‘‘আরও অগ্রসর হওয়া উচিত কি না ভাবছি – ইতিমধ্যে আলোটা যেন হঠাৎ নিভে গেল, কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার দপ ক’রে জ্বলে উঠল। ... ভয়ে আমার গা ছম্ছম্ করছিল বটে, কিন্তু তবুও যেন কেন মনে হচ্ছিল – ওটা ভৌতিক ব্যাপার নয়, অন্য কিছু একটা হবে। ... স্নিগ্ধ নীলাভ আলোতে আশেপাশের ঘাস–পাতাগুলি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কর্তিত একটা গাছের গুঁড়ি থেকে আলো নির্গত হচ্ছিল। সমস্ত গুঁড়িটাই জ্বলে জ্বলে যেন অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে। .... গুঁড়িটার অনেকটাই পচে গেছে। .... গুঁড়িটার গা থেকে আলো বিকিরণকারী কতকগুলো কাঠের কুচি সংগ্রহ করে অক্ষত দেহে পাঁচীর মা–র ভিটে থেকে ফিরে এলাম।’’
১৩২৬ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় (ডিসেম্বর, ১৯১৯) প্রকাশিত ‘পচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণ করবার ক্ষমতা’ নামে এই লেখাটার চোখ পড়েছিল ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু’র। জগদীশচন্দ্রের ‘জহুরি–চোখ’ চিনতে ভুল করেনি ‘না–কাঁচ কাটার হীরে’ – সত্যানুসন্ধানী এক প্রকৃতি বিজ্ঞানীকে। তাই বসু বিজ্ঞান মন্দির–এর গবেষণার কাজে তিনি তাঁকে ডেকে নিয়েছিলেন স্নেহভরে, বলেছিলেন, ‘‘যদি আমার এখানে আসতে চাও তবে অনেক কিছু শিখতে পারবে।’’ এভাবেই গবেষণার সুযোগ এসেছিল (১৯২১) অনুসন্ধিৎসু, নিষ্ঠাবান অথচ অর্থ ও উচ্চ শিক্ষায় অভাবী প্রকৃতিগবেষকের। হ্যাঁ, সেই প্রকৃতি বিজ্ঞানী এই নিযুক্তির মর্যাদা রেখেছিলেন তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে। ১৯৩০–এর দশক থেকে তিনি ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসেবে। বস্তুতঃ ভারতে ‘প্রাণী মনস্তত্ত্ব’ বা ‘ইথোলজি’–র অগ্রপথিক তিনিই।
‘ব্যাঙাচি থেকেই ব্যাঙ হয়’ – কে না জানে! কিন্তু অনেকেরই অজানা, ‘পেনিসিলিনের প্রভাবে’ এই রূপান্তর থেমে যায়। ‘ব্যাঙাচি’ তখন ‘বড় ব্যাঙাচি’ হয়, কিন্তু ‘ব্যাঙ’ হয়ে ওঠে না – এই অদ্ভুত আবিষ্কারটি যাঁর কৃতিত্ব, তিনি প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। ব্যাঙাচি ব্যাঙে পরিণত হয় যে হরমোনের প্রভাবে, তার নাম ‘থাইরোসিন’। তিনি সূক্ষ্ম ভাবে লক্ষ করেছিলেন যে ব্যাঙাচির এই রূপান্তর বন্ধ করা যায় ‘পেনিসিলিন প্রয়োগের মাধ্যমে’। সেই সময় বিখ্যাত ‘বিজ্ঞানী জুলিয়ান হাক্সলে’ এসেছিলেন কলকাতায়। তাঁকে দেখানো হয়েছিল গবেষণার ফল। তিনি বলেছিলেন, ব্যাপারটা খুবই রহস্যজনক। একটা রিপোর্ট ‘নেচার’ পত্রিকায় দেওয়া উচিত। দুর্ভাগ্য, সেটা আর কখনওই করা হয়নি।
গোপালচন্দ্র ছিলেন ‘স্বভাববিজ্ঞানী’। আর্থিক কারণে ‘ইন্টারমিডিয়েট’ অবধিই পড়াশোনা করতে পেরেছিলেন। ‘বাংলার গাছপালা’, ‘কীটপতঙ্গ’, ‘পশুপাখিদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা’কে তিনি কাছ থেকে ‘পর্যবেক্ষণ’ করেছিলেন, গবেষণা চালিয়ে ফলাফল লিখেছিলেন। ১৯২১ থেকে ১৯৭১ – বসু বিজ্ঞান মন্দিরে তিনি গবেষণা চালিয়েছিলেন ‘ব্যাঙ’, ‘পিঁপড়ে’, ‘মৌমাছি’ আর ‘মাকড়সা’ নিয়ে। ১৯৩০ সালে বাংলার ‘মাছখেকো মাকড়সা’ সম্বন্ধে তাঁর বিশদ পর্যবেক্ষণ ‘বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ট্রানজ্যাকশনে’ বেরিয়েছিল। ১৯৩৪-৩৫ সালে ‘পিঁপড়ে অনুকারী মাকড়সা’, ‘টিকটিকি-শিকারি মাকড়সা’ সম্পর্কে চারটি গবেষণাপত্র ‘মুম্বইয়ের ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটি’, ‘আমেরিকান সায়েন্টিফিক মান্থলি’ এবং ‘কলকাতার সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। স্বয়ং জগদীশচন্দ্রও আশা করেছিলেন, এই আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা নিবন্ধগুলি গোপালচন্দ্রকে বিদেশেও পরিচিতি দেবে। কিন্তু ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন পাল্টাচ্ছিল। হিটলারের অভ্যুত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছিল।
সামান্য উপকরণ দিয়ে কত অসামান্য মণিমুক্তো যে খুঁজে বের করেছিলেন তিনি! যেমন, পিঁপড়ের ডিম থেকে ‘রানি’, ‘পুরুষ’ না ‘কর্মী’ – কোন ধরনের পিঁপড়ের জন্ম হবে, তা বুঝতে টবে রাখা আমগাছে বাসা বানিয়েছিলেন। যেখানে শুধুই থাকবে ‘কর্মী পিঁপড়ে’। টবের চার দিকে জল থাকায় সেখানে প্রবেশ নিষেধ ছিল অন্য পিঁপড়ের। ছ’ সপ্তাহ পর দেখা গিয়েছিল, ডিম পাড়া হয়েছে, লার্ভা রয়েছে এবং পিঁপড়ের সংখ্যাও বেড়েছে। স্ত্রী পিঁপড়ের অনুপস্থিতিতে কী করে সম্ভব হল এটা? ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ সাল অবধি খাবার, বাসা এবং পিঁপড়ের প্রকৃতি পাল্টে তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন তাদের ডিম পাড়ার ধরন।
তবে তাঁর সবচেয়ে আশ্চর্য আবিষ্কার বোধ হয় জৈব দ্যুতি – যেটার কথা লেখার শুরুতে উল্লেখ হয়েছে। পরিত্যক্ত জায়গায় বৃষ্টির রাতে আগুন জ্বালায় কে? রহস্যভেদ করতে এক বৃষ্টিভেজা রাতে তিনি রওনা দিয়েছিলেন ‘পাঁচীর মার ভিটা’র দিকে। সে ছিল এক জঙ্গুলে, জনমানবহীন জায়গা। সেখানে তিনি দেখেছিলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে জমাট-বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা অস্পষ্ট আলোর রেখা। কাছে যেতেই সেই আলো আরও স্পষ্ট, আরও উজ্জ্বল হয়েছিল। হঠাৎই তা দপ করে নিভে গিয়েছিল। ফের জ্বলে উঠেছিল। আরও খানিক এগিয়ে তিনি দেখেছিলেন যেন বেশ বড় এক অগ্নিকুণ্ড। আগুনের শিখা ছিলনা। কাঠকয়লা পুড়ে যেমন গনগনে আগুন হয়, অনেকটা সেই রকম। সে আলোর তীব্রতা ছিলনা। তিনি লক্ষ করেছিলেন, শুষ্ক দিনে জঙ্গলে জল পড়লে রাত্রিবেলায় এই আলো দেখা যায়। অথচ দিনের আলোয় দেখা যায় না। পচা গাছপালার এই আশ্চর্য আলো বিকিরণের ক্ষমতার উপর বৈজ্ঞানিক রচনা তাঁর আগে কেউ লেখেননি আর ব্যাখ্যাও করেননি।
বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণার সময়ই দেশ-বিদেশের বৈজ্ঞানিক পত্রিকাতে তাঁর নানা নিবন্ধ প্রকাশিত হতে শুরু হয়েছিল। গবেষণার প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে গোপালচন্দ্র কীটপতঙ্গ খুঁজে বেড়াতেন। শুধু বিজ্ঞানচর্চাই নয়, অন্ত্যজদের লেখাপড়া শেখানো, জারিগান, কথকতার মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। বিজ্ঞানী ‘সত্যেন্দ্রনাথ বসু’ ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা সম্পাদনার ভারটি তাঁর হাতেই সমর্পণ করেছিলেন। প্রায় তিন দশক সম্পাদক থাকাকালীন তিনি বিজ্ঞান সাহিত্যে এক নতুন দিক উন্মোচন করেছিলেন।
কীটপতঙ্গের জীবনের অদ্ভুত দিকও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন গোপালচন্দ্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘শুঁয়োপোকার মৃত্যু অভিযান’। গোপালচন্দ্রের গবেষণাধীন ছিল ‘খাদ্যনির্ভর তত্ত্ব’। এটা খুব মজার একটা ‘থিয়োরি’ বা ‘তত্ত্ব’। পিঁপড়ে সমাজে রাজা, রানি, শ্রমিক ও সৈনিক পিঁপড়ের সংখ্যা নির্ধারিত হতে পারে স্রেফ ‘খাদ্যনিয়ন্ত্রণ’ করে। প্রকৃতিবিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র গবেষণা করে এই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ থিয়োরি বা তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। মনুষ্যসমাজে যে রকম একজনের বাচ্চা অন্য জনে চুরি করে নিয়ে যায় তেমনি কীটপতঙ্গও অন্যের বাচ্চা চুরি করে। গোপালচন্দ্রের গবেষণা থেকে এ সব অভিনব ঘটনা জানা যায়। তাঁর লেখা ‘ভীমরুলের রাহাজানি’ পড়ে জানা যায়, কী ভাবে দৈহিক শক্তি ও দুষ্টবুদ্ধি নিয়ে কয়েকটি ভীমরুল শত শত বোলতার সামনে থেকে বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যায় কিংবা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় সবাইকে। কীট-পতঙ্গ যে প্রতিদিন লড়াই করে বেঁচে থাকে, এ দেশে তা প্রথম দেখেছিলেন বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। সবাই তাঁকে বলেন ‘প্রকৃতি বিজ্ঞানী’। ‘প্রজাপতি’, ‘পিঁপড়ে’, ‘মাকড়সা’, ‘মাছ’, ‘ব্যাঙাচি’ – এসব নিয়ে ছিল তাঁর গবেষণা। পিঁপড়েরও কত নাম। ‘বিষ পিঁপড়ে’, ‘কাঠ পিঁপড়ে’, ‘লাল পিঁপড়ে’, ‘সুড়সুড়ে পিঁপড়ে’, ‘ডেঁয়ো পিঁপড়ে’, ‘নালসো পিঁপড়ে’, ‘ক্ষুদে পিঁপড়ে’ – এদের স্বভাব হল লড়াই করে বেঁচে থাকা। যুদ্ধ করে জয় ছিনিয়ে নেওয়া। যুদ্ধ জয় করে এরা আনন্দে নাচে। যুদ্ধে জেতার প্রবণতা ক্ষুদে পিঁপড়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ক্ষুদে পিঁপড়ের দল মাটি দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে। তারপর উই পোকার মতো মাটির নিচ দিয়ে গর্ত করে সুড়ঙ্গ বানায়। তারপর ছক কষে কিভাবে শত্রুকে বিনাশ করতে হবে। আর এই লড়াই তারা করে কেবলমাত্র খাবারের জন্য। তারা মূলত লড়াই করে বড় লাল পিঁপড়েদের সঙ্গে। গোপাল চন্দ্র বলছেন, ক্ষুদেদের কাছে প্রায়ই হেরে যায় বড়রা। আরও আশ্চর্য হল যে, যুদ্ধে জিতে পরাজিত কিছু পিঁপড়কে তারা কয়েদ করে নিয়ে আসে। ছোটদের বাসায় ক্রীতদাস হিসাবে থাকে। শ্রমিকদের গোলাম হয়ে থাকে আজীবন।
গোপাল চন্দ্রের আগে থেকেই বিশ্বের নানা প্রান্তে কীট-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণা হয়েছিল। বিজ্ঞানী ‘ওয়সন’, ‘উইয়সন’, ‘গুডল গোয়ৎস’ বহু তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু গোপাল চন্দ্র যে দৃষ্টিতে দেখেছিলেন তা অনেকের কাছে ঈর্ষার কারণ। তাঁর গবেষণা থেকে অনেকে অনেক তথ্য নিয়েছেন। কেউ ঋণ স্বীকার করেছেন, কেউ করেননি। তবে তা নিয়ে তিনি কোনদিনই ক্ষোভ জানাননি।
তাঁর গায়ে ছিল সোঁদা মাটির গন্ধ। কবিগান গেয়ে বেড়িয়েছেন, লোকগীতি গেয়েছেন। ভাটিয়ালির সুর তুলেছেন, গ্রামের কৃষক, শ্রমিকের জন্য গান লিখেছেন। এরই সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলার বনে-জঙ্গলে। কীট-পতঙ্গ সংগ্রহ করেছেন। খালি চোখেই তাঁর দেখার ক্ষমতা ছিল আশ্চর্য। খাবারের জন্য কীট-পতঙ্গরাও যে মানুষের মতো যন্ত্র ব্যবহার করে তা এদেশে তাঁর আগে আর কেউ দেখতে পাননি। বিদেশে যে এসব নিয়ে কাজ হচ্ছে তা তিনি জানতেন না। বাবা মারা গিয়েছিলেন পাঁচ বছর বয়সে। মাকে নিয়ে সংসার চালাতে যজমানি করতে হত। পত্রপত্রিকা পড়বেন কী করে!
‘বিজ্ঞানী ডারউইন’ বলেছিলেন, ‘গ্যালাপ্যাগাস দ্বীপপুঞ্জে’ এক শ্রেণির পাখি গর্ত থেকে পোকা বের করার জন্য গাছের ডালের সাহায্য নেয়। ‘বিজ্ঞানী গুডল’ বলেছিলেন, শিম্পাঞ্জিরা উইপোকার গর্তে ঢুকিয়ে দেয় গাছের ডাল, সেই ডাল বেয়ে উই উঠে পড়ে আর তা খায় তারা। এ তো গেল মেরুদণ্ডী প্রাণীদের বাঁচার চেষ্টা। অমেরুদণ্ডীরাও যে বেঁচে থাকার যন্ত্র ব্যবহার করে তা দেখতে পেয়েছিলেন গোপালচন্দ্র। তিনি বলেছিলেন কানকাটারি পোকা ডিম রক্ষা করার জন্য কি চেষ্টাই না করে। কানকাটারি পিছনের পায়ে কাদা মেখে শুকিয়ে নেয়, শত্রু এলে জোড়া পায়ে লাথি মারে। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার আগে থেকে রক্ষা করার চেষ্টা। বিজ্ঞানী বলছেন ডিম পাড়ার পর কানকাঠারির পা দুটো জল ঢেলে ধুইয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মা হওয়ার কী বাসনা তার! পায়ে আবার সে কাদা মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে শক্ত করে নিয়েছে। ডিমের সঙ্গে নিজেকেও শত্রুর হাত থেকে সে বাঁচাতে চায়। মাকড়সা নিয়ে তাঁর গবেষণায় মুগ্ধ বিদেশের বিজ্ঞানীরা। মাকড়সা নিয়ে তাঁর গবেষণা দেখতে এসেছিলেন বেলজিয়ামের এক বিজ্ঞানী। মিলনের পর স্ত্রী মাকড়সা পুরুষ মাকড়সাকে খেয়ে ফেলে। মিলনের পর পালাতে যায় পুরুষ আর তখনই তাকে দৌড়ে ধরে ফেলে স্ত্রী। তারপর মেরে গিলে নেয়। গোপাল এই দৃশ্য দেখিয়েছিলেন বেলজিয়ামের বিজ্ঞানীকে, তিনি তো দেখে ‘থ’। বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসুর সহযোগী। তবে তা অনেক পরে। মাকড়সা স্বভাব কেন এমন তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি।
দেখার চোখ, অনুসন্ধিৎসু মন, আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় এবং নিরন্তর অনুশীলন এই গুণগুলির সহাবস্থান যে কোনও মানুষকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে। দারিদ্র্য বা উচ্চতর ডিগ্রির অভাব কোনও প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না তা বারে বারেই প্রমাণ করেছেন অনেকের সঙ্গে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।
বেশ কিছু কাল আগের কথা বলছি। তখন রাজশার্দূল এর শাসনামল বিরাজমান। ‘শরীয়তপুরের লোনসিং’ নামের একটি গ্রামে বাস করতেন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ। নাম ‘অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য’। পেশা ‘যজমানি’। অর্থাৎ পুজোর দক্ষিণার দাক্ষিণ্যই তাঁর সংসারযন্ত্রকে সচল রাখতে সাহায্য করত। তবে মধ্যে কাজ করতেন স্থানীয় জমিদারের কাছারিতেও। তাঁর পরিবারেই ১৮৯৫ সালের ১লা আগস্ট গৃহিণী ‘শশিমুখী দেবী’ জন্ম দেন এক পুত্র সন্তানের। দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেওয়া পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তানটির কথাই আজকে বলতে বসেছি। তাঁর নাম গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। ভারতীয় উপমহাদেশে তিনিই সম্ভবত কীট আচরণ বিদ্যার পথিকৃৎ।
পাঁচ বছর বয়সে অম্বিকাচরণ পরলোক গমন করেন। বাড়ে দারিদ্র্যের মাত্রা। দরিদ্র পরিবারের দারিদ্র্যের এই কষাঘাত গোপলাচন্দ্রের শৈশবকে কষ্টময় করে তুলেছিল। প্রতি মুহূর্তে জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাঁকে চলতে হত। ছোটবেলায় তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই হাইস্কুল শেষ করার পর তিনি যখন ১৯১৩ সালে কলেজে আই এ পড়ার জন্য ভর্তি হলেন তখন তাঁর আর কলেজ এর পাঠ্যক্রম শেষ করা হয়ে উঠে নি। তবে স্কুলে থাকতেই তিনি কীট পতঙ্গের প্রতি আগ্রহী ওঠেন। কীটপতঙ্গের প্রতি তাঁর আগ্রহের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন এভাবে তাঁর জীবনীতে,
‘‘ছেলেবেলার অনেক ঘটনার কথাই ভুলে গেছি, তবে কোন কোন ঘটনার অনেক কিছু স্মৃতিই রয়ে গেছে – কতক ঝাপসা, কতক পরিস্কার। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে যোগেন মাস্টারের কথা। মাঝে মাঝে যোগেন মাস্টার ছেলেদের ডেকে এনে ম্যাজিকের খেলা দেখাতেন। একটা মজার জিনিস দেখাবেন বলে একদিন তিনি ক্লাসরুমে মাস্টার, ছাত্র সবাইকে ডেকে নিয়ে এলেন। পকেট থেকে গাঢ় খয়েরী রঙের কয়েকটি বিচি বের করে মাস্টারদের হাতে দিয়ে বললেন – দেখুন তো জিনিসটা কী এবং এতে কোন ছিদ্র বা টুটা-ফাটা আছে? দেখতে কতকটা কাঁই বিচির মতো হলেও আসলে তা নয়, কোনও একটা অজানা ফলের বিচি – মসৃণ ও গোলাকার, কোথাও কোনও টুটা-ফাটা নেই। বিচিগুলি টেবিলের ওপর রাখার কয়েক মিনিট পরেই একটা বিচি হঠাৎ প্রায় চার ইঞ্চি উঁচুতে লাফিয়ে উঠলো। তারপর এদিক ওদিক থেকে প্রায় সবগুলি বিচিই থেকে থেকে লাফাতে শুরু করে দিল। অবাক কাণ্ড। কিভাবে এটা সম্ভব হতে পারে? আমরা তো ছেলেমানুষ, বড়রাই কিছু বুঝতে পারেন নি। অবশেষে মাস্টারমশাই ছুরি দিয়ে একটা বিচি চিরে ফেলতেই দেখা গেল, তার ভেতরে রয়েছে একটা পোকা (Larva)। টেবিলের ওপর পড়েই পোকাটা ধনুকের মতো শরীরটাকে বাঁকিয়ে দু-প্রান্ত একত্রিত করে এক অদ্ভুত ভংগিতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
এই ঘটনা থেকেই কীট-পতঙ্গ, পোকা মাকড় সম্পর্কে একটা কৌতূহল জাগতে লাগল। নতুন কোনও পোকা-মাকড় বা গাছপালার কোনও বৈশিষ্ট্য নজরে পড়লে বিষ্ময় জাগতো বটে, কিন্তু সুসংবদ্ধ জ্ঞানের অভাবে তার প্রকৃত রহস্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল না।’’
১৯১৩ সালে গ্রামের লোনসিংহ স্কুল থেকে জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯১৪ সালে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। শহরে পড়াশুনার খরচ জোগানো সংসারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে বিশ্বযুদ্ধের ঝাপটা এসে পড়ল। ফলে পাকাপাকিভাবে পড়াশুনা বন্ধ করে গ্রামে যেতে হল। এখানে পণ্ডিতসার স্কুলে সহকারী শিক্ষকের পদে মাত্র ১৬ টাকায় শিক্ষকতার কাজে যুক্ত হন। যখন তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন স্কুলে যাবার পথে, রাস্তার পাশে ছোট ছোট পোকামাকড়, তাদের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি এই সব অভিজ্ঞতা, তার বিস্তারিত পরীক্ষা নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ করে তা লিপিবদ্ধ করতেন এবং প্রবাসী, ভারতবর্ষ, সহ অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ করতেন।
স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় তাঁর সাহিত্যের প্রতিও আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তিনি জারি গানও লেখা শুরু করেন । জারি ও পালাগানলেখার পাশাপাশি তিনি ১৯১৭ সালে ‘শতদল’ নামক একটি মাসিকপত্র প্রকাশ করা শুরু করেন, যা প্রতিমাসে প্রকাশিত হত। দুঃসহদের জন্যও কাজ করার একটি সংস্থাও গঠন করেন তিনি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করা, প্রকৃতির সংস্পর্শে এনে প্রকৃতির প্রতি তাদের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বিজ্ঞান ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন হাতেকলমে বিজ্ঞানের বিভিন্ন সৃষ্টিকে উপলব্ধি করার জন্য। ‘সনাতন’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও এই সময়ে পালন করেন।
বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণার প্রতি তাঁর যেমন আগ্রহ ছিল তেমনি তিনি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা ও আগ্রহ তৈরি করতেন। কীটপতঙ্গের জীবনযাত্রা নিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন এবং ছাত্রদের প্রশ্নের সহজ ও সরল উত্তর দিতেন।
তাঁর গবেষণার নানাবিধ বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কীটপতঙ্গের গবেষণা। ‘ছোট লাল পিঁপড়ে’, ‘নালসে পিঁপড়ে’, ‘মাকড়সা’, ‘শিকারি মাকড়সা’, ‘সাপ’, ‘ব্যাং’, ‘টিকটিকি’, ‘প্রজাপতি’, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তাঁর গবেষণার বিষয় নিয়ে অনেকে দেশে বিদেশে গবেষণা করে প্রতিষ্ঠিত হন, নোবেল পুরস্কার পান কিন্তু তিনি পাননি। ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ তার অন্যতম সেরা গ্রন্থ। ১৯৩০ সালে ‘বাংলার মাছ খেকো মাকড়সা’ সম্বন্ধে তাঁর পর্যবেক্ষণ জগদীশচন্দ্র বসুর নজরে পড়ে।
‘পিঁপড়ে অনুসারী মাকড়সা’, ‘টিকটিকি’, ‘শিকারি মাকড়সা’ সম্পর্কে তাঁর লেখা গবেষণাপত্র ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি জার্নাল’, ‘আমেরিকার সায়েন্টিফিক মান্থলি’,‘ কলকাতার সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’-এ প্রকাশিত হয়। তাঁর মোট ২২টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।
গোপালচন্দ্র যখন একা একা তাঁর গবেষণা করে যাচ্ছিলেন, তখন বিজ্ঞানের এই শাখার মূলধারাটি ছিল জার্মানিতে। যদি তিনি এই মূলধারার সঙ্গে মিলে যেতে পারতেন তাহলে তিনি হয়তো সারা বিশ্বে সুপরিচিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ত্রয়ী ‘লরেঞ্জ’, ‘টিন বার্গেন’ ও ‘ফন প্রিন’-এর সমগোত্রীয় হয়ে যেতেন। তিনি ‘চার্লস ডারউইন’, ‘জ্যাঁ অ্যারি ফ্যাবার’, ‘ওজিন মারে’দের সঙ্গে এক সারিতে অবস্থান করতেন।
তাঁর জীবনী যদি পর্যালোচনা করা যায় তবে তাঁর কর্মগুলিকে বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চার প্রেক্ষিতে মহাকাব্যিক আখ্যা দেওয়াই যায়। তিনি পরবর্তী জীবনে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার কারণে তিনি অনেক সুযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। তবুও তিনি সত্যিকার অর্থেই মেধা মনন এবং মানসিকতার দিক থেকেও ছিলেন একজন যুক্তিবাদী এবং কুসংস্কারবিরোধী ব্যক্তিত্ব। একথা তিনি তাঁর জীবন কথাতেই লিখে গেছেন।
“পূজার্চনা সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রায়ই বাদানুবাদ হতো। একবার ভাইয়ের (মেজ ভাই নেপালচন্দ্র) ভয়ানক অসুখ হয়। ডাক্তার ও কবরেজ যখন আশা ছাড়লেন তখন একদিন স্বপ্ন দেখার ভান করে একটা ওষুধ মাকে দিলাম, ওষুধ ধারণ করার পর রোগী ধীরে ধীরে আরোগ্যলাভ করে। এই ব্যাপারটাকে উপলক্ষ (করে) পদ্যছন্দে একটি ব্রতকথা লিখে ছাপিয়ে দিলাম। নাম ‘আপদ বিনাশিনীর ব্রতকথা’ বইটি ঘরে ঘরে প্রচারিত হলো। এমন কি আজও বোধ হয় এই ব্রতকথা কোনও কোনও স্থানে প্রচলিত আছে, প্রচারের পর মাকে সমস্ত বিষয়টা যে মিথ্যা তা খুলে বলি, এগুলির আসারতার কথা বুঝিয়ে দিলাম, অন্য লোকেদেরও বললাম, কিন্তু কেউ আমার এই সত্য কথা মানতে রাজি হন নি।”
জগদীশ চন্দ্র বসু তাকে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কাজ করতে সুযোগ দেন সত্যি। তবে একটু ভালোভাবে তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করে দেখলে দেখা যায় সত্যিকার অর্থে কোন কোন স্থানে জগদীশ চন্দ্রের ব্যক্তিত্বের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য গোপালচন্দ্রের কর্মের স্বাধীনতা প্রকাশের অন্তরায় দাঁড়িয়েছে।
সে যাই হোক। গোপালচন্দ্র প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ১৯৩২ সালে। ১৯৩৬ সালে তাঁর জলচর মাকড়সার ওপর কাজটি প্রকাশিত হয় ‘American Museum of Natural History’-এ এবং ১৯৫১ সালে আমন্ত্রিত হন ‘International Union for the Study of Social Insects’-এর সম্মেলনে। অনেক কাজের মধ্যে পিঁপড়ের লিঙ্গ নির্ধারণের পরীক্ষা এবং তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে অন্যতম।
তিনি দলবদ্ধ পতঙ্গ যেমন ‘পিঁপড়া’, ‘মৌমাছি’ ইত্যাদির শ্রমিক, রাণী কি ভাবে জন্মায়,তাদের প্রজনন, রূপান্তর, পূর্ণতা পাওয়া ইত্যাদি খুব বিচক্ষণতার সাথে লক্ষ করেন। তাঁর প্রকাশিত রচনা গুলিতে পর্যবেক্ষণের দক্ষতার পরিচয় মেলে।
সত্যি কথা বলতে যে আমরা যে আজকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করছি। এই বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চা শুরু করা অন্যতম পথিকৃৎ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের অবদান স্মরণ করছি অসম্ভব শ্রদ্ধা আর বিনয়ের সঙ্গে। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যে তিনি জীবনভর কাজ করেন। তাঁর কর্মজীবনে তিনি প্রায় হাজারের মতো বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন যার বেশির ভাগই বাংলায় এবং তা প্রচুর জনপ্রিয়তাও পায়।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য সারা জীবনে হাজারের অধিক প্রবন্ধ লেখেন। বেশিরভাগ বাংলা পত্র পত্রিকায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘প্রবাসী’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘যুগান্তর’, ‘নতুনপত্র’, ‘মন্দিরা’, ‘সাধনা’, ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’, ‘বঙ্গশ্রী’, ‘শিশুসাথী’, ‘সন্দেশ’, ‘নবারুণ’, ‘প্রকৃতি’, ‘অন্বেষা’, ‘দেশ’ প্রভৃতি। গোপালচন্দ্র এই উপমহাদেশের বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনন্য পথিক।
গোপালচন্দ্র প্রথমে জগদীশচন্দ্র বসু’র সহকারী হিসাবে পরে ‘স্যার জগদীশচন্দ্র বোস স্কলারশিপ’ নিয়ে ১৯২৩ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত টানা প্রায় ৪৮ বছর বসু বিজ্ঞান মন্দিরেই গবেষণার কাজে নিয়োজিত থাকেন।
তাঁর ব্যাঙাচি থেকে ব্যাঙের রুপান্তরে পেনিসিলিনের ভূমিকা নিয়ে এই গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে তাঁকে অবসরের পরেও গবেষণা চালিয়ে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৫১ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সামাজিক পতঙ্গ বিষয়ে আলোচনাচক্রে ভারতীয় শাখা পরিচালনার জন্য আমন্ত্রিত হন।
১৯৪৮ সালে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে মিলে ‘বাঙ্গালী বিজ্ঞান পরিষদ’ নামে একটি বিজ্ঞান গবেষনা সমিতি গঠন করেন।
পুলিন বিহারির মতো কয়েক জন বন্ধু মিলে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ১৯৫০ সালে বাঙ্গালী বিজ্ঞান পরিষদের পত্রিকা ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ এর প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি এই পত্রিকার প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তিনি ‘ভারতকোষ’ নামক বাংলা এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরির সময় সহযোগী ভূমিকা পালন করেন।
তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রচিত পুস্তকের মাঝে ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’, ‘করে দেখা’ (তিন খন্ড) অন্যতম। তাছাড়া তাঁর প্রতিটি রচনা একজন প্রকৃতিবিদ এবং যুক্তিবাদী হিসেবে তাঁর বৈদগ্ধ্যের পরিচয় বহন করে।
১৯৬৫ সালে তিনি কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ এবং জ্ঞানের প্রতি তৃষ্ণা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার পটভূমির শুধু প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্বই নন তিনি হলেন অন্যতম। তাঁর লেখা আমাদের কাছে প্রেরণার এক অন্যতম আধার।
তাঁর জীবনে গুরুত্ব পূর্ণ পর্যবেক্ষণের মধ্যে উভচরদের ‘মেটামরফোসিস’, ‘বায়োলুমিনেসেনস’ (bioluminescence) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া তিনি ‘কীট আচরণবিদ্যা’র উপর বিস্তারিত কাজ করেন। তিনি তাঁর কাজ দিয়ে ‘হান্স মলিশ’, ‘হাক্সলি’র মত বিখ্যাত বিজ্ঞানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর জীবনব্যাপী যে সমস্ত বিজ্ঞানের বই লিখেছেন তার মধ্যে অনেকগুলি বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে। তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হল – ‘আধুনিক আবিষ্কার’, ‘মহাশূন্যের রহস্য’, ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’, ‘মনে পড়ে’, ‘প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ’, ‘করে দেখ’, ‘রোমাঞ্চকর জীবজগৎ’, ‘জীবন নিয়ে যে বিজ্ঞান’, ‘জীববিদ্যা’, ‘বিষয় উদ্ভিদ’ সহ আরও অনেক বই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যেই রয়েছে সৃষ্টির অফুরন্ত উৎস, তাঁদের মধ্যেই এই শক্তিকে জাগরিত করার মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের উৎসাহ দিতে হবে, যা গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর ছোটবেলা থেকেই। ‘আনন্দ পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ ছাড়াও তিনি বহু সম্মানে সম্মানিত হন তার সঙ্গে তাঁর মৃত্যুর তিন মাস আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সাম্মানিক ডি এস সি’ সম্মানে ভূষিত হন।
১৯৮১ সালের ৮ই এপ্রিল তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সত্যি কথা বলতে কি গোপাল চন্দ্রের মত অসাধারণ কিছু ব্যক্তিত্বের অবদান আমাদের আজকের দিনে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয়। তাঁর কর্মময় জীবন, বিজ্ঞানের প্রতি ছুটে চলার অপূর্ব আগ্রহ আর বিদগ্ধ এবং যুক্তিবাদী মানস ও মনন আমাদের সর্বদা প্রেরণা যোগাবে। আর উৎসাহ যোগাবে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে বিশ্ব মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে। তাঁর অসমাপ্ত কাজ, অপ্রকাশিত লেখা এবং তাঁর বাংলার কীট-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণা আজও দেশে বিদেশে বিভিন্ন গবেষক কাজ করে চলেছেন, আগামী দিনে এই সমস্ত গবেষক, প্রকৃতি বিজ্ঞানের গবেষণা কোনও নতুন আলোর সন্ধান দিতে পারবে বলে আমরা আশা করে থাকব।
(তথ্যসূত্র:
১- বিজ্ঞান অমনিবাস, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।
২- বাংলার কীটপতঙ্গ, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য।
৩- গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য: ব্যক্তি ও বিজ্ঞানী, গৌরী মিত্র, গাঙচিল (২০০৯)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত