তাঁর সাহিত্যিক জীবনের একেবারে প্রথমদিকে কলকাতার মনোহরপুকুর লেনের ছোট্ট একটা টিনের ঘরে একা থাকতেন তারাশঙ্কর। ভোরবেলা উঠে দূরের টাইমকল থেকে জল এনে রাখতে হত। পাইস হোটেলে দু’বেলা খাওয়া সারতেন। তাঁর ঘরের কাজ করে দেওয়ার জন্য জুটে গিয়েছিল এক বিনি মাইনের চাকর। নাম ছিল তাঁর ‘ষষ্ঠীচরণ’। তাঁর আবার বাবুর প্রতি খুব মায়া ছিল। মাঝেমাঝে তারাশঙ্করকে সে বোঝাত, ‘‘বাবু এইসব লেখালেখি না করে একটা চাকরিবাকরি করুন।’’ শুনে মিটিমিটি হাসতেন তারাশঙ্কর। তাঁকে বলতেন, ‘‘আমি তো এ ছাড়া আর কিছু পারি না রে, ভালও লাগে না।’’ ষষ্ঠীচরণ মুখে এই কথা বললেও তাঁর আবার বাবুর লেখা গল্প শোনার খুব সাধ ছিল। এই ষষ্ঠীচরণ ছিলেন তারাশঙ্করের বহু গল্পের প্রথম শ্রোতা। শুধু তাই নয়, গল্প শোনার পর ষষ্ঠী যা মতামত দিতেন তা মন দিয়ে শুনতেন তারাশঙ্কর। এক বার তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাংলার অতি সাধারণ মানুষদের আমরা আধুনিক লেখক-শ্রেণি যে নির্বোধ বা রসবোধহীন মনে করি, এর চেয়ে ভুল আর কিছু হয় না। যাঁরা রামায়ণ মহাভারত বুঝতে পারে, কৃত্তিবাসী কাশীরামদাসীই শুধু নয়, গদ্য-অনুবাদ – যেগুলির ভাষায় ছাঁকা সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য এবং ভাগবতের কথকতা যারা বুঝতে পারে, তাঁরা একালের লেখাগুলি বুঝতে পারবে না কেন? দেশের ভাষায় লেখা বিষয় যদি দেশের মানুষই না বুঝতে পারে, তবে সে কেমন লেখা?’’
চিরকাল স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করেছিলেন তারাশঙ্কর। নিজের অবস্থাকে আড়াল করেননি কোনও দিন। যখন তাঁর বড় ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তখন তারাশঙ্করের মনে হয়েছিল, ভাবী বেয়াইকে নিজের অবস্থাটা পরিষ্কার করে জানানো উচিত। তাই ভাবী বেয়াইকে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আপনাদের অর্থনৈতিক অবস্থা হইতে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা-অসমৃদ্ধ। সেই হিসাবে আমি নিজ হইতেই আপনাকে সর্বাগ্রে সকল কথা খুলিয়াই জানাইতে চাই। আমার পূর্ব পুরুষেরা জমিদার ছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি তাহার যাহা পাইয়াছি, তাহার বার্ষিক মুনাফা, আমার অংশে-আন্দাজ ১০০০/ ১২০০ টাকা। চাষের জমি-আমার অংশে ৭৫/৮০ বিঘা। বাগান পুকুর যাহা আছে, তাহা আপনি অবশ্যই জানেন যে-কেবল পল্লীতে ভোগের সামগ্রী, কোনও আর্থিক আয় তাহা হইতে হয় না। বর্তমানে জমিদারির অবস্থাও জানেন। আমার কর্ম্মজীবনে আমি সাহিত্যিক। … বর্তমানে আমার আয় ৩০০/৪০০ টাকা মাসিক, ইহার অধিক নয়। তবে ইহার একটা স্থায়িত্ব আছে বলিয়া আমি মনে করি। কারণ আমার বইগুলির সংস্করণ দ্রুত শেষ হইতেছে …। কথাগুলি আমার পক্ষে লেখা উচিত নয়। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে না লিখিয়া উপায় নাই বলিয়াই লিখিতেছি।’’
খুব জেদি ছিলেন তারাশঙ্কর। তাঁর এমনই জেদের প্রমাণ পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একবার বড় মাপের একটি পুরস্কার পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর। তরুণ সুনীল গিয়েছিলেন তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে। কথায় কথায় তারাশঙ্কর বলে উঠেছিলেন, ‘‘আমার জেদ চিরকালই বড্ড বেশি। এই দেখো না জেদের বশে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর ধরে সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস একদিনে ছেড়ে দিলুম।’’ তাই শুনে সুনীল অবাক হয়েছিলেন। কারণ সিগারেটের নেশা ছাড়া যে কী কঠিন, সেটা নেশাড়ু মাত্রই জানেন। কৌতূহলী সুনীল জিজ্ঞাসাই করে ফেলেছিলেন, ‘‘এত কঠিন কাজ একদিনে করলেন কী করে?’’ কোনও কথা না বলে বাঁ-হাতখানা উঁচু করে তাঁকে দেখিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। সুনীল শিউরে উঠে লক্ষ করেছিলেন বাঁ হাতের কবজি থেকে শুরু করে তালু পর্যন্ত অনেকগুলো গোল গোল পোড়া-ছ্যাঁকা দাগ। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘ও কী? এটা কী?’’ তারাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘কিছু না। সিগারেট ছাড়ার পর ও জিনিস আবার খেতে লোভ হলেই সিগারেট ধরিয়ে নিজের হাতে ছ্যাঁকা দিয়েছি। তাই এখন আর লোভ হয় না।’’
শুধুমাত্র জেদ নয়। তাঁর ধৈর্য্যও ছিল চমকে দেবার মতন। ধৈর্য্য না থাকলে সাহিত্য সাধনা করা মুশকিল। জানা যায়, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় গণদেবতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হওয়ার পর বই হওয়ার কাজ চলছিল। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার লেখা। সবে আশি পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছিল। প্রকাশককে একদিন ডেকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘ছাপানো থামাও। লেখাতে খামতি আছে। আবার নতুন করে লিখতে হবে।’’ বাকি পুরো ন’শো পৃষ্ঠা আবার নতুন করে লিখেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলা কথা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৯৮ সালের ২৩শে জুলাই পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিশীল জীবনের সমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর কলকাতা শহরে। তারাশঙ্কর তাঁর বিশাল সাহিত্য ভান্ডারের মধ্য থেকে অন্ততঃ ১০টি উপন্যাস এবং বেশ কিছু অনন্য সাধারণ ছোট গল্পের জন্য স্বকালের সীমা ছাড়িয়ে উত্তরকালের অগণিত পাঠককে স্পন্দিত করতে সমর্থ হয়েছেন। এ অর্থেই তিনি বাংলার চিরায়ত কথা সাহিত্যের কালজয়ী শিল্প প্রতিভা। বিলীয়মান সামন্ত সমাজের এ ক্ষুদ্র জমিদার পরিবারে তারাশঙ্করের জন্ম। তাঁর পিতার নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। তাঁর পিতা ‘হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়’ ও বৈমাত্রেয় পিসি ‘শৈলজা ঠাকুরাণী’ ছিলেন তারাশঙ্করের ভাষায় ‘সেকালের প্রতিনিধি’। পক্ষান্তরে মা ‘প্রভাবতী দেবী’ ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের সমর্থক এ বিদুষী মহিলা। এক দিকে ধর্মশাস্ত্রের অবাধ অনুশীলন এবং অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে তারাশঙ্করের মানস গঠিত হয়েছিল।
প্রভাবতীর বাস্তব দেশপ্রেম শৈশবেই তারাশঙ্করকে উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর (৩০শে আশ্বিন) যেদিন বঙ্গভঙ্গ আইন কার্যকরী হয় সেদিনই তিনি ৭ বছরের শিশু পুত্রের হাতে রাখি বেঁধে দিয়েছিলেন। পিতার রাজদ্রোহী মনোভাব, মা-এর দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক গ্রুপের সঙ্গে মাতৃকুলের সংশ্রব কৈশোরেই তাঁর মধ্যে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। বিপ্লবী রাজনৈতিক গ্রুপের সঙ্গে স্বল্পস্থায়ী সংযোগও ঘটে তাঁর। এর পর ১৯২১ সালে গান্ধী আহূত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় থেকেই তিনি শর্তহীন গান্ধীপন্থী এবং রাজনীতির পরিভাষায় কংগ্রেসম্যান। দলীয় রাজনীতির সঙ্গে তারাশঙ্করের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি গ্রেফতার হন। তারাশঙ্করকে বিচারের জন্য সিউড়ি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারে তাঁর কারাদন্ড হয়। ‘সি ক্লাস’ বন্দীরূপে তিনি কয়েকমাস জেল খাটেন। কারাগারেই তাঁর সাহিত্য চর্চার প্রকাশ ঘটে। এখানেই তিনি লেখা শুরু করেন ‘পাষাণপুরী’ আর ‘চৈতালী ঘূর্ণি’। বাংলার কংগ্রেস রাজনীতির উপদলীয় কোন্দল ও সংঘাতের কারণে রাজনীতির প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। কারামুক্তির দিনেই তারাশঙ্কর প্রতিজ্ঞা করেন যে, সাহিত্য সাধনার মাধ্যমেই তিনি দেশ সেবা করবেন। তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজনীতির সঙ্গে সংশ্রব রক্ষা করেন। ১৯২৯ সাল থেকে ৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর কালজয়ী উপন্যাসগুলো রচনা করেন। তাঁর উপন্যাসের প্রধান গুণ মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি ও জীবন জিজ্ঞাসার গভীরতা। বিশ শতকের শিল্পী হয়েও তারাশঙ্কর ঐতিহ্য অনুসরণ থেকে দূরে সরে যান। আধুনিক হওয়ার গলদঘর্ম প্রচেষ্টা তাঁর ছিল না। উচ্চকণ্ঠে স্বতন্ত্র ঘোষণা বা রুগ্ন মানসিকতা কিংবা কারু-সর্বস্বতা থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রেখেছিলেন। তবু বর্তমান যুগের তরঙ্গ সঙ্কুলতা তিনি উপলব্ধি না করে পারেন নাই। সমাজের ও জীবনের সর্বস্তরের ক্ষয়িষ্ণুতা তাঁর কাছে গভীর বেদনার বাণী বহন করে এনেছিল। সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের পর্বে পর্বে তিনি সেই বেদনার সমাধান প্রত্যাশা করেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়। এর পর ক্রমান্বয়ে তিনি রচনা করেন ‘ধাত্রীদেবতা’ (১৯৩৯), ‘কালিন্দী’ (১৯৩৯), ‘গণদেবতা’ (১৯৪৩), ‘পঞ্চগ্রাম’ (১৯৪৪), ‘মন্বন্তর’ (১৯৪৪), ‘সন্দীপন পাঠশালা’ (১৯৪৬), ‘ঝড় ও ঝরাপাতা’ (১৯৪৬), আর ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৪৬-৪৭) যেখানে সমাজ ও রাজনীতি পরস্পরিত হয়ে রাঢ় বাংলার জীবন ও সংস্কৃতি এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের শিল্পসাক্ষ্য নির্মিত হয়। অন্যদিকে রচিত হল ‘রায় কমল’ (১৯৩৫) ও ‘কবি’র (১৯৪২) মত রাজনীতি নিরপেক্ষ কালজয়ী উপন্যাস।
‘চৈতালী ঘূর্ণি’ এই উপন্যাসে গ্রামের দরিদ্র চাষী গোষ্ঠী আর তাঁর স্ত্রী দামিনী গ্রাম্য শোষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য শহরে আসে। গোষ্ঠ কারখানায় চাকরি পায়। স্বামী-স্ত্রী বস্তিতে থাকে। গোষ্ঠ মজুরদের ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করে, যার সঙ্গে নিম্ন-মধ্যবিত্ত কর্মীরাও জড়িত ছিল। তারাশঙ্কর বাংলা কথা সাহিত্যে নতুন বক্তব্য নিয়ে আসেন।
‘ধাত্রী দেবতা’, এ উপন্যস রচনা করে তারাশঙ্কর ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ইতিহাসকে শিল্পের মহিমা দান করেন। আইন অমান্য আন্দোলনকালে নিজের কারাবরণকে শিবনাথের আত্মকথায় ধাত্রীদেবতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘কালিন্দী’, রায়হাট গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কালিন্দী নদীতে (ব্রাহ্মণী স্থানীয় নাম) জেগে ওঠা নতুন চরের মালিকানা স্বত্ব নিয়ে দুই জমিদার পরিবারের অন্তর্কলহকে কেন্দ্র করে তার কালিন্দী উপন্যাস রচিত হয়েছে। সাঁওতালদের অকৃপণ শ্রমে কালিন্দীর চর যখন ‘স্বর্ণ প্রসবিনী’ তখন এ চরটির মালিকানা স্বত্বের দাবি প্রতিষ্ঠায় রায় বংশ ও চক্রবর্তী বংশের মধ্যকার ঐতিহ্যিক দ্বনদ্ব নবরূপে বিকশিত হলো। কিন্তু তৃতীয় এক পক্ষের আগমনে স্বশ্রেণীর মধ্যকার ঐতিহ্যিক অন্তর্কলহ এক যাদুকরী আপস রফায় মিটল বটে- কিন্তু চরকে নিয়ে দ্বনদ্ব-মাত্রা ও গুণ উভয় দিক থেকেই লাভ করল ভিন্ন তাৎপর্য। প্রাক-ধনতান্ত্রিক যুগের প্রতিভু যন্ত্রকলের মালিক ও অর্থশক্তিতে করায়ত্ব করে নিলেন সাঁওতাল সম্প্রদায়কে। কালিন্দীর চরে স্থাপিত হলো নতুন যুগের যন্ত্রকল। কৃষিজীবী সাঁওতালরা পরিণত হলো শ্রমদাসে। স্বর্ণপ্রসবিনী কালিন্দীর চর বিমলবাবুর কুক্ষিগত হলো। উপন্যাসের শুরুতে যে দ্বনদ্ব ছিল সামন্ত সমাজের অভ্যন্তরীণ কলহের মধ্য সীমাবদ্ধ, মধ্য পর্যায়ে তা দুই অর্থনৈতিক শ্রেণীর পরস্পর সংঘাতে রূপ নিল। আর উপান্তে-তারাশঙ্কর প্রতিষ্ঠা করলেন অমোঘ সমাজসত্য। এ পর্যায়ে লক্ষ্য করি কালিন্দীর চরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রাক-ধনিক যুগের প্রতিভু বিমলবাবুর যন্ত্রপুরী। উচ্ছেদকৃত সাঁওতালরা বাধ্য হয়েই প্রত্যাবর্তন করে তাদের অতীত যাযাবর জীবনে। তবে সমাজপতির এই ধারাক্রমকে একটি ইঙ্গিতময় তাৎপর্যে প্রতিষ্ঠা প্রয়াসী হয়েছেন ঔপন্যাসিক।
‘গণদেবতা’, পঞ্চগ্রাম উপন্যাসে দ্বারক চৌধুরীর ট্রাজিক পরিণতিতে কিংবা হিরু পালের শ্রীহরি ঘোষরূপে অবিশ্বাস্য গোত্রান্তরে তারাশঙ্কর এ সত্যই প্রকাশ করেছেন। সংগৃহীত অগাধ বিত্ত এবং সে সূত্রে অর্জিত অমিত প্রতাপই বর্ণগত শ্রেণীভেদের মূলে আঘাত হানতে হিরু পালকে প্ররোচিত করেছে। তারাশঙ্কর বোঝাতে চেয়েছেন অবক্ষয়- উন্মুখ সমাজে যে নবপ্রেরণা ক্রমশঃ সঞ্চারিত হচ্ছে, তার নিয়ামক অর্থ বা বিত্ত। সামন্ত-সমাজের রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় অর্থ ও অর্থনীতির ভূমিকা এভাবেই গণদেবতা- পঞ্চগ্রামে শিল্পের অবয়ব সন্ধান করেছে।
‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’য় তারাশঙ্কর কৌমসমাজের গোষ্ঠীজীবনকে বিষয়ভুক্ত করেছেন। উপন্যাসটিতে রয়েছে সমান্তরাল দু’টি কাহিনী স্রোত। একটি – বাঁশবাঁদি গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কোপাই নদীর বিখ্যাত হাঁসুলী বাঁকের কাহার সম্প্রদায়ের জীবন সংহতির অনিবার্য ভাঙন, কৃষি নির্ভর জীবনের ক্রমাবসান এবং বাঁশবন – ঘেরা উপকথার হাঁসুলী বাঁকের বিরান প্রান্তরে পরিণত হওয়ার কথকতা। তারাশঙ্কর দেখাতে চেয়েছেন হাঁসুলী বাঁকের গোষ্ঠী জীবনের বিনাশের ইতিহাস অর্থাৎ মূল্যবোধের বিপর্যয় এবং পরিণতিতে কাহার সম্প্রদায়ে স্বগ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়ার প্রসঙ্গ। উপন্যাসে দেখি, যুদ্ধের দামামাই নগদ অর্থ উপার্জনের প্রলোভনে আকৃষ্ট করে কাহারদেরকে দিনমজুরে পরিণত করেছে, যুদ্ধের রসদ যোগানোর অনিবার্যতায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে বাঁশবাঁদির বাঁশবন। ফলত, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে কাহারকুল; বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক সমাজের অজগরতুল্য জঠরের আকর্ষণে বাস্তুহারা- সংস্কৃতিহারা কৃষক কাহার রূপান্তরিত হয়েছে যন্ত্রকলের শ্রমদাসে।
তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’র চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছিলেন ক্লাসিক চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিনহা। ‘ঝিন্দের বন্দি’র শেষটা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনীর থেকে বদলে দিয়েছিলেন তপন সিনহা। পরে এ নিয়ে আক্ষেপ করতেন। তারই কাছাকাছি তাঁর আক্ষেপ ছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ ছবিটিকে ঘিরে। ‘হাঁসুলি …’ সিনেমা হবে শুনে তারাশঙ্কর অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। তা নিয়ে যে কাণ্ড করেছিলেন, রীতিমতো অদ্ভুত। মূল কাহিনীরর পটভূমি ছিল বীরভূমের লাভপুর। তপন সিনহাকে নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন সেখানে। মাইলের পর মাইল হাঁটতেন। লোকেশন দেখে বেড়াতেন। অন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু তারাশঙ্করের ক্লান্তি ছিলনা। চোখের দৃষ্টি যেন মাঝে মাঝে দিগন্ত ছাড়িয়ে কোথায় উধাও হয়ে যেত। ধ্যানমগ্ন ঋষি যেন! এক বার বলেছিলেন, ‘‘জানো তপন, এই লাভপুরের আশেপাশে পাঁচ-ছখানা গ্রামে ক’খানা গাছ আছে, তা’ও বলে দিতে পারি আমি।’’ সেই কোপাই নদী। গাঁ-ঘর। তার লোকজন। এমনকী করালীর পিসতুতো ভাই ‘নসুবালা’, যে মেয়ে সেজে ঘুরে ঘুরে বেড়াত, তাঁকেও চিনিয়ে দিয়েছিলেন তারাশঙ্করই। দিনের শেষে কাজের পর লাভপুরের বাংলোয় বসে মহাভারতের গল্প শোনাতেন তারাশঙ্কর। তেমনই এক দিন – তপন সিনহা লিখছেন, ‘‘হঠাৎ এক জন বৃদ্ধা এসে তাঁকে প্রণাম করল। …‘কেরে নসু নাকি … আয় আয়।’ সাদরে আহ্বান জানালেন তারাশঙ্কর। ‘হ্যাঁ বাবু, ভাল আছেন তো?’ বৃদ্ধাটি বলল। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে কেমন যেন মনে হল। তারাশঙ্কর আমার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে এই বাবু এসেছেন, তোদের নিয়ে সিনেমা করতে।’ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ হচ্ছে হাঁসুলিবাঁকের উপকথা-র নসুবালা। এ বার ভাল করে দেখলাম – যাঁকে বৃদ্ধা ভেবেছিলাম সে আসলে একজন পুরুষ। …. নসুবালা নাচে, গান গায়, তামাক খায়, মদ খায়, ঢোল বাজায়। … হঠাৎ তারাশঙ্কর বললেন, ‘এই নস্যে, বাবুকে একটা গান শোনা।’ কানে এক হাত দিয়ে দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে নসুবালা শুরু করলে – ‘আহা – আমায় এ হিদি মাঝারে আঁকা হয়ে গেলা শ্যামের চরণখানি।’ …’’ নসুকে এত কাছ থেকে দেখেও সিনেমায় তাঁকে ‘মেয়ে’ হিসেবে দেখিয়েছিলেন তপন সিনহা। পরে ভুল বুঝেছিলেন। তখন তাঁর আপসোসের অন্ত ছিল না!
যে বছর সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’ মুক্তি পেল, সেই বছরই (১৯৬২) মুক্তি পেয়েছিল তপন সিংহর পরিচালনায় ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। একদিন শুটিং-এর জন্য লাভপুর পৌঁছেছেন তপন সিনহা। তখন বর্ষাকাল। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। জল-কাদা মেখে কাজ করছিলেন সবাই। হঠাৎ নাম ধরে ডাক শুনে পিছনে তাকিয়ে তপন দেখেছিলেন ওয়াটাররপ্রুফ পরে স্বয়ং তারাশঙ্কর। তাঁর চোখাচুখি হতেই হো হো করে হেসে উঠে তারাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘এ হে হে দেখো দেখো! শহরের সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়েগুলো জল কাদা মেখে কী চেহারা করেছে দেখো।’’ লেখকের ছোটভাই এক ধামা তেলমাখা মুড়ি আর এক হাঁড়ি বেগুনপোড়া এনে হাজির হয়েছিলেন। লেখক বলেছিলেন , ‘‘নাও হে, অনেক কাজ হয়েছে, এবার সকলে একটু খেয়ে নাও। এরপর চা আসবে।’’
তারাশঙ্কর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বারবার নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন তপন সিনহা। একজন মানুষ গ্রামকে যে কী নিখুঁতভাবে চিনতে পারেন তার প্রমাণ তারাশঙ্কর। গ্রামের ক’টা গাছ আছে, তাও তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। ঘরে ঘরে লোকজনকে নাম-নামে চিনতেন। সবার শখ-আহ্লাদ-স্বভাব-অভাব যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পেতেন। যত দূরেই যান, গাঁ-ঘরটা তাঁর মনে যেন ছবি হয়ে ভেসে থাকত!
তারাশঙ্করের সাহিত্যিক জীবনের প্রথম পর্বে (১৯২৯-১৯৪৭) কালজয়ী উপন্যাসের পাশাপাশি রচনা করেন অসামান্য এক গুচ্ছ ছোট গল্প। তারাশঙ্করের প্রথম ছোটগল্প সঙ্কলন ‘ছলনাময়ী’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। তাঁর ছোটগল্পের সমষ্টি ‘জলসা ঘর’ (১৯৩৭), ‘রসকলি’ (এপ্রিল ১৯৩৮) ও ‘হারানো সুর’-এর মাধ্যমেই বাংলা ছোটগল্পে তাঁর তর্কাতীত প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়। তাঁর ছোটগল্পগুলোতে রাঢ় দেশের জীবনযাত্রার শাখা-চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ‘জলসা ঘর’-এ আভিজাত্য বংশ মর্যাদার সাথে নিম্নস্তরের সামাজিক পরিবেশের তুলনামূলক সমাজ-চিত্র ফুটে উঠেছে। ‘হারানো সুরে’ নিম্নশ্রেণীর জীবনযাত্রার ছায়াছবি অবলম্বনে কাহিনীর পরিবেশন করতে চেয়েছেন। ‘রসকলি’ গল্প সংগ্রহে ভাবের অকৃত্রিমতায়, বিষয় বৈচিত্রে ঘটনাগুলো প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এ গ্রন্থে যেমন গ্রাম্য পরিবেশে আত্মদ্বনদ্ব এবং সামাজিক কোলাহল স্থান পেয়েছে তেমনি পশুত্ব এবং মানবতার মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তি রসানুভূতি পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত। তারাশঙ্করের ভাষা সরল কিন্তু ঋজু। তিনি কোথাও রাজনৈতিক উম্মাদনায় বিভ্রান্ত হননি বরং সহজ সরল গ্রাম্য সহজ জীবানুভূতিতে দীপ্তিমান। ‘জলসাঘর’, ‘তারিনী মাঝি’, ‘রসকলি’, ‘কালা পাহাড়’, ‘অগ্রদানী’, ‘বেদেনী’, ‘যাদুকরী’, ‘নটু মোক্তার’, ‘সওয়াল’, ‘কামধেনু’, ‘পিতা-পুত্র’, ‘ডাইনী’, ‘শ্মশানের পথে’ অসংখ্য ছোট গল্পের কয়েকটি নাম।
উত্তর স্বাধীন ভারতে শিল্পী তারাশঙ্করের শিল্প চেতনায় বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে কংগ্রেসী রাজনীতির শীর্ষনেতৃত্বের নিষ্ঠ সান্নিধ্য আসার সুযোগ ঘটে তাঁর। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধান সভার সদস্য মনোনিত হন তিনি। পরে রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন পেলে কেন্দ্রীয় রাজ্য সভায় সদস্য হিসাবে উন্নীত হন ১৯৫২।
‘চীন-ভারত মৈত্রী’ শক্তিশালী করার জন্য উভয় দেশের সরকার সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক প্রতিনিধি দলের মধ্যে শুভেচ্ছা সফরের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই সূত্রে ১৯৫২ সালে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় চীন সফরে যান। পরে ১৯৫৭ সালে আফ্রো এশিয়া সাহিত্য সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসবে রাশিয়ার তাসখন্দ ভ্রমণ করেন। তারাশঙ্কর ১৯৫২ সালে ‘আরোগ্য নিকেতন’ লেখেন। এ গ্রন্থের জন্য তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’, ‘সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে তারাশঙ্করের ‘রাধা’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। রাধা উপন্যাসে ইতিহাসকে অতিক্রম করে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ধর্মবোধ, পার্থিব প্রত্যাশাসমূহ উপজীব্য করা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে ‘গণদেবতা’কে মুখ্যত স্মরণে রেখে তাঁর সমগ্র সাহিত্য জীবনের পুরস্কারস্বরূপ তাকে ‘জ্ঞানপীঠ’ প্রদান করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে অনুকূল জনমত গঠনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেন ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’র সভাপতির গুরুত্বপূর্ণ পদ। এ সময় তিনি দু’টি উপন্যাস রচনা করেন। একটি ‘সুতপার তপস্যা’। অপরটি ‘একটি কালো মেঘের কথা’। ১৯৬৫ সালের পর থেকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায় বিস্তৃত গোপন রাজনৈতিক তৎপরতাকে উপজীবী করে ক্ষুদ্র উপন্যাসে ‘সুতপার তপস্যা’ রচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে বিষয়বস্তু করে তিনি রচনা করেন তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘একটি কালো মেয়ের কথা’। এ গ্রন্থে বাংলাদেশীদের ত্যাগ ও সংগ্রামের অনন্যতাকে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
পশুপ্রেমের যে তিনটি গল্প বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে, সেগুলি হল শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’ আর তারাশঙ্করের ‘কালাপাহাড়’। তিনটি গল্পই করুণ রসে আর্দ্র। পড়ামাত্রই পাঠকহৃদয় সিক্ত হয়ে যায়। এই ত্রয়ী গল্পের তৃতীয়টি অর্থাৎ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালাপাহাড়’ গল্পটি প্রকাশের আশি বছর পূর্তি হয়েছে তিন বছর আগে। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালের ২০শে নভেম্বর ‘দেশ’ পত্রিকায়। এই আশি বছরে গল্পের পটভূমি, কেন্দ্রীয় চরিত্র, পার্শ্বচরিত্রের অর্থাৎ গল্পের সেই এলাকা, ‘কালাপাহাড়’ এবং তার মালিক রংলালের কেমন পরিবর্তন ঘটেছে? দেখা যাক গল্পের ভিতর বাহির। বড় চাষি রংলাল পছন্দসই গরু কিনতে চায়। বাড়ির গরু জোড়া বিক্রির টাকা নিয়ে পাঁচুন্দীর হাট থেকে ঘটনাচক্রে কিনে ফেলে দুটো অতিকায় মহিষ। বাড়ি নিয়ে গেলে স্ত্রী ও পুত্রের কথা ধরে তাদের নাম হয় ‘কালাপাহাড়’ আর ‘কুম্ভকর্ণ’। রোজ তাদের নদীর ধারে চরাতে নিয়ে যায়। দূরে চলে গেলে অবিকল মহিষের ডাক ডেকে ফিরিয়ে আনে। দু’জনার ঝগড়া হলে, তাদের আলাদাভাবে স্নান করিয়ে পেট ভরিয়ে খাইয়ে তবে একসঙ্গে মিলতে দেয়। উপদেশ দেয়, ‘ছিঃ ঝগড়া করতে নেই। একসঙ্গে মিলেমিশে থাকবি তবে তো!’ একদিন বাঘ পড়ল তাদের ওপর। ‘কুম্ভকর্ণ’ বাঘটাকে শিঙে গেঁথে ফেলেও মারা গেল। রংলাল বালকের মতো কাঁদতে লাগল। এখন কালাপাহাড়কে সামলানো বিপদ। সে রংলালের কোলে মুখ তুলে দেয়, রংলাল পরম স্নেহে তার মাথা চুলকে দেয়। একসময় তার দুরন্তপনায় অস্থির হয়ে রংলাল এক পাইকারের কাছে তাকে বিক্রি করলেও সে ফিরে আসে। শেষে এক পাইকার কোন জমিদারকে দিতে তাকে কিনল। কিন্তু পাইকারের হাত থেকে গলার দড়ি ছিনিয়ে নিয়ে কালাপাহাড় শহরের রাস্তায় ছুটতে থাকে আর রংলালকে ডাকে ‘আঁ–আঁ–আঁ’। শান্তিভঙ্গের কারণে পুলিস সাহেব তাকে গুলি করে মারলেন। ‘‘সাহেব রিভলবারটা খাপে ভরিয়া সঙ্গের কনস্টেবলকে নামাইয়া দিলেন, বলিলেন, ‘ডোম লোগকো বোলাও’ …’’। অনভ্যস্ত পরিবেশে এই অতিকায় অথচ অসহায় প্রাণীর মৃত্যু আমাদের বেদনার্ত করে। মহিষ কালাপাহাড় এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও তার মালিক কৃষক রংলালই আমাদের আলোচ্য। গল্পটি পাঠ করে রংলাল সম্বন্ধে যা ধারণা করা যায় তাতে, সে নানুর লাভপুর কেতুগ্রাম কাটোয়া কান্দী থানা এলাকার কোনও এক গ্রামের মাঝারি কৃষক। তার স্ত্রী এই এলাকার দেশাচার লোকাচার মানে। পুত্র প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত আধুনিক যুবক। সে ম্যাট্রিক পাস করে কাজের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। তার পারিবারিক আয় কৃষিনির্ভর। কোনও বছরে ধান ভাল ফললে শখ আহ্লাদ মেটাতে পারে। ধান চাষই তার মুখ্য পেশা। চাষের কাজে যত্নবান। গল্পকারের ভাষায় বলশালী দেহ। খুব খাটতে পারে। একবিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট রাখে না। বোধ হয় এই কারণেই গরুর ওপরেও তার প্রচণ্ড শখ। লেখক ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, রংলাল গরুর মতোই খাটে এবং তাঁর বুদ্ধিও ...। সে যাই হোক, রংলাল এই মধ্যবঙ্গের একজন কৃষক যে বিগত শতকের তিরিশের দশকে নিজহাতে হাল ডাকিয়ে, জমিতে চাঙড় চাঙড় মাটি তুলে ভাল ধান/ফসল ফলাত। তার দাম পেয়ে সংসারে শ্রীবৃদ্ধি ঘটাত। খড় বাঁচাতে মাঠে–ঘাটে নদীর ধারের ঘাস খাইয়ে মহিষ পুষত। একেবারে হিসেবি কৃষক। সমাজবিজ্ঞানের ভাষ্যে রংলাল সামন্ত যুগের একজন আদর্শ উৎপাদক, যার উৎপাদনক্ষেত্র নিজস্ব কিছু জমি। আর উৎপাদনের উপকরণ সেই কেঠো লাঙল আর হাল বলদ অথবা মহিষ। গ্রামীণ পরিবেশের আদর্শ কৃষক দম্পতিও তাঁরা। কৃষিকেন্দ্রিক আচার অনুষ্ঠান মেনে চলে। তাই তো নতুন মহিষের আগমনের সঙ্গে তেল–সিঁদুর পরিয়ে উলিয়ে বরণ করে নেয়। ছেলের সঙ্গে প্রজন্ম–ফারাক মানসিক ফারাকে পরিণত হয়। নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষকের জীবনযাপন, কিন্তু তাঁরা সুখী। এবার আমরা দেখব স্থান–কাল–পাত্রের মধ্যে শুধুমাত্র ‘কাল’টিকে আশি বছর পরে এনে কী দেখতে পাই। আজকের রংলাল অবশ্যই শুনতে পাবে না ‘ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস’ শব্দ, আর চোখ খুলে দেখতে পাবে না হিংস্র চিতাবাঘকে। না, লাভপুরের কুয়েনদী বা কেতুগ্রামের কান্দর বা ভরতপুর–কান্দীর ময়ূরাক্ষীর ধারের কোনও ঝোপজঙ্গলেই আর কুম্ভকর্ণকে মেরে ফেলার মতো চিতাবাঘ নেই। অর্থাৎ জৈববৈচিত্র্য নষ্ট হয়েছে। ১৯৩৭–এর রংলালের ছেলে যশোদানন্দন ম্যাট্রিক পাস করলেই একটা কাজের জোগাড় হত। এখনকার রংলালের পুত্ররা বেকার। এখন ম্যাট্রিক কেন এমএ পাস করেও চাকরি নেই। কর্মসংস্থানের জন্য যশোদানন্দনদের খুব ঘুরতে হচ্ছে, তাই তাঁদের মেজাজ সেদিনের চেয়েও তিরিক্ষে। টেট ফেট কেউ কিচ্ছু পাচ্ছে না। হতাশায় কেউ কেউ আত্মহত্যাও করে ফেলছে। সেদিনের রংলাল পুরনো গরু বিক্রির টাকা তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে নিয়ে মোট ১০০ (একশো) টাকায় কালাপাহাড় আর কুম্ভকর্ণকে কিনতে পেরেছিল। কিন্তু আজ তাঁরা সেই টাকায় একটা হাঁসও হবে না পাঁচুন্দীর হাটে। কালাপাহাড় বা কুম্ভকর্ণকে কিনতে লাগবে এক লক্ষ টাকা। মুদ্রাস্ফীতি এতখানিই ঘটেছে! সেরা গরু পোষার, যত্ন করার শখ ছিল রংলালের। এখনকার রংলালদের গরু–মহিষ পোষার শখ একেবারে লোপ পেয়ে পেয়ে বিনষ্ট হয়েছে। এই এলাকার কোনও গ্রামে আর হাল বলদ রাখার রেওয়াজ নেই। পূর্বে উল্লেখিত চার–পাঁচখানা থানা এলাকার কোন গাঁয়ের চাষি ছিল রংলাল, তা জানা না থাকলেও, এটা জানা আছে যে, সেই গাঁয়ে আর দশ–বিশ জোড়া গরু–মহিষও নেই। আট দশক তো খুব দূরের, মাত্র তিন দশক আগেও কেতুগ্রাম থানার অন্তর্গত শিবলুন গ্রামে অন্ততঃ ৪০০ জোড়া গরু–মোষের হাল দেখা যেত। কিন্তু আজ সেই শিবলুন গ্রামে মাত্রই বিশ জোড়া হাল বলদ। এসব পোষার খরচ বেশি। পোষায় না। ধানজমির হাঁটুভর কাদা এখন বড় লাঙলে নয়, ট্র্যাক্টরেই করে দিচ্ছে। তাদের একদিনের চালনায় তাবৎ মাঠ কর্দমাক্ত। তাহলে কি শাশ্বত বাংলার সব কিছুই বদলে গেছে? না, পাঁচুন্দীর হাটের অবস্থা একটুও বদলায়নি। সেরকমই পশুর কেনাবেচা হয়। সেদিনের শাকাশী মহিষ কুম্ভকর্ণের সঙ্গে মাংসাশী চিতাবাঘের লড়াইও একই আছে। বাঘ এখনও ঘাস খায় না। নিরীহ শাকাশী প্রাণীদের মেরে খেতে চায়। আগের মতোই বজায় আছে গরিব চাষির দুর্দশা। তাঁরা যেন সেই রামা কৈবর্ত আর রহিম শেখের সময় থেকেই বড় বড় মহাজনদের খাদ্য! আজও তেমনই আছে। রংলাল আগের বছরের ধানের ফলন এবং দাম পেয়ে পুরনো খারাপ গরু বিক্রি করে ভাল মহিষ কিনতে পেরেছিল। আজকের রংলালের ধান বিক্রি হয় না। হলেও ন্যূনতম দামে। না, উৎপাদন ব্যয়ের দ্বিগুণ লাভ দিয়ে কোনও সরকার কেনে না। তারাশঙ্কর লিখেছিলেন, ‘‘মহিষের মেজাজ একবার খারাপ হইলে সে আর শান্ত হয় না, বরং উত্তরোত্তর সে অশান্ত হইয়া ওঠে।’’ আজকের রংলাল হয়তো তার শিক্ষিত, কাজের ছেলে যশোদানন্দনের পরামর্শে লাখ টাকার কালাপাহাড়কে পশু হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার ডাক্তারবাবু বলে, এ আমাদের কম্মো নয়। আপনি বরং ‘অ্যানিম্যাল বিহেভিয়ার স্পেশালিস্ট’ অথবা ‘ইথোলজিস্ট’দের কাছে নিয়ে যান। হ্যাঁ, ‘বিহেভিয়াল সায়েন্স’ বা ‘ইথোলজি’র যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে। আজকের দিনে হলে হয়তো কালাপাহাড়ের মনখারাপ সেরে যেত। ভুলে যেত তার সাথী কুম্ভকর্ণ আর মালিক রংলালকে। ‘‘... প্রাণভয়ে কালাপাহাড় ছুটিতেছিল’’, লিখেছেন তারাশঙ্কর। করুণ দৃশ্য। আজও মানুষ দেখতে বাধ্য হয়, দীর্ঘদিনের হাল বলদকে যখন তার রংলালের মতো মনিবরা পাইকারকে বিক্রি করে দেয়, তখন সেই গৃহস্থের চোখে জল আসে, আর সেই পশুও গোয়াল ছেড়ে পাইকারের সঙ্গে যেতে চায় না। তারও চোখ ছলছল করে ওঠে। হায় রে কালাপাহাড়! তুমি সাথীহারা হয়ে পাগল হয়েছিলে বলে রংলাল তোমাকে বেচে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তুমি অচেনা পথে মালিককে খুঁজতে গিয়ে সভ্যতার ক্ষতি করে ফেলেছিলে। তাই নির্মম গুলিতে তোমার মৃত্যু। তোমার পরিবর্ত হিসেবে গ্রামে বড় গৃহস্থের বাড়িতে এসেছে যন্ত্রের লাঙল, ট্র্যাক্টর। সে পাগল হলে? কী হাল হয়? গ্রামের অজিত বিশ্বাসের ট্র্যাক্টরও পাগল হয়ে পর পর অ্যাকসিডেন্ট ঘটাচ্ছিল। অজিতদারা তাই তাকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিক্রি করে দিব্যি তারা ফিরেও আসে। কিন্তু পশু কালাপাহাড়ের মতো সেই যন্ত্রদানব তাণ্ডব করে নতুন মালিকের বাড়িতেও অ্যাকসিডেন্ট করে যাচ্ছে শোনা যায়!
তাঁর জীবনের একেবারে শেষের দিকে মৃত্যুকে যেন তিনি টের পাচ্ছিলেন। শরীর ভাল যাচ্ছিল না। তাঁর স্ত্রী ‘উমাশশী’কে তিনি ডাকতেন ‘বড়বৌ’ নামে। প্রাণের চেয়েও প্রিয় ছিলেন তিনি। কে আগে পৃথিবী ছেড়ে যাবেন তাই নিয়ে দোলাচল কাজ করত প্রায়ই। কেবলই ভাবতেন, যে পড়ে থাকবে সে যে চূড়ান্ত একা হয়ে পড়বে। তাঁর জীবনের শেষ দিকের লেখা ডায়রির পাতায় বারবার মৃত্যু-চিন্তা এসেছে। ১৯৬৮ সালের ৮ই এপ্রিল ডায়রিতে তারাশঙ্কর লিখেছিলেন, ‘‘আজ সনতের (বড় ছেলে) ঘরে আয়নায় নিজের খালি গায়ের ছবি দেখলাম। শরীরে-মৃত্যুর হাতের স্পর্শ লেগেছে – তা বোঝা যাচ্ছে। – আসুক সমাপ্তি আসুক। খুব ক্লান্ত আমি। মৃত্যুতে কোনও আক্ষেপ তো নেই আমার। … কিন্তু আমার বড়বৌ! আমার বৌকে ছেড়ে যেতে পারব? বড়বৌ নইলে যে আমার পৃথিবী অন্ধকার। সে যে আমার জীবনকে জুড়ে রয়েছে – মাটির উপরে বয়ে যাওয়া নদীর মত।’’ তবু চলে যেতেই হয়েছিল তাঁকে। ‘জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবন’-এ! আগে একাই চলে গিয়েছিলেন তারাশঙ্কর। বড়বৌয়ের তাঁর কাছে আসতে তখনও তেরো বছর বাকি ছিল! সুস্বাস্থের অধিকারী তারাশঙ্কর কোনও কালেই ছিলেন না। অল্পবয়েস থেকেই অনিয়ম, শরীরের ওপর অত্যাচারের কারণে মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। শেষ দিকে সংসারটি যখন সবে একটু থিতু হয়েছিল তখনই শুরু হয়েছিল তাঁর ঘনঘন অসুস্থতা। রক্তচাপের ওঠানামা, চোখের দৃষ্টি কমে আসা, নার্ভের সমস্যা, পেটের সমস্যায় ভুগেছিলেন খুব। এমনকী রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকে এমনই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে ছয় বছরে ক’দিন সভায় উপস্থিত থাকতে পেরেছিলেন হাতে গুনে বলা যায়। যেহেতু দেশের জন্য সব রকমের কাজ করেছিলেন, তাই শেষ জীবনেও কোনও কাজে ঘেন্না বলতে কিছু ছিল না। তখন পাইকপাড়ায় তাঁর নিজের বাড়ি, গাড়ি সব হয়েছিল তবু ওই বয়েসেও নিজেই অক্লেশে নর্দমায় দু’হাত ডুবিয়ে নোংরা পরিষ্কার করতেন। তারপর ভাল করে হাত ধোওয়ারও বালাই ছিল না। ওই থেকেও শরীরে রোগ জীবাণু বাসা বেঁধেছিল। একদিন সন্ধে থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। বড় ছেলের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছিলেন অনেকক্ষণ। সারাদিনে সুস্থ মানুষটা রাতেই আচমকা আবার অসুস্থ পড়েছিলেন। ডাক্তার ছুটে এসেছিলেন। ধরা পড়েছিল ‘ব্রেইন ফিবার’। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। ঝাপসা হয়ে আসছিল চারদিক। অনেক চেষ্টার পরেও আজীবন লড়াই করা গণদেবতা শেষে থেমে গিয়েছিলেন। ক্যালেন্ডারে সেদিন তারিখ ছিল ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সাল।
(তথ্যসূত্র:
১- আমার সাহিত্য জীবন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
২- তারাশঙ্কর: ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য, প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য (সম্পাদিত)।
৩- মনে পড়ে, তপন সিংহ, আনন্দ পাবলিশার্স।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত