা’। এতেই হয়ে গিয়েছিল ‘একশ ভাগ স্বদেশী চায়ের বিজ্ঞাপন’। এককালে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় ‘মোহাম্মদী পত্রিকার’ ‘ঈদ’ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘বিশেষ ক্রোড়পত্রে’ কয়েক পাতাজুড়ে ‘ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ড কর্তৃক চায়ের বিজ্ঞাপন’ প্রকাশিত হয়েছিল। কোনো নির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণ না করেও বিজ্ঞাপনটিতে চা’কে ‘উৎসবের অনুষঙ্গ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। ১৯৪৪ সালের ১০ই এপ্রিল আরেকটি পত্রিকায় ‘টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ড’ আরেকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল, যেখানে চা’কে তারা ‘ভারতের জাতীয় সম্পদের একটি দৈত্যাকার উৎস’ হিসেবে দেখিয়েছিল। বিজ্ঞাপনে ‘ভারতীয় চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির একটি পরিসংখ্যান’ও তুলে ধরা হয়েছিল। এর মাধ্যমে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে, চা ‘ভারতের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান’ হয়ে উঠেছে। এরপরে ‘বেসরকারি কোম্পানিগুলো’ও তাদের বিজ্ঞাপনে নতুন নতুন ধারণা যোগ করতে থাকে। ‘শারদীয় শুভেচ্ছা’ থেকে ‘দশোহরা’ কিংবা ‘দীপাবলির শুভেচ্ছাসমৃদ্ধ বিজ্ঞাপন’ নিয়ে আসে ‘লিপটন’ ও ‘ভ্যালি ভিউ’। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন আগে ‘ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ড’ চা’কে ‘ভারতের সত্যিকার প্রতিনিধি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। অর্থাৎ চা এবারে ‘ভারতের জাতীয় এক পানীয়’ এবং ‘অর্থনীতির উপাদান’ হয়ে উঠেছিল।
বিজ্ঞাপনের বাইরে ‘রাজনীতিবিদ’রাও ‘চায়ের সংস্কৃতি’ জনপ্রিয় করায় ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৩৪ সালে ‘বোম্বাইয়ে’ ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে’ ‘চা বিরতি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। ‘চা বিরতি’র খবরটি বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষ সেই নতুন প্রথাকে বেশ উৎসাহভরে গ্রহণ করেছিল। ‘কংগ্রেসের’ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা ‘মৌলানা আবুল কালাম আজাদ’ চায়ের খুব প্রশংসা করতেন। তিনি ‘কংগ্রেসের পুনা সম্মেলনে’ ‘চা চক্রের’ আয়োজন করেছিলেন। ভারতের চা কোম্পানিগুলো খবরটি ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিল। বিংশ শতকের শুরু থেকে ভারত তথা বাংলায় ‘চায়ের সংস্কৃতির’ দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভের বিষয়টি বিশিষ্ট ‘ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের’ দৃষ্টি এড়ায়নি। ‘যদুনাথ সরকার’ ১৯১১ সালে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ইকোনমিকস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’য় লিখেছিলেন – ‘‘সবখানেই ভারতীয়রা ভালো ভালো ঘরবাড়ি বানাচ্ছে। বাঙলার কৃষকরা এমনকি কোট পরিধান শুরু করেছে। শহরের অনেক চাকর এবং ছোটখাটো কারিগররা বরফ ব্যবহার করছে। চা-পানের অভ্যাস খুব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতি পাঁচ বছরে চা পানকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে।’’
প্রস্তুতের প্রক্রিয়া অনুযায়ী চা পাঁচ ধরনের হয়ে থাকে – ‘কালো চা’, ‘সবুজ চা’, ‘ইষ্টক চা’, ‘উলং চা’ ও ‘প্যারাগুয়ে চা’। চা প্রস্তুতিকে আর সহজ করে তুলতে ১৯০৯ সালে ‘টমাস সুলিভ্যান’ ‘টি-ব্যাগের’ প্রবর্তন করেছিলেন। তবে যে ধরনের চা’ই হোক, ভারতের পুরনো সেই বিজ্ঞাপনের সুরেই বলা যায় … ‘‘আপনার দিন শুরু এককাপ আপনার নিজস্ব স্বাদের চা নিয়ে’’, আবার চাইলে বলা যায় সুমনের সেই গানের মতই, “এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই”! নন্দিত কথাসাহিত্যিক ‘হুমায়ুন আহমেদ’ও চায়ের স্তুতি করেছিলেন তার ‘উষ্ণতার মাপকাঠিতে’, “এককাপ উষ্ণ চা একজন ভালো বন্ধুর মত” বলে – ‘স্বাদে’ হোক, ‘গন্ধে’ হোক, ‘উষ্ণতায়’ই হোক, বাঙালির চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠুক, বয়ে যাক শত তর্কের ঝড় চায়ের স্টলে বন্ধুর হাতে!
(তথ্যসূত্র:
১- ফ্রম অ্যান ইম্পেরিয়াল প্রডাক্ট টু আ ন্যাশনাল ড্রিংক: দ্য কালচার অব টি কনজাম্পশন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া, গৌতম ভদ্র।
২- ফরমেশন অ্যান্ড এক্সপ্যানশন অব টি কালচার ইন ইন্ডিয়া উইদ আ স্পেশাল রেফারেন্স টু বেঙ্গল, গুরুঙ রোশান।
৩- চা দেশে দেশে, জনাব আমিনুর রশীদ কাদেরী, আবির প্রকাশন।
৪- চা শিল্পের ইতিহাস, জনাব আবুল কাসেম, গতিধারা।
৫- A Brief History of Tea: Addiction, Exploitation, and Empire, Moxham Roy, Robinson (২০০৯)।
৬- A History of Tea: The Life and Times of the World’s Favorite Beverage, Laura C. Martin, Tuttle Publishing (২০১৮)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত