তিনি বৃদ্ধ ছিলেন। বাংলায় এসে যুবক হয়েছেন! এক সময়ে তিনি ছিলেন প্রথম সারির দেবতাদের এক জন। এখন হয়ে গিয়েছেন দেবশিল্পী! রাজহাঁসের বদলে বাহন হয়েছে হাতি। আজ যে পৃথিবীজুড়ে এত বহুতল, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, পার্ক প্রভৃতি যাবতীয় বিলাসিতার ছড়াছড়ি, প্রযুক্তি আর পূর্তবিদ্যার দাপটে সভ্যতার আলপিন থেকে স্যাটেলাইট পর্যন্ত নির্মিত, ভারতীয় পুরাণকে যদি ইতিহাসের অতিবাদ হিসাবে স্বীকার করা যায়, তা হলে বলতেই হবে যে বিশ্বকর্মাই এই সব যাবতীয় বিদ্যাকে প্রথম গ্রন্থিত এবং বাস্তবায়িত করে তুলেছিলেন। তিনি বিশ্বকর্মা। বেদের চৌহদ্দি ছেড়ে আপাতত তাঁর ঠিকানা কারখানা, দোকান, মায় অটো স্ট্যান্ড, এমনকী সিন্ডিকেটের অফিসও।
‘মণ্ডনসূত্রধারে’ বিশ্বকর্মার রূপ বর্ণনা যা পাওয়া যায় তা হল –
‘‘বিশ্বকর্মা চতুর্বাহুরক্ষমালাঞ্চ পুস্তকম্
কম্বাং (ম্বং) কমণ্ডলং ধত্তে ত্রিনেত্রৌ হংসবাহনঃ।।’’
অর্থাৎ চতুর্ভুজ বিশ্বকর্মার হাতে যথাক্রমে পুস্তক, অক্ষমালা, শঙ্খ এবং কমণ্ডলু, শোভা পাচ্ছে। তিনি ত্রিনেত্রযুক্ত ও হংস বাহনারূঢ়। এক অন্য বিবরণে বিশ্বকর্মার মস্তকে মুকুট আছে। কিন্তু বর্তমানে বহু ক্ষেত্রেই শাস্ত্ররূপ অনুসরণ না করে বিশ্বকর্মার হাতে হাতুড়ি, বিভিন্ন যন্ত্র, কাস্তে প্রভৃতি দিয়ে তাঁকে গজপৃষ্ঠে আরোহণ করানো হচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁকে শ্রমজীবীর প্রতীক হিসাবে বরণ করে তাঁকেও যেন শ্রমজীবী হিসাবেই কল্পনা করা হচ্ছে।
শুধু তা-ই নয়, বাঙালির বিশ্বকর্মা স্বতন্ত্র পুজো এবং রীতিতেও। দক্ষিণ ভারতে দেবশিল্পীর পুজো হয় তিথি মেনে, মহানবমীর দিন। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দিওয়ালির পরের দিন বিশ্বকর্মা পুজো হলেও বাংলায় এই পুজো সৌর ক্যালেন্ডার মেনে হয়। সূর্যের কন্যা রাশিতে প্রবেশ করার দিন (সাধারণতঃ ১৭ই সেপ্টেম্বর) বঙ্গে পূজিত হন বিশ্বকর্মা। বাকি ভারতের থেকে আলাদা হয়ে বাংলায় তাঁর পুজো মানে ঘুড়ির উৎসবও!
বিশ্বকর্মা পূজা বা অর্চনার ক্ষেত্রেও এখন যেন একটি সরল সমাধান সূত্র গ্রহণ করা হচ্ছে। অন্যান্য যে কোনও পুজো তিথি-নক্ষত্র অনুসারে পালন করা হয়, ফলে কোনও পূজারই একটি নির্দিষ্ট তারিখ হয় না। কিন্তু বিশ্বকর্মা পূজা প্রতি বছরেই ১৭ই সেপ্টেম্বরের জন্য নির্দিষ্ট। যদিও নারদ বচনানুসারে নিত্য কর্তব্য এবং বিশেষ পার্বণে অবশ্যই বিশ্বকর্মা পূজা করা উচিত। নারদ মতে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী বা ত্রয়োদশী অথবা শ্রাবণ মাসের শুক্লা পূর্ণিমাতেই বিশ্বকর্মার পূজা বিধি নির্দিষ্ট। আসলে হিন্দুদের সব দেবদেবীরই পূজার তিথি স্থির হয় চাঁদের গতিপ্রকৃতির উপর নির্ভর করে। এ ব্যাপারে অনুসরণ করা হয়ে থাকে চান্দ্র পঞ্জিকা। কিন্তু বিশ্বকর্মা পূজার তিথিটি স্থির হয় সূর্যের গতিপ্রকৃতির উপর ভিত্তি করে। যখন সূর্য সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে গমন করে, তখনই সময় আসে উত্তরায়ণের। দেবতারা জেগে ওঠেন নিদ্রা থেকে। এবং শুরু হয় বিশ্বকর্মা পূজার আয়োজন। এ ব্যাপারে হিন্দু পঞ্জিকার দু’টি প্রধান শাখা সূর্যসিদ্ধান্ত এবং বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত উভয়েই একমত।
সেই মতো একটু স্পষ্ট করে বললে বিশ্বকর্মা পূজার দিনটি নির্ধারিত হয়েছে ভাদ্র মাসের শেষ তারিখে। এই ভাদ্র সংক্রান্তির আগে বাংলা পঞ্জিকায় পাঁচটি মাস রয়েছে। এই পাঁচটি মাসের দিন সংখ্যাও প্রায় বাঁধাধরা – ১৫৬ দিন। এই নিয়ম ধরে পুজোর যে বাংলা পঞ্জিকা মতে তারিখটি বের হয় তা ইংরাজি ক্যালেন্ডারের ১৭ সেপ্টেম্বর। কোনও কোনও বছর এই পাঁচ মাসের মধ্যে কোনওটিও যদি ২৯ বা ৩২ দিন বিশিষ্ট হয়, তখনই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এক দিন পিছিয়ে বা এগিয়ে যায়। তবে তা খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। এই বছরেও নিয়মের অন্যথা হয়নি। সূর্য নিয়ম মেনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কন্যা রাশিতে। ভাদ্র সংক্রান্তির আগে বাংলা পঞ্জিকার পাঁচটি মাসের দিন সংখ্যা ১৫৬টিই থেকেছে। এবং এই বছরও ১৭ই সেপ্টেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্বকর্মা পূজা। আজও আকাশ রঙিন হতে উঠবে ঘুড়ির সম্ভাবে। তারা বলে দেবে উৎসবের সূচনা। এর পরে এক এক করে সারা বছর উৎসবে মাতবে বাঙালি।
ইতিহাসবিদেরা বলছেন, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে বিশ্বকর্মার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে তিনি বিশ্বের স্রষ্টা। তাঁর যে রূপের কথা জানা যায়, তাতে বৃদ্ধ, এক মুখ সাদা গোঁফ-দাঁড়িতে ঢাকা। বাহন রাজহাঁস। অনেকটাই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সমার্থক। অথর্ববেদেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপিকা শ্রীমতী মধুপর্ণা রায়চৌধুরী এক বাংলা দৈনিকে জানিয়েছিলেন, বেদ-পরবর্তী যুগে কী ভাবে না জানি সেই পদ খোয়া গেল তাঁর! তিনি হয়ে উঠলেন দেবশিল্পী, কারিগরশ্রেষ্ঠ। দেবতাদের আয়ুধ নির্মাতা তিনি। সত্যযুগে তিনি স্বর্গ তৈরি করলেন। ত্রেতায় তৈরি করলেন রাবণের স্বর্ণলঙ্কা। দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা এবং পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থের রূপকারও তিনি। কিন্তু ওইটুকুই। তাঁর ধ্যানমন্ত্র থাকলেও মহিমা-কীর্তন কিন্তু সে ভাবে শোনা যায় না। কোনও মন্দিরের কথাও শোনা যায়নি।
দেবশিল্পী হিসেবেই তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন পশ্চিম থেকে দক্ষিণ ভারতে। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক কীর্তি নারায়ণ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, শুধু ভারত নয়, তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশেও দেবশিল্পী হিসেবে বিশ্বকর্মার উল্লেখ মেলে। মধুপর্ণা রায়চৌধুরী জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ ভারতে বিশ্বকর্মার সঙ্গে বাহন হিসেবে বাঘ ও গরুকে দেখা যায়। সেই রূপের সঙ্গে কোনও ভাবেই বাংলার হস্তীবাহন বিশ্বকর্মাকে মেলানো যায় না।
দেবতাদের শিল্পী হলেন বিশ্বকর্মা। তিনি নির্মাণ, যন্ত্রপাতি আদির দেবতা। স্বর্গের অনান্য দেবতা দের মতো তাঁরও পূজা হয়। বিশ্বকর্মার ধ্যান মন্ত্রে বলা হয়,
“ওঁ বিশ্বকর্মন্ মহাভাগ সুচিত্রকর্মকারক্।
বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃক্ ত্বঞ্চ রসনামানদণ্ডধৃক্।।’’
এর অর্থ, হে দংশপাল (বর্মের দ্বারা পালনকারী), হে মহাবীর, হে বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্ব বিধাতা, হে সুন্দর চিত্র রূপ কর্মকারক, আপনি মাল্য চন্দন ধারন করে থাকেন।
বিশ্বকর্মার প্রনাম মন্ত্রে বলা হয়,
‘‘দেবশিল্পী মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক।
বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদয়ক।।”
এর অর্থ, দেবশিল্পী, মহাভাগ (দয়াদি অষ্ট গুন যুক্ত) দেবতা দের কারু কার্য্যসাধক সর্বাভীষ্ট প্রদানকারী হে বিশ্বকর্মা আপনাকে নমস্কার।
ধ্যান ও প্রনাম মন্ত্রে বিশ্বকর্মার যে পরিচয় পাওয়া গেলো সেটি হল বিশ্বকর্মা মহাবীর আবার দয়াদি অষ্ট গুন যুক্ত। তিনি সৃষ্টি কর্তা আবার সৃষ্টি বিধাতা। তিনি মহাশিল্পী আবার মহাযোদ্ধা। বিশ্বকর্মার এই চরিত্র বেদ এবং পুরানে আরোও পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠে।
ঋগ বেদের দশম মণ্ডলের দুটি বিশিষ্ট সূক্তে বিশ্বকর্মাকে স্তব করা হয়েছে। দুল্যক ও ভূলোক প্রথমে জলাকার ও সম্মিলিত ছিল। উভয়ের সীমা যত বৃদ্ধি পেলো- ততই তারা পরস্পর দূরবর্তী হতে লাগলো। এবং এক সময় পৃথক হল। বিশ্বকর্মা মনে মনে এই বিষয়ে চিন্তা করে নিরীক্ষণ করলেন। এই বিশ্ব তাঁরই কর্ম বলে তাঁর নাম বিশ্বকর্মা। বিশ্বকর্মা ‘বিমনা’ অর্থাৎ তিনি সমষ্টি মনা। বিশ্বকর্মা ‘ধাতা’ অর্থাৎ তিনি স্রষ্টা, বিশ্বকর্মা শ্রেষ্ঠ, বিশ্বকর্মা সর্ব দ্রষ্টা, এবং তিনি ‘ধামানি বেদ ভুবনানি বিশ্বা’, বিশ্ব ভুবনের সকল ক্ষেত্রই তাঁর পরিজ্ঞাত এবং তিনি সর্ব অন্তর্যামী।
বিশ্বকর্মার চোখ, বদন, বাহু, পদ সর্বত্র, সর্ব দিকে। তিনি বিশ্বতশ্চক্ষু, বিশ্বতোমুখ , বিশ্বতস্পাৎ। এই বিশ্ব যজ্ঞে তিনি নিজেকে আহুতি দিয়েছেন। অর্থাৎ বিশ্ব জগতের কল্যাণে তিনি সর্বদা চিন্তা রত। তিনি বাচস্পতি অর্থাৎ বাক্যের অধীশ্বর। তিনি মনোজেব অর্থাৎ মনের ন্যায় বেগ মান। তিনি বিশ্বের সমস্ত প্রানীর মঙ্গলকারী। তিনি সাধুকর্মা অর্থাৎ তাঁর চেষ্টা ও বিধান মঙ্গলময়।
বেদের যিনি বিশ্ব স্রষ্টা, পুরানে তিনি দেবতাদের শিল্পী বিশ্বকর্মা। তিনি স্বর্গের একজন দেবতা। তিনি সহস্র রকম শিল্প জানেন। তিনি দেবতা দের শিল্পের কারিগর। কারিগরি সকল বিদ্যা বিশ্বকর্মার হাতে। কোন কোন পুরান বলে বিশ্বকর্মার পিতা হলেন প্রভাস। প্রভাস হলেন অষ্টবসুর এক জন। আর বিশ্বকর্মার মাতা হলেন বরবর্ণিনী। বরবর্ণিনী হলেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী। আবার ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরান বলে ব্রহ্মার নাভি থেকে বিশ্বকর্মার সৃষ্টি।
পুরানের বিশ্বকর্মা একজন শিল্পী। তিনি বিমান নির্মাতা (দিব্য দেব বিমান), অলংকার ভূষন, আয়ূধ প্রস্তুতকারক। মনুষ্য শিল্পীরা বিশ্বকর্মার প্রবর্তিত শিল্প কেই উপজীব্য করে বেঁচে আছে। বিশ্বকর্মা প্রচুর জিনিষ নির্মাণ করেছেন। কুঞ্জর পর্বতে অবস্থিত অগস্ত্য মুনির ভবন, কুবেরের অলকা পুরী ও দিব্য বিমান, রাবনের স্বর্ণ লঙ্কা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা পুরী – সকল কিছু বিশ্বকর্মার দ্বারা সৃষ্টি। রাবনের রাজাপ্রসাদের সাথে সুন্দর উদ্যান, গোষ্ঠ, মন্ত্রণা গৃহ, মনোরম ক্রীড়া স্থান, রাজাপ্রাসাদের কারুকার্য ইত্যাদি দেবশিল্পীর নিখুত শিল্প কলার পরিচয় দেয়। এছাড়া ভাগবত পুরান অনুসারে দ্বারকা নগরীর যে সুরক্ষিত, ভাস্কর্য , কলা কৌশলের একটি ধারনা পাওয়া যায়- তাতে শিল্পী বিশ্বকর্মার শিল্প কে দেখে আশ্চর্য হতে হয়।
বিশ্বকর্মার অপর নির্মাণ হল দেবপুরী। তিনি সমস্ত সৌন্দর্য কে মিলিয়ে এই পুরী নির্মাণ করেছিলেন। এই পুরীকে পাওয়ার জন্য বারংবার অসুর গণ সুর লোকে হানা দিয়েছিলেন। তাই বিশ্বকর্মার সৃষ্টিকে প্রনাম না করে থাকা যায় না। মৎস্য পুরান বলে- কি কূপ, কি প্রতিমা, কি গৃহ, কি উদ্যান সকল কিছুর উদ্ভাবক হলেন বিশ্বকর্মা। শুধু এখানেই বিশ্বকর্মার সৃষ্টি শেষ নয়, যে বিমানে চড়ে দেবতারা গমন করেন- তাও বিশ্বকর্মার তৈরী। এবং বিভিন্ন দিব্য বান- যা কেবল দেবতাদের অস্ত্রাগারে থাকে – তাও বিশ্বকর্মার তৈরী। যে ধনুক দিয়ে ভগবান শিব ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন, যে ধনুক পরশুরামের কাঁধে শোভা পেতো- সেই ধনুক বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। বৃত্রাসুর বধের জন্য বিশ্বকর্মা দধীচি মুনির অস্থি থেকে বজ্র নির্মাণ করে দেবেন্দ্র কে দিয়েছিলেন। কিছু পুরান বলে ভগবান বিষ্ণুর চক্র, ভগবান শিবের ত্রিশূল বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। শ্রীশ্রী চন্ডী অনুসারে মহিষাসুর বধের জন্য দেবী মহামায়া প্রকট হলে দেবীকে তীক্ষ্ণ বর্শা, অভেদ্য কবচ এবং বহু মারনাস্ত্র বিশ্বকর্মা দেবীকে প্রদান করেন। রামচন্দ্রের সেতু বন্ধনের অন্যতম কারিগর নল এই বিশ্বকর্মার পুত্র। বিষ্ণু পুরান বলে ত্বষ্টা নামক এক শিল্পী ছিল- যিনি বিশ্বকর্মার পুত্র। দেবতাদের শিল্পী যেমন বিশ্বকর্মা, তেমনি অসুর দের শিল্পী হলেন ময় দানব। বায়ু পুরান ও পদ্ম পুরান মতে ভক্ত প্রহ্লাদের কন্যা বিরোচনার সাথে বিশ্বকর্মার বিবাহ হয়। বিশ্বকর্মার ঔরসে বিরোচোনার গর্ভে অসুর শিল্পী ময় দানবের জন্ম হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরান মতে বিশ্বকর্মা ও তাঁর স্ত্রী ঘৃতাচী দু’জনেই শাপ পেয়ে ধরাধামে জন্ম নেন। ঘৃতাচী ছিলেন স্বর্গের এক নর্তকী। তাঁদের নয়টি সন্তান হয় – যথা মালাকার, কর্মকার, কাংস্যকার, শঙ্খকার, সূত্রধর, কুবিন্দক, কুম্ভকার, স্বর্ণকার, চিত্রকর। বিশ্বকর্মা প্রত্যেককেই নানান শিল্প শেখান। তিনি মালাকারকে পুষ্প শিল্প, কর্মকারকে লৌহ শিল্প, কাংস্যকারকে কাংস শিল্প, শঙ্খকারকে শঙ্খ শিল্প, সূত্রধরকে কাষ্ঠ শিল্প, কুবিন্দক কে বয়ন শিল্প, কুম্ভকারকে মৃৎ শিল্প, স্বর্ণকারকে অলঙ্কার শিল্প, চিত্রকরকে অঙ্কন শিল্প শেখান। স্কন্ধ পুরান বলে বৃত্রাসুর হলেন বিশ্বকর্মার পুত্র। যাকে দেবরাজ ইন্দ্র বধ করেন। তবে স্কন্ধ পুরানের এই মত অপর কোন পুরানে পাওয়া যায় নি।
এছাড়াও জানা যায় যে, বিশ্বকর্মার এক মেয়ে পিতার অমতে বিয়ে করেছিলেন। এই কারনে বিশ্বকর্মা বানর হয়ে পৃথিবীতে জন্মান। ঘটনা টি এই – বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচীর কন্যা চিত্রাঙ্গদা পৃথিবীর সূর্য বংশীয় রাজা সুরথ কে ভালোবাসতেন। সুরথও চিত্রঙ্গদা কে ভালোবাসতেন। কিন্তু দেবতা হয়ে তো মানুষের সাথে বিবাহ হয় না। বিশ্বকর্মা জানতে পেরে মেয়েকে যথেষ্ট শাসন করলেন। এই অবস্থায় পৃথিবীর মেয়েরা যা করেন বিশ্বকর্মার কন্যাটিও তাই করলেন। স্বর্গ থেকে পালালেন। দু’জনে বিবাহ করে নিলেন। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বিশ্বকর্মা আসলেন। কন্যা ভাবলেন পিতা বুঝি আশীর্বাদ করতে এসেছেন। কিন্তু না। বিশ্বকর্মা অভিশাপ দিলেন। কন্যার বিবাহ বিচ্ছেদ হোক – এমন অভিশাপ দিলেন। কিন্তু সনাতন ধর্মে বিবাহকে খুব পবিত্র সম্পর্ক মানা হয়- যেখানে বিবাহ বিচ্ছদের স্থান নেই। তাই মহর্ষি ঋতধ্বজ ভাবলেন দেবতা হয়ে বিশ্বকর্মার একি পশুর মতো বুদ্ধি? মুনি বিশ্বকর্মা কে বানরকুলে জন্মাবার শাপ দিলেন । বিশ্বকর্মা বানর হলেন। অবশেষে এক সময় কন্যার বিবাহ মেনে নিলে কন্যা ও বিশ্বকর্মা দু’জনেরই শাপ দূর হয়।
বাঙালী হিন্দুগণ যে বিশ্বকর্মার মূর্তি পূজো করেন তিনি চতুর্ভুজা। এক হাতে দাঁড়িপাল্লা, অন্য হাতে হাতুরী, ছেনী, কুঠার থাকে। অবশ্যই এগুলি শিল্পের প্রয়োজনীয় জিনিষ, তাই শিল্প দেবতা বিশ্বকর্মা এগুলি ধারন করে থাকেন। দাঁড়িপাল্লার একটি কারন আছে। আমরা যদি দাঁড়িপাল্লা কে ভালো মতো লক্ষ্য করি- দেখি দুই পাশে সমান ওজনের পাল্লা থাকে। ওপরের মাথার সূচক যখন সমান ভাবে ঊর্ধ্ব মুখী হয়- তখন বুঝি মাপ সমান হয়েছে। এভাবে একটি পাল্লায় বাটখারা রেখে অপরটিতে দ্রব্য রেখে পরিমাপ হয়। এর তত্ত্ব কথা আছে। আমাদের জীবনের কাটাতি আত্মিক বিন্দুতে স্থির রাখতে হবে। দুই পাল্লার একদিকে থাকবে জ্ঞান আর কর্ম। জ্ঞানের দিকে বেশী ঝুকে পড়লে কর্ম কে অবহেলা করা হবে- পরিণামে আসবে দুঃখ, অভাব। আর কাটাতি কর্মের দিকে বেশী ঝুকে পড়লে তবে আসবে আধ্যাত্মিক অকল্যাণ। তাই কাটাতি দুয়ের মাঝে সমন্বয় করে রাখতে হবে। কোন দিকেই না যেনো বেশী ঝুঁকে পড়ে। এই নিয়ম না মেনে চললে বিশ্বপ্রেম , বিশ্ব ভাতৃত্ব সচেতনতা কোনটাই সম্ভব না।
প্রাচীন শ্লোকে যতই বিশ্বকর্মার সাথে হাতি না থাকুক, বর্তমানে বিশ্বকর্মার মূর্তি যদি আমরা দেখি, তাহলে দেখি তাঁর বাহন হস্তী। কলকাতার কর্মকার সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা শিক্ষা ব্রতী স্বর্গত হরষিত কেশরী রায় প্রথম বিশ্বকর্মার হস্তী বাহন বিগ্রহের পূজা করেন। হাতী কেন বাহন? পুরানের প্রনাম মন্ত্রে বিশ্বকর্মা কে মহাবীর বলে বর্ণনা করা হয়েছে। হাতীর কত টা শক্তি তার আন্দাজ করতে পারি। নিমিষে গাছ পালা মাথা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয়। কারোর ওপর চরণ ভার দিলে- তার মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মৃত্যু- আর অস্থি সকল চূর্ণ চূর্ণ হবে। এমন প্রবাদ আছে, হাতী নাকি একটু বড় পাথর শুঁড়ে তুলে ছুঁড়ে মারতে পারে। প্রাচীন কালে রাজারা যুদ্ধে হস্তী বাহিনীর প্রবল ভাবে ব্যবহার করতেন। তাই এই মহা শক্তিমান প্রানী এই দিক থেকে মহা যোদ্ধা বিশ্বকর্মার বাহন হবার যোগ্যতা রাখে। যদিও, এটি বর্তমান শাস্ত্র পন্ডিতদের মত। কারণ, প্রাচীন গ্রন্থে কোথাও বিশ্বকর্মার বাহন রূপে হস্তীর উল্লেখ পাওয়া যায় না।
বর্তমান শাস্ত্রকারদের মতে, হস্তীর হাত নেই। তবে একটি ‘কর’ বা ‘শুন্ড’ আছে। কর আছে বলেই হাতীর এক নাম ‘করী’। ‘কৃ’ ধাতু থেকেই ‘কর’ শব্দটির উৎপত্তি। সে এই শুন্ডের সাহায্যেই গাছের ডাল টানে, জল খায়, স্নান করে। আবার দেখি শিল্পের মাধ্যমেই কর্ম সংস্থান। তাই বিশ্বকর্মা কর্মের দেবতা। এই শুঁড় দ্বারা কর্ম করা – এই দিক থেকে হস্তী একভাবে বিশ্বকর্মার বাহন হিসাবে মানানসই।
বিশ্বকর্মা যে শুধু কর্মে সুদক্ষ তা নয়, তিনি বেশ কিছু গ্রন্থও লিখে রেখে গেছেন উত্তরসূরীদের জন্য। এবার আলোচনা করব বিশ্বকর্মার লেখক-প্রতিভা এবং লেখালেখি বিষয়ে।
বিশ্বকর্মার রচিত স্থাপত্যশিল্প বিষয়ক গ্রন্থটির নাম ‘বাস্তুশাস্ত্রম’। ‘মানসার’ এবং ‘ময়মতম’ গ্রন্থে বস্তু ও বাস্তু শব্দদুটিকে সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘বস্তু’ শব্দ থেকে ‘বাস্তু’ কথাটা এসেছে। ‘বাস্তু’ শব্দের অর্থ পৃথিবী। ব্যাপক অর্থে সমস্ত প্রাণীর আবাসস্থলই বাস্তু। অর্থাৎ, স্রষ্টার যে-কোনো সৃষ্টিই বাস্তু। কাজেই শুধু পরিকল্পিত মনুষ্যগৃহই নয়, দেবতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর আবাসকেই বাস্তু বলে। বাস্তুশাস্ত্রে বাস্তু শব্দের অর্থ ব্যাপক। এই শিল্পকে নির্মাণ শিল্পকে না-বুঝিয়ে পরিকল্পনা, নির্মাণ, চিত্র, অলংকরণ, স্বর্ণ-চর্ম-বয়নশিল্প, অস্ত্রশিল্প, পোতনির্মাণ, মূর্তিনির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত আছে।
পুরাণে উল্লেখ আছে, চারটি বেদের মতো চারটি উপবেদও আছে। উপবেদগুলি হল আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং স্থাপত্যবেদ। এই উপবেদ স্থাপত্যবিদ্যা বা বাস্তুবিদ্যার রচয়িতা হলেন বিশ্বকর্মা। বলা হয় তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রধান বাস্তুকার। তাঁর রচিত অন্তত দশখানি পুথি এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে মৎস্যপুরাণের ২৪২ থেকে ২৪৭ অধ্যায়, অগ্নিপুরাণের ১০৪ থেকে ১০৬ অধ্যায়, গরুড়পুরাণের ৪৬ থেকে ৪৭ অধ্যায়, ভবিষ্যপুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণের তৃতীয় খণ্ড, বিভিন্ন আগম, শুক্রনীতিসারের চতুর্থ অধ্যায়, বৃহসংহিতা, গৃহ্যসূত্র, অর্থশাস্ত্র প্রভৃতিতে বাস্তুশাস্ত্রের আলোচনা পাওয়া যায়। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় গণপতিশাস্ত্রী বাস্তুবিদ্যা বা বাস্তুশাস্ত্রম গ্রন্থটি আবিষ্কার করে মুদ্রিত করেন। বিশ্বকর্মার নামে প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্রটির নাম ‘বিশ্বকর্মাবাস্তুশাস্ত্রম’।
আর্যাবর্তের শিল্পধারা বিশ্বকর্মার দ্বারা প্রবর্তিত বলে মনে করা হয়। বিশ্বকর্মার ‘বাস্তুশাস্ত্রম’-এর প্রথমেই বলা হয়েছে, জগতের কল্যাণ কামনায় এই শাস্ত্র প্রচার করছেন – ‘‘বাস্তুশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি লোকানাং হিতকাম্যয়া।’’ বিশ্বকর্মার নামে এরকম গ্রন্থ অন্ততপক্ষে দশটি পাওয়া গেছে।
সুপরিকল্পিতভাবে গৃহনির্মাণ, গ্রাম ও নগরের পত্তনের নিয়মাবলি এবং বিধিনিষেধ তাঁর গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়।
বিশ্বকর্মা রচিত এই গ্রন্থে গৃহ, মন্দির, গ্রাম, নগর, যন্ত্র প্রভৃতির বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের প্রধান আলোচ্য বিষয় হল –
(১) সর্বপ্রথম গৃহারম্ভের কাল পরীক্ষা, উপকরণ সংগ্রহ, জমি পরীক্ষা, বিভিন্ন দিক নির্ণয়, ভবন লক্ষণ প্রভৃতি বিভিন্ন পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে।
(২) বাসযোগ্য গৃহ ছাড়াও বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, সর্বসাধারণের ব্যবহার্য গৃহ, পাকশালা, শৌচাগার, পুষ্করিণী, উদ্যান প্রভৃতি কোনদিকে থাকবে, আলো-বাতাস প্রবেশের কীরকম হবে, সবই সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে।
(৩) বিশ্বকর্মার খ্যাতি পুরাণাদিতে দেবশিল্পী হিসাবে পাওয়া যায়। বিভিন্ন মন্দির ও তার উপকরণ প্রভৃতির বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে। মন্দিরের কাজে ব্যবহারের জন্য আট প্রকার কাঠ এবং সাধারণ গৃহস্থদের গৃহনির্মাণের জন্য তেইশ প্রকারের কাঠের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কাঠগুলি কাটার পর পনেরো দিন জলের মধ্যে ভিজিয়ে রাখলে তাতে পোকা ধরবে না। এই প্রসঙ্গে বিশ্বকর্মা লিখেছেন – ‘‘কাষ্ঠং নো ভক্ষ্যতে কীটের্যদি পক্ষং ধৃতং জলে।’’
(৪) দেওয়ালের প্রস্থ ও উচ্চতা, ভিতের গভীরতা, দরজা ও জানালার পৃথক পৃথক মাপের বর্ণনাও এই গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়।
ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাসে বিশ্বকর্মার ‘বাস্তুশাস্ত্রম’ গ্রন্থটির অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ‘বাস্তুশাস্ত্রম’ এক অমূল্য সম্পদ।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মশাস্ত্র বেদে মাত্র তেত্রিশটি দেবতার উল্লেখ থাকলেও হিন্দুরা বিশ্বাস করেন তাদের দেবতা তেত্রিশ কোটি। অবশ্য বেশির ভাগ দেবতা স্বর্গে বাস করলেও বেশ কিছু দেবতা এই ধরাধামেই বসবাস করতেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। এদেরই একজন দলিত গোষ্ঠীভুক্ত দেবতা বিশ্বকর্মা তথা বিশ্বকর্মা ঠাকুর। ইনার জন্য সারা বছরে একদিন মাত্র নির্ধারণ করেছেন শ্রমজীবী ভক্তেরা। ইনি নিরুপদ্রব দেবতা। ইনি ক্রোধী নন, বদমেজাজি নন। ইনি পুজো পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে বাঁশ নিয়ে দৌড়ে বেড়াননি। ইনাকে ভয় পেয়ে সাধারণ মানুষ তটস্থ হয়ে থাকেন না। ইনিও কার্তিক ঠাকুরের মতো ঘরের ছেলে। ভাদ্র মাসের ৩১ তারিখে ইনি পূজিত হন। আগের আষাঢ়-শ্রাবণ মাসটা তুমূল বর্যাকাল।এ সময় কোনো কার্য নির্মাণ করা যায় না। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে সমস্ত মানুষের হাতে প্রচুর টাকাপয়সা আসে, সেইসঙ্গে বৃষ্টি-বাদলার উৎপাতও নেই। অতএব নির্মাণশিল্পের স্রষ্টা তথা গুরু বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ো কর্মযজ্ঞে।
পূর্ব ভারতে সম্ভবত প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ওড়িশায়। জগন্নাথের মূর্তি তৈরির কারিগর ছিলেন বিশ্বকর্মা। পরবর্তী কালে মনসামঙ্গল কাব্যে লখিন্দরের লোহার বাসরঘরের কারিগরও এই দেবশিল্পীই। কিন্তু তাঁর রূপবর্ণনা কোথাও বলা হয়নি। বাংলার কারখানা আর দোকানে তিনি ঢুকলেন কবে? কী ভাবেই বা তিনি এমন সুপুরুষ হলেন?
সামাজিক ইতিহাসের গবেষক ও প্রবন্ধকার জহর সরকারের মতে, বাংলায় বিশ্বকর্মা পুজো উত্তর-ঔপনিবেশিক একটি ধারা। শিল্পভিত্তিক সমাজ কারিগরি উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে হিন্দুধর্ম থেকে বিশ্বকর্মাকেই বেছে নিয়েছিল। সেই কারণেই ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনে বিশ্বকর্মা পুজো হয়। এই সূত্র ধরেই সামাজিক ইতিহাসের এক গবেষক বলছেন, ‘‘নতুন দেবতারা সব সময়েই নিম্নবর্গের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পান। নিম্নবর্গীয় বাঙালি তাই নিজের কল্পনা মেনেই বিশ্বকর্মাকে যুবক হিসেবে বরণ করেছে।’’ জহরবাবুও বলছেন, তরুণ কারিগর, মিস্ত্রিদের জন্যই কার্তিকের মতো যুবক রূপ পেয়েছেন বিশ্বকর্মা।
তো এ হেন দেব-কারিগরের সঙ্গে ঘুড়ি কী ভাবে জুড়ল, তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, পশ্চিম ভারতে মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ে। এ রাজ্যেও কোথাও কোথাও মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে বাংলায় বর্ষা বিদায়ের অঙ্গ হিসেবে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব কোথাও যেন ভাদ্র শেষে শরতের আগমনের সূচনা হতে পারে। কাকতালীয় ভাবেই তা বিশ্বকর্মার সঙ্গে মিশে গিয়েছে।
ঔপনিবেশিক আমল থেকেই গঙ্গার দু’পারে চটকল এবং শিল্পতালুকগুলিতে বিশ্বকর্মা পুজোর রমরমা বেড়েছিল। সেই উৎসব কিন্তু ধর্মীয় আঙিনা ছেড়ে সামাজিক উৎসবে মিশে গিয়েছিল। ব্যারাকপুর, নৈহাটির বন্ধ হওয়া চটকলের বহু অহিন্দু শ্রমিক আজও মনে করতে পারেন, নববধূকে সাইকেলে চাপিয়ে কারখানায় ভোগ খেতে যাওয়ার কথা।
বাংলায় এসে আর রূপ বদলাননি বিশ্বকর্মা। তবে গত কয়েক দশকে ঠাঁই বদলে ফেলেছেন। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে ঠাঁই পাননি তিনি। তাই বিশ্বকর্মা এখন শুধুমাত্র কারখানা নয়, রিকশা স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড, টোটো স্ট্যান্ড এমনকি প্রোমোটিং শিল্পেও থিতু হয়েছেন।
বিশ্বের স্রষ্টার সম্মান আপাতত এঁদেরই হাতে।
(তথ্যসূত্র:
১- A History of Hinduism: The Past, Present, and Future, R Ramachandran, Sage Publications Pvt. Ltd (২০১৮)।
২- The holy puranas: Brahma, Padma, Vishnu, Shiva, Bhagabata, Narada (Vol I), Bibek Debroy, BR publishing corporation.
৩- Hindu Gods and Goddesses, Swami Harshananda, Advaita Ashrama (২০০২)।
৪- Hindu Gods & Goddesses, Stephen Knapp, Jaico Publishing House (২০১৩)।
৫- The Rigveda: The Oldest Literature of the Indians, Adolf Kaegi (1849-1923), Wentworth Press (২০১৬)।
৬- 7 Secrets from Hindu Calendar Art, Devdutt Pattanaik, Westland (২০০৯)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত