২০শে জুলাই, ১৯২৯ সাল। লাহোর বোস্টাল জেল। আটজন বেশ মোটাসোটা পালোয়ান লোককে সঙ্গে নিয়ে, জেল সুপার, ডাক্তার, জেলের সেলে মধ্যে ঢুকলেন। কিছু বুঝতে না বুঝতেই ওই আটজন লোক, সাতদিন ধরে না খাওয়া দুর্বল মানুষটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’জন দুটি হাত, দু’জন দুটি পা এবং দু’জন পুরো শরীরটা চেপে ধরল। এছাড়াও একজন মাথা ও অন্যজন চিবুক ধরে জোর করে হাঁ করাল। সেই সুযোগে ডাক্তার একটি সরু নল দিয়ে দুধ ঢালতে শুরু করলেন। আর কোনো উপায় না দেখে ওই মহান মানুষটি তাঁর আমরন অনশনকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছাকৃতভাবে জোরে জোরে কাশতে থাকলেন, এটা ভেবে যে, যদি কোনোভাবে ওই দুধ ভর্তি নলটি খাদ্যনালী থেকে সরে গিয়ে শ্বাসনালীতে চলে যায়, তার ফলে কিছুটা দুধ ফুসফুসে চলে গেলে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, যেমন ভাবা তেমন কাজ, আরও জোরে জোরে কাশতে থাকলেন, ফলে কিছুটা দুধ ফুসফুসে ঢুকেও গেল, এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ফলে তাঁর আমরন অনশন বজায় থাকল। ৪৮ ঘন্টা ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করার পর, মানুষটির জ্ঞান ফিরল। চোখ খুলতেই তিনি লক্ষ করলেন – তাঁকে প্রলুব্ধ করার জন্য তাঁর সেলে নানা ধরনের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এদিকে নলটি জোরপুর্বক খাদ্যনালী থেকে শ্বাসনালীতে ঢুকে যাওয়ায় তাঁর গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। তিনি বুঝতে পারলেন সারাজীবন তিনি আর কোনোদিন কথা বলতে পারবেন না। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর পাশে রাখা রয়েছে একটি শ্লেট আর পেনসিল। জেল সুপার বললেন – ‘‘আপনার কি খেতে ইচ্ছা করছে ওই শ্লেটে লিখে দিন। আপনার যা ইচ্ছা তাই খেতে পারেন।’’ যে মানুষটি ছোটোবেলা থেকে খাদ্যরসিক ছিলেন, পকেটে পয়সা থাকলেই বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে খেতে যেতেন, সেই মানুষটিই নয় দিন অভুক্ত থেকেও তাঁর সামনে পড়ে থাকা তাঁর পছন্দের খাবারগুলির দিকে তাকিয়ে শুধু একবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন। কোনো কিছুই মুখে তোলেননি। জেল সুপার তাঁর ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁকে কিছু বুঝিয়ে-সুজিয়ে খাওয়ানোর জন্যে। কিন্তু তাঁর অদম্য জেদ, তাঁর ইচ্ছা শক্তি, আর অকৃত্রিম দেশপ্রেমের কাছে সবাই হার মানল। এইভাবেই চলতে থাকল তাঁর আমৃত্যু অনশন।
১৯২৮ সালের ৮ই জুলাই। কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল থেকে তাঁর পিতাকে একটি পত্রে তিনি লিখেছিলেন,
‘‘পাঞ্জাবের জেল হইতে অদ্য আমাকে এখানে লইয়া আসিয়াছে। ... আমাকে বোধ হয় শীঘ্রই হয় খালাস করিয়া দিবে, না হয় কোনও গ্রামে নজরবন্দী করিয়া রাখিবে। আমি যত শীঘ্র বাড়ী যাইতে চেষ্টা করিব। ... কিরণ যদি আসিয়া থাকে ত’ অবিলম্বে আমার সহিত যেন সাক্ষাৎ করে।
ইতি –
খেঁদু।’’
কিন্তু তাঁকে ছাড়া হয়নি। বাড়ি যাওয়ার স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে যায়। প্রেসিডেন্সি থেকে তাঁকে আবার লাহোর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘খেঁদু’ তাঁর ডাকনাম। ভালোনাম, ‘শ্রী যতীন্দ্রনাথ দাস’ (‘কিরণ’ নাম ছিল যতীন দাসের ছোট ভাইয়ের)। বাঘা যতীনের চেয়ে পঁচিশ বছরের ছোট তিনি। কিন্তু দুই যতীনের উদ্দেশ্যই ছিল এক। ভারতের স্বাধীনতা।
৩০শে অক্টোবর, ১৯২৮ সাল। পাঞ্জাবকেশরী লালা লাজপৎ রাই, লাহোরের রাজপথে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য আসা, স্যার জন সাইমনের, ‘সাইমন কমিশন’ বিরোধী একটি অহিংস স্বদেশী মিছিল পরিচালনাকালে, লাহোরের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার ‘জেমস এ. স্কট’ ও ডেপুটি কমিশনার ‘জে. পি. স্যান্ডার্সের’ নেতৃত্বে এক পুলিশ বাহিনীর হাতে প্রহৃত হয়ে গুরুতর আহত হন।
১৭ই নভেম্বর ১৯২৮ সাল। গুরুতর আহত ‘পাঞ্জাবকেশরী লালা লাজপৎ রাই’ গত হন। যদিও তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে লিখিত হয়েছিল ‘হৃদরোগে আক্রান্ত’ হয়ে মৃত্যু, কিন্তু ডাক্তারদের মতে ব্রিটিশ পুলিশের নির্মম প্রহার ছিল তাঁর মৃত্যুর মূল কারণ। পরবর্তীতে বিষয়টি ব্রিটিশ সংসদে উত্থাপিত হলে, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পাঞ্জাবকেশরী’র মৃত্যুতে ব্রিটিশ পুলিশের নির্মম লাঠি চার্জ ও ব্রিটিশ পুলিশের কোনও রকমের ভূমিকার কথা অস্বীকার করে।
১৭ই ডিসেম্বর ১৯২৮ সাল। পাঞ্জাবকেশরীর মৃত্যুর ঠিক এক মাসের মাথায় প্রতিশোধ নিলেন বিপ্লবীরা। বিপ্লবীদের গুলিতে ডেপুটি কমিশনার ‘জে. পি. স্যান্ডার্স’ নিহত হন। লাহোরের সব রাস্তা পোস্টারে ছেয়ে যায়। পরে ঘোষিত হয়, “Beware of Bureaucracy. The killing of J. P. Sanders was only to Avenge the murder of Lala Lajpat Rai … We are sorry that we had to shed human-blood on the altar of revolution which will end all exploitation of man in the hands of man.”
৮ই এপ্রিল ১৯২৯ সাল। দিল্লি। একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। দিল্লীতে সেদিন কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেসন বসেছে। কংগ্রেসী আসনে ‘মতিলাল নেহেরু’, ‘মদনমোহন মালব্য’ যেমন ছিলেন, তেমনি সভায় উপস্থিত ছিলেন কুখ্যাত লর্ড সাইমন’। সভা চলছিল ‘বিঠলভাই প্যাটেলের’ Speakership-এ। সভায় ‘Trade Dispute Bill’ এবং ‘Public Safety Bill’ পাশ করানো হচ্ছিল। সেই সময়েই অধিবেশনে কক্ষে বিকট শব্দে একটি বোমা বিস্ফোরণ হয়। চারিদিকে শুরু হয়ে যায় আতঙ্কিত লোকদের ছুটোছুটি। সঙ্গে সঙ্গে আবার পিস্তলের গুলির শব্দ। সকলের চোখে মুখে যখন মৃত্যুর বিভীষিকা, তখন দুই সুদর্শন তরুন ‘ভগৎ সিং’ এবং বাংলার ‘বটুকেশ্বর দত্ত’ তাঁদের হাতের রিভলবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন – ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। তরুনদ্বয় উচ্চকন্ঠে বললেন, – ‘‘আমরা কাউকে হত্যা করতে আসিনি। বিপ্লবের পথ আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু আজ আমরা শুধু প্রতিবাদ জানাতে এসেছি। অত্যাচারী গভর্নমেন্টের জন স্বার্থ বিরোধী কাজের প্রতিবাদ।’’ ইচ্ছে করেই ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত ধরা দিলেন। যদিও বিপ্লবের আদর্শ প্রচারের জন্যেই ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত ধরা দিয়েছিলেন। তবু মনে হয়, ওটা তাঁদের অদূরদর্শীতাই ছিল। কেন না এই সূত্র ধরেই ব্রিটিশ সরকার বহু বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করলো, বহু সূত্র আবিষ্কার করলো। সবচেয়ে বড় ঘটনা হল স্যান্ডার্স হত্যার যোগসূত্রও আবিষ্কার করে ফেললো। শুরু হল ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’। বিভিন্ন সূত্র ধরে এবং বিভিন্ন বন্দীর স্বীকৃতি আদায় করে পুলিশ পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বাংলা ও বিহার জড়িয়ে এক আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্রের সূত্র আবিষ্কার করলো। এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিদের নামের তালিকায় ছিলেন – ‘ভগৎ সিং’, ‘বটুকেশ্বর দত্ত’, ‘শুকদেব’, ‘রাজগুরু’, ‘চন্দ্রশেখর আজাদ’, ‘যতীন দাস, ‘ভগবতীচরণ ভোরা’, ‘শিব বর্মা’, ‘জিতেন স্যান্যাল’, ‘ফনী ঘোষ’, ‘ললিত মুখার্জী’, ‘জয়গোপাল’ সহ মোট ত্রিশ জন। ‘ফণীঘোষ’, ‘ললিত মুখার্জী’ ও ‘জয় গোপাল’ রাজসাক্ষী হয়ে যান।
১৪ই জুন ১৯২৯ সাল। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত থাকার জন্য, সেদিন সকালে কলকাতায় টাউনসেন্ড রোড ও হাজরা রোডের মোড়ে দোতালায় একটি ঘর থেকে বিপ্লবী যতীন দাসকে গ্রেপ্তার করে পত্রপাঠ লাহোরে পাঠানো হয়।
১০ই জুলাই ১৯২৯ সাল। পুলিশ স্যান্ডার্সকে হত্যার অপরাধে ও ইংরেজ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে লাহোরে ষড়যন্ত্র মামলা খাড়া করে, যাতে পাঞ্জাবের ‘ভগৎ সিং’, ‘সুখদেব’, ‘রাজগুরু’, বাংলার বীর সন্তান ‘যতীন দাস’ প্রমুখ ১৭ জনকে আসামী করা হয়। যতীন দাসের সেই মামলা চলাকালীন জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা দাবি করে আমৃত্যু অনশন, সরকারি মহলেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। দেশের নেতৃবৃন্দের অনুরোধ উপেক্ষা করে আদর্শ অনুযায়ী উদ্দেশ্যসিদ্ধ করবার এক মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবী চরিত্র যতীন দাসের সেই আমৃত্যু অনশনের সময়কার সংকটমুহুর্তকালীন কথাবার্তায় যা প্রকাশ পায় সেই বিবরণ দেওয়া হল:
১৬ই আগস্ট ১৯২৯ সাল। এক ঘোষণায় পাঞ্জাব সরকার যে জেল তদন্ত কমিশন গঠন করলেন, তার মধ্যে রইলেন, পাঞ্জাবের জেলাসমূহের প্রধান পরিদর্শক (সভাপতি) ‘আফজল হক’, ‘মোহনলাল’, ‘হরবক্স সিং’, ‘মহীন্দ্ৰ সিং’, ‘দৌলতরাম মালিয়া’, ‘চৌধুরী জাফরুল্লা’, ‘মহম্মদ হায়াৎ খাঁ’ ও ‘কুরেশী আলি’। পাঞ্জাবের স্বরাষ্ট্রসচিব ‘অগিলভি’ হলেন তদন্ত কমিশনের সেক্রেটারি। ‘ডা. গোপীচাঁদ ভার্গব’ জেল পরিদর্শনে এসেছিলেন। যতীন দাসের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা ‘ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট খইরুদ্দিন’ যেভাবে লিপিবদ্ধ করছেন তা ছিল নিম্নরূপ –
ডা. গোপীচাঁদ: “সুপ্ৰভাত মিস্টার দাস!”
মিঃ দাস: “সুপ্ৰভাত” (গলার স্বর অতি মৃদু)
ডা. গোপীচাঁদ: “আপনি জল ও ওষুধপত্র কিছু খাচ্ছেন না কেন?”
মিঃ দাস: “আমি মরতে চাই।”
ডা. গোপীচাঁদ: “কেন?”
মিঃ দাস: “কারণ আমার দেশ, কারণ আমি রাজনৈতিক বন্দীদের মর্যাদা তুলে ধরতে চাই।”
২১শে আগস্ট ১৯২৯ সাল। ডা. গোপীচাঁদের সঙ্গে ‘পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন’ও এসেছিলেন দাসকে দেখতে। সেদিন তাঁরা নিজেদের সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘সর্দার ভগৎ সিং’কে। তাঁদের সাথে যতীন দাসের কথাবার্তা ‘ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট খইরুদ্দিন’ লিপিবদ্ধ করেছিলেন নিম্নরূপে –
পুরুষোত্তম দাস: “আপনি আজ কেমন আছেন মিস্টার দাস?”
মিঃ দাস: “খুব ভালো আছি।”
পুরুষোত্তম দাস: “আপনার তো বেঁচে থাকা দরকার।
মিঃ দাস: বেঁচে আছি তো!”
পুরুষোত্তম দাস: “কোনো ওষুধ বা পুষ্টিকর কিছু না নিয়ে কেমন করে বেঁচে থাকবেন?”
মিঃ দাস: “আমার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে।”
ডা. গোপীচাঁদ: “একটু ওষুধ অন্ততঃ খান। আপনার এই অনশনের ফল দেখবার জন্যে আরও দুসপ্তাহ আপনাকে বাঁচতে হবে। তারপর যদি দেখেন, আপনার দাবি পূর্ণ হয় নি, তখন যা খুশি করবেন।”
মিঃ দাস: “এই গভর্নমেন্টকে আমি একটুও বিশ্বাস করি না।”
পুরুষোত্তম: “আমার মনে হয়। ডা. গোপীচাঁদ ঠিক কথাই বলেছেন। অন্তত আরও দুসপ্তাহ বেঁচে থাকবার জন্যে আপনার কিছু ওষুধ খাওয়া দরকার।”
মিঃ দাস: “না। ওষুধ খাওয়া মানে এই নির্যাতনের মেয়াদ বৃদ্ধি মাত্র।”
ভগৎ সিং: “এর আগের বারে আপনি আমার অনুরোধ রেখেছিলেন।”
মিঃ দাস: “হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আবার এসেছেন কেন? এবারে আর আপনার কথা শুনতে রাজি নই। আপনি যান।”
পুরুষোত্তম ও ডা. গোপীচাঁদ (একসঙ্গে): “ভগৎ সিং তো নিজে আসেননি। আমরাই তাঁকে নিয়ে এসেছি।”
মিঃ দাস: “ভগৎ সিং, আপনি আমার বুক ভেঙে দিয়েছেন।”
ভগৎ সিং: “আমি এঁদের অনুরোধেই এসেছি। কিন্তু আপনাকে অনুরোধ করি আপনি আর পনেরোটা দিন বেঁচে থাকবার চেষ্টা করুন। আমাদের দাবি যদি না মেনে নেয়, তখন আমরা মরতে পারি।”
মিঃ দাস: “আপনাকে গায়ের জোরে খাওয়ালো কী করে?”
ভগৎ সিং: “আমি যতক্ষণ পেরেছি, প্রতিরোধ করেছি। আমার অনুরোধ, আপনি রোজ একপোয়া করে দুধ খান।”
৩০শে আগস্ট ১৯২৯ সাল। যতীন্দ্রনাথকে দেখতে এলেন ‘ডা. গোপীচাঁদ’, ‘পন্ডিত শান্তনম’, ‘সর্দার শার্দুল সিং কবিশের’ ও ভগৎ সিং-এর পিতা ‘সর্দার বিষণ সিং’। ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট খইরুদ্দিনের লিখিত বিবরণে সেদিনের বার্তালাপ ও ঘটনা ছিল নিম্নরূপ –
ডা. গোপীচাঁদ: “মিস্টার দাস, কেমন আছেন?”
- (উত্তর নেই)।
ডা. গোপীচাঁদ: “আপনি তো কথা রাখলেন না। আপনি বলেছিলেন যে, এই কটা দিন বেঁচে থাকবেন। কিন্তু এভাবে কি সম্ভব?” - (তবুও কোনো উত্তর এলো না।)
ডা. গোপীচাঁদ: “কেন ওষুধ খাচ্ছেন না বলুন তো?” - (কোনো উত্তর এলো না এবারেও)।
ডা. গোপীচাঁদ: “আপনার মৃত্যু হলে সব নষ্ট হয়ে যাবে। একমাত্র একজন ছাড়া কমিটির আর সকলে সবগুলি দাবি মেনে নিয়েছেন। আপনি যদি চান, আমি তাঁদের এখানে আনতে পারি। আপনি আপনার কথা রাখুন।”
যতীন দাসের কাছ থেকে তবুও কোনো উত্তর এলো না।
পন্ডিত শান্তনম বললেন: “মিস্টার দাস, আমরা জানি মৃত্যু আপনার কাছে কিছুই না। আপনাকে আদর্শচ্যুত করবার কোনো অধিকার আমাদের নেই। আমরা বলছি না, যে আপনি অনশন ভঙ্গ করুন। ওষুধ খেয়ে ক’দিন বেশি বাঁচবার মানে যন্ত্রণা বৃদ্ধি। কিন্তু তবু আমাদের জন্যে, জেল কমিটির অনুমোদনের ফল কী হয় শুধু সেইটুকু দেখবার জন্যে আপনাকে আরও কদিন বাঁচতে বলছি।”
দাস, জিতেন সান্যালের মুখের দিকে তাকালেন। সান্যাল নিচু হয়ে দাসের মুখের কাছে কান পাতলেন। এখন সামান্য নড়ল ঠোঁট। সান্যাল জানালেন অন্যদের – “বলছেন, না।”
ডা. গোপীচাঁদ: “কিন্তু আপনি কথা রাখছেন না। বলেছিলেন, দুসপ্তাহ বেঁচে থাকবেন। এখনো তো চোদ্দ দিন হয়নি!”
সান্যালের কানে কানে ফিসফিস করে বললেন দাস, “৪ঠা সেপ্টেম্বর চোদ্দ দিন পূর্ণ হবে। আমি বেঁচে থাকব।”
দেশের জন্যে, রাজনৈতিক বন্দীদের জন্যে গোপীচাঁদ, পণ্ডিত শান্তনম, সর্দার শার্দুল সিং একসঙ্গে অনুরোধ করতে লাগলেন দাসকে- “জেল কমিশন আসবে আপনার সামনে। আপনাকে যে কথা বলতে হবে। বমি বন্ধ করার জন্য একটু ওষুধ আর চিনির জল খেতে হবে।”
দাস তখন বললেন – “শিব শৰ্মা, সান্যাল আর ঘোষ কী বলেন?”
তাঁরা তিনজনেই ব্যগ্র হয়ে বললেন – “আমরাও তাই বলি।”
দাস রাজি হলেন ওষুধ দিয়ে সামান্য একটু সোডার জল খেতে। ভগৎ সিং-এর পিতা সর্দার বিষণ সিং নিঃশব্দে শুধু দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি কোনো কথাই বললেন না।
জেল তদন্ত কমিটির সভ্যরা লাহোর সেন্ট্রাল জেলে এসে বন্দীদের সঙ্গে দেখা করলেন। দীর্ঘ আলোচনার পরে তাঁরা কথা দিলেন যে, লাহোর-বন্দীদের সমস্ত দাবীই তাঁরা সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করবেন। তাঁরা আরো বললেন যে, যতীন দাসের বিনাশর্তে মুক্তির ব্যবস্থাও তাঁরা করবেন। জেল কমিটি তাঁদের রিপোর্টে একবারও বলে নি যে যতীন্দ্রনাথকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হোক। তাঁদের অনুরোধ ছিল – গভর্নমেন্ট অবিলম্বে তাঁর মুক্তির আদেশ দিন। কিন্তু, তা আর হয় নি।
১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর প্রান্তরে বাংলা তথা ভারতের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল মীরজাফর, উমিচাঁদ, ইয়ারলতিফ, জগৎশেঠদের বিশ্বাসঘাতকতায়। কিন্তু শুধু মীরজাফররাই এদেশে জন্মেনি, ক্ষুদিরাম, ভগৎসিং, বাঘাযতীন, যতীন দাসের মতো সিংহ হৃদয় ব্যক্তিরাও জন্মেছিলেন। শৃঙ্খলিত দেশ মাতার বন্ধন মোচন করে দেশবাসীর মাথাকে বিশ্বের সামনে উঁচু করে তুলে ধরার ব্রত তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে বিপ্লবী বীর যতীন দাসের আত্মবলিদান ‘দধীচি’র তনুত্যাগের সঙ্গেই তুলনীয়।
২৭শে অক্টোবর ১৯০৪ সাল। কলকাতার শিকদার বাগানে মাতুলালয়ে ভূমিষ্ঠ হন যতীন দাস। পিতা ‘বঙ্কিমবিহারী দাস’ এবং মাতা ‘সুহাসিনী দেবী’র প্রথম সন্তান যতীন ভূমিষ্ঠ হবার পরে কিছুক্ষণ না কেঁদে নির্বাক ও নিস্পন্দ ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে নবজাতকটি ভীষণভাবে কেঁদে উঠেছিল। মনে হয় যেন শিশুটি দেশ মাতৃকার রূপধ্যানে নিমগ্ন ছিল, দেশ মাতার বন্ধন দশা অনুভব করে অবশেষে যেন ডুকরে কেঁদে উঠলো। সেই শুভমূহূর্তেই সম্ভবত ভাগ্যবিধাতা স্থির করে দিয়েছিলেন যে, দেশ মাতৃকার বন্ধন মোচন ও তাঁর ক্লেশ নিবারনের জন্য এ শিশু বলিপ্রদত্ত। মাত্র ৯ বছর বয়সেই মাতৃহারা হন যতীন। বাবা বঙ্কিমবিহারী তাঁর দুই ছেলে যতীন ও কিরণকে ভোলাবার জন্য চাঁদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলতেন, ওদের মা ওখানে রয়েছেন। বাবার কাছেই যতীন ও কিরণ ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মানিকতলার বোমা তৈরীর কাহিনী এবং রাজপুত বীরদের গল্প শুনেছিলেন। আবার ১৯০৮ সালে কানাই ও সত্যেনের দ্বারা আলিপুর জেলের মধ্যেই রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইকে গুলি করে হত্যা করার ফলশ্রুতিতে কানাইলাল দত্তের নির্ভিকভাবে ফাঁসি বরনের মতন কাহিনীও শুনেছিলেন। এসব কাহিনী শিশু যতীন দাসের মনে অতি শৈশবেই বিপ্লবের বারুদ প্রস্তুত করেছিল। বাবার মতই অনমনীয় স্বভাবের হয়ে উঠেছিলেন যতীন। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেওঘরে মামার বাড়িতে একবার বেড়াতে গিয়েছিলেন যতীন। অন্য ছেলেদের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ শখ হল ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পানসীতে তাঁরা চড়বেন। মালী বাঁধা দিয়ে জানালো, হুকুম নেই। ক্রুদ্ধ যতীন একদিন মাঝরাতে এসে সেই পানসিটা দীঘির মাঝখানে রেখে যান।
১৯০৮ সাল থেকে ১৯২০ সাল। এই সময়টা ছিল তাঁর বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্ব। একদিকে শাসক ইংরেজদের কঠোর নির্যাতন, অন্যদিকে বাংলার যুবক দলের দেশমাতৃকার পায়ে আত্মনিবেদন। শুধু বাংলার নয় বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে মেতে উঠেছিল পাঞ্জাবও। পাঞ্জাবের গদর বিপ্লবের প্রস্তুতি; কর্তার সিং এর ফাঁসি বরণ; উড়িষ্যার বুড়িবালাম নদীর তীরে মাত্র চারজন সহকর্মী নিয়ে বাঘা যতীনের দেড়হাজার সশস্ত্র পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই যতীন দাসের মনে বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্র ছোঁয়া দিয়ে গিয়েছিল মাত্র এগারো বছর বয়সেই। যতীন যেমন মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তেমনি শারীরিক দিক থেকেও ছিলেন বলিষ্ঠ। কুস্তির আড্ডায় যাওয়া, ফুটবল খেলা, নিয়মিত ব্যায়াম অনুশীলন করা – এগুলো তাঁর রুটিন ছিল। তিনি ভোজনরসিকও ছিলেন।
১৯২১ সাল থেকে ১৯২৮ সাল। স্কুলে পড়তে পড়তেই অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়ে বিপ্লবী জীবন শুরু। পরে তিনি মহাত্মা গান্ধীর ডাকে যোগ দেন অসহযোগ আন্দোলনে। এই আন্দোলন করতে গিয়েই গ্রেফতার হন প্রথম বার। সময়টা ১৯২১ সাল। সেই তাঁর প্রথম জেলে যাওয়া। সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘‘আমার মনে আছে, ১৯২১ সালে পূজার ঠিক আগে আমরা যখন রসা রোডে কাপড়ের দোকানের সামনে পিকেটিং করি, তখন তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অনেকের মতো তাঁকেও জেলে পাঠানো হয়, কিন্তু মুক্তিলাভের পর তিনি নিজেকে সক্রিয়ভাবে দেশের কাজে নিয়োজিত রাখেন, অনেকেই যা করেননি।’’ পরে সুভাষচন্দ্রের হাতে গড়া ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ দলে তিনি মেজরের পদ পান। ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশান থেকে ১৯২১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন প্রথম বিভাগে। সে সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন গান্ধীজি। ইতি পূর্বেই রাওলাট আইনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নৃশংস জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড ঘটে গেছে। ১৯১৯ সালেই সেই কুখ্যাত রাওলাট অ্যাক্ট পাশ করিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতেই অসহযোগ আন্দোলন। যুগের দাবীতে স্বাভাবিকভাবেই যতীন দাসও এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। বাবার নিষেধ অমান্য করে মিছিলে গিয়ে একাধিক বার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। দোকানে পিকেটিং করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ছয় মাস কারাদন্ড ভোগ করতে হয়। মেয়াদ পূর্তির আগেই ছাড়া পেয়ে যতীন আবার কংগ্রেসে যোগ দিলেন। বাবা এ সময় কড়াভাবে পড়াশুনো ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করলে ষোল বছরের যতীন দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, “পড়াশুনো নিশ্চই করবো, কিন্তু দেশের কাজের ডাক এসেছে যখন, সে কাজ ছাড়তে পারবো না।’’ বাবা রেগে গিয়ে বেরিয়ে যেতে বললে, তিনি এক কাপড়ে দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস অফিসে গিয়ে উঠেছিলেন। এই সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌছেছিল। হয়তো সেদিন একজোট হয়ে লড়লে ব্রিটিশদের উৎখাত করাও অসম্ভব হত না। কিন্তু চৌরিচৌরার সামান্য একটা ঘটনাকে অযুহাত করে গান্ধিজী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে হতাশ যতীন গান্ধিজীকে আর নির্ভরযোগ্য নেতা মনে করতে পারেন নি। তিনি এরপরে বাড়ি ফিরে এলেন। দেশকে ভালবাসা, দেশের মানুষকে ভালবাসা, প্রয়োজনের তাঁদের জন্যে আত্মোৎসর্গ করা এগুলোই ছিল যতীনের ধ্যান-জ্ঞাণ-প্রেম। বিদ্যালয়ে পাঠকালেই কিশোর যতীন দাস কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি মহামারীর প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে আর্ত অসহায় জনগনের সেবা করতেন একনিষ্ঠ ভাবে। বঙ্গবাসী কলেজ বি. এ. ক্লাসে পড়ার সময়েও যতীন পাড়ায় পাড়ায়, বস্তিতে বস্তিতে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরনের যে ঐকান্তিক প্রয়াস চালাতেন, তা তুলনাহীন। সমাজ সেবার কাজেই যতীনদাসকে কখনো পেছনের সারিতে দেখা যায়নি, সব সময় তিনি থাকতেন সকলের পুরোভাগে। তরুন ছাত্র যতীন দাসের এটাই ছিল চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য। ভবানীপুরের গিরীশ মুখার্জী রোডের একটি বাড়িতে থাকাকালিন যতীন কাছেই সুবার্বান রোডের জনৈক দেবেন বোসের বাড়িতে নিয়মিত যেতেন। এখানেই তিনি পরিচিত হন রাসবিহারী বসুর শিষ্য ও সহকর্মী বিপ্লবী নেতা শচীন্দ্র চন্দ্র সান্যালের সঙ্গে। ইস্পাত কঠিন দৃঢ় মানসিকতার যতীনদাসকে চিনতে ভুল করেননি বিচক্ষন শচীন স্যান্যাল। তাঁর গড়া হিন্দুস্থান রিপাবরিক্যান এ্যাসোসিয়েশনে কুড়ি বছরের যুবক যতীনকে অন্যতম সহকর্মী হিসেবে তিনি টেনে নেন। বঙ্গদেশে ‘Hindustan Republican Association’ বা সংক্ষেপে ‘H.R.A.’ এর বৈপ্লবিক সংগঠন কার্যের সকল দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল ঋজু ব্যক্তিসম্পন্ন তরুন বিপ্লবী বীর যতীন দাসের ওপর। এই সংগঠনে, সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা স্থির করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যতীনদাস ছিলেন দলের বৈজ্ঞানিক নেতা। তিনি বোমা তৈরী করতে পারতেন এবং সদস্যদের বোমা বানানো শেখাতেনও। তাছাড়া দলের প্রয়োজনে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের বিরাট দায়িত্ব তিনি পালন করতেন। কখনো ‘রহমৎ’ নাম নিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করতেন কখনো ‘রবীন’ নাম নিয়ে দলের নেতৃত্ব দিতেন আবার কখনো বা ডাকাতি করে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করতে হতো। অবশ্য এতে কোন সাধারণ ব্যক্তি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ হতেন না। শচীন্দ্রনাথ সান্নালের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সান্যাল লিখেছেন, “… রবীন দুঃসাহসী ছিল। তাকে দেখে মনে হত বিপদের পথে পা বাড়াতে সে সর্বদাই প্রস্তুত।” বস্তুতঃ, জীবনমৃত্যু কে পায়ের ভৃত্য করেই লৌহ মানব যতীনদাস বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। অবশ্য কংগ্রেস কমিটির সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল। এই সূত্রে সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও হয়। ১৯২৪ সালে দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস কমিটির তিনি সহ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সময়ে উত্তর বঙ্গে বিধ্বংসী বন্যায় ত্রাণ কার্যের জন্যে সুভাষ চন্দ্রের নেতৃত্বে যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়, সেই বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিলেন যতীনদাস। যতীনদাস খেতে ভালবাসতেন, আর অদৃষ্ঠের এমনই পরিহাস যে অনশনেই তাঁর জীবনাবসান হয়। জেলে তিনি মোট দুবার অনশন করেছিলেন রাজ বন্দীদের প্রতি অত্যন্ত দুর্ব্যবহারের প্রতিবারে। এর মধ্যে প্রথমবার অনশন সংক্রান্ত আলোচানা প্রসঙ্গে ‘কাকোরী মামলা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার। ১৯২৪ সালের ২৪শে অক্টোবরে ‘Bengal Ordinance’ জারী করা হয় নির্বিচারে সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তারের জন্যে। বিপ্লবী দল সংগঠনকে টিকিয়ে রাখতে অর্থ সংগ্রহের জন্যে যে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে, তার মধ্যে দুঃসাহসিক অভিযান হলো কাকোরী স্টেশনের কাছে ট্রেন ডাকাতি। প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা ব্রেকভ্যানের লোহার সিন্দুক ভেঙে তাঁরা সংগ্রহ করেছিল। এই ডাকাতির ব্যাপারে অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন বিপ্লবী যতীনদাস ‘কালীবাবু’ ছদ্মনামে। অবশ্য আর. হটন নামে উচ্চ পদস্থ গোয়েন্দা অফিসারের তৎপরতায় বিপ্লবী দলের অনেকেই ধরা পড়ে যান। এই মামলার বিচারে রামপ্রসাদ বিসমিল, রোশন সিং প্রমুখের ফাঁসি এবং শচীন সান্যাল, যোগেশ চ্যাটার্জী প্রমুখের যাবজ্জীবণ দীপান্তর হয়। ‘Bengal Ordinance’ এর আওতায় যতীন দাসকেও গ্রেপ্তার করে প্রথমে মেদিনীপুর জেলের কুখ্যাত ৪৪ নং সেলে জানালাবিহীন ঘরে রাখা হয়। তিনি সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে আলিপুর জেলে স্থানান্তর করা হয় ১৯২৬ সালের ২৮শে মে। ঐ বছরের অগস্ট মাসে তাঁকে ময়মনসিংহ জেলে পাঠানো হয়। জেল কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারে যতীনদাস ও পান্নালাল মুখার্জী অনশন শুরু করেছিলেন এবং ২২ দিন অনশনের পর গোয়েন্দা বিভাগের ডি.আই.জি. লেম্যানের হস্তক্ষেপে তাঁরা অনশন ভঙ্গ করেন। কিছুকাল পাঞ্জাবের দুর্গম সিয়ানওয়ালি জেলে, আবার কিছুকাল চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে অন্তরীন থাকার পর ১৯২৮ সালের অক্টোবর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরে যতীনদাস বঙ্গবাসী কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন।
১৯২৮-২৯ সাল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য সময়। সমস্ত দেশ একটা বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের জন্যে প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কলকাতার কংগ্রেস অধিবেসন তাঁদেরকে প্রচন্ড হতাশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল। সুভাষ চন্দ্র বসু এই অবস্থানকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, সমস্ত দেশ যখন তৈরী, তখন নেতারা তৈরী নন। দেশের দুর্ভাগ্য যে মহাত্মা গান্ধী কোনো আলো দেখতে পেলেন না। এই সময় পাঞ্জাবে ভগৎ সিং, বাংলায় সতীশ পাকরাশি, যতীনদাস, সূর্যসেন, অম্বিকা চক্রবর্তী প্রমুখ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতা আনার পরিকল্পনা করেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় সাইমন কমিশনের বিরোধীতায় আন্দোলন পরিচালনা। ১৯২৭ সালের ১০ই নভেম্বর সাইমন কমিশন গঠিত হয় সরকারকে শাসনতন্ত্র সংশোধনের ব্যপারে পরামর্শ দানের জন্যে। ১৯২৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী এই কমিশন কলকাতায় এলে কংগ্রেস কমিটির নির্দেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এই কমিশান ৩০শে অক্টোবর লাহোরে এলে লালা লাজপত রাইয়ের নেতৃত্বে এক বিরাট শোভা যাত্রা স্টেশান অবরোধ করে ধ্বনি তুললো ‘গো ব্যাক সাইমন’। এরপরে পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গুরুতরভাবে আহত হয়ে ১৭ই নভেম্বর লাজপৎ রাইয়ের মৃত্যু। এরপরেই ১৭ই ডিসেম্বর লাহোরের প্রধান সড়কে ভগৎ সিং ও রাজগুরু, দয়ানন্দ বৈদিক মহাবিদ্যালয়ের সামনে স্কটকে না পেলেও তাঁর সহকারী স্যান্ডার্স কে গুলি করে হত্যা করেন। স্যান্ডার্সের হেড কনস্টেবল ‘চন্দন সিং’ স্যান্ডার্স কে সাহায্যার্থে এগিয়ে এলে ভগৎ সিং তাঁকেও গুলি করে ভূপাতিত করেন। এটা যে সাধারণ খুন নয়, সাধারণকে তা বোঝাতে প্রচুর ইস্তেহার ছড়িয়ে বিপ্লবীরা লাহোর থেকে সরে পড়েন। কলকাতয় এসে ভগৎ সিং যতীনদাসের সঙ্গে দেখা করে বিপ্লবীদের জন্য বোমা তৈরীর কাজে সাহায্য করতে অনুরোধ করেন। যতীন দাস রাজি হন। বাংলায় যতীন দাসকে যখন খুবই প্রয়োজন ছিল, সেই সময় কেবলমাত্র ভগৎ সিং এর অনুরোধে তিনি আগ্রা গেলেন বোমা তৈরী করতে ও শেখাতে। দলের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক আগ্রায় এলেন ট্রেনিং নিতে। ঝাঁসির জঙ্গলে বোমা পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত ও বিজয় কুমার সিংহ নির্জনে একটা বাড়ি ভাড়া করলেন। সেখানেই এলেন যতীন্দ্রনাথ দাস। যতীন দাসকে ঘিরে চারিদিকে কড়া পাহাড়া। তাঁর কাছেই ট্রেনিং নিয়ে শুখদেব গেলেন লাহোরে, আর শিব বর্মা গেলেন সাহারানপুরে, যেখানে আরো দুটো গোপন বোমার কারখানা খোলা হয়েছিল। এরপরেই ঘটেছিল দিল্লির সেন্ট্রাল এসেম্বলিতে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের বোমা নিক্ষেপের ঘটনা (৮ই এপ্রিল ১৯২৯ সাল)। তারপরের ঘটনাবলী নিম্নরূপ –
১৪ই জুন ১৯২৯ সাল। সকালে হাজরা রোডে পুলিশ যতীন দাসকে গ্রেপ্তার করে। প্রথমে তাঁকে পত্রপাঠ পাঠানো হয় লাহোর পুলিশ ফাঁড়িতে। পরে লাহোর বোস্টাল জেলে তাঁকে আটক করা হয় অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে।
১০ই জুলাই ১৯২৯ সাল। ব্রিটিশ সরকার ও পুলিশ খাড়া করলো ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’– যার মূল অভিযোগ স্যান্ডার্স কে হত্যা।
১৩ই জুলাই – ১৫ ই জুলাই ১৯২৯ সাল। দিল্লীর বোমার মামলায় ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছিল। ১৩ই জুলাই, ভগৎ সিংকে পাঠানো হল লাহোর সেন্ট্রাল জেলে, আর বটুকেশ্বর দত্তকে পাঞ্জাবের সিয়ানওয়ালি জেলে। জেলের ভেতরে তাঁদের চোর – ডাকাতের সঙ্গে থাকতে হত, অখাদ্য খাবার দেওয়া হত। তেল, সাবান বা কোনো প্রসাধনী দ্রব্যই ব্যবহার করতে দেওয়া হত না। খবরের কাগেজ, বই ইত্যাদি পড়ার সুযোগ দেওয়া হত না। জেলার ও ওয়ার্ডার তাঁদের সঙ্গে অপমানজনক ব্যবহার করতো। এই পরিস্থিতি তে অনেক বন্দী দীর্ঘকাল কারাবাসের পর উন্মাদ পর্যন্ত হয়ে গেছে। অথচ ইউরোপীয় চোর ডাকাতরাও জেলে অনেক ভদ্র পরিবেশ পেত, ভদ্র ব্যবহার পেত। ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত এর প্রতিবাদ করলে তাঁদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ১৫ই জুলাই থেকে তাঁরা আমরন অনশন শুরু করেন দুজনে স্বতন্ত্র জেলে থেকেও। এদিকে তখন যতীন দাসকে গ্রেপ্তারের পর বিচারের নামে নানা প্রহসন শুরু হয়েছে। লাহোর মামলার অন্যান্য অভিযুক্তেরা ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের সঙ্গে দেখা হবার পর তাঁরাও অনশনে যোগ দেবে কিনা যখন ভাবছিলেন, তখন আপত্তি একজনই করেছিলেন – তিনি স্বয়ং যতীন দাস। কারণ ইতিপূর্বে অনশনের তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল। তাছাড়া নির্মম ব্রিটিশ সরকার সম্বন্ধে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল যে, সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়বে না, সেটাও তিনি স্মরণ করিয়েছিলেন। অন্য বন্দীদের উৎসাহ তখন এতই প্রবল ছিল যে যতীনদাসের সতর্ক বানীতে তাঁরা কর্ণপাত করেননি। যতীনদাস শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনশন ধর্মঘটে যোগ দিলেন কিন্তু দৃঢ়চরিত্রের যতীন এটাও জানিয়েছিলেন যে, তিনি আমৃত্যু অনশন গ্রহণ করলেন। দাবি পূরণ না হলে তিনি প্রাণ গেলেও অনশন ভাঙবেন না। ‘হয় ব্রত সাধন, নয় মৃত্যু বরণ’ – এটাই ছিল যতীনের সংকল্প। সমগ্র দেশের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো লাহোরের বিখ্যাত বোস্টাল জেলের মধ্যে বাংলা মায়ের এই তাজা তরুণ সন্তানের দিকে। যতদিন যায়, বিপ্লবী বীর যতীনদাসের মনের বল ততই বাড়তে থাকে। ততই তিনি নির্ভীকরূপ ধারণ করতে থাকেন। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় সংবাদপত্রের বিশেষ সংষ্করণের প্রতি দেশ সাগ্রহে উতকন্ঠিত অবস্থায় অপেক্ষা করে থাকে – যদি ইংরেজ সরকার তরুন প্রাণের আদর্শের মর্যাদা দিতে এগিয়ে আসে। হায়! পররাষ্ট্রলোভী দাম্ভিক, নির্মম, ব্রিটিশ সরকার! শুভ জন্মক্ষণে যে শিশু ক্রন্দন রহিত ছিল, দেশমাতৃকার ক্লান্তি মোচনের উদ্দেশ্যে সেই শিশুই নবীণ যোদ্ধারূপে ধীর-স্থির-অচল-অটল থেকে তিলে তিলে, – দেশের সকল স্তরের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অনুরোধ, উপরোধ উপেক্ষা করে ৬৩ দিন অনশনের পর একমাত্র সহোদর কিরণচন্দ্র ও কয়েকজন বাঙালী সহকর্মীর নিবিড় সান্নিধ্যে দেশের জন্য তাঁর অমূল্য প্রাণ দান করলেন। শোকে, মূহ্যমান সমগ্র দেশ এই দামাল সন্তানকে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী বীর শহীদ’ আখ্যায় ভূষিত করল।
১২ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সাল। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম বন্দি অজয় ঘোষ লিখেছিলেন, ‘‘হাসপাতালে এসে দেখলাম যতীন দাস একটা ছোট্ট খাটিয়ায় শুয়ে আছে। তখনও তাঁর জ্ঞান হয়নি। ডাক্তাররা আশঙ্কা করছেন, হয়তো রাত কাটবে না।’’
১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সাল। জেলের ভেতরে হাসপাতালে সেদিন ডাক্তার আর অফিসারদের ভিড়। স্তব্ধ হয়ে এসে দাঁড়ালেন বন্ধুরা – বিজয় কুমার সিংহ, জিতেন্দ্র নাথ সান্নাল ও অজয় ঘোষ। সূর্য একটু একটু করে উঠছে আকাশের উর্দ্ধে। একটু একটু করে ছিড়ে যাচ্ছে পরাধীনতার গ্লানির শৃঙ্খলাগুলো। কে যেন গাইতে লাগলো অতি মৃদুস্বরে – ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে …’
দুপুর ১টা বেজে ৫ মিনিট, একাই তিনি চলে গেলেন। স্তব্ধ বিষন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লাহোর বোস্টাল জেলের সকলে।
তৎকালীন ভাইসরয়ের অফিস থেকে লন্ডনে বার্তা গেল, “ষড়যন্ত্র মামলার মিস্টার দাস, পাঁচজনের মধ্যে যিনি অনশন করছিলেন, আজ দুপুরের পরে বেলা ১টার সময় মারা গেছেন।’’ এই মৃত্যুর প্রতিবাদে মহম্মদ আলম এবং গোঁপী চাঁদ ভার্গব পাঞ্জাব লেজিসলেটিভ কিউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন। মতিলাল নেহেরু লাহোর জেলে বন্দীদের ওপরে অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিবাদস্বরূপ কেন্দ্রীয় সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে মুলতুবি প্রস্তাব রাখেন।
রক্ত গোলাপের স্তুপে ঢেকে দেওয়া হল যতীন্দ্রনাথের নশ্বর দেহ। তারপর রাজবন্দীরাই বহন করে নিয়ে গেলেন জেল গেট পর্যন্ত। বাইরে পাঞ্জবের নেতৃবৃন্দ অপেক্ষা করছেন জনতার পুরোভাগে। প্রতিটি মানুষের চোখ জলে ভরা। এমন কি সেই ক্রুর হৃদয় কয়েদী ও ওয়ার্ডারদের চোখও অশ্রুসিক্ত। তাঁরাও শহীদ যতীনদাসের দেহকে বহন করে ধন্য হতে চাইলো। জেল গেটের বাইরে অপেক্ষমান জনতার সামনে এসে দাঁড়ালেন লাহোরের তৎকালীন পুলিশ সুপারইনটেনডেন্ট হ্যামিলটন হার্ডিং। নিজের হ্যাট খুলে তিনি শহীদের অপরাজিত আত্মাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন।
বিকেল চারটে, শহীদের দেহকে বহন করে এক অভূতপূর্ব শোভাযাত্রা শহরের পথে অগ্রসর হলো। বিশাল জনতা শোকে মূহ্যমান। অন্ততঃ পঞ্চাশ হাজার লোকের বিশাল মিছিল এবং প্রায় এক মাইল লম্বা। ইতস্ততঃ চোখে পড়ছে বড় বড় করে লেখা ব্যানার – ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘স্বাধীনতা আমাদের চাইই’। লাহোরের মানুষের স্বতঃপ্রণোদিত যে আবেগের প্রকাশ সেদিন ঘটেছিল, তা অবিস্মরণীয়।
শোকে মূহ্যমাণ হয়ে গেল কলকাতাও। দক্ষিণ কলকাতার সমস্ত দোকান পাট বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত। ছাত্ররা কালো পতাকা হাতে দলে দলে মিছিলে বেড়িয়ে পড়লো। সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ল। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমস্ত অনুষ্ঠান বাতিল করে কলকাতায় দ্রুত ফিরে এসেই ‘বি.পি.সি.সি’.-র সভাপতি হিসেবে ১৫ই সেপ্টেম্বরকে শোক দিবস হিসেবে পালন করার জন্য ডাক দিলেন।
যতীনদাসের মরদেহ নিয়ে ‘লাহোর এক্সপ্রেস’ বিকেলে দিল্লী পৌঁছনোর পর, সমগ্র দিল্লী শহর যেন ভেঙে পড়লো স্টেশনে। ফুল আর ফুলের মালা দিয়ে আগত অগনিত মানুষের মুখে ধ্বনিত হল, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ‘যতীন দাস জিন্দাবাদ’।
১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সাল। রাত্রি আড়াইটে। ট্রেন কানপুরে পৌছলে বিপুল জনতার সামনে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু যতীন দাসের মরদেহের সামনে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সময় জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, “ভারতীয় বীরদের বিরাট ভূমিকার বীরগাঁথায় আরেকটি নাম যুক্ত হল। আমরা যেন আমাদের মাথা নত করি আর যেন প্রার্থনা করি সেই শক্তিকে পাবার জন্যে যাতে সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, যতই সময় লাগুক না কেন বা যাই এর ফলাফল হোক না কেন, আমাদের জয় নিশ্চিত হবেই।”
বিকেল তিনটে। হাওড়া স্টেশনের অবস্থা ছিল আরও উত্তাল। দুর্বার জনস্রোত তখন প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করে নীচের ইয়ার্ডে ছড়িয়ে গেছে। স্টেশনে কোথাও তিল ধারনের জায়গা ছিল না। শুধুমাত্র একটুখানি ঘেরা জায়গায় (স্বেচ্ছা সেবকদের দ্বারা ঘেরা) অপেক্ষা করছিলেন শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী, নেলী সেনগুপ্তা, কমলা নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় প্রমুখ বিশিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ। সকলেই নগ্নপদ ও শোকার্ত। প্রথমে শহীদ যতীন দাসের মরদেহ টাউন হলে নিয়ে যাওয়া হলে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান বরদাপ্রসন্ন পাইন-এর নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানানো হয় অমর শহীদের উদ্দেশ্যে। কলকাতার তৎকালীন মহানাগরিক যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত বলেছিলেন, “অন্য কোনও দেশ হলে তিনি দেবতার সম্মান পেতেন। ভারতবাসীর কাছে তিনি এখন পূজ্য।” পিতা বঙ্কিমবিহারী দাসের সঙ্গে দেখা করতে যাঁরা কিরণচন্দ্রের সঙ্গে এসেছিলেন, বাহান্ন বছরের বৃদ্ধ বঙ্কিমবাবু তাঁদের শান্তভাবেই গ্রহণ করে বলেছিলেন, “আমার সন্তানের জন্য আমি গর্বিত। আমি আজ সবচেয়ে ভাগ্যবান পিতা।”
শহীদ যতীনদাসের শবদেহে বহন করে যে বিরাট শোভাযাত্রা কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে অগ্রসর হয়েছিল, তার তুলনা হিসাবে বলা চলে, একমাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের শবদেহ বহনের সময়েই এরূপ জনসমাগম ঘটেছিল। সরকারী রিপোর্ট অনুসারে অন্ততঃ পাঁচ লক্ষ লোক সমবেত হয়েছিল। শোভাযাত্রার সামনে মহিলা ও বালিকাদের দল গাইতে গাইতে চলেছিল, ‘রক্তে আমরার লেগেছে যে আজ সর্বনাশের নেশা …’। শ্মশানে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিশিষ্ঠ নেতৃবর্গ। নতুন করে আবার ফুলে ফুলে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল তাঁর দেহ। শঙ্খধ্বনি ও বিউগলের সঙ্গীত বেজে উঠেছিল। নতজানু হয়ে সুভাষচন্দ্র বসু শহীদ যতীনদাসের পদধূলি নিয়ে নিজের কপালে লেপন করেছিলেন, যেন বীরের আত্মত্যাগ ও প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তাকে তিনি গ্রহণ করলেন যতীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। চন্দনকাঠের চিতা ওপর যখন তাঁর দেহ তোলা হল, তখন পিতা বঙ্কিম বিহারী দাসের বানী পাঠ করলেন শ্রীহেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত – ‘‘ওঁ নারায়ণ! যে বিশ্বাসঘাতকতায় মগ্ন হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছিল, তারই প্রায়চিত্ত স্বরূপ আমি আমার আদরের পুত্রকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। অশ্রুজল ভিজিয়ে আমার খেঁদুকে তোমার পায়ে সমর্পণ করলাম। তার এই আত্ম বিনাশের মধ্য দিয়ে সমগ্র ভারত যেন জেগে ওঠে।”
যতীনের মৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘‘দুঃখের মন্থন বেগে উঠিবে অমৃত,
শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।’’
মৃত্যুর পরে তাঁকে নিয়ে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় লেখা হয়, ‘‘অনশনে জলমাত্র পান না করিয়া তেষট্টি দিন ধরিয়া মৃত্যুর আবাহন! তিনি অমৃতস্য পুত্রাঃ।’’ ‘প্রবাসী’-তে লেখা হয়েছিল, ‘‘তেষট্টি দিন ধরিয়া তিনি মৃত্যুকে ধীর পদক্ষেপে ক্রমশ নিকটবর্তী হইতে দেখিয়াছেন। কিন্তু ভীত, বিচলিত হন নাই। ধন্য তাঁহার দৃঢ়তা।’’ তাঁকে ‘অতিমানবিক’ বলেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেও হাঁপ ছাড়তে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। নিষিদ্ধ করেছিল কাজী নজরুলের ‘প্রলয়শিখা’ কাব্যগ্রন্থটি। যার অন্যতম কবিতাটির নাম ছিল ‘যতীন দাস’। বিপ্লবী নায়ক শ্ৰীভূপেন রক্ষিত রায় তাঁর গ্রন্থ ‘সবার অলক্ষ্যে’তে লিখেছেন, ‘‘বাংলা তথা ভারতের বিপ্লবযুগের প্রধান অবদান হল ‘মার্টারডম’ বা আত্মদানের শিক্ষা। ‘ভাবনাহীন চিত্তে’ জীবন ও মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্যরূপে গ্রহণ করবার তত্ত্ব পরিস্ফুট হয়েছে অজস্ৰ বিপ্লবী শহিদের আত্মোৎসর্গে শতসহস্ৰ বিপ্লবী-কর্মীর দুর্জয় কর্মকাণ্ডে, বিপ্লবীর সাহস, মৃত্যুভয়হীনতা, কর্মনিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা ও বৃহৎ-এর পানে সমুন্নত দৃষ্টিই জাতির বেঁচে থাকার সঞ্চয়। বিপ্লবের ইতিহাস মিউজিয়ামে যত্ন করে তুলে রাখার বস্তু নয়, ইহা জীবনপথে নিত্য কাজে লাগাবার সম্পদ।’’ বিপ্লব জাতিকে নেতিবাদ শেখায় না, সে যা দেয় তা ‘ডিরেক্ট’ ও ‘পজিটিভ’। বিপ্লবী শুধু ধ্বংসের বার্তা শোনান না। তাঁর কণ্ঠে একই সঙ্গে ধ্বনিত হয় ধ্বংস ও সৃষ্টির আহ্বান। তাঁর বাণী তাই চিরন্তন। সে-বাণী লালন করতে হয় সুখে-দুঃখে, সম্পদে-বিপদে সর্বক্ষণ।
(তথ্যসূত্র:
১- বিপ্লবী যতীন দাস, শেখ রফিক ও মিফতাহুর রহমান চৌধুরী, বিপ্লবীদের কথা।
২- The Martyr: Bhagat Singh Experiments in Revolution, Kuldip Nayar, Har-Anand Publications (২০০০)।
৩- Filming Reality: The Independent Documentary Movement in India by Shoma A. Chatterji (২০১৫)।
৪- আজকাল পত্রিকা, ২রা সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল।
৫- ‘শহীন যতীনদস ও ভারতের বিপ্লব আন্দোলন’, সন্তোষ কুমার অধিকারী।
৬- ড. প্রেম দত্ত বর্মা, পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি উইকলি বুলেটিন, ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৪।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত