সুকুমারের ‘আবোল তাবোল’ কবিতার শেষের দু’লাইন ছিল,
“ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গ মোর।”
এটি বাস্তবায়িত করেই সুকুমার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ১৯২১ সালেই তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। এর চিকিৎসা তখনও অধরাই ছিল। শেষের আড়াই বছর তার অধিকাংশ সময়েই কেটেছে রোগশয্যায়। পুত্র সত্যজিৎ লিখেছেন, “… রুগ্ন অবস্থাতেও তাঁর কাজের পরিমাণ ও উৎকর্ষ দেখলে অবাক হতে হয়। শুধু লেখা বা আঁকার কাজেই নয়, ছাপার কাজেও যে তিনি অসুখের মধ্যে অনেক চিন্তা ব্যয় করেছেন তারও প্রমাণ রয়েছে। একটি নোটবুকে তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটি মুদ্রণ পদ্ধতির তালিকা রয়েছে। এগুলি পেটেন্ট নেবার পরিকল্পনা তাঁর মনে ছিল, কিন্তু কাজে হয়ে ওঠে নি।”
তাঁর অসুখের কোনও চিকিৎসা নেই এবং মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও অসাধারণ মানসিক স্থৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন সুকুমার। প্রকৃত কর্মযোগীর মত অবিচলিতভাবে তিনি তার নিজের কাজ করে গিয়েছেন। লীলা মজুমদারের স্মৃতিচারণ, “শুনলাম রোগের নাম কালাজ্বর। তার তখন কোন ভাল চিকিৎসা ছিল না। চোখের সামনে একটু একটু করে বড়দার শরীর ভাঙতে লাগল …। তার আগের বছরেই বড় বৌঠানের একটি সুন্দর ছেলে হয়েছিল, ঘটা করে তাঁর নামকরণ হয়েছিল … ছেলের নাম সত্যজিৎ। ডাক নাম মানিক।”
এসময় রবীন্দ্রনাথ এসে মৃত্যুপথযাত্রী তাঁর ‘যুবক বন্ধু’কে মাঝে মাঝে দেখে যেতেন। একবার সুকুমারের ইচ্ছে হয় তিনি কবির স্বকন্ঠে গান শুনবেন। এলেন রবীন্দ্রনাথ। সুকুমারের অনুরোধে শোনালেন – ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’, ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’, ‘দুঃখ এ নয় সুখ নহে গো গভীর শান্তি এ যে’ গান কয়টি। এ প্রসঙ্গে সুকুমারের খুড়তুতো বোন মাধুরীলতা (খুল্লতাত কুলদারঞ্জনের দুই মেয়ে – ইলা ও মাধুরীলতা) বলেছেন, “গানের পর গান চলিল, সকলে তন্ময় হইয়া গান শুনিতে লাগিল। দাদার প্রশান্ত মুখখানি দেখিয়া মনে হইতেছিল যে তিনি পরম শান্তি লাভ করিয়াছেন।”
নিজের রোগশয্যায় শুয়েই তিনি রচনা করেছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অতীত ইতিহাস নিয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘অতীতের ছবি’। ১৯২২-এর মাঘোৎসবে সমাজের বালক-বালিকাদের মধ্যে এটি বিতরণ করা হয়েছিল। ভাবগম্ভীর এই দীর্ঘ রচনাটি ছোটদের কতটা স্পর্শ করেছিল বলা যায় না; তবে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির নাম এতে উল্লেখিত হয়েছে এবং সুকুমারের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মমত লেখাটিতে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তাঁর হতাশার চিহ্নও স্পষ্ট। কবিতাটির কিছু অংশ এইরূপ –
“ছিল এ ভারতে এমন দিন
মানুষের মন ছিল স্বাধীন,
সহজ উদার সরল প্রাণে
বিস্ময়ে চাহিত জগত পানে।
…
অনাদি নিয়মে অনাদি স্রোতে
ভাসিয়া চলেছে অকূল পথে
প্রতি ধূলিকণা নিখিল টানে
এক হতে চায় একেরই পানে,
অজর অমর অরূপ রূপ
নহি আমি এই জড়ের স্তূপ
দেহ নহে মোর চির-নিবাস
দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ।
…
কালচক্রে হায় এমন দেশে
ঘোর দুঃখদিন আসিল শেষে।
দশদিক হতে আঁধার আসি
ভারত আকাশ ফেলিল গ্রাসি।”
১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ১০০নং গড়পার রোডের বাড়িতে বিদায় নিলেন সুকুমার। লীলা মজুমদারের কলমে, “… কত ইচ্ছা, কত আশা। … মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে বড়দা তাঁর সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। … জীবনে এই প্রথম ব্যক্তিগত শোকের আঘাত বুঝলাম।”
সুকুমার রায়ের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা এক অর্থে সৌভাগ্যবান, কারণ জীবনে বন্ধুর চলার পথকে তিনি মসৃণ করে দিয়েছিলেন তার স্বতঃস্ফূর্ত হাস্যরসের সঞ্জীবন ধারায়। সে সময়ের বহু মানুষের স্মৃতিতে বিধৃত রয়েছে তার রসসৃষ্টির টুকরো টুকরো উদাহরণ। লেখক কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “সেদিন তাঁর এক লেখার-খাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখি প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে, ‘নোটিস, এই খাতা হারাইলে কাহারও নিস্তার নাই, আদায় না করিয়া ছাড়িব না – না পাইলে গালি দিব’।”
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সুগায়িকা ভাগ্নি সাহানা দেবী (বসু) লিখেছেন, “১৯১৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী (৬ই ফাল্গুন) রসা রোডের বাড়িতে আমার বিবাহ হয় ডাঃ বিজয়কুমার বসুর সঙ্গে। মনে আছে বিয়ের পরের দিন মামাবাড়ির সুবৃহৎ বৈঠকখানার ঘরে আমাদের পিসতুতো ভগ্নীপতি তাতাবাবু (সুকুমার রায়) কি রকম জমিয়েছিলেন তাঁর ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’র পাণ্ডুলিপি আবৃত্তি করে এবং তাঁরই অন্যান্য লেখা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে। এখনও কানে বাজে সেই অসাধারণ একেবারে নিজস্ব ঢঙে এই লাইনগুলি তাঁর পড়া –
“কাছে এসে ঘেঁষে ঘেঁষে
হেসে হেসে কেশে কেশে
এত ভালো বেসে বেসে
টাকা মেরে পালালি শেষে …”
ঘরভর্তি লোক সেদিন কি হাসিটাই হেসেছিলেন। কি অদ্ভুত ঢঙই যে ছিল তাতাবাবুর এসব পড়ার। ওরকম আর শুনিনি। অমন প্রতিভা আর হল না।”
সুকুমার কলেজে পড়ার সময়েই ‘ননসেন্সে ক্লাব’ গড়ে তোলেন। এর মুখপত্র ছিল ‘৩২II ভাজা’ (সাড়ে বত্রিশ ভাজা)। বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি ‘মন্ডা ক্লাব’ (ইংরেজিতে Monday Club) নামে এক সাহিত্য-আসর প্রতিষ্ঠা করেন। এটিরও মুখপত্র সাড়ে বত্রিশ ভাজা বলে উল্লেখিত হয়েছে। মনে হয়, ‘ননসেন্স ক্লাবে’র মুখপত্রটিই চালু ছিল এবং পরে সেটি ‘মন্ডা ক্লাবে’রও মুখপত্র হিসাবে গণ্য হয়। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ‘মন্ডা ক্লাবে’র সভ্য ছিলে। এঁদের মধ্যে ছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস নাগ, অজিতকুমার চক্রবর্তী, সুবিনয় রায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ক্লাবের সম্পাদক ছিলেন সুকুমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিশিরকুমার দত্ত। সভ্যদের নামের তালিকায় তাঁর নামের সঙ্গে ‘এ.বি.সি.ডি.’ এবং পাশে বন্ধনীতে ‘সম্পাদক’ ছাপা হত।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ক্লাবের তৃতীয় জন্মদিন উপলক্ষে ১৯১৮ সালের ১৮ই আগস্ট ‘মন্ডা-সম্মিলন’ নামে একটি গান রচনা করেছিলেন। সুরটি ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’-এর অনুরূপ। গানটি ছিল –
“মন্ডা-সম্মিলন
(সুর : আমাদের শান্তিনিকেতন)
আমাদের মন্ডা-সম্মিলন।
আরে না – তা’ না, না –
আমাদের Monday সম্মিলন।
আমাদের হল্লারই কুপন।
তার উড়ো চিঠির তাড়া
মোদের ঘোরায় পাড়া পাড়া,
কভু পশুশালে হাসপাতালে আজব আমন্ত্রণ।
(কভু কলেজ-ঘাটে ধাপার মাঠে ভোজের আকর্ষণ)।”
এই সম্মিলনীর আয়-ব্যয়ের একটি হিসেব ছাপা হয়েছে। হিসাবের শেষে দেখানো হয়েছে নগদ চোদ্দ আনা তখনও মজুদ আছে। সম্পাদক সেই হিসেবের নীচে লিখেছেন,
“আমার হাতে অর্থাৎ বাক্সে এই সোয়া চৌদ্দ আনা পয়সা মজুদ আছে। সভ্যেরা যদি অসভ্যের মতো খাই-খাই না করিয়া চা-বিস্কুটে খুসী থাকিতেন – যাক সে কথা বলিয়া কোন লাভ নাই।
শ্রীশিশিরকুমার দত্তদাস
অনাহারী সম্পাদক।”
এই বিবরণীতে একটি বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছিল। সেটি হল,
“আমাদের অভূতপূর্ব সম্পাদক সংসার বিমুখ ও উদাসীন হইয়া লোটাকম্বল ও চা-বিস্কুট সহযোগে বাণপ্রস্থ অবলম্বনের সংকল্প জানাইয়া, ক্লাবের মায়া কাটাইবার উদ্যোগ করিয়াছেন। তাঁহাকে উক্ত সংকল্প হইতে নিরস্ত করিবার জন্য কয়েকটি বলিষ্ঠ ভক্তের প্রয়োজন। ভক্তসভ্যগণ সত্ত্বর হউন।”
কিন্তু সংসার তিনি ত্যাগ করেন নি। কারণ, ক্লাবের যেমন তাঁকে ছাড়া চলত না, তেমনি তাঁরও ক্লাব ছাড়া চলত না। এ কারণেই একটি ‘প্রতিবাদ সভা’র চিঠি পাওয়া গিয়েছে, সেটি হ’ল –
“সম্প্রতি ক্লাবের সর্ব্বজনস্বীকৃত সম্পাদকরূপে আমি ‘অধিকারী’ উপাধি গ্রহণ করিয়াছি। ইহাতে কোন কোন ঈর্ষাপরায়ণ ‘সভ্য’ অসঙ্গতভাবে আপত্তি করিতেছেন। কালিদাসবাবু আপত্তি করিতে চান করুন, কিন্তু আমি স্বোপার্জ্জিত উপাধি ছাড়িব না।
এইরূপ অন্যায় আপত্তির বিশেষ প্রতিবাদ বাঞ্ছনীয়। অনেক হিসাব করিয়া দেখিলাম, আগামী মঙ্গলবার ২১শে আগষ্ট, বাংলা তারিখ জানি না, আমাদের ক্লাবের জন্মদিন, অর্থাৎ প্রায় জন্মদিন। ঐ দিনই সন্ধ্যার সময় ১০০নং গড়পার রোড, অর্থাৎ কালাবোবা ইস্কুলের পশ্চাতে, সুকুমারবাবু নামক ক্লাবের একজন আদিম ও প্রাচীন সভ্যের বাড়ীতে সভার আয়োজন হইয়াছে। বক্তা প্রায় সকলে, সভাপতি আপনি, বিষয় গম্ভীর – সুতরাং খুব জমিবার সম্ভাবনা।
আসিবার সময় একখানা সেকেন্ডক্লাস গাড়ী সঙ্গে আনিবেন – আমায় ফিরিবার পথে নামাইয়া দিতে হইবে। খাওয়া গুরুতর হইবার আশঙ্কা আছে।
ইতি
শশব্যস্ত –
শ্রীশিশিরকুমার দত্তাধিকারী
সুযোগ্য সম্পাদক।”
ভোজের ব্যবস্থা ছাড়া যে সাহিত্য আলোচনা নিষ্ফল, সেটা বোধ হয় সব সভ্যই মেনে নিয়েছিলেন। অপর একটি নিমন্ত্রণের চিঠি ছিল এই রকম –
“আঃ! আবার খাওয়া!!
এইত সেদিন সবাইকে বুঝিয়ে বললুম যে আর ‘খাই খাই’ ক’রো না – এর মধ্যে সুনীতিবাবু খাওয়াতে চাচ্ছেন। আমার হাতে কতকগুলো টাকা গছিয়ে দিয়ে এখন বলছেন, না খাওয়ালে জংলিবাবুকে দিয়ে মোকদ্দমা করাবেন। আমি হাতে পায়ে ধরে নিষেধ করলুম, তা তিনি কিছুতেই শুনলেন না, উলটে আমায় তেড়ে মারতে আসলেন। দেখুন দেখি কি অন্যায়! তা আপনারা যখন উপদেশমত চলবেন না, কাজেই অগত্যা সুকুমারবাবুকে বলে কয়ে এই ব্যবস্থা করে এসেছি যে তাঁর বাড়ীতে আগামী মঙ্গলবার (৩০শে জুলাই) সন্ধ্যা ৭টার সময় আপনি সুস্থদেহে হাজির হবেন। সুনীতিবাবুর ভোজের পাত সেখানেই পড়বে। এখন খুসী হলেন ত?
ত্যক্তবিরক্ত
শ্রীসম্পাদক।”
প্রায় সব নিমন্ত্রণই করা হত পদ্য লিখে। আরও কয়েকটি নিমন্ত্রণ পত্র এখানে দেওয়া হ’ল –
(১)
“আসছে কাল, শনিবার
অপরাহ্ণ সাড়ে চার,
আসিয়া মোদের বাড়ি,
কৃতার্থ করিলে সবে
টুলুপুষু খুশি হবে।”
(সুকুমারের স্ত্রী সুপ্রভার ডাক নাম ছিল টুলু এবং ভাই সুবিনয়ের স্ত্রী ছিলেন পুষ্পলতা। টুলু এবং পুষু বলতে সম্ভবত এদেরই বোঝানো হয়েছে।)
(২)
“রবিবার ১০ই চৈত্র
প্রফেসর সুরেন মৈত্র
আবাহন করেন সবে
শিবপুরে আপন ভবে
মহাশয় সময় বুঝে
চাঁদপালে জাহাজ খুঁজে
চড়িবেন যেমন রীতি
নিবেদন সাদর ইতি।”
(৩)
“শনিবার ১৭ই
সাড়ে পাঁচ বেলা,
গড়পারে হৈ হৈ
সরবতী মেলা।
অতএব ঘড়ি ধ’রে-
সাবকাশ হয়ে,
আসিবেন দয়া করে
হাসি মুখ লয়ে।
সরবৎ, সদালাপ,
সঙ্গীত ভীতি –
ফাঁকি দিলে নাহি মাপ,
জেনে রাখ – ইতি।”
(এটি ‘সরবৎ সম্মিলন’-এর নিমন্ত্রণ, কার লেখা জানা নেই। সুকুমারেরও হতে পারে)।
একদিন সম্পাদক কোথায় ডুব দিলেন জানা নেই। ‘সভ্যদের মাথায় তো প্রায় বজ্রাঘাত হবার জোগাড়। ক্লাবটিও টলমল করে উঠলো’। সে সময়ে সুকুমার রায় একটি চিঠি লিখে সেটি বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্পাদক না থাকায় চিঠির চারদিকে শোকচিহ্নস্বরূপ কালো বর্ডার ছিল। এই পদ্যটি বহুল প্রচলিত এবং অনেকেই পড়েছেন,
“সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব-
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি ত যায় যায়।
তাই বলি, সোমবারে
মদগৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধুলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।
রকমারি পুঁথি যত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে।
করজোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।”
কিন্তু ইতিমধ্যেই সম্পাদকের খোঁজ পাওয়া গেল। কাজেই এর পরের চিঠি,
“শুভ সংবাদ, সম্পাদক জীবিত আছেন। আগামী সোমবার ২৫নং সুকিয়া ষ্ট্রীটে ৬II ঘটিকায় তাঁহার শ্রীমুখচন্দ্র দর্শনার্থ ভক্ত সমাগম হইবে।”
এবার সম্পাদক ফিরে এসে নিজেই পদ্যে চিঠি লিখলেন,
“আমি অর্থাৎ সেক্রেটারি
মাস তিনেক কলকেতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে-
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে!!
বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া
কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া
চিন্তা নেইক গভীর বিষয়-
আমার প্রাণে এসব কি সয়?
এখন থেকে সমঝে রাখ
এ সমস্ত চলবে নাকো,-
আমি এবার এইছি ঘুরে
তান ধরেছি সাবেক সুরে।–
শুনবে এস সুপ্রবন্ধ
গিরিজার ‘বিবেকানন্দ’,
মঙ্গলবার আমার বাসায়-
(আর থেকো না ভোজের আশায়)।”
একটি বিষয় পরিষ্কার যে মজলিশি মেজাজে এধরণের সম্মেলন প্রায়ই হোত, এবং খুব ঘন ঘনই হোত। আলোচ্য প্রসঙ্গেই সুকুমারের ‘সম্পাদকের দশা’ কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। সেটি আর এখানে উধৃত করছি না। এটি সুকুমারের মৃত্যুর পর সুবিনয়ের সম্পাদনায় ‘সন্দেশে’র ১৩৩১ ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু শেষের কিছু অংশ বাদ দিয়ে। কবিতার শেষে সুকুমারের নিজের কিছু মন্তব্য ছিল। এই অংশটি হয়তো অনায়াসলভ্য নাও হতে পারে। সেজন্য এই বর্জিত অংশটি মন্তব্য সহ তুলে দেওয়া হল –
“হে পাঠক জ্ঞানবান, কর সবে অবধান।
উপদেশ লভ এই হয়ে অতি সাবধান।।
সম্পাদকী কাজ পাওয়া-সৌভাগ্য সে অতিশয়।
কিন্তু সেটা নহে ঠিক আদ্যোপান্ত মধুময়।।
তোমাদের সম্পাদক-সেও ত মানুষ বটে।
বৃথা যেন তার পরে অত্যাচার নাহি ঘটে।।
যদি এ পত্রিকা তব নাহি হয় মনোমত।
কিম্বা যদি “৩২II” বন্ধ থাকে মাসকত।।
কিম্বা যদি অন্যরূপে দোষত্রুটি ঘটে তবু।
সম্পাদকে গালি দেওয়া উচিত না হয় কভু।।
লেখকবৃন্দের প্রতি আছে এক নিবেদন।
না লিখেন কভু যেন গুরুপাক বিবরণ।।
পেচকের মত সবে হাঁড়িমুখ নিরবধি।
গম্ভীর গম্ভীরতম প্রবন্ধ লিখেন যদি।।
নির্ঘাৎ জানিহ তবে, ধ্রুব সত্য অতি খাঁটি।
নিস্ফূর্তি নির্জীব সভা একদম হবে মাটি।।
অতএব কহি শুন ছাড় শুষ্ক নীরবতা।
পেট ভরে হাস আর শুনাও হাসির কথা।।
নচেৎ এ সম্পাদক হতশ্বাস হয়ে শেষে।
একেবারে দিবে ছুট জনহীন দূর দেশে।।”
“উৎসাহের চোটে পদ্য লিখিয়া ফেলিলাম-লেখকগণ অতি সূক্ষ্মভাবে কবিতার ভাষাগত বা ছন্দোগত দোষ গুণ বিচার না করিয়া ইহার মর্মগ্রহণ করিতে সচেষ্ট হইলে সম্পাদক বেচারা বাধিত হইবে।”
বেশ কয়েকটি কবিতা এখানে উধৃত হল, কারণ কবিতাগুলি একসঙ্গে পাওয়াটা কষ্টসাধ্য।
তাঁর লেখকজীবন মাত্র কয়েকটি বছরের। শেষের আড়াই বছর আবার শয্যাশায়ী ছিলেন দুরারোগ্য অসুখে। কিন্তু মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবনে সুকুমার রায় যা দিয়ে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যকে, তা তুলনাহীন। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রায় একশো বছর হতে চলল, কিন্তু আজও আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় তিনি অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক। তাঁর বিচিত্র শব্দ-ব্যবহার, লেখার লাইন, চরিত্রের নাম কী অক্লেশে আমাদের কথাবার্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। তাঁর একটিমাত্র কথা ব্যবহার করে দশটি কথা বলে ফেলার ফল পাই আমরা। গোমড়ামুখো কারও পরিচয় দিতে গেলে ‘রামগরুড়ের ছানা’ বললেই যথেষ্ট। অদ্ভুত ধরনের জোড়াতালি দেওয়া ঘটনা দেখলে শুধু ‘বকচ্ছপ’ বা ‘হাঁসজারু’ বলেই থেমে যাওয়া যায়। ‘সাতদিনের ফাঁসি’ তো কবেই প্রবাদের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে। লাগসই জায়গায় যদি বলা যায় ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল’ – ব্যস, আর কিছু ভেঙে বলার দরকার নেই। ‘সাত দুগুনে চোদ্দর নামে চার’ বললে অনেকেই বাকি অংশটা বলে দেবেন – ‘হাতে রইল পেনসিল।’ এই ভাবেই বাঙালি জীবনের নানা স্তরে মিশে গেছেন স্বল্পায়ু লেখক সুকুমার রায়। ভুগছিলেন দুরারোগ্য কালাজ্বরে। কিন্তু অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী এই মানুষটি রোগশয্যাতেও তাঁর সৃষ্টিকর্ম থামাননি। নানা ধরনের লেখালেখির কাজ করে গিয়েছেন সমানে। সঙ্গে ছিল ছবি আঁকা। অসামান্য ‘আবোলতাবোল’ গ্রন্থের লে-আউট তাঁরই তৈরি। কিন্তু দুঃখের কথা, ছাপার হরফে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি।
আমাদের দুঃখের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায় যখন জানতে পারি, তাঁর মৃত্যুর পরের বছরেই কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছিল। যদি আগের বছর ওষুধটি বার হত, এবং সেই ওষুধে আরোগ্য লাভ করে যদি তিনি আরও চল্লিশ-পঞ্চাশটি বছর বেঁচে থাকতেন, তা হলে …। পরেরটুকু অনুমান করতে আমাদের কারুরই কষ্ট হয় না। তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্পর্শে বাংলা সাহিত্য আরও অনেকটাই ধনী হয়ে উঠতে পারত। তবে অল্প দিনের জীবনে তিনি যা দিয়ে গিয়েছেন, তাও তো তুলনাহীন! তাঁর ছড়ায়,কবিতায়, গল্পে, নাটকে, ছবিতে আমরা আজও মজে আছি।
‘আবোলতাবোল’ বইটির ভূমিকায় লেখক লিখেছেন – ‘‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই। সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’’
আজগুবি, উদ্ভট,অসম্ভব বস্তুর এমন শিল্পসম্মত ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত আর কখনোই হয়নি। শুধু এই বইটিতেই নয়, সুকুমার রায়ের সৃষ্টিশীল সব লেখারই মূলে আছে তাঁর উদ্ভাবিত ‘খেয়াল রস’। লেখকের মৃত্যুর কয়েক বছর পরে তাঁর প্রথম গল্প-সংকলন ‘পাগলা দাশু’ প্রকাশিত হয়। সেই সংকলনের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে, তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র গতি, তাঁর ভাবসমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমত্কৃতি আনে … বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গরসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরও কয়েকটি দেখা গিয়েছে, কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভায় যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে, তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না।” ভাবসমাবেশের জগতে সুকুমার রায়ের যে ‘অভাবনীয় অসংলগ্নতা’র উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তা তুলনাহীন। সুকুমারের বৈশিষ্ট্য তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। উদ্ভট রসের দুই বিশিষ্ট লেখক এডওয়ার্ড লিয়ার ও লুইস ক্যারলের ছায়া পড়েছিল সুকুমারের ওপর, তবে সেই ছায়াকে তিনি সঙ্গী করেননি। তাঁর নিজস্বতা গড়ে উঠেছিল বিশুদ্ধ বাঙালিয়ানা ও আশেপাশের জগৎ থেকে।
উনিশ শতকে ইংরেজি সাহিত্যে ‘লিটারেরি ননসেন্স’ রীতিমত একটি সাহিত্য-আন্দোলনের চেহারা ধরেছিল। আপাতদৃষ্টিতে যাকে যুক্তিতর্ক বলে, তার সঙ্গে এই সাহিত্যের কোনও সম্পর্ক ছিল না। যা ছিল তা এর ঠিক উলটো দিক। অর্থাৎ মাথামুন্ডুহীন বিষয়। এক ঝাঁক লেখকের মধ্যে সবার ওপরে উঠে এসেছিলেন লিয়ার এবং ক্যারল। লিয়ারের ‘এ বুক অব ননসেন্স’ মাত করে দিয়েছিল পাঠকদের। তাঁর ‘লিমেরিক’ সবার মুখে মুখে ফিরত। এই আন্দোলন উজ্জীবিত করেছিল সুকুমার রায়কে। কিন্তু মৌলিকতা, স্বকীয়তা তাঁর লেখার পরতে পরতে। আজগুবি, উদ্ভট, খেয়ালরসের যে কাণ্ডকারখানা তিনি ঘটিয়েছেন তার প্রায় পুরোটাই উঠে এসেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের ভেতরমহল থেকে।
সৎপাত্রের খোঁজ করা এবং হিতৈষী-সাজা কোনও একজনের সেই বিয়েতে ভাংচি দেওয়া একেবারেই বাংলা মুলুকের ব্যাপারস্যাপার। পাত্র গঙ্গারামের গুণের শেষ নেই। তার উনিশটিবার ম্যাট্রিকে ফেল মারাটা কোনও ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত নয়, বিরল এক অধ্যবসায়ের পরাকাষ্ঠা। বাবুরাম সাপুড়ের কাণ্ডকারখানাও আমাদের মাতিয়ে রাখে। ‘ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা’ বললে আমরা অক্লেশে মেনে নিই, কুমড়োপটাশ নাচলে কী হয় – আমাদের আর অজানা নয়; বোম্বাগড়ের রাজা কেন ছবির ফ্রেমে আমসত্ত্ব ভাজা বাঁধিয়ে রাখে – তা নিয়ে কেউ এখন আর প্রশ্ন তোলে না। কারণ সুকুমার রায় তাঁর আশ্চর্য লেখার গুণে বিচিত্র এই জগৎটিকে সত্যি করে তুলেছেন। আমাদের একমাত্র কাজ হল অপরূপ এই জগতের সবকিছু উপভোগ করা – আমরা তাই-ই করে থাকি।
শুধুমাত্র ছড়া-ছবিতেই নয়, তাঁর গল্প ও নাটকেও প্রধান রস ওই খেয়ালরস। ‘হ য ব র ল’-তে উদ্ভট কাণ্ডের ছড়াছড়ি। গল্পের ওই বুড়োকে ভোলা অসম্ভব। বুড়োর কখনও বয়েস বাড়ে না, কারণ বুড়ো বাড়তে দেয় না। বুড়ো কাককে বলেছিল, ‘‘চল্লিশ বছর হলেই আমরা বয়েস ঘুরিয়ে দিই। তখন আর একচল্লিশ, বেয়াল্লিশ হয় না – ঊনচল্লিশ,আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে বয়েস নামতে থাকে। এমনি করে দশ পর্যন্ত নামে, তখন বয়েস আবার বাড়তে দেওয়া হয়। আমার বয়েস যে কত উঠল, নামল, এখন আমার বয়েস হয়েছে তেরো।’’
বিস্ময়কর সেই নামকরণ-পর্বও। হিজি বিজ বিজ বলল, ‘‘একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম অবিমৃষ্যকারিতা, তার ছাতার নাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু—কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে।’’
শব্দের আশ্চর্য মহিমার কথা একাধিকবার শুনিয়েছেন সুকুমার। এমনকী বিচিত্র এই জগতে গাছের ফুল ফোটার সময় ভয়ংকর সব শব্দ উঠে থাকে। নিছক শব্দ নয়, ‘শব্দকল্পদ্রুম’। ‘ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খট্কা/ ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্কা।’ যে জগতে ফুল ফোটা আর পটকা ফাটার শব্দের মধ্যে বিন্দুমাত্র তফাত নেই, সেই জগতে বাড়ির নাম ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ হলে সে বাড়ি তো পড়ে যাবেই।
নেড়ার গানও দিব্যি মানানসই এখানে। ‘লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ’ – এর মধ্যে তো কণামাত্রও অসঙ্গতি নেই। কিন্তু বিচারক প্যাঁচা এই প্রতিভাবান নেড়াকেই সাজা দিয়েছিল। সেই সাজাটিও জব্বর! ‘তিন মাসের জেল আর সাত দিনের ফাঁসি।’
তিন মাসের জেল নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, কিন্তু সাত দিনের ফাঁসি! কথায় বলে – হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। সুতরাং মেনে নেওয়া যেতে পারে যে হুকুম পালন করা হয়েছিল। কী ভাবে সেটা কেউ জানে না, এবং বোধহয় জানতেও চায় না।
সুকুমার রায়ের নাটক ও নাটিকাগুলির প্রধান রসও সেই খেয়ালরস। প্রতিটি নাটকই মজাদার। এগুলির মধ্যে আছে ‘ঝালাপালা’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘অবাক জলপান’, ‘চলচিত্তচঞ্চরি’ ইত্যাদি। প্রতিটি নাটকেই উদ্ভট,আজগুবি সব ঘটনা ঘটে চলে অনায়াসে। এখানে কোনও সমস্যাই সমাধানহীন নয়। ‘ঝালাপালা’র কেষ্ট পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে ‘আই গো আপ, উই গো ডাউন’-এর মানে জানতে চেয়েছিল।
পণ্ডিতমশাইয়ের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, তিনি একটুও সময় নষ্ট না করে বললেন, “… ‘আই’ – আই কি না চক্ষুঃ, ‘গো’ – গ য়ে ও কারে গো – গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ। ‘আপ’ কি না আপঃ – সলিলং বারি অর্থাৎ জল। গোরুর চক্ষে জল, অর্থাৎ জল। গোরুর চক্ষে জল, অর্থাৎ কি না গোরু কাঁদিতেছে। কেন কান্দিতেছে ? না ‘উই গো ডাউন’ অর্থাৎ গুদমখানা। গুদমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না, তাই না দেখে, ‘আই গো আপ’ – গরু কেবলি কান্দিতেছে।”
এমন হৃদয়বিদারক শব্দার্থ একমাত্র সুকুমার রায়ের পণ্ডিতমশাইয়ের পক্ষেই বার করা সম্ভব। এই ব্যাখ্যা আমরা যখন শুনি, আমাদের কোনও সংশয় প্রকাশের ইচ্ছেই আর অবশিষ্ট থাকে না। সুকুমার রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে সত্যজিৎ রায় ওঁর বাবাকে নিয়ে যে অসামান্য তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছিলেন সেখানে বিশিষ্ট অভিনেতা উৎপল দত্ত পণ্ডিতমশাইয়ের এই চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন।
‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এ রাম, লক্ষ্মণ, জাম্বুবান,সুগ্রীব, হনুমান, বিভীষণের সঙ্গে মূল রামায়ণের ওই চরিত্রগুলির আকাশপাতাল তফাত। কিন্তু নাটকের পাত্রপাত্রীদের উদ্ভট, হাস্যকর কাণ্ডকারখানা সবাইকে এমনই মশগুল করে রাখে যে, মূল কাহিনির সঙ্গে মিল-গরমিলের কথাটা কারও মাথাতেই আসে না।
মহাকাব্যের পাত্রপাত্রীরা এখানে আজগুবি কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে গিয়েছে সমানে। এমনকী নাটকের সামান্য একজন দূতও এর বাইরে নয়। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদসংগ্রহের বৃত্তান্ত শোনাতে গিয়ে দূত বলল, ‘‘আমি ছানটান করেই পুঁইশাক চচ্চড়ি আর কুমড়ো ছেঁচকি দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়ে খেয়েই অমনি বেরিয়েছি – অবিশ্যি আজকে পাঁজিতে কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিষেধ লিখেছিল, কিন্তু কি হল জানেন? আমার কুমড়োটা পচে যাচ্ছিল কি না।’’ এরপর ধমক খেয়েই কাজের কথায় এসেছিল দূত। ‘‘হ্যাঁ-হ্যাঁ – খেয়ে উঠেই ঘণ্টা দু-তিন জিরিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি খুব ঢাকঢোল বাজছে – ধ্যা র্যা র্যা র্যা র্যা … ধ্যা র্যা র্যা … ধ্যারা।’’ আবার ধমক। তারপরেই আসল সংবাদে এসেছিল দূত। কিন্তু ওই যে ‘ছান-টান’ করা, পুঁইশাক চচ্চড়ি আর কুমড়োর ছেঁচকি খাওয়া, তারপর খেয়ে উঠেই (বেরিয়ে পড়া নয় ) দু-তিন ঘণ্টা জিরিয়ে নেওয়ার বৃত্তান্ত শুরুতেই নাটকের মেজাজটি গড়ে দিয়েছে।
‘চলচিত্তচঞ্চরি’ উদ্ভট রসের আর একটি অনবদ্য নাটক। এই নাটকের লেখক ভবদুলাল চরিত্রটি তুলনাহীন। ইনি অনেক কথাই ঠিক ভাবে শোনেন না। যা বোঝেন তার প্রায় পুরোটাই ভুল। তাঁর বইয়ের নাম ‘চলচিত্তচঞ্চরি’। বইটির সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। যেমন, এটির মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা সাতশো কি আটশো, মলাট লাল রঙের। তার ওপর বড় বড় করে সোনার জলে লেখা থাকবে বই ও লেখকের নাম। দাম একুশ টাকা।
সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে আছে, কিন্তু বইটা ছাপতে দেওয়া হয়নি এখনও। কেন? একটাই কারণ। লেখাই হয়নি বইটা। পরে অবশ্য কয়েক পাতা লিখেছিলেন। কিন্তু যে-সব চরিত্রের মুখে উলটোপালটা কথা বসিয়েছিলেন, তারাই রাগ করে পাতাগুলো ছিঁড়ে দিয়েছিল।
অপরূপ চরিত্র এই ভবদুলাল। মনে হয়, এই চরিত্রটির মধ্যেই সত্যজিৎ রায়ের জনপ্রিয় চরিত্র ‘জটায়ু’র বীজ লুকিয়ে আছে। সুকুমার রায়ের ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ একটি অনবদ্য কল্পকথা। এই প্রফেসর হুঁশিয়ারকে সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর পূর্বপুরুষ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। অদৃষ্টপূর্ব বিচিত্র প্রাণীদের নামকরণ করার ব্যাপারে প্রফেসর হুঁশিয়ার অত্যন্ত পটু ছিলেন। উদ্ভট চেহারার একটা হ্যাংলা প্রাণীর নাম দিয়েছিলেন ‘হ্যাংলাথেরিয়াম’। অত্যন্ত বিরক্ত, গোমড়া চেহারার একটা প্রাণীর নাম দেওয়া হল ‘গোমড়াথেরিয়াম’। আজব চেহারার এক ল্যাংড়া জন্তুর নাম রাখা হল ‘ল্যাংড়াথেরিয়াম’। বিদ্ঘুটে আকৃতির একটা প্রাণী প্রাণপণে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই, তার লাগসই নামটিও ঠিক করে ফেলেছিলেন প্রফেসর – ‘চিল্লানোসরাস’। চরিত্রের বিচিত্র সব নামকরণ করার ঝোঁকটি উত্তরাধিকারসূত্রে সত্যজিৎও পেয়েছিলেন।
একটি পর্যায়ে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেছিলেন সুকুমার রায়।পত্রিকার প্রয়োজনে নানা ধরনের লেখা লিখিয়েছিলেন নানাজনকে দিয়ে। নিজেও লিখেছিলেন অনেককিছু। প্রতিভাবান লেখক, যে-কোনও বিষয়কেই উপস্থিত করতে পারতেন সুন্দর ভাবে। উপকথা, রূপকথার তো স্বাভাবিক একটা টান থাকে, কিন্তু যে বিষয়গুলি নেহাতই তথ্যভিত্তিক – সেগুলিও তাঁর লেখার জাদুতে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। এই সব লেখার মধ্যে আছে ‘পিরামিড’, ‘দক্ষিণ দেশ’, ‘ভূমিকম্প’, ‘চীনের পাঁচিল’, ‘ডুবুরী জাহাজ’, ‘গরিলা’, ‘রাক্ষুসে মাছ’ ইত্যাদি।
সংক্ষিপ্ত জীবনকথাও লিখেছেন ছোটদের জন্যে। বিখ্যাত মানুষজন, বিচিত্র তাঁদের কর্মকাণ্ড; কিন্তু খুব সহজ ভাষায় গল্পের ভঙ্গিতে তাঁদের জীবনকাহিনি শুনিয়েছেন সুকুমার। এই তালিকায় আছেন লিভিংস্টোন, পাস্তুর, সক্রেটিস,গ্যালেলিও, ডারুইন প্রমুখ।
মৌলিক গল্পেও আশ্চর্য রকমের সফল সুকুমার। তার বেশ কয়েকটি গল্পের পটভূমিতে আছে স্কুলজীবন। ছাত্র ও পণ্ডিতদের নানা ভূমিকায় দেখা যায় এই সব গল্পে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে ‘পাগলা দাশু’, ‘দাশুর কীর্তি’ ও ‘দাশুর খ্যাপামি’। ‘জগ্যিদাসের মামা’, ‘পালোয়ান’, ‘বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়’, ‘ব্যোমকেশের মাঞ্জা’ ইত্যাদি অপরূপ গল্পগুলিও ওই স্কুলজীবনকে কেন্দ্র করেই।
তবে ‘ভুল’ গল্পটি একেবারেই অন্য ধরনের। এমন গল্প আর একটিও চোখে পড়ে না। ছোটদের পত্রপত্রিকায় এই ধারাটির চর্চা হলে অল্পবয়সী পাঠকদের সচেতনতা অবশ্যই বাড়ত। ছোট আকারের ‘ভুল গল্প’-টিতে গল্পের টান চমৎকার। একবার পড়তে শুরু করলে থামা যায় না। আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে গল্পের ঘটনাগুলি সাজানো। গল্পের শেষে ভুল গল্পের ভুলগুলি দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটি-দুটি নয়, গোটা-পনেরো ভুল আছে ছোট মাপের এই গল্পটিতে। গল্পে বলা হয়েছে , বৃন্দাবনবাবুর মাথাভরা টাক, কিন্তু শেষে দেখা যায় – তিনি টিকি দোলাচ্ছেন। গল্পের প্রথম দিকে বলা হয়েছে তাঁর বয়স ষাট, কিন্তু পরে জানানো হয়েছে তিনি চাকরি করছেন ৫৬ বছর ধরে। গল্পের প্রথম পর্বের তথ্য – রামবাবু ইংরেজি জানেন না, কিন্তু পরে দেখা যায় – তিনি গড়গড় করে ইংরেজি টেলিগ্রাম পড়ছেন। গল্পের শেষে এই ধরনের বড় মাপের ভুল দেখানো হয়েছে গোটা-পনেরো।
সুকুমার রায় শুধু লেখাতেই নয়, খেয়ালরসের জোগান দিয়েছেন তাঁর ছবিতেও। ‘আবোলতাবোল’ বইটির পাতায় পাতায় মজাদার জীবন্ত ছবির ছড়াছড়ি। বইয়ের পাতায় এরা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এদের মধ্যে আছে হাঁসজারু, বকচ্ছপ, কাঠবুড়ো, কুমড়োপটাশ, বোম্বাগড়ের রাজা, রামগরুড়ের ছানা, ট্যাঁশ গরু,পালোয়ান ইত্যাদি। ‘হ য ব র ল’-র ছবিগুলো গল্পের সঙ্গে ভীষণ মানানসই। অমরত্ব পেয়েছে প্রতিটি ছবিই। এগুলির মধ্যে আছে বেড়াল, কাক, বুড়ো, ব্যাকরণ সিং, নেড়া, হিজি বিজ্ বিজ্, কালো ঝোল্লা-পরা হুতোমপ্যাঁচা, মাথায় শামলা-আঁটা শেয়াল, কুমির ইত্যাদি। মজাদার কিছু কার্টুন চিত্রমালাও এঁকেছেন সুকুমার। এগুলিও অপরূপ।
বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটি বেঁচেছিলেন মাত্র ছত্রিশ বছর (১৮৮৭-১৯২৩)। তাঁর খেয়াল রস আপ্লুত করে আসছে প্রতি যুগের পাঠকদের। আজও করছে, ভবিষ্যতেও করবে।
সুকুমার চলে যাবার পর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের মন্দিরে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। আচার্যের ভাষণে তিনি বলেন, “আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি, এই কথাই বার বার মনে হয়েছে, জীব-লোকের ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মলোক আছে। যে-কোন মানুষ এই কথাটি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসের দ্বারা নিজের জীবনে স্পষ্ট করে তোলেন, অমৃতধামের তীর্থযাত্রায় তিনি আমাদের নেতা। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সে গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।”
১৯৮৭ সালে সুকুমারের জন্মশতবর্ষে তার সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ রায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজনায় তার নিজের পরিচালনায় আধ ঘন্টার একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। অভিনয়াংশে ছিলেন উৎপল দত্ত, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, তপেন চ্যাটার্জি, সন্তোষ দত্ত প্রভৃতি অভিনেতা। ভাষ্যপাঠ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ নিজেই।
সুকুমারের মৃত্যু নেই। তার লেখনী থেকেই নিঃসৃত হয়েছে, “দেহ নহে মোর চির নিবাস, দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ।” এই বিশ্বাসকে সঙ্গে করেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এই প্রাণোচ্ছল, কর্মচঞ্চল, আনন্দময় মানুষটি তার রেখে যাওয়া সাহিত্য কীর্তির মধ্য দিয়ে চির ভাস্বর হয়ে আমাদের মধ্যে বিরাজ করবেন।
(তথ্যসূত্রঃ
১- সুকুমার, লীলা মজুমদার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি (১৯৮৯)।
২- কারিগরি কল্পনা ও বাঙালি উদ্যোগ সিদ্ধার্থ ঘোষ, দে’জ পাবলিশিং (১৯৮৯)।
৩- বিশেষ সুকুমার রায় সংখ্যা, সুভাষ চক্রবর্তী সম্পাদিত, যুবমানস (এপ্রিল ১৯৮৮)।
৪- সুকুমার রচনা সমগ্র, শুভম (২০১১)।
৫- সমগ্র শিশুসাহিত্য, সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু সম্পাদিত, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড (১৩৮৯ বঙ্গাব্দ)।
৬- ব্যক্তি সুকুমার, স্মৃতির আলোয় (প্রবন্ধ), শ্যামলী দেবী এবং শুভাশিস ঘোষের একটি ছোট রচনা।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত