পৈতৃক ব্যবসায় ছেলের মন নেই, বাবাকে না জানিয়েই সে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পাড়ি দিচ্ছে দূর শহরে। ওদিকে অফিসে ছেলের হিসেবে বেজায় ‘গরমিল’ পেয়ে বাবার মেজাজও সপ্তমে। বাড়ি ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে যায় পিতাপুত্রের। ইস্পাত কঠিন কণ্ঠে বাবার প্রশ্ন ‘‘কোথায় যাচ্ছ?’’ এতক্ষণ বাবার মেজাজ নিয়ে মায়ের সঙ্গে মজা করা ছেলের ততক্ষণে মুখ শুকিয়ে গেছে। অফিসের কাজে ‘অমনোযোগী’ হবার কারণে ছেলেকে প্রবল শাসন করা ও তাঁর ‘গানবাজনা’ করার ব্যাপারে ভয়ঙ্কর আপত্তি করে তাঁকে প্রায় ‘ত্যাজ্যপুত্র’ করার উপক্রম করে যিনি ‘সাদাকালো যুগের বাংলা ছবির সেরা রাশভারী বাবার তকমা’ পেয়েছেন তিনি অভিনেতা ‘কমল মিত্র’। সে যুগের একাধিক ছবিতে হয় ‘রাগী বাবা’ নয়তো ‘মহিষাসুর’, ‘কংস’, ‘যমরাজ’, ‘প্রজাপতি দক্ষ’র মতো বিভিন্ন চরিত্রে ‘ক্রুদ্ধ ও রুষ্ঠ অভিব্যক্তিতে’ যাঁকে দেখতেই দর্শকরা অভ্যস্ত ছিলেন তিনি কিন্তু বাস্তবেও যথেষ্ট ‘মেজাজী’ ছিলেন। আশির দশকের সময় থেকে যেমন হিন্দি ছবির গানের দৃশ্যে ‘একাধিক তারকা সমাবেশ’ দেখতে আমরা অভ্যস্ত, সেই রেওয়াজ বাংলা ছবিতে প্রথম চালু করেছিলেন পরিচালক ‘সত্যজিৎ রায়’। ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পরশ পাথর’ ছবির একটি দৃশ্যে ‘সত্যজিৎ’ চেয়েছিলেন ‘বাংলা ছবির ব্যস্ততম নক্ষত্রদের’ একইসঙ্গে ক্যামেরাবন্দী করতে। দৃশ্যটি সকলেরই চেনা, ‘মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী কাচালু’র (চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ‘গঙ্গাপদ বসু’) দেওয়া পার্টির দৃশ্য। সেই দৃশ্যের জন্য সমস্ত শিল্পীদের আগে থেকেই বলে দেওয়া হয়েছিল ‘নিজেদের পছন্দ মতো পার্টির পোশাক’ পরে আসতে। ‘সত্যজিতের ছবি’, তাই মোটামুটি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন সেই সময়ের টালিগঞ্জের দিকপাল শিল্পীরা। ‘ছবি বিশ্বাস’, ‘পাহাড়ি সান্যাল’, ‘জহর গঙ্গোপাধ্যায়’, ‘চন্দ্রাবতী দেবী’, ‘রেণুকা রায়’, ‘তুলসী লাহিড়ী’, ‘ভারতী দেবী’, ‘অমর মল্লিক’, ‘নীতিশ মুখোপাধ্যায়’ – কে ছিলেন না সেই ‘নক্ষত্র সমাবেশে’। শুধু বেঁকে বসেছিলেন কমল মিত্র। যিনি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছিলেন। এত বড় অভিনেতা হয়ে তাঁকে ‘এক্সট্রার চরিত্রে’ অভিনয় করতে হবে শুনে তিনি তো রেগে আগুন হয়েছিলেন! অগত্যা আসরে নেমেছিলেন ‘ছবির প্রযোজক’ ‘প্রমোদ লাহিড়ী’ স্বয়ং। ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে অবশেষে ‘নিমরাজি’ হয়েছিলেন কমল মিত্র। ‘প্রমোদ লাহিড়ী’ তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, ‘‘আসলে একটা রেকর্ড রাখতে চাইছি, যে একসঙ্গে এত স্টার একই ছবির একটি দৃশ্যে থাকবে।’’ ‘পারিশ্রমিকের জন্য’ যদিও কাউকে ভাবতে হয়নি। ‘পরশ পাথর’ চলচ্চিত্রের ওই একটি দৃশ্যেই খরচ হয়েছিল ৩৫,০০০ টাকা, যা সে যুগের একটি ছবির পক্ষে অভাবনীয়। কমল মিত্র রাজি তো হয়েছিলেন। উপস্থিতও হয়েছিলেন উক্ত দিনে তাঁর পছন্দের পোশাক ‘প্রিন্সকোর্ট ও গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট’ পরে। কিন্তু ব্যাপারটা তাঁর মোটেও পছন্দ হয় নি। ‘প্রযোজকের অনুরোধে’ তিনি এসেছিলেন বটে, কিন্তু এত বড়মাপের এক শিল্পীকে ডেকে এনে শুধু বসিয়ে রাখা হবে জেনে তিনি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেছিলেন। তাই তাঁর মেজাজ বেশ চড়া ছিল, আর মুখের ভাবও ছিল ঠিক তেমনই। ‘সত্যজিৎ’ যেন অভিনেতার ঠিক সেই মুডটাই চেয়েছিলেন। চট করে ক্যামেরাবন্দী করে ফেলেছিলেন ‘রাগী চেহারার কমল মিত্র’কে। সেই রাগী মুখই তো বুঝিয়ে দিয়েছিল ‘হঠাৎ করে ধনী হওয়া’ ‘পরেশ দত্ত’কে (চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ‘তুলসী চক্রবর্তী’) ‘উচ্চবংশীয় বনেদি সম্প্রদায়’ তাঁদের একজন বলে মেনে নিতে নারাজ। ‘কমল মিত্রর স্বাভাবিক অভিব্যক্তি’ পরিচালকের কাজে লেগে গিয়েছিল। আর সেই সঙ্গেই ‘বাংলা ছবির ইতিহাসে’ এক ঐতিহাসিক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল।
‘কমল মিত্র’ – প্রখ্যাত এই অভিনেতার কথা এলেই সামনে এসে যায় ‘রাশভারী’, ‘অহঙ্কারী’, ‘গম্ভীর কণ্ঠস্বর’ নিয়ে থাকা দীর্ঘদেহী একটি মানুষের ছবি। নায়ক নায়িকার ‘রাগী পিতা’ হিসাবে দর্শকদের কাছে সাধারণ ভাবে পরিচিত হলেও, তিনি শুধু এই একই ‘টাইপ চরিত্রাভিনেতা’ নন। পুরানো বাংলা চলচ্চিত্র অনুরাগী অনেকেরই চোখের সামনে ভেসে ওঠেন অন্য এক অভিনেতা। কখনও তিনি ‘বধূ’ ছবির ধনী গৃহকর্তার একান্ত অনুগত ভৃত্য ‘কালী’। সাধারণ ভাবে ‘স্যুটেড বুটেড’ কেতাদুরস্ত সেই মানুষটি সেখানে হাঁটুর ওপর কাপড় পরে, ছোট একটা ফতুয়া গায়ে সারাটা সময় অনুগত ভৃত্যের অভিনয় করে গিয়েছিলেন। চলচ্চিত্র প্রেমীরা কখনওই ভুলতে পারবেন না ‘লৌহ কপাট’-এর ‘ডাকাত সর্দার বদর মুন্সী’কে, ভুলতে পারেন না ‘বিভাস’ ছবির ‘ডা. তারকেশ্বর রায়’কে, ‘জীবন মৃত্যু’র সহৃদয় মানুষ ‘রণদেব সিংহ’কে। দর্শকমনে এখনও জাগরূক ‘রাজদ্রোহী’ ছবির সেই কর্তব্যপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ রাজসেনাপতি ‘তেজ সিংহ’। যে মানুষটি ‘শিল্পী’ ছবির নায়িকার কঠিন, কঠোর দৃঢ়চেতা পিতা, সেই মানুষটি আবার ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ছবিতে ‘যমরাজের চরিত্র’ অভিনয় করে দর্শকদের কৌতুক উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন। এ ছবিগুলি পাশাপাশি রাখলে অবাক হতেই হয়। কী ভাবে চলচ্চিত্র প্রেমীদের পক্ষে ভোলা সম্ভব ‘শাপমোচন’ চলচ্চিত্রের সন্তানবৎসল সেই পিতাকে, যিনি পরবর্তীকালে বিত্তবান হয়েও অস্বীকার করতে পারেননি ছেলেবেলায় উপকার পাওয়া তাঁর ‘ক্ষেত্রদা’কে। আবার ‘একটি রাত’ ছবিতেও সাবলীল ভাবে অভিনয় করে গিয়েছিলেন তিনি। বহু সিনেমায় তাঁর কন্যা হিসাবে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী ‘সুচিত্রা সেন’ও। তবুও তাঁর সব অভিনয় ছাপিয়ে, চলচ্চিত্রে তাঁর ‘রাশভারী’, ‘অহঙ্কারী’, ‘গম্ভীর কণ্ঠস্বর’ নিয়ে থাকা পিতার চরিত্রগুলোই বাঙালি চলচ্চিত্র প্রেমীদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। উত্তম যুগের বাংলা চলচ্চিত্রের ‘রাগী পিতা’ মানেই যেন তিনি। তাই সম্ভবতঃ তাঁর সম্বন্ধে না জেনেই বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে ‘মেম’ তৈরি করে। সেই অভিনেতার নাম ‘কমল মিত্র’।
১৯৪৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেবকী বসু’র হিন্দি ছবি ‘কৃষ্ণলীলা’-য় রাজা ‘বৃষভানু’র চরিত্রে অভিনয় করে তিনি পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন পঁচাত্তর টাকা। তাঁর অভিনয় পছন্দ হয়েছিল ‘দেবকী বসু’র। তবুও পারিশ্রমিকটুকু হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন সাবধানবাণী, “আপনি কখনও নায়ক করবেন না। আপনি চরিত্রাভিনয় করবেন।” সারাজীবন এই গুরুবাক্যের প্রতি মান্যতাই জন্ম দিয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্র, নাটক ও যাত্রা জগতের অন্যতম সেরা চরিত্রাভিনেতা ‘কমল মিত্র’ বা ‘কে মিটারের’।
বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশকে বাংলা সিনেমা সবাক হওয়ার পর বেশ কয়েক জন গুণী শিল্পী এই মাধ্যমটিকে ঘিরে জড়ো হয়েছিলেন একে সাবালক করতে। চলচ্চিত্রকে নিয়ে আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছিল। এই আগ্রহের শিকার ছিলেন কিশোর কমলও। তাঁর আবৃত্তি, অভিনয়ের সহজাত প্রতিভার দিকে নজর পড়েছিল অনেকেরই। তাঁর এই প্রতিভার সঠিক পরিস্ফুটন যে একদিন ঘটবে, এ ধারণা অনেকেরই ছিল তখনকার ‘বর্ধমান’ শহরে। কমল মিত্রকে সে পরামর্শও দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু তাঁর পরিবারের কেউই কখনও অভিনয় শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তবু বিগত শতকের বিশের দশক ধরে বহু চেষ্টায় কমল মিত্র চলচ্চিত্র ও রঙ্গালয়ের এক সাধারণ অভিনেতা থেকে অ-সাধারণ একজন চরিত্রাভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর স্থান হয়েছিল ‘বাংলা চলচ্চিত্র’, ‘রঙ্গালয়’ ও ‘যাত্রা’র প্রথম সারির অভিনেতাদের অন্যতম হিসেবে।
১৯১২ সালের ৯ই ডিসেম্বর কমল মিত্রর জন্ম হয়েছিল ‘বর্ধমান’ শহরে। তাঁর ‘পিতামহ ডাক্তার জগদ্বন্ধু মিত্র’ ছিলেন নামকরা চিকিৎসক। ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুরোধে’ যিনি ‘হুগলি জেলার চাঁদরা গ্রাম’ থেকে ‘বর্ধমানে’ এসে প্র্যাকটিস শুরু করেন। তাঁর খ্যাতি এতটাই ছড়িয়েছিল যে, ‘পঞ্চম জর্জ’ ভারতে এসে তাঁকে ‘দরবারি মেডেল’ প্রদান করেছিলেন। সেই ‘চাঁদরার মিত্র’ বংশের কৃতী সন্তান কমল। তাঁর বাবা ‘নরেশচন্দ্র মিত্র’ ছিলেন বর্ধমানের ‘প্রখ্যাত আইনজীবী ও বর্ধমান মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান’। কমল মিত্রর পড়াশোনা ‘বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজে’। ছাত্রাবস্থা থেকেই তখনকার ‘বর্ধমান’ শহর ও তার আশপাশে ‘ছোট-বড় নানা শৌখিন দলের নাটকে’ তিনি ছিলেন ‘স্টার অভিনেতা’। বিভিন্ন দল তাদের নাটকে অভিনয় করার জন্য তাঁকে সাদরে নিয়ে যেত।
অথচ অভিনয় শিক্ষার কোনও প্রথাগত পাঠ তাঁর ছিল না। তিনি নিজেই তাঁর স্মৃতিকথায় এমনই একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, “এক ছুটির দিন বৈঠকখানা ঘরে বসে ‘জনা’ নাটকের প্রবীরের অংশ ‘দাও মাগো সন্তানে বিদায়, চলে যাই লোকালয় ত্যাজি’ এই অংশটি বেশ জোরেই পড়ছিলাম। আমি যখন পড়ছিলাম, বর্ধমানের একমাত্র নাট্যশিক্ষক স্বর্গীয় প্রমোদীলাল ধৌন সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার নাটক পড়া শুনে আমাদের বৈঠকখানায় ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী পড়ছিস রে?’ আমার কাছে সব কথা শুনে বললেন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে, মায়ের সঙ্গে অভিমান করে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? মাকে মারতে যাচ্ছিস নাকি?’ কিন্তু তিনি অতকথা বল্লে কী হবে? আমার তো সে সময় বীররস ছাড়া অন্য কোনও রসে যে নাটক অভিনীত হতে পারে, সে ধারণাই ছিল না। এই প্রমোদবাবুই আমার সর্বপ্রথম নাট্যশিক্ষক।”
কলেজ পাশ করার পরই চোখের অসুখে বাবা ‘দৃষ্টিহীন’ হয়ে পড়লে কমল মিত্রকে চাকরির সন্ধানে বেরোতে হয়। বাড়ির কাউকে না জানিয়েই তিনি ‘সামরিক বাহিনীতে’ নাম লেখান। যদিও বাবার তীব্র আপত্তিতে সে কাজ তাঁর আর করা হয়নি। “কারণ, বাবার বড় ভাই মারা যান অল্প বয়সে। ‘মিলিটারি’তে যোগ দিলে ছোট ছেলেও মারা যাবে, এমন একটা আশঙ্কা আমার ঠাকুমার ছিল। তাই ঠাকুরদা বর্ধমান মহারাজাকে ধরে বাবার নাম কাটিয়ে দেন,” – পরে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন ‘কমল মিত্রর ছোট মেয়ে চন্দনা ঘোষ’। তিনি আরও জানিয়েছিলেন – “পরবর্তী কালে বাবা সরকারি কালেক্টরেটে চাকরি পান। দীর্ঘ এগারো বছর সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু তাঁর সেই চাকরি স্থায়ী ছিল না। স্থায়ী করার জন্য বাবা কখনওই কাউকে ধরাধরি করেননি। সে জাতের মানুষই ছিলেন না তিনি।”
ইতিমধ্যে ‘শৌখিন নাট্যদলে’ কমল মিত্রর জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল। তিনি ‘বর্ধমান’, ‘আসানসোল’, ‘রানিগঞ্জ’ ইত্যাদি জায়গায় নাটকে অভিনয় করে বেড়াতেন। এই সময়ে একদিন ‘আসানসোলের ব্যারেট ক্লাব’-এ ‘আলমগীর’ নাটকে ‘জয়সিংহর ভুমিকায়’ তাঁকে অভিনয় করতে দেখে ‘আসানসোলের এস ডি ও’ (আই সি এস) ‘ম্যাক ইনার্নে’ সাহেব তাঁকে কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। কমল মিত্রকে তিনি বলেছিলেন, “কেন এখানে পড়ে আছ? তুমি নিজেই জানো না তোমার মধ্যে কী জিনিস লুকিয়ে!”
বিশের দশকে ছাত্র অবস্থাতেই কমল মিত্র কলকাতায় আসা-যাওয়া শুরু করে দেন। উদ্দেশ্য, ‘সাধারণ রঙ্গালয়’ বা ‘চলচ্চিত্রে’ অভিনয় করার সুযোগ খোঁজা। সেই সময় কলকাতায় এলে তিনি উঠতেন ‘দর্জিপাড়ায় তাঁর দিদির বাড়িতে’। পাশে ‘কাশী বোস লেনে’ থাকতেন নামকরা অভিনেতা ‘দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’। ‘কমল মিত্রর ডাক্তার ভগ্নিপতি’র সঙ্গে দুর্গাদাসবাবুর বন্ধুত্ব ছিল। সেই সুবাদে কমল গিয়েছিলেন ‘দুর্গাদাসের কাছে’ একটা সুযোগের আশায়। তখন ‘চিত্রা’ সিনেমায় (আজকের ‘মিত্রা’) ‘দুর্গাদাসের’ ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। কমলের অভিনয় করার ইচ্ছের কথা শুনে ‘দুর্গাদাস’ বলেছিলেন, “এ জগতে কোনও ভদ্রসন্তানের আসা উচিত নয়। আমার এখন ছেড়ে যাওয়ার উপায় নেই, তাই পড়ে আছি, তবু মাঝে মাঝে মনে সন্দেহ হয় যে আমি নিজে ভদ্রসন্তান কিনা? বাড়ি গিয়ে লেখাপড়া করোগে, মন দিয়ে অন্য কাজ কর্ম করো। তাতে ইজ্জত পাবে কিন্তু এখানে পাবে না।’’
কিন্তু কমল মিত্র হাল ছাড়েননি। ‘বর্ধমানে’ থাকতে চলে যেতেন ‘দামোদর নদীর তীরে’ গলা ছাড়তে, চিৎকার করে সংলাপ বলা অভ্যেস করতেন মঞ্চে অভিনয়ের উপযুক্ত কণ্ঠস্বর তৈরি করতে। যত দিন না তাঁর গলা একই মাত্রায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছিল ‘দামোদরের নির্জন চরের’ ওপার থেকে, তত দিন এই অধ্যবসায় জারি ছিল।
‘বর্ধমান কালেক্টরেটের অফিসে’ কমলবাবুর সহকর্মী ছিলেন ‘কবি কনক মুখোপাধ্যায়’। তাঁর মাধ্যমে ‘ভারতলক্ষ্মী স্টুডিয়ো’র ‘চিত্রপরিচালক গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায়’ ও ‘সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের’ সঙ্গে কমল মিত্রর পরিচয় হয়। কিন্তু তাঁদের মুখ থেকে ‘স্তোকবাক্য’ শোনা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এর পর ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বোমা পড়ার আতঙ্কে’ অনেকের মতো চিত্রপরিচালক ‘দেবকীকুমার বসু’ও কলকাতা ছেড়ে ‘কালনা’য় তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। ‘বর্ধমান শহর’ থেকে ‘কালনা’র দূরত্ব খুব বেশি নয়। খবর পেয়ে কমলবাবু হাজির হয়েছিলেন সেখানে। কমলকে তিনি হতাশ করেননি। পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘কালেক্টরেটের চাকরি’টা না ছেড়ে তাঁর ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে।
ভরসা দিয়েছিলেন আরও একজন। ‘নাট্যচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী’ স্বয়ং। ‘শিশির ভাদুড়ী’ ‘নাট্টনিকেতন থিয়েটারের’ নাম বদলে ‘শ্রীরঙ্গম’ দিয়ে (পরে ‘বিশ্বরূপা’) ‘জীবনরঙ্গ’ নাটক মঞ্চস্থ করতে তখন উদ্যোগী। নতুন অভিনেতা চেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। সেই বিজ্ঞাপনের সূত্রেই কমল মিত্র নাট্যাচার্যের সামনে হাজির হয়েছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাথের’ ‘পণরক্ষা’ কবিতাটি আবৃত্তি করতে বলা হয়েছিল তাঁকে। কমলের আবৃত্তি শুনে ‘শিশির ভাদুড়ী’ বলেছিলেন, “কমল, ইউ পোজেস আ ভেরি রিচ ভয়েস।” কিন্তু তার পরও ‘‘এখানেও ইতি হয়ে গেল’’, লিখেছেন কমল মিত্র।
পথের সন্ধান অবশ্য প্রথম এসেছিল চলচ্চিত্র জগৎ থেকে। ‘গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায়’ ‘নীলাঙ্গুরীয়’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্রে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। চরিত্রটি ছিল ‘নায়কের বন্ধুর’। ‘একটি মাত্র সংলাপ’। নায়কের টেব্লে গিয়ে বলতে হবে, ‘‘আপনি তো দেখছি মশাই একটি বর্ণচোরা আম!’’ এটাই ছিল ‘কমল মিত্রের চলচ্চিত্র জীবনে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলা প্রথম সংলাপ ও শট’। অবশ্য তার জন্য কোনও ‘পারিশ্রমিক’ তিনি পাননি। পারিশ্রমিক প্রথম পেয়েছিলেন ‘দেবকী বসু’র হিন্দি ‘রামানুজ’ ছবিতে ‘একজন সৈন্যর ভুমিকা’য় অভিনয় করে। এখানেও ‘হিন্দি সংলাপ’ ছিল একটি, ‘‘মুঝে মাফ কিজিয়ে মহারাজ। ম্যায় নেহি জানতা।’’ সংলাপ বলতে-বলতে তাঁকে ‘মহারাজরূপী’ ‘ধীরাজ ভট্টাচার্য’র হাতে চাবুক খেতে হয়েছিল। এই শট দিতে গিয়েই জীবনে প্রথম ‘টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ার লাঞ্চ খাওয়ার সৌভাগ্য’ হয়েছিল তাঁর। পরে অবশ্য এই ‘ধীরাজ ভট্টাচার্য’র ‘পিতার ভুমিকায়’ কমল মিত্র অভিনয় করেছিলেন ‘সতী’ ছবিতে।
‘নীলাঙ্গুরীয়’ তাঁর জীবনের প্রথম ছবি বলে ধরা হলেও, ১৯৪৩ সালে ‘দেবকী বসু’র ‘শ্রীরামানুজ’ ছবি দিয়েই তাঁর ‘চলচ্চিত্র অভিনয়ের যাত্রা’ শুরু হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে ‘দেবকী বসু’র পরের হিন্দি ছবি ‘স্বর্গ সে সুন্দর মেরা দেশ’ ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। ওই বছরই ‘নীরেন লাহিড়ী’ পরিচালিত ‘বনফুল’। এটিও হিন্দি ছবি। ‘দেবকীবাবু’র ছবিতেই কমল মিত্রকে ‘হিন্দি ভাষা’ শিখতে হয়েছিল। হিন্দি তাঁর একদমই জানা না থাকায় প্রথম দিকে মুশকিলে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি শিক্ষক রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে ‘হিন্দি’ ও ‘উর্দু’ ভাষা রপ্ত করেছিলেন। কারণ, তখন কলকাতা থেকেই হিন্দি ছবি তৈরির রেওয়াজ ছিল। আর সে সব ছবির দর্শক ছিল সারা ভারতব্যাপী।
১৯৪৫ সালের পর থেকে কমল মিত্র বাংলা চলচ্চিত্রের পরিচালকদের কাছে নতুন প্রতিভা হিসেবে গণ্য হতে থাকেন। দেখা যাচ্ছে ‘দেবকী বসু’র সঙ্গে-সঙ্গে ‘নীরেন লাহিড়ী’, ‘অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়’ (‘সংগ্রাম’ ১৯৪৬), ‘অপূর্বকুমার মিত্র’ (‘তুমি আর আমি’ ১৯৪৬) ‘হেমেন গুপ্ত’ (‘অভিযাত্রী’ ১৯৪৭), ‘অগ্রদূত’ (‘সমাপিকা’ ১৯৪৮) ও তাঁদেরই ছবি ‘সব্যসাচী’তে একেবারে নামভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। ১৯৪৪ সালে অভিনেতা ‘বিপিন গুপ্ত’র সুপারিশে তিনি ‘স্টার থিয়েটারে’ যোগ দেন। স্টারের নিয়ম মেনে সেই সময়ে অভিনেতাদের চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় বের করা শক্ত ছিল। স্টারে তখন ‘মহেন্দ্র গুপ্ত রচিত ও পরিচালিত’ ‘টিপু সুলতান’ নাটক অভিনীত হচ্ছিল। সে নাটকে তিনি ‘ব্রেথওয়েট’ চরিত্রে অভিনয় করতে ‘সর্বপ্রথম কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয় মঞ্চে’ অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ওই বছরেই ‘বিপিন গুপ্ত’ হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করতে মুম্বই চলে গেলে কমল মিত্র সুযোগ পেয়েছিলেন নাটকের নামভূমিকায় অভিনয় করার। টানা ১১৯ রজনী তিনি ওই নাটকে ‘টিপুর ভুমিকায়’ অভিনয় করেছিলেন। সেই নাটকই তাঁকে সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনেতার সম্মান এনে দিয়েছিল। এর পরই তিনি ‘কালেক্টরেটের সরকারি চাকরি’ থেকে ইস্তফা দিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা করে নিয়েছিলেন। কাজটি করার আগে অবশ্য ‘দেবকী বসু’র অনুমতি নিয়েছিলেন।
চলচ্চিত্র ও থিয়েটারে অভিনয়ের কারণে কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ‘পিতৃবন্ধু রায়বাহাদুর হৃষীকেশ বিশ্বাসের কলকাতার ১ নং শিবশঙ্কর লেনের বাড়িতে’ একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন কমল মিত্র। খাওয়া বলতে কলকাতার ‘পাইস হোটেলের’ কম পয়সার দু’বেলার খাবার। কখনও পয়সা না থাকলে ‘একবেলা শুধুই চপ আর জল’ খেয়ে রাত কাটিয়ে দিতেন। ‘ইকমিক কুকারে’ রান্না করে খেয়েও চালিয়েছিলেন দীর্ঘ তিন বছর। এই সংগ্রামী জীবনের দিনগুলো কমলবাবু চিরকাল মনে রেখেছিলেন। তাঁর ‘বড় মেয়ে বন্দনা’র বক্তব্যে, “বাবা এই কারণে খুব মিতব্যয়ী ছিলেন। আমাদের মা-ও খরচ সামলে সংসার চালাতে জানতেন। আমাদের কখনও কোনও কিছুর অভাব যেমন রাখেননি, তেমনই কারও কাছে এক পয়সা ধারবাকি রাখাও বাবা পছন্দ করতেন না।”
‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে’ স্মৃতিকথা লিখতে বসে কমল মিত্র অভিনয় জীবনের শুরুর দিনগুলোর কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন অতি যত্নে। ‘প্রায় প্রত্যেক সহ-অভিনেতার কথা’, ‘কলকাতায় তাঁর সময়ে চালু থাকা চোদ্দোটি স্টুডিয়োর নামধাম’ (যার প্রতিটিতে তিনি কাজ করেছেন), ‘বিভিন্ন রঙ্গালয়ের নাম’ (যার প্রত্যেকটিতে তিনি অভিনয় করেছেন), ‘এমনকী শুটিং ও রঙ্গমঞ্চে অভিনয় চলাকালীন নানা অম্লমধুর কাহিনী’, তাঁর সময়ের ‘চলচ্চিত্র ও থিয়েটারের অভিনয় জগতের অনুপুঙ্খ ছবি’ সযত্ন তুলে ধরেছেন। ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের’ কথায়, “কমল মিত্রর বাইরের ইমেজ (সেই ইমেজ অবশ্যই তাঁর অভিনীত চরিত্র থেকেই তৈরি হয়েছিল), গুরুগম্ভীর গলা, নায়ক-নায়িকার প্রেমের প্রশ্নে রীতিমতো খারাপ বাবা বা জ্যাঠামশাই। কিন্তু বাস্তবিক ও ব্যক্তিগত জীবনে ওঁর মতো স্নেহপ্রবণ মানুষ আমি কমই দেখেছি। আর মিথ্যে বলে কোনও কথা উনি জানতেনই না।”
‘লিলি চক্রবর্তী’ তাঁর প্রথম ছবি ‘ভানু পেল লটারি’তে কাজ করতে এসে প্রথম দিনই কমল মিত্র, ‘জহর রায়ের’ মুখোমুখি হয়েছিলেন। সে এক অভিজ্ঞতা! তিনি আজও স্মরণ করেন কমল মিত্রের স্নেহভরা মনকে। পরবর্তী কালে ‘শ্রেয়সী’ নাটকে অভিনয় চলাকালীন একদিন দাঁতের যন্ত্রণায় কাবু হয়ে পড়েছিলেন ‘লিলি চক্রবর্তী’। সেই যন্ত্রণার হাত থেকে তাঁকে আশ্চর্য ক্ষমতায় মন্ত্রপাঠ ও গাছগাছালি দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন কমল মিত্র। এই সব অলৌকিক গুণ নাকি তাঁর ছিল। ‘বড় মেয়ে বন্দনা’র মতে, এই বিদ্যা তিনি শিখেছিলেন তাঁদের জমিদারির নায়েবের কাছ থেকে।
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কমল মিত্র একাধারে যেমন ‘নীলাঙ্গুরীয়’, ‘শ্রীরামানুজ’, ‘বনফুল’, ‘সংগ্রাম’, ‘তুমি আর আমি’, ‘পূর্বরঙ’, ‘অভিযাত্রী’ ইত্যাদি ছবিতে কাজ করেছিলেন, তেমনই ওই একই সময়ে ‘টিপু সুলতান’, ‘কেদার রায়’, ‘গৈরিক পতাকা’, ‘সীতারাম’ নাটকে অভিনয় করে একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতার স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই খ্যাতির কারণেই ‘স্টার থিয়েটারের’ অভিনেতা হলেও ‘সুকুমার দাশগুপ্ত’ তাঁকে ‘সাত নম্বর বাড়ি’-তে অভিনয় করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ছবিতেই কমল মিত্র ‘প্রথম ও শেষ’ ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্লে-ব্যাকে’ দু’টি গানে লিপ দিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে কমল মিত্র বিবাহ-সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিছুটা আকস্মিক ভাবেই। ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা ও ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের টানে’ কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের আক্রমণ অনিবার্য হয়ে গিয়েছিল। তাই “একরাত্রে যখন ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল, তার পর দিন সকালেই গাড়ি নিয়ে সোজা বর্ধমান। বাড়ি পৌঁছে কোনও ভূমিকা না করে বাবাকে বললুম, আমি বিয়ে করতে চাই। এবং সম্ভব হলে এখুনি। আপনি পাত্রী দেখার ব্যবস্থা দেখুন।” তাঁর নিজের কথায়, “আমি বর্ধমান জেলার অন্তর্গত মেমারীর জমিদার মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ মহাশয়ের চতুর্থ কন্যাকে বিবাহ করি।”
ইতিমধ্যে উত্তর কলকাতার ‘শিবশঙ্কর মল্লিক লেন’ ছেড়ে কমল মিত্র উঠে এসেছিলেন ‘ভবানীপুরের রায় স্ট্রিটের’ একটা ছোট দোতলা বাড়িতে, ভাড়া নিয়ে। এই বাড়িতেই তিনি সংসার পেতেছিলেন। বর্ধমান থেকে বাবা ও মাকে নিয়ে এসেছিলেন। পরে ১৯৫৬/৫৭ সালে ‘শরৎ বসু রোডে’ একটা একতলা বাড়ি কিনে সেটাকে দোতলায় বদলে নিয়েছিলেন। সেই বাড়িটা আজও দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় লেখা ‘কে মিটার’ ফলকটি আজও অসামান্য এই অভিনেতাকে মনে করিয়ে দেয় পথচারীদের।
চলচ্চিত্র পর্দার কমল মিত্রর চারিত্রিক গাম্ভীর্যের সঙ্গে পারিবারিক কমল মিত্রর খুব মিল ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন তাঁর কন্যারা। ‘স্ত্রী অর্চনা’, ‘বড় মেয়ে বন্দনা’, ‘ছেলে ইন্দ্রজিৎ’ ও ‘ছোট মেয়ে চন্দনা’কে নিয়ে তাঁর ছিল ভরা সংসার। ‘বন্দনা ও চন্দনার স্মৃতিচারণে’ পাওয়া যায়, ছোটবেলায় তাঁরা দেখেছিলেন, কমল মিত্র সারাদিন শুটিং করে ফিরে বাড়ির সবাইকে নিয়ে আড্ডায় বসতেন। “বাবা কোনও দিনও আমাদের সামনে সিনেমার গল্প করতেন না। কেউ যদি শুটিং দেখার আবদার করত বিরক্ত হতেন। আমাদের কোনও দিন সিনেমা দেখতে নিয়ে যাননি। স্কুল-কলেজে অনেকেই আমাদের পরিচয় জানত। তারা যখন আমাদের কোনও নাটকে অভিনয়ের কথা বলত, আমরা বলতাম, বাবা পছন্দ করবেন না। আমাদের সব সময়ে কড়া নজরের মধ্যে রেখে উনি মানুষ করেছেন। বাড়িটা ছিল ওঁর কাছে একেবারেই ব্যক্তিগত একটা জায়গা। তবে বৈঠকখানায় অনেক নামীদামি অভিনেতাকে আসতে দেখেছি। তাঁরা বাবার সঙ্গে গল্প করতে আসতেন। তখন মায়ের ডাক পড়ত। আমরাও সবাই মিলে সেই আড্ডায় যোগ দিতাম। বেশি আসতেন সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, জীবেন বসু … উত্তমকুমারও এসেছেন। বাবা সিনেমায় যেমন, বাড়িতেও তেমন কড়া মানুষ ছিলেন। অথচ কার কী দরকার তার খবর ঠিক রাখতেন। আমাদের বলতে হত না।”
১৯৪৯ সালে অবশেষে তিনি ‘শ্রীরঙ্গম’ থেকে ‘নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের’ ডাক পেয়েছিলেন, ‘পরিচয়’ নাটকের জন্য। তার পর ‘ছবি বিশ্বাস’ তাঁকে ডেকে ‘মিনার্ভার পরিচালনার দায়িত্বভার’ তুলে দিয়েছিলেন। সেখানে ‘জীবনটাই নাটক’-এর নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। ‘রিজিয়া’, ‘সীতা’, ‘আলমগীর’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘ভ্রমর’ (কৃষ্ণকান্তের উইলের নাট্যরূপ), ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘মহানায়ক শশাঙ্ক’, ‘এরাও মানুষ’ ইত্যাদি নাটকের পর তিনি ‘মিনার্ভা থিয়েটারের’ সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন বলে জানিয়েছেন ‘দেবনারায়ণ গুপ্ত’। ১৯৬৩ সালে ‘নীহাররঞ্জন রায়ের’ ‘তাপসী’ নাটকে অধ্যাপক ‘ভবেন্দ্রনাথ’-এর চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন কমল মিত্র। এই নাটকেই ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’ প্রথম মঞ্চে অভিনয় করতে এসেছিলেন।
’তাপসী’র পর কমলবাবু ‘স্টার থিয়েটারে’ আর কোনও নাটক অভিনয় করেননি। ‘দেবনারায়ণ গুপ্তের’ কথায়, “কমল কলকাতার প্রায় প্রতিটি রঙ্গমঞ্চেই কাজ করেছেন, কিন্তু কোনও মঞ্চ-মালিকই তাঁকে বেশি দিন আটকে রাখতে পারেননি, তার কারণ কমল বড় ‘একরোখা মানুষ’ ছিলেন। যদি তিনি মনে করতেন তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগছে, তা হলেই তিনি সেখান থেকে সরে আসতেন।” ‘রঙ্গনা’ ছাড়ার পর জীবনে শেষবারের জন্য মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৯৮৩ সালে ‘সোনার খোঁজে’ নাটকে এক ‘গোয়েন্দা অফিসারের ভুমিকায়’।
অন্য দিকে চলচ্চিত্রেও ১৯৮১ সালে ‘তরুণ মজুমদারের’ ‘খেলার পুতুল’ ও ‘অগ্রদূত গোষ্ঠীর’ ‘সূর্যসাক্ষী’ ছবিতে শেষবারের জন্য অভিনয় করে ‘অভিনয় জগৎ’ থেকে চিরকালের জন্য ‘অবসর’ নিয়েছিলেন। ‘তরুণ মজুমদারের স্মৃতিচারণে’ জানা যায়, “আমার ছবিতে ওঁর মতো একজন অভিনেতাকে দরকার ছিল। তাই আমি ওঁর কাছে যাই। ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে টিভি দেখছিলেন। আমায় খুবই স্নেহ করতেন। তাঁকে বললাম ‘খেলার পুতুল’-এ কাজ করার কথা। বললেন, ‘আমি তো ছেড়ে দিয়েছি রে’। আমি যখন বললাম তা হলে তো ছবিটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তখন বললেন ‘মুশকিলে ফেললি রে’। কাজটা করেছিলেন।’’
বাইরে থেকে দেখতে কঠোর এই মানুষটির ভিতরটা যে কত কোমল ছিল, তার পরিচয় পেয়েছিলেন অভিনেতা ‘হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়’। আবার খুব স্পষ্টবক্তা ছিলেন। ‘সত্যজিৎ রায়ের’ ‘পরশপাথর’ ছবিতে অভিনয় করার অনুরোধ নিয়ে তাঁর ‘প্রোডাকশন ম্যানেজার ভানুবাবু’ এসেছিলেন কমল মিত্রের বাড়িতে। সব শুনে কমল মিত্রের স্পষ্ট জবাব ছিল, “মাথা খারাপ, আমি যাব সত্যজিৎবাবুর ছবিতে কাজ করতে! আমার ভাই খুব মুখ খারাপ। কখন কী বেরিয়ে যাবে!” কিন্তু ‘সত্যজিৎ’ হাল ছাড়েননি। কমল মিত্রকে তাঁর চাই-ই। বলেছিলেন, “শুটিংয়ের সময় না হয় একটু সামলে থাকবেন।”
কমল মিত্র অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলির মধ্যে আছে ‘কংস’, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘দেয়ানেয়া’, ‘আনন্দমঠ’, ‘জিঘাংসা’, ‘সব্যসাচী’, ‘লৌহকপাট’, ‘আশিতে আসিও না’, ‘সবার উপরে’, ‘বন্ধু’, ভানু পেল লটারী’, ‘শেষ অঙ্ক’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘তিন ভুবনের পারে’, ‘হারমোনিয়াম’, ‘পিতাপুত্র’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘বর্ণালী’ ইত্যাদি। ‘দেবকীকুমার বসু’ থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমার আদি যুগের বহু খ্যাতিমান পরিচালকের ছবিতে যেমন কাজ করেছিলেন, তেমনই পরবর্তী কালে ‘অজয় কর’, ‘তপন সিনহা’, ‘তরুণ মজুমদার’, ‘রাজেন তরফদার’ এমনকী ‘সত্যজিৎ রায়ের’ ‘পরশপাথর’ ছবিতে ছোট একটি পার্টির দৃশ্যেও তিনি ছিলেন স্ব-মহিমায়।
‘নাট্যচার্য শিশিরকুমার’ তাঁকে বলেছিলেন, “কমল নোট মুখস্ত করে এম এ পাশ করা যায়, কিন্তু যে লাইনে তুমি ঢুকেছ, এখানে শেখার শেষ কোনও দিন হবে না, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে শিখতে হবে।” কথাটা কমল মিত্র আজীবন মনে রেখেছিলেন। দেশ বিদেশের নানা বই জোগাড় করে ‘অভিনয়কলা’কে তিনি আয়ত্ত করেছিলেন আশ্চর্য নিষ্ঠায়। ‘চার্লি চ্যাপলিন’ ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা। শেষ বয়সে তাঁর সারা জীবনে সংগৃহীত বহু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিশাল ভাণ্ডার ‘কলকাতার নন্দনের লাইব্রেরি’তে দান করে দিয়েছিলেন, কেবলমাত্র ‘চ্যাপলিনের আত্মজীবনী’টি ছাড়া।
শেষ দিকে কমল মিত্র ক্রমশঃ একা হয়ে পড়েছিলেন। বলতেন, “প্রায় সব সহশিল্পী চলে গেল। এমনকী যারা বয়সে আমার ছোট তাঁরাও রইল না। ছবি, পাহাড়ি, জহর (গাঙ্গুলি), অসিতবরণ, বিকাশের সঙ্গে অনেক বছর ধরে কাজ করেছি। সেটে আর তাঁরা আসবে না, এই কথা যখন ভাবি তখন নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ লাগে। এমনকী উত্তম, ভানু, জহরও চলে গেল। একদিন স্টুডিয়োতে দেখি পরিচালক অজয় কর ঢুকছেন, তাঁকে দেখে একজন অপরজনকে জিজ্ঞেস করছে ‘লোকটা কে রে?’, সে কথা শুনে মনে হয়েছিল, আমারও স্টুডিয়ো পাড়া ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।”
কাউকে কিছু না জানিয়েই কমল মিত্র সরে দাঁড়িয়েছিলেন ‘অভিনয় জগৎ’ থেকে। যেমন অনাহুতের মতো তাঁর আগমন ঘটেছিল ‘বাংলার চলচ্চিত্র ও রঙ্গালয়ে’, তেমনই অনাড়ম্বর ছিল তাঁর প্রস্থান। বাংলা সিনেমার ‘রাগী পিতা’ বড় অভিমানে ক্যামেরার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের ‘মৃত্যুর মুহূর্তকে’ কমল মিত্র আশ্চর্য ক্ষমতায় বুঝতে পেরেছিলেন। ‘নিজের শ্রাদ্ধশান্তির যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা’ গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের উপর কড়া নির্দেশ ছিল, কোনও ভাবেই যেন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া না হয়। তাঁর মৃত্যুশয্যার পাশে উপস্থিত ‘স্ত্রী’, ‘মেয়ে’, ‘জামাই’ সবাইকে অবাক করে দিয়ে, শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে উপস্থিত সকলের কাছে জীবনে স্বকৃত কোনও অজানা অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে, মৃত্যুর কোলে যেন সজ্ঞানেই ঢলে পড়েছিলেন। ঠিক যেমনটি বাংলা সিনেমায় হয়! ২রা আগস্ট ১৯৯৩ সালে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর ৮ মাস।
(তথ্যসূত্র:
১- Five iconic villains of Bengali cinema, The Times of India, May 7, 2018.
২- ছায়াছবির মানিক ও সন্ধানী ফেলুদা, পবিত্র মুখোপাধ্যায়।
৩- ফ্ল্যাশব্যাক, কমল মিত্র।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত