সন ১৮৪৬, ১লা অগাস্ট।
সময় সন্ধ্যা সওয়া ছটা।
লণ্ডনের প্রাচুর্যপূর্ণ মেফেয়ার অঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ সেণ্ট জর্জ হোটেল।
ঠিকানা ৩২ নম্বর অ্যালবিমার্ল স্টীট।
কেনসাল গ্রিন সমাধিক্ষেত্রে যে বাঙালি চিরনিদ্রায় শায়িত, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন হুগলির তীরে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব আনার। ব্রিটিশের দাসত্ব নয়, বরং তাঁদের সহযোগিতায় এ দেশের উন্নতি সম্ভব, এ ছিল তাঁর একান্ত উপলব্ধি। তাই সেকেলে ধর্মান্ধতাকে তুচ্ছ করে বিশ্ব দরবারে বাঙালির শিল্পোদ্যোগী উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে কালাপানি পেরিয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর বিলেতে। অথচ বাঙালি তাঁকে মনে রেখেছে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর্দা হিসেবে!
তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ব্যাঙ্কের সঙ্গে বাঙালির যোগসূত্র গড়ে তোলা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের উন্নতিসাধন বা ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে রেলপথ স্থাপনের স্বপ্ন দেখা— এ সবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। তাঁর হাত ধরেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বৈভব ও প্রতিপত্তির সূচনা।
৫১ বছর বয়সের এক বাঙালী ভদ্রলোক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুশয্যাতেও তাঁর অগাধ সৌজন্যবোধের এতটুকু ঘাটতি দেখা যায় নি। তাঁর সদাহাস্য মুখে ছিল একটিই কথা “I am content”। এই ভদ্রলোকের নাম প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর – কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর সম্বন্ধে কবিগুরু চিরকাল এক রহস্যময় নীরবতা বজায় রেখেছেন।
দ্বারকানাথের নিজে হাতে লেখা শেষ চিঠির তারিখ ১৯শে মে, ১৮৪৬। পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে মৃদু ভর্ৎসনা করে লিখেছেন,
“All that I have hithertoheard from other quarters, as much as what Mr. Gordon has written me about your Amlahs now convinces me of the truth of their reports. It is only a source of wonder to me that all my estates are not ruined. Your time, I am sure being more taken up in writing for the newspapers and in fighting with the missionaries than for watching over and protecting these important matters which you leave in the hands of your favorite Amlahs instead of attending to (them) yourself most vigilantly.”
তারপর একই চিঠিতে পুত্রকে বিস্তারিত নির্দেশ দিয়েছেন কি করে বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করা যায়।
অন্যত্র লিখেছেন তাঁর পাঠানো শ্বেতপাথরের মূর্তি, ইতালীর বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য উপভোগ্য সামগ্রী বেলগাছিয়া ভিলায় এবং অন্যাত্র কিভাবে সযত্নে রাখতে হবে। ব্রাহ্মধর্ম ও তত্ত্ববোধিনী সভা নিয়ে অত্যাধিক মাতামাতি করে দেবেন্দ্রনাথ, তাতে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও নিরাশ হন নি পিতা। ইতিমধ্যে দ্বারকানাথের এক মারাত্মক অসুস্থতা দেখা দিয়েছে – সে বছরই জুন মাসের শেষে তঁর এক বান্ধবী সেসিলিয়া আণ্ডারউডের (Duches of Iverness) বাড়ীতে পার্টি চলাকালীন। কাঁপুনি দিয়ে এসেছে সাংঘাতিক জ্বর। তারপর উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছে তাঁর অবস্থা। চিকিৎসক ডাঃ মার্টিন তাঁকে আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্যে নিয়ে গেছেন ব্রাইটনে। হুলি নামক এক ভৃত্য বিশ্বস্তভাবে সেবা করছেন তাঁর মনিবের। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটে নি। ২৭শে জুলাই অতি সন্তর্পণে তাঁকে আবার নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁর প্রিয় সেন্ট জর্জ হোটেলে।
ক্ষুরধার বুদ্ধি দ্বারকানাথের নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি ছিল না যে তাঁর জীবনাবসান আসন্ন। ছারখার হয়ে গেছে ‘ব্যারন’ উপাধিলাভের আশা বা দেশে ফিরে একক প্রচেষ্টায় অর্জিত প্রভূত সম্পত্তি উপভোগের সম্ভাবনা। বাঙালী মানসে যাঁর ভাবমূর্তি শুধুমাত্র এক অপব্যায়ী, ভোগবিলাসী, উড়নচণ্ডী ইংরেজদের আজ্ঞাধীন এক জমিদারের। তাহলে মৃত্যুকালে কী করে এসেছিল এই অদ্ভুত প্রশান্তি! তাঁর জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালানি লিখেছেন,
“… yet he took this bitter disappointment, along with great physical pain, calmly, and would respond to each query about how he felt with a faint smile and murmur, “I am content.” This would indicate, despite his frankly worldly-minded and epicurean ways, a large reserve of inner spiritual resources.”
কিন্তু কী হয়েছিল দ্বরাকানাথের? প্রথমে ডাক্তাররা এক ধরণের ম্যালেরিয়া বলে সন্দেহ করেন। অথচ তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা আছে “Fever, disease ofright lung.”। সেই সময়ে এক গুজব রটে যে মহারানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা থাকায় তিনি বৃটিশ আমলাদের কয়েকজনে বিষনজরে আসেন এবং তাঁকে সরিয়ে ফেলতে চক্রান্ত করা হয়। (উল্লেখ্য যে সরকারীভাবে পড়াশুনো বিশেষ না করলেও দ্বারকানাথ মহারানীকে প্রথম দর্শনেই বিমোহত করেন। ৮ই জুলাই, ১৮৪২ সালে ভিক্টরিয়া তাঁর ডায়রীতে লেখেন, “The Brahmin speaks English remarkably well, and is a very intelligent, interesting man.”)। এর সত্যি মিথ্যে যাচাই করা কঠিন, কিন্তু এমন একটু ধারণা ঠাকুর পরিবারের অন্দরমহলেও অন্ততঃ কিছু লোক পোষণ করতেন। ইঙ্গিত মেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত “On the Edges of Time” গ্রন্থে। দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন যে তাঁর অকাল মৃত্যু ঘটেছিল, “under somewhat mysterious circumstances.”।
প্রসঙ্গতঃ, দ্বারকানাথের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে লণ্ডনশহর জুড়ে খুব ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। তাঁর বন্ধু প্রখ্যাত সাংবাদিক জে এইচ স্টকলার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন,
“A terrific thunderstorm passed over the great city at the hour of his death, as if it were only natural that so truly great a man should pass away in a moment of striking solemnity.”
সে যুগে ইংল্যাণ্ডে শবদাহ করা বে-আইনী ছিল। তাই রাজা রামমোহন রায়ের মত দ্বারকানাথকেও সমাহিত করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। নানান ব্যবস্থাপনা, শবদেহ পরীক্ষা (পোস্ট মর্টেম) করতে কয়েকদিন সময় লাগে এবং ৫ই আগস্ট তাঁর কবর দেওয়ার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়। গুণমুগ্ধ মহারানী ভিক্টোরিয়া চারটি রয়্যাল ক্যারেজ পাঠিয়েছিলেন। শবদেহের সঙ্গে চলেছিলেন পুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নে নবীনচন্দ্র ছাড়াও স্যার এডওয়ার্ড রায়ান, মেজর হেণ্ডার্সন, ডাঃ এইচ এইচ গুডিভ, প্রখ্যাত স্থপতি উইলিয়ান প্রন্সেপ, মোহনলাল প্রমুখ গণ্যমান্যরা। শবাধারে ঢাকনির ওপর রূপোর পাতে মৃতের পরিচিতি লেখা ছিল,
“Baboo Dwarakanauth Tagore, Zumindar,
Died 1st August, 1846, Aged 51 Years.”
গন্তব্যস্থল উত্তর লণ্ডনের কেনসাল গ্রীন সেমিটারি। উপস্থিত বন্ধুরা যে তাঁকে যথোচিত সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। পদমর্যাদায় এই শবস্থানটি ছিল ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবির ঠিক পরেই। ওয়েস্টমিনস্টারের রেওয়াজ ছিল “by invitation only”- এ কারণে কেনসাল গ্রীনে অনেক নামকরা ব্যক্তি তথা মনীষীর সমাধি হয়। যেমন ইংরেজ রাজপরিবারের অগাস্টাস ফ্রেডেরিক ও ডিউক অফ সাসেক্সের, এছাড়া চার্লস ব্যাবেজ (আধুনিক কম্পিউটারের পথিকৃত), উইলিয়াম মেকপীস থ্যাকারে, ইসম্বার্ড কিংডম ব্রুনেল, উইলিয়াম উইল্কি কলিন্স প্রমুখের। এই সেমিটারির প্রতিপত্তি সম্পর্কে কিছুটা কৌতুকভরে জি কে চেস্টারটন পরবর্তীকালে লিখেছিলেন,
“Before the Roman came to Rye, or out to Severn strode, The rolling English drunkard made the rolling English road. My friends we will not go again or ape an ancient rageOr stretch the folly of our youth to be the shame of age, But walk with clearer eyes and ears this path that wandereth And see undrugged in evening light the decent Inn of death; For there is good news yet to hear and fine things to be seen Before we go to Paradise by way of Kensal Green.”
পরবর্তীকালে অবহেলায় এই সমাধির অবস্থা নিতান্তই করুণ হয়ে দাঁড়ায়! এমন কি ওখানে সমাহিত বিখ্যাত মনীষীদের তালিকায় দ্বারকানাথের নামও নেই। যারাই দ্বারকানাথ কে নিয়ে খোঁজ করতে এখানে গিয়েছেন, তাঁদের সকলেরই তাঁর সমাধি খুঁজে পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
৬ই আগস্ট ১৮৪৬-এর লণ্ডন টাইমসের পাঁচ নম্বর পাতা থেকে জানা যায় আরও এক আশ্চর্য তথ্য –
“It is stated that the fine face and features of the deceased man were so little changed by death that the parties, called on to perform the usual offices on similar mournful occasions were with some difficulty persuaded that the spirit has fled. While in this state, a cast of the Baboo’s face was taken.”
মৃত ব্যক্তির মুখের ছাঁচ নেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল সে যুগে, বিশেষ করে তিনি যদি হতেন বিখ্যাত কোন মনীষী। মনে রাখতে হবে ফটোগ্রাফি জিনিসটা তখন সবে উদ্ভাবিত হয়েছে, ব্যবহার তখনো তেমন শুরু হয় নি। মুখের এই রকম ছাঁচকে বলা হত ‘ডেথমাস্ক’ বা ‘মৃত্যুমুখোশ’। ঠিক এমনটি করা হয়েছিল দ্বারকানাথের তেরো বছর আগে যখন ব্রিস্টলে মৃত্যুবরণ করেন রাজা রামমোহন রায়। (রামমোহনের মৃত্যুমুখোশের একটি কপি কলকাতায় পৌঁছয় শিবনাথ শাস্ত্রীর সৌজন্যে ১৮৮৬ সালে, যদিও মূল ছাঁচটির হদিশ হারিয়ে যায় রামমোহন-জিজ্ঞাসুদের কাছ থেকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আসলটা খুঁজে পান গবেষক শ্রী অনিরুদ্ধ সান্যাল, স্কটল্যাণ্ডের এক মিউজিয়ামের গুদামঘরে।) কিন্তু দ্বারকানাথের ক্ষেত্রে তাঁর মৃত্যুমুখোশের কি হল – তার কোন হদিশ মেলে না। দ্বারকানাথের জীবনীকার ও বিবাহসূত্রে ঠাকুর পরিবারের অন্তর্গত কৃষ্ণ কৃপালানি স্বীকার করেছেন, “what happended to the cast of the face thus taken is not known.”
লণ্ডন টাইমসের বিবরণ থেকে আরও জানা যায়,
“The heart was subsequently removed from the body for transmission to India, there to be dealt with in accordance with the tenets of the sect to which the Baboo belonged.”
কার মাথা থেকে এসেছিল এই উদ্ভট বুদ্ধি? কেই বা মৃতদেহ থেকে হৃৎপিণ্ডটা নিষ্কর্ষণ করলেন? কারাই বা দাঁড়িয়ে দেখলেন এই বীভৎস কীর্তিকলাপ? মনে রাখতে হবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং ডাঃ গুডিভ এবং তাঁর ছাত্ররা। এঁদের অন্ততঃ দুজনে বিলেতে এসেছিলেন দ্বারকানাথের দাক্ষিণ্যে। শিক্ষা বিস্তারে, বিশেষতঃ চিকিৎসাশাস্ত্রে, দ্বারকানাথের চরম উৎসাহ ছিল। বিলেতে ডাক্তারী পড়তে আসা প্রথম চারজন ভারতীয় ছাত্রের নাম ভোলানাথ বসু, দ্বারকানাথ বসু, গোপালচন্দ্র শীল ও সূর্য্যকুমার চক্রবর্তী। শোনা যায় গোঁড়া হিন্দু ছাত্রদের যাতে শব ব্যবচ্ছেদের ব্যাপারে সংকোচ না ঘটে তার জন্যে ব্রাহ্মণ দ্বারকানাথ ঠাকুর গোড়ার দিকে নিজে উপস্থিত থাকতেন। তাই ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। এই চারজন ছাত্র ও তাঁদের গুরুমশাই দাঃ গুডিভ দ্বারকানাথের সঙ্গে একই জাহাজে বিলেতে আসেন। কাজেই প্রয়োজনে এ কাজ তাঁদের মধ্যে কেউ একজন নিপুনভাবে করে থাকতে পারেন। কিন্তু কেন করলে্ন এই কাজ? শবদেহ থেকে নির্গত হৃৎপিণ্ড হিন্দু বা ব্রাহ্ম অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কোন কাজে লাগে বলে বর্তমান লেখকের জানা নেই। তবে কি এর অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল? উপস্থিত ডাক্তারুরা কিছু সন্দেহ করেছিলেন কি? হয়তো কোন আছিলায় হৃৎপিণ্ডটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করতে? তাহলে কি তাদের সরকারি ডেথ সার্টিফিকেটে তাঁদের আস্থা ছিল না?
প্রসঙ্গতঃ সূর্য্যকুমার ছিলেন অসাধারণ মেধাবী এবং ডাঃ গুডিভের অতি প্রিয় ছাত্র। Comparative anatomy-তে ছ’শ ইউরোপিয়ান ছাত্রকে পরাভূত করে প্রথম স্থান ও স্বর্ণপদক অধিকার করে তিনি ইংরেজদের অবাক করে দিয়েছিলেন। সারা নামে এক ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং Soorjee Coomar Goodeve Chuckerbutty নাম নেন। পরে দেশে ফিরে ডাক্তারী প্র্যাকটিস করে খুব নাম করেন। অদৃষ্টের এমনই খেলা যে ইনিও বিলেত সফরকালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা যান এবং ওঁকেও কেনসাল গ্রীন সেমেটারিতে সমাহিত করা হয়। ওঁর উত্তরসূরীদের মধ্যে cephologist প্রণয় রায় এবং লেখিকা অরুন্ধতী রায় আজ বিশ্ববিখ্যাত।
আশ্চর্যের ব্যাপার হৃৎপিণ্ডের কি হয়েছিল তাও জানা যায় না। কৃপালানি লিখছেন, “There is no record of what happened to the heart assuming as the Times reported, that it was removed.” তবে এ কথা জানা যায় যে বন্ধু ও আত্মীয়দের ইচ্ছে অগ্রাহ্য করে ব্রাহ্মমতে শ্রাদ্ধ করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন, হিন্দুমতে পিতার শ্রাদ্ধ করতে মা পরলোক থেকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন। দ্বারকানাথ সংস্কারমুক্ত হলেও হিন্দু বাছবিচারে নিমজ্জিত দিগম্বরী দেবীর কাছে এটা আশা করা কি তাঁর জীবিতকালেও কি যুক্তিযুক্ত হত?
কেন উঠে আসছে এইসব অপ্রিয়, অস্বাস্থ্যকর ও বিষাদগ্রস্থ প্রসঙ্গ? ডেথমাস্ক বা শবদেহ থেকে নির্গত হৃৎপিণ্ড তুচ্ছ ব্যাপার নয় কি? কিন্তু এই বিবরণগুলি যে আদৌ তুচ্ছ বা অবান্তর নয়। দ্বারকানাথের স্মৃতি মুছে ফেলার বা তাঁকে দমন করার এক বৃহত্তর প্রয়াসের এটি একটি ক্ষুদ্র অংশ বা নিদর্শন মাত্র। আর এর ধরণটাও বেশ চতুর ও সুক্ষ্ম। ‘দেশ’ পত্রিকার ১২ই ফেব্রুয়ারীর ১৯৯৮ সংখ্যায় প্রিন্স দ্বারকানাথ প্রবন্ধের রচয়িতা স্বর্গত সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখেছেন, “দ্বারকানাথকে প্রিন্স আখ্যায় ভূষিত করে প্রকারান্তরে তাঁকে বাঙালী ভদ্রলোক জাত থেকে আলাদা করার পেছনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছেন, তাঁর পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। পৌত্র রবীন্দ্রনাথের উদাসীনতা যুগিয়েছে বাড়তি ইন্ধন।” ব্লেয়ার ক্লিং তাঁর রচিত দ্বারকানাথের জীবনী “Partner in Empire” বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন,
“I was intrigued by the discovery that the grandfather of the poet Rabindranath and the father of the saintly Debendranath was an astute business tycoon who owned a fleet of ships, coal mines, insurance companies, banks and indigo plantations. At once I sensed the likelihood of a dramatic conflict between the worldly father and his otherworldly son, and imagined Dwarkanath’s profound disappointment when Debendranath refused to carry on the hard-won business empire. In this case research confirmed my guess. I had anticipated that the adulaloy historians of the Tagore family had exaggerated Dwarkanath’s achievements, and I was surprised to discover that he was all they had said and more.”
ঠাকুরবাড়টির ইতিহাস যাঁর নখদর্পণে, সেই কৃষ্ণা কৃপালানি লিখেছেন,
“The Maharshi’s disinterestedness to the memory of his father is the more surprising when one considers that Ram Mohun Roy from whom the Maharshi derived his main religious inspiration, had great affection and regard for Dwarkanath … Poet Rabindranath grew up under the austere and domineering personality of his father from whom he acquired some of his inhibitions which he had overcome later before he could become the ‘myriad-minded’ genius. But his father’s disinterestedness to Dwarkanath’s memory he seemed to have acquired and cherished with a vengeance. Debendranath now and then made a respectful reference to his father, but Rabindranath hardly ever, in his voluminous writings and dialogues, refers to his grandfather. It would seem that what was disinterestedness in his father became almost antipathy in his case.”
মধ্যবিত্ত বাঙালীর মনে দ্বারকানাথের ভাবমূর্তি একপেশে বা গতানুগতিক। রবীন্দ্রনাথের লেখায় দ্বারকানাথের কোন উল্লেখ নেই কেন? এর উত্তরে অনেকেরই জবাব, তার কারণ দ্বারকানাথ ছিলেন দুশ্চরিত্র। বিলেতে তাঁকে প্রতি মাসে নাকি এক কোটি টাকা পাঠাতে হত দেবেন্দ্রনাথকে। সত্যিই কি তাই? আরও কিছু গবেষকের মতে, কলকাতার Sans Souci থিয়েটারের অভিনেত্রী এস্টার লীচ ও তারঁ কন্যার সঙ্গে দ্বারকানাথের খুব সখ্যতা ছিল। এই ব্যাপার নিয়ে বেশ মুখরোচক কুৎসা রটীয়ে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের বন্ধু রামমোহনের দত্তকপুত্র রাজারাম। ১৮১৪ সালের জুন মাসে এক চিঠিতে তিনি এসবের বিবরণ জানান জ্যানেট হেয়ারকে।
সুদর্শন ও তীক্ষ্ণাধী দ্বারকানাথের প্রতি অনেক মহিলা যদি আকৃষ্ট হয়ে থাকেন, তাতে আশ্চর্য হবার খুব কারণ নেই। আর যদি তিনি দুশ্চরিত্র হয়ে থাকেন, তাহলে কেমন করে পেয়েছিলেন সে যুগের মনীষীদের যথা রামমোহন রায়ের ভালোবাসা ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা? কৃপালানির বইতে উদ্ধৃত হয়েছে ক্ষিতীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগরের মন্তব্য, “I know Dwarkanath very well. What is said against him is sheer columny.” অথচ দ্বারকানাথের সম্বন্ধে এই ধরণের বিকৃত ধারণা খুবই প্রচলিত আছে।
দ্বারকানাথের সঙ্গে অনেক মহিলার বন্ধুত্ব ছিল। কেউ কেউ তাঁকে অন্তরঙ্গতার সঙ্গে ‘Dwarky’ বলেও সম্বোধন করতেন। Charlotte Harvey নামে এক মহিলা তো বিয়ের আগে অন্ততঃ একবার নৈশভোজ করতে চেয়েছিলেন। ১৮৩৭ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “I trust however to be able to dine with you once before I am married. Believe me, always and even to be your sincere and I dare not say further.” এইসব ঘটনা সে যুগে হয়তো ঠাকুর পরিবারকে বিব্রত করেছিল। এজন্যেই বুঝি ডেথ সার্টিফিকেটে উল্লিখিত জেমিমা পাইন সম্পর্কে দ্বারকানাথের জীবনীকাররা (কিশোরীচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণ কৃপালানি প্রমুখরা) কেউই কোন উচ্চবাচ্চ্য করেন নি। কে ছিলেন এই জেমিমা পেইন যিনি মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে ছিলেন? যাঁকে সাক্ষী ধরা হয়েছে “Jemima Payne, present at death, 32 Albemerle Street” – অর্থাৎ যাঁর ঠিকানা দ্বারকানাথের সঙ্গে এক? এমন হতেই পারে যে তিনি সেই হোটেলের কর্মচারী বা ম্যানেজার ছিলেন। প্রশ্ন হতে পারে পরে তাহলে তাঁর কোন উল্লেখ নেই কেন? (প্রসঙ্গতঃ রামমোহন যখন মৃত্যুশয্যায়, সেই সপ্তাহে তাঁর ঘর থেকে কে ঢুকছেন বা কে বেরোচ্ছেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে তাঁর জীবনীকারদের লেখায়, তাঁর ডাক্তারের রোজনামচায়।) একথাও জানা যায় যে দ্বারকানাথ Claret বা অন্যান্য সুরাপান করতেন। তাই বলে কি তাঁকে দুশ্চরিত্র বলাটা আজকের দিনে অহেতুক নয় কি?
এবার দ্বারকানাথের ভোগবিলাসী আচরণ, বেহিসেবী খরচা, সাহেবদের নিয়ে খানাপিনা এবং বিশৃঙ্খল ফূর্তির প্রসঙ্গে আসা যাক। দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে জানা যায় যে উক্ত কারণগুলির জন্যে দ্বারকানাথের শেষ জীবনে কার-টেগোর কোম্পানি দেউলিয়া হবার উপক্রম হয়। এই কোম্পানি লাটে ওঠার পর মহর্ষি লিখলেন, “বিষয়সম্পত্তি সকলি হাত হইতে চলিয়া গেল। যেমন আমার মনে বিষয়ের অভিলাষ নাই, তেমনি বিষয়ও নাই; বেশ মিলিয়া গেল।“ অথচ পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দুটি জমিদারী ছাড়াও তাঁর নিজের অর্জিত দুটি জমিদারীর ট্রাস্ট ডিড রেখে গিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। বিরাহিম্পুর, পাণ্ডুয়া, কালীগ্রাম ও শাহজাদপুরের জমিদারীগুলি বহু পুরুষ ধরে ঠাকুর পরিবারের স্বচ্ছলতা বজায় রেখেছিল।
সেকারণে দ্বারকানাথ জমিদারীর সঙ্গে ঋণভার রেখে গিয়েছিলেন একথা অনস্বীকার্য্য। কিন্তু এখানেও দেখা যায় দেবেন্দ্রনাথের অতিরঞ্জন। তিনি বলেছেন যে ১৮৪৮ সালে কার-টেগোরের দেনা ছিল এক কোটি টাকা আর পাওনা ছিল সত্তর লক্ষ অর্থাৎ ত্রিশ লক্ষ টাকার ঘাটতি। অথচ সিদ্ধার্থ ঘোষের গবেষণা থেকে জানা যায় যে কোম্পানীর মোট দেনা ছিল ২৫ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা; আর সমস্ত সম্পত্তি ও অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২৯ লক্ষ ২ হাজার ৯৫০ টাকা। (১৮৪৮ সালের ৫ ই এপ্রিল বেঙ্গল হরকরা পাতায় প্রকাশিত হয় এই তথ্য।) দেবেন্দ্রনাথ আরো লিখেছেন, ব্যক্তিগত ঋণশোধের জন্যে দ্বারকানাথ ট্রাস্ট ডিডের সম্পত্তিও হস্তান্তর করতে রাজী ছিলেন। কিন্তু দ্বারকানাথের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী পার্টনার গর্ডন এবং ইয়ং জানতেন ট্রাস্ট ডিডের সম্পত্তিতে এইভাবে হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকারই ছিল না দেবেন্দ্রনাথের। তদুপরি ক্লিং-এর লেখা থেকে জানা যায় গর্ডন এবাং স্টুয়ার্ট উভয়েই দেবেন্দ্রনাথ, নগেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ আপোস–মীমাংসার সুযোগ দিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখেছেন, “কার-টেগোর কোম্পানীর অবস্থা মোটেই শোচনীয় ছিল না… ঠাকুর পরিবারের সংস্রবচ্যুত হয়ে গর্ডন-স্টুয়ার্ট কোম্পানী নামে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে যান।”
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে মহর্ষি পরবর্তীকালে জমিদার হিসেবে যথেষ্ট বৈষয়িক বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। তাহলে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর কার-টগোর বা ইউনিয়ন ব্যাংক চালানোর ব্যাপারে তাঁর এত অনীহা কেন দেখা গিয়েছিল? এর উত্তর পাওয়া যায় ঠাকুর পরিবারের-ই ক্ষিতীন্দ্রনাথের লেখায়, “একটি বৃহৎ কারবার চালাইতে গেলে যে বুদ্ধি, দূরদর্শিতা এবং সর্বোপরি যে সংযম আবশ্যক, সত্যের অনুরোধে চলিতে বাধ্য দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ তিন ভ্রাতার কেহই প্রাপ্ত হন নি। পরিশ্রম করিয়া, মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া অর্থোপার্জনে তাঁহারা তিনজনেই অসমর্থ ছিলেন বলিলে অত্যুক্তি হইবে না…। দেবেন্দ্রনাথ আসলে শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। বেশ চুপচাপ বসিয়া দর্শনশাস্ত্র আলোচনা করিবেন, আর নির্ঝঞ্ঝাটে প্রয়োজন মত টাকাকড়ি জমিদারী হইতে আসিলেই দেবেন্দ্রনাথ সুখী।“
দেবেন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অটল আনুগত্যসম্পন্ন। অথচ চরিত্রের দিক থেকে তাঁর মিল ঠাকুর্দার সঙ্গেই বেশী। কৃপালানি লিখেছেন,
“… Rabindranath was not so orthodox a Brahmo as to despise all who, like Dwarkanath, believed in orthodox forms of Hindu worship; his novel ‘Gora’ and many other writings bear ample testimony to his intellectual liberality; he was not an ascetic and did not disdain or look down upon worldly mindedness. In fact, he believed, despite his personal inhibitions, in a full-blooded love of life. Why then did he fail to appreciate and admire his grandfather to whom he owed not merely the material ease of his existence, but not a little of his versatility, his whole-some love of life, his love of music, the arts and the theatre, his comprehensive outlook, his universal-mindedness, not to speak of his love of foreign travel?” তিনি আরও বলেছেন যে, “… had Rabindranath taken the pains to study his grandfather’s life and activities, his generous impulses and humanitarian deeds, he would have grown to understand and admire him.”
একাধিকবার লণ্ডনে গেলেও একবারের জন্যেও তিনি কেনসাল গ্রীনে ঠাকুর্দার সমাধিস্থলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। কাজেই যখন জানতে পারি যে কার-টেগোরের আর্থিক সংকটের বিষয় অতিরঞ্জন, গর্ডন-ইয়ং-এর ভূমিকা প্রতিকূল মন্তব্য ইত্যাদি দেবেন্দ্রনাথের কীর্তিকলাপ নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করার রাস্তা তিনি বন্ধ করে দিয়ে গেছেন, তখন কারোরই খুব আশ্চর্য হওয়া উচিত নয়। স্বয়ং ক্ষিতীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ইহার (কার-টেগোর) সম্বন্ধীয় কাগজপত্র পূজ্যপাদ রবীন্দ্রনাথের কর্তৃত্বে এবং তাঁহার আদেশে দগ্ধীভূত হওয়ায় এই কারবার কত বিস্তৃত ছিল এবং কী রূপে পরিচালিত হইত তাহার বিবরণ উদ্ধার করিবার কোন আশা নাই।” মূল্যবোধের যে সংকটের তাগিদে ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ এই কাণ্ডটি করেন ব্লেয়ার ক্লিং বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর “Rabindranath’s Bonfire” প্রবন্ধে। ক্লিং-এর মতে এটি কবির আবেগ ও অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে এক emotional প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ক্ষিতীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যাটিও যে সমানভাবে প্রযোজ্য তাতে লেখকের সন্দেহ নেই।
সিদ্ধার্থ ঘোষের মতে দ্বারকানাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মনটি বিষিয়ে দেন দেবেন্দ্রনাথ। ঠাকুর্দার মৃত্যুর ১৭ বছর পরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম; তিনি কখনোই দ্বারকানাথের সংস্পর্শে আসেন নি। অথচ তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথের ছিল ঠাকুর্দার প্রতি সম্পূর্ণ অন্য মনোভাব। অসাধারণ মেধাবী সত্যেন্দ্রনাথ এক সুকঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম ভারতীয় আই সি এস হন – একথা সর্বজনবিদিত। বিলেতে প্রশিক্ষণের সময়ে তিনি দেবেন্দ্রনাথের কবল মুক্ত অবস্থায় ঠাকুর্দার স্মৃতির সঙ্গে বিজড়িত বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। এই সময়েই তাঁর শিশুপুত্র টোবির ঠাণ্ডা লেগে মৃত্যু ঘটে এবং তাকে দ্বারকানাথের কবরের কাছেই সমাহিত করা হয়। (জ্ঞানদানন্দিনীর স্মৃতিকথায় এই ঘটনা জানা যায়, যদিও বর্তমান লেখক বহু চেষ্টা করেও এর সঠিক স্থান নির্ণয় করতে পারেন নি।) ঠাকুর্দার প্রতি বিদ্বেষ থাকলে নিশ্চয়েই এরকম হতে দিতেন না।
সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল ১৮৪২ সালে, অর্থাৎ যে বছর দ্বারকানাথ তাঁর প্রথম ইউরোপ সফর সেরে দেশে ফেরেন। তাঁর বয়স যখন চার বছর, সেই সময়ে দ্বারকানাথ দ্বিতীয় ও অন্তিমবারের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে বেরোন। শিশুমনে হয়তো প্রশ্রয়পূর্ণ ঠাকুর্দার কিছু স্মৃতি রয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরবাড়িতে তিনিই দ্বারকানাথের পরে প্রথম কালাপানি পার হন। হয়তো সে কারণেই তিনি ঠাকুর্দার প্রতি সমবেদনা অনুভব করতেন। নিজের বুদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দরুণ তিনি দ্বারকানাথের স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়া বিলেতে পৌঁছনোর পর পরই তাঁর একটি অভিজ্ঞতা হয়। সে সম্বন্ধে নিজে কিছু না বললেও তাঁর সুহৃদ মনমোহন ঘোষের লেখা একটা চিঠিতে এই ঘটনাটা জানতে পারি। এর আগেই উল্লেখ করেছি যে দ্বারকানাথের বৈশিষ্ট্যহীন সমাধিটি কেনসাল গ্রীনে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ওখানে সমাহিত ৫০ জন বিখ্যাত মনীষীদের মধ্যে দ্বারকানাথের নাম নেই। বস্তুতঃ, ১৯শে মে, ১৮৮২ সালে জ্ঞানেন্দ্রনাথকে লেখা মনমোহনের বিরক্তি, ক্রোধ ও নৈরাশ্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। এই চিঠির কিছু অংশ নীচে উদ্ধৃত করা হল। মনে রাখতে হবে যে চিঠির বিষয় হচ্ছে মনমোহন ঘোষ ও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কেনসাল গ্রীন প্রথমবার দর্শনের অভিজ্ঞতা।
“The very name of the place will of course fill your heart with a sort of melancholy reverence in the great man that sleeps there his eternal sleep. The very sight of the tomb, though it excited feelings of reverence for the dead man who lay underneath, at the same time made us uneasy not knowing how to reconcile the description we had heard at home from what we saw. We were both disgusted to see the imposition that has been practiced by those who had hands in the matter. We had heard that there was a handsome tomb with an inscription in Bengalee but we found out that all this was utter and sheer fabrication and downright falsehood. It is nothing but a mere block of stone (not marble) about 3 cubits in length with no inscription except the following words:
‘D.T.
Dwarkanath Tagore of Calcutta
Absit: 1st August, 1846’
These were the only letters miserably engraved on the piece of stone, which is surrounded by an iron chain, and has 4 cypress trees almost dying. In its side we saw several other tombs and beautiful monuments, but all the time we were uneasy, owing to the thought that came to our mind, viz. that the great man whose example we had followed in coming to England, and to whom only we were indebted for that visit, was occupying a most insignificant tomb, while those who were his courtiers lying under beautiful marble tombs with handsome inscriptions on them. I have been told that your uncle (Maharshi) had to pay thousands of Rupees for that tomb. I learnt it did not cost more than 2 pounds or Rs. 20. In short it was the most ugly tomb we saw in the whole country … will you relate all these to our uncle and with my best respect tell him that I am quite disgusted with this treacherous affair … you can ask him to let us know without delay whether he should like to have his father’s tomb changed and a worthy inscription placed in it and what amount of money he will like to spare for the purpose. If he will decide soon and let us know by the middle of July, we can have a new tomb erected in the 1st August the anniversary.”
এই সনির্বন্ধ অনুরোধের কোন উত্তর মেলে নি দেবেন্দ্রনাথের তরফ থেকে। তবে এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্যেন্দ্রনাথ আসল ব্যাপারটা বিশেষতঃ দেবেন্দ্রনাথের অতিরঞ্জন আর দ্বারকানাথের স্মৃতিকে খাটো করার প্রয়াস নিশ্চয় বুঝেছিলেন।
পিতার প্রতি দেবেন্দ্রনাথের মনোভাব কেন এতটা প্রতিকূল হয়েছিল? তাঁর লেখায় এ বিষয়ে স্ববিরোধের অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। আশ্চর্য্য বিষয় এই যে দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথ দুজনের আদর্শ চরিত্র বলতে দ্বারকানাথের মা অলকাসুন্দরী (আসলে মাসি, তিনি দ্বারকানাথকে দত্তক নিয়েছিলেন) এবং রাজা রামমোহন রায়। অথচ তাঁদের প্রভাবে কী করে এঁরা দুজনে দুই বিপরীত পথের দিশারী হলেন? খুব কাছের থেকে দেখা কোন এমন কী ঘটনা ঘটেছিল যার জন্যে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পিতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন? ১৮৩৩ সালে রামমোহন যখন চরম আর্থিক সংকটের সম্মুখীন এবং ম্যাকিন্টশ কোম্পানীর কাছে তাঁর টাকা পয়সা আটকে ছিল, সে সময়ে দ্বারকানাথ কেন তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন নি কেন? কেন তিনি ম্যাকিন্টশ কোম্পানীর যাবতীয় সম্পত্তি কিনতে ব্যস্ত ছিলেন? তিনি কি রাজা রামমোহনের দুরাবস্থার কথে জানতেন না? নাকি সেই মূহুর্তে ভোগবিলাসে, সুন্দরী রমণীর সাহচর্যেয় এত বিভোর ছিলেন যে খেয়াল হয় নি! অথচ রাজার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শিশুর মত কেঁদেছিলেন এবং পরে ব্রিস্টলে তাঁর স্মৃতির উদ্দ্যেশ্যে প্রিন্সেপকে দিয়ে নির্মাণ করিয়েছিলেন এক চমৎকার স্মৃতিসৌধ। এসব কাণ্ডকারখানা কি ছিল দ্বারকানাথের এক গভীর অপরাধবোধের অভিব্যক্তি? এসব কাছের থেকে দেখেই কি ব্রাহ্মধর্মের ধারক-বাহক ও রামমোহনের মানসপুত্র দেবেন্দ্রনাথের মনে তাঁর পিতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বাসনা প্রবল হয়ে উঠেছিল?
হয়তো বা মৃত্যুর তিনদিন আগে অলকাসুন্দরীকে গঙ্গাযাত্রায় (তাঁর ধর্মান্ধ মাতা দিগম্বরী দেবীর প্রভাবে?) নিয়ে যাওয়ায় ঘোর মনোমালিন্য ঘটেছিল পিতার সঙ্গে? দ্বারকানাথ তখন উত্তর ভারত সফর করছিলেন। একুশ বছরের নাতির কাছে মিনতি করেছিলেন অলকাসুন্দরী। আরো বলেছিলেন দ্বারকানাথ উপস্থিত থাকলে এরকমটা কখনোই হতে দিতেন না। ঠিক বোঝা যায় না, কী কারণে প্রিয় ঠাকুমার কথায় কর্ণপাত করে নি দেবেন্দ্রনাথ। ফিরে এসে এই খবর পেয়ে দ্বারকানাথ যে পুত্রের এরকম অর্বাচীনতায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন তা অনুমান করা যায়। কারণ পরবর্তীকালে দিগম্বরী দেবী যখন মরণাপন্ন অসুস্থ হন তখন গঙ্গাযাত্রা করতে দেন নি দ্বারকানাথ। বরং শেষ মূহুর্ত পর্য্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করিয়েছেন।
“Rabindranath’s Bonfire” প্রবন্ধে ক্লিং লিখেছেন,
“The source of Debendranath’s antipathy could well have been his identification with his mother’s shame and embarrassment over his father’s behavior. This feeling would have been strong enough to last a lifetime.” তিনি আরও লিখেছেন, “The women of his household could not tolerate the slightest deviation from orthodoxy. When he returned from Europe in 1842 and refused to undergo the purification ritual, they considered him defiled and exiled him to a separate building in Jorasanko compound. The young Debendranath, brought up in women’s quarters of Jorasanko, was raised in gossip and inuendos about his father’s relationships with European women.”
সিদ্ধার্থ ঘোষ আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, “ম্লেচ্ছ আচরণের জন্যে স্বামী সহবাসে অসম্মতি জানিয়েছিলেন বলে দ্বারকানাথ-পত্নীর হিন্দু-সাত্বিকতা প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনার পর খ্যাতি-প্রতিপত্তির শিখরবাসী হয়েও দ্বারকানাথ যখন তাঁর বৈঠকখানা বাড়িয়ে নিজেকে সরিয়ে আনেন, স্ত্রী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে, তখন সেটা গুণ হিসেবে ধরা পড়ে না আমাদের মধ্যবিত্ত মননে। দিগম্বরী দেবী শুধু টাকার প্রয়োজনে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়াতেন, তারপর ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল ঢেলে শুদ্ধ করতেন নিজেকে।”
শোনা যায় তাঁর মা অলোকাসুন্দরীর মৃত্যুর পরে এবং ১৮৩৯ সালে স্ত্রী দ্বিগম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে পারিবারিক বিধিনিষেধের শেষ বন্ধনটুকুও ছিন্ন হয়েছিল। বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষী ছড়া কেটে লিখেছিলেন, “বেলগাছিয়ার বাগানে হয় ছুরি কাঁটার ঝনঝনি, … মদের কত গুণাগুণ আমরা তার কি জানি? জানেন ঠাকুর কোম্পানী।”
দ্বারকানাথ প্রজাবৎসল ছিলেন না। তাঁকে নিপাট ভালো মানুষ বলেও ভাবা সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর গুণ ছিল অনেক। সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখেছেন, “এই বিপুল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে আছেন মাঝারি উচ্চতার, পেলব চেহারার একটি মানুষ – দ্বারকানাথ ঠাকুর আর তাঁর ম্যানেজিং এজেন্সি সংস্থা – ‘কার-টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানী’। সময়টা ১৮২০ থেকে ১৮৪৬, যে পর্বে কলকাতায় একটা মিনি-ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন প্রায় ঘটতে চলেছিল। সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ ও সামাজিক হিত সাধনে রামমোহনের অনুরাগী ও সহযোদ্ধা দ্বারকানাথ। আধুনিক চিকিৎসা ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী। অন্ধ ও কুষ্ঠারোগাক্রান্তের হিতার্থী, কলকাতা নগরে উন্নতিকামী জাস্টিস ফর পিস, একাধিক সংবাদপত্রের স্বত্ত্বাধিকারী, মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়াসী, কলকাতা থিয়েটার ও চারুকলা সংস্থার পৃষ্ঠপোষক। দ্বারকানাথের চেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যক্তিত্ব উনবিংশ কেন বিংশ শতাব্দীতেও বিরল।
দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং রামমোহন রায় সমসাময়িক এবং বন্ধু হলেও দু’জন দুই প্রান্তের মানুষ ছিলেন। চিন্তাধারায় এবং উদ্যোগে দ্বারকানাথ তাঁর সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম তথা রামমোহনের একেশ্বরবাদী দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও তিনি কখনও নিজের ধর্ম ছাড়েননি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তখন প্রতি বছর দুর্গা, কালী এবং জগদ্ধাত্রী পুজো হত। এমনকী, এক সময় দ্বারকানাথ নিজের হাতে কুলদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনের নিত্য সেবা করতেন।
১৯৪৩ সালে ইংরেজ সাংবাদিক এইচ এন ব্রেলস্ফোর্ড শিল্পপতি জামশেদজী টাটার প্রসঙ্গে লেখেন,
“Why are the Tatas unique or nearly so? Where were the enterpreneurs of the same calibre whether Indians or Englishmen who should have been doing what they did and much more of the same kind fifty or sixty years earlier?”
এর প্রত্যুত্তরে ব্লেয়ার ক্লিং দেখিয়েছেন যে জামশেদজীর আবির্ভাবের ষাট বছরেরও বেশী আগে সেই caliber-এর ব্যক্তিত্ব ছিলেন দ্বারকানাথ। উপরন্তু দ্বারকানাথের সমস্ত কাজ একটি জীবনে এক হাতে করা। তিনি নাসেরওয়ানজীর মতো কর্মদক্ষ পিতার পথনির্দেশ পান নি, আবার দোরবজীর মতো সুযোগয় পুত্রও পান নি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যকে চিরস্থায়ী করার জন্যে। পান নি ঠাকুর পরিবারের মহিলাদের শ্রদ্ধা ও সহায়তা। এখানে উল্লেখ্য টাটা পরিবারে মহিলারা জামশেদজীর পুত্রদের শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁকে শ্রদ্ধা করতে, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে – এর নজির পাওয়া যায় ক্লিং-এর লেখায়।
কর্মজীবনের পাশাপাশি দ্বারকানাথ ছিলেন থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক এবং শিল্পরসিক। তাঁর নামের সঙ্গে একটা মিথ হয়ে রয়ে গিয়েছে বেলগাছিয়া ভিলা। তত্কালীন সাহেবদের কাছে এটি ছিল ‘পারফেক্ট প্যারাডাইস’। চার দিকে সবুজ ঘাস বিস্তৃত দ্বিতল বাড়িটির প্রতিটি ঘর ছিল ইউরোপীয় ধাঁচের আসবাবপত্রে সাজানো। এ ছাড়াও সে সময় জোড়াসাঁকোর বৈঠকখানা বাড়িটিও সাজানো ছিল দেওয়াল জোড়া আয়না, কাটগ্লাসের ঝাড়বাতি ও বিদেশি শিল্পীদের আঁকা তৈলচিত্রে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলায় পাবলিক ব্যাঙ্ক ছিল না। আধা সরকারি ব্যাঙ্ক এক অর্থে ছিল সরকারি খাজাঞ্চিখানা। ১৮২৮-এ দ্বারকানাথ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলার নেপথ্যেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ সবের পাশাপাশি, এ দেশে সংবাদমাধ্যম স্থাপন এবং তার উন্নতির জন্য দ্বারকানাথের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। ১৮২১-এ রামমোহন প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ‘সংবাদ কৌমুদি’র তিনি সম্পাদক ছিলেন। ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বেঙ্গল হেরল্ড’ এবং বাংলা ‘বঙ্গদূত’ কাগজের সূচনাও হয়েছিল তাঁর হাতে। এ ছাড়া তাঁর অর্থসাহায্যে চলত ‘বেঙ্গল হরকরা’, ‘ইন্ডিয়া গেজেট’, ‘ইংলিশম্যান’ প্রভৃতি সংবাদপত্র।
এই দ্বারকানাথকেই ১৮২৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘বোর্ড অব কাস্টমস, সল্ট অ্যান্ড ওপিয়াম’-এর দেওয়ান নিযুক্ত করেছিল। পরের বছর, ১৮২৯ সালে দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক’। প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক, যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা অন্য কোনও বাণিজ্যিক সংস্থার অধীন ছিল না। পরে এই ব্যাঙ্কের অন্যতম ডিরেক্টরও হয়েছিলেন। জাহাজের ব্যবসা-সহ বাংলায় নতুন গড়ে ওঠা ব্যবসায়িক প্রচেষ্টায় দ্বারকানাথের ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়ে সাহায্য করত। ব্যবসা ছড়ালেন পত্রপত্রিকার জগতেও।
এহেন দ্বারকানাথকে আমরা ভুলে গেলাম কি করে? কোথায় বা গেল সেই মৃত্যুমুখোশ? দেবেন্দ্রনাথ, নগেন্দ্রনাথ, নবীনচন্দ্র, কিশরীচাঁদ মিত্র – কারো লেখা থেকে এ বিষয়ে কিছু জানা যায় না। সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের জাতিগত স্বভাবটাই দুর্বল। কিন্তু অবজ্ঞা, অবহেলা, ইতিহাসবোধের অভাব কোন শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছলে এরকম মূল্যবান জিনিস বেমালুম হারিয়ে যায়? ১৯ শে মে, ১৮৪৬-এর পর দ্বারকানাথ আর কোন চিঠি লেখেন নি এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁকে ঘিরে নাবালক নগেন্দ্রনাথ ও নবীনচন্দ্র ছাড়াও অনেক বিচক্ষণ লোকজন ছিলেন, যেমন তাঁর চিকিৎসক ডা; মার্টিন। তাঁদের কাউকে কোন নির্দেশ দেন নি দ্বারকানাথ? তিন বছর আগে উইলের কোন পরিবর্তন করার কথা কি তাঁর মাথায় আসে নি? নাকি এই সমষ্টিগত স্মৃতিবিলোপ কারো আদেশে ঘটেছিল? অথবা সেইসব কাগজপত্র রবীন্দ্রনাথের আদেশে দগ্ধীভূত দলিল দস্তাবেজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত?
আক্ষরিক অর্থে যে মৃত্যুমুখোশটি অন্তর্হিত হয়েছে, তা ছাড়াও এখানে ভাবার্থে একটি মৃত্যুমুখোশ বর্তমান, যার অন্তরালে নির্বাসিত আসল দ্বারকানাথ। সেই মুখোশ উন্মোচন করে নতুন করে তাঁর মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। Mysticism থেকে দূরে সরে আসা, শিল্পায়ন ও বিশ্বায়নে অগ্রণী দেশ আজকের ভারতবর্ষে হয়তো দেখা যাবে যে প্রথম ‘multinational entrepreneur’ হিসেবে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কবিগুরুর চেয়ে কিছু কম নয়।
বর্তমানে হয়ত কেউ কেনসাল গ্রিনে তাঁর সমাধির খোঁজ পেলে, কদাচিৎ সেখানে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে একটা গোলাপ রাখেন। বছরের বাকি দিনগুলোতে পুষ্পবিহীন সমাধি বেদীটির উপরে ঝরে পড়ে কয়েকটা শুকনো পাতা আর কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি, যা উজাড় করে দেয় তাঁর প্রতি অন্তহীন সমবেদনা!
(তথ্যসূত্র:
★ বিশেষ কৃতজ্ঞতা: শ্রী অনিরুদ্ধ সান্যাল।
★ সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১- কিশোরীচাঁদ মিত্র, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর’, ১৯৬২।
২- ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী’, ১৩৭৬।
৩- ব্লেয়ার বি ক্লিং, “পার্টনার ইন এম্পায়ারঃ দ্বারকানাথ টেগোর এণ্ড দ্য এজ অফ এণ্টারপ্রাইজ ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’, ১৯৭৭।
৪- সিদ্ধার্থ ঘোষ, ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ’, দেশ পত্রিকা, ১২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৪।
৫- ব্লেয়ার বি ক্লিং, ‘দ্য টাটাস এণ্ড দ্য টেগোরস’ টোনি স্টুয়ার্ট সম্পাদিত ‘শেপিং বেঙ্গলী ওয়ার্ল্ডস, পাবলিক এণ্ড প্রাইভেট’, মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, ১৯৮৯।
৬- ব্লেয়ার বি ক্লিং, ‘রবীন্দ্রনাথ’স বনফায়ার’, ভবতোষ দত্ত সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর কমেমোরেটিভ ভল্যুম’, বিশ্বভারতী প্রেস, ১৯৯০।
৭- টাইমস অফ লণ্ডন, আগস্ট ৫ ও ৬ সংখ্যা, ১৮৪৬।
৮- কৃষ্ণ কৃপালানি, ‘দ্বারকানাথ টেগোরঃ এ ফরগটন পাইওনিয়ার’, ন্যাশেনাল বুক ট্রাস্ট অফ ইণ্ডিয়া, ১৯৮০।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১লা আগস্ট ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত