ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নিরস্ত্র মানুষ কে, বা বন্দি কে বা বন্দিদের ব্রিটিশদের দ্বারা হত্যার নির্মম ইতিহাস একটা-দুটো নয়, রয়েছে অজস্র। কিন্তু কয়টা ঘটনা আমরা সকলে জানি বা মনে রেখেছি?
তেমনই এক ঘটনা হল ‘হিজলী হত্যাকাণ্ড’ যা আজ হারিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
১৯৩১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর ঘটে ‘হিজলী হত্যাকাণ্ড’। ইংরেজদের গুলিতে প্রাণ হারান দুই বিপ্লবী। এক জন সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী ‘সন্তোষ মিত্র। অন্য জন, মাস্টারদা সূর্য সেনের সহকর্মী ‘তারকেশ্বর সেনগুপ্ত’।
এখন যেখানে ‘খড়্গপুর আইআইটি’র পুরনো ভবন, পরাধীন ভারতে সেখানেই ছিল হিজলী বন্দি নিবাস। অদূরে প্রথম মহিলা জেল। ১৬ই সেপ্টেম্বরের সেই রাতে হিজলী বন্দি নিবাসে ‘পাগলা ঘন্টা’ বাজিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায় ইংরেজ পুলিশ। খবর পেয়ে ‘সুভাষচন্দ্র’ ও ‘যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত’ হিজলীতে আসেন। হিজলী ও চট্টগ্রাম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ওই বছর ২৬শে সেপ্টেম্বর কলকাতায় এক সভা হয়। সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং ‘রবীন্দ্রনাথ’। হিজলী ‘শহীদ ভবনের’ পাশেই ‘শহীদচক’। প্রতি বছর ১৬ই সেপ্টেম্বর এখানেই ‘শহীদ দিবস’ পালিত হয়।
এবারে এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত জানার আগে, প্রথমে জেনে নেওয়া যাক হিজলী’র ইতিহাস।
কাশীদাসী মহাভারতের কথা। পঞ্চপান্ডব বনবাসে চলেছেন। গভীর জঙ্গল। মাতা কুন্তী বড় ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে চাইলেন। এদিকে ঘন জঙ্গলে থাকে নরখাদক রাক্ষস, রাক্ষসদের রাজা হিড়িম্ব আর তাঁর বোন হিড়িম্বা। সে ভয়ে পাণ্ডবরা তো আর দমে যাবার পাত্র নয়! কাজেই মহাবলী ভীম বললেন ‘‘আমি আছি তো! কোনো ভয় নেই।’’ পান্ডবরা জঙ্গলেই বিশ্রাম নিতে বসলেন, আর ভীম পাহারা দিতে লাগলেন। এদিকে নরখাদক হিড়িম্ব তো অল্হাদে আটখানা। সে চললো ভুরিভোজ সারতে। ভীম তো আর এতও সহজে তা হতে দেবেন না! তাই লেগে গেলো ভীম আর হিড়িম্বর যুদ্ধ। ভীম হিড়িম্বকে বধ করে দেহ রেখে এলেন খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরের সামনে। তারপর? ভীম ও হিড়িম্বার প্রেম এবং বিয়ে। সেই প্রেমকাহিনী আমরা মোটামুটি সবাই জানি। তাঁদের সেই গান্ধর্বমতে বিয়েটাও হয়েছিল খড়গেশ্বর মন্দিরে। পঞ্চপান্ডব বেশকিছুদিন ছিলেন এই মন্দিরের পাশে। জঙ্গলের মধ্যে একটা পুরনো মন্দির। সেই মন্দিরকে কেন্দ্র করে তারপর গড়ে উঠলো ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের নাম? ‘খড়্গপুর’!
আই আই টি ক্যাম্পাস থেকে ৫ কিমি উত্তরে ‘ইন্দা বাজার’ রয়েছে। সেখানে আজও খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরটি রয়ে গেছে। প্রাচীন এবং ভগ্নপ্রায় মন্দিরটি কিছুদিন আগে সংস্কার করা হয়েছে।
‘শ্রী শ্যামাপদ ভৌমিক’ তাঁর ‘ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ (প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, ২০০৯) বইতে লিখেছেন, ‘বিষ্ণুপুরের রাজা খড়গমল্ল’ ৮৪১ সালে এই মন্দিরটি বানিয়েছিলেন। তাই মন্দিরের নাম ‘খড়গেশ্বর’। এদিকে সেই সময় বাংলায় পাল বংশের রাজত্বকাল চলছে। অন্য কোনো রাজা নিজের নামে মন্দির বানিয়ে যাবে এটা পরাক্রমী পাল রাজা ‘দেবপাল’ (৮১০-৮৫০ সাল) মেনে নেবার পাত্র ছিলেন না। তাই অনেক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন ‘খড়গসিং পাল’ নামে দেবপালের কোনো রাজকর্মচারী মন্দিরটি বানিয়েছিলেন।
মহাভারতের সমসাময়িক আরো একটি মন্দির রয়েছে ইন্দাতেই। সেটি ‘হিড়িম্বেশ্বরী কালীমন্দির’। ‘রাক্ষসী হিড়িম্বা’ নাকি এখানেই রোজ কালীর পুজো করতে আসতেন।
মহাভারতের রূপকথা তো কাশীরাম দাস নিজের মতন করে লিখেছিলেন ষোড়শ শতকে। সত্যিকারের ইতিহাস অনেকটাই তা থেকে ধারনা করা যায়। জঙ্গলের মধ্যে আদিবাসীদের বাস। জায়গাটা সাঁওতাল পরগনার সীমান্তবর্তি এলাকা। এই শিকারজীবী আদিবাসীরাই অনার্য বা রাক্ষস বলে গণ্য হত আর্যদের কাছে। আর একটা ব্যাপারও বলা উচিত, কালী ছিলেন অনার্যদের দেবী। তাই তো তিনি কালী কালিকাময়ী হৃতসর্বস্বা নগ্নিকা। শিবও অনার্য সমাজে পূজিত ছিলেন। তা সেই প্রাচীন কালীমন্দির ও শিবমন্দিরের কথা নিশ্চয়ই মহাভারতের কথক জানতেন। কাজেই কিংবদন্তিতে সেই জঙ্গল আর আদিবাসীদের মন্দির ঘিরেই আদিবাসীদের গ্রাম রাক্ষসরাজ হিড়িম্বর রাজত্ব হয়ে উঠেছিলো। আর এভাবেই ইতিহাসের পাতায় উঠে এলো প্রাচীন খড়্গপুর।
এই মন্দিরগুলো পরে সংস্কার করা হয়েছে। আদি মন্দিরগুলোর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। কেন যায়না, তারও একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের নাম ‘কালাপাহাড়’। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে একটু আধটু পরিচিত, তাঁরা সকলেই কালাপাহাড়ের ধ্বংসযজ্ঞের সাথে পরিচিত। যাইহোক, এই কালাপাহাড় ভেঙেছিলেন খড়্গপুরের প্রাচীনতম মন্দিরদুটি।
এবার মহাভারতের সময় থেকে আমরা এগিয়ে আসি আরো পরবর্তী সময়ে।
খ্রিস্টীয় ১৭ শতক। আদিবাসীদের গ্রাম থেকে খড়গপুর ততদিনে বর্ধিষ্ণু গ্রাম। খড়গপুর তখন আর বাংলার অংশ নয়। উড়িষ্যার ‘বালেশ্বর’, ‘দাঁতন’, মেদিনীপুরের ‘কাঁথি’, ‘তমলুক’, ‘পাঁশকুড়া’, ‘হলদিয়া’ এই সমস্ত জায়গা নিয়ে একটি নতুন সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল সেই সময়। সাম্রাজ্যের নাম? ‘হিজলী’।
‘তাম্রলিপ্ত বন্দর’ তখন মৃতপ্রায়। বর্তমানের আই আই টি ক্যাম্পাস থেকে প্রেমবাজার গেট দিয়ে সোজা ৬-৭ কিমি গেলে ‘কেলেঘাই নদী’র দেখা পাওয়া যাবে। আজ দেখলে মনে হয় একটা সরু নালা। অথচ সেসময় এ নদীরই ছিল ভরা যৌবন। বড় বড় নৌকো যেত নদীতে। কেলেঘাই থেকে কাঁথির দিকে গেলে পড়বে ‘রসুলপুর নদী’। সপ্তদশ শতকে সেই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল নতুন বন্দর।
অনেকে বলেন ‘আকবরের সেনাপতি রাজা মান সিংহ’ এই বন্দর তৈরি করেছিলেন। কেউ বলেন এই মান সিংহ ছিলেন অন্য কেউ। চারিদিকে হিজলের জঙ্গল ছিল বলে জায়গার নাম হয়েছিল হিজলী। এখান থেকে নদীপথে যাওয়া যেত নানা জায়গায়। কলকাতা শহরের জন্ম হয়নি তখনও। কেলেঘাই আর হলদি নদীর সাথে খাল টেনে জোড়া হয়েছিল হিজলী বন্দরকে। ১৬২৮ সালে সেই বন্দরকে ঘিরে তৈরি হয় ‘হিজলী সাম্রাজ্য’। এর আগে ‘উড়িষ্যার গজপতি রাজারা’ই রাজত্ব চালাতেন এখানে। বন্দর থাকায় বাণিজ্যে এই জায়গাটা দ্রুত উন্নত হতে থাকল। বাণিজ্যের সাথে এলো অর্থনৈতিক জৌলুষ। কাজেই অন্য রাজারা আক্রমণ হানল হিজলীতে। তাজ খান নামে এক মুসলিম সুলতান জয় করলেন হিজলী। একসময় দিল্লির মসনদে বসলেন মুঘল বাদশাহ ‘শাহজাহান’। তিনি-ই বা ছাড়বেন কেন এরকম বাণিজ্য-বন্দরকে? আবার যুদ্ধ। এবং হিজলী হয়ে গেল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। কিন্তু এতবার রাজা বদল হলেও, হিজলী বন্দরের গুরুত্ব বা গরিমা কোনটাই ম্লান হল না।
১৬৮৭ সাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন হানা দিয়েছে ভারতে। তাদের চাই নতুন বন্দর যেখানে তারাই শুধু একচেটিয়া বাণিজ্য করতে পারবে। ‘ক্যাপ্টেন নিকলসন’ প্রথম চেষ্টা করেন হিজলী বন্দর দখল করার। তারপর তিনি রণে ভঙ্গ দিলে, আর এক তরুণ ইংরেজ সাহেব মাত্র ৪০০ জন সেপাই নিয়ে দখল করতে পারলেন হিজলী বন্দর। তৎকালীন মুঘল সম্রাট ‘আওরঙ্গজেব’ কিছুদিনের মধ্যেই প্রচুর সেনা নিয়ে তাড়া করলেন সেই সাহেবকে। সাহেবের সেনাবাহিনী একেবারে ধরাশায়ী হয়ে গেল সেই আক্রমণে। সাহেব তো প্রাণ হাতে পালিয়ে গেলেন রূপনারায়ণ নদীর ওপারে ‘উলুবেড়িয়া’ নামে একটা গ্রামে। হিজলী আবার ফিরে এলো মুঘলদের হাতে।
এদিকে সেই সাহেব? তিনি আরও পূর্বে হুগলী নদীর তীরে চলে গেলেন। সেখানে কিনলেন তিনটি গ্রাম, ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ আর ‘কলিকাতা’। ১৬৯৮ সালে, নতুন বন্দর তৈরি করলেন সেই সাহেব। হ্যাঁ, তাঁর নাম, ‘জব চার্নক’!
তারপর একসময় ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ থাবা বসাল গোটা ভারতবর্ষে। বাদ গেল না হিজলীও। ১৭৫৪ সালে হিজলি এলো ইংরেজদের হাতে। মাঝখানে ‘পর্তুগিজ উপনিবেশ’ হিসেবেও কিছুদিন থাকতে হয়েছিল হিজলীকে। ইংরেজরা হিজলী বন্দরটির ঠিক পাশেই তৈরি করে আরও একটি বন্দর, তার নাম ‘খেজুরি’।
খেজুরি থেকে লন্ডনে যাবার জাহাজ ছাড়ত একসময়। ‘রাজা রামমোহন রায়’ এই খেজুরি বন্দর থেকেই জাহাজে উঠেছিলেন ১৮২৯ সালে। ১৮৫২ সালে ‘ভারতবর্ষের প্রথম টেলিগ্রাফ অফিস’ তৈরি হয় খেজুরি আর কলকাতায়। ‘প্রথম তারবার্তা’ যায় খেজুরি থেকে কলকাতার জিপিও। ১৮৬৪ সালে এক ভয়াবহ সাইক্লোনে ধংস হয়ে গেল এই বন্দরগুলি।
তারপর হিজলীর ইতিহাসের ঔজ্জ্বল্য এখানেই শেষ।
১৮৯৯ সালে তৈরি হল ‘খড়্গপুর রেল-স্টেশন’। দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিম ভারতের সাথে যোগাযোগের উল্লেখযোগ্য জংশন হিসেবে খড়্গপুর আস্তে আস্তে হয়ে উঠতে থাকল একটি ‘রেলশহর’।
বিংশ শতকের শুরু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজেছে সারা পৃথিবীজুড়ে। কলকাতায় ইংরেজদের ঘাঁটিতে আক্রমণ হতে পারে যে কোনোও মুহূর্তে। যুদ্ধের কৌশল ইংরেজরা ভালই বোঝে। কাজেই কলকাতায় সমস্ত সামরিক শক্তি ব্যয় করলে আখেরে ক্ষতি হবে। কারণ খুব সহজ। শত্রুপক্ষ কলকাতায় আক্রমণ করে একবার সবকিছু ধ্বংস করে দিলেই তো সব শেষ। কাজেই কলকাতার আশেপাশে কোথাও সরাতে হবে সামরিক শক্তি। নজর পড়ল খড়্গপুরের দিকে। ‘শালুয়া’ এবং ‘কলাইকুন্দা’য় বানানো হল সেনা ছাউনি। এত সামরিক বাহিনী, তাদের সরঞ্জাম আনার জন্য চাই অনেক ট্রেন। কিন্তু অত ট্রেন চালানোর বাড়তি খরচ কমানো চাই। কাজেই তৈরি হল ‘দীর্ঘতম রেল প্ল্যাটফর্ম’। লম্বা ট্রেন বোঝাই সামরিক বাহিনী আর তাঁদের রসদ পৌঁছতে পারা গেলো একবারেই। এরপর যুদ্ধবিমানগুলোর ঘাঁটি হিসেবেও পরবর্তীকালে গড়ে তোলা হল জায়গাগুলিকে।
যুদ্ধ শেষ। এত পরিকাঠামোকে অন্য কিভাবে কাজে লাগানো যায়? ১৯৩০ সালে ইংরেজরা বানাল ‘হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প’।
অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংখ্যা এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ব্রিটিশ সরকার তাঁদের সাধারণ জেলে স্থান দিতে অসমর্থ হয়। তাই সরকার কয়েকটি নতুন ডিটেনশন ক্যাম্প গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম ক্যাম্পটি স্থাপিত হয় ‘বক্সা দূর্গে’। ১৯৩০ সালে ‘হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প’ স্থাপিত হয়। ১৯৩৭ সালে এই ক্যাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ১৯৪০ সালে আবার চালু করা হয়। ১৯৪২ সালে শেষ বারের মতো ক্যাম্পটি বন্ধ হয় যায় এবং বন্দীদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী এই ক্যাম্পটি ব্যবহার করেছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে হিজলি ডিটেনশন ক্যাম্প প্রাঙ্গনেই ‘আইআইটি খড়্গপুর’ স্থাপিত হয়। ১৯৯০ সালে পূর্বতন ডিটেনশন ক্যাম্পের কিছু অংশ নিয়ে চালু হয় ‘নেহেরু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংগ্রহশালা’।
১৯৩১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর এই ডিটেনশন ক্যাম্পে ঘটে এক নারকীয় নিধনযজ্ঞ। সেদিন এই বন্দিশালায় নির্বিচারে গুলি করে মারা হয়েছিল অনেক ভারতীয় নারী-পুরুষকে, যাঁদের অপরাধ ছিল স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখা। বিপ্লবী ‘তারকেশ্বর সেনগুপ্ত’ ও ‘সন্তোষ মিত্র’ ছিলেন তাঁদের মধ্যে। সারা দেশ গর্জে উঠেছিল রাগে, ঘেন্নায়। ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’ মিছিল করে এসে নিয়ে গিয়েছিলেন শহীদদের মরদেহ। ‘মহাত্মা গান্ধী’ সহ বহু নেতা পরবর্তীকালে এখানে প্রতিবাদ জানাতে আসেন।
এবারে জানা যাক কে ছিলেন বিপ্লবী ‘সন্তোষ মিত্র’ এবং ‘তারকেশ্বর সেনগুপ্ত’।
উত্তর কলকাতার এক কায়স্থ পরিবারে ‘সন্তোষ মিত্র’ জন্ম নেন ১৯০১ সালের ১৫ই আগস্ট। হিন্দু স্কুল এবং প্রেসিডেন্সি তে পড়াশুনা করেন। প্রেসিডেন্সি তে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ‘সুভাষচন্দ্র বসু’। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু। মূলত অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেও, ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর বারীন ঘোষের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। সেই সুবাদে ১৯২৩ সালে দ্বিতীয় আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়। বিখ্যাত আইনজীবী ‘যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত’ তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন। এরপরেও তাঁর আন্দোলন চলতে থাকে। ফের গ্রেফতার হন ১৯৩০ সালে। সেই সময় বিভিন্ন জেলে কয়েদিদের চাপ এত বেড়ে গেছিল যে কয়েকটি কারাগার তৈরি করতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। হিজলীতেও তৈরী হয় একটি কারাগার। সেখানেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ওদিকে ‘তারকেশ্বর সেনগুপ্ত’ ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকারী ও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অন্যতম কর্মী। তিনি ‘সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য’ ছিলেন।
‘তারকেশ্বর সেনগুপ্ত’ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের, বরিশাল জেলার গাইলা গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ‘হরিচরণ সেনগুপ্ত’। তাঁর পারিবারিক পরিবেশে দেশপ্রেমের ধারণা নিয়ে তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলেন। ১৯২৪ সালে গৈলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও ১৯২৬ খ্রি. বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আই.এ. পরীক্ষা দেন কিন্তু অকৃতকার্য হন।
তারকেশ্বর সেনগুপ্ত ছিলেন একজন বিপ্লবী সমাজকর্মী। তিনি ‘গৈলা শাখার যুগান্তর গ্রুপের’ সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৫ সালে তিনি ‘শঙ্কর মঠ’ এবং ‘গৈলা সেবাশ্রমের’ সাথে যুক্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেফতার হন এবং কয়েক মাসের জন্য কারাবাস ভোগ করেন। তিনি ‘লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে’ যোগ দেন এবং আবার ‘ডি.আই শাসনে’ গ্রেফতার হন। তাঁকে হিজলী কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৩১ সালের ২৭শে জুলাই কোর্টরুম চত্বরে খুন হন অলিন্দ যুদ্ধের নায়ক দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসির আদেশ শোনানো ‘বিচারক গ্যালিক’। পুলিশ আততায়ী কে ধরতে গেলে সে সেখানেই আত্মহত্যা করে। তাঁর পকেট থেকে ‘বিনয় গুপ্ত’ নাম লেখা চিরকুট পাওয়া যায়। যদিও সেটা তাঁর আসল নাম তা ছিল না। এই ঘটনায় স্বভাবতই খুশির হওয়া ছড়িয়ে পরে হিজলি জেলের কয়েদিদের মধ্যে। এই খবরে পেয়ে ক্ষিপ্ত প্রশাসন ১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৩১ সালে হিজলি জেলে কয়েদিদের উপর গুলি চালাতে শুরু করে। যদিও কেউ কেউ বলেন প্রশাসন কে ঠুঁটো বানিয়ে ওই কাজ করেছিলেন স্থানীয় ইউরোপিয়ান ক্লাবের কয়েকজন সদস্য। জেলে ‘পাগলা ঘন্টা’ বাজানো হয়েছিল। কি ঘটছে সেটা দেখতে সেলের বাইরে আসেন ‘সন্তোষ মিত্র’ এবং বরিশালের ‘তারকেশ্বর সেনগুপ্ত’। বুলেট বিদ্ধ হন তাঁরা। সেখানেই মারা যান।
‘হিজলি গুলিচালনার ঘটনা’ নামে পরিচিত এই ঘটনাটিই ভারতের কোনো জেল বা ডিটেনশন ক্যাম্পে গুলিচালনার একমাত্র ঘটনা।
এই ঘটনায় গর্জে উঠেছিলেন ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।
২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৩১ সালে, মনুমেন্ট এর নিচের সমাবেশ থেকে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান তিনি।
হিজলী জেলে বন্দীদের উপর কারারক্ষীদের গুলি চালনার ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং কবিতাও লিখেছিলেন,
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু,
নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ,
তুমি কি বেসেছো ভালো।” (প্রশ্ন)
অনেকে বলেন হিজলী জেলে এই ঘটনার পর ‘গান্ধী’জি দেশবাসীর কাছে আবেদন করেছিলেন যে, অপরাধীদের যেন ক্ষমা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’ কবিতার প্রথম স্তবক হল,
“ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে
তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালোবাসো – অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’।
বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
আজই দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।’’
পংক্তিগুলো পাঠ করলে সম্ভাবনাটি সত্য বলেই মনে হয়। ভগবানের দূত বলে হয়তো গান্ধীজির ক্ষমা করার নির্দেশকেই ইঙ্গিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবিতাটিতে গান্ধীজির নাম তো নেই-ই, হিজলী জেল, ব্রিটিশ প্রশাসন, গুলিবর্ষণ ইত্যাদি কোনো কিছুরই উল্লেখ নেই। কবিতায় সমকালের ঘটনার প্রত্যক্ষ উল্লেখ করা রবীন্দ্রনাথের একেবারেই মনোমতো ছিল না।
২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯৩১ সালে, এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ‘সেন্ট জেমস স্কোয়ার’ এর নাম বদলে ‘সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার’ রাখে ‘কলকাতা কর্পোরেশন’।
১৯৯০ সালে কুখ্যাত হিজলি ক্যাম্প এর এক অংশে তৈরী হয় ‘নেহেরু মিউজিয়াম অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি’। যেখানে বসানো হয় এই দুই বিপ্লবীর নামের ফলক। শুধু তাই নয় আই আই টি খড়্গপুর ক্যাম্পাসে একটি রাস্তাও রয়েছে সন্তোষ মিত্রের নামে।
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে তখন দরকার নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রস্তাব আসে জমি দেবার। ‘ডঃ বিধানচন্দ্র রায়’ এই বন্দী শিবিরকেই ভারতের শ্রেষ্ঠ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে। তাই আজও আইআইটি খড়্গপুরের সঙ্গে জুড়ে আছে তাঁর সেই ঐতিহাসিক উক্তি,
“এইখানে হিজলী বন্দীশিবির দাঁড়িয়ে রয়েছে এক স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে, যা আজকের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আগামীদিনের পথে। এই ছবি ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের প্রতীক হয়ে উঠুক …”
বর্তমানে দুর্গাপূজায় যাঁরা কলকাতায় ঠাকুর দেখতে যান, তাঁরা ‘সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার’ নামটির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু কে ছিলেন এই ‘সন্তোষ মিত্র’ তাঁর খোঁজ রাখেন কি? ‘খড়্গপুর আই আই টি’-এর নাম অনেকেই শুনেছেন ও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে চাক্ষুষ করেছেন, বা অনেকে সেখানে হয়ত শিক্ষা নিয়েওছেন। কিন্তু এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুরাতন ভবনের ইতিহাস কয়জন জানেন বা মনে রেখেছেন?
(তথ্যসূত্র:
১- ইতিহাস ও সংস্কৃতি, শ্রী শ্যামাপদ ভৌমিক, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, (২০০৯)।
২- মেদিনীপুরের ইতিহাস, কমল চৌধুরী সম্পাদিত, দে’জ পাবলিশার্স (২০১১)।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১১ সাল।
৪- সংগ্রামী জাতীয়তাবাদ: মেদিনীপুর ও মানভূম (১৯০০-১৯৪৭), ড. শ্যামাপ্রসাদ বসু, দে’জ পাবলিশিং।
৫- মেদিনীপুর: ইতিহাস ও সংস্কৃতির বিবর্তন, প্রণব রায়, সাহিত্যলোক (২০১১)।
৬- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত