আজ ‘মহালয়া’। বাঙালির রক্তের মধ্যে যদি কোনও সুর মিশে গিয়ে থাকে, সে সুর মহালয়ার। অন্য সময় রেডিওর সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ক না থাকলেও বছরের একটি বিশেষ দিনে ভোরবেলা আজও বাঙালি বাড়ি থেকে ভেসে আসে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র চেনা সুর। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-বাণীকুমারের যে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাঙালির ঘরে ঘরে মহালয়ার সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছিল তার সঙ্গে স্রষ্টা হিসেবে প্রধানত তিন জনের নাম জড়িয়ে আছে। ‘বাণীকুমার’, ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’ আর ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র’। মহালয়া উপলক্ষে ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র’কে আমরা মনে রাখলেও প্রায় ভুলেই গিয়েছি অপর দুই নক্ষত্র, ‘বাণীকুমার’ ও ‘শ্রী পঙ্কজকুমার মল্লিক’কে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই টেলিভিশন বিভিন্ন বাড়িতে স্থান পেতে শুরু করে; এখন এ যন্ত্রটি নেই এরকম বাড়ি খুঁজে পাওয়া শক্ত। যদিও তার আগে এক সময়ে রেডিওই ছিল খবর ও অন্যান্য অনুষ্ঠান সম্প্রচারের একমাত্র মাধ্যম, এখন সে দায়িত্ব পালন করছে টেলিভিশন। কোন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যের উপস্থিতি দর্শকমনকে আকৃষ্ট করে অনেক বেশি; সেজন্যই রেডিওর জৌলুষ এখন অনেকটাই স্তিমিত। হয়ত এর একমাত্র ব্যতিক্রম মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। টেলিভিশনের চেয়ে আকাশবাণীর এই অনুষ্ঠানটি এখনও লোকের কাছে অনেক বেশি প্রিয়। অনুষ্ঠানের শুরুটি – ‘‘মহিষাসুরমর্দিনী। রচনা ও প্রবর্তনা – বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন – পঙ্কজকুমার মল্লিক। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।’’
“আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ম্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্ত্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবনমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী ঊষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ।”
এরপর তিনবার শঙ্খধ্বনির পর শুরু হয় অনুষ্ঠান। সুপ্রীতি ঘোষের পরিশীলিত কন্ঠে গাওয়া সেই গান – “বাজল তোমার আলোর বেণু”।
সাধারণ মানুষের কাছে পঙ্কজকুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেভাবে এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, সেই তুলনাতে একটু হয়তো আড়ালেই থেকে গেছেন বাণীকুমার। অথচ মূল অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও রচনা বাণীকুমারেরই। উপরোক্ত গানটির রচয়িতাও বাণীকুমার।
পরনে কোঁচানো ধুতি ও পাঞ্জাবি, গায়ের রং ফর্সা, ঝকঝকে কালো পাম্পশু, মুখে পান, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। মাথার সামনের দিকের অংশ কিছুটা ফাঁকা হলেও পেছনে ও কানের দু’পাশের চুলটি বড়ো সুন্দর। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। গায়ে মিষ্টি আতরের গন্ধ। গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা। সব কিছুর মধ্যেই এক শিল্পীসুলভ ভাব। মুখে তাঁর জর্দা মেশানো পান। আতরও মাখতেন তিনি। জুঁইফুলের আতর ছিল তাঁর খুব প্রিয়। এ হেন মানুষটি যে দরকারে কতটা কঠিন হতে পারতেন কে বলবে? বলতে পারে অতীত।
প্রথম দিকে টেপরেকর্ডিং করা অনুষ্ঠানের চল হয়নি। আকাশবাণী-তে সব অনুষ্ঠানই হত লাইভ। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে যাঁরা অংশ নিতেন তাঁরা অনেকেই আগে মহড়ার জন্য চলে আসতেন বেতারে। মহড়ার অবসরে চলত চা-পান, রঙ্গরসিকতা। একবার হয়েছে কী, যথারীতি কেউ আড় হয়ে শুয়ে পড়েছেন, তো কেউ বা ঘুরছেন এদিক-সেদিক। বাণীকুমার বসে আছেন রেকর্ডিং-এ। ও দিনের আগে ভাষ্য অংশ পাঠ করা হত স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতে। সুরে নয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব ধারায় চণ্ডীপাঠ করছিলেন সুরেলা কণ্ঠে। হঠাৎই অলস রসিকতার ছলে বাংলা ভাষ্যটিও স্তোত্রের সুরের অনুকরণে বলতে শুরু করলেন। তাতে চারিদিকে বেশ একটা মৃদু হাসির ভাব জাগল। কিন্তু বাণীকুমার দ্রুত রেকর্ডিং রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “আরে আরে থামলে কেন? বেশ তো হচ্ছিল! হোক! হোক না ওই ভাবেই …।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হেসে বললেন, “আরে না না একটু মজা করছিলাম!” কিন্তু বাণীকুমার গভীর আগ্রহ নিয়ে বললেন,“মোটেই না! দারুণ হচ্ছিল! ওইভাবেই আবার করো তো।” বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আবার শুরু করলেন, “দেবী প্রসন্ন হলেন …।” সেদিনই বাংলার ইতিহাসে সংযুক্ত হল এক নতুন মাত্রা। অন্য ধারায় মহালয়ার পাঠ। দুর্গাপুজোর কার্টেন রেজার! এক হলদে রঙের রোদ্দুরে মায়া যেন! শরৎ এসে হাজির হয় পুজোর আকাশে। অনেকের বাড়িতে এক সময় রেডিয়ো এসেছিল মহালয়ার আগমনী হিসেবেই। ১৯৩২-এ বাণীকুমারের প্রযোজনায় সম্প্রচারিত হল শারদ-আগমনী গীতিআলেখ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তখন এটি ঘিরে তীব্র আপত্তি ওঠে। ধর্মকে যাঁরা চিরদিন বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়, সেই রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে। প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল – এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শোনা যাবে? রুখে দাঁড়ালেন বাণীকুমার। গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রই করবেন এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন তিনি। আর মায়ের এই আরাধনায় মুসলমান শিল্পীরাও অংশগ্রহণ করবেন৷ সে-ও আটকাবে না কিছুতেই৷ মা শুধু হিন্দুর মা নন। এই লড়াকু মনোভাব লেখা ছিল যেন মজ্জায়৷ অন্য একটি আপত্তিও ছিল, মহালয়ার সকালে পিতৃতর্পণের আগেই কেন চণ্ডীপাঠ হবে? এ কারণে কয়েক বছর অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু শেষে বাণীকুমারের সিদ্ধান্ত মেনেই মহালয়ার ভোরেই প্রচারিত হয়ে আসছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে প্রথম প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি, কিন্তু তখন এর নাম ছিল ‘শারদ বন্দনা’। ১৯৩৪-এর ৮ই অক্টোবর (১৩৪১ বঙ্গাব্দ) মহালয়ার সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রচারিত হয়েছিল অনুষ্ঠানটি। ‘এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শোনা যাবে?’ – এই আপত্তি ছাড়াও আরও একটা আপত্তি এসেছিল রক্ষণশীল সমাজের পক্ষ থেকে। আপত্তিটি ছিল, ‘মহালয়ার সকালে পিতৃতর্পণের আগেই কেন চণ্ডীপাঠ হবে?’ এ কারণেই ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর ভোরে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু পরিশেষে বাণীকুমারের সিদ্ধান্ত মেনেই ১৯৩৭ সাল থেকেই মহালয়ার ভোরে প্রচারিত হয় – ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৩২ সালে ষষ্ঠীর দিন। তবে তার আগের বছর ১৯৩১ সালে, বাণীকুমার ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’-র বিষয়বস্তু নিয়ে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। সে বছরই চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর সময়ে ‘বসন্তেশ্বরী’ প্রচারিত হয়। তাতে সুর দিয়েছিলেন ‘পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী’। তাতে ছিলেন ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ’ ও ‘বাণীকুমার’ও। আর সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন ‘রাইচাঁদ বড়াল’। এমনই এক সময় সকলে মিলে ঠিক করলেন দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সকালে এমন একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? সেই শুরু। ১৯৩২ সালে প্রথম প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাণীকুমার এই রচনায় সহায়তা পেয়েছিলেন ‘পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী’র। কয়েকটি গানে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত ‘হরিশচন্দ্র বালী’ ও ‘রাইচাঁদ বড়াল’। তবে বেশির ভাগ গানে সুর দিয়েছিলেন ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’। শোনা যায় অনুষ্ঠানের আগের দিন রাত্রে স্টুডিওতেই থাকতেন ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র’। অন্য শিল্পীদের রাত দু’টো নাগাদ স্টুডিওয় নিয়ে আসা হত। ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ’ স্টুডিওতেই স্নান সেরে গরদের ধুতি ও চাদর পরতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শাঁখ বেজে উঠত। শুরু হত লাইভ প্রোগ্রাম। প্রথম দিকে কয়েক বছর ‘রাইচাঁদ বড়াল’ ও ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’ যুগ্ম সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন। তবে পরবর্তী কালে এই অনুষ্ঠানে এসেছিল বেশ কিছু পরিবর্তন। বদলেছিল শিল্পীর তালিকাও। শুধু বদলায়নি গ্রন্থণা ও শ্লোক আবৃত্তির সেই শিল্পী। ‘বাণীকুমার’ একই রকম জেদি মনোভাব দেখিয়েছিলেন পঞ্চাশের দশকেও। যখন ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’ চলে গেলেন বোম্বাই, রিহার্সাল করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয়। ‘বাণীকুমার’ বেঁকে বসলেন, সুতো ছেঁড়া যাবে না। হোক তারকা, তবু বাদ হেমন্ত। দুর্ভাগ্য ‘শচীন গুপ্তের’, সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর গাওয়া হল না হেমন্তের ‘জাগো দুর্গা’। বর পেলেন ‘দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়’, আর সেই থেকেই অমর হয়ে রইলেন দ্বিজেন।
অনুষ্ঠানটি সফল ও আকর্ষণীয় করে তুলতে বাণীকুমারের সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম অবশ্যই স্মরণীয়; ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র’, ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’ ও ‘বাণীকুমার’ ছিলেন ‘একই বৃন্তের তিনটি ফুল’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ গীতি আলেখ্যটি পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধে বাণীকুমার নিজেই লিখেছেন – “মহিষাসুরমর্দিনী” আমার প্রথম যৌবনের রচনা। কিন্তু মূল রূপটির বিশেষ পরিবর্তন না ঘটলেও এই গ্রন্থের বর্তমান রূপ বহুতর তথ্য ভাবগর্ভ বিষয় এবং বেদ-পুরাণাদি-বিধৃত শ্লোকাবলী সংযোজনায় সমলংকৃত। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্থ মার্কন্ডেয় সপ্তশতী চন্ডীর সংক্ষিপ্তসার বললেও অত্যুক্তি হয় না, তদুপরি এর মধ্যে আছে মহাশক্তি-সম্বন্ধে বৈদিক ও তান্ত্রিক তত্ত্বের ব্যঞ্জনা, এবং এর অন্তরে নিহিত রয়েছে শাশ্বত ভারতের মর্মকথা। …”
মাত্র একবারই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রচার বন্ধ হয়েছিল। দেশে জরুরী অবস্থা থাকাকালীন ১৯৭৬-এর ২৩শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে সরিয়ে ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’ নাম দিয়ে এক বিকল্প অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। রূপদান করেছিলেন অভিনেতা ‘উত্তমকুমার’, সঙ্গীতশিল্পী ‘লতা মঙ্গেশকর’ প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। এই নতুন উদ্যোগ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি ‘বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র’ ও ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’। কিন্তু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ স্থানচ্যুত হওয়ায় জনরোষ ফেটে পড়ে। পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বেতার অফিস ভাঙচুর হয়। অফিসের সামনে লোকে গালিগালাজ করতে শুরু করে। অনেকের এমনও মনে হয়েছিল যে মহালয়ার পুণ্য প্রভাত কলুষিত হল! এ বার বুঝি অমঙ্গল কিছু ঘটবে! ‘উত্তমকুমার’ কিন্তু এ দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি বীরেন্দ্র কৃষ্ণের কাছে গিয়ে তাঁর অস্বস্তি ও অযোগ্যতার কথাও বলেছিলেন। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহই দিয়েছিলেন। সম্প্রচারের দিন খাটে বসে ছেলের সঙ্গে মন দিয়ে তিনি শুনেছিলেন উত্তমকুমারের মহালয়া। সবটা শোনার পরে তিনি নাকি শুধু এটুকুই বলেছিলেন, “লোকে যদি নেয় নিক।” এ কথা জানা যায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের পুত্র ‘প্রদ্যোৎকুমার ভদ্রের’ কাছ থেকে। বেতার কর্তৃপক্ষ একেবারে গোপনে তাঁকে কিছু না জানিয়ে এই নতুন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করায় তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ওরা একবার আমায় জানালোও না। আমি কি নতুন কিছুকে কোনও দিন বাধা দিয়েছি?” ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ না-বাজানো সম্পর্কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বক্তব্য ছিল, ‘‘আমি তো অমর নই, একদিন না একদিন অন্যদের তো এগিয়ে আসতেই হবে এ কাজে।’’
কিন্তু এ কথা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতি বছর মহালয়াতে বাঙালির ভোর হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ দিয়েই। আর সেই অনুষ্ঠান বাঙালির চিরকালের ঠাকুরঘরই৷ ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’-এর অশেষ দুর্গতি-র পরে দুর্গতির কারণ বলতে গিয়ে ‘উত্তমকুমার’ যে নিজেই বলেছিলেন, ‘‘ঠাকুর ঘরকে রিনোভেট করে ড্রয়িং রুম বানালে যা হয়, তাই-ই হয়েছে।’’
বহু মানুষের চাহিদায় সে বছরই ষষ্ঠীর দিন আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করা হয়। আশ্চর্যের কথা হল, এই সম্প্রচার হবে শুনে অভিমান, ক্ষোভ সব ভুলে ‘বীরেন্দ্র কৃষ্ণ’ পুনরায় কাজে নেমে পড়েছিলেন। সাথে ছিলেন ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’।
তবে এই জরুরী অবস্থার সময়েই অপসারিত হন পঙ্কজকুমার মল্লিক ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ থেকে। সেই ক্ষত আমৃত্যু রয়ে গিয়েছিল তাঁর পাঁজরে! তাঁর প্রিয় অনুষ্ঠান ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’! বহু দশক ধরে রেডিয়োর যে অনুষ্ঠানে প্রাণ ভ’রে গান শেখাতেন তিনি। তার পরিণাম? আত্মজীবনী-তে পঙ্কজ মল্লিক লিখছেন, ‘‘আসরে শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিয়েছিলাম ‘তোমার শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’। … তখন কি জানতাম এই গানই আমার আসরের শেষ গান হয়ে দাঁড়াবে! … মীরাবাঈ ভজন শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম। এমন সময় অকস্মাৎ এক দিন আমার বাসভবনের ঠিকানায় এল এক চিঠি, পত্রলেখক কলকাতা বেতার কেন্দ্রের তদানীন্তন স্টেশন ডিরেক্টর। … অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হল। এক বোবা যন্ত্রণা আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিল। … যে মীরাবাঈ ভজনটি শেখাতে আরম্ভ করেছিলাম সেটিকে, বলা বাহুল্য, শেষ হতে দেওয়া হল না।’’ এই বিষয়ে পঙ্কজকুমার মল্লিকের পৌত্র ‘শ্রী রাজীব গুপ্ত’র বক্তব্য, ‘‘অল ইন্ডিয়া রেডিওর পক্ষ থেকে জানানো উচিত ছিল। সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে দাদুর দুটো অনুষ্ঠান হত। প্রথমটি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর দ্বিতীয়টি ‘সঙ্গীতশিক্ষার আসর’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বন্ধ করার পনেরো দিন আগে সঙ্গীতশিক্ষার আসর অনুষ্ঠানটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সঙ্গীতশিক্ষার আসর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দাদু একটা ধাক্কা পেয়েছিলেন। সে সময় উনি যে গানটি শেখাতে শুরু করেছিলেন, সেটাও ওঁকে শেষ করতে দেওয়া হয়নি। তার পনেরো দিনের মধ্যেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র ঘটনাটা ঘটে। একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাদু জানতেন না, মহিষাসুরমর্দিনীর পরিবর্তে অন্য একটা অনুষ্ঠান হতে চলেছে। অথচ সবার সঙ্গেই দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হত। পরপর দুটো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় দাদুর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু হেমন্তবাবুর সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সম্পর্ক এমন ছিল না যাতে দু’জনের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতে পারে। হেমন্তবাবু ওঁর সন্তানতুল্য ছিলেন। তাই দাদুর একটা ক্ষোভ থেকে থাকতে পারে, হেমন্তবাবু সব জেনেও ওঁকে কিছু জানাননি। কিন্তু ঝগড়া বা তর্কাতর্কি কিছুই হয়নি। হেমন্তবাবুও কখনওই দাদুর প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাননি। আসলে এই বিষয়টা এতটাই জটিল যে এক কথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।’’ পঙ্কজকুমার মল্লিকের জায়গায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কাজ করায় দু’জনের মধ্যে কি কোনও দ্বৈরথ সৃষ্টি হয়েছিল? পঙ্কজকুমার মল্লিকের পৌত্র ‘শ্রী রাজীব গুপ্ত’ সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যম কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘‘পঙ্কজকুমার ও হেমন্ত, দু’জনেই খুব নম্রভাষী মানুষ ছিলেন। আমার দাদু অর্থাৎ পঙ্কজকুমার ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সারাজীবনে কারও সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছেন কিনা জানা নেই।’’ সেই সঙ্গে তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, সে সময়ে গোটা বিষয়টি নিয়ে কেউ কিছুই জানাননি পঙ্কজকুমারকে, এবং এই বিষয়টিই তাঁর সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল। প্রান্তবেলায় সন্তান হারানোর মতো এ শোক ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল গানসাধক প্রবীণ মানুষটিকে। এও কি তাঁর পাওনা ছিল!
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বরাবরই ভোর হবার আগে রাত্রিবেলাতেই বেতারকেন্দ্রে চলে আসতেন এবং ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থেকে তারপরে যেতেন। টেপ রেকর্ডারে অনুষ্ঠান চললেও এ অভ্যাস তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালের পর থেকে তিনি আর কখনও রাত্রি বেলা যেতেন না। অবশ্য জনসাধারণের চাহিদাকে মর্যাদা দিতে সেবছর ষষ্ঠীর দিন সম্প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ আর ১৯৭৭ থেকে স্বমহিমায় মহালয়ার ভোরে ফিরে আসে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি রচনা ও তরঙ্গায়িত করে ‘বাণীকুমার’ যে আসাধারণ কাজটি করেছিলেন তৎকালীন স্টেশন ডিরেক্টর ‘দিলীপকুমার সেনগুপ্ত’ সে প্রসঙ্গে বলেছেন – “বাণীকুমার যদি আর কোনো কাজ নাও করতেন, তাহলেও শুধু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র জন্যই মানুষ তাঁকে মনে রাখত। … শাজাহান যেমন তাজমহল গড়েছিলেন, যা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের একটা হয়ে আছে, আমাদের বাণীদা হাওয়ায় তাজমহল গড়ে গেলেন, যা মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
‘বাণীকুমার’, যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে, নিজের জেদ আঁকড়ে রেখে নিষ্ঠার সঙ্গে কোটি কোটি বাঙালি শ্রোতার কাছে তাঁদের প্রিয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর শেষ জীবন শোনা যায় সুখের হয় নি। স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন ছিলনা। বহু শিল্পীর ক্ষেত্রেই এটা হয়েছে। শিল্প সৃষ্টিতে নিমগ্ন থেকে বহু স্রষ্টাই তাঁদের ভবিষ্যত জীবনের পরিণতির কথা ভাবেন নি। এক সময়ে যাদের সবাই শ্রদ্ধা ও আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, জীবনের শেষ পর্বে তাঁরা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে বিস্মৃতির গর্ভে লীন হয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ১৫ই আগস্ট ‘বাণীকুমার’ চিরবিদায় নিয়েছিলেন, না ফেরার দেশে। তাই, সাময়িক ভাবে হলেও তাঁর প্রিয় অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাতিল হবার খবর তাঁকে শুনে যেতে হয় নি। দুঃখের বিষয়, সাধারণ মানুষের কাছে যে ভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত পঙ্কজকুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, সেই তুলনায় একটু হয়তো আড়ালেই থেকে গিয়েছেন বাণীকুমার। অথচ মূল অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও রচনা বাণীকুমারেরই।
বাণীকুমার নিজের লেখাতেই জানিয়েছেন, “এ কথা বলা বাহুল্য যে আমাদের কয়জনের আন্তরিক সাধন দ্বারা এই মহিমাময় চণ্ডী-গাথা সকল শ্রেণীর জনবর্গের প্রার্থনীয় হয়েছে। … ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কলিকাতা বেতারের তথা বাংলার একটা কীর্তি স্থাপন করেছে।”
‘পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী’র ঠাকুরঘরে বসে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ লেখা শুরু করেছিলেন ‘বাণীকুমার’৷ কিছুটা লিখতেন, আর পড়ে শোনাতেন বন্ধু অশোকনাথকে৷ অশোকনাথ শুনতেন, আলোচনা করতেন, তথ্য সহায়তায় এগিয়ে আসতেন। বাণীকুমার লিখে চলতেন৷ আর লিখেই বসতেন আর এক অক্লান্ত পথিকের সঙ্গে৷ রাজার রোয়াব ছিল যাঁর সঙ্গীতে, তিনি ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’৷ অহরহ বৈঠক৷ আর ঘরময় সুরের পরশ৷ এক লাইন এক লাইন করে কোরাস নির্মাণ, পর্দার আড়ালে হাজার রাগ৷ ‘পিলু’, ‘খম্বাজ’, ‘আহির ভৈরব’, ‘মালকোষ’ … পঙ্কজকুমার তখন সে আবহে এমনই আশক্ত হয়েছিলেন যে, ‘রাতের রাগ মালকোষ’কে ব্যবহার করেছিলেন ভোরের সে মুহূর্তে! ‘কর্ণাটকী শৈলির রাগ’ অনায়াসেই মিশ খেয়েছিল অন্য ঘরানায়৷ আর ‘বাণীকুমার’, বন্ধু পঙ্কজের কাছে নতুন আত্মজকে সমর্পণ করে আবার ঢুকে যেতেন ‘ঘোর-মধ্যে’৷ যে ঘোরে প্রতিনিয়ত ডুব দিয়ে বাণীকুমার তুলে এনেছিলেন মুক্তো-হিরে-চুনি-পান্না। ভোর চারটেয় তরঙ্গে ভাসা শুরু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র৷ আরম্ভে ‘তিন বার শঙ্খধ্বনি’, আর তারপরই বীরেন ভদ্রের অমর হয়ে যাওয়া স্বর৷ ‘বাণীকুমার’ সেই শঙ্খ বাড়ি থেকে বেতারকেন্দ্রে নিয়ে যেতেন। ‘মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়’ তাতে ফুঁ দিতেন৷ শুরুর নির্দেশ৷ পরে ‘গৌর গোস্বামী’ বাঁশি দিয়ে বা কখনও ‘শৈলেশ্বর মুখোপাধ্যায়’ ক্ল্যারিওনেটে তুলে দিতেন এই সুর। তখন তো লাইভ ব্রডকাস্টের যুগ৷ দীর্ঘ বিশ-বাইশ দিনের অবিরাম মহড়া চলত পঙ্কজ মল্লিকের নেতৃত্বে। সকলের উপস্থিতি চাই। এক দিকে সারেঙ্গি ধরতেন ‘মুন্সি’, চেলোয় ওঁরই ভাই ‘আলি’, হার্মোনিয়ামে ‘খুশি মহম্মদ’, বেহালায় ‘তারকনাথ দে’, ম্যান্ডোলিনে ‘সুরেন পাল’, গিটারে ‘সুজিত নাথ’, এসরাজে ‘দক্ষিণামোহন ঠাকুর’, পিয়ানোয় ‘রাইচাঁদ বড়াল’, নক্ষত্রের সমাহার৷ আর এ সবের অন্য পিঠে গায়কদের নিয়ে একা থাকতেন ‘বাণীকুমার’। দেখতেন প্রত্যেকের সংস্কৃত উচ্চারণ ঠিক চলছে কিনা। এমনকি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রেরও! তিনি শুরুর দিকে সংস্কৃত বেশ কিছু কথা অনেকটা বাংলার মতো উচ্চারণ করে বলতেন, যা অধ্যাবসায়ের জোরে শেষে এমন বসেছিল তাঁর গলায়, যে একটা ভিন্ন ধারাই তৈরি হয়ে গেল। বাণীকুমারের কথা ছিল, আগে মানে বুঝতে হবে প্রতিটি শব্দের, সে তুমি কোরাসই গাও না কেন, উপলব্ধি করতে হবে ভাব, তার পর মিলবে ছাড়। সোজা পঙ্কজবাবুর সান্নিধ্যে এক বিস্তর মহাযজ্ঞ।
আজও বোধনের আগে আর এক বোধনের কথা ছড়িয়ে পড়ছে আশ্বিনের শারদ হাওয়ায়। কচুরি জিলিপির দোকানে অর্ডার চলে গিয়েছে পঙ্কজকুমারের। এরই মধ্যে বেতারকেন্দ্র থেকে হয়ত বেরিয়ে পড়েছেন ‘বাণীকুমার’ গঙ্গার দিকে যাবেন বলে। কারণ এখন তিনি নিশ্চিন্ত। মহালয়া এখন বাঙালির রক্তে মিশে গেছে। যতদিন বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন মহালয়ার ভোরে বাংলার ঘরে ঘরে বেজে উঠবে সেই ঘোষণা,
‘‘মহিষাসুরমর্দিনী। রচনা ও প্রবর্তনা – বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন – পঙ্কজকুমার মল্লিক। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।”
“আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ম্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্ত্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবনমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী ঊষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ। …”
(তথ্যসূত্র:
১- শতবর্ষে বাণীকুমার: স্মরণে ও বরণে।
২- কলকাতা বেতার, সম্পাদনা: ভবেশ দাশ ও প্রভাতকুমার দাস, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র (২০১৫)।
৩- আমার যুগ – আমার গান, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, কলকাতা ফার্মা কে এল এম প্রাইভেট (২০১২)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত