তাঁর তৈরি সুরে দিকদিগন্ত আজও পঞ্চমমুখর!
৩৩১টি চলচ্চিত্রে সংগীত রচনা ও পরিচালনা করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ২৯২টি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৩১টি বাংলা চলচ্চিত্র, ৩টি তেলেগু চলচ্চিত্র, ২টি তামিল চলচ্চিত্র, ২টি ওড়িয়া চলচ্চিত্র ও ১টি মারাঠি চলচ্চিত্র। হিন্দি ও মারাঠি মিলিয়ে মোট ৫টি টেলিভিশন সিরিয়ালের জন্য সংগীত পরিচালনাও করেছিলেন। কিন্তু –
‘‘… ‘নাইন্টিন ফরটি টু আ লভ স্টোরি’র পর আর ডি-র হাতে কোনও কাজ ছিল না। সেই নব্বইয়ের দশকে রাহুল দেব বর্মনকে কোনও কাজ দেওয়া হত না! বলা হত, উনি সুর করলে ছবির গান হিট হবে না! ভাবুন তো সেই সময় ও রকম একটা পর্যায়ের মানুষের এই অবস্থা! আজ ওঁর জন্মদিনে আমার ওই কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে আর কষ্ট হচ্ছে …’’, বেশ কয়েকবছর আগে সংবাদমাধ্যমে এই কথা বলেছিলেন বর্তমানের আরেক খ্যাতনামা শিল্পী রূপঙ্কর।
রূপঙ্কর আরও জানিয়েছিলেন, ‘‘এক বার কোনও কারণে গাইতে না পারলে, ছবি, গান ফ্লপ হলেই সে ব্রাত্য! আসলে এই পাবলিক বিষয়টা ভয়ঙ্কর! তাঁরা কখন ফিশ ফ্রাই খাবেন আর কখন চাউমিন সেটা বোঝা প্রায় অসম্ভব!’’
তাঁর মতে তারিখটা ২৭ থেকে ২৯ হলেই লোকে রাহুল দেব বর্মনের সমালোচনা করতে বসে যায়। যেমন ফেসবুকে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই দেখা যায়, রাহুল দেব বর্মণ কোন ইংরিজি গান থেকে টুকেছেন বেশ কিছু মানুষ সেই নিয়ে আলোচনা করছেন!
এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে রূপঙ্কর বলেছিলেন, ‘‘এই টেকনোলজির যুগে আর ডি থাকলে আজ অনেক সঙ্গীত পরিচালকের ভাত মারা যেত!’’
সুরকার, গায়ক এই মানুষটি তখনকার ইন্ডাস্ট্রির চেয়ে একশো ভাগ এগিয়েছিলেন বলে মনে করেন রূপঙ্কর। রূপঙ্করের কথায়, ‘‘শোলে ছবিতে হেমা মালিনীকে গব্বরের গুন্ডারা যখন তাড়া করেছে তখন একমাত্র রাহুল দেব বর্মণের পক্ষেই সম্ভব ওই টেনশনের সিচুয়েশনে তবলার ব্যবহার করা! পারকাশনের ব্যবহার ওঁর মতো আর কেউ পারবেন না।’’
অন্য দিকে সঙ্গীত পরিচালক জয় সরকার সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ‘‘সত্তরের দশক ছিল আর ডি-র দশক। ওই সময় আমার জন্ম হয়েছিল ভাগ্যিস! তাই ওঁর গান শুনে বড় হতে পেরেছিলাম! আজ গানবাজনার জগতে আমরা যে যা করছি তাঁর সবটাই ওঁর জন্য! এটা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই আমার।’’ তাঁর মতে, ’’এখন বলিউডে যে মানের গানবাজনা হয় তা শুনে মনে হয় এই ইন্ডাস্ট্রিতেই আর ডি বর্মন এমন সব চমকে দেওয়া, মাতিয়ে রাখা কাজ করে গেছেন। খুব খারাপ লাগে দেখে যে পরম্পরা কেমন করে আজকের সুরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে!’’
আর ডি বর্মন মানে যেমন এক মুঠো ঝলমলে উচ্ছ্বাস তেমনই আর ডি বর্মন মানে সংযম, যা কৃতি সুরকারের অন্যতম পরিচয়, এটাই মনে করেন জয় সরকার। ‘‘দেখুন ‘মুসাফির হু ইয়ারো’ গানটির সুর করছেন যখন আর ডি তখন সারা রাত গাড়ি করে মুম্বইয়ের পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছিলেন তিনি। তার পর যে গান হল তাতে রিদিমের একটাই প্যাটার্ন থাকল। ইন্টারলিউডে গানের মুখড়া বাজলো। ব্রেক করে অন্য কোনও যন্ত্র এনে গানের মেলোডি নষ্ট করতে চাননি আর ডি। এই সংযম কিন্তু শিক্ষার,’’ – সংবাদমাধ্যমে আরও জানিয়েছিলেন জয় সরকার।
আসলে যত এক্সপেরিমেন্টই আর ডি বর্মন করে থাকুন তার সবটাই মেলোডির জন্য! মেলোডিকে ছাপিয়ে কোনও কম্প্রোমাইজ তিনি করেননি। এমনকি শোনা যায়, ‘ছোটে নবাব’ ছবিতে সুর করার সময় এই মেলোডিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বাবা শচীন দেব বর্মনকে কিছুই না বলে তিনি লতা মঙ্গেশকরকে ‘ঘর আয়ি’ ক্ল্যাসিকাল গায়কী নির্ভর গানটি গাইতে বলে দেন। জিজ্ঞেস করার প্রসঙ্গ এই কারণেই উঠেছিল, কারণ সে সময়ে বেশ কিছু দিন শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের ঝগড়া চলছিল। শচীন দেব বর্মন তাঁর কোনও ছবিতেই লতা মঙ্গেশকরকে গাওয়াচ্ছিলেন না। কিন্তু ও রকম ধ্রুপদী মেজাজের গানের জন্য রাহুল দেব বর্মনের লতা মঙ্গেশকরকেই চাই। ব্যস! উনি ফোন করলেন। লতাজি গানের কম্পোজিশন শুনে আনন্দের সঙ্গে গান রেকর্ড করলেন শুধু নয়, শচীনকর্তা সেই গান শুনে ‘বন্দিনী’ ছবিতে আবার লতা মঙ্গেশকরকে গাওয়ালেন! মেলোডির জয় হল!
এমনই ছিলেন রাহুল দেব বর্মন। এক সময়ে বছরে সতেরোটা ছবির জন্য গান তৈরি করেছেন তিনি। কিন্তু আত্মবিশ্বাস, গান নিয়ে পড়াশোনার ফলে নিজের মধ্যে যে ক্ষমতার বলয় তৈরি করেছিলেন তিনি, সেই বলয় তাঁকে বরাবর বাজারি নিয়মকে ভেঙে অন্য রাস্তায় গান বাঁধার স্বপ্নকে সুরে ভাসিয়েছিল।
রাহুল দেব বর্মন – ত্রিপুরার রাজপুত্র শচীন দেব বর্মনের পুত্র। শচীন দেব বর্মন – যিনি সকলের কাছে বহুল পরিচিত ‘শচীনকর্তা’ নামে। যিনি নিজেই ‘সুরের রাজপুত্র’। একদিন দিন রোজের মতোই মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিলেন শচীনকর্তা। বাড়ি ফিরে রাহুলকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সে দিনের রাহুল অবাক হয়েছিলেন। পরে বাবার মুখে শুনেছিলেন, সেদিন রাস্তায় বেশ কিছু মানুষ তাঁকে ‘রাহুল দেব বর্মনের বাবা’ বলে চিহ্নিত করায় তিনি বেজায় খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এই দৃশ্যপটও একদিন বদলে গিয়েছিল।
“আমি এই গান তরে শিখাইছি? মাঠের গান ভুলে, বাংলার গান ভুলে, তুই ইংরিজি গানের নকল কইরা সুর করস! আমার সব শিক্ষা বৃথা গেল। তুই আমার কুলাঙ্গার ছেলে।”
– চিৎকার করে উঠেছিলেন রাহুলের বৃদ্ধ পিতা। রাগে কেঁপে উঠেছিলেন তিনি। মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে, একবার তাকিয়েছিলেন ছেলের দিকে। বৃদ্ধ ভেবেছিলেন – তাঁর এতদিনের শিক্ষা-দীক্ষা, গান বাঁধার শৈলী – যা দিয়ে তিলে-তিলে বড় করে তুলেছিলেন ছেলেকেও, তা বুঝি আজ ভেঙে পড়তে বসল। সেই কবে দু’হাতে সুর তুলে এনেছিলেন বাংলার হৃদয় থেকে, বেঁধেছিলেন ‘আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’, ‘মন দিল না বঁধু’-র মতো গান, যা বাঙালির মুখে-মুখে ফেরে এখনও, তাঁরই ছেলে কিনা এমন গান বেঁধেছে! যুগ কি তাহলে বদলে গেল! ‘তুমি আর নেই সে তুমি’-র সুর কি সত্যিই আজকের দিনে ব্যর্থ? ছেলের এই নতুন সুর – এই বিদেশ থেকে আহরণ করার প্রবণতা – ভারতের সঙ্গীত-ভবিষ্যৎ কি তাহলে এভাবেই নিজস্বতা হারাবে?
শ্রী শচীন দেব বর্মণ। ত্রিপুরার রাজপরিবারের রক্ত বইছে তাঁর শরীরে। সুরের উত্তরাধিকারও। তাঁর ছেলে, রাহুল দেব বর্মণের নতুন সুর শুনতে সেদিন গেছিলেন স্টুডিওতে। সাতের দশকের শুরুর দিক। শচীন কর্তা দেখলেন, আশা ভোঁসলে-কে রাহুল তোলাচ্ছেন ‘দম মারো দম’ গানটি। সেই গান শুনেই শচীন কর্তা এমন প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন।
সত্যিই কি রাহুল ‘কুলাঙ্গার’ ছিলেন? তাঁর সুরে শুধুই বিলিতি প্রভাব, দেশি ঘরানার স্বাদ বুঝি একেবারেই নেই? হিন্দি বাদ দিয়ে, যদি বাংলার দিকেই মন দিই? পুজোর অ্যালবামে তাঁর অনেক গানই সে-সময় প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখনও সেই গানগুলি শুনতে পাওয়া যায় এদিক-ওদিক কান পাতলেই। কিন্তু বাংলা গানের শ্রোতা হিসেবে, আমরা কি রাহুল দেব বর্মণকে ‘ওগো নিরুপমা’, ‘মনে পড়ে রুবি রায়’, ‘কিনে দে রেশমি চুড়ি’ – ইত্যাদি গানগুলোর জন্য মনে রাখব? একাধারে দুর্বল লিরিক ও চটুল সুর একশ্রেণীর শ্রোতার মধ্যে আলোড়ন তুলতে পারে, কিন্তু আমাদের মন যখন সমাহিত হয়ে শুধু সঙ্গীতে সমর্পণ করতে চায়, রাহুল দেব বর্মণের ওই গানগুলোর দিকে আমরা ভুলেও পা বাড়াব না।
চোখ বুঝলেই অনেকের মনে পড়বে একটা রেডিও সেটের কথা, প্রিল্যুডের পর যা থেকে বেরিয়ে আসছে বিষাদকণ্ঠ – ‘এ কী হল, কেন হল, কবে হল, জানি না / শুরু হল, শেষ হল, কী যে হল – জানি না তো।’ আর, এই বিষণ্ণতা শুষে নিচ্ছেন সামনে দাঁড়ানো এক তন্বী। সিনেমার নাম ‘রাজকুমারী’। কণ্ঠে কিশোরকুমার, কথা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের। আর চিত্রায়ণে, রেডিও-র ওপাশে লিপ দিচ্ছেন স্বয়ং উত্তমকুমার! রেডিও-র সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধ তনুজার যে অভিব্যক্তি – যেন গানের প্রত্যেকটা কথা ও সুর প্রবল একাকিত্ব ও মানসিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে দিচ্ছে তাঁকে – রাহুল দেব বর্মণকে আমরা এই সুরের জন্যেই চিনি।
আর এই বাংলার সূত্র ধরেই মনে পড়ে যায় হিন্দি ‘অমর প্রেম’ সিনেমায় রাজেশ খান্নার লিপে ‘ইয়ে ক্যায়া হুয়া’ গানটি। রাহুলেরই সুর, কণ্ঠে সেই কিশোরকুমার। আবার, ‘অমর প্রেম’ যে বাংলা সিনেমার হিন্দি রূপ, সেটিও উত্তমকুমারের অভিনীত। ‘নিশিপদ্ম’। বাংলার সাবিত্রী হিন্দিতে শর্মিলা। তবে মূল রচনাকার আবার সেই বাংলারই। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাহুল দেব বর্মণ তাই আমার মতো বাংলা আঁকড়ে পড়ে-থাকা শ্রোতার কাছে উত্তম-কিশোর-তনুজা ও সাদাকালো সিনেমার আবহ হয়ে ধরা দেন। যেন ছোটবেলা, যেন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা অথচ বেরোতে না-পারার আক্ষেপ। এই রাহুল ‘কুলাঙ্গার’ নন। তিনি শচীনকত্তার ছেলে। আমাদের কৈশোরপাঠে নইলে মস্ত ফাঁকি থেকে যাবে যে!
পোশাকি নাম রাহুল দেব বর্মণের আড়ালে হারিয়ে যায়নি ডাকনাম ‘পঞ্চম’। শোনা যায়, জন্মের পর তিনি প্রথম উচ্চারণ করেন ‘পা’। এ গল্প শুনেই অভিনেতা অশোক কুমার তাঁর নাম দেন পঞ্চম। নাম নিয়ে রয়েছে আরো একটি গল্প। ছেলেবেলায় তিনি নাকি পাঁচটি ভিন্ন সুরে কাঁদতে পারতেন। তাই সে সময় পঞ্চম নামেই ডাকা হতো তাঁকে। চলচ্চিত্র জগতে সবার কাছে তিনি ছিলেন ‘পঞ্চম’দা।
গানের কথায় প্রথম সুর দেন মাত্র নয় বছর বয়সে। তাঁর সুরারোপিত গান ‘আয় মেরি টেপি পালাট কে আ’ ব্যবহার হয় ‘ফান্টুস’ চলচ্চিত্রে। ‘পিয়াসা’ সিনেমায় বাবা শচীন দেব বর্মণ ছেলের সুর দেয়া গান ‘সার জো তেরা চক্রায়ে’ ব্যবহার করেন। এছাড়া ‘আরাধনা’ সিনেমার সঙ্গীত আয়োজনে এসডি বর্মণ থাকলেও ‘মেরে স্বপ্ন কি রানী কভ আয়েগি তু’ ও ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’ গানগুলোয় সুর দিয়েছিলেন রাহুল।
‘পঞ্চম’ শৈশবে সংগীতের শিক্ষা পেয়েছিলেন প্রখ্যাত ‘সরোদ বাদক ওস্তাদ আলি আকবর খান’ এবং ‘তবলা বাদক শামতা প্রসাদের’ কাছে। মাউথ অরগান বাজাতে পারতেন পঞ্চম। বাবার ‘অ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা’ গানে মাউথ অরগ্যান বাজিয়েছিলেন।
ভারতে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘ইলেকট্রনিক অর্গানের’ সঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্রের শ্রোতা ও দর্শককে পরিচয় করিয়েছিলেন। গানটি ছিল – ‘ও মেরে সোনা রে’। ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ‘রক মিউজিকের’ আগমনও তাঁর হাত ধরে। পরিচয় করিয়েছিলেন ‘চেলো’ ও ‘বাজ’ গিটারের সঙ্গেও।
অভিনয়েও পারদর্শী ছিলেন। মেহমুদ পরিচালিত ‘ভূত বাংলা’ সিনেমা দিয়ে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটে। পরে ‘পেয়ার কা মওসম’ চলচ্চিত্রে মি পোপাট লালের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় নজর কাড়ে সমালোচকদের।
সময়ের অভাবে ‘বিতি না বিতায়ে রায়না’ গানটিতে সুর দিয়েছিলেন হোটেলের রুমে বসেই। শ্রীমতী লতা মঙ্গেশকর ও শ্রী ভূপিন্দর সিংয়ের গাওয়া এ গান ব্যবহার হয়েছিল ‘পরিচয়’ সিনেমায়। গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে দুজনই অর্জন করেন জাতীয় পুরস্কার।
‘সলভা সাল’ সিনেমায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ দেয়া ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা’ গানটি বেশ জনপ্রিয়। এ গানটিতে মাউথ অর্গানে সুর সঞ্চারে ছিলেন রাহুলই।
‘চুরা লিয়া’ গানটিতে ব্যবহৃত সুর সৃষ্টি করেন কাঁচের গ্লাসে চামচ দিয়ে আঘাতের মাধ্যমে। তিনিই ভারতীয় চলচ্চিত্রজগতে প্রথম ব্যবহার করেন ইলেকট্রনিক অর্গান। ‘তিসরি মঞ্জিল’ সিনেমার ‘ও মেরে সোনা রে’ গানটি এখনো বেশ জনপ্রিয়।
হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে পরিচয় করিয়ে দেন ব্রাজিলিয়ান বসানোভা রিদমের সঙ্গে। এ রিদম ব্যবহার হয় পতি-পত্নী সিনেমায় ‘মার ডালেগা দর্দ-ই-জিগার’ গানটিতে। কণ্ঠ দিয়েছিলেন শ্রীমতী আশা ভোঁসলে।
দার্জিলিংয়ে দেখা পেয়েছিলেন প্রথমা স্ত্রী শ্রীমতী রীতা প্যাটেলের। ১৯৬৬ সালে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেও সম্পর্ক টেকেনি। পরবর্তীতে গানের মধ্যেই পরিচয় আশা ভোঁসলের সঙ্গে। ১৯৮০ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন তাঁরা।
প্রত্যেক সম্পর্কেই মান-অভিমান থাকে। আশা-রাহুলও তার ব্যতিক্রম নন। রাহুলের মৃত্যুর অনেক বছর পর এক সাক্ষাৎকারে আশা ভোঁসলে সকলের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন তাঁদের ঝগড়ার টপিক। শুনলে অবাক হতে হয়, গান নিয়েই মান-অভিমান হত তাঁদের। আশার মনে হত, সব ‘রোম্যান্টিক গান’ রাহুল ‘লতা মঙ্গেশকর’কে দিয়ে গাওয়াতেন। আর আশার জন্য থাকত সব ‘হাই পিচের গান’।
ঘুমে-জাগরণে সব সময়ই মিউজিক নিয়ে চিন্তা করতেন আরডি। একবার নাকি রেকর্ডিং স্টুডিওর লবিতে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক চৈতন্য পাড়ুকোনকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। চৈতন্য পরে জানিয়েছিলেন, সে দিন মাঝপথে উঠে যান রাহুল। মিউজিক অ্যারেঞ্জার বাবলু চক্রবর্তীকে বলে আসেন, ‘এখানে ওই মিউজিকটা রাখো, আর এখানে সাইলেন্স’। ফিরে এসে অর্ধসমাপ্ত বাক্যটা নাকি শেষ করেছিলেন রাহুল। একবার রাহুল নিজেই বলেছিলেন, ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ ছবি ‘কাঞ্চা রে কাঞ্চা রে…’ গানটি নাকি তিনি পুরোটাই স্বপ্নে তৈরি করেছিলেন!
‘ছাটে নওয়াব’ সিনেমার মাধ্যমেই সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন। হিন্দি, বাংলা, তেলেগু, তামিল ও ওড়িয়া – সব মিলিয়ে সুর দিয়েছেন মোট ৩৩১টি চলচ্চিত্রে। পাশাপাশি রয়েছে চারটি অ্যালবাম।
একই পরিচালক, একই মিউজিশিয়ানদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন রাহুল দেব বর্মণ। সে কারণেই তাঁর নিজস্ব টিম ছিল। প্রায় ৪৬ জন সদস্যের সেই দলে ছিলেন দিকপাল বাজনদাররা।
কম্পোজিশনের এক অসাধারণ রেকর্ড রয়েছে রাহুলের। ১৯৭২ – ওই বছরে মোট ১৯টি ছবিতে সুরারোপের কাজ করেছিলেন তিনি।
সুরের আকাশের ভিন্ন এক ‘ধ্রুবতারা’ তিনি। রাহুল দেব বর্মন। আজ সারা দেশের গানের সুরে পঞ্চমের উচ্ছ্বাস! কিন্তু নেওয়ার ভাণ্ডারে কতটাই বা তাঁকে আমরা দিতে পেরেছি?
কিন্তু তাঁর তৈরি সুরে দিকদিগন্ত আজও পঞ্চমমুখর!
(তথ্যসূত্র:
১- R. D. Burman -The Man, The Music; Anirudha Bhattacharjee, HarperCollins (২০১১)।
২- R. D. Burman – The prince of music, Khagesh Dev Burman, RUPA (২০১৫)।
৩- R.D. Burmania: Panchamemoirs, Chaitanya Padukone, Notion Press (২০১৬)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত