তাঁর নিজের চেহারাটি ছিল বিশাল লম্বা। এতটাই যে, মাপসই জুতো মিলত না দোকানে। সুকুমার সেন লিখেছেন, ‘‘আকারে শালপ্রাংশু মহাভুজ, সদ্বংশজাত, সৌম্য, বিনয়ী, সদালাপী, শিক্ষিত, বিচক্ষণ, সহৃদয় বাঙালির বোধ করি শেষ নিখুঁত নিদর্শন ছিলেন তিনি।’’ গার্হস্থ্যে টইটম্বুর মানুষটি মুহূর্মুহূ চা খেতেন। আর লেখার সময়ে অভ্যেস ছিল, মাঝে মাঝে উঠে বয়াম খুলে হাল্কা কিছু মুখে পোরা। তবে মুম্বই যাওয়া ইস্তক শরীর ভাঙতে শুরু করেছিল। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় পুণায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে নিজের বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘মিথিলা’। ২৬/৬/৫৩-র চিঠিতে ‘পরিমল গোস্বামী’কে লিখেছিলেন, ‘‘সাত মাস হল পুনায় এসে স্বাস্থ্য অন্বেষণ করছি … আমার মাথায় রক্তের চাপ, পেটে বায়ুশূল, পায়ে বাত। আর বেশিদিন নয়।’’ না, এর পরেও প্রায় বারোটা বছর খুব খারাপ ছিলেন না তিনি। হৃদরোগের ফাঁড়াটা গিয়েছিল ৬৬ বছর বয়সে। সিগারেট ছাড়তে হয়েছিল। তবে সামলে নিয়েছিলেন। কিন্তু ‘‘মহাকাল হচ্ছেন বাড়িওয়ালা। তিনি নোটিশ দিলে বাড়ি ছাড়তেই হবে।’’ সেই নোটিস এসে পৌঁছেছিল ১৯৭০ সনের ২২শে সেপ্টেম্বর। ‘পরিমল গোস্বামী’ পরে লিখেছিলেন, ‘‘জুলাই কি অগস্ট মাসে রেডিওতে তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেছি। সে স্বরে জীবন শেষ হয়ে আসার ধ্বনি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।’’ লেখা অবশ্য থামেনি। ব্যোমকেশের নতুন গল্প নিয়ে প্রতুলচন্দ্রকে শাসিয়ে রেখেছিলেন, ‘‘সত্যবতীর গাড়ি হবে। কিন্তু একটা খুনের মামলায় পুলিশ আপনাকে কিরকম নাস্তানাবুদ করে দেখবেন।’’ ‘বিশুপালবধ’-এ সত্যিই প্রতুলবাবু নামে একটি চরিত্র ছিল। সেই কাহিনী সমাপ্ত হওয়ার আগেই যবনিকা পড়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনে।
জানেন কি কোথায় বসে ব্যোমকেশ লিখেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়? ‘৬৬ নম্বর মহাত্মা গান্ধী রোড, প্রসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস’। আগে যে রাস্তার নাম ছিল হ্যারিসন স্ট্রিট। প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ের বর্তমান কর্ণধার শ্রী সন্দীপ দত্ত সাম্প্রতিক অতীতে একটি নামকরা দৈনিকের সাংবাদিককে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন – ‘‘জানেন, শরদিন্দুকে আমার বাবা কাকারা কেউ কখনও চিনতেই পারেননি। আসলে ডিটেকটিভের স্রষ্টারা কি অত সহজে ধরা দেন মশাই? … হাতে এক কাপ চা আর যদি সিগারেটের বদ অভ্যাস থাকে, তাহলে একটা সিগারেট জ্বালান, তারপর এই প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং-এর বারান্দায় একটা চক্কর কাটুন। আর কে জানে, শরদিন্দুও হয়তো কোনও এক সময় এই বারান্দাতেই পায়চারি করতে করতে ব্যোমকেশের কোনও এক গল্পের কথা ভেবেছিলেন!’’
সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার বয়সের তফাত ছিল ন’বছরের। ১৯৬৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় যখন ‘বেণীসংহার’ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল, সেখানে তখন ব্যোমকেশের বয়স ছিল ৬০ বছর। আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ছিলেন ৬৯ বছরে। ঠিক এর এক বছর আগেই সত্যজিৎ রায় বানিয়েছিলেন ‘চিড়িয়াখানা’ চলচ্চিত্রটি, যাতে আবার ব্যোমকেশের ভূমিকায় ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার স্বয়ং। শরদিন্দু অবশ্য সেই চলচ্চিত্র নিয়ে খুব একটা খুশি হননি! ব্যোমকেশ তাঁর নিজস্ব আত্মকৃতি হলেও চশমা তাঁর একদমই পছন্দের ছিলনা। তিনি বরং ভাবিত ছিলেন ব্যোমকেশের রিটায়ারমেন্ট নিয়ে। বলেছিলেন – ‘‘ব্যোমকেশের প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে তো! সে আর কত পারবে!’’ এই হলেন শরদিন্দু। যিনি কুড়ি বছর বয়সেই ভাবতেন, ‘‘এই যে এতগুলো দিন গেল, আমি কি করলুম!’’ সাহিত্যই যে তাঁর একমাত্র ইষ্টদেবতা, সেটা আসলে তখনও তিনি স্থির করতে পারেননি। তখন তাঁর ছিল খেলাধুলোর প্রবল নেশা। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেনিস, বাস্কেটবল, ভলিবল … কী না খেলতেন তিনি! কলেজজীবনে চুটিয়ে সিনেমা দেখেছিলেন। শখের থিয়েটার করেছিলেন। আইন পড়বেন না সাহিত্য করবেন, ওকালতি করে সাহিত্য না শুধুই সাহিত্য – এই দ্বন্দ্ব ঘুচতেই তাঁর অনেকটা সময় লেগেছিল।
তিন জনকে গুরু মানতেন শরদিন্দু – বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র। তবে তাঁর আদর্শ ছিলেন বঙ্কিম, যিনি বলে গিয়েছিলেন, ‘‘যে জাতির ইতিহাস নাই, তাহার ভবিষ্যৎও নাই।’’ শরদিন্দুর সাহিত্য বহুলাংশে এই ভাবনায় সিঞ্চিত ছিল। তাঁর ঐকান্তিক প্রয়াস তাঁর নিজেরই কথায়, ‘‘… আমি বাঙালীকে তাহার প্রাচীনের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছি … বাঙালী যতদিন না নিজের বংশগরিমার কথা জানিতে পারিবে, ততদিন তাহার চরিত্র গঠিত হইবে না …।’’ নিজে নানা রকম বই প্রচুর পড়তেন শরদিন্দু। সাহিত্য, ইতিহাস, পুরাণ নিয়ে কী গবেষণা হচ্ছে, খেয়াল রাখতেন। ভাষাচর্চার জন্য মাস-মাইনে দিয়ে সংস্কৃত পণ্ডিত রেখেছিলেন। যে যুগের গল্প, সেই যুগের উপযোগী ভাষা, শব্দ, জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি বর্ণনা আহরণ করে আনতেন। বিশেষ করে তৎসম শব্দব্যবহারে তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। যোগেশচন্দ্র রায়বিদ্যানিধি তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘এত সংস্কৃত শব্দ পুঞ্জীভূত হইয়াছে, এত সমাসবদ্ধ নূতন নূতন শব্দ রচিত হইয়াছে যে আমি ভাষায় আপনার অধিকার দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি।’’ তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জাতিস্মর’-এর তিনটি গল্পই ইতিহাসগন্ধী। ‘চুয়াচন্দন’, ‘প্রাগজ্যোতিষ’, ‘মরু ও সঙ্ঘ’র মতো বিখ্যাত সব গল্পও তিরিশের দশকেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। ১৯৩৮ সালে একটা উপন্যাসও আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু সেটার মাঝপথে তাঁকে মুম্বাই চলে যেতে হয়েছিল। এক যুগ পরে সে লেখা শেষ হয়েছিল। ‘কালের মন্দিরা’র ভূমিকায় বলা ছিল, ‘‘গল্পের যে স্থানটিতে বারো বছরের ফাঁক পড়িয়াছে পাঠকপাঠিকা হয়তো তাহা সহজেই ধরিয়া ফেলিতে পারিবেন। যদি না পারেন, বুঝিব আমার অন্তর্লোকে মহাকালের মন্দিরা এখনও একই ছন্দে বাজিতেছে …।’’
ছাত্রবয়স থেকেই প্ল্যানচেট করতেন শরদিন্দু। তবে শেষ দিনটি পর্যন্ত তাঁর চৌম্বকীয় নেশা ছিল কোষ্ঠীবিচার। এক দিকে মুম্বাইতে হৃষীকেশ-নবেন্দুদের ভরসা দিতেন তিনি। অন্য দিকে ডাকযোগে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন আসত তাঁর কাছে, ‘‘অশুভটা কোন পথ ধরে আসবে? একটু আলোকপাত করলে সুখী হব।’’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু তাঁর গণনায় চমৎকৃত হয়েছিলেন। প্রমথনাথ বিশী তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আপনার বিরহে আমরা অর্থাৎ প্রতুলবাবু, জিতেনবাবু, বিমল মিত্র, গজেনবাবু ও আমি সকলেই কাতর। আপনি আসিয়া গ্রহনক্ষত্রকে একটু সচল করিয়া দিবেন, এই ভরসায় আছি।’’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাবার পরে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘‘জন্মসময়ের অভাবে লগ্ন স্থির করিতে পারিতেছি না … চেহারা ইত্যাদি হইতে মনে হয় সিংহ লগ্ন। সিংহ লগ্নের বুধ মারক। বুধ দশার আরম্ভেই মৃত্যু হইয়াছে।’’
১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসের ডায়েরিতে একটা আশ্চর্য কথা লিখেছিলেন তিনি – ‘‘যাঁহারা বর্তমান কালের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আশ্রয় করিয়া গল্প-উপন্যাসাদি লেখেন, অকস্মাৎ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ফলে তাঁহাদের বড় অসুবিধা হইয়াছে। পটভূমি এমন বদলাইয়া গিয়াছে যে নূতন আসরে পুরাতনের পালা আর জমিতেছে না … এখন অনতিপূর্বকালও ইতিহাসের পর্যায়ে গিয়া পড়িয়াছে, তাই বর্তমান ও সদ্য অতীতকে যে লেখক ঐতিহাসিকের চক্ষু দিয়া দেখিতে পারিবেন, তাঁহার রচনাই সার্থক হইবার সম্ভাবনা।’’ এই ‘ঐতিহাসিকের চক্ষু’টিই তাঁর মতে সবচেয়ে দামি জিনিস। তাঁর নিজের বিচরণক্ষেত্র অবশ্য শুধু বর্তমান নয়। প্রাচীন অতীতও, নির্দিষ্ট করে বললে প্রাক-ইসলামি অতীত। ইসলামি পর্বের ইতিহাসের প্রতি তাঁর দৃষ্টি সদয় ছিল না। সমসাময়িক সাহিত্যধারা সম্পর্কেও নয়। নাম না করে কল্লোল গোষ্ঠী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘এখনকার সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিকেরা মানবচিত্তের পঙ্কোদ্ধারে ব্যস্ত … আমরা অমৃতের পুত্র নয়, আমরা বানরের বংশধর এই কথাটাই এখন বড় কথা।’’
১৮৯৯ সালের ৩০শে মার্চ জৌনপুরে শরদিন্দুর জন্ম হয়েছিল, বড়ো হয়েছিলেন মুঙ্গেরে আর পাটনায়। বংশে ওকালতি করার চল ছিলো। নিজের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন চোদ্দো বছর বয়সে, নিজের লেখা প্রথম সম্পূর্ণ গল্পের কালে তাঁর বয়স ছিল ষোলো, কুড়ি বছর বয়সে প্রথম ছাপা হয়েছিল তাঁর একটি কবিতার বই। ঊনিশ বছরের শরদিন্দু পাত্র বিয়ে করেছিলেন এগারো বছর বয়সের পাত্রীকে। তারপর আইন পড়া, ছাড়া, বাবার আগ্রহাতিশয্যে ওকালতি করা, তিন বছর পরে সেটা ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যজীবী হয়ে যাওয়া। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত গল্প লিখেছিলেন, তারপর খুব একটা ঘোরাঘুরি না করেই তখনকার নামকরা এক মাসিক পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীতে ঢুকে গিয়েছিলেন তাঁর লেখার গুণের জোরে। তাঁর প্রথম গল্পের বই ‘জাতিস্মর’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩২ সালে। ১৯৩৮ সালে তিনি মুম্বই চলে গিয়েছিলেন ‘বোম্বে টকীজে’ চিত্রনাট্য লেখার চাকরী নিয়ে, সেখানে ছিলেন ১৯৪১ পর্যন্ত। তারপরে সেই চাকরি ছেড়ে হয়েছিলেন স্বাধীন চিত্রনাট্যকার, সেখানে সফল হওয়া সত্ত্বেও সিনেমার জগত ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় ফিরে এসেছিলেন ১৯৫২ সালে। সেই সঙ্গে আবাস পরিবর্তন করে, মুম্বই থেকে চলে এসেছিলেন পুণেতে। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন, মৃত্যু হয়েছিল ১৯৭০ সালে।
১৯৩২ সালে প্রথম প্রকাশ থেকে ১৯৭০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শরদিন্দুর চল্লিশাধিক বছরের সাহিত্যচর্চার ধারা তারাশঙ্করের মতো বাঁধভাঙা জলস্রোত না হলেও ক্ষীণতোয়া বলা যায় না। তেষট্টিটি মৌলিক বইয়ের হিসেব পাওয়া যায়, এ ছাড়া সঙ্কলন ও রূপান্তর – যথা গল্পের ভিত্তিতে উপন্যাস, চিত্রনাট্যের উপন্যাসরূপ ইত্যাদি আছে বেশ কয়েকটি। সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ, তার মধ্যে আছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কিশোর সাহিত্য, অনুবাদ। রেকর্ডের জন্য পালাও লিখেছিলেন। অনুবাদ করেছিলেন একটিই, তবে সেটা ঠিক ভাষান্তর বলা যায় না, ছায়া অবলম্বনে বলা ঠিক হবে, সেটি এতোই উৎকৃষ্ট যে সেটিকে মৌলিক সাহিত্যের তকমা দিলে গর্হিত অপরাধ হবে না। প্রবন্ধও লিখেছিলেন, তবে তা ‘চন্দ্রহাস’ ছদ্মনামে, তার সংগ্রহ বর্তমানে পাওয়া মুশকিল। এই ছদ্মনামে কিছু কবিতাও লিখেছিলেন। সংখ্যা গুণলে তাঁর লেখা ছোটো গল্পই সবচেয়ে বেশী, সংখ্যায় দুশো বাইশ, ছত্রিশটি বইতে সংগৃহীত; উপন্যাস তেরোটি, নাটক ও চিত্রনাট্য তেরোটি, কিশোরপাঠ্য কাহিনী আটাশটি। জনপ্রিয়তা তো ছিলই, তাছাড়াও ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিশোর সাহিত্যের জন্য পেয়েছিলেন ভারত সরকারের দেওয়া পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’, এছাড়া আরও কিছু পত্রপত্রিকার পুরস্কারও তাঁর ভাগ্যে জুটেছিলো।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা ‘তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ ছিলেন মুঙ্গেরে ডাকসাইটে উকিল। বরাবরই চেয়েছিলেন, ছেলে আইনজীবী হোন! বাড়িতে আলমারি ঠাসা বই, নামকরা সাহিত্যপত্রিকা সব আসত। ফলে কম বয়স থেকেই সাহিত্যের সঙ্গেও পরিচয় ছিল শরদিন্দুর। প্রথম দিকে ইংরেজি বই-ই বেশি পড়তেন। চলতি বাংলা নভেল কম বয়সে পড়ানোর পক্ষপাতী ছিলেন না অভিভাবকেরা। লুকিয়েচুরিয়ে যেটুকু পড়েছিলেন, ভাল লাগেনি। তাঁর প্রথম মুগ্ধতা এসেছিল ‘রমেশচন্দ্র দত্ত’ পড়ে, তার পর পনেরো বছর বয়সে বঙ্কিম তাঁর একেবারে মন জুড়ে বসেছিলেন। এক বছর আগেই তাঁর স্কুলে বাংলার শিক্ষক বলেছিলেন, ‘‘কবিতা লেখার চেষ্টা কর তো দেখি। যাঁর লেখা ভাল হবে, প্রাইজ পাবে!’’ সেই থেকে লেখার অভ্যেসও পেয়ে বসেছিল। ম্যাট্রিক দেওয়ার পরে ছুটিতে মামার বাড়ি গিয়েছিলেন এলাহাবাদে। সেখানেই ঝোঁক গিয়েছিল গল্প লেখার দিকে। নিত্যনতুন প্লটও আসতে শুরু করেছিল, কিন্তু কোনওটাই শেষ করা হয় নি। তবু কেমন করে যেন একটা উপন্যাস লেখা হয়ে গিয়েছিল।
১৯১৫ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন শরদিন্দু। কলকাতাবাসের প্রথম পাঁচ বছর ছিলেন ওয়াইএমসিএ-র হস্টেল, তার পরে বাসিন্দা হয়েছিলেন মেস বাড়ির। অর্থাৎ সিমলা স্ট্রিট, বাদুড়বাগান ঘুরে হ্যারিসন রোড। হস্টেল থেকেই ‘অজিত সেনের’ সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। কলেজজীবনে শরদিন্দুর সাহিত্যচর্চার প্রধান দোসর ছিলেন এই ‘অজিত’। শরদিন্দুর ১৯১৮-১৯২০র ডায়েরি পড়লে বোঝা যায়, কী ভাবে সদ্য যুবকের মনটি নানা দিকে ডানা মেলেছিল। এক দিকে সাহিত্যচর্চা, অন্য দিকে বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড়। পাত্রী বাবারই ঠিক করা, মুঙ্গেরে তাঁর সহকর্মী আইনজীবীর কন্যা ‘পারুল’।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শরদিন্দু সামরিক প্রশিক্ষণ শিবিরে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই অভিজ্ঞতাটা ভাল হয়নি। ‘‘এ জীবনের হীনতা এতই অতলস্পর্শ, এর শাসনবিধান এতই প্রভুতান্ত্রিক যে personal qualities এখানে একেবারেই নিষ্পেষিত হয়ে যায়।’’ ক্যাম্প থেকে ফেরার কিছু দিন পরে আষাঢ় মাসে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। নবপরিণয়ের রোম্যান্সটুকু বুকে নিয়ে ক’দিন পরে অজিত আর অতুল মিত্রের উৎসাহেই কবিতার বই ছাপিয়েছিলেন, নাম ছিল ‘যৌবনস্মৃতি’ (১৯১৯)। জীবন সুখেই কাটছিল। শুধু কেবলই মনে হচ্ছিল, রুজিরোজগারে সাফল্যের জন্য যে পাটোয়ারি বুদ্ধি থাকা দরকার, সে তাঁর নেই। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা উঠলেই শরদিন্দু কিছুটা গুটিয়ে যেতেন। পিতার আগ্রহেই আইন পড়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু বেশি দিন টানতে পারেননি। বছর দুয়েকের মধ্যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। শরদিন্দু বিলিতি সিগারেট ছেড়েছিলেন, আন্দোলনে সামান্য জড়িয়েও পড়েছিলেন। তার পরেই পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে মুঙ্গেরে ফিরে গিয়েছিলেন। ‘বরদা’-র গল্পে যে বাণীমন্দির ক্লাবের কথা আছে, ওই ক্লাবের জন্যই শুরু করেছিলেন ‘বঙ্কিম’ আর ‘রমেশচন্দ্র দত্ত’র উপন্যাসকে নাট্যরূপ দেওয়ার কাজ। কিন্তু বাবা যে ছেলের রকমসকম দেখে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন, সেটা চাপা থাকেনি। শেষ অবধি শরদিন্দুকে ফের আইন পড়তে ফিরে যেতে হয়েছিল। পটনা থেকে পাশ করে বাবার জুনিয়র হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
ওকালতি জীবনেই ‘বসুমতী’তে ছাপা হয়েছিল তাঁর প্রথম গল্প ‘উড়ো মেঘ’। শরদিন্দুর কাছে এই বার যেন স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল তাঁর কক্ষপথ। একে একে ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ও তাঁর লেখা নিতে শুরু করেছিল। ১৯২৯ সালে শরদিন্দু ওকালতি থেকে একেবারে হাত তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর বাবাও তত দিনে বুঝেছিলেন, এ পথ শরদিন্দুর নয়। তা হলে? শরদিন্দু ঠিক করে নিয়েছিলেন, সাহিত্যই হবে তাঁর সাধনা। তাতে হয়তো জাঁকালো রোজগার হবে না। কিন্তু বাবার যে রকম পসার, তাতে তাঁর খুব দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে।
তাঁর দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৪ বছরের ব্যবধানে। গল্পগ্রন্থ ‘জাতিস্মর’ (১৯৩৩)। সাহিত্যিক হিসেবে শরদিন্দু তত দিনে তাঁর জাত চেনাতে শুরু করেছিলেন। লেখার পদ্ধতি সম্বন্ধে নিজের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলি তৈরি করেছিলেন, যার মূল কথাই হল পরিমিতি। ‘‘স্টাইল দেখাইবার চেষ্টা করিবে না। মনের ভাবটিকে শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি দিবার চেষ্টা করিবে, তাহা হইলেই স্টাইল আসিয়া পড়িবে। অকারণে একটি শব্দও ব্যবহার করিবে না … digression অতিশয় বিপজ্জনক। মাঝে মাঝে প্রয়োজন হইলেও যত দূর সম্ভব সংক্ষেপে সারিবে। প্রকৃতির বর্ণনা কোথাও দশ পংক্তির বেশী করিবে না …।’’ শরদিন্দু সেই সময়ে কিছু দিন মুঙ্গেরে, কিছু দিন কলকাতায় মেসে থাকতেন। সম্পাদকদের সঙ্গে দেখা করে নতুন লেখা পড়িয়ে নিতেন। সাহিত্যিক বন্ধু-পরিচিতের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল।
১৯৩২ সালে আবির্ভূত হয়েছিল ব্যোমকেশ। আষাঢ়, অঘ্রান আর মাঘের ‘বসুমতী’তে বেরিয়েছিল পরপর তিনটি গল্প। ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমন্তহীরা’ আর ‘সত্যান্বেষী’। পরের বছর এর সঙ্গে ‘মাকড়সার রস’ গল্পটি যুক্ত হয়ে প্রকাশ পেয়েছিল ব্যোমকেশের প্রথম বই, ‘ব্যোমকেশের ডায়েরি’। অজিত, অতুল, হ্যারিসন রোডের মেস বাংলা সাহিত্যে চিরজীবী হয়ে গিয়েছিল। শরদিন্দু নিজে তখন কলকাতায় মেসখরচ আর অন্যান্য মিলিয়ে মাসে তিরিশ টাকা নিজের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন। ব্যোমকেশের গল্পে অজিতের মাসখরচ দেখানো হয়েছিল পঁচিশ টাকা।
শরদিন্দুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, নিম্ন মানের লেখার জন্যই এ দেশে গোয়েন্দা সাহিত্য তার প্রাপ্য মর্যাদা পায় না। আর্থার কোনান ডয়েল, এডগার অ্যালান পো, আগাথা ক্রিস্টির পাশে দেশীয় ডিটেকটিভ সাহিত্যকে তাঁর কোনও দিনই উঁচু মানের বলে মনে হয়নি। কিশোর বয়সেও ‘পাঁচকড়ি দে’-র ‘নীলবসনা সুন্দরী’ পড়ে ভাল লাগেনি। সে দিক থেকে এই ধারাটিকে সুসাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত করার একটা চ্যালেঞ্জই তিনি নিয়েছিলেন বলা যেতে পারে। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘ডিটেকটিভ গল্প যদি অপাংক্তেয় হয়, তবে historical romanceও অপাংক্তেয়। একটা অতীতের romance, অন্যটা বর্তমানের romance।’’
যত লেখা লিখেছিলেন শরদিন্দু, মোটের উপরে তার চারটি গোত্র – ‘সামাজিক-রোম্যান্টিক’, ‘ইতিহাস-আশ্রয়ী’, ‘সরস রচনা’ এবং ‘ডিটেকটিভ গল্প’। বন্ধু ‘পরিমল গোস্বামী’ বিশেষ ভক্ত ছিলেন শরদিন্দু ওরফে ‘চন্দ্রহাস’-এর সরস কবিতার। যেমন, ‘শিল্পীর শিরে পিলপিল করে আইডিয়া/ লেখেন যখন পুস্তক তিনি তাই দিয়া/উইপোকা কয় চল এইবার খাই গিয়া’! অথবা নজরুলের গানের প্যারডি, ‘তোমার এ মহাবিশ্বে ছাতা হারায় খালি প্রভু’! পরিমলের আগ্রহেই শরদিন্দুর লেখা ‘শিব-উমা’ আর ‘ডিটেকটিভ’, দুটো নাটকের রেকর্ড বেরিয়েছিল। ‘বন্ধু’ নামে আর একটি নাটক রঙমহলে অভিনয় হত।
শরদিন্দু নিজেও অভিনয় করেছিলেন দু’-এক বার। যেমন ১৯৩৬-এর রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রেডিয়োয় লেখকদের নিয়ে ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় হয়। শরদিন্দু কেদারের চরিত্র করেছিলেন। পরিমলের লেখা কৌতুকনাটিকার একটা রেকর্ডে সরযূবালা, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গেও অভিনয় করেছিলেন।
এ দিকে তাঁর বাবার পসার এ বার কমছিল। একটা চালকল ছিল, সেটা লোকসানে পড়েছিল। ১৯৩৪-এর ভূমিকম্পে মুঙ্গেরের বাড়িটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ছাদে দাঁড়িয়ে শরদিন্দু দেখেছিলেন, আলসেগুলো ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। নীচে নামার সিঁড়ি বন্ধ। ওই অবস্থায় স্ত্রীকে উদ্ধার করে মাটিতে নামিয়েছিলেন। যে নিশ্চিন্তির মধ্যে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়ে এসেছিল, এই বার তাতে ছেদ পড়েছিল। শরদিন্দু লিখেছিলেন, ১৯৩৮-এ তাঁর মাসিক আয় ছিল দেড়শো টাকার মতো। এটা সমসাময়িক বহু লেখকের থেকেই বেশি ছিল। কিন্তু বড় পরিবারের দায়দায়িত্ব, নিজের তিন পুত্রের প্রতিপালন – তাঁর টাকার প্রয়োজন ছিল। ঠিক সময়ে ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হয়েছিলেন তাঁর উপরে।
হিমাংশু রাই-দেবিকা রাণীর ‘বম্বে টকিজ’-এ তাঁকে চিত্রনাট্য লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ‘হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান ফিলজফি’র লেখক, দার্শনিক শ্রী সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। হিমাংশু রাই ছিলেন তাঁর শ্যালক। তখন মুম্বইতে তিনি ভাল গল্প লেখার লোক পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, কলকাতায় নিশ্চয় সে রকম কেউ আছেন। সুরেন্দ্রনাথ ও তাঁর বন্ধুরা হিমাংশুবাবুর সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেন প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন শ্রী সুচিত্রা মিত্রের পিতা শ্রী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়কে। কিন্তু সৌরীন্দ্রবাবু তখন জনপ্রিয় লেখক, উপরন্তু কলকাতা শহরেই আইনজীবী হিসেবে যথেষ্ট পসার। তিনি মুম্বই যাবেন কোন দুঃখে? তত দিনে মুঙ্গেরে ডাকসাইটে আইনজীবী পিতার পুত্র শরদিন্দু আইন-ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ওদিকে তাঁর ঘরে তখন স্ত্রী ও তিন পুত্র। কিন্তু তিনি ঠিকই করে নিয়েছিলেন যে শুধুই গল্প লিখবেন, ওকালতি তাঁর ধাতে পোষাবে না। সেই ইচ্ছেতে বাদ সেধেছিল আর্থিক অনটন। ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে তাই সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের চিঠি পকেটে নিয়ে সপরিবার মুম্বই রওনা দিয়েছিলেন শরদিন্দু। বিশ্ববিদ্যালয়, দর্শনশাস্ত্র, জনপ্রিয় লেখক এবং হিন্দি ছবির এই রাজযোটক আর হয়নি।
মুম্বই এসে শরদিন্দু প্রথমে উঠেছিলেন আন্ধেরি অঞ্চলে। সেখানে বাংলা ভাষা কেউ বোঝে না, তাই তিনি সিনেমার গল্প লিখতেন ইংরেজিতে। বম্বে টকিজ-এর ‘কঙ্গন’, ‘পুনর্মিলন’, ‘ঝুলা’ ইত্যাদি সিনেমার চিত্রনাট্যে তাঁর হাত ছিল। তিন বছর পরে বম্বে টকিজ-এর সঙ্গে তাঁর চুক্তি শেষ হয়, ১৯৪১ সালে তিনি যোগ দেন ‘আচারিয়া আর্ট প্রোডাকশন’ নামে এক সংস্থায়। সেই সংস্থার ‘উলঝন’, ‘আগে কদম’ ইত্যাদি ছবির ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। দু’বছর পরে ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই প্রোডাকশন হাউসও। তাঁর ‘বিষের ধোঁয়া’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘ভাবী’ তখন হিট ছবি। কিন্তু তাল কেটে গিয়েছিল ‘নিশাচর’ গল্প অবলম্বনে হিন্দি ছবি তৈরির পরে, যা ছিল সিরিয়াস গল্প, কিন্তু প্রযোজকের হস্তক্ষেপে হয়ে গিয়েছিল একটি কমেডি ছবি। তাঁর গল্প নিয়ে তৈরি ‘বিজয়লক্ষ্মী’ সিনেমাতেও প্রযোজকের সৃজনশীল হস্তক্ষেপ হয় এবং ফল হয় ভরাডুবি। তখন হতাশ শরদিন্দু যেন প্রযোজককে স্মরণ করেই নিজের ডায়রিতে লিখেছিলেন, ‘‘যাঁর রসবোধ যত কম, তাঁর মেরামত করিবার বাতিক তত বেশি।’’
কিন্তু দুটো সিদ্ধান্ত তত ক্ষণে নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। এক, মুম্বই ছাড়বেন না। দুই, ফ্রিলান্স করবেন, কিন্তু গল্প বদলাতে দেবেন না। ‘এস ব্যানার্জি’ তখন এক বার করে চিত্রনাট্য বানাচ্ছিলেন, কয়েক মাস পর আবার সেটিকে গল্পের আকারে লিখছিলেন। তাঁর ‘মনচোরা’ গল্প নিয়ে সন্দীপ রায় সম্প্রতি যে সিনেমা তৈরি করেছিলেন, সেই গল্প লেখার আগে তাকে ‘কানামাছি’ নাম দিয়ে চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শরদিন্দু। প্রথমে চিত্রনাট্য লিখলেন ‘যুগে যুগে’, পরে সেই কাহিনী নিয়েই লিখেছিলেন উপন্যাস ‘রাজদ্রোহী’ – উত্তমকুমার আর অঞ্জনা ভৌমিকের হিট ছবি। মুম্বইপ্রবাসী প্রৌঢ় শরদিন্দুই সেই লেখক, যিনি নিজের লেখাকে কখনও পাঠিয়েছিলেন চিত্রনাট্যে, কখনও বা গল্পের দুনিয়ায়। চিত্রনাট্য তাঁর কাছে গল্প, উপন্যাসের মতোই সাহিত্যের প্রকরণ। সিনেমার নয়।
আর ব্যক্তিজীবনে শরদিন্দু? বিকেলবেলা নাতি তূণককে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বেরোতেন। সন্ধ্যা নামত, লাইন বেয়ে কয়লার ধোঁয়া ছেড়ে সুরাতের দিকে ছুটে বেরিয়ে যেত ‘ফ্লাইং রানি’ নামের এক্সপ্রেস ট্রেন। তখনই দাদুর কাঁধে চেপে বাড়ি ফিরত নাতি। পরে তূণক নিজেই ইংরেজি ভাষায় এক স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন সে কথা।
ব্যোমকেশ-স্রষ্টা নিজেও প্রেমপত্র লিখতেন ইংরেজিতে। ১৯ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, হোস্টেল থেকে নববিবাহিতা স্ত্রীকে লিখছিলেন, ‘‘My sweet little loving wife, I have a longing in my heart to fly away to you to kiss your sweet lips …’’
মুম্বই ছিল এই দম্পতির প্রথম নিজস্ব সংসার। তার আগে শরদিন্দু মুঙ্গেরে বাবা ও ভাইদের সঙ্গে যৌথ পরিবারে থাকতেন। আজও প্রশ্ন ওঠে, সংসারের নিজস্ব পরিসরে দেখা তাঁর স্ত্রী ‘পারুলবালা’ই কি ‘সত্যবতী’ চরিত্রের মডেল? ব্যোমকেশ যেমন সত্যবতীকে সত্যান্বেষণের খুঁটিনাটি শোনাতেন, শরদিন্দুও ছিলেন সে রকম। লেখা শেষ হলে স্ত্রীকেই পড়ে শোনাতেন। পরে নিজেই বলেছিলেন, স্ত্রী ও ‘একমাত্র বান্ধবী’ পারুলই ছিলেন তাঁর সব লেখার প্রথম পাঠক। ‘‘সেন্সরশিপটা আমার ঘরে থেকে যাওয়ায় লাভ হয়েছে। ছাপা হওয়ার আগে লেখা আর কাউকে পড়াই না।’’ তাঁর এক পুত্রও কলকাতায় চাকরি করতে এসে থাকতেন ব্যোমকেশ-সত্যবতীর কেয়াতলায়। নিজের জীবনের হরেক ক্লু এ ভাবেই তাঁর গল্পে দিয়ে গিয়েছিলেন শরদিন্দু।
কেমন ছিল এই দম্পতির জীবন? শরদিন্দুর ছিল ব্যায়াম-করা, প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার দোহারা চেহারা। তার পাশে পারুল ছিলেন বড়জোর সাড়ে চার ফুট। কিন্তু সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকত। শরদিন্দু গল্পের প্লট ভাবতে ভাবতে ঘরে ঘুরে বেড়াতেন, আপনমনে প্লেট থেকে এক মুঠো আলুভাজা তুলে খেতেন। পারুলের কাজই ছিল স্বামীর জন্য আলুভাজার প্লেট তৈরি রাখা। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছিলেন সহৃদয়, অতিথিবৎসল। ‘সুকুমার সেন’ও তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে গিয়েছেন, ‘‘যেমন শরদিন্দুবাবু, তেমনি, তাঁর স্ত্রী। দু’জনেই এক মুহূর্তে অচেনাকে চিরচেনা করতে পারেন।’’ সন্ধ্যায় নাতিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে মাঝে মাঝে ছেলে, বউমাদের সঙ্গে তাস খেলতে বসেন তিনি। বোরিভলি এলাকায় তখন অনেক পুকুর ছিল, প্রতি শনিবার ‘চার’, ‘টোপ’ ইত্যাদি নিয়ে তখন মাছ ধরতে যেতেন শরদিন্দু। কোষ্ঠীবিচার ছিল তাঁর নেশা। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় মাঝে হতাশ হয়ে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন, শরদিন্দুই তাঁর কোষ্ঠী দেখে বলেছিলেন, ‘‘যেয়ো না। এখানেই তোমার রাজযোগ।’’
বন্ধুবান্ধবের মধ্যে সময় কাটানোর জন্য একটি নতুন খেলাও চালু করেছিলেন তিনি। খেলাটা ছিল, কেউ রবীন্দ্রনাথের দু’এক লাইন কবিতা বলবে, শেষ অক্ষর দিয়ে আর এক জন অন্য এক কবিতা। খেলার নামটাও ছিল তাঁরই দেওয়া – ‘অন্তাক্ষরী’, ব্যোমকেশ-স্রষ্টাই হলেন এই খেলার উদ্ভাবক।
মুম্বই-এর জল সহ্য না হওয়ায় চার বছরের নাতি তূণককে নিয়ে তিনি সস্ত্রীক চলে এসেছিলেন পুণেতে। ছেলে, বউমারা মুম্বই থেকে সপ্তাহান্তে আসতেন, তূণকের পোষা কাঠবিড়ালির নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘চিড়িকদাস’। এই পুণেতেই সদর্পে বাংলা সাহিত্যে ফিরেছিলেন তিনি। লেখা হয়েছিল একের পর এক ব্যোমকেশ, ‘গৌড়মল্লার’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’, ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’। এছাড়াও শিবাজির আমলের দুই বালক-বালিকাকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘সদাশিব’। কলকাতায় তাঁর গল্প নিয়েই শ্রী সত্যজিৎ রায় তখন তৈরি করছিলেন ‘চিড়িয়াখানা’, আর শ্রী তপন সিনহা তৈরি করছিলেন ‘ঝিন্দের বন্দি।’ তবুও তিনি সিনেমায় আর ফেরেননি। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার কপিরাইট এখন তাঁর পৌত্রপ্রতিম শ্রী প্রবীর চক্রবর্তীর হাতে। অঞ্জন দত্ত, অরিন্দম শীল থেকে দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়, সবাইকে কপিরাইটের জন্য তাঁরই দ্বারস্থ হতে হয়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘দাদু চিড়িয়াখানা দেখে ঠাট্টা করেছিলেন, ইস! ব্যোমকেশ তো কায়েত, তাঁকে উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় … একেবারে বামুন বানিয়ে দিল।’’ কায়েত মানসপুত্রের প্রতি তাঁর দুর্বলতা তিনি প্রকাশ করেছিলেন বারবার। এক সাক্ষাৎকারে এক বার জানিয়েছিলেন, ব্যোমকেশ কেন ‘বক্সী’ – ‘‘কায়েতদের বুদ্ধি বেশি।’’ ওদিকে ফেলুদাও কিন্তু প্রদোষচন্দ্র মিত্র – কায়স্থ!
এ দেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং সাহিত্যধারা হিসেবে উপন্যাসের বিবর্তন, এ দুয়েরই সাধারণ সূত্র ছিল ইতিহাসের প্রতি আবেগ। ১৮৯৯ সালে জন্মানো শরদিন্দু যেন ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সেই বিদ্বৎসমাজের উত্তরসূরি, যাঁরা ইতিহাসচর্চাকে জরুরি কর্তব্য বলে মনে করতেন। শরদিন্দু যখন লিখতে শুরু করেছিলেন, তত দিনে ‘জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চা’ পুরোদমে ঘোড়া ছোটাচ্ছিল। ‘রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘যদুনাথ সরকার’, ‘রমেশচন্দ্র মজুমদার’, ‘নীহাররঞ্জন রায়ের’ লেখা হয়ে উঠেছিল শরদিন্দুর আকর। রমেশচন্দ্র তাঁকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘লোকে ইতিহাস পড়ে না, কিন্তু আপনার বই পড়িবে।’’
১৯৭০ সালে পুণেতেই তাঁর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়। একটু ভাল হতে মুম্বই নিয়ে আসা হয়। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও পাওয়া গিয়েছিল তাঁর অপ্রকাশিত এক লেখা। সেই লেখা ১৬ বছর বয়সে ‘প্রেমের প্রায়শ্চিত্ত’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন, কিন্তু কাঁচা লেখা ভেবে আজীবন ড্রয়ারেই রেখে দিয়েছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রবীর চক্রবর্তী শরদিন্দুর স্মৃতিচারণে লিখেছিলেন, ‘‘লেখাটা ছেপে বেরোনোর পরের দিনই তরুণ মজুমদারের ফোন, তিনি সিনেমা তৈরি করবেন। অবিলম্বে গল্পের চিত্রস্বত্ব চাই।’’ ‘এস ব্যানার্জি’ যে গল্পকে কাঁচা ভেবে কোনও দিন চিত্রনাট্যে রূপ দেওয়ার কথা ভাবেননি, সেই গল্পই মৃত্যুর পর নিয়ে এসেছিল সিনেমার আর এক জয়টিকা। গল্পটার নাম অবশ্য জীবদ্দশাতেই পাল্টে দিয়েছিলেন শরদিন্দু। নাম দিয়েছিলেন – ‘দাদার কীর্তি’!
(তথ্যসূত্র:
১- আমার কালের কয়েকজন কথাশিল্পী, জগদীশ ভট্টাচার্য, ভারবি (১৯৯৯)।
২- বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, সুকুমার সেন, ইস্টার্ণ পাবলিশার্স (১৯৭৬)।
৩- বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ভূদেব চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং (১৯৮২)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত