দাসপাড়ায় হইচই পড়ে গেল। একজন মরা মানুষ ফিরে এসেছে। দলে দলে লোক দেখতে এল তাঁকে। শিশুরা মায়ের পেছনে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি মারছে, যেন তাঁরা ভূত দেখছে। দাওয়ায় বসে আছে লালু। একটা লুঙ্গি পরা, খালি গা। সারা গায়ে আর মুখেও কালো কালো বসন্তের দাগ, একটা চক্ষু বোজা। তাঁর চেহারা বদলে গেছে অনেক। দু-চারজন ফিসফিস করে কানাকানি করতে লাগল। এ পদ্মাবতীর ছেলে লালু নয়, এ অন্য মানুষ। নিতান্ত উড়ো খবর তো নয়, বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্বয়ং ‘কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন’ এসে বলেছেন যে, তাঁরা লালুকে মরতে দেখেছেন। কবিরাজমশাই ধন্বন্তরীর মতন, তিনি কারুর মৃত্যু ঘোষণা করলে তাঁর পক্ষে কি আর বেঁচে থাকা সম্ভব? তা ছাড়া তাঁর মুখাগ্নি করা হয়েছিল। সেই মানুষ বেঁচে ফিরে আসছে। এ একটা গাঁজাখুরি কথা নয়। ও নাকি এখন মুসলমান? বাড়ি থেকে বেরুল হিন্দুর ছেলে, ফিরে এল মুসলমান হয়ে, ছি ছি, এমন কথা শোনাও পাপ! এঁকে কোনওক্রমেই আর লালু বলে মানা যাবে না। পদ্মাবতী প্রথমে গুপি-তাহেরের সঙ্গে লালুকে উঠোনে পা দিতে দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘‘কে? কে? এ কি আমার লালু? আঁ? লালু?’’ এত বেশি আবেগ যে, তিনি পড়ে গিয়েছিলেন মাটিতে। তখন তাঁর মাথায় জল দিতে হয়। তিনি আবার চোখ মেলার পর লালু বলেছিল, ‘‘হ মা, আমি।’’ তারপর আত্মস্থ হয়ে পদ্মাবতী তাহেরদের কাছ থেকে সব শুনলেন। তখন আবার অন্যরকম আবেগ শুরু হল। তিনি কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, ‘‘হা আমার পোড়া কপাল। আমি ভাবলাম, ভগবান বুঝি মুখ তুলে চেয়েছেন। কিন্তু এ কী হল? ছেলে মোছলমানের ঘরে ভাত খেয়েছে। মোছলমান মেয়েমানুষকে মা বলে ডেকেছে। এখন আমি এ ছেলেকে ঘরে নিই কী করে? এর থেকে যে আমার মরণও ভালো ছিল। আমি আগেই মরলাম না কেন?’’ গোলাপি ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। তাঁর চক্ষু থেকেও অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে, হয়তো তা আনন্দের অশ্রু, কিন্তু মুখে কোনও কথা নেই। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মতামত। কয়েকজন বলল, মন্ত্র উচ্চারণ করে যে মানুষের শ্রাদ্ধ পর্যন্ত হয়ে গেছে, তাঁকে আবার জীবিত বলে গণ্য করা যায় কীভাবে? কয়েকজন বলল, ও যখন মোছলমান হয়েছে, তখন তো আর হিন্দু সমাজের মধ্যে থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ওর মা যদিও বা ওকে রাখে, তা হলে ওদের একঘরে করা হবে। ওরা কোনও কাজ পাবে না। খাবে কী করে? লালুর সঙ্গে কেউ কথা বলছে না, পদ্মাবতীকে আড়ালে ডেকে নানাজনে নানা পরামর্শ দিচ্ছে। কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন সেনের কাছেও খবর পৌঁছোল। প্রথমে তিনি একবার ভাবলেন, স্বয়ং এই আগন্তুককে দেখতে আসবেন। তারপর মত বদল করলেন। দেখার কী আছে, তিনি তো ভালোভাবেই জানেন, লালু বেঁচে নেই। একটুও প্রাণের চিহ্ন থাকলে কি তিনি তাঁকে বাঁচাবার সবরকম চেষ্টা করতেন না? মুখাগ্নি করতে তো তিনিই বলেছিলেন। অন্য কেউ এসেছে। কুমতলবে, তিনি তাঁর মুখ দর্শনও করতে চান না। এমনকী ‘ফুলু ঠাকুরানি’, বন্যার সময় লালু যাঁর প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করেছিল, এ-সংবাদ শোনার পর তিনি মৃগী রোগীর মতন ছটফট করতে লাগলেন। চক্ষু কপালে তুলে বলতে লাগলেন, ‘‘আঁ! কস কী? অমন ভালোমানুষের পোলাডা ধম্ম খাইছে? জাইত গেছে? দেখিস যেন সে আমার বাড়ির ত্রিসীমানাতেও আর না-আসে।’’ সব লোকই সন্ধের পর বিদেয় নেয়। অন্ধকার নেমে এলে গ্রামের মানুষ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে থাকে না। এই সময় সাপখোপের বড় ভয়। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেল। লালুর থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে গালে হাত দিয়ে বসে রইলেন পদ্মাবতী। গোলাপি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে দরজার ধারে। কোনও কথা নেই। এরপর কী হবে? খানিক বাদে, পদ্মাবতীর খেয়াল হল যে, লালু কতক্ষণ আগে এসেছে, তাঁকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। এবেলার ডাল-ভাত ওবেলাই রান্না করা থাকে। রান্নাঘরের পেছনে গোটাকতক কলাগাছ। একটা কলাপাতা কেটে আনলেন পদ্মাবতী লালুর সামনে কলাপাতাটা পেতে দিয়ে একটু দূর থেকে ভাত বেড়ে দিলেন। ক্ষুধার্ত লালু হাত বাড়াতেই পদ্মাবতী বললেন, ‘‘দেখিস বাবা, আমারে ছুঁয়ে দিস না যেন।’’ লালুর নিজস্ব একটা কাঁসার থালা আছে। বরাবর সে তাতেই খায়। কলাপাতা দেখে সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘‘আমার থালাটা বিক্রি করে দিয়েছ নাকি?’’ পদ্মাবতী বললেন, ‘‘না, দিই নাই। এখন তো বাড়ির থালা-বাসনে খেতে নাই। কলাপাতাও তত ভালো। বউমা, একটা কুপি জ্বাল।’’ লালু বলল, ‘‘বৃষ্টির ছাঁট আসতেছে। ঘরের মইধ্যে যেতে হবে।’’ পদ্মাবতী বললেন, ‘‘না রে, ঘরেও তো যাওয়া যাবে না। ঘরে যে রাধা কৃষ্ণ, লক্ষ্মী-জনার্দন আছেন।’’ লালু বলল, ‘‘ঠাকুরের ছবি আর সরা? সেগুলান একপাশে সরায়ে রাখলে হয় না?’’ পদ্মাবতী বললেন, ‘‘ছিঃ বাবা, ও কথা বলতে নাই। ঠাকুর-দেবতাদের কি সরাতে আছে?’’ লালু জিজ্ঞেস করল, ‘‘রাত্তিরে আমি শোব কোথায়?’’ পদ্মাবতী করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘‘তোকে একটু কষ্ট করে বাইরেই শুতে হবে। তুই মুসলমান হইছিস। হিন্দুর ঠাকুর-দেবতার সামনে তোর তো আর যাইতে নাই।’’ লালু একটু গলা তুলে অসহিষ্ণুভাবে বলল, ‘‘তোমরা তখন থেকে বলতেছ, আমি মোছলমান হইছি। মোছলমান হইছি, কই, আমি তো কলমা পড়ে মোছলমান হই নাই! আমি তো যেমন ছিলাম, তেমনই আছি।’’ পদ্মাবতী বললেন, ‘‘তুই যে যবনের হাতের অন্ন খেয়েছিস, তাতেই হিন্দুদের জাত চলে যায়।’’ লালু জিজ্ঞেস করল, ‘‘কীভাবে জাত গেল? শরীল থিকা কি ফুস কইরা বাইরাইয়া যায়? জানতে পারলে ধরে রাখতাম। কিছু ট্যারও পাইলাম না!’’ পদ্মাবতী বললেন, ‘‘ওরে, এসব নিয়া তর্ক করতে নাই। আমরা আর কতটুকু জানি। সমাজের মাথারা যা বলেন, আমরা তাই শুনি।’’ লালুর চকিতে মনে পড়ল ‘সিরাজ সাঁই’-এর কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘তর্ক করতে নাই। তর্কে কোনও লাভ হয় না।’’ সে আবার শান্তভাবে বলল, ‘‘আমার জাত গেছে। আমি আর ঘরের মইধ্যে ঢোকতে পারব না। ঝড়বাদল যাই হোক, আমারে এই দাওয়ায় থাকতে হবে?’’ পদ্মাবতী বললেন, ‘‘দেখি কী করা যায়। কয়েকটা দিন একটু কষ্ট কর। একজন বুঝদার লোক কইল, তুই যদি চিত্তির করোস, পুরুত ডাইক্যা শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা যায় আর গ্রামের মানুষদের একবেলা ভোজন করানো যায়, তাইলে সব শোধন হয়ে যাঝে কিন্তু তাতে যে অনেক খরচ। আমার তো টাকাপয়সা কিছু নাই, দেখি যদি কেউ হাওলাত দেয়।’’ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সুরে নয়, খুব সহজভাবে লালু বলল, ‘‘আমি শুধু প্রায়শ্চিত্ত করলে হবে না, পুরুতকে টাকা দিতে হবে। গ্রামের মানুষদের খাওয়াতে হবে। অনেক টাকা খরচ করলে তবে আমি জাত ফিরে পাব!’’ অন্নস্পর্শ করেনি সে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘‘অমন জাতে আমার দরকার নাই মা। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।’’ পদ্মাবতী ব্যাকুল হয়ে বললেন, ‘‘সে কী! কোথায় যাবি! কোথায় যাবি।’’ লালু বলল, ‘‘বুঝে গেছি। এ-বাড়িতে আমার ঠাঁই নাই। তোমারে আর আমি বিপদে ফেলতে চাই না।’’ পদ্মাবতী বললেন, ‘‘ওরে লালু, আমি তো জানি, তুই আমার বুকের ধন। তুই আমার একমাত্র সন্তান। তোকে ফিরে পেয়েও আবার ছেড়ে দিলে আমি বাঁচব কেমন করে?’’ লালু বলল, ‘‘যাঁর জাত চলে যায় সে আর তোমার সন্তান থাকে না। আমি তো প্রায় মরেই গেছিলাম, ধরে নাও আমি বাঁইচ্যা উঠি নাই। যেখানে জাত পাতের ঠেলাঠেলি নাই, আমি তেমন জায়গায় চলে যাব।’’ পদ্মাবতী হাহাকার করে বললেন, ‘‘তেমন জায়গা কি কোথাও আছে? সবখানেই তো দেখি হিন্দু, না মোছলমান না কেরেস্তান নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে থাকে। একসময় দেখি সকলের মইধ্যেই গলাগলি ভাব, আবার এক এক সময় হাতাহাতি, হাঙ্গামা, কাজিয়া।’’ লালু বলল, ‘‘আছে। বন-জঙ্গলের পশুপাখিরা জাত-ধর্ম কিছু মানে না। জাত নাই, তাই জাতও হারায় না। আমি তাদের সাথে গিয়া থাকব।’’ এবার সে গোলাপির দিকে ফিরে বলল, ‘‘তুমি যাবা আমার সাথে?’’ গোলাপি বলল, ‘‘আমি কোথায় যাব। আমি কোথায় যাব?’’ লালু বলল, ‘‘আমি যেখানে যাব, তুমি আমার সাথে থাকবে।’’ গোলাপি বলল, ‘‘আমার ভয় করে, আমার ভয় করে।’’ লালু ঠিক তিনবার ওই একই প্রশ্ন করল তাঁর স্ত্রীকে। তারপর বলল, ‘‘তয় তুমিও থাকো আমার মায়ের কাছে।’’ দাওয়া থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল লালু। পদ্মাবতী পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে চিৎকার করতে লাগলেন, ‘‘লালু, দাঁড়া, দাঁড়া। শোন আমার কথা।’’ লালুও তখন দৌড়োত শুরু করেছে। সেদিন আকাশে জ্যোৎস্না ছিলনা। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল লালু।
‘‘মানুষ তত্ত্ব যার সত্য হয় মনে
সে কি অন্য তত্ত্ব মানে
মাটির ঢিপি কাঠের ছবি
ভূত ভবিষ্যৎ দেবা দেবী
ভোলে না সে এসব রূপী
মানুষ ভজে দিব্য জ্ঞানে।’’
১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবরে ‘হিতকরী’ পত্রিকার মতে, ১১৬ বছর বয়সে লালনের মৃত্যু হয়। আর ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ যান শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের দেখা হয়নি। অন্যদের কন্ঠে তিনি লালনের গান শুনেছেন। ছেঁউরিয়ার লালন মাজারের ধারেপাশে এখনও একটি গুঞ্জন শোনা যায়, ‘রবীন্দ্রনাথ নাকি লালন সাঁই-এর গান লেখা মূল খাতাটি এনেছিলেন। কিন্তু আর ফেরত দেননি’। যদিও এ অভিযোগের যথার্থ উত্তর দিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন, জমিদারি এস্টেটের কর্মী বামাচরণ ভট্টাচার্য ওই খাতাটির গানগুলি নকল করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ তার থেকেই কুড়িটি বেছে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ‘প্রবাসী’তে প্রকাশ করেন। এর পরেই সুধী জনের নজরে আসে বাউল এবং বাউলগান। এর পর শিলাইদহ থেকে স্থায়ী ভাবে শান্তিনিকেতন চলে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ও-পার বাংলার লোকায়ত মরমি সুর আর রাঢ় বাংলার রুক্ষ রৌদ্ররসে ভেজা সুরের সমন্বয় তাঁকে আকুল করেছে। তিনি উভয় ক্ষেত্রেই খুঁজে পেয়েছেন উপনিষদের বার্তা। আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরেছেন বাংলার বাউলগানের আন্তরসত্তাকে। মূলত তিনি এবং তাঁর শান্তিনিকেতনই লালন ফকির ও বাউল গানের আবিষ্কারক ও প্রচারক।
বাউলের তথা লোকায়ত সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রাধান্য পায়নি কোনও দিন, মূর্তি পুজোও সেখানে গুরুত্বহীন। তাই যখন লালন গাইলেন – ‘‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে …।’’ তখনই প্রিয় হয়ে উঠলেন তিনি। অবশ্য ভারতের মাটিতে বহু আগেই মানব মহাসম্মিলনের গান গেয়ে গিয়েছেন মহা-সাধকেরা। নানুরের কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস তো কবেই বলেছেন, ‘‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’’ তার পরে ১৪৭৪-এ নিত্যানন্দ, ১৮৮৬-তে চৈতন্য দেব মনুষ্যত্ব, মানবতা আর মানব প্রেমের আলোকমালায় সাজিয়ে দিয়েছেন এ ভারতভূমি। নিত্যানন্দের ছেলে বীরচন্দ্রই মূলত তথাকথিত পতিত-অন্ত্যজ-ব্রাত্য জনকে বৈষ্ণবের ছত্রচ্ছায়ায় এনে হাজির করেছেন, মর্যাদা দিয়েছেন। আউল-বাউল-সাঁই-দরবেশ -কর্তাভজা-রামকানালি এমন বহু গৌণ গোষ্ঠী সাধন পথের ভিন্নতা সত্তেও মানবপ্রেম ও সম্মিলনের বার্তাই দিয়ে এসেছে। সিরাজ সাঁই, লালন ফকির, দুদ্দু শাহ থেকে সমস্ত বাউল জনই সেই পথের পথিক। বরং লালনের থেকে দুদ্দু আরও খানিকটা এগিয়ে। তিনি তখনই বলতে পেরেছিলেন – ‘‘জাতাজাতি সৃষ্টি করে ভারতকে শ্মশানে দিলে …।’’
এবারে ফিরে যাই অনেক অতীতে। হরিনাথ মজুমদারের বাড়িতে তখনও আগুন লাগানো হয়নি। তবে তাঁর বাড়ি ঘিরে বসে আছে ছয় লাঠিয়াল। তাঁদের একজনের হাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে মশাল। এক্ষুনি বুঝি ছারখার হবে সব! বন্ধ ঘরের ভিতরে কাঙালের বাড়ির লোক অশ্রুসজল নয়নে জানলার বাইরের দিকে চেয়ে। এমন বিপদের কথা, হরিনাথ কি জানে? উঠোনে বসে গুড়ুক গুড়ুক করে একজন ফরসা-টুকটুকে চেহারার টেকো লোক তামাক টানছে। সম্ভবত ঠাকুরবাড়ির নায়েব। হঠাৎ ছায়াময় জঙ্গল ফুঁড়ে, একজন মানুষ তাঁর দলবল সমেত রণ-পায়ে সটান টেকো লোকটার একেবারে সামনে এসে উপস্থিত হল। সে মাটিতে নামতেই নায়েব বাজখাঁই স্বরে প্রশ্ন করল, ‘‘কে তুই?’’ উত্তর এল, ‘‘আমরা হরিনাথের বন্ধু।’’ নায়েব ব্যাঙ্গের সুরে বলল, ‘‘বন্ধু! নিজে লুকিয়ে থেকে তোদের পাঠিয়েছে!’’ অপর পক্ষ থেকে উত্তর এল, ‘‘হ্যাঁ বন্ধু। কাঙালের কি খাজনা বাকি আছে? যত দূর জানি, সে তো ইস্কুল গড়ার জন্য সব দিয়ে দিয়েছে। তবু তাকে ধরতে এসেছেন কেন?’’ নায়েব হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘‘সে কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে নাকি! ভালো চাস তো এই বেলা সরে পড়।’’ পাল্টা হুঙ্কার এল, ‘‘পিছু হঠতে আমরা আসিনি কত্তা! হরিনাথকে ধরলে লাশ পড়বে। রক্তারক্তি হবে! তার চেয়ে দেশে আইন আছে …।’’ নায়েব ক্ষেপে উঠে বললেন, ‘‘কী! আমাকে আইন দেখাচ্ছিস! ওরে কে আছিস …!’’ কাঙাল হরিনাথের ‘বন্ধু’ বলে পরিচয় দিয়ে নায়েবের সামনে রুখে দাঁড়ানো এই ঋজু-মানুষটি কে ছিলেন? তিনি ছিলেন দুই বাংলার মানুষ-রতন ফকির লালন সাঁই। এ কাহিনীর সত্যতা কত দূর, সে তথ্য-প্রমাণ মেলে না আজ আর। লালনের জীবন-নির্ভর উপন্যাস ‘মনের মানুষ’-এ ইতিহাস আর কল্পনার আশ্রয়ে গড়া এ কাহিনী যে ফকিরের ‘প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক জীবনকাহিনী’ নয়, তা জানিয়েছিলেন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্বয়ং। তবে, কাঙালের সঙ্গে ফকিরের সখ্য মিথ্যে নয়। চির সত্য। ইতিহাস নিজেই তার সাক্ষ্য দেয়। হরিনাথের উদ্যোগেই তাঁর ‘ব্রহ্মাণ্ডবেদ’ সংকলনে সেই ১২৯২-এ প্রথম লালনের গান প্রকাশ করেন। গানটি ছিল, ‘কে বোঝে সাঁইয়ের লীলাখেলা’। দু’জনের জন্ম হয়েছিল একই এলাকায়, কুমারখালির গড়াই নদীর এপার আর ওপারে। হরিনাথ তাঁর সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’য় শিলাইদহের জমিদার ঠাকুরদের প্রজাপীড়নের খবর প্রকাশ করতেন। তাই তাঁকে শায়েস্তা করতে লাঠিয়াল নিয়ে সদলে নায়েব এসে হাজির হয় বাড়িতে। সে খবর পেয়ে প্রাণের দোসর হরিনাথের পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে একতারার বদলে লালন লাঠি হাতে রুখে দাঁড়ান। খালি হাতে ফিরতে হয় নায়েবকে! কাঙাল নাকি নিজেই তাঁর ডায়েরিতে লিখে গিয়েছেন এই ঘটনার কথা! কিন্তু তারই বা হদিশ কই? আসলে সাঁই তাঁর আত্মপরিচয় সম্পর্কে বেশ নীরব ও নিস্পৃহ ছিলেন। তিনি তাঁর গানেও আত্মপরিচয় ‘লিখিয়া ঢাকেন’। তাঁর ছিল, ‘শব্দের ঘর নিঃশব্দের কুঁড়ে’। সেই জন্যই হয়তো এত বিতর্ক, এত চর্চা এক দীন ফকিরের জীবনের আয়নামহল ঘিরে।
এর অনেক বছর পরে লালন সাঁইয়ের মুখোমুখি বসে রবিঠাকুর তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘তোমাদের ধর্মের বিশেষত্বটি কি, আমাকে বলতে পার?’’ লালন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘বলা বড় কঠিন, ঠিক বলা যায় না।’’ ফকির কথাটা শেষ করতেই রবিঠাকুর অন্য কি একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন। তার ফাঁকে ফকিরের এক সহচর বলল, ‘‘বলা যায় বৈকি কথাটা সহজ। আমরা বলি এই যে, গুরুর উপদেশে গোড়ায় আপনাকে জানতে হবে। যখন আপনাকে জানি, তখন সেই আপনার মধ্যে তাঁকে পাওয়া যায়।’’ এ বার রবিঠাকুর একটু ধন্দ্বে পড়লেন। উঠে গিয়ে বোটের একেবারে কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালেন। দূরে, বহু দূরে কুমারখালির দিকে পদ্মা যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চেয়ে রইলেন। শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে তাঁর জোব্বায়, চিকনের কাজে। রাঙা রোদ আলপনা আঁকছে পদ্মার জলে। কবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমাদের এই ধর্মের কথা পৃথিবীর লোককে সবাইকে শোনাও না কেন?’’ ফকিরসাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কবির কাছে এসে বললেন, ‘‘যার পিপাসা হবে, সে গঙ্গার কাছে আপনি আসবে।’’ ‘বাংলাদেশের একটি ছোটো নদীর ধারে এক সামান্য কুটিরে’-র বাসিন্দা এই দুই ফকিরের মধ্যে লালন ছিলেন কি না তার উল্লেখ করেননি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মবোধ’ প্রবন্ধে। কিন্তু পড়ন্ত বিকেলের পদ্মার আশমানি হাওয়ায় কান পাতলে এখনও সুদূর থেকে শোনা যায় কবি আর ফকিরের এমন সংলাপ। তাহলে কি দু’জনের মধ্যে সত্যিই কখনও দেখা হয়েছিল? লালন চর্চার বড় অংশজুড়ে তর্ক সে নিয়েই! কেন না, রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে যখন শিলাইদহে গেলেন, সেটা লালনের মৃত্যুর পরের বছর, ১৮৯১ সালে। সে সময় শিলাইদহে লালন ঘনিষ্ঠ গগন হরকরা, সর্বক্ষেপি, গোঁসাই গোপালের সঙ্গে কবির নিত্য লালনের গান ও দর্শন নিয়ে কথা হত। ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে লালনের গানের দুটি খাতা আনিয়ে এস্টেটের এক কর্মচারীকে দিয়ে নকল করিয়েও নেন। দ্বিতীয় খাতার কয়েকটি গানে শব্দ সংশোধন করে শুদ্ধ পাঠ লিখে দেন তিনি। তার থেকেই ‘প্রবাসী’তে প্রকাশ করেন কুড়িটি লালনগীতি। সেই সব গানের নিবিড় পাঠে, কবি ভেসে যান ফকিরের ভাব নদীর গহনে। ‘সে যে মনের মানুষ, কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়নদ্বারে’ শুনলে তাই আমাদের মনে পড়ে লালনের ‘আছে যার মনের মানুষ মনে, সে কি জপে মালা’। এমনি করেই, ‘আমি তারেই খুঁজে বেড়াই যে রয় মনে আমার মনে’ শুনে মনে পড়ে যায় ‘আমার মনের মানুষেরি সনে মিলন হবে কতদিনে’। প্রবাসীতে যখন ধারাবাহিক ভাবে ‘গোরা’ প্রকাশিত হচ্ছে, সেই তখন থেকেই কবির এই লালন-ঘোর দেখা দেয়। ‘গোরা’-য় লিখলেন, ‘খাঁচার ভিতর অচিন-পাখি কেমনে আসে যায়।’ আবার লালনের সেই গানের কথাই ফিরল পরে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-র পাতায়। লিখলেন, ‘এই অচিন পাখির যাওয়া-আসার খবর গানের সুর ছাড়া আর কে দিতে পারে!’
দুই দেশের মধ্যে সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে মেহেরপুর, তারপর … কুষ্ঠিয়া হয়ে সেই ছেঁউরিয়া। কাছেই সাঁইয়ের হৃদয়পুর! কেন্দুলির বাসন্তিক রাত-আখড়ায় বসে বাউল সুরের আয়না মহলে ওড়াউড়ির ফাঁকে, লালন সাঁই আর তাঁর শেষ সাকিন ছেঁউড়িয়ার গল্প আজও বলেন দুই বাংলার কয়েকজন বাউল-ফকির-দরবেশ। সাঁইকে নিয়ে তাঁর এই শিষ্যমহলের ঘর-গেরস্থালির উলটো পিঠে ইতিহাসের পাতা উল্টালে উঠে আসে কুষ্ঠিয়াজুড়ে লালন-বিরোধী আন্দোলনের কথা। ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’-র কথা। কী শুনতে হয়নি তাঁকে? কেউ বলেছেন, ‘শরিয়তবিরোধী, বেশারাহ, বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট ফকির’, কেউ বলেছেন, ‘নারীভজন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল লালন শাহের একমাত্র সাধ্যসাধনা।’ কুষ্ঠিয়ার পাক প্রেস থেকে লালনপন্থীদের বিরুদ্ধে লিফলেটও বিলি হয়েছিল। তাতে লেখা হয়েছিল ‘‘… তাঁর অবতারবাদের সংবাদ জানলে যে কোনও রুচিসম্পন্ন মানুষ লালন এবং তাঁর অনুসারীদের নাম মুখে আনতে ঘৃণা বোধ করবে। কিংবদন্তীর উপর ভিত্তি করে সত্য জানবার কোনও প্রকার চেষ্টা না করে কিছু সংখ্যক ক্ষমতাবান জ্ঞানপাপী একটা নূতন কিছু করে হঠাৎ যশস্বী হওয়ার চেষ্টায় মেতে উঠেছেন। … কুষ্ঠিয়ার জনসাধারণ এই হীন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করছে!’’ ‘শাহ’ কথাটার মানে ফরাসিতে মহারাজা। সে তো দরবেশদের পদবি। কিন্তু সব দরবেশ যে বাউল নয়। তাহলে লালন সাঁই? সব বাউল দরবেশ নন। কিন্তু লালন ফকির ছিলেন দীক্ষায় দরবেশ, আর সাধনায় বাউল।
সাঁইয়ের জন্ম নিয়েও রয়েছে নানা জনশ্রুতি। শিষ্যদের একাংশের মতে, সাঁইজি ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৮৯০ সালে। তাহলে জন্ম হতে হয় ১৭৭৪ সালে। বেশির ভাগেরই দাবি, নদিয়া জেলার কুষ্ঠিয়ার কামারখালি থানার চাপড়া ইউনিয়নের গড়াই নদীর তীরে ভাঁড়ারা গ্রামে সাঁইয়ের জন্ম। বাবার নাম ছিল মাধব কর, মা ছিলেন পদ্মাবতী। আবার একটি দলিলের কথাও মেলে। ১৮৮০ সালের ১৯শে জানুয়ারি রেজিস্ট্রি করা সেই দলিল জানাচ্ছে, ‘‘পাট্টা গ্রহীতা-শ্রীযুত লালন সাঁই, পিং মৃত সিরাজ সাঁই, জাতি মুসলমান, পেশা ভিক্ষা ইত্যাদি। সাকিন ছিঁউড়ে, পরগণা ভ্রাহিমপুর, ইস্টাসন ভলকো, সাব-রেজিস্টারি-কুমারখালী।’’ এরপরে আরও জটিল হয়ে পড়ে লালনের পরিচয়। তবে ফকিরের একটি পরিচয় কখনও গোপন নয়, তিনি ছিলেন ‘একা’ একজন মানুষ। ছেলেবেলায় তাঁর বাবা মারা যান। অর্থকষ্টে তাঁর তেমন শিক্ষা গ্রহণও হয়নি। চাপড়ার ভৌমিক পরিবার ছিল তাঁর মামার বাড়ি। কিন্তু ক্রমে মামার বাড়ি দুঃসহ হয়ে ওঠে। দুঃখ ভুলতে সারাদিন একা একা টইটই করে তিনি ঘুরে বেড়াতেন মাঠে-প্রান্তরে-গাঙের ধারে। কখনও উদাস হয়ে চেয়ে থাকতেন বন-প্রকৃতির দিকে। কখনও সুরেলা পাখির পিছনে ছুটতে ছুটতে তার দিন যেত। কোনও ফকির মেঠো পথে সুরের সারিন্দা নিয়ে হেঁটে গেলে, খেলা ছেড়ে লালন তাঁর পিছু নিতেন। একদিন ফকিরের হাত থেকে একতারা নিয়ে সত্যি সত্যিই তিনি শিখে নিয়েছিলেন সুর-সাধন। আনমনে গেয়ে উঠেছিলেন,
‘‘কার বা আমি কেবা আমার
আসল বস্তু ঠিক নাহি তার।’’
বাবার মৃত্যুর পর সংসারের সব দায় এসে পড়ে তাঁর উপরে। একদিন বিয়েও হয় তাঁর। দিন যত যেতে থাকে, তাঁর রকমসকম দেখে নানা কথা উড়তে থাকে হাওয়ায়। পড়শিদের কানাকানিতে আর দারিদ্রের জ্বালা সঙ্গে নিয়ে, লালন পথে নামেন। সঙ্গে ছিলেন মা আর নতুন বৌ। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ভাঁড়ারা গ্রামের শেষ ঠিকানা দাসপাড়ায়। সেখানেই নতুন করে ঘর বেঁধেছিলেন লালন। কিন্তু সংসারে মন কই ছিল তাঁর! তাঁর মন যে বাঁধা মনের ওপারে!
‘‘না জেনে ঘরের খবর তাকাও কেন আসমানে। দোতারায় সুর তুলেছে কমল।’’
লালন যখন নতুন করে ঘর বাঁধেন, তখনও সারাক্ষণ তাঁর বিবাগী মন নিভৃতে খুঁজেছিল এর উত্তর। এই দেহটাই কি তবে ঘর, কখনও খাঁচা? নাকি আরশিনগর? লালন কি তবে শান্তরতির পথে বিশ্বাসী ছিলেন? কেউ কেউ বলেন, শান্তরতি নয়, এ সাধনা যে কামাচারের সাধন! লালন সাঁইয়ের গানেই রয়েছে এর সহজ উত্তর। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘তিরপিনির তীর-ধারে, মীনরূপে সাঁই বিহার করে’’। সে বার গাঁ থেকে অনেকে গঙ্গাস্নানে চলল মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। লালনও ঝোলা নিয়ে সঙ্গী হয়েছিল দাসপাড়ার পড়শিদের। ক’দিন বেশ কেটেছিল তাঁর। কত নতুন মানুষ, কত কথার ভিড়। স্নান তো হল, এ বার ফেরা। ফেরার পথেই লালনের গা গরম হল। হল ধুম জ্বর! সঙ্গীরা বলল, ‘বসন্ত হয়েছে লালুর! গুটিবসন্ত! গুটিবসন্ত!’ জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে বকতে লালন একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। কে দেখবে তাঁকে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে! রাত্তিরে জ্বর বাড়ল প্রবল। কোনও সাড় ছিল না শরীরে। সঙ্গীরা রোগের সংক্রমণের ভয়ে দেহ ফেলে রেখেই চলে গিয়েছিল। কারা যেন মুখাগ্নি করে ভাসিয়ে তাঁর শরীর ভাসিয়ে দিয়েছিল! গাঁ-ঘরে রটেছিল লালনের মৃত্যু সংবাদ। পুত্রশোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন লালনের মা। কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল তাঁর স্ত্রীর। ওদিকে কলার ভেলায় লালনের দেহ ভেসে চলেছিল গাঙের ঢেউয়ে ঢেউয়ে। কত গ্রাম, কত পথ ছাড়িয়ে।
লালনকে নিয়ে এমন কাহিনীর মিশেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসেও আছে। কাল্পনিক। তবু সে লালনের যাত্রাপথের কথায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘‘কখনও আটকে যায় কচুরিপানায়। কখনও সাহেবদের কলের জাহাজ ভোঁ বাজিয়ে গেলে বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কায় সরে যায় পাড়ের দিকে। … ভেলা এসে ঠেকল একটা মস্ত বড় গাছের শিকড়ে। সেখানে নদীর পাড় ভাঙছে, গাছটির গুঁড়ির কাছেই ছলাৎ ছলাৎ করছে ঢেউ। পাশেই একটা গ্রাম্য ঘাট। সেই ঘাটে সারাদিন পুরুষরা এলেও সন্ধের সময় শুধু নারীরাই জল সইতে আসে। … তিনজন রমণী সেই ঘাটে দেহ প্রক্ষালন করছে। গ্রামটি মুসলমান প্রধান। রমণীরা নিজেদের মধ্যে কলস্বরে কথা বলছিল, হঠাৎ যেন তাঁরা কাছেই ‘উঃ’ শব্দ শুনতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে কথা থামিয়ে তারা উৎকর্ণ হল।… খুব কাছেই, পুরুষের কণ্ঠ। দু’জন রমণী সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে দৌড় দিল আলুথালুভাবে। একজন দাঁড়িয়ে রইল …!’’ হায় আল্লা! বেঁচে আছে তো! পিপাসায় ঠোঁট শুকিয়ে আসছিল লালনের। তিনি কেবল বলেছিলেন, ‘জল, জল!’ জলের কথা শুনে রমণী আঁতকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমরা মুসলমান!’ আর যে পারছিলেন না লালন। তিনি আবার বলেছিলেন, ‘মানুষের আবার জাত কি। জল দাও একটু। জল …!’ ঘাটের সেই রমণীই লালনকে সেবায় ভরিয়ে সুস্থ করেন। নিয়ে যান ঘরে। কিন্তু কী নাম ছিল সেই রমণীর? আর তাঁর স্বামীই বা কে ছিলেন? গবেষকদের কেউ বলছেন, ছেঁউড়িয়ার মলম কারিকর। আর তাঁর স্ত্রী-ই লালনকে সুস্থ করে তোলেন। তাঁর ঘরে সে সময় ‘সিরাজ সাঁই’ এসেছিলেন। রমণীর সেবায় আর সিরাজের ওষুধে রোগমুক্তি ঘটেছিল কয়েক দিনেই। বল ফিরেছিল শরীরে। কিন্তু মুখে বসন্তের দাগ রয়ে গিয়েছিল। চির জন্মের মতো অন্ধ হয়ে গিয়েছিল একটি চোখও। আবার কোনও কোনও গবেষক বলেন, ‘মলম’ নয়, লালনকে সিরাজ নিজেই ঠাঁই দিয়েছিলেন। লালন চেয়েছিলেন, সিরাজের সঙ্গেই পথে হারাতে। সিরাজ সঙ্গে নেননি। কেন নেননি? কারণ তখনও যে সংসারে লালনের কাজ বাকি। লালন ফিরে এসেছিলেন আপন গাঁয়ে। তিনি ফিরলেন বটে, গ্রাম তাঁকে মানল না। তাঁকে দেখে আনন্দ আর বিস্ময়ে চমকে উঠেছিলেন মা আর বৌ। কিন্তু সারা মহল্লা রটে গেল, লালনের জাত গিয়েছে। সে মুসলমানের অন্ন-জল গ্রহণ করেছে। ভাঁড়ারা গ্রাম তাঁকে ভিটেছাড়া করল। একতারা আঁকড়ে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে লালন যে পথে এসেছিলেন, হাঁটা দিয়েছিলেন আবার সেই পথে। এত দুঃখ, এত দহন! লালনের তখন কত বয়েস? সম্ভবতঃ তখন তিনি যৌবনের মধ্যভাগে। তাঁর কেবল মনে হত, এ কেমন জাত? এ কেমন ভগবানের বিচার? মনের রঙে বৈরাগ্যের রং ধরল তাঁর। ঘর ছাড়ার সময় বৌকেও ডেকেছিলেন তিনি। সেও সঙ্গে আসে নি! অভিমানে-কান্নায় তখনই বুঝি মনে মনে গান বেঁধেছিলেন লালন,
‘‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন বলে জেতের কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।’’
ফের দেখা হয়ে গিয়েছিল কাহার-সম্প্রদায় ভুক্ত বাউলগুরু সিরাজের সঙ্গে। কে ছিলেন এই সিরাজ সাঁই? সিরাজ ছিলেন লালন সাঁইয়ের গুরু দরবেশ। একজন সুফি সাধক। নানা জনের নানা মত। তবে কেউ কেউ বলেন, দীক্ষা লাভের আগেই লালন সাঁইয়ের ধর্মান্তর ঘটেছিল। লালনের প্রথম জীবনীকার বসন্ত পালের মত অনুসারে, সিরাজ সাঁইয়ের জন্ম হয়েছিল যশোরের ফুলবাড়ি গ্রামে। লালনের মতোই তাঁর গুরুজির পরিচয় নিয়েও নানা ধন্ধ আজও বিদ্যমান! লালন নিত্য নানা প্রশ্ন করতেন সিরাজকে। বিশ্ব সংসার ও জগৎ নিয়ে তাঁর সে সব কৌতূহল মেটাতেন সিরাজ সাঁই। ধীরে ধীরে লালন জানতে পেরেছিলেন, সাধনার আরেক রূপ ‘রংমহল’-এর কথা। সেও এক দেহতত্ত্ব। তাতে নাকি তালা লাগানো। ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে সেই তালা খোলা শিখতে হয়। লালন তাই সিরাজের কাছে দীক্ষা নেন। জানতে পারেন সাধনসঙ্গিনীর কথা। দিন দিন মনের মানুষের সন্ধানে লালন যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। গহন বনে একলা বসে গান গাইতেন,
‘‘আমার মনের মানুষের সনে
মিলন হবে কত দিনে।’’
ঠিক এই সময় থেকেই নতুন নতুন কথা এসে বাসা বাঁধতে থাকে তাঁর প্রাণে। তাতে সুর বসিয়ে গেয়েও ফেলতেন।
সিরাজ সাঁইয়ের সংর্স্পশে এসে লালন জেনেছিলেন, মহাযোগের খবর। সে খবর যোগেশ্বরীকে ধরে জানতে হয়। জেনেছিলেন, সবই রস-রসিত খেলা। আর তারই মাঝে বাউলের সাধনা বায়ুর সাধনা। তাকে জানতে হয় কখনও অমাবস্যা, কখনও জোয়ার। কামের ঘরে কপাট মারতে হয়। সাধন করতে সঙ্গিনী লাগে। অথচ সাধন তো হয় একার! এ কেমন ধারা? লালনপন্থীরা বলেন, বাউল চিরকাল একা। সে কখনও অনুমানে বিশ্বাস করে না। গুরু লালন সাঁইও করতেন না। লালনপন্থীরাও করেন না! লালন বলেছেন, রস-রতির যোগ সাধনায় পুরুষ আর প্রকৃতি মিশে আছে। বলছেন,
‘‘হাওয়া ধর অগ্নি স্থির কর
যাতে মরিয়া বাঁচিতে পার
মরণের আগে মর
শমন যাক ফিরে।’’
খড়ের চালের কয়েকটা বাঁশ-বাতার ঘর। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে বাঁকা নদী। ওপারে আদিগন্ত চর। ধু ধু বালিয়াড়ি। কখনও সখনও নির্জন নদীঘাটে নৌকো এসে থামত। ঘুঙুরালি সুর তুলে শিষ্যরা এসে বসতেন আখড়ায়। লালন গাইতেন, তাঁরা বাজাতেন খমক-দোতারা।
‘‘বাড়ির কাছে আরশিনগর।
সেথায় এক পড়শি বসত করে।’’
গাইতেন,
‘‘দেহের মাঝে নদী আছে।
সেই নদীতে নৌকা চলছে
ছয়জনাতে গুণ টানিছে
হাল ধরেছে একজনা।’’
সিরাজের কাছে দীক্ষা নিয়ে কুষ্ঠিয়ার কাছে ছেঁউড়িয়ায় নদী কিনারে লালন আখড়া করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে, ছেঁউড়িয়া মৌজায় লালন-ভক্ত মলম-শাহ কারিকর লালন ফকিরকে সাড়ে ১৬ বিঘে জমি দান করেন। তার উপরেই সেই আখড়া গড়ে উঠেছিল। সেটা ছিল বাংলা ১২৩০ সাল।
প্রথম দিকে সাঁইজির আখড়া কেমন ছিল? মুখে মুখে যে কথা ঘোরে তা হল, প্রথমে ছেঁউড়িয়ায় গ্রামের বাইরে একটি বনের মধ্যে আম গাছের নীচে বসে সাধনা করতেন লালন সাঁই। বন থেকে খুব একটা বের হতেন না প্রথমে। পরে ওই গ্রামের কারিগর সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় গড়ে উঠল আখড়া। একে একে এসে জুটলেন তাঁর শিষ্যরা। শীতল, মনসুর, মনিরুদ্দিন। গাঁ-ঘরের লোকও তাঁকে গুরু মানল। শীতল ও ভোলাই ছিল ছেলের মতো। কখনও সখনও নাকি তিনি বেরিয়ে পড়তেন ঘোড়ায় চড়ে। কখনও একা, কখনও শিষ্য সঙ্গে, পাবনা, রাজশাহি, ফরিদপুরের পথে। সে সময় শিষ্য বাড়তে থাকে তাঁর। মানুষের সেবায় কবিরাজী চিকিৎসাও করতেন লালন। গবেষকরা বলেন, শিষ্য ভোলাইয়ের গানের খাতায় তেমন ওষুধ ব্যবহারের বিধির নজির মিলেছে। আসলে, মানুষের জন্য প্রাণ কাঁদত তাঁর। নিরাশ্রয়-নিঃসঙ্গ মা মারা যাওয়ার পর, সাঁই তাঁর গ্রামে আখড়া থেকে খাবার পাঠিয়েছিলেন নিজের গ্রামে শ্রাদ্ধের জন্য।
আসলে লালন কেবল সাধক ফকির ছিলেন না, জগত-সংসারের খবরও রাখতেন। ছিলেন ‘স্বভাবকবি’। ছন্দমিল নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাঁর শিষ্যরা সেগুলি লিখে রাখতেন। লিপিকরের কাজ করতেন ‘মানিক শাহ’ ওরফে ‘মানিক পণ্ডিত’, আর ‘মনিরুদ্দিন শাহ’। প্রাণে গান এলে বলতেন, ‘‘ওরে আমার পুনা মাছের ঝাঁক এসেছে।’’ কেউ কেউ বলেন, এই আখড়া গড়ে তোলার পর সাঁই ফের বিয়েও করেন। ‘মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের’ তেমন একটি লেখার কথা বলা যাক। তিনি লিখছেন, ‘‘কিছুকাল পরে একজন বিধবা বয়নকারিণী মুসলমানীকে তিনি (লালন) নেকাহ করেন এবং পানের বরোজ করিয়া তাহার ব্যবসা করিতে থাকেন। ফকিরকে প্রায়ই দেখা যাইত না, শুনা যাইত তিনি নির্জ্জন স্থানে বসিয়া নিজতত্ত্বে মগ্ন থাকিতেন এবং গান রচনা করিতেন।’’ কোনও কোনও গবেষকের দাবি, ইনিই ছিলেন লালনের প্রেম-সাধিকা, সাধনসঙ্গিনী। নিজের পূর্ব-স্ত্রীর মৃত্যুর পর এই বিশাখা বা মতিবিবিকে জীবনসঙ্গিনী করে সাঁই সাধন-ভজন করতেন ‘হকের ঘর’ নামে আখড়ারই একটি ঘরে। সেখানে বসেই, শিষ্যদের সঙ্গে বাহাসও করতেন। বলতেন, ‘‘এ বিশ্ব সংসারে আমি নিঃস্ব!’’
কেমন দেখতে ছিলেন ফকির লালন সাঁই? উল্লেখ করা যাক ‘মনের মানুষ’-এর পাতা থেকে। যেখানে জ্যোতিরিন্দ্রের আহ্বানে লালন গিয়েছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জ্যোতিদাদার তখন পোর্ট্রেট আঁকার পর্ব চলছে। ‘‘দ্রুত হাতে কয়েকটা টান দিয়ে রেখাচিত্রটি সম্পূর্ণ করে জ্যোতিরিন্দ্র বলল, এই দিকে এসে দেখুন তো, আপনার মুখখানি ঠিক হয়েছে কি না। লালন উঠে এসে জ্যোতিরিন্দ্রের পাশে দাঁড়াল। ছবিটি দেখার পর হাসি ছড়িয়ে গেল তাঁর সারা মুখে। সে বলল, বাবুমশাই, আমার মুখখানি কেমন দেখতে, তা তো আমি জানি না। কখনও দেখি নাই। জ্যোতিরিন্দ্র বলল, ‘সে কী? নিজের মুখ কখনও দেখেননি? এই যে গাইলেন আরশিনগরের কথা?’ লালন বলল, ‘সে আরশিনগরে নিজেকেও দেখা যায় না, পড়শিকেও দেখা যায় না!’ …’’ লালনের কী এমন ছবি এঁকেছিলেন রবিঠাকুরের জ্যোতিদাদা, যা দেখে উপন্যাসের সাঁই হেসেছিলেন! রবীন্দ্রভারতীতে ১৮৮৯ সালের ৫ই মে শিলাইদহে বোটের উপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালনের যে পেনসিল স্কেচটি রয়েছে, তাতে লালন ন্যুব্জ। অসম্পূর্ণ হলেও, সেটিই একমাত্র লালনের পার্থিব অবয়ব। ছবির উপর লেখা ‘লালন ফকির। শিলাইদহ বোটের উপর।’ গবেষকদের অনুমান, এ ছবি লালনের মৃত্যুর এক বছর আগে আঁকা হয়েছিল। নন্দলালও এক সময় এই স্কেচটি দেখে লালনকে এঁকেছিলেন। তবে নন্দলালের লালন-এর ছিল খাড়া নাক। মাথার চুল বাঁধা। ‘হিতকরী’-র নিবন্ধকার স্বচক্ষে দেখেছিলেন লালন ফকিরকে। তাঁর লালন ছিলেন একটু অন্য। বাবরি চুল, একটি চক্ষু দৃষ্টিহীন। মুখে ছিল বসন্তের দাগ।
শেষের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন লালন। কিন্তু নিরন্তর তত্ত্বালাপে মেতে থাকতেন। সে সময় রোগশয্যায় দুধ ছাড়া আর খুব একটা কিছু খেতেন না। খেতে চাইতেন মাছ। অসুস্থ শরীরে একদিন যে সামান্য জোতজমা, বাড়ি-ঘর ছিল তার অন্তিম দানপত্র করে স্ত্রী, কন্যা, ‘শিষ্য-জামাতা শীতল’কে দিয়ে দিয়েছিলেন। শেষের সময় শিয়রে প্রায়, বুঝতে পেরে, সাধন সঙ্গিনী ও ধর্মকন্যা ‘পিয়ারী’ সারাক্ষণ তাঁর পাশে পাশে থাকতেন, লালন তবু তাঁদের বুঝতে দিতেন না, তাঁর কষ্টের কথা। একদিন নগদ দু’হাজার টাকাও রেখেছিলেন সৎকারের জন্য। শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘‘ইন্তেকাল হলে হিন্দু মতে দাহ হবে না। আবার ইসলামি মতে জানাজা নামাজও পড়া যাবে না।’’ আর যে দিন চলে গেলেন, রাত থেকে শিষ্যরা নাম-গান করেছিল –
‘‘পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে।
ক্ষম হে অপরাধ আমার ভবকারাগারে।’’
কার্তিকের সেই ভোরের কথায় ‘বসন্তকুমার পাল’ লিখেছেন, লালনের রোগশয্যার কথা। শেষের দিনও সাঁই সারা রাত্তির গান করেছেন। গলা উঠেছে তারসপ্তকে,
‘‘পাখি কখন যেন উড়ে যায়।
বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়।’’
রাত যখন ফুরিয়ে এল, নদীর জলে আলো এসে পড়েছে সবে, শেষ হল গান। বসন্তকুমার লিখছেন, ‘‘স্বরলহরী থামিয়া গেল, সমস্ত গৃহতল নীরব নিস্তব্ধ, ইহার পর শিষ্যগণকে সম্বোধন করিয়া ‘আমি চলিলাম’ বলিয়া তাঁহার কণ্ঠ হইতে শেষ স্বর উচ্চারিত হইল, নেত্রদ্বয় নিমীলিত করিলেন, সমাজ পরিত্যক্ত দীন ফকিরের জীবননাট্যের যবনিকাপাত হইল।’’ একটু পরেই নাড়ি স্থির হয়ে এল। শিষ্যরা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সে দিন ছিল কার্তিকের পয়লা!
কত গান গেয়েছিলেন লালন? কেউ বলেন ন’শো, কেউ বলেন হাজার। অনেকেই বলেন, লালন সাঁইয়ের গানের কোনও স্বরলিপি নেই বলে গানগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। এই আশঙ্কার কথা জানাচ্ছেন বহু লালন অনুরাগী। লালন আকাদেমির উদ্যোগে কিছু কিছু গানের স্বরলিপি রচনা করেছেন কয়েক জন সুরকার। কিন্তু, এটা পথ নয় বলে মনে করেন লালন মাজারের খাদেম ফকির মহম্মদ আলি শাহ। লালন সাঁইয়ের গান তো ফকিরদের গলায় বেঁচে থাকবে ফকির মহম্মদ আলি শাহ সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘‘এ ভাবেই তো এত দিন বেঁচে রয়েছে লালন সাঁইয়ের গান। তার জন্য স্বরলিপির দরকার পড়েনি।’’ আগে নিরক্ষরেরাই লালনের গান গাইত বলে তার কোনও স্বরলিপি নেই বলেও মনে করেন ফকির মহম্মদ আলি শাহ। লালন সঙ্গীত চর্চ্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের ফকির রহমান শাহ এই প্রজন্মের গাওয়া লালনের গানকে প্রশ্রয় দিলেও লালন মাজারের ফকির মহম্মদ আলি শাহ তা মানতে নারাজ ছিলেন। তিনি সংবাদমাধ্যম কে জানিয়েছিলেন, ‘‘মূলধারা থেকে লালন সঙ্গীত সরে যাচ্ছে। আদি সুর এখন আর গাওয়া হচ্ছে না।’’ যন্ত্রানুষঙ্গের আওয়াজে চাপা পড়ে যাচ্ছে লালনের কথা, যা এক দর্শন। এখন গানের শব্দগুলি ঠিকঠাক উচ্চারণ না করায় অনেক ক্ষেত্রে লালনের গানের অর্থ বদলে যাচ্ছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি একটি গানের দু’কলি শুনিয়েছিলেন সাংবাদিকদের, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।’ এখন অনেক ফকিরও ‘কমনে’ না বলে ‘ক্যামনে’ বলেন গানে। কিন্তু, তাতে তো মানে পাল্টে যাচ্ছে। কমনে মানে কোন দিক দিয়ে আর ক্যামনের অর্থ কী ভাবে ব্যাখ্যাও করেছিলেন ফকির মহম্মদ আলি শাহ। পশ্চিমবঙ্গের ফকিররা যে ভাবে লালনের গান গেয়ে থাকেন তাতে অনেক সময় ভাষার তারতম্য দেখা যায়। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘লালন সাঁইয়ের হাজারখানেক গানের মধ্যে শ’খানেক গান বেশির ভাগ বাউল বা ফকির গেয়ে থাকেন। ফলে, বাকি গানগুলি আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে।’’ তাই, আজ যখন কিছু মানুষ লালন ফকিরের গানের স্বরলিপি তৈরির উপর জোর দিচ্ছেন এবং ফকির মহম্মদ আলি শাহ নিমরাজি হয়েই তা মেনে নিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন কবি, আউল-বাউল এবং দার্শনিক। মানবতাবাদের দর্শন। এই সব নিয়েই একটা আস্ত লালন। সেই লালনকে টুকরো টুকরো করার একটা চেষ্টা চলছে। যা শুরু হয়েছে দেশভাগের পর থেকেই। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পরে দুই বাংলার ফকিরেরা এবং লালন অনুরাগীরা ভেবেছিলেন লালনের দর্শনের চর্চা এ বার বাড়বে। কিন্তু না, দিনে দিনে লালন হয়ে উঠেছে ধর্ম আর রাজনীতির কারবারীরদেরও একটা বিশেষ ইস্যু। লালন এখন তিন টুকরো। লালন ‘মুসলিম’ সম্প্রদায়ের, লালন ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’, লালন ‘কেনা-বেচার মশলা’। এই পরিস্থিতিতে, লালনের অনুগামী এবং অনুরাগীরা কী ভাবে লালন চর্চা করে চলেছে তা জানতে হলে বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদে গেলে হবে না। যেতে হবে ও-পারে। বাংলাদেশে। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়। লালনের আখড়ায়। লালন নেই। আখড়া হয়ে উঠেছে কারও কাছে লালন ধাম, কারও কাছে বা লালন মাজার। ছেউড়িয়া আজও দুই বাংলার আউল, বাউল, ফকিরদের অন্যতম তীর্থস্থান। ধর্মীয়, রাজনৈতিক হোতাদের ঠান্ডা চোখকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র একতারা হাতে ফকিরেরা অবলীলায় পৌঁছে যান ছেউড়িয়ায়। সেই যাত্রাপথে অনেক সময় কোনও কোনও ফকিরের রক্ত ঝরে। হ্যাঁ, একতারা হাতে নিরীহ ফকিরেরা আজও বাংলাদেশের নানা জায়গায় আক্রান্ত হন। কিন্তু, লালন চর্চা থেমে থাকে না। সাবেকি ঢঙের পাশাপাশি এ কালের ঢঙে লালনের গান আজও গেয়ে চলেছেন লক্ষ লক্ষ জন। আর শুনছে কোটি কোটি মানুষ।
(তথ্যসূত্র:
১- মনের মানুষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স (২০০৮)।
২- লালন ফকির ও তাঁর গান, অন্নদাশঙ্কর রায়, কবি প্রকাশনী (২০১৭)।
৩- লালন মত লালন পথ, আজাদুর রহমান, অন্বেষা প্রকাশন (২০১৫)।
৪- ফকির লালন সাঁই দর্শন ও সমাজতত্ত্ব, আবু ইসহাক হোসেন, দি ইউনিভার্সেল একাডেমি (২০১৬)।
৫- লালন সমগ্র, মোস্তাক আহ্মাদ, দি ইউনিভার্সেল একাডেমি (২০১৫)।
৬- লালন, সুধীর চক্রবর্তী, নালন্দা (২০১৫)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত