‘বিশ্বনাথ দত্তের মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথ’ উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। সেদেশে তাঁর পরিচিত কেউ ছিলেন না, তাঁর অর্থবলও ছিলনা, তবে তাঁর একমাত্র ভরসা ছিল যে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিবেকানন্দ তখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন! মহেন্দ্রকে জাহাজ-ঘাটা থেকে নিয়ে এসে একটি বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন ‘কৃষ্ণ মেনন’ নামে তাঁর দাদার এক ভক্ত! নতুন দেশ, সম্পূর্ণ অন্যরকম পরিবেশ, চতুর্দিকে রাজার জাতের লোক, প্রথম প্রথম খুব আড়ষ্ট হয়ে ছিলেন মহেন্দ্র। দিন সাতেক কেটে গিয়েছিল, তখনও দাদার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। বিবেকানন্দ তখন লণ্ডনে নানা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। একদিন কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন মহেন্দ্র। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাবার পর দেখতে দেখতে তাঁর মনে হয়েছিল, ব্রিটিশ রাজত্বের এই রাজধানীর সঙ্গে ভারতের রাজধানী কলকাতা শহরের বেশ খানিকটা মিল আছে। তিনি বুঝেছিলেন ইংরেজরা নিজেদের এই শহরের আদলেই তো কলকাতা শহরটা বানিয়েছে। ‘অক্সফোর্ড সার্কাস’, ‘পিকাডেলি সার্কাস’ দেখতে দেখতে তাঁর ‘কলকাতার ডালহৌসি-পার্ক স্ট্রিটের’ কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। লণ্ডনে মস্ত মস্ত বাড়িগুলির দিকে তাঁকে ঘাড় উঁচু করে তাকাতে হয়েছিল, আর তিনি ভেবেছিলেন কলকাতার ‘মল্লিক, শীল, ঘোষ, বোস, ঠাকুরদের প্রাসাদগুলি’ই বা কম কীসে! হাঁটতে হাঁটতে দু’জনে একসময় চলে এসেছিলেন চীপসাইড পল্লীর দিকে। সেটা ছিল বাণিজ্য এলাকা, কলকাতার বড়বাজারেব মতন। অসংখ্য মানুষ পিলপিল করছিল চতুর্দিকে, সবাই ছুটছিল যেন কীসের তাড়ায়। রাস্তার ধারে ধারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিল ফেরিওয়ালারা, ঘরঘড়িয়ে চলছিল চার চাকার ঘোড়ার গাড়ি আর দু’চাকার এক্কা, কিশোরয়েসী খবরের কাগজের হকাররা তারস্বরে শোনাচ্ছিল সেদিনের গরম গরম খবর। রেস্তোরাঁগুলি থেকে ভেসে আসছিল কফির গন্ধ। একটা চৌমাথার কোণে এক ইংরেজের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন দু’জন ভারতীয়, সেদিকে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে মহেন্দ্র চমকিত ও উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। কারণ ভারতীয়দের মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর চেনা, তিনি অস্ফুট স্বরে বলে উঠেছিলেন, “ওই তো শরৎদাদা!” বরানগর মঠে দীক্ষা নেবার পর ‘শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী’র যদিও সন্ন্যাস নাম হয়েছিল ‘সারদানন্দ’, কিন্তু মহেন্দ্র তাঁকে পূর্ব নামেই ডাকতেন। ‘সারদানন্দ’ খুব স্নেহ করতেন তাঁকে। বরানগর-আলমবাজার মঠে মহেন্দ্র নিয়মিত যাতায়াত করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সব শিষ্যেরই তিনি স্নেহভাজন ছিলেন, কিন্তু তিনি দীক্ষা নেননি। ‘ভুবনেশ্বরীদেবী’ তাঁর এক পুত্রকে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সমর্পণ করেছিলেন, আর কোনও সন্তানকে ছাড়তে তিনি রাজি ছিলেন না। প্রবাসে একজন পরিচিত মানুষকে দেখলে বড় আনন্দ হয়। মহেন্দ্রর ইচ্ছে হয়েছিল তখনই সারদানন্দের দিকে ছুটে যেতে। মেননকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “পাশের ভদ্রলোকটি কে?” ‘মেনন’ প্রথমে পাশ ফিরে দারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে চেয়ে ছিলেন মহেন্দ্রর দিকে। তারপর অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, “আপনি চিনতে পারছেন না?” মহেন্দ্র আবার তাকিয়ে দেখেছিলেন। সেই ব্যক্তিটি কালো রঙের প্যাস্টালুন, কালো রঙের ভেস্ট পরিহিত, গলায় টাই নেই বটে, কিন্তু জামার কলারটি স্বতন্ত্র, মাথায় কখনউয়ের জের মতন অর্ধচন্দ্রাকৃতি কালো, মোটা টুপি, সামনের দিকে সিঁথি কাটা চুল দেখা যায়। গায়ের রং বেশ ফর্সা, চক্ষু দুটি সাধারণ মানুষের চেয়ে বড় আকারের, দারুণ তেজসম্পন্ন দৃষ্টি। তিনি স্থির নেত্রে দূরের কিছু একটা লক্ষ করছিলেন। মেননের বিস্ময় দেখেই মহেন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি কী ভুল করেছেন। নিজের অগ্রজকে সেদিন তিনি চিনতে পারেনি। কিন্তু মানুষের এমন রূপান্তরও হয়! কলকাতার সেই নরেন দত্তের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের এত তফাত। মাত্র চার-পাঁচ বছর, তার মধ্যেই এমন পবিবর্তন! নরেন দত্তই যে বিবেকানন্দ, সে কথা জানতে কলকাতার অনেকেরই বেশ সময় লেগেছিল। তারপর থেকে মহেন্দ্র এবং তাঁর বাড়ির লোকজন সবাই স্বামী বিবেকানন্দের জয়যাত্রার সমস্ত কাহিনী অনুসরণ করেছিলেন। মার্কিন মুলুকের দিকে দিকে বেদান্তের বাণী প্রচার করে তিনি এসেছিলেন ইংল্যান্ডে, কিন্তু সেখানে তিনি যেন অন্য মানুষ। মানুষের চরিত্র রূপ ফুটে উঠত তাঁর চোখে, স্বামী বিবেকানন্দর চোখ দেখে আর বোঝাই যেত না, তিনি মহেন্দ্ৰর সহোদর ভ্রাতা। ওই রূপে স্বামীজিকে মহেন্দ্র একটু ভয়ই পেয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর অগ্রজ এমন একটা উচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছেন, আর তাঁর কাছাকাছি তিনি পৌঁছাতে পারবেন না। মহেন্দ্র বিবেকানন্দের সঙ্গে যে ইংরেজ যুবকটিকে দেখেছিলেন, তাঁর নাম ছিল ‘গুডউইন’। তিনি ছিলেন ‘দ্রুত সংকেত লিপি’ বা ‘শর্ট হ্যান্ড বিশেষজ্ঞ’। সেই জীবিকা নিয়ে তিনি একদা গিয়েছিলেন আমেরিকায়, পেশাগতভাবে বিবেকানন্দর বাণী লিপিবদ্ধ করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অন্য সব ছেড়েছুঁড়ে বিবেকানন্দের সঙ্গে জুটে গিয়েছিলেন, তখনও তিনি ওই কাজই করতেন। বিবেকানন্দকে গুরু বলে মেনে নিয়েছিলেন ‘গুডউইন’, কিন্তু পয়সাকড়ির প্রশ্ন ছিলনা, গুরুর ছিটেফোঁটা কৃপাই ছিল তাঁর ভবসা। মহেন্দ্র যেদিন ‘সারদানন্দ’কে দেখেছিলেন, তার কিছুদিন আগেই তিনি ইংল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন – মাত্র দিন সাতেক হবে। বিবেকানন্দই তাঁকে আনিয়েছিলেন কলকাতার মঠ থেকে। লণ্ডনে দিনের পর দিন একা বহু শ্রোতাদের সামনে বিবেকানন্দকে বক্তৃতা দিতে হত। ক্লান্ত হয়ে পড়তেন মাঝে মাঝে, তাই বিবেকানন্দ ঠিক করেছিলেন কলকাতা থেকে আবও কয়েক জন গুরুভাইকে আনিয়ে নিজেব আরব্ধ কাজ আরও বেশি প্রচারের দায়িত্ব দেবেন। ‘গুডউইন’ সারদানন্দকে কিছু বোঝাচ্ছিলেন, বিবেকানন্দ অনেকক্ষণ নীরব ছিলেন। মহেন্দ্র আর মেনন কাছে আসতেই ‘সারদানন্দ’ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মহেন্দ্রকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। যেন সমুদ্রে ডুবন্ত ব্যক্তি হঠাৎ পেয়ে গেছে একটি কাষ্ঠখণ্ড। ‘সারদানন্দ’ বাংলায় মহেন্দ্রর কুশল সংবাদ নিতে নিতে বলেছিলেন, “ওরে, কী দেশে এসে পড়েছি, সর্বক্ষণ ইংবিজিতে ক্যাচ-মাচ করতে হয়, কোনও খাদ্য মুখে রোচে না …।” বিবেকানন্দ ভাইকে দেখে তেমন কিছু সাদর সম্ভাষণ করেননি। গম্ভীরভাবে ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? কয়েকদিন পর তুমি আমার সঙ্গে এসে থাকবে।” তারপর নিজের কোটের পকেট থেকে পাঁচটি পাউন্ড বার করে মহেন্দ্রর হাতে দিয়ে তিনি ‘মেনন’কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “আমি স্টার্ডির বাড়ি ছেড়ে আগামীকাল সেন্ট জর্জেস রোডে লেডি ফার্গুসনের বাড়িতে উঠে আসছি। তুমি মহেন্দ্রকে সেখানে পৌঁছে দিয়ো।” তারপর আর বিবেকানন্দ সেখানে দাঁড়ান নি, এগিয়ে গিয়েছিলেন। মহেন্দ্রর মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দ নামে যাঁকে তিনি সেদিন দেখেছিলেন, তিনি যেন সত্যিই এক অপরিচিত দূরের মানুষ ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন – এঁকে কি তিনি দাদা বলে ডাকতে পারবে, নাকি স্বামীজি বলতে হবে? ‘মেনন’ তাঁকে জানিয়েছিলেন, “মহেন্দ্র, তুমি প্রথমে তোমার নিজের অগ্রজকে চিনতে পারনি, তাতে আমি অবাক হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমার নিজেরও ওই একই ব্যাপার হয়েছে। উনি আমেরিকা যাত্রা করার আগে মাদ্রাজে আমি ওঁকে দেখেছি। আলাসিঙ্গা আর আমি ওঁর সঙ্গে কত সময় কাটিয়েছি। আমিই তো ওঁর তামাক সেজে দিতাম। তখন অঙ্গে ছিল সন্ন্যাসীর সাজ, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কত হাসিমস্করা করতেন, সাধারণ মানুষের মতন মিশতেন। কিন্তু এখন যেন উনি এক পৃথক ব্যক্তি, দারুণ এক মহাশক্তি ভর করেছে ওর ওপর। এক একদিন বক্তৃতার সময় এমন সিংহবিক্রম প্রকাশ পায় যে আমার গা ছমছম করে। আমরা ওঁর সঙ্গে কথা বলার সাহস পাই না।” পরদিন সেন্ট জর্জেস রোডের বাড়িতে এসে মহেন্দ্র সঙ্কোচে এক পাশে বসে ছিলেন। বাড়িতে তখন অন্য দু’ চারজন অভ্যাগত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছিলেন বিবেকানন্দ। ‘সারদানন্দ’ কাছেই ছিলেন, কিন্তু মুখ খুলছিলেন না। এরকম গম্ভীর পরিবেশে সময় যেন কাটতেই চাইছিল না মহেন্দ্রর। এক সময় অন্যরা বিদায় নিলে বিবেকানন্দ উঠে গিয়েছিলেন ওপর তলায়। খানিক বাদে আবার নেমে এসেছিলেন বৈঠকখানায়। তখন যেন তিনি অন্য মানুষ। সারা মুখে হাসি মাখা ছিল, তবু ‘সারদানন্দ’কে এক ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “হ্যাঁ রে শরৎ, তুই শালা কাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভ্যাড় ভ্যাড় করে বাংলা বলছিলি কেন রে? কতবার বলে দিয়েছি না, কাছাকাছি কোনও ইংরেজ থাকলে নিজেদের ভাষায় কথা বলা অতি অভদ্রতা। যাতে সকলে বুঝতে পারে, সেই জন্য ইংরিজি বলতে হয়। মহীনকে দেখেই তুই যে একেবারে উথলে উঠলি! তুই ইংলিশ বলা প্র্যাকটিস করবি। শালা, তোকে এখানে আনিয়েছি কি এমনি এমনি।” তারপরে তিনি মহেন্দ্রর দিকে ফিরে বলেছিলেন, “ও মহীন, তোর মুখখানা শুকনো কেন? খাওয়া হয়নি কিছু বুঝি? মা কেমন আছেন বল! আর সবাই কে কেমন আছেন? আসার পথে জাহাজের দুলুনিতে তোর কষ্ট হয়নি তো? তুই বুঝি ভাবছিস, কোথায় এসে পড়লুম রে বাবা! প্রথম প্রথম এমন মনে হয়। লোকের সঙ্গে কথা বলতে বাধো বাধো লাগে। সব ঠিক হয়ে যাবে। জিভের আড় ভাঙতে একটু সময় লাগবে। বেশি বেশি লজ্জা করবি না। এ দেশে তুই সজ্জা করে না খেয়ে থাকলে কেউ পুঁছবেও না।” বুক পকেট থেকে একটা অতি সুদৃশ্য সোনার কলম বার করে বলেছিলেন, “এটা তুই নে। আমার দরকার নেই, তুই এটা ব্যবহার করবি!” এরপরে মহেন্দ্রর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে এক গাল হেসে বলেছিলেন, “এই পোশাক তোকে কে বানিয়ে দিয়েছে? ঠিক যেন নব কাত্তিকের মতন দেখাচ্ছে। এই গাঁইয়া জামা-প্যান্ট এদেশে চলবে না।” বলে তিনি পাশ পকেটে হাত দিয়েছিলেন, এগারোটি পাউণ্ড মুঠোয় উঠে এসেছিল, সেগুলো মহেন্দ্রর হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, “এক প্রস্থ পোশাক কিনে নিবি।” একটা চুরুট ধরিয়ে শরতের কাছে গিয়ে বললেন, “এই ঘঁৎকো, একটা গান গা না। এখন যত ইচ্ছে বাংলা বলে পেট খোলসা করে নিতে পারিস!” মহেন্দ্র তখনও কথা বলতে পারেননি। তিনি অবশেষে খুঁজে পেয়েছিলেন ঠিক সেই আগেকার আমুদে নরেন দত্তকে, যিনি তাঁর দাদা। এক শরীরে দুই সত্তা। তাঁর মনে হয়েছিল যেন কিছুক্ষণের জন্য উচ্চ স্তর থেকে তাঁর দাদা নেমে এসেছেন সাধারণ স্তরে।
বৈষয়িক বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন, অদ্ভুত প্রখর স্মৃতিশক্তি, প্রবল রসবোধ, ভুবনবিদিত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নরেন্দ্রনাথ তথা স্বামী বিবেকানন্দের তুলনায় আপাতবিচারে বিশেষ কিছুই করেননি মহেন্দ্রনাথ দত্ত। সাধারণভাবে ততটা পরিচিতও হয়তো তিনি। কিন্তু তাঁর নিজের দীর্ঘ, বিচিত্র জীবনকাহিনী এবং প্রায় শতখানেক বই আমাদের আজও অবাক করে দেয়। তিনি যেন এক ‘বহুরূপী’। কখনও ‘ভূপর্যটক’, কখনও ‘শিল্প-সংস্কৃতির তত্ত্বজ্ঞানী’, কখনও ‘সমাজবিজ্ঞানী’, আবার কখনও ধারণা হয় তিনি ‘ঈশ্বরে সমর্পিত এক পবিত্র প্রাণ’। ১৪ই আগস্ট ১৯০০ সালে, স্বামী বিবেকানন্দ প্যারিস থেকে তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, “আই অ্যাম কোয়ায়েট প্রাউড অব হিম নাউ।” ‘নন্দলাল বসুর স্মৃতিচারণ’ থেকে পাওয়া যায় – “তাঁর সংগে আলাপ করলে শিল্পবিষয়ে জ্ঞান খুলে যায়, আর অনেক মৌলিক তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়।” তাঁর ‘প্যালেস্টাইন ভ্রমণ’ ও ‘ইহুদী জাতির ইতিহাস’ বইটির মূল্যায়নে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ মন্তব্য করেছিল – “তিনি ফা-হিয়েন, ইবনবতুতা প্রভৃতি ঐতিহাসিক ভ্রমণকারীদের সগোত্র।” স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী অথবা রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের আদি পর্বের ইতিহাস, তাঁর আকর গ্রন্থগুলি ছাড়া অসম্পূর্ণ। বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় আশি। তাঁর প্রণীত গ্রন্থের মতো বিষয়-বৈচিত্র খুব কম লেখকেরই। অথচ এই মহেন্দ্রনাথ দত্তকে (১৮৬৯-১৯৫৬) আমরা শুধু মনে রেখেছি বিবেকানন্দের মধ্যম ভ্রাতা হিসেবে। ভুলে গিয়েছি ১৮৯৭-১৯০২ সালে নিঃসঙ্গ এবং প্রায় নিঃসম্বল অবস্থায় ইউরোপ-আফ্রিকা-এশিয়া মহাদেশের নানা স্থানে তাঁর ভ্রমণের কথা। মনে রাখিনি সর্বজনীন দুর্গোৎসবে সিমলা ব্যায়াম সমিতির একচালা প্রতিমার সৌন্দর্যময় পরিকল্পনা তাঁরই ছিল।
সিমলে দত্তবাড়ির এই অদ্ভুত মানুষটির জন্ম হয়েছিল ১লা অগস্ট, ১৮৬৯ সালে। স্বামীজি সম্পর্কে ছোট একটা ভুল শুরুতেই ভেঙে দেওয়া ভাল। আমাদের নরেন্দ্রনাথ কিন্তু বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দাসীর জ্যেষ্ঠপুত্র নন। নরেনের আগে তাঁদের আর একটি ছেলে ছিল, মাত্র আট মাস বয়সে নামকরণের আগেই শিশুটির দেহাবসান হয়েছিল। বিশ্বনাথের তিন পুত্র নরেন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল তার অনেক পরে। গবেষকদের শেষ হিসেবমতো বিশ্বনাথ দত্তের ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিল দশ। চার ছেলে, ছয় মেয়ে। এঁদের মধ্যে নবম মহেন্দ্রনাথ ৮৭ বছর বেঁচে ছিলেন এবং কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথের দেহাবসান হয়েছিল ৮১ বছর বয়সে। ভুবনবিদিত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার তুলনায় মহেন্দ্রনাথ তেমন কিছু করেননি, কিন্তু পরবর্তী কালে তাঁর শতখানেক বইগুলো সকলকে বিস্ময়ে অভিভূত করে। মহেন্দ্রনাথ দাদার তুলনায় তেমন কিছু কীর্তিমান না হলেও মহেন্দ্রনাথের মতো মানুষ এ দেশে তেমন জন্মগ্রহণ করেননি। অন্য দেশ হলে এত দিনে তাঁর বিচিত্র জীবন নিয়ে নির্মিত অন্তত আধডজন চলচ্চিত্র বিশ্বজনকে মোহিত করত!
মহেন্দ্রনাথ অবশ্যই ঊনবিংশ শতাব্দীর অনন্য এক ‘দার্শনিক’, ‘দুঃসাহসী’, ‘গবেষক’, ‘চিন্তানায়ক’, ‘ইতিহাসবিদ’, ‘পরিব্রাজক’ এবং ‘উদাসী এক সাধক’। জানা যায়, লেখক মহেন্দ্রনাথের কলম ধরার অভ্যেস ছিল না, কিন্তু এই স্মৃতিধর পুরুষটি ভক্তজনকে ‘ডিক্টেশন’ দিতেন – যেমনটা দিতেন ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্য নাট্যকার ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ’। আরও জানা যায়, বই লিখে অর্থ উপার্জনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন মহেন্দ্রনাথ। তাঁর নামাঙ্কিত বইগুলি ছাড়া এ দেশের ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলন’কে পুরোপুরি বোঝা প্রায় অসম্ভব। যদিও কেউ কেউ এখন দুঃখ করেন, লেখক মহেন্দ্রনাথ তাঁর প্রাপ্য সম্মান আজও পাননি। নিজের নামাঙ্কিত ছোট ছোট বইগুলি ছাড়াও আরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েক ডজন কথোপকথন। সব রচনা বোধ হয় আজও গ্রন্থিত হয়নি, কিন্তু ভক্তজন ও অনুরাগীদের এই সব স্মৃতিসঞ্চয়ে বিবেকানন্দ অ্যান্ড ফ্যামিলির যে সব খবরাখবর ছড়িয়ে আছে, তা বিস্ময়কর। সবচেয়ে বিস্ময়কর যে বিষয়, তা হল তাঁর অনন্য ‘স্মৃতিশক্তি’, সেই সঙ্গে ‘রসবোধ’ ও ‘সত্যনিষ্ঠা’। মহেন্দ্রনাথ যখন লেখক, তখন আমরা এক আশ্চর্য বিবেকানন্দকে বারে বারে খুঁজে পাই। ঘটনামালার গভীরে ঢুকে খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে সেই বিবেকানন্দকে, যিনি আজও তুলনাহীন! একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, ভুবনবিদিত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার থেকে তিনি ছিলেন ছ’বছরের ছোট। এই সাধকের প্রাক্সন্ন্যাস জীবনের তথ্য তাঁর থেকে বেশি কেউ জানতেন না। কিন্তু ঐতিহাসিকের সত্যনিষ্ঠা নিয়ে তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম্বন্ধে যে সব ঘটনামালা দেশে এবং বিদেশে লিপিবদ্ধ করেছেন, সেখানে তাঁকে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে অহেতুক কোনও ব্যস্ততা নেই। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে তিনি কী নামে ডাকতেন? ‘দাদা’ বলতেন কি না, তা ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু অনেকগুলি বই একের পর এক পড়লে বোঝা যায়, এই সব লেখা না থাকলে আমরা সম্পূর্ণ বিবেকানন্দকে এমন নিবিড় ভাবে পেতাম না। কিন্তু কেমন ছিল তাঁর সঙ্গে দাদার সম্পর্ক? বিবেকানন্দ বচন যাঁরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন, তাঁরা জানেন – বিবেকানন্দ তাঁর ভাইকে যে ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিলেন, তা পূর্ণ হয়নি এবং জ্যেষ্ঠের এই হতাশা এবং কঠিন মন্তব্য চিঠিপত্রের দু’এক জায়গায় ছড়িয়ে আছে।
এই সব প্রসঙ্গে এক সময় অবশ্যই আসতে হবে। কিন্তু মহেন্দ্রনাথের জীবনকথার কয়েকটি বিভাগ সবারই নজরে পড়ে যায়। প্রথমে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের যে বাড়িতে তাঁর জন্ম, মহেন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন – ভিটেবাড়ির ভিতরে দেড়বিঘা জমি ছিল এবং অনেক জমিতে রেওয়ত ছিল। দশ ভাইবোনের মধ্যে ‘সাতজন বড় হইয়াছিল।’ যে কন্যারা বড় হয়েছিল, তাঁদের নাম হারামণি, স্বর্ণলতা, কিরণবালা ও যোগেন্দ্রবালা। দাদার ও নিজের বল্গাহীন তামাকপ্রিয়তা সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ নির্ভয়ে জানিয়েছেন, পিতৃদেবের কোচোয়ানের কাছ থেকেই এ ব্যাপারে নরেন্দ্রনাথের হাতেখড়ি। সে বলত, ‘বিলুবাবু, হুক্কা পিয়ো।’ হুঁকো থেকে নরেন্দ্রনাথের এই তামাকপ্রিয়তা যে নস্যি, খৈনি এবং চুরুটে বিস্তৃত হয়েছিল, তা আমরা মহেন্দ্রনাথের রচনা থেকেই জানতে পারি। মারবেল, লাটিম, ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গে তিনি যে ব্যাটম্বল (এখনকার ক্রিকেট) খেলায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন, তাও মহেন্দ্রনাথের সুনিপুণ বর্ণনা থেকেই আমরা জানতে পারি। পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তের ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে ওকালতির খবররাখবর আমরা যতটুকু পাই, তা মহেন্দ্রনাথের জন্যই। আইনবিদ বিশ্বনাথ দত্তের কোনও চিত্র বা আলোকচিত্র আজও উদ্ধার হয়নি। কিন্তু মহেন্দ্রনাথ আমাদের জানিয়েছেন, সে বার লাহৌরে বিশেষ বরফ পড়ায় বিশ্বনাথ কানে কালা হয়ে যান। পসার ছেড়ে তিনি প্রথমে রাজপুতানা, পরে ইনদওর ও শেষে মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে চলে যান। রান্নাবান্না এবং খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে নরেন্দ্রনাথের বিশেষ আগ্রহ যে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া, তা মহেন্দ্রনাথই আমাদের জানিয়েছেন। পোলাও ও মাংস রান্নায় তাঁর পিতৃদেব ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেই দক্ষতা যে বিবেকানন্দ সন্ন্যাসজীবনেও ত্যাগ করেননি। আরও একটি মজার খবর – নরেন্দ্রনাথ অল্প বয়সে কিছুতেই ইংরেজি পড়তে চাইতেন না। শেষ পর্যন্ত জননী ভুবনেশ্বরীই নরেনকে বাংলা এবং ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব নেন। দাদা সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ যা লিখছেন তার আকার তেমন দীর্ঘ নয়, কিন্তু তথ্যের উৎস হিসেবে এগুলিকে ‘সোনার খনি’ বলাটা অত্যুক্তি হবে না। এ ছাড়াও অনেক খবর ছড়িয়েছিটিয়ে আছে নানা জনের সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের শেষ বয়সের সংলাপে। যেমন তাঁর ছোটবেলার খাদ্যবিলাস। স্কুল থেকে ফিরে দু’ভাই পাঁঠার মুড়ি দিয়ে কড়াইশুঁটির তরকারি প্রাণভরে খেতেন। এঁরা যে মিতাহারী ছিলেন, এমন ভাবার সুযোগ নেই! তাঁর বইতে আরও খবর আছে, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন তৈরির অনেক আগে নরেন তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ‘গ্রিভি ক্লাব’ সংগঠন করেছিলেন এবং ভুনি খিচুড়ি তৈরিতে সবিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। আর একটি খবর আমার খুব ভাল লেগেছিল – বেদ বেদান্ত উপনিষদ বোঝার অনেক আগেই তিনি ফরাসি রান্নার দামি বই কিস্তিতে কিনেছিলেন। নিলামে কিনেছিলেন চায়ের কেটলি। চায়ের নেশা এতই প্রবল ছিল যে, ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের রাত্রে কাশীপুরে বাড়ির দরজায় আগুন ধরিয়ে, তাতেই সবাই মিলে চা পান করেছিলেন।
সে কালের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ বিভিন্ন জায়গায় যে সব বিবরণ রেখে গিয়েছেন, তার কোনও তুলনা নেই। তিনি জানিয়েছেন কয়লার প্রচলনের আগে কলকাতার রান্নাঘরের কথা। সেই সময় সব বাড়িতে কাঠের জ্বালে রান্না হতো এবং খালধার থেকে গাড়ি করে ‘সুঁদুরীকাঠ’ আসত। ‘ইংরেজি ১৮৭৫ বা ৭৬ সালে গ্যাস ঘরেতে পাথুরে কয়লা চলন হলো এবং লোকের বাড়িতে গাড়ি করে বিনামূল্যে বিতরণ হত। … ক্রমে কয়লার এক আনা করে মণ হলো।’ মহেন্দ্রনাথ জানাছেন, হুগলিতে তখন নাকি গুঁড়িগুঁড়ি বরফ পড়ত।
নরেন্দ্রনাথের বাল্যকাল সম্বন্ধে মহেন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘একসময় রাতের বিবাহেও ফলাহার হত, অর্থাৎ চিঁড়ে, দই, ঘি ইত্যাদি।’ যথাসময়ে কলকাতায় নিমন্ত্রিতের পাতে লুচির শুভাগমন, ‘তখনকার দিনে কলাপাতায় বড় বড় লুচি দিত, আর আলুনী কুমড়ার ছক্কা … কলাপাতার এক কোণে একটু নুন দিত।’
কয়েক বছর আগে স্বামী ব্রহ্মানন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষ ছিল। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বরাহনগর মঠে সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল রাখালচন্দ্র ঘোষ। তাঁর জন্ম ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২১শে জানুয়ারি শিকরা কুলীন গ্রামে। এই গ্রামটি বসিরহাট মহকুমার অন্তর্গত। তাঁর পিতা আনন্দমোহন ঘোষ ছিলেন জমিদার। রাখালচন্দ্র কলকাতায় এসে সিমলাপল্লির ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে যখন ভর্তি হন, তখন তাঁর বয়স ছিল বারো বছর। নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পর। পরে তিনি ব্রাহ্ম সমাজে গেছেন এবং নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার জন্য অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। অবশ্য এই ব্যাপারে উৎসাহ পেয়েছেন নরেন্দ্রনাথের কাছে। রাখালচন্দ্র ও নরেন্দ্রনাথের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “১৮৮৪ বা ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ, গ্রীষ্মকাল, আমাদের পড়িবার ঘরে নরেন্দ্রনাথ ও রাখাল রাত্রে পাশাপাশি শুইয়া আছে। খানিক রাত্রে দুজনের ভিতর তর্ক উঠিল। রাখাল বলিল যে, নরেন্দ্রনাথ অনেক দিন জিমনাস্টিক করা ছাড়িয়া দিয়াছে, সে এখন পিকক মার্চ বা ঊর্ধ্বপদ ভ্রমণ করিতে পারিবে না। এই তর্ক উঠিলে এক টাকা বাজি ধরা হইল। অর্ধেক রাত্রে তখন দুই জন উঠিয়া সম্মুখের দালানে জিমনাস্টিক শুরু করিল। নরেন্দ্রনাথ মালকোঁচা মারিয়া দালানটাতে ঊর্ধ্বপদ ভ্রমণ করিতে লাগিল আর রাখাল সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল। পাশের ঘরে যাহারা শুইয়াছিল, তাহাদের ঘুম ভাঙিলে বকাবকি শুরু করিল কি উৎপেতে ছেলে, আদ্দেক রাতে উঠে জিমনাস্টিক শুরু করেছে? ছোঁড়া দুটো মাথাপাগলা, একটু বিবেচনা নেই যে, লোক ঘুমুচ্ছে।”
১৮৯১ সালে যখন এফ এ পাশ করেন, তখন তাঁর দাদা সন্ন্যাসী হয়ে পরিব্রাজক এবং দু’বছর পরে বোম্বাই থেকে জাহাজে আমেরিকায় পাড়ি দেন।
মহেন্দ্রনাথের সুদীর্ঘ জীবনকে ঠিক ভাবে বুঝতে গেলে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমে দাদার সঙ্গে শৈশব, বাল্যজীবন ও পিতার আকস্মিক দেহত্যাগে পারিবারিক বিপর্যয়। এর পরই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সংসারত্যাগে আর এক বিপর্যয় এবং কাশীপুর উদ্যানবাটি ও বরাহনগর মঠে দাদার কঠিন জীবন যাপন। এর পরে স্বামীজির পরিব্রাজক জীবন সম্বন্ধে মেজ ভাইয়ের কাছে তেমন খবরাখবর নেই। দাদার বিদেশযাত্রার পরে নিয়মিত অর্থসাহায্য খেতড়ি থেকে আসত এবং খেতড়িরাজ নিজে গুরুর পরিবারের সব খবরাখবর নিতেন। এফ এ পাশ করে, বিশেষ কিছু না করে ১৮৯৬ সালে খেতড়ির মহারাজের কাছ থেকে এক পিঠের জাহাজভাড়া নিয়ে ব্যারিস্টারি পড়বার আশায় মহেন্দ্রনাথ লন্ডনে হাজির হন। তাঁর অজ্ঞাতে খেতড়ির মহারাজের কাছ থেকে বিদেশে আসার অর্থসাহায্য নেওয়া স্বামীজির মোটেই পছন্দ হয়নি। লন্ডনে মহেন্দ্রনাথ ব্রিটিশ মিউজ়িয়ামে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন এবং সেই সময় প্রবাদপ্রতিম সান-ইয়াৎ-সেন-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সংসারত্যাগী দাদা ছিলেন ভাইয়ের আইন পড়ার বিশেষ বিরোধী। তিনি বললেন, আমেরিকায় গিয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ভাই রাজি হলেন না। ফলে দাদার প্রবল ধৈর্যচ্যুতি। তিনি সোজা বললেন, দেশে ফিরবার জাহাজভাড়া তিনি দিতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, এই পর্বে স্বামীজির প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়, যার বিবরণ মহেন্দ্রনাথ দিয়েছেন। এর পর মহেন্দ্রনাথ উধাও, দাদাকে না বলেই পায়ে হেঁটে বিলেত থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত। তাঁর এই আচরণ দাদাকে বিশেষ কষ্ট দিয়েছিল এবং স্বামীজি উধাও হওয়া ভাইকে অন্যের মাধ্যমে খবর পাঠাচ্ছেন, তাতে লিখছেন, মহিম যেন মাকে চিঠি দেয়। ১৮৯৮ থেকে টানা পাঁচ বছর নিঃসম্বল অবস্থায় পর্যটন, মহেন্দ্রনাথের জীবনে এক চাঞ্চল্যকর অধ্যায়। এর সম্বন্ধে সামান্য কিছু লেখা হলেও তা যথেষ্ট নয়। ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ায় মহেন্দ্রনাথের দুঃসাহসিক ভ্রমণ সম্বন্ধে যৎসামান্য যা লিপিবদ্ধ হয়েছে। তা যথেষ্ট নয়। পরবর্তী কালে তাঁর ভক্তদের এক জন যে সংক্ষিপ্তসার দিয়েছেন তা নির্ভরযোগ্য মনে হয়। বর্ণনাটি মোটামুটি এই রকম:
‘‘ইংলণ্ড ত্যাগ করিয়া জাহাজে ফরাসি দেশ। সেখান হইতে জাহাজে জিব্রাল্টার পার হইয়া হাঁটাপথে মরাক্কা মাল্টাদ্বীপ, আলেকজান্দ্রিয়া, কায়রো। … কায়রো হইতে জেরুসালেম … আড়াই মাস অবস্থান করেন দামাস্কাসে। ত্রিপোলীতে দু’এক মাস, কনস্টানটিনোপল, সোফিয়া, বুলগেরিয়া, বানকাল পাহাড় অতিক্রম ও নানা পথ ভ্রমণ করিয়া পুনরায় কনস্টানটিনোপলে। … সে স্থান হইতে আরমেনিয়া, সেখান হইতে ককেশাস পাহাড় পার হইয়া বাকু শহরে অবস্থান। সেখান হইতে কাসপিয়ান সাগর পার … তেহরান-খোরসান-ইসপাহান-মেসোপটেমিয়া-বাগদাদ, বসরা-করাচি-কাশ্মীর।’’
দাদার আকস্মিক দেহত্যাগের কয়েক দিন পর মহেন্দ্রনাথের কলকাতায় ফেরা।
সুদীর্ঘ জীবনে মহেন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন অনুধ্যান ছাড়াও অসংখ্য ভক্তজনের কাছে যে সব কথা বলেছেন, তার বেশ কিছু গবেষকদের হাতে রয়েছে। এই সব সংলাপ বিশ্লেষণ করে, তার থেকে মণিমুক্তো সংগ্রহ করা আজও হয়নি। তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্বন্ধেও গবেষকরা সমস্ত খবরাখবর সাজিয়ে নিতে পারেননি। কিছু কিছু খবর অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে, যেমন ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তনকালে (১৯০২) মহেন্দ্রনাথ কিছুকাল করাচিতে সাংবাদিকতা করেছিলেন। কলকাতায় ফিরে মহেন্দ্র কখনও উপার্জনের তেমন চেষ্টা করেননি। বই থেকে উপার্জনের চেষ্টা সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব মতামত, ‘‘বই বেচার পয়সা থেকে এক পয়সার পান কিনে যদি আমায় খাওয়াও তা হলে আমি পতিত হব, আর তোমরা যদি খাও তা হলে তোমাদেরও বিশেষ অকল্যাণ হবে।’’
তবে বৈষয়িক বিষয়ে মহেন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন তা নয়। তাঁর এক ভক্ত লিখেছেন – ‘পৈত্রিক সম্পত্তি আত্মীয়দের গ্রাস থেকে তিনি নিজে অতি পরিশ্রম এবং অর্থাভাবের সঙ্গে লড়াই করে উদ্ধার করেছিলেন।’ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বসতবাড়ি ছাড়া তিন-চারটি ভাড়াটে বাড়ি তাঁর এবং ছোটভাই ভূপেনবাবুর ছিল। এক সময় তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাবার সম্পত্তি যেমন পেয়েছিলাম তেমনই রেখে যাবো।’’ তবে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে ছিল ‘দুই কি তিনখানি আটহাত মোটা কাপড়, হাতকাটা কামিজ দুই-একটি ও একটি লাঠি এবং রাস্তার ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা আট আনা দামের চশমা এবং তামাকের লটবহর।’ মহিমবাবু বাড়িতে যে অন্ন পেতেন, তা তাঁর ভাড়াটেবাড়ির কিছু অংশ থেকে। পরিচিত জনেরা মহেন্দ্রনাথের অদ্ভুত স্মৃতিশক্তির কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। এক বার রসিকতা করে তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘‘আমার ব্রেনের এক স্কোয়ার ইঞ্চিতে এক একটা বড় লাইব্রেরি আছে।’’ আবার তিনি বলছেন, ‘‘বই-পড়া বিদ্যের কানাকড়ি দর নেই। … আমি যা দেখেছি, তার কিছুই বলে যেতে পারলাম না। আমার গায়ে কুড়িটা জিভ বসিয়ে দাও, চল্লিশজন লোক বসে লিখুক কত দেখি।’’ জ্যেষ্ঠভ্রাতা স্বামীজি সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য, ‘‘তিনি দেশের এতো প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন, দেশকে ভালবেসেছিলেন বলে। তাঁর ধ্যান-ভজনের জন্য অতোটা নয়। হার্ট এবং ইনটেলেক্ট দুটোই চাই কিছু করতে গেলে।’’ মহেন্দ্রনাথের আর একটি বিখ্যাত পরামর্শ, ‘‘কারও নিন্দে কোরো না, রূঢ় বাক্য ব্যবহার কোরো না। বড় ক্ষতি হয়। সবাইকে ভালবাসবে।’’
স্বামী বিবেকানন্দের লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্রে অনুজ মহেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে মন্তব্য পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা থেকে স্বামী সারদানন্দকে ২০মে ১৮৯৪ তারিখে লেখা একখানি চিঠিতে স্বামীজী লিখেছেন, “তুমি কি বলিতে চাও আমি একজনের বন্ধনের সহায়তা করিব? কি আহাম্মক তুমি! যদি আমার ভাই মহিন বিবাহ করে আমি তাহার সহিত কোন সংস্রব রাখিব না। এ বিষয়ে আমি স্থির সংকল্প। এখন বিদায়।” (পত্রাবলী, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১৩৫) আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন পথের পথিক মনে হলেও স্বামীজী মহেন্দ্রানাথের জীবনপথের প্রতি স্নেহপূর্ণ এবং তীক্ষ্মদৃষ্টি রেখেছিলেন। লুসার্ন থেকে ২৩শে আগস্ট ১৮৯৬ তারিখে স্বামীজী একখানি চিঠিতে তাঁর বন্ধু মিঃ স্টাডিকে জানাচ্ছেন, “মহিম ও ফক্সের সঙ্গে এর পর যখন দেখা হবে, দয়া করে তাদের আমার ভালবাসা জানিও।” (পত্রাবলী, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ৪৮৩।) ৬৩ নং সেন্ট জর্জিয়া রোড, লন্ডন থেকে স্বামীজী বিদেশিনী শিষ্যা মিসেস বুলকে লেখা ৫ই জুন, ১৮৯৬ তারিখের চিঠিতে মহেন্দ্রানাথের ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে স্বামীজী জানাচ্ছেন – “I do not like any one whom I love to become a lawyer, although my father was one … What my nation wants is pluck and scientific genius, so I want Mohin to be an electrician. Even if he fails in life, still I will have the satisfaction that he strove to become great and really useful to his country … I want him to be daring, bold and struggle to cut a new path for himself and his nation …” (Complete Works of Swami Vivekananda Vol.6, Page 363, Second reprint of the subsidized Edition, March 1989, Advita Ashram.) এই চিঠিতে আমরা জানতে পারি যে স্বামীজ চেয়েছিলেন, মহেন্দ্রনাথ ওকালতি না পড়ে একজন ইলেক্ট্রিসিয়ান হন। আরও জানতে পারি তিনি জানাচ্ছেন, “যাঁকে তিনি ভালবাসেন, তাঁর উকীল হওয়া তিনি পছন্দ করেন না।”
পরর্বতী জীবনে যদিও মহেন্দ্রনাথ Electrician হননি, কিন্তু দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পৃথিবীর নানা স্থানে অকুতোভয়ে ভ্রমন করেছেন,পর্যবেক্ষণ করেছেন বিশ্ব-প্রকৃতি আর মানব সমাজকে। এই সম্বন্ধেও স্বামীজীর আর একখানি চিঠি পাই। প্যারিস থেকে ইংরাজী ১৪ই আগস্ট ১৯০০ সালে বিবেকানন্দ জন ফক্সকে ইংরাজীতে লেখা এক চিঠিতে জানাচ্ছেন – “Kindly write Mohin that he has my blessings in whatever he does. And what he is doing now surely much better than lawyering, etc. . . Only as my health is failing and I do not expect to live long, Mohin must see his way to take care of mother and family. I may pass away any moment. I am quite proud of now.” (Complete Works of Swami Vivekananda Vol.8, Page 531-532, First reprint of the subsidized Edition, January 1989.) দেহত্যাগের দুবছর আগে লেখা এই চিঠির আদেশ মহেন্দ্রনাথ পালন করেছিলেন গৌরমোহন মুখার্জী ষ্ট্রীটে ফিরে এসে রত্নগর্ভা মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর এবং স্বামীজীর আত্মীয়-স্বজনদের তত্ত্বাবধানের জন্য। অবশ্য মা এবং পরিবারের লোকেদের দেখাশুনা করা ছাড়াও মানব সমাজ, বিজ্ঞানশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ের উপর জাতির নব পথপ্রর্দশনের চিন্তারাজি গ্রথিত করেছেন প্রায় একশখানি গ্রন্থে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করলেও বিবেকানন্দ পারিবারিক দায়িত্ব অবহেলা করতে চাননি। পারিবারিক দুরবস্থা তাঁকে ব্যথিত করত। শ্রীপ্রমদাদাস মিত্র মহাশয়কে ৪ঠা জুলাই ১৮৮৯ তারিখে একটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন, “আমার মাতা ও দুইটি ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জেষ্ঠ, মধ্যমটি ফার্ষ্ট আর্টস পড়িতেছে আর একটি ছোট, ইহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল। কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্য্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমন কি কখনও কখনও উপবাসে দিন যায়। তাহার উপর জ্ঞাতিরা দুর্বল দেখিয়া পৈতৃক বাসভূমি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিল, হাইকোর্টে মোকদ্দমা করিয়া যদিও সেই পৈতৃক বাটীর অংশ পাইয়াছেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হইয়াছেন- যে প্রকার মোকদ্দমার দস্তুর। কখন কখন কলিকাতার নিকট থাকিলে তাহাদের দুরবস্থা দেখিয়া রজোগুণের প্রাবল্যে অহংকারের বিকার স্বরূপ কার্য্যকারী বাসনার উদয় হয়। সেই সময় মনের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ বাধে, তাহাতেই লিখিয়াছিলাম , মনের অবস্থা বড়ই ভয়ঙ্কর। এবার তাহাদের মামলা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলিকাতায় থাকিয়া তাহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মত বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্ব্বাদ করুন।”
পরমহংসদেবের ভাবশিষ্য হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করে দেশে দেশে ফিরে প্রায় বিশ বছর ধরে “ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে” কতই না ভ্রমণ করেছেন। নবজাগরণের কল্যাণপ্রদ মহাভব ও শুভধর্মের যুগান্তকারী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে এসেও ভুলতে পারেননি- গর্ভধারিণী মাতৃদেবী ভুবনেশ্বরীকে, সহোদর ভাই মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথকে, আর নিজ পরিবারের আত্মীয়-স্বজনদের। সেই জন্যই বোধহয় ১৯০০ সালের ২৫শে আগস্ট তারিখে কন্যাসম শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতাকে লিখলেন, “আমি এইবার সম্পূর্ণ অবসর নিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি মায়ের ইচ্ছা আমি আমার আত্মীয়দের জন্য কিছু করি। ভাল, বিশ বছর আগে যাত্যাগ করেছিলুম, আনন্দের সঙ্গে তা ঘাড়ে নিলাম।”
কথাপ্রসঙ্গে মহেন্দ্রনাথ এক বার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মাপজোক করেছেন। কথা উঠল, নরেনের কিছু ছিল না, ঠাকুরের কাছে গিছলো, তাই বিবেকানন্দ হলো! মহেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘আরে সে যে পোয়েট ছিল, পেন্টার ছিল। ফিলজফার ছিল!’’
মহেন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল নানা বৈচিত্র। এক সময় তাঁর ভ্রমণকাহিনী সম্পর্কে বলা হত – তিনি ফা-হিয়েন, ইবন বতুতার সগোত্র। নানা বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করে গিয়েছেন। শোনা যায় ওঁর তিরিশটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়েছিল। আরও শোনা যায়, তিনি নিজে কখনও কলম ধরেননি। সব সময় তিনি মুখে বলে গিয়েছেন এবং অন্য কেউ লিখেছে। ‘স্বামীজির জীবনের ঘটনাবলী’, ‘লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ’ ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাল্যজীবন’ ‘কাশীধামে বিবেকানন্দ’ ইত্যাদি বইগুলো না থাকলে বিবেকানন্দকে আমরা এত নিবিড় ভাবে জানতে পারতাম না। ‘ঘটনাবলী’র তিনটি খণ্ড পাঠ না করলে স্বামী বিবেকানন্দ পাঠকের মনে যেন অপূর্ণ থেকে যান। এখানে তিনি ‘জাতক’-এর রীতি অনুসরণ করেছেন – ‘নিজের কোন মত প্রকাশ করা হয় নাই, পাঠ করিয়া যিনি যাহা বুঝিবেন সেইরূপ মীমাংসা করিবেন।’ একই মাপকাঠিতে অতুলনীয় স্মৃতিকথা দু’খণ্ডের ‘লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ’। যার ভূমিকায় তিনি জানিয়েছেন, ১৮৯৬ সালে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে লন্ডনে যান এবং মধ্যম ভ্রাতাও এক সপ্তাহ পরে লন্ডনে পৌঁছন। দীর্ঘ জীবনলাভের সৌভাগ্য হয়েছিল মহেন্দ্রনাথের। তাঁর জীবনের শেষ পর্বে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়কে বাড়িতে ডাকা হয়েছিল। পরীক্ষা করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘কি করে বেঁচে আছেন উনিই জানেন, এসব এঁদের পক্ষেই সম্ভব। আমরা চিকিৎসক, আমাদের শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা করে যেতে হবে।’’ মহেন্দ্রনাথের দেহাবসান ঘটেছিল ১৫ই অক্টোবর ১৯৫৬ সালে পূজার সময়। মহানবমীর দিনে গুরুতর অসুস্থ মহেন্দ্রনাথকে দেখতে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তবাড়িতে ‘ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়’ এসেছিলেন। বিজয়া দশমীর রাত্রি ১২টা ৪২ মিনিটে মহেন্দ্রনাথের বিদায় মুহূর্তে ঘরের আলোটি হঠাৎ ফিউজ হয়ে গিয়েছিল এবং সেই সময়েই নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলেন স্বামীজীর অসামান্য ভ্রাতা ও অসামান্য লেখক মহেন্দ্রনাথ। তাঁর এক ভক্ত লিখে গিয়েছেন – ‘১৩৬৩ সালের ২৮ আশ্বিন, রবিবার, পুণ্য বিজয়া দশমী। রাত্রি ১২টা ৪২ মিনিটে সব স্থির হইয়া গেল। আশ্চর্য, ঠিক সেই সময় পুণ্যদর্শনের ঘরের আলোটি ফিউজ হইয়া যাওয়ায় বরেনবাবু অতি দুঃখে বলিলেন, আমাদের আলোও নিভল।’
(তথ্যসূত্র:
১- প্রথম আলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
২- পত্রাবলী, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৮০।
৩- পত্রাবলী, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৮৭।
৪- Complete Works of Swami Vivekananda Vol.VI, Second reprint of the subsidized Edition, March 1989, Advita Ashram.
৫- Complete Works of Swami Vivekananda Vol.VIII, First reprint of the subsidized Edition, January 1989.
৬- কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা, মহেন্দ্রনাথ দত্ত।
৭- অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ, শংকর।
৮- স্বামী বিবেকানন্দ এক অনন্ত জীবনের জীবনী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
৯- লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ, মহেন্দ্রনাথ দত্ত।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত