নিজের জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘‘আমার গান যাতে আমার গান বলে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো।’’ কথাটি তাঁর গানের নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্রিক সত্ত্বার বিষয়টিকেই ইঙ্গিত করে। সময়ের বিবর্তনে এখন রবীন্দ্রনাথের গানের স্বভাব কিংবা ঢং কতটা মৌলিকত্ব বজায় থাকছে সেটি আসলে ভাববার বিষয়। অনেকের গায়কীতেই এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিচিত্র প্রকাশ দেখা যায়। আধুনিকায়নের মিশেলে গায়কীতেও বদল ঘটেছে। যে কারণে এতদিন পর প্রশ্ন উঠেছে এতো গায়কীর মধ্যে কোনটি তাঁর নির্বাচিত, কাঙ্ক্ষিত, কিংবা তাঁর গানের প্রকৃত ঢং। তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যথার্থ সুর, ঢং বা ঘরানাকে প্রকৃত গায়কীতে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে যে ক’জন সঙ্গীতশিল্পী আজন্ম সাধনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানকে গণমানুষের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদেরই একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষিকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। কবিগুরু যাঁর নাম ‘অণিমা’ থেকে ‘কণিকা’ রেখেছিলেন, যাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডাকতেন ‘আকবরী মোহর’ সেই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনো সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে অনন্য উজ্জ্বল হয়ে আছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীদের মধ্যে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষত টপ্পা অঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক গায়িকা। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অতুলপ্রসাদের গানেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন; যদিও এই ধারায় তাঁর রেকর্ড সংখ্যা খুব বেশি নয়। জীবনের অধিকাংশ সময় শান্তিনিকেতনে অতিবাহিত করলেও তাঁর জনপ্রিয়তা পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশেও পরিব্যাপ্ত ছিল।
১৯৫২-৫৩ সাল। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রেকর্ডিংয়ের জন্যে এসেছিলেন কলকাতায় এইচএমভি স্টুডিয়োতে। রিহার্সাল রুমে তাঁর দেখা হয়েছিল সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। দু’জনের সেই প্রথম মুখোমুখি পরিচয় হয়েছিল। এর আগে থেকেই সলিলের গান কণিকার ভীষণ প্রিয় ছিল। সে দিন কণিকা বলেই ফেলেছিলেন, সলিলের গান গাইতে তাঁর খুব ইচ্ছে করে। এ কথা শুনেই সলিল চৌধুরী দিন দুয়েকের মধ্যেই কণিকার জন্যে দুটো গান তৈরি করে ফেলেছিলেন। রেকর্ডিংও হয়ে গিয়েছিল। এর পরেই গন্ডগোলের শুরু হয়েছিল। খবর গিয়েছিল শান্তিনিকেতনে। কণিকা নিজেই লিখেছিলেন, ‘‘সলিলের গান করেছি, এ খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছল যথারীতি। অনেকে আপত্তি করলেন, কেন আমি রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে আবার আধুনিক গান গাইব? রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়লাম কোথায়! সে গান তো আমার সারাজীবনের আশ্রয়। কিন্তু তর্কে আমি কুঁকড়ে যাই। লড়াই চালাতে ইচ্ছে করে না। ফলে আপত্তি মেনে নিলাম। সলিলকে জানালাম, বের করা যাবে না ওই রেকর্ড। দুঃখ পেয়েছিল সলিল। আমিও কম দুঃখ পাইনি।’’ শেষে উৎপলা সেনকে দিয়ে গানগুলো আবার রেকর্ডে গাইয়েছিলেন সলিল চৌধুরী। ১৯৫৩ সালের পুজোয় প্রকাশিত সেই গানদুটি ছিল ‘প্রান্তরের গান আমার’ এবং ‘আমার কিছু মনের আশা’। কিন্তু কণিকার গলায় গানদুটির আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি পরে। এর কয়েক বছর পরে আবারও দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় – ‘পত্র লিখি কাজল মেঘে’ এবং ‘সুরের পথে ঘুরে বেড়ায় আমার মন’ (কথা: শ্যামল গুপ্ত, সুর: মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়)। কিন্তু এই রেকর্ডদুটিও প্রকাশিত হয়নি, কণিকারই অনুরোধে। কারণ হিসেবে তাঁর প্রথম রেকর্ডকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের দুঃখ পাওয়ার কথা বলেছিলেন কণিকা। সলিল-সংক্রান্ত পূর্ব অভিজ্ঞতাও হয়তো একই সঙ্গে তাঁর ভেতরে কাজ করেছিল। যদিও কণিকার প্রয়াণের পর একটি অ্যালবামে মানবেন্দ্র-সুরারোপিত গানদুটি সঙ্কলিত হয়েছিল। কণিকা-সলিল ঘটনার কথা ‘পুরনো আখরগুলি’ নামক নিজের স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছিলেন অপর কিংবদন্তী সুচিত্রা মিত্র। তিনি বলেছিলেন, ‘চোখের জলে অর্ধেক মুছে যাওয়া একটি চিঠিতে’ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সলিল চৌধুরীকে লিখেছিলেন, ‘‘কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে। কাজেই আমাকে ক্ষমা কোরো ভাই।’’ উল্লেখ্য, শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া প্রথম রেকর্ডের গানদুটি কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, ছিল আধুনিক গান। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত ওই রেকর্ডে নীহারবিন্দু সেনের কথায় ও হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে কণিকা গেয়েছিলেন ‘ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার’ ও ‘গান নিয়ে মোর খেলা’। রবীন্দ্রনাথ তখন বেঁচে ছিলেন। এ ঘটনায় তিনি একটু দুঃখ পেয়েছিলেন। কণিকার ভাষায়, ‘‘আমার আধুনিক গানের রেকর্ড বের হওয়ায় দুঃখ পেলেন গুরুদেব। … গুরুদেব দুঃখ পাওয়ায় আমারও মন খারাপ হয়ে গেল।’’ খুবই স্বাভাবিক। যে ছোট্ট মেয়েটার মিষ্টি গান শুনে তাঁকে আশ্রমে টেনে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যাঁর পিতৃদত্ত ‘অণিমা’ নাম পালটে ‘কণিকা’ করে দিয়েছিলেন, সেই মেয়েটি প্রথম রেকর্ডে তাঁর গান ছাড়া অন্য গান গাইলে দুঃখ তো পেতেই পারেন কবি। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। কিন্তু সেই জিনিসই ঘটেছিল কবির প্রয়াণের বেশ কয়েক বছর পরে।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র – রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির মনে একই সঙ্গে থাকেন এই দুই কিংবদন্তী। কেমন ছিল কণিকা-সুচিত্রা সম্পর্ক? কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল ভীষণ স্পর্শকাতর মন। সমালোচকরাও অনেক সময় সুযোগ বুঝে আক্রমণ করতেন তাঁকে। যেমন সুচিত্রা-কণিকার লড়াই। ১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতন শূন্য। রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন। সেই সময় সুচিত্রা মিত্র শান্তিনিকেতনে গান শিখতে আসেন। তখন ইন্দিরা দেবী পিয়ানো বাজিয়ে সঙ্গীত ভবনে গান শেখাতেন। বর্ষামঙ্গল হত, শারদোৎসব হত। প্রফুল্লকুমার দাস ছিলেন। ছিলেন নীলিমা সেন, অরুন্ধতী দেবী। চিনা ভবনের সান্ধ্য আসরে প্রথম দেখা হয়েছিল সুচিত্রা ও কণিকার! সুচিত্রা সে দিন গেয়েছিলেন ‘ওই যে ঝড়ের মেঘে’। সুচিত্রার স্মার্টনেস্, ফর্সা রং, স্কিনের চাকচিক্য নিয়ে সে সময় শান্তিনিকেতনের মাঠেঘাটে জল্পনা শোনা যেত – ‘শহরে থাকলে রং ফর্সা হয়’, ‘নিশ্চই দামি ক্রিম মাখে’, ‘হাঁটা চলায় কী তেজ’। সুচিত্রা ও কণিকা, দু’জনের মধ্যে কোন বাক্যালাপ ছিল না। কেবল দু’জনে দু’জনকে আড়চোখে দেখতেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পরে জানিয়েছিলেন, ‘‘আমি সুচিত্রার সাজ-পোশাক দেখতাম আর নিজের দিকে তাকাতাম। আমার লাল মাটির খালি পা। শাড়ির নীচের দিকটায় লাল ধুলো। রোদে পোড়া তামাটে রং।’’ কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সুচিত্রা মিত্র সকলের মন জয় নিয়েছিলেন। সুচিত্রা মিত্রের গান গাওয়া, ছবি আঁকা, পুতুল গড়া, রান্না, সব দেখে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন! পরে খুব জমে উঠেছিল দু’জনের। এক জন ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় কুরূপা তো আর এক জন সুরূপা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও যেমন ‘শ্যামা’ রেকর্ডিং হয়েছিল। শ্যামা আর বজ্রসেন মানেই তখন কণিকা-হেমন্ত জুটি। ’৬২ সালে এইচ এম ভি জনগণকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য শিল্পীদের লরিতে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সুচিত্রা মিত্র শাড়ি পরে এক লাফে লরিতে উঠে গিয়েছিলেন। অন্য দিকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় উঠতেই পারছিলেন না। তাঁকে কোনওমতে টুল পেতে ওঠাতে হয়েছিল। তাঁদের দুজনের চরিত্রের মতো গানেও দু’জন দুটো ঘরানার ছিল। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় শৈলজারঞ্জন মজুমদারের আর সুচিত্রা মিত্র শান্তিদেব ঘোষের। আর এই ঘরানা নিয়েও সমালোচকরা দু’জনের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। শেষে তাঁদের মনোমালিন্য এমন হয়েছিল যে, কবিপক্ষে রবীন্দ্রসদনে একই দিনে দু’জনের গানের অনুষ্ঠানে দু’জন বসেছিলেন দু’প্রান্তে। পরে একই অনুষ্ঠানে দু’জনের গান গাওয়ার প্রস্তাব আসলেই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রেগে বলতেন, ‘‘সুচিত্রা অনুষ্ঠানে ১২ হাজার নিলে, আমায় ১ টাকা হলেও বেশি দিতে হবে।’’ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ থেকেও আর একটা ঘটনার কথা জানা যায়। একবার কলকাতায় ‘মায়ার খেলা’ হবে। ঠিক হয়েছিল কণিকা হবেন প্রমোদা আর সুচিত্রা হবেন শান্তা। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় সুচিত্রা মিত্রকে প্রস্তাবটা দিতেই সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘‘আমি শান্তা করলে মোহর প্রমোদা করবে না।’’ অগত্যা দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় কণিকাকে রাজি করাতে শান্তিনিকেতন পৌঁছালেন। কণিকা জানতে চাইলেন, ‘‘শান্তা কে?’’ দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘খুব ভাল গায় একটি সুন্দর মেয়ে।’’ তাঁর কথামতো অনুষ্ঠানের আগে কলকাতায় রিহার্সাল করতে গিয়ে কণিকা দেখলেন শান্তা আর কেউ নয়, স্বয়ং সুচিত্রা! কণিকা বেঁকে বসলেন। তিনি কিছুতেই সুচিত্রা মিত্রের সাথে গাইবেন না। তাঁর সব রাগ গিয়ে পড়েছিল দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের ওপর! কণিকা বন্দোপাধ্যায়কে অনেক করে বোঝানো হল, লোকে টিকিট কেটে বসে আছে সুচিত্রা-কণিকা শুনবে বলেই! শেষে তিনি রাজি হয়েছিলেন ও সুচিত্রা মিত্রের সাথে গেয়েছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের পরে দেখা গিয়েছিল একটা অবাক করা দৃশ্য। অনুষ্ঠানের পর তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন! কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হবার পরে সুচিত্রা মিত্র বলেছিলেন, ‘‘মোহর চলে গেছে, আর শান্তিনিকেতনে যাব না।’’
অণিমা ওরফে মোহরের জন্ম হয়েছিল ১২ই অক্টোবর, ১৯২৪ সালে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের সোনামুখী গ্রামে। শান্তিনিকেতনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ বরাবর দামোদর নদ পেরিয়ে পৌঁছতে হয় এই সোনামুখীতে। সেখানে ছিল মোহরের মা অনিলাদেবীর মামার বাড়ি। মোহরেরা ছিলেন পাঁচ বোন – কণিকা, সুহিতা, সুরেখা, ঝর্না ও বীথিকা। তিন ভাই শান্তিময়, সুমন, পান্নালাল। মা অনিলা অপূর্ব গান গাইতেন। বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন দক্ষ এস্রাজ বাদক। বিষ্ণুপুরের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য মোহরের রক্তে মিশেছিল। মা অনিলাদেবীর জ্যাঠামশায় রাজেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০২ সালে ইলামবাজারের কাছে হেতমপুর কলেজের সহপাঠী বন্ধু ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালের অনুরোধে শান্তিনিকেতন আশ্রমে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ বিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের প্রস্থানের পরে এই ভূপেন্দ্রনাথের হাতেই রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন আর রাজেন্দ্রলালকে আশ্রম বিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। রাজেন্দ্রলাল রবীন্দ্রনাথের জমিদারি দেখাশোনার জন্য পতিসরে যাতায়াত করতেন। পতিসরে জমিদার রবীন্দ্রনাথের নানা যুগান্তকারী কাজে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। রাজেন্দ্রলাল তাঁর পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ, বোনপো সুজিতকুমার মুখোপাধ্যায়, ভাইঝি জামাই ও মোহরের বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়কে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। তখন থেকেই তাঁর পরিবারের বিভিন্ন শাখার সদস্যরা শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা হয়ে যান। বিয়ের পরে ১৯২১ সাল থেকে বিশ্বভারতী পর্বের সূচনাকালে সত্যচরণ শান্তিনিকেতনে সংসার পেতে থাকতে শুরু করেন ও যুক্ত হন বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়ে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সহকারী হিসেবে। ১৯২৪ সালে জন্ম হয়েছিল মোহরের। শান্তিনিকেতনের ইতিহাসের যে পর্বে মোহরের জন্ম হয়েছিল, তা ছিল রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের শান্তিনিকেতন পর্ব। তখন তিনি তাকে ‘বিশ্বভারতী’তে বদলে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলেন।
শান্তিনিকেতনের আদি আশ্রম সীমান্তের দক্ষিণ প্রান্তে ছিল ন’টি কুঁড়েঘর নিয়ে আশ্রমের সব থেকে উজ্জ্বল গুরুদের পাড়া বা পল্লি। যা ‘গুরুপল্লী’ নামে আজও পরিচিত। আর উত্তর প্রান্তে ‘উত্তরায়ণ’ বা রবীন্দ্রনাথের আবাস অঞ্চল। গুরুপল্লির ওই ন’টি বাড়িতে থাকতেন রবীন্দ্রনাথের প্রধান সহকর্মীরা, যাঁদের আশ্রমের ‘নবরত্ন’ বলা হত। নতুন শান্তিনিকেতনকে ‘বিশ্ববিদ্যার তীর্থ’ হিসেবে গড়ে তোলার কাজে তাঁরা তখন রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন। তাঁরা হলেন নন্দলাল বসু, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রমদারঞ্জন ঘোষ, জগদানন্দ রায়, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, নেপালচন্দ্র রায়, নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামী এবং মোহরের বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়। বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতেন আশ্রমের পূর্ব-পশ্চিমের পল্লিগুলিতে। তাঁরা সকলেই ছিলেন অত্যন্ত পণ্ডিত ও প্রতিভাধর মানুষ। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পরে আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিমান ‘রবীন্দ্রনাথ টেগর’-এর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁদের সঙ্গেই একে একে শান্তিনিকেতনে আসতে শুরু করেছিলেন এন্ড্রুজ, পিয়ারসন, এলমহার্স্ট, সিলভা লেভি, উইন্টানিজের মতো আরও অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি। মোহর হয়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সময়কালটি ছিল শান্তিনিকেতনের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। কণিকা নিজেই লিখে গিয়েছেন, ‘‘শান্তিনিকেতনে থাকার সুবাদে আমাদের কত বড়ো বড়ো লোকেদের সঙ্গে, জ্ঞানী-গুণীদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। গান্ধিজি, নেহরু, সরোজিনী নাইডু, গুরুদেবের বিদেশি বন্ধু এলম্হার্স্ট, এন্ড্রুজসাহেব এবং আরও অনেককেই জানতাম নিজের লোক বলে।’’ তিনি এই সব মানুষের সাহচর্য ও ভালবাসায় শান্তিনিকেতনের ‘আশ্রমকন্যা’ হয়ে ঘুরে বেড়াতেন তাঁর আশ্চর্য কণ্ঠস্বরে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে।
আর এই শান্তিনিকেতনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই একদিন ‘অণিমা’ থেকে ‘কণিকা’ হয়ে গিয়েছিলেন সেই ছোট্ট বালিকা – সৌজন্যে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। বড়ই অদ্ভুত সেই আখ্যান। কোন এক দিন ভীষণ ঝড় উঠেছিল বিকেলের দিকে। আশ্রমের গাছপালাগুলি মাতালের মতো দুলছিল। মনে হচ্ছিল যেন মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়বে মাটিতে। সেই ঝড় মাথায় করে ছোট্ট অণিমা ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে বন্ধুর সঙ্গে আশ্রমের উত্তর প্রান্তে, যেখানে আশ্রমগুরুর বাড়ি সেই উত্তরায়ণে আম, জাম, গাব কিংবা শাল-শিমুল কুড়োতে। ঝড়ের আনন্দই না হলে তাঁর বাকি পড়ে যাবে যে! গুরুদেবের গান ‘ওরে ঝড় নেমে আয়’ সে কত বার গেয়েছিল। কিন্তু বুঝতে পারেনি সে দিনের সেই ঝড় ক্রমশ ভয়ঙ্কর আকার নেবে, বৃষ্টিতে চারপাশ সাদা হয়ে আসবে। গোটা আশ্রমটাই অদৃশ্য হয়ে যাবে চোখের সামনে থেকে। ভয়ে তাঁরা ছুটতে শুরু করেছিল নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কোন দিকে যে ছুটেছে, সেটা তাঁরা বুঝে উঠতে পারেনি। একটা বাড়ি সামনে পেয়েই তার দাওয়ায় গিয়ে উঠেছিল। ততক্ষণে তাঁরা ভিজে একেবারে চুপসি হয়ে গিয়েছিল। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে বাইরের ঝড় দেখছিল আর ভাবছিল, বাড়িতে মা হয়তো চিন্তা করছেন! তবে তাঁর এই স্বভাব সকলেরই জানা ছিল। এর আগেও আশ্রমের আনাচকানাচে আপন মনে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়াতে অনেকেই দেখেছিলেন তাঁকে। এমন সময়ে তাঁর চোখ পড়েছিল আশ্রয় নেওয়া বাড়িটার জানালার দিকে। ছোট্ট অণিমা দেখেছিল সাদা চুল, সাদা গোঁফ-দাড়ি আর অপূর্ব দু’টি চোখ নিয়ে একজন মানুষ তাকিয়ে আছেন বাইরে ঝড়ের দিকে। তাঁকে চিনতে অণিমার দেরি হয়নি। এঁকে ঘিরেই তো শান্তিনিকেতন আশ্রম! এঁর গানই তো সে গায় সারাক্ষণ। তার আগে আশ্রমের রাস্তা দিয়ে কত দিন তাঁকে হেঁটে যেতে দেখেছিল অণিমা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তাঁকে দেখেছিল অনেক বার – কিন্তু সবই দূর থেকে। এত কাছ থেকে তাঁকে সেই প্রথম দেখেছিল অণিমা। ভয়ে কাঁটা হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল এ বার হয়তো বকুনি খেতে হবে। না, তিনি বকেননি। বরং কাছে ডেকে অণিমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “গান জানিস?” অণিমা মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানাতেই তিনি বলেছিলেন, “শোনা দেখি!” অণিমা অবলীলায় গেয়ে উঠেছিল তাঁরই একটা গান। তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনে বলেছিলেন, “ওরে বাবা, তুই এতটা শিখেছিস!” এর পরে তাঁর পরিচয় জেনে নিয়ে বলেছিলেন, “মাঝেমাঝে এসে আমায় গান শুনিয়ে যাস।” এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথ ও অণিমা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎ ঘটেছিল শান্তিনিকেতন আশ্রমের উত্তরায়ণের ‘শ্যামলী’ বাড়ির দাওয়ায়। রবীন্দ্রনাথ যেমন করে ‘দীনেন্দ্রনাথ’কে চিনে নিয়ে তাঁকে ‘দিনেন্দ্রনাথ’ করে তাঁর গানের ‘ভাণ্ডারি’ করে নিয়েছিলেন, তেমনই ‘অণিমা’র দেখা পেয়ে তাঁকে ‘কণিকা’য় বদলে দিয়ে নিজের গান কেমন করে গাইতে হবে তার উদাহরণ রেখে যেতে চেয়েছিলেন। তাই কণিকাই হলেন সেই অল্প কয়েকজন রবীন্দ্রগানের শিল্পীর মধ্যে একজন, যাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান রেখে গিয়েছিলেন।
ক্ষিতিমোহন সেনের মেয়ে অমিতা, যিনি ওই একই সময়ে গুরুপল্লীর বাসিন্দা ছিলেন, তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ‘‘বাড়ির জানলা দিয়ে কতদিন দেখেছি মাঠের মধ্যে দিয়ে মোহর ছুটছে গুরুদেবের কাছে। রাস্তা দিয়ে যেত না, পাছে দেরি হয়ে যায়। মাঠের কাছে একটা বনপুলকের গাছ ছিল। বসন্তে ফুল ফুটলে গন্ধে চারদিক ভরে উঠত। তার তলা দিয়ে মোহর দৌড়োচ্ছে, তাড়াতাড়িতে ফ্রকের পিঠের সব বোতামও হয়তো লাগানো হয়নি।’’ এই ছবি শান্তিনিকেতন আশ্রমের বাইরে আর কোথাও সম্ভবই হত না। কণিকা নিজেই লিখেছিলেন, ‘‘পড়াশুনার সঙ্গেই নাচ-গান-খেলা-ছবি আঁকা শিখেছি। … প্রকৃতির সঙ্গে ছিল আমাদের আত্মিক যোগ। পাখির ডাক শুনে বুঝতাম কোন পাখি ডাকছে। কোন প্রজাপতি কোন গুটিপোকা থেকে হয়েছে … গাছপালার সঙ্গেও তাই ছিল আমাদের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর নানা ঋতুতে নানা ফুল আমাদের মনটাকে সবসময় রাঙিয়ে রাখত।’’ এই ভাবেই প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথের স্নেহ, ভালবাসায় কণিকা বড় হয়ে উঠেছিলেন।
তাঁর শৈশবের স্মৃতিচারণে কণিকা আরও জানিয়েছিলেন, “গুরুদেবের সান্নিধ্য পেয়েছি সেই থেকেই। যখনই ওঁর কাছে যেতাম তখনই উপহারস্বরূপ হাতে এসে যেত লজেন্স বা বাদাম। আমার নানা দেশের স্ট্যাম্প জমানোর নেশা ছিল। রোজই প্রায় তাঁর কাছে যেতাম স্ট্যাম্প নিতে।” তাঁকে গড়ে তোলার প্রসঙ্গে কণিকা লিখেছিলেন, “আমার গানের দিকে নজর পড়েছিল স্বয়ং গুরুদেবের। আমি গান শিখতে যেতাম দিনুদার (দিনেন্দ্রনাথ) কাছে। তাঁর সেই বিরাট চেহারা। আমরা তাঁর ঘাড়ে-পিঠে চেপেই গান শিখেছি … শান্তিদা চিনা ভবনের কাছে এক টিনের ঘরে আমাদের গানের ক্লাস নিতেন। আর ছিলেন শৈলজাদা। গুরুদেব সবসময়েই শৈলজাদাকে বলতেন আমার গানের দিকে নজর দিতে।” শৈলজারঞ্জন মজুমদার, রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের কাছ থেকেই গান গাওয়ার তালিম নিয়েছিলেন কণিকা। যদিও শৈলজারঞ্জন বিশ্বভারতীতে যুক্ত হয়েছিলেন রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। পরে তিনি সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায়। কণিকা তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার গুরু হিসেবে যাঁর নাম উল্লেখ করে গিয়েছেন, তিনি হলেন বিশ্বভারতীর শৈলজারঞ্জন। শান্তিনিকেতনের যে সাঙ্গীতিক পরিবেশ ছিল, সেখানে বিষ্ণুপুরের প্রভাব পড়েছিল। বিষ্ণুপুর থেকে অনেক প্রখ্যাত গাইয়ে ও বাজিয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ও মিশে গিয়েছিলেন সেখানকার জীবন যাপনের সঙ্গে। রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনাদিনাথ দত্তরা শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনকে ঋদ্ধ করে তুলেছিলেন। তাঁরা ছিলেন শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রগানের পরিবেশ বা ঘরানার অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব। সেই ঘরানাই কণিকাকে তাঁর পূর্ববর্তী অমিয়া ঠাকুর, রমা কর, অমিতা সেনদের রবীন্দ্রগানের ধারার স্বয়ংসম্পূর্ণ এক প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তুলেছিল। প্রসঙ্গত তাঁর মতোই ওই ধারার আরও যে ক’জন প্রতিনিধির নাম করতে হয়, তাঁরা সেবা মিত্র, সুচিত্রা মিত্র, নীলিমা সেন, অরুন্ধতী গুহঠাকুরতা, আরতি বসু প্রমুখ।
কৈশোর ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠতে উঠতে কণিকা ক্রমশঃ শান্তিনিকেতনের পাঠভবন, শিক্ষাভবন পাশ করে সঙ্গীতভবন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ভারতীয় মার্গসঙ্গীত নিয়ে ডিগ্রি পেয়েছিলেন ১৯৪৩ সালে। এরই মধ্যে কণিকা যেমন রবীন্দ্রনাথের কাছে অপরিহার্য এক গায়িকা হয়ে উঠেছিলেন, তেমনই রবীন্দ্রনাথও কণিকার জীবনে এক বড় নির্ভরতার জায়গা নিয়েছিলেন। তাঁর গুরুদেবের কাছে কণিকা যখন-তখন হাজির হতে পারতেন। আবার গান শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথের ডাক আসত দিনের যে কোনও সময়ে। শিক্ষকদের কাছে বকুনি খেয়ে ক্রুদ্ধ কণিকার নালিশ জানানোর মানুষটিও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমনও ঘটেছিল, কিশোরী মনের বিক্ষুব্ধতায় অশ্রুসজল নেত্রের কণিকাকে প্রবোধ দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সদ্য লেখা গান ‘কেন নয়ন আপনি ভেসে যায়’ তুলিয়ে দিয়েছেন কণিকাকে। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর ‘তাসের দেশ’-এর ‘দহলা’, ‘ডাকঘর’-এর ‘সুধা’, ‘বিসর্জন’-এর ‘অপর্ণা’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয়ের জন্য কণিকাকে দিয়ে রিহার্সাল করিয়েছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার রিহার্সালের শেষে কোনও দিন তিনি নিজেই গেয়ে উঠতেন ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ আর বলতেন “আমি চলে যাওয়ার পর তোমরা এই গান গেও।”
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ‘ভিক্ষাপাত্র কণ্ঠে নিয়ে’ সারা ভারত চষে বেড়াতেন। এই সূত্রেই কণিকা শান্তিনিকেতনের বাইরে কলকাতার ‘ছায়া’ প্রেক্ষাগৃহে রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে প্রথম বার সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন ১৯৩৭ সালে। তখন তাঁর তেরো বছর বয়স। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কলকাতায় এই অনুষ্ঠানটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “ছায়া সিনেমা হলে বর্ষামঙ্গলের দিন গুরুদেব বসেছিলেন স্টেজের ওপরেই, চেয়ারে, একপাশে। আমি তাঁর হাতলের পাশটিতে দাঁড়িয়ে গাইছি ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। ভালই গাইছিলাম! কী জানি, গুরুদেবের বোধহয় মনে হয়েছিল আমি নার্ভাস। একসময় দেখি, উনিও আমার সঙ্গে গাইতে শুরু করেছেন। সত্যি কথা যদি বলতে হয়, খুবই রাগ হয়েছিল আমার। কেন আমার সঙ্গে গাইলেন?” এই ঘটনাটা সম্ভবতঃ দু’জনের সম্পর্কের মধুরতার প্রকাশ করে। কণিকাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দল ভারতের নানা শহরেও গিয়েছিল। এই ভ্রমণকালে শুধু গান নয়, সাহেবি ঢঙে কাঁটা-চামচ দিয়ে খেতেও কণিকাকে শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খ্যাতি শান্তিনিকেতনের গণ্ডি ছাড়িয়ে শহর কলকাতার ঘরে ঘরে পৌঁছেছিল তাঁর প্রকাশিত প্রথম রেকর্ডের সূত্রে। ১৯৩৭ সালে তাঁর কাকা গোকুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতা বেড়াতে এসেছিলেন কণিকা। সেই বেড়ানোর শেষে কাকা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন ৬/১ অক্রুর দত্ত লেনে হিন্দুস্থান কোম্পানির অফিসে কী করে গান রেকর্ড হয়, তা দেখাতে। এই দেখার সূত্রেই কোম্পানির মালিক চণ্ডীচরণ সাহা ও ট্রেনার যামিনী মতিলাল কণিকার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা তখনই ঠিক করেছিলেন কণিকাকে দিয়ে নতুন গান রেকর্ড করবেন। কিন্তু গান নির্বাচন করতে গিয়ে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানের উপরে ভরসা করতে পারেননি ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায়। সে কালের বিখ্যাত গীতিকার নীহারবিন্দু সেন ও সুরকার হরিপদ চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে এনে দু’টি আধুনিক গান তৈরি করে রেকর্ড করিয়েছিলেন কণিকার গলায়। গান দু’টি ছিল, ‘গান নিয়ে মোর খেলা’ ও ‘ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার’। ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রেকর্ডটি বাজারে এসেছিল ও বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিল। এই রেকর্ডিংয়ের সময়ে ‘ফুলপরী’ নামে একটি শিশুগীতিনাট্যের জন্যেও কণিকা গান গেয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘটনায় দুঃখ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি কণিকাকে ডেকে বলেই দিয়েছিলেন, “তুমি যদি এই সব গান গাও তবে আর আমার গান গেয়ো না।” রবীন্দ্রনাথের এই অভিমান দীর্ঘস্থায়ী না হলেও বোঝা যায় কেন তিনি ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। ফলে দেরি না করে ওই ১৯৩৮ সালেই তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে কণিকাকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সেই অক্রুর দত্ত লেনের হিন্দুস্থান রেকর্ডের অফিস ঘরে। রেকর্ড করা হয়েছিল ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’ এবং ‘না না না ডাকব না’ গান দু’টি। এই রেকর্ডটিই ছিল কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম রবীন্দ্রগানের রেকর্ড। এর পরে ১৯৪০ সালের ২৮শে জুলাই দিনটা ছিল বোলপুরে টেলিফোন চালু হওয়ার ঐতিহাসিক দিন। সে দিন সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করেছিলেন আর কণিকাকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী’ গানটি – যা রবীন্দ্রনাথই কণিকাকে শিখিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটি রেডিয়োয় প্রচারিত হয়েছিল।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। ওই বছর উদয়নের বারান্দায় ‘বশীকরণ’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেই নাটকের রিহার্সালে রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত ছিলেন। এই নাটকে কণিকা অভিনয় ও গান করেছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই রবীন্দ্রনাথ উদয়নের বারান্দায় এসে বসেছিলেন। নাটক দেখে মাঝেমাঝে হেসে উপভোগ করছিলেন। কণিকা ভেবেছিলেন, ‘‘বোধহয় তাঁর অসুস্থতা এবার সেরে যাবে।’’ কিন্তু তা আর হয়নি। তবে অসুস্থ শরীরেই কণিকাকে রবীন্দ্রনাথ যে গানটি শিখিয়েছিলেন, তা হল – ‘ওই মহামানব আসে’। উদয়নের বারান্দায় ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধ পাঠের দিনেই গীত হয়েছিল গানটি। আর তার পরের কথার জন্য কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীর পাতার আশ্রয় নেওয়াই বাঞ্চনীয়। কণিকা লিখেছিলেন – ‘‘শেষ পর্যন্ত এল দুঃসহ বাইশে শ্রাবণ। বাইরে সেদিন ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি। এক ঝড় বৃষ্টির দিনেই আমার তাঁর কাছে যাওয়া। আজকের ঝড়বাদল তাঁর না-থাকার খবর নিয়ে এল। এমন একটা খবরের জন্য রোজ শঙ্কিত হয়ে থাকতাম আমরা … আশ্রমের সবাই তখন সে খবর জেনে গেছে। সবাই বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। বৃষ্টির মধ্যে নীরবে নিঃশব্দে পুরনো লাইব্রেরির সামনে পৌঁছে গেলাম সবাই। সেই যে ডাকঘরের রিহার্সাল দিতে-দিতে কতবার গাইতেন আর বলতেন, ‘আমার মৃত্যুর পর তোমরা গেয়ো – সমুখে শান্তি পারাবার’। … আজ এই দুঃসহ দিনে সেই গানই আমরা গাইলাম। যেন তিনিই গাইয়ে নিলেন।’’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে কণিকা ক্রমশঃ খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন। ছড়িয়ে পড়েছিলেন সারা বিশ্বে। পরে তিনি রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও আরও অনেক ধরনের গান গেয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন নতুন গায়ক-গায়িকা। দেশবিদেশে আজ তাঁর ভক্তের সংখ্যা অগণিত। কিন্তু কণিকা আজীবন মনে করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গান তিনি গাইতেন না, নিবেদন করতেন। যেন রবীন্দ্রনাথই তাঁকে দিয়ে গানগুলি গাইয়ে নিতেন, এমনই মনে হত তাঁর। ১৯৪৩ সালে কণিকা আকাশবাণীতে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আকাশবাণীর ‘রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার আসর’ পরিচালনা করেছিলেন একাধিক বার। ১৯৪৩ সালেই তিনি অধ্যাপিকা হিসেবে সঙ্গীতভবনে যোগদান করেছিলেন। পরে অধ্যক্ষ পদেও যোগ দিয়েছিলেন। নিয়মমাফিক অবসর গ্রহণের পরেও সাম্মানিক অধ্যাপিকা হিসেবে গান শিখিয়েছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ১৯৪৫ সালে তিনি বিয়ে করেছিলেন বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আজীবন বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কণিকাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন তাঁর নীরব ভক্তের মতো। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে মোট পাঁচ বার কণিকা বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। শেখ মুজিবর রহমান স্বয়ং তাঁর গানের ভক্ত ছিলেন। কণিকার গানের টানে বাংলার বহু দিকপাল খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গায়ক তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা কণিকাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন। ১৯৭০ সালে হীরেন নাগ পরিচালিত ‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ ছবিতে ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটি গেয়ে তিনি বিএফজেএ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ‘সংগীত নাটক আকাডেমি’ পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে। ১৯৮০ সালে ই এম আই গ্রুপ তাঁকে ‘গোল্ডেন ডিস্ক’ পুরস্কার দিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে পেয়েছিলেন ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ সন্মান, ১৯৯৬ সালে ‘শিরোমণি’ ও ১৯৯৭তে বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ পুরস্কার প্রদান করেছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘আকবরী মোহর’ ২০০০ সালের ৫ই এপ্রিল ভোরবেলায় সকলকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তাঁর অনন্ত সুরের জগতে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত