(দুর্লভ ছবিগুলি শ্রী চিন্ময় চৌধুরী লিখিত দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ‘আমাদের গর্ব বিনয় বাদল দিনেশ’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত)
১৯২৮ সালে কোলকাতায় কংগ্রেসের সভায় আপাতদৃষ্টিতে ‘মতিলাল নেহরু’র আগমনে তাঁকে সামরিক কায়দায় অভিনন্দন জানাবার জন্যে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অনুপ্রেরণায়’ ‘সুভাষ চন্দ্র বসু’ গঠন করলেন ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’। এর ‘জিওসি’ ছিলেন ‘সুভাষ বসু’ নিজে এবং সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হল ‘মেজর সত্য গুপ্ত’কে। কংগ্রেস সভা শেষ হয়ে গেলে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’কে আরও সংগঠিত করে গড়ে তুলতে ‘সত্য গুপ্ত’ সারা বাংলায় ঘুরে বেড়ালেন এবং একটি শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তুললেন। ঢাকায় ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ এর কর্মকান্ডে যুক্ত হলেন অনেকেই, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ‘মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র’ ‘বিনয় কৃষ্ণ বসু’।
পুলিশের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ‘বাংলার ইনস্পেক্টর জেনারেল অব পুলিশ’ ‘এফ জে লোম্যান’ এবং ‘ঢাকার সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ’ ‘ই হাডসন’কে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৩০ সাল, ২৯শে আগস্ট সকাল, ‘বাংলার ইনস্পেক্টর জেনারেল অব পুলিশ’ ‘এফ জে লোম্যান’ এবং ঢাকার সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ’ ‘ই হাডসন’ তদানীন্তন ‘ভারপ্রাপ্ত গভর্ণর হিউ স্টিফেনসনের স্ত্রী’র ‘এলো মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল ও হাসপাতাল’ পরিদর্শন উপলক্ষ্যে তদারকির কাজে এলেন ‘মিটফোর্ড হাসপাতালে’। পুলিশের সতর্ক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই ‘লোম্যান’কে হত্যার উদ্দেশ্যে বিপ্লবীরা হাসপাতালে রোগী বেশে অবস্থান করছিলেন। বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন ‘বিনয় বসু’। ‘এফ জে লোম্যান’ পরিদর্শন শেষে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পরপরই ‘বিনয় বসু’র রিভলবারের গুলিতে গুরুতর আহত হলেন তিনি এবং ‘হাডসন’। কলকাতা থেকে বিমান যোগে চিকিৎসকদল এসেও ‘দেহের গ্রোয়েন অঞ্চলে’ গুলিবিদ্ধ ‘লোম্যান’কে বাঁচাতে পারেনি। মনে করা হয় বুলেট শিরদাঁড়াকেও আঘাত করেছিল। ‘বিনয় বসু’ সুকৌশলে মুহূর্তের হাসপাতাল ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যান। ‘লোম্যান’ হত্যাকারী ‘বিপ্লবী বিনয় বসু’কে উদ্দেশ্য করে সেদিন বাংলার অপরাজেয় কথাশিল্পী ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ তাঁকে আর্শিবাদ করে বলেছিলেন, “ধন্যি ছেলে, দেখিয়ে গেছে আমরাও জবাব দিতে জানি”।
এই ঘটনার পর ঢাকায় সর্বত্র পুলিশের অমানুষিক অত্যাচার শুরু হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে ‘বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ’ ‘এফ জে লোম্যান’কে হত্যা করার পর এক আততায়ীর নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ‘ঢাকা পুলিশের’ অকর্মণ্যতার পরিচায়ক। সুতারং অকর্মণ্যতার গ্লানি দূর করার জন্য আসামীর সন্ধান করতে পুলিশ হন্যে হয়ে ওঠে। যুবকদের ধরে থানায় আটক রেখে নির্যাতন চালায়। পুলিশের অন্যায় অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠে ঢাকাবাসী। পুলিশের ভয়ে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। ‘লোম্যান’ হত্যাকারী আততায়ীকে পুলিশ ধরতে সক্ষম না হলেও আততায়ী যুবক সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিল। ‘বিনয় কৃষ্ণ বসু’ জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। ‘ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমা’র ‘রোহিতভোগ গ্রামে’। তাঁর বাবার নাম ‘রেবতীমোহন বসু’। তিনি ছিলেন একজন ‘প্রকৌশলী’। বিনয়ের বাবা পরিবার নিয়ে ঢাকাতে বসবাস করতেন। তাই ‘বিনয় বসু’ ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বড় হয়েছেন। সম্ভবতঃ ‘ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল’ থেকে ‘ম্যাট্রিক’ পাস করার পর তিনি ‘মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল’ (বর্তমানের স্যার ‘সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ’)-এ ভর্তি হন। এই সময় ‘বিনয় বসু’ বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী ‘হেমচন্দ্র ঘোষের’ সংস্পর্শে এসে বিপ্লববাদী ‘যুগান্তর দলে’ যুক্ত হন তিনি। শৈশব থেকে ‘বিনয় বসু’ ছিলেন প্রচন্ড জেদী ও সাহসী। বিপ্লববাদী দলে যুক্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর অসীম সাহস ও দূরদর্শিতা দিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার শপথ নেন। তিনি বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার পর সহপাঠীদের অনেককেই বিপ্লবী দলে যুক্ত করেন। ১৯২৮ সালে তিনি ও তাঁর সহপাঠী সহযোদ্ধারা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’-এ যুক্ত হন। এই বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই ‘বিনয় বসু’ এই দলের ঢাকা শাখা গড়ে তোলেন।
পুলিশ সারা বাংলা তন্নতন্ন করে ‘বিনয় বসু’কে গ্রেফতার করার জন্য খুঁজে ফেরে। সর্বত্র ‘বিনয় বসু’র ছবিযুক্ত পোস্টার লাগান হয়। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা, পাঁচ হাজার মতান্তরে দশ হাজার, পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোথাও ‘বিনয় বসু’কে পাওয়া গেল না।
আর অন্যদিকে ‘বিনয় বসু’ ও দলীয় সদস্য ‘সুপতি রায়’ মুসলিম শ্রমিক বেশে ‘দোলাইগঞ্জ’ (‘গেণ্ডারিয়া’) রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে ‘চাষাড়া’ যান। ‘চাষাড়া স্টেশনে’ ট্রেন থামা মাত্র তাঁরা দেখতে পেলেন, পুলিশ প্রতিটি কামরায় উঠে আততায়ীকে ধরার জন্য ‘চিরুনী অভিযান’ চালাচ্ছে। ‘বিনয় বসু’ ও ‘সুপতি রায়’ খুব সতর্কভাবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যান। তাঁরা দু’জন স্থানীয় বিপ্লবী ‘গিরিজা সেনের বাড়িতে’ আত্মগোপন করেন। পরদিন ভোরে তাঁরা খেয়া পার হয়ে বন্দরে যান (‘নারায়নগঞ্জ শহরের’ বিপরীত পাড়)। সেখান থেকে ‘বৈদ্যনাথবাজার’। তারপর ‘মেঘনা’ পাড়ি দেওয়ার পালা। ‘মেঘনা’ পাড়ি দেওয়ার জন্য মুসলমান শ্রমিকের বেশ পরিত্যাগ করে ‘সুপতি রায়’ জমিদার এবং ‘বিনয় বসু’ জমিদার ভৃত্যের ছদ্মবেশ ধারণ করেন। ‘বিনয় বসু’ জমিদারের (‘সুপতি রায়’) সফরের জন্য একখানা নৌকা জোগাড় করেন। শুরু হয় ‘মেঘনা’ পাড়ি। নৌকা থেকে একসময় স্টীমারে উঠতে সক্ষম হন। স্টীমারে উঠে আবার মুসলমান শ্রমিকের বেশ ধরেন। তারপর স্টীমারে চড়ে ‘ভৈরব স্টেশন’, সেখান থেকে ট্রেনে চড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ‘কিশোরগঞ্জ স্টেশনে’ ট্রেন থামলে পুলিশ আততায়ী ধরার জন্য ট্রেনে উঠে গাড়ীর কামরাগুলো একে একে তল্লাশি চালানো শুরু করলে তাঁরা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। হঠাৎ জানালার পাশে টিটিকে দেখে দুজনে তড়িঘড়ি গাড়ি থেকে নেমে টিটির কাছে টিকিট না করে ট্রেনের চাপার জন্যে ক্ষমা চান। দুজনই টিটির সাথে টিকেট ঘরের দিকে টিকিট কাটতে চলে যান। ইতিমধ্যে ট্রেনের সকল কামরা তল্লাশি করা শেষ হয়ে যায়। ভীত যাত্রীর অভিনয়ে কোন রকমে পার পান সে যাত্রা। দুজনে গিয়ে ট্রেনে ওঠেন। ট্র্রেন চলে ‘ময়মনসিংহ’ স্টেশনের পথে।
‘ময়মনসিংহ স্টেশনে’ আবার এক বিপদ। ট্র্রেন থামার সাথে সাথে এক দারোগা তাঁদের বগিতে উঠে তল্লাশি শুরু করে। ‘বিনয় বসু’ ও ‘সুপতি রায়’ ততক্ষণাৎ পুলিশকে ফাঁকি দেওয়ার পরামর্শ সেরে নেন। ‘বিনয় বসু’ ছেঁড়া কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন আর ‘সুপতি রায়’ দু-হাত জোড় করে দারোগাকে ‘তাঁর ভাতিজা’ অসুস্থ বলে জানান, ‘‘মনে হয় বসন্ত হইছে’’ বলায় বসন্তরোগভীত দারোগা পরবর্তী স্টেশনে কাপড় মুড়ি দেয়া ‘বিনয়ের’ মুখ না দেখেই সদলবলে নেমে যায়। সেখান থেকে তাঁরা নিরাপদে ‘জগন্নাথগঞ্জ’, ‘সিরাজগঞ্জ’ হয়ে থেকে সোজা ‘কলকাতা দমদম স্টেশনে’ নেমে ‘ওয়ালীউল্লাহ লেনে অবস্থিত বিপ্লবী সুরেশ মজুমদারের বাড়িতে’ গিয়ে ওঠেন। ‘সুরেশ বাবু’র বাড়ি ছিল বিপ্লবীদের অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
ঢাকা থেকে বহু বিপদ-আপদের পথ পাড়ি দিয়ে ‘বিনয়’ বসু কলকাতা পৌঁছলেও নেতৃবৃন্দ নিশ্চিন্ত বোধ করেননি। তাঁরা ‘বিনয়’কে সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য ‘কাতারামগড়’ কোলিয়ারীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। অন্যদিকে কলকাতা পুলিশ সবগুলো রেলস্টেশনে ‘বিনয়’কে ধরবার জন্যে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল। ‘ব্যান্ডেল স্টেশনে’ সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বন্দুক হাতে প্রস্তুত। দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই কলকাতাগামী ট্রেন এসে পৌঁছাবে। তাঁদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবগুলো কামরা বিশেষভাবে তল্লাশি করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। কারণ এই গাড়ীতেই ‘বিনয় বসু’র থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রেন এসেছে এমন সময় ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের’ মোটর গাড়ি দেখে পুলিশ বিস্মিত হল। তাঁরা দেখল মোটর গাড়ি হতে নামলেন ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কনফিডেন্টসিয়াল ক্লার্ক সরোজ রায়’ এবং তাঁর সঙ্গে দু’জন আত্মীয়। আত্মীয় দুজনকে ট্রেনের কামরায় তুলে দিয়ে হাসি মুখে পুলিশকে ‘‘চারদিকে নজর রেখো’’ বলে সাবধান করে ‘সরোজ বাবু’ গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। ‘সরোজ বাবু’র আত্মীয় দু’জনের একজন ছিলেন ‘বিনয় বসু’।
‘বিনয় বসু’ ‘কাতারামগড় কোলিয়ারীতে অনাথ দাশগুপ্তের বাড়ী’ চলে গেলেন। এই বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের আর একটি গোপন আস্তানা। সেখান থেকে তিনি কিছুদিন পর ফিরে এলেন কলকাতায়। নেতারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন ‘বিনয়ের’ নিরাপত্তার জন্যে। বিপ্লবীরা নেতৃবৃন্দের কাছে এব্যাপারে পরামর্শ চাইলে ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়’, ‘লেডী অবলা বসু’, ‘শরৎ বসু’, ‘সুভাষ বসু’, ‘শরৎ চাটার্জি’সহ প্রায় সকল নেতাই আত্মরক্ষার জন্য ‘বিনয় বসু’কে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার উপদেশ দেন। সেই মত তাঁকে বিদেশ পাঠানোর জন্য ‘কিংস-বর্জ ডকের জনৈক পদস্থ কর্মচারীকে’ও ঠিক করা হল। পরদিন তাঁকে সমুদ্রগামী একখানা জাহাজে তুলে দেওয়া হবে। যাতে করে তিনি সোজা ‘ইটালী’তে যেতে পারেন। কিন্তু সকল পরামর্শ ও প্রস্তুতির অবসান ঘটালেন ‘বিনয়’ নিজেই, কিছুতেই মাতৃভূমি ছেড়ে যাবেন না তিনি, জানিয়ে দিলেন নেতাদের। পরবর্তী অভিযানে অংশ গ্রহণের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করলেন।
ওই বছর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতন শতগুণে বেড়ে যায়। শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে জেলে আটক রেখে চলে নির্যাতন। এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ ‘সুভাষচন্দ্র বসু’, ‘যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত’ এবং ‘সত্য বক্সী’র মতো নেতৃত্বকেও গ্রেফতার করে ‘আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে’ আটকে রাখে। একের পর এক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করায় ‘আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে’ নতুন বন্দীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছিল না। জেলের মধ্যে সৃষ্টি হলো এক অসহনীয় অবস্থা। রাজবন্দীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছিল। তাঁরা ‘জেলকোড’ অনুযায়ী কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ বেদমভাবে লাঠি চালায়। চলে নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার। ‘সুভাষ বসু’, ‘যতীন্দ্রমোহন’ এবং ‘সত্য বক্সী’রাও বাদ গেলেন না এই অত্যাচার থেকে। এঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ল জেলের ভিতরে। জানা গেল এই অত্যাচারের পিছনে রয়েছে ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসন’। বিপ্লবীদের টার্গেট হল ‘কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল লে. কর্নেল সিম্পসন’। যিনি বসতেন ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এ। বন্দীদের উপর পাশবিক নির্যাতনের জন্য ‘কুখ্যাত’ ছিল ‘সিম্পসন’। তাই ‘সিম্পসনের’ নাম বিপ্লবীদের হত্যা তালিকার শীর্ষে ছিল। তাই বিপ্লবীদের পরবর্তী অভিযান ছিল কলকাতার ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ। অসংখ্য পুলিশ প্রহরী পরিবেষ্টিত দুর্ভেদ্য অফিস ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। এই ভবন আক্রমণ করে সেখান থেকে ফেরার আশা কেউ করতে পারে না। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা চলল কে এই আক্রমণ পরিচালনা করবেন? বিপ্লবী নেতারা অনেক ভেবেচিন্তে এই দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন ‘বিনয় বসু’কে। তাঁর সঙ্গী হলেন আরো দু’জন নির্ভীক যুবক। ‘মুন্সিগঞ্জ মহকুমার যশোলঙের সতীশচন্দ্র গুপ্তের পুত্র দীনেশ গুপ্ত’ ও ‘মুন্সিগঞ্জ মহকুমার পূর্ব শিমুলিয়ার অবনী গুপ্তের পুত্র সন্তান বাদল গুপ্ত’। কিশোর বয়স থেকেই ‘বিনয় বসু’, ‘দীনেশ গুপ্ত’ ও ‘বাদল গুপ্ত’ পরস্পর পরিচিত ছিলেন। বিপ্লবী নেতারা স্থির করলেন ভারত সরকারের সরকারী অফিসের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কেন্দ্রস্থল ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করে দেখাতে হবে যে বিপ্লবীরা সক্রিয় রয়েছেন। তাঁদের একজনকে জেলে বন্দী করলে দশজন অগ্রসর হয়।
ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। বয়স্ক রাতটা তারাদের হাত ধরে পুরানো বাসায় ফেরার তোড়জোড় করছে। কুয়াশায় ভেজা ফুটপাতে কৃষ্ণচূড়া ফুলের অলস শয্যা। ‘৭০নং পার্ক স্ট্রিট’। বাড়ির দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। সুপ্ত শহরবাসীকে উদ্বিগ্ন না করে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন ‘বাদল গুপ্ত’, ‘দীনেশ গুপ্ত’। কুড়ির কাছাকাছি বয়স। পরনে সামরিক সজ্জা। ‘নিকুঞ্জ সেনের তত্ত্বাবধানে’ উঠে পড়লেন একটা ট্যাক্সিতে। ফাঁকা রাস্তায় ঝড়ের বেগে ছুটলো গাড়ি। খানিক বাদে পৌঁছলেন ‘খিদিরপুর পাইপ রোডের’ নির্দিষ্ট স্থানে। অন্যদিকে, ‘মেটিয়াব্রুজের রাজেন গুহের বাড়ি’ থেকে পথে নামলেন ‘বিনয় বসু’। ‘রসময় শূরের’ সঙ্গে চলে এলেন ‘পাইপ রোডে’। তারপর ‘বিনয়’, ‘বাদল’, ‘দীনেশ’ একসঙ্গে শুরু করলেন সেই ‘ঐতিহাসিক যাত্রা’। যা আজও শিহরণ জাগায় মনের অন্দরমহলে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উধাও ঠাণ্ডার আমেজ। সময় গড়াচ্ছে। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনে সেই পরিচিত ব্যস্ততা। গাড়ি-ঘোড়ার দুড়দাড় দৌড়। অজস্র মানুষের হাঁকডাক। লালমুখো সাহেবরা লালবাড়িটাতে ঢুকছেন বেরোচ্ছেন। প্রতি গেটে সিপাহীদের কড়া পাহারা। অপরিচিতদের দেখলেই হাজারো জিজ্ঞাসাবাদ। এগারোটা নাগাদ মহাকরণের সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে এলেন তিনজন। ধীরে সুস্থে এগিয়ে গেলেন। রাস্তা পেরিয়ে চলে এলেন ‘পশ্চিম গেটের সামনে’। সান্ত্রীরা কোনো প্রশ্ন করলো না। তাঁদের ‘সাহেবী পোশাক এবং চলন বলন’ দেখে কারো মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি। মাথায় সুন্দর টুপি, গলায় ঝোলানো মাফলার। ইউরোপীয়দের মতো গটগট করে ঢুকে গেলেন। বিল্ডিংয়ে ঢোকামাত্রই তাঁদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। চোখের দৃষ্টিতে প্রতিশোধের আগুন। অলস ভঙ্গি নিমেষে উধাও। তড়িৎগতিতে সিঁড়ি পেরোতে লাগলেন। তাঁদের লক্ষ্য বড় বড় আমলাদের ঘরের দিকে।
১৯৩০ সালের ৮ই ডিসেম্বর এ্যাকশনের জন্য তিন বিপ্লবী প্রস্তুত। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ এর একটি কক্ষে ‘কারা বিভাগের সর্বময় কর্তা ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এস এন সিম্পসন’ তাঁর কাজকর্ম পরিচালনা করছেন। তাঁর ‘ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞান গুহ’ পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন। বেলা ঠিক ১২টা। বিলাতী পোশাকে তিন বাঙালী যুবক ‘কর্নেল সিম্পসনের’ সাক্ষাৎ পেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তাঁরা ‘সিম্পসনের সহকারীকে’ ঠেলে কামরার ভিতরে প্রবেশ করল। হঠাৎ পদধ্বনী শুনে কর্নেল তাঁদের দিকে তাকালেন। বিস্ময়-বিমূঢ় চিত্তে দেখলেন সম্মুখে তিন বাঙালী যুবক হাতে রিভলবার তাঁর সামনে দণ্ডায়মান। মুহূর্তের মধ্যে ‘বিনয়ের কণ্ঠে’ ধ্বনিত হল, ‘‘প্রে টু গড কর্নেল। ইওর লাষ্ট আওয়ার হ্যাস কাম।’’ কথাগুলো উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি রিভলবার থেকে ছয়টি বুলেট ‘সিম্পসনের’ দেহ ভেদ করে বের হয়ে গেল। ‘সিম্পসনের নিথর দেহ’ লুটিয়ে পড়লো মেঝের উপর।
মুহুর্তে আক্রমণ প্রতিরোধে ছুটে এলো পুলিশ। ‘রাইটার্স বিল্ডিঙের করিডোরে’ শুরু হল যুদ্ধ, ‘স্টেটসম্যান পত্রিকা’ এই যুদ্ধকে নাম দিয়েছিল “veranda battle” বা “বারান্দা যুদ্ধ”। একদিকে তিন বাঙালী যুবক, হাতে শুধুমাত্র তিনটি রিভলবার। আর অন্যদিকে ‘পুলিশ কমিশনার টেগার্ট’ ও ‘ডেপুটি কমিশনার গার্ডনের নেতৃত্বে রাইফেলধারী সুশিক্ষিত পুলিশ’। এক পর্যায়ে যুদ্ধে আহত হলেন ‘জুডিশিয়াল সেক্রেটারী নেলসন’। ডাক পড়ল ‘গুর্খা বাহিনীর’।
এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে পালাতে ব্যস্ত সমস্ত রাইটার্স বিল্ডিং, বিভীষিকাময় অবস্থা, রিদিকে শুধু ছুটাছুটি, কলরব- কোলাহল- চিৎকার আর শুধু এক রব ‘‘বাঁচতে চাও তো পালাও’’। ‘দীনেশের’ পিঠে একটি গুলি বিদ্ধ হল। তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। অসংকোচে গুলিবর্ষণ করতে লাগলেন শত্রুকে লক্ষ্য করে। যতক্ষণ পর্যন্ত ‘বিনয়-বাদল-দিনেশের’ হাতে গুলি ছিল, ততক্ষণ কেউ তাঁদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারেননি। একপর্যায়ে বিপ্লবীদের গুলি নিঃশেষ হল। ‘গুর্খা ফৌজ’ অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলল। তখন তিনজন বিপ্লবী একটি শূন্য কক্ষে প্রবেশ করলেন। ‘বাদল’ সঙ্গে আনা ‘সায়েনাইডের পুরিয়া’ মুখে দিলেন। ‘বাদল’ শহীদ হলেন। ‘বিনয়’ ও ‘দীনেশ’ নিজেদের রিভলভারের শেষ বুলেট দুটি ব্যবহার করলেন নিজেদের মস্তক লক্ষ্য করে। দু’জনেই আহত হয়ে ধরা পড়লেন। ‘গুরুতর আহত বিনয় ও দীনেশ’কে পুলিশ ‘মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে’ পাঠিয়ে দিল।
চিকিৎসায় সামান্য সুস্থ হয়ে উঠলেন দু’জনেই। ‘বিনয় বসু’ মেডিকেল ছাত্র, তাঁর জানা ছিল ‘এনাটমি’। জানতেন মৃত্যুর সম্ভাব্য পথ। ১৪ই ডিসেম্বর রাতে কাঙ্খিত মৃত্যুকে বরণ করার জন্য মস্তিষ্কের ব্যাণ্ডেজের ভিতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে নিজ মস্তিষ্ক বের করে আনেন এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেন মৃত্যুঞ্জয়ী বীর ‘বিনয় কৃষ্ণ বসু’।
ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টায় ‘দীনেশ’ অপারেশনের পরে বেঁচে উঠেছিলেন। কিঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাঁকে পাঠানো হয় ‘আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের কনডেমড সেলে’। এরপরেই ঘটনাক্রম যেদিকে মোড় নেয় ও ‘দীনেশ গুপ্তের’ সাথে ব্রিটিশ সরকার যে ব্যবহার ও অত্যাচার করেছিল, তাতে ইংরেজদের সুসভ্য জাতি হিসেবে চিনতে ভুল হয়। আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে যুদ্ধে আহত শত্রুকে স্ট্রেচারে করে ‘আন্তর্জাতিক রেডক্রস’ বা নিজেদের হাসপাতালে রাখার নিয়ম – সে সুস্থ হয়ে গেলে তাঁকে ‘যুদ্ধবন্দী’ করে রাখা যেতে পারে। কিন্তু ইংরেজরা ভারতীয় বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে কোন নিয়মের ধার ধারত না। ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়ান মাস্টার্স’ বইয়ের ১২২ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘ব্রুটালি টরচার্ড ইন জেল’ – যে ব্যক্তি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছিল তাঁকে ঘটনাচক্রে ইংরেজরা বাঁচিয়ে তোলে, তারপরে তাঁকে জেলবন্দী করে তাঁর উপরে অকথ্য অত্যাচার চালায়। যদিও এত অত্যাচার চালিয়েও ইংরেজরা ‘দীনেশের মুখ’ থেকে একটা কথাও বার করতে সমর্থ হন নি। এরপরে শুরু হয় বিচারের প্রহসন। ‘আলিপুরের ডিস্ট্রিক্ট জজ মি. গার্লিক’কে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সভাপতি করে একটি ‘ট্রাইব্যুনাল’ গঠিত হয়। লোক দেখানো বিচারে ‘দীনেশের’ ফাঁসির হুকুম হয়। ‘দীনেশের’ ফাঁসির হুকুম শুনে সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ, ‘সিম্পসন’কে হত্যা করার জন্য তিনজন গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, কার গুলিতে ‘সিম্পসনের মৃত্যু’ ঘটে এবং সেটা কিভাবে জানা গেল। উল্লেখ্য যে দীনেশ কোন ধরনের স্বীকরোক্তি গোছের কিছুই দেন নি। ‘বাদল’ ও ‘বিনয়’, এই দু’জনে আগেই মারা গিয়েছিলেন – এই দু’জনের কারও গুলিতে যে ‘সিম্পসনের’ মৃত্যু হয় নি সেটা ট্রাইব্যুনাল কিভাবে নিশ্চিত হয়েছিল? এই প্রশ্নের সম্মুখে ‘দীনেশ গুপ্তের’ পক্ষে একটা ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ থেকে গিয়েছিল। অথচ ঠিক এই রকমই একটা পরিস্থিতিতে প্রানদণ্ডে দণ্ডিত হয়েও ‘শ্রী প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী’র (পরবর্তীকালে বাস্তুহারা নেতা) মৃত্যুদণ্ড নাকচ হয়ে গিয়েছিল। ওদিকে সুসভ্য বলে খ্যাত ইংরেজদের বিচার ব্যবস্থায় একটা কথা চালু আছে যে, শত শত দোষী ব্যক্তি ছাড়া পায় তো পাক, কিন্তু একজন নির্দোষ ব্যক্তিও যেন সাজা না পায় – বস্তুত ‘দীনেশ গুপ্তের’ ক্ষেত্রে সেকথা খাটে নি। এই ঘটনায় সাধারণ মানুষ এতটাই ক্রুদ্ধ হয়েছিল যে, ‘দীনেশ গুপ্তের’ ফাঁসির পরে ‘গার্লিক’ তাঁর জীবনের কুড়ি দিনও পার করতে পারেন নি। ‘সাতকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ ‘যুগান্তর’ দলের ‘কানাই ভট্টাচার্য’ নামে এক যুবক, ‘গার্লিক’কে গুলি করে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন। দেশবাসী দীনেশকে বাঁচানোর জন্য ‘জয়েন্ট ডিফেন্স কমিটি’ গড়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলা চালায়। কিন্তু ‘স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল’ পুরানো আদেশই বহাল রাখে। ১৯৩১ সালের ৭ই জুলাই ‘দীনেশ গুপ্তের’ ফাঁসি কার্যকর হয়।
(তথ্যসূত্র:
১- আমি সুভাষ বলছি, শৈলেশ দে।
২- মুক্তির মন্দির সোপান তলে, দীপক কুমার রায় ও অরুণা চৌধুরী।
৩- বৃটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জীবনকথা, তপন কুমার দে, জাগৃতি প্রকাশনী।
৪- যা ইতিহাসে নেই, বিমল মিত্র, বিপ্লবীদের কথা (২০১৪)।
৫- শহীদ দীনেশ গুপ্তের জীবন, অসিতাভ দাশ, সাহিত্য ও পত্রাবলী।
৬- মনে রেখো, বঙ্গেশ্বর রায়।
৭- গণশক্তি পত্রিকা, ১৯শে জুন ২০১১ সাল।
৮- বিনয়-বাদল-দীনেশ, শৈলেশ দে।
৯- আমাদের গর্ব বিনয় বাদল দিনেশ, চিন্ময় চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত