১৯৮৯ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর। মধ্য কলকাতার এক নার্সিং হোম।
‘‘সনৎ, সনৎ কোথায়? … খামগুলো ঠিকমতো পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে তো?’’
মধ্য কলকাতার নার্সিংহোমে শুয়ে শেষ বিদায়ের কয়েক ঘণ্টা আগে বলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সনৎ ছিলেন তাঁর ড্রাইভার কাম সেক্রেটারি। শেষ দিকে তাঁর প্রায় সব কিছু দেখতেন সনৎই।
হেমন্তর তখন ক্ষীণ গলা। ক্লান্ত স্বর। তিনি নিশ্চিত জানেন, হাতে আর সময় বেশি নেই। তবু তার মধ্যেই খোঁজ নিচ্ছেন, প্রতি মাসের পয়লা তারিখে খামে করে আঠেরো-উনিশজনকে যে অর্থসাহায্য তিনি পাঠান, তার কী হল? চল্লিশ বছর ধরে এটাই তো নিয়ম। শেষ সময়েও তার যেন অন্যথা না হয়।
একবারের কথা। ‘বসুশ্রী’ সিনেমা হলে পয়লা বৈশাখে মন্টু বসুর সেই বিখ্যাত জলসা। প্রতি বার যে অনুষ্ঠানে হেমন্তকে সবার শেষে মঞ্চে উঠে পনেরো-ষোলোটা গান গাইতেই হত। সে বার বাড়ি বয়ে এসে অন্যতম উদ্যোক্তা অজয় বিশ্বাস অগ্রিম টাকা দিয়ে গেলেন। হেমন্ত টাকাটা ড্রয়ারে রেখে দিলেন।
অজয়বাবু চলে যাওয়ার কিছু বাদেই এক মহিলা এলেন। এক বিখ্যাত শিল্পীর স্ত্রী। তাঁর স্বামী তখন প্রয়াত। ছেলে-মেয়ে নিয়ে প্রায় পথে বসার জোগাড়। কিছু সাহায্য না করলেই নয়। কালক্ষেপ না করে ড্রয়ারে রাখা টাকার বান্ডিলটা বের করে মহিলার হাতে তুলে দিলেন হেমন্ত।
শুধু অর্থের ব্যাপারে নয়, জাগতিক অনেক কিছুতেই হেমন্ত ছিলেন গড় মানুষের অনেকটাই ঊর্ধ্বে।
’৭২ সাল। হেমন্ত’র পরিচালনায় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়-মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনিন্দিতা’ মুক্তি পেল। ছবিতে ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি ব্যবহার করেছিলেন হেমন্ত।
এর আগে পঙ্কজ মল্লিক ‘মুক্তি’ ছবিতেও এই একই গান নিয়েছিলেন। কিন্তু হেমন্ত নিলেন দুটো স্তবক বেশি। রেকর্ডে দু’পিঠ ধরে গানটি ছিল। দু’পিঠেই সুরকার হিসেবে পঙ্কজ মল্লিকের নাম।
তাঁর খুব কাছের একজন সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলেন হেমন্তকে এই বিষয়ে। হেমন্ত উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘অনিন্দিতা-র গান করার সময়ই মনে হয়েছিল, পঙ্কজদার সুরটা রাখব। তাই পরিবর্ধিত অংশটি নিয়ে ওঁকে শুনিয়ে সম্মতি চাইলাম। খুশি হয়েই অনুমোদন দিলেন। পুরো গানটারই সুরকার হিসেবে ওঁর নাম রাখলাম। তার দুটো কারণ। ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা। আর দুই, এতে ছবির অন্যতম সুরকার হিসেবে পঙ্কজদার কিছু অর্থপ্রাপ্তি হবে!’’
এ যদি ওঁর উদারতার এক পরিচয় হয় তো, ‘বালিকাবধূ’-র ঘটনাটি কী গোত্রে ফেলা যাবে?
তরুণ মজুমদারের ছবি। ’৬৭ সালে রিলিজ করল। তার আগে আবহসঙ্গীত তৈরির সময় এক জায়গায় পরিচালক হেমন্তকে বললেন, এইখানটা একটু অন্য রকম করলে ভাল হয়। হেমন্ত বদলটা চাননি। কিন্তু পরিচালককে সম্মান দিতেই আবহের কিছু অংশে নির্দ্বিধায় পরিবর্তন আনলেন। উল্লেখ্য, তখন কিন্তু বাংলা ছবিতে তাঁর কাজের বয়স কুড়ি বছর পেরিয়েছে। বম্বেতে পনেরো বছর।
‘ইন্দিরা’-তে প্রিমিয়ার শো হয়েছিল ‘বালিকা বধূ’-র। শো চলাকালীন ওই বিশেষ জায়গাটা পেরতেই তরুণ মজুমদারকে বাইরে ডেকে নিলেন হেমন্ত। বললেন, ‘‘ভাগ্যিস, আপনার কথাটা মেনে নিয়েছিলাম, এখন বুঝতে পারছি, আপনি যেটা বলেছিলেন, সেটা একদম ঠিক।’’
তার পরেও একটা ব্যাপার খেয়াল করার থাকে। ছবিতে আবহসঙ্গীতে হেমন্ত যে গভীরতা নিয়ে কাজ করতেন, তা তাবড় বিশেষজ্ঞকে চমকে দিত।
‘সপ্তপদী’-তে কৃষ্ণেন্দু-রিনা ব্রাউনের বিয়ে নিয়ে সঙ্কটের সময়ের একটি আবহের কথা উল্লেখ করতে হয়। রিনাকে বিয়ে করতে হলে কৃষ্ণেন্দুকে খ্রিস্টান হতে হবে। তা নিয়ে পরিবারে সঙ্ঘাত। দোলাচলে কৃষ্ণেন্দু।
হেমন্ত আবহ শুরু করলেন অনসম্বল সিম্ফোনির স্ট্রিং দিয়ে। তারপর হিন্দু মন্দিরের ঘণ্টা। শেষে চার্চের ঢং ঢং ঢং শব্দটা এসে মিলে যায় সেই ধারায়! একটাও সংলাপ নেই, ধর্ম থেকে ধর্মান্তরের চলাচলকে ধরতে হেমন্ত’র আবহর এই টেক্সট অনেককেই মুগ্ধ করেছিল।
কুণ্ঠাহীনভাবে নিজের দোষ কবুল করতে পারতেন হেমন্ত। তার জন্য বহু গুণী মানুষের সম্মান আদায় করে নিতেন। এমন একটি ঘটনার সাথে জড়িয়ে রয়েছে সংগীতশিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম।
শিলিগুড়িতে একটি অনুষ্ঠান। অনেক গায়ক-গায়িকা গিয়েছেন। অনুষ্ঠান চলছে। গ্রিনরুমে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। হঠাৎই গোলমাল বেধে গেল।
কী ব্যাপার? কয়েক জন শ্রোতা মানববাবুকে তাঁর জনপ্রিয় আধুনিক গান গাইতে অনুরোধ করেছেন। উনি কিছুতেই সে সব গাইবেন না। শুধু নজরুলগীতি শোনাবেন। এ নিয়ে বাদানুবাদ। তার মধ্যেই কোনও এক উদ্যোক্তা বলে ফেলেছেন, ‘‘আপনি পেশাদার শিল্পী। টাকা নিয়ে গাইতে এসেছেন যখন, শ্রোতাদের অনুরোধ আপনার রাখা উচিত।’’
তাতে মানববাবু আরও উত্তেজিত, ‘‘কী, আমায় টাকা দেখাচ্ছেন! টাকা ফেরত নিন। আমি গাইব না।’’
অবস্থা ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে মানববাবুকে ডেকে নিলেন হেমন্ত। বললেন, ‘‘বোস, সব সময় আসর বুঝে গান গাইবি। নিজের জেদ ধরে থাকবি না। মনে রাখিস, শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়াটাই আমাদের কাজ। কয়েকটা নয় আধুনিক গেয়ে নজরুলগীতি গাইবি। এত রাগ করিস কেন?’’ মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল, হেমন্ত’র পায়ে হাত ছুঁইয়ে মানববাবু বলছেন, ‘‘আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও অমন হবে না।’’
মানববাবু গান গেয়ে নেমে আসার পর হেমন্তদা তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওঁরা খুব তাড়াতাড়ি একটা রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা করবেন। তাতে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইব। তুই নজরুলগীতি।’’
ছ’সপ্তাহর মধ্যে পরের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। পনেরোটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে হেমন্ত নেমে যাওয়ার পর মঞ্চে উঠেছিলেন মানববাবু।
তাঁর অনুজ আরেক সঙ্গীত পরিচালক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, ‘‘হেমন্তদার কাছে ওঁর সুরে গান গাইবার অনুরোধ নিয়ে গেলে উনি বলতেন, গানটা কবে শেখাবে বলো।’’ তোলাবে নয়, শেখাবে। অনুজকেও এ ভাবে শিক্ষকের সম্মান দিতেন উনি। সেই সম্মানটাই বোধহয় মাঝে মাঝেই ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর জীবনে। অনেকটা যেন সেই, ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান।’
এক দিকে এই সম্মান-প্রদর্শন, অন্য দিকে ওই আকাশছোঁওয়া প্রতিভাধর হয়েও নতজানু থাকা, এই দুইয়ের আশ্চর্য সমাহার হেমন্ত’র দ্যুতি যেন আরওই বাড়িয়ে দিয়েছিল।
রবীন্দ্রগানকে যে কী ভাবে নিতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ে! তরুণ মজুমদারের ‘আলোর পিপাসা’ ছবির কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয়। অনেক সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করতে হবে বলে, শাস্ত্রজ্ঞ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের এক ছাত্রীর কাছে উচ্চারণ শিখতেন। নানা ভাষায় গান গেয়েছেন, প্রত্যেক বার এই একই ধরনের অধ্যবসায়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন।
হেমন্ত’র সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য ছিল ‘চণ্ডালিকা’। চণ্ডালিকার সব চরিত্রের সব ক’টি গান অনায়াস দক্ষতায় গাইতেন।
একবার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তাঁর চিকিৎসার খরচ তুলতে কবির বন্ধুরা একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। সেখানে ‘চণ্ডালিকা’র গান গাওয়ার কথা সুচিত্রা মিত্র আর হেমন্ত’র। শেষ মুহূর্তে কোনও এক কারণে সুচিত্রা মিত্র আসতে পারেননি। উদ্যোক্তারা মহা বিপাকে। হেমন্ত বলেছিলেন, ‘‘কোনও চিন্তা নেই। আমি গেয়ে দিচ্ছি।’’
অথচ এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কেই কী অদ্ভুতভাবে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি রেকর্ড বেরনোর পর। যার এক পিঠে ‘যখন ভাঙল মিলনমেলা’, অন্য পিঠে ‘আমার এ পথ’। ট্রেনার ছিলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত-বিশেষজ্ঞ অনাদি দস্তিদার। প্রথম গানটিতে সঞ্চারীতে এসে উনি গাইলেন, ‘ভেবেছিলেম ভুলব না আর আমার চোখের জল’। গাইছিলেন ‘গীতমালিকা’ দেখে। সেখানে কথায়, স্বরলিপি-তে অমনই লেখা ছিল। অথচ শেষে শুদ্ধিপত্রে লেখা ছিল, ‘ভুলব না’ নয়, হবে ‘ঝরবে না’। কারও খেয়াল হয়নি। সে ভাবেই রেকর্ড বেরিয়ে গেল। ব্যস, পুরো দায় তখন যেন একা হেমন্ত’র! অজস্র বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হয়েছিল আজীবন মিতভাষী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে।
রবীন্দ্রনাথের গানে এমন বিভ্রাট তাঁকে যে কতটা বিপন্ন করে তুলেছিল, যাঁরা কাছের মানুষ, তাঁরা প্রত্যেকে জানতেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বসে, তিনি যেন ঠিক গান নয়, সাধনায় বসতেন। আর ওঁর এই ভাবটা ছড়িয়ে পড়ত শ্রোতাদের মধ্যেও।
’৭০ এর দশকে রঞ্জি স্টেডিয়ামের একটা অনুষ্ঠানে মঞ্চে মহম্মদ রফি। দর্শক উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। তাদের উল্লাস সাগরের ঢেউকেও হার মানায়। তুমুল চিৎকারের মধ্যে মঞ্চ ছাড়লেন রফি।
এর পরেই উঠবেন হেমন্ত। সকলে রুদ্ধশ্বাস। এমন উত্তাল জনতাকে কী করে বাগে আনবেন তিনি?
মঞ্চে উঠলেন। হারমোনিয়াম ধরলেন। তার পরেই অতি পরিচিত সেই জলদগম্ভীর স্বরে বেজে উঠল – ‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল …’।
তখন কোথায় সেই আছড়ে ওঠা সাগর-ঢেউ! মুহূর্তে কোন এক জাদুমন্ত্রের মায়ায় নিশুত রাতের নৈঃশব্দ্য ঘনিয়ে এল যেন …
১৯৬২ সাল। তখনো ‘যাত্রিক’ নামেই ছবি করেন তরুণ মজুমদার। ‘মনোজ বসু’র ‘আঙটি চাটুজ্যের ভাই’ গল্প অবলম্বনে তিনি শুরু করবেন ‘পলাতক’ ছবির কাজ। কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছেন এক ভবঘুরে গায়ক যাকে ঘর আটকাতে পারে না। প্রাণের টানে সে ঘুরে চলে সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে। এই ছবিতেও সুর করার জন্য তিনি ডাকলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। গল্প শুনে হেমন্ত বললেন, “এ তো সবই লোকসঙ্গীত, আমি এ বিষয়ে একটু মাটো আছি।” তরুণবাবু নাছোড়বান্দা, তিনি হেমন্তকেই চান সঙ্গীত পরিচালক রূপে। তখন হেমন্ত বললেন এক নতুন গীতিকারের কথা। তাঁর কাছে আসে গান লিখে নিয়ে। তাঁর লেখা গান খুব পছন্দ হেমন্তর। তরুণবাবুর আপত্তি নেই, বরং তিনি খুশী হলেন। আর গানে সুর করা শুরু হবে যখন, তখন ঘাড়ের ব্যথায় হেমন্তবাবু ভরতি হলেন বম্বের নর্থকোট হসপিটালে।
সেই অবস্থাতেই এক আজব কাণ্ড চলল হাসপাতালে। গীতিকার তাঁর লিরিক লিখে লিখে পাতা দিচ্ছেন হেমন্তকে আর সুরকার ওই শোওয়া অবস্থায় একটু ভেবে নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুর করে যাচ্ছেন কথায়। আর সেভাবেই ফলতে লাগল –
‘‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই
কোনও দেশে সাকিন নাই
কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না’’ …
– এবং অন্য সব চিরমধুর গীতাঞ্জলি।
সেই বছরেই (১৯৬২) প্রথম পুজোর গানেও মাতিয়ে দিলেন সেই গীতিকার আর হেমন্তর জুটি। দুটি গান ছিল –
১) ‘‘তারপর? তার আর পর নেই’’ …
২) ‘‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল’’ …
‘তারপর?’ এই মহিলা কণ্ঠ চাঁদ ওসমানির যিনি ছিলেন ঐ গীতিকারের স্ত্রী। তারপরেই শুরু হল হেমন্তর গলাতে –
‘‘… তার আর পর নেই নেই কোন ঠিকানা
যা কিছু গিয়েছে থেমে যাক থেমে যাক না।।’’ …
এখানেই প্রশ্ন। সুর কি সৃষ্টি করা যায়? না কি, সব সুর হয়েই আছে? শুধু খুঁজে নিয়ে নতুন চেহারা দেওয়া! শিশু যেমন বিল্ডিং ব্লক্স খেলে! এ দিক থেকে দেখলে সুরসৃষ্টি ‘ইনভেনশন’ নয়, ‘ডিসকভারি’। ‘নদী’, ‘ফুল’, ‘বিদ্রোহ’, ‘প্রার্থনা’, ‘প্রেম’, ‘যন্ত্রণা’, ‘শীৎকার’, ‘শেক্সপিয়র’, ‘রাত্রি’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ – সব রয়েছে। ‘সুর’, ‘স্বর’, ‘উপসুর’, ‘কম্পাঙ্ক’ – সবই। ‘পারমুটেশন-কম্বিনেশন’-এর রসায়ন জানা ইঞ্জিনিয়ার তা থেকেই ইতিহাস গড়েন! ধুতি-শার্ট তাই ইঞ্জিনিয়ার, রসায়নবিদ। এবং তাঁর রসায়নাগারের ভিয়েনে উপচে পড়ছে মেলডির রস।
‘নিঝুম সন্ধ্যায়’ শোনা শিশু বড় হয়ে ‘মেলডি’ শব্দটা শুনেছিল। কিন্তু প্রচলিত অর্থের সঙ্গে আভিধানিক ব্যাখ্যার মিল পায়নি। ‘নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা’ তাঁকে শুনিয়েছে ‘চলো মন গঙ্গাযমুনাতীর’! বলেছে ‘প্রভু আমার প্রিয় আমার’। ‘কার দুর্গা’, ‘কোন পাহাড়ি’, ‘কোথাকার তিলক-কামোদ কিংবা কেদার’ – সে সব জানেন সঙ্গীতবেত্তারা! কিন্তু আভিধানিক আমগাছের খবর না রেখেও মেলডির আম খেতে অসুবিধা হয়নি। সে সুযোগ করে দিয়েছেন ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘নজরুল’, ‘অতুলপ্রসাদ’, ‘রজনীকান্ত’, ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’, ‘হিমাংশু দত্ত’, ‘অনুপম ঘটকেরা’; এবং ধুতি-শার্ট।
বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক ‘সি রামচন্দ্র’ এক বার প্রশ্ন করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে, “আপনি তো গায়ক, সুরকার, প্রযোজক – তিন রকম ভূমিকাই পালন করেছেন। এর মধ্যে আপনার নিজের সবচেয়ে ভাল লাগে কোনটি?” হেমন্তর উত্তর ছিল, “অবশ্যই গায়ক।” অর্থাৎ সুরকার হিসেবে নিজের মূল্যায়নে খানিকটা উদাসীন ছিলেন তিনি নিজেই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর-রচনা সম্পর্কে বাঁধা গতের কিছু কথা শুনতে আমরা অভ্যস্ত – খুব সহজ সরল সুর করতেন, বেশি খাটতে হত না, ইত্যাদি। একটু মনে করে দেখা যেতে পারে, কোন পরিস্থিতিতে কী ধরনের সুর তিনি করেছেন, কাকে দিয়ে কী গান গাইয়েছেন।
‘আনন্দমঠ’ ছবিতে লতাজিকে দিয়ে গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের। ‘ফিল্মিস্তান’-এর সঙ্গে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও শিল্পী রাজি হয়েছিলেন শুধুমাত্র সুরকারের অনুরোধে। ছবিটির কথা হয়তো আজকের দর্শক ভুলেই গিয়েছেন, কিন্তু ‘বন্দে মাতরম্’-এর ওই ‘মার্চিং সুর’ আজও দেশাত্মবোধের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ‘হারানো সুর’-এ গীতা দত্তকে দিয়ে ‘তুমি যে আমার’ গানটি গাওয়ানোর জন্য বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। গানটি রেকর্ডিং হওয়ার পরও যখন পরিচালক আর নায়ক মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন, মনে হচ্ছে যেন বেশি ‘ফ্ল্যাট’ হয়ে গেল, সুরকার হেমন্ত কিন্তু বলে গেলেন, চিন্তা নেই, এ গান লাগবেই। ‘নাগিন’ ছবিতে হারমোনিয়াম আর ক্লাভিয়োলিন ব্যবহার করে সাপুড়ের বিনের আওয়াজ সারা ছবিতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, ভারত মেতেছিল সেই সুরে। এর জন্যও পরিচালক ও প্রযোজকের সঙ্গে মতানৈক্য হয়েছিল তাঁর। বিনীত যুক্তিতে, অথচ গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাঁদের শেষ পর্যন্ত স্বমতে এনেছিলেন সুরকার।
লতা মঙ্গেশকরকে বাংলা গানের জগতে নিয়ে আসার কৃতিত্ব তাঁরই। শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। পরে ‘প্রেম এক বারই এসেছিল নীরবে’ গানটি যখন লতাকে দিয়ে গাইয়েছেন, শুনে মনে হয়েছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রভাবেই গানটি এত শ্রুতিমধুর। অথচ এই গানেরই সুরে ‘আজ রোনা পড়া তো সমঝে’ গানটি যখন কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়ালেন, তখন কিন্তু মনে হয় না রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুসারী গান শুনছি। একই গান দু’জন বড় মাপের শিল্পীকে দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গায়কিতে গাওয়ানো এবং দু’টি গানই সফল – এক জন সুরকারের পক্ষে এ কিন্তু কম সার্থকতার নিদর্শন নয়।
‘আনারকলি’ ছবিতে সি রামচন্দ্রের অসমাপ্ত কাজ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন, শুধুমাত্র পেশাদারি বন্ধুত্ব ও সৌজন্যের খাতিরে, অথচ সুরকার হিসেবে নিজে কৃতিত্ব দাবি করতে চাননি। ‘মুক্তি’ ছবিতে পঙ্কজকুমার মল্লিক ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি, পঙ্কজবাবুর সুর অনুমোদন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নিজের পরিচালনায় ‘অনিন্দিতা’ ছবিতে যখন গানটি আবার ব্যবহার করলেন হেমন্ত, দু’টি স্তবক বেশি নিলেন। সুরকার হিসেবে শুধু পঙ্কজ মল্লিকের নামই রেখেছিলেন। হেমন্তর আত্মীয়প্রতিম চিকিৎসক ডা. সুবীর মজুমদার জানতে চেয়েছিলেন, শেষ দু’টি স্তবকের সুরকার কে? প্রথমে বলতে চাননি, পরে বলেন, শেষ স্তবক দু’টির সুর তিনি দিয়েছেন, তবে পঙ্কজবাবুর অনুমতি নিয়ে। নিজের নাম যুগ্ম ভাবে সুরকার হিসেবেও রাখেননি, কারণ অগ্রজ ‘পঙ্কজদা’র প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা।
সুরকার হিসেবে সমকালের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মনে প্রভূত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের জায়গায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তপন সিংহ ‘ক্ষণিকের অতিথি’র সঙ্গীত পরিচালনায় ডেকে নেন তাঁকে। ছবি দেখে হেমন্ত বলেন, “এ তো কাব্য। আবহে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতই ব্যবহার করব।” কিশোরকুমার ‘লুকোচুরি’ ছবির সুরারোপের দায়িত্ব নিজে না নিয়ে তুলে দেন হেমন্তর হাতে। এই ছবিতে তাঁর নিজের সুরে গাওয়া ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’ অনায়াসে স্থান করে নেয় বিবিসি-র সমীক্ষায় পঞ্চাশ বছরের সেরা গানের তালিকায়। গুরু দত্ত ‘সাহিব বিবি আউর গোলাম’ ছবিতে সুরারোপের জন্য নির্ভর করেন তাঁরই উপর, বলেন, বাংলার সংস্কৃতি-আশ্রিত এই ক্লাসিকের আবহসঙ্গীতের উপর সুবিচার করার মতো আর কে আছে?
তাঁর প্রযোজনায় ও সুরে সমৃদ্ধ ‘নীল আকাশের নীচে’ দেখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু বলে ওঠেন, ‘‘You have done a great service to the nation’’; আবার বিদেশি পরিচালক কনরাড রুক্স-এর ছবি ‘সিদ্ধার্থ’-এ সঙ্গীত পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি গেয়ে আসেন সেই ‘নীল আকাশের নীচে’র প্রাণমাতানো গান, ‘ও নদী রে’। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ে তাঁকে স্পর্শ করে প্রবাসী ভারতীয়রা বলে ওঠেন, “ইন্ডিয়াকে টাচ করছি।” আমাদের সুরের আকাশে ‘শুকতারা’ হয়ে আজও জেগে আছেন তিনি।
হেমন্ত সর্বপ্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন ১৯৪২ সালে ‘অপরাধ’ ছবিতে ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে’ গানটি, সুপ্রভা সরকারের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে। হেমন্ত প্লেব্যাক করেছিলেন ‘ধ্রুব চক্রবর্তী’র ঠোঁটে। আর ‘সুপ্রভা দেবী’ প্লেব্যাক করেছিলেন ‘মণিকা দেশাই’য়ের ঠোঁটে। ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ‘হরিপ্রসন্ন দাশ’। ওই সময় তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু ছবিতে সহকারী সুরকার হিসেবে হেমন্ত কাজ করেছিলেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায় ১৯৪৩ সালে ‘প্রণব দে’ সুরারোপিত ‘প্রিয় বান্ধবী’ ছবিতে ‘পথের শেষ কোথায়’ গানটি। ছবিতে গানটি রেডিয়োতে ভেসে আসছে, এমন দৃশ্যের মাধ্যমে চিত্রায়িত করা হয়।
১৯৪৪ সালে গাওয়া ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ ও ‘আমার আর হবে না দেরি’ গান দু’টি হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বেসিক রেকর্ডের রবীন্দ্রসঙ্গীত। খুবই জনপ্রিয় হয়। ‘অনাদিকুমার ঘোষদস্তিদারের’ সঙ্গীত তত্ত্বাবধানে তিনি এই রেকর্ডটি করেছিলেন।
কলকাতায় ফেরার ট্রেনের টিকিট কেটে চুপি চুপি মুম্বই থেকে পালিয়ে আসছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁকে প্রায় ধরেবেঁধে আটকান প্রযোজক ‘শশধর মুখোপাধ্যায়’।
‘‘আমি তোমাকে এখানে এনেছি। তুমি চলে গেলে, তুমি তো হারবে না, আমি হেরে যাব। একটা হিট ছবি দিয়ে তুমি যেখানে খুশি চলে যাও। আমি বাধা দেব না।’’
‘ফিল্মিস্তান’ স্টুডিয়োর তখন সর্বেসর্বা শশধর মুখোপাধ্যায়। পরিচালক হেমেন গুপ্তকে দিয়ে ‘আনন্দমঠ’ ছবির জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে মুম্বইতে নিয়ে যান তিনি।
ফিল্মিস্তান-এর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সম্পর্ক তখন অতি খারাপ বললেও কম বলা হয়। তবু তাঁকে দিয়ে ছবির জন্য ‘বন্দেমাতরম’ গাইয়ে প্রায় অসাধ্যসাধন করেছিলেন হেমন্তকুমার। নিজে গেয়েছিলেন ‘জয় জগদীশ হরে’। গীতা দত্তের সঙ্গে ডুয়েট।
গান তো জনপ্রিয় হল, কিন্তু ছবি? সুপার ফ্লপ। তার পরেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চলে আসতে চান কলকাতা। ভিটি স্টেশন থেকে লুকিয়ে ফোন করে সে-খবর শশধর মুখোপাধ্যায়ের কানে পৌঁছে দেন হেমন্ত-পত্নী বেলা।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ফেরা হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি! এর পরই যে ‘নাগিন’! যে ছবির গানের রেকর্ড কুড়ি বছর বাদে ভেঙেছিল ‘ববি’।
অথচ এই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ই কি’না এক সময় রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। জলসায় গাইতে দেবার আশ্বাস পেয়েও ঠায় চার ঘণ্টা বসে থেকে শুনেছেন, ‘‘দূর মশাই, আপনার গান কে শুনবে? দেখছেন না, পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন! ওঁর গান শুনে বাড়ি চলে যান।’’
ভেবে বসেছিলেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাহিত্যিক হবেন। গল্প লিখতেন। তার কয়েকটি প্রকাশও পেয়েছিল। যার একটি তো একেবারে ‘দেশ’ পত্রিকায় – ‘একটি দিন’। তখন সাহিত্যিক হবার স্বপ্নে তিনি মশগুল।
গায়ক-বন্ধুর ব্যাপারে স্কুলবেলার সহপাঠী ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়’, ‘রমাকৃষ্ণ মৈত্র’রা শুধু হাল ছাড়েনি। তাই রক্ষে।
প্রথম রেকর্ড বেরনোর পর সেটাকে কাগজে মুড়ে হাতে নিয়ে চেনাজানা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যাতে কারও কৌতূহল হয়, জানতে চান, ওটা কী! ধীরে ধীরে গান গাওয়া তখন অস্থিমজ্জায় ঢুকে পড়েছে।
শচীনকর্তার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যদি কর্তার দু’কলি ভেসে আসে, অঞ্জলি পেতে নেবেন!
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শুনছেন কোনও বাড়িতে পঙ্কজ মল্লিকের গান বাজছে, স্তব্ধ হয়ে ভেবেছেন, ‘‘আমারও গান কি কোনও দিন এমন ঘরে ঘরে বাজবে?’’
তখন ওই যুবক যদি জানতেন, ঘরে-ঘরে কেন, তাঁর শ্রোতার দলে এক দিন নাম লেখাবেন উস্তাদ আমির খান, মেহদি হাসান!
দিল্লির এক জলসায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে মুগ্ধ উস্তাদজি বলেছিলেন, ‘‘তোমার গান শুনছিলাম এতক্ষণ।’’
আর গজল-শাহেনশা মেহদি হাসান বলতেন, ‘‘দেখা হলে লতাজির কণ্ঠে একটা চুমু দিতে চাই।’’ আর পুরুষ-কণ্ঠ হলে? – ‘‘হেমন্তকুমারের। এই উপমহাদেশের সেরা কণ্ঠস্বর হেমন্তকুমারের।’’
সাম্প্রতিক অতীতে গায়িকা শ্রীমতী আরতি মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘হেমন্তদা’-কে নিয়ে বলতে গিয়ে ‘মেহদি-প্রসঙ্গ’ ব্যক্ত করেছিলেন এক সংবাদমাধ্যমের কাছে। সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণে তিনি বলছিলেন,
‘‘মধ্য কলকাতার এক নামী হোটেলে মেহদি হাসানকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সংবর্ধনার দিন মেহদি হাসানের সঙ্গে বসে আছি। হেমন্তদা হাঁকডাক করে তদারকিতে ব্যস্ত। হাসানসাহেব এক দৃষ্টিতে হেমন্তদাকে লক্ষ করছিলেন। এক সময় নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘ক্যায়া আওয়াজ পায়া হ্যায়! ইয়ে খুদা কি দেন্ হ্যায়।’
অনেক কষ্টে সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি কোনও দিন কেউ হেমন্তদার আওয়াজ আর আপনার গায়কি নিয়ে জন্মায়?’
সঙ্গে সঙ্গে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠলেন, ‘ইন্শাল্লা! খুদা কি মর্জি। তব্ হী ইয়ে চমৎকার হো সকতে’ …।’’
কেবল মাত্র খোদার ইচ্ছেতেই এমন জাদু ঘটা সম্ভব।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক হওয়া হয়নি। কিন্তু ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিকে পাশ করার পর বাবার ইচ্ছেয় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে হয়েছিল। যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
আসলে চার ছেলে, এক মেয়ের দ্বিতীয় হেমন্তকে নিয়ে ছোট থেকেই বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের অনেক আশা। চোদ্দো পুরুষের ভিটে বড়ুগ্রাম ছেড়ে কালিদাস পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন ভবানীপুরের ২৬/২এ রূপনারায়ণ নন্দন লেনে। দু’ঘরের বাড়ি।
ম্যাকনিন ম্যাকেনজির সাধারণ কেরানি কালিদাস। টানাটানির সংসার। মিত্র ইনস্টিটিউশনের মতো বেশি মাইনের স্কুলে ছেলেদের পড়ানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কিন্তু মেজ ছেলের পড়াশুনোয় আগ্রহ দেখে হেডমাস্টারমশাইকে ধরেটরে হাফ-ফি-তে কোনওক্রমে ভর্তি করেছিলেন।
ছেলে পড়াশুনোয় তো ভালই, কিন্তু গোলটা বাধল ঠিক ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার তিন মাস আগে। স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে!
তার মূলেও কিন্তু ওই গান! টিফিন টাইমে অন্যরা সব খায়-দায়। কালিদাসবাবুর মেজছেলের না আছে বাড়ির দেওয়া টিফিন, না পকেটে কানাকড়ি। বন্ধুদের নিয়ে সে টেবিল বাজিয়ে গান গায়। পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেববর্মনের রেকর্ডের গান। তাতে এমন হইচই, হট্টগোল রেজিস্টার থেকে নাম কেটে দিয়ে বলা হল – ‘‘যাও, এ বার গান গেয়ে বেড়াও গে যাও।’’
ফাইনাল পরীক্ষার বাকি তখন সবে তিন মাস! কালিদাসবাবু স্কুলে গিয়ে প্রায় হাতে-পায়ে ধরে সে-যাত্রায় ছেলেকে রক্ষা করেন। এর পরও যখন ফার্স্ট ডিভিশন পেল ছেলে, খুব চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু তত দিনে গান যে তাকে পেয়ে বসেছে!
বন্ধু সুভাষ অসিতবরণকে ধরে রেডিয়োয় অডিশনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। অভিনেতা অসিতবরণ তখন রেডিয়োয় তবলা বাজান।
অডিশনে পাশ করার তিন মাস বাদে প্রোগ্রামের চিঠি এল। গান শুনে পাহাড়ী সান্যাল বললেন, ‘‘বাহ্, চর্চা করলে ভাল গাইয়ে হবে।’’ পঙ্কজ মল্লিক এক দিন আকাশবাণীতে অনুজ হেমন্তকে দেখে বললেন, ‘‘তুমি তো দেখছি আমাদের ভাত মারবে!’’
বাইরে গনগনে দুপুর। ঘর অন্ধকার করার চেষ্টা হয়েছে। সছিদ্র জানালা-দরজা বন্ধ করে ভিজে গামছা টাঙানো। রোদের আভা লাল গামছা ভেদ করে ঢুকছে ঈষৎ। তাতেই গাঢ় গোধূলি ঘরে। মাটিতে জলে মোছা মাদুরে শুয়ে বাঙালি শিশু। আসছে না ঘুম! কিন্তু আসতে বাধ্যও! কখন যেন ঘরের মধ্যে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে আছেন সাদা ধুতি-শার্টের একটা বাঙালি সুর। হাতপাখা দোলাতে থাকা মায়ের গলা দিয়ে তিনি বেরিয়ে আসছেন। বেরিয়ে আসছেন প্রশান্তির অবসাদ নিয়ে! ঘরে নামছে নিঝুম সন্ধ্যা! ক্লান্ত পাখিরা পথ ভুলে গিয়ে কী করবে শেষ পর্যন্ত, সে প্রশ্ন একটু-সামান্য জাগছেও মনে। যদিও কথা বোঝার কথা নয় সে বয়সে। কিন্তু পাখি তো খুবই চেনা লোক! বাতাবি গাছে থাকে। রোজ উঠোনে জিরোতে আসে। কেন জানা নেই, ওদের জন্য মন কেমন করছে! সুরটা ক্রমশ ঘুম বুনছে। ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুমোতে যাচ্ছে সুরটা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে শুয়ে সন্ধ্যার মেঘমালায় সুর খুঁজে পাওয়ার ব্যারামের জেরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া হল না ধুতি-শার্টের! তবে, ইঞ্জিনিয়ারিং শেখেননি তিনি, বলা যায় না! সঙ্গীতের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, রসায়নে দীক্ষিত হলেন কার্যত আত্মশিক্ষায়। গাইতে শুরু করেই সুর তৈরির নেশায় পড়লেন। এখানেই ইঞ্জিনিয়ারিং।
ইঞ্জিনিয়ারিংটা আর হল না। বাবা দুঃখ পেয়েছিলেন, তবু ’৩৮ সালে কলেজে ইস্তফা দিয়ে বসল ছেলে।
এই সময়কাল, তার অল্প আগে পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের জীবনে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকল। বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বেরল। রেডিয়ো থেকেও ঘন ঘন ডাক। ‘মহালয়া’। আইপিটিএ। সলিল চৌধুরী। প্রথম প্লে-ব্যাক।
কিন্তু তার পরেও যে খুব সুদিন চলছিল সংসারে, তেমন হয়তো নয়। অর্থের কারণেই বহু দিন পর্যন্ত গানের টিউশানি ছাড়তে পারেননি। বাঁধা রোজগারের জন্য গ্রামাফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে গানের ক্লাস নিতেন। বলতেন, ‘‘টিউশনি না করলে খাব কী?’’
’৪৫ সালে বিয়ে করলেন বেলা মুখোপাধ্যায়কে। স্ত্রী, পাঁচ-পাঁচটি নাবালক শ্যালক-শ্যালিকা নিয়ে নতুন সংসার পাতলেন ইন্দ্র রায় রোডের ভাড়া বাড়িতে। ’৪৭-এ প্রথম সন্তান, জয়ন্ত। ’৫৪-তে রাণু।
সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমে পিতার স্মৃতিচারণে জয়ন্ত বলছিলেন, ‘‘রাণু ঠিক মতো গানটা গাইল না বলে বাবার খুব দুঃখ ছিল। বিশেষ করে শ্রাবন্তী মজুমদারের সঙ্গে ডুয়েট ‘আয় খুকু আয়’ গানটা রাণুরই করার কথা ছিল। বালসারাজি রাণুর কথা ভেবেই গানটা কম্পোজ করেছিলেন। মনে আছে, ‘মাসুম’ ছবির গান ‘নানী তেরি’-র শেষ অন্তরাটা গাড়িতে বাবা কী যত্নে রাণুকে শেখাতে শেখাতে নিয়ে যাচ্ছে রেকর্ড করাতে। রাণুকে না পেয়ে ফিমেল ভয়েস-এর জন্য কবিতা কৃষ্ণমূর্তিকে নেয়। কবিতার আসল নাম ছিল সারদা। বাবাই ওকে কবিতা নাম দেয়। বাবার সঙ্গে ও নানা জায়গায় গাইতে যেত। পরে মান্না দে’ও বাবার কাছ থেকে ওকে প্রোগ্রাম করতে নিয়ে যেত।’’
হেমন্ত পুত্র আরও জানিয়েছিলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম হিন্দি ছবি ‘বিশ সাল বাদ’-এর নেপথ্য-গল্প। ছবিটি নাকি তৈরি হয়েছিল ‘ডালডা’র সবচেয়ে বড় বড় ডাব্বায় জমানো টাকা দিয়ে! ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা! সেই ’৬০-’৬১ সালে টাকাটা নেহাত কম নয়।
এই সময়ের ঠিক আগে ছ’মাস গান গাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। গলায় কী একটা অসুবিধের জন্য গাইতে পারছিলেন না। ভেবে বসেছিলেন, আর বোধ হয় কোনও দিন গানই গাওয়া হবে না।
ঠিক এমন সময়ই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে প্রস্তাব দেন, ‘‘আমি ছবি করছি, তিন দিন বাদে ‘ফিল্ম সেন্টার’ স্টুডিয়োতে রেকর্ডিং। আমি তোমাকে জোর করব না। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি এসো।’’
এসেছিলেন লতাজি। গেয়েওছিলেন। আর সম্মানদক্ষিণা দিতে গেলে ফুঁসে উঠে বলেছিলেন, ‘‘দাদা, আপ মুঝে প্যয়সা দে রহেঁ হ্যায়?’’ ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন খাম।
লতা মঙ্গেশকর-আশা ভোঁসলে দুজনেই কোনও দিন গানের জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অর্থ নেননি। জয়ন্ত জানিয়েছিলেন, ‘‘মাত্র দু’মিনিটে গানের মুখড়াটা করেছিল বাবা। আমি তখন বছর চোদ্দোর ছেলে। এক দিন দেখি, বাবা ‘কত দিন গেল কত রাত’ গানটা গুন গুন করে গাইছে। তার পরই আমায় ডেকে বলল, ‘চল তো বাবু সুরটা করি। আমি ঠেকা দিয়ে গেলাম তবলায়। বাবা মুহূর্তে সুর করে ফেলল— ‘কঁহি দীপ জ্বলে…’।’’
উত্তমকে হিন্দি ছবিতে অভিনয় করার জন্য প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন হেমন্তই। ১৯৬২ সালে হেমন্ত প্রযোজিত প্রথম হিন্দি ছবি ‘বিশ সাল বাদ’ সুপারহিট হয়। এর পর উত্তমকে নায়ক করে ‘শর্মিলি’ বলে একটি হিন্দি ছবির পরিকল্পনা করেন হেমন্ত ও পরিচালক বীরেন নাগ। নায়িকা ওয়াহিদা রেহমান। উত্তমের সঙ্গে কথা বলে ‘শর্মিলি’ তৈরির প্রস্তুতি নেওয়া হয়। একটি সর্বভারতীয় পত্রিকায় পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কথা ছিল, প্রথম শুটিং হবে উত্তমকে নিয়ে, আসানসোলে কয়লাখনিতে। সব কিছু ঠিকঠাক। কিন্তু চূড়ান্ত মুহূর্তে উত্তম অভিনয় করবেন না বলে বেঁকে বসেন। কী কারণে এই সিদ্ধান্ত তাও স্পষ্ট করে জানাননি। এ হেন আচরণে হেমন্ত খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। দু’জনের মধ্যে সম্পর্কে সামান্য হলেও চিড় ধরে। যার ফলে অবিস্মরণীয় ‘উত্তম-হেমন্ত’ জুটির সাময়িক বিচ্ছেদ। এ দিকে ‘শর্মিলি’ না হওয়ার জন্য হেমন্তকে বিপুল আর্থিক মাসুল গুনতে হয়েছিল। তখন তিনি ওই ছবির কাজ বন্ধ রেখে, বিশ্বজিৎ ও ওয়াহিদাকে নিয়ে তৈরি করলেন ‘কোহরা’ (১৯৬৪)। বীরেন নাগই পরিচালনা করেছিলেন।
কী ভাবে বাঙালি মনে রেখেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে?
হেমন্ত বিষয়ে নানা বয়ান বাঙালির। তিনি নাকি ‘কলসিতে গলা ঢুকিয়ে’ গাইতেন। ব্যঙ্গাত্মক এই বয়ানেরই ভিন্নভাষ ‘গলায় কাজ ছিল না’। আসলে, মন খুলে গ্রহণ করার বদলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, উত্তম-সৌমিত্র, লতা-আশা, হেমন্ত-মান্না গোছের প্রতিতুলনাতেই স্বচ্ছন্দ কিছু মন। অর্বাচীনতার সেই প্রাবল্যেই সুমন বনাম নচিকেতা স্তরেও পৌঁছনো গিয়েছিল! হেমন্তকেও প্রতিতুলনায় পড়তে হয়েছিল। মজার বিষয়, যাঁদের সঙ্গে প্রতিতুলনা, তাঁদের বিচারে তিনি ব্যতিক্রমী বৈদূর্যকণ্ঠই! যে কণ্ঠে মোহিত উস্তাদ আমির খান, মেহেদি হাসানেরাও।
প্রথম পাবলিক ফাংশনে গাইতে পারেননি পঙ্কজ মল্লিক এসে যাওয়ায়। কিন্তু মনখারাপ উবে গিয়েছিল ‘পঙ্কজবাবু’কে শোনা যাবে বলে! তাঁর গায়ে ‘ছোট পঙ্কজ’ তকমা সাঁটা ছিল শুরুতে। বিষয়টিতে নকলনবিশির সাক্ষ্য পান অনেকেই। কিন্তু ‘পঙ্কজকণ্ঠী’ না বলে ‘ছোট পঙ্কজ’ বলা কেন? ভাবার বিষয়।
বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় গানের দরজা খুলেছিল। নবম শ্রেণিতে আকাশবাণী দিয়ে শুরু। অন্যদের সুরে কিছু গানের পর নিজের সুরে ‘কথা কোয়ো না কো, শুধু শোনো’। তারও পরে বন্ধু অমিয় বাগচীর কথা আর নিজের সুরে ‘আজ কোনও কথা নয়’। সুরের চলনে রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু মধ্যপথে ‘উধাও হয়ে যে চলে যাব দোঁহে’ অংশে কেমন যেন বদলে যায় সুরটা। ‘সিগনেচার’ তৈরির শুরু?
হেমন্ত-উত্তম বা হেমন্ত-দেব জুটির রসায়নে বা বাংলা-হিন্দি ছবিতে তাঁর অমোঘ কণ্ঠটি ছিল যেমন, তেমনই ছিল রোমান্টিকতার ব্ল্যাঙ্ক-চেক এবং ‘সিগনেচার’। অনেকের অনেক সুরকেই অনেকের এক রকম লাগে। কিন্তু তা যদি বহু দিন বেঁচে থাকে, তখন বিশ্বাস করতে বিশ্বাস হয়, বিষয়টার মধ্যে কিছু একটা আছে! এবং বোঝা যায়, ‘প্রোডাক্ট’ এক নয়, একই কারখানার। যেমন, রবীন্দ্রনাথ শুনলে বোঝা যায়, কারখানার নাম রবীন্দ্রনাথ। নজরুল-রজনীকান্তেও যেমন। বা সলিল-সুমনে। ‘সিগনেচার’ এটাই। এবং ‘সিগনেচার’ তৈরি করা সহজ নয়।
ধুতি-শার্ট মেলডির বৈজয়ন্তী উড়েছে দশকের পর দশক। বেসিক রেকর্ড থেকে রুপোলি পর্দা। পুরুষকণ্ঠে, নারীকণ্ঠে। এবং-এবং সঙ্গীতায়োজনে। ‘কতদিন পরে এলে’ গানে প্রথম পঙ্ক্তি উচ্চারণের পরেই যে কয়েক ফোঁটা বাদ্যবিন্দু ঝরে পড়ে, তা বিচ্ছিন্ন তো নয়ই, বরং মনে হয়, ওই ‘টুং-টুং টুং-টুং’টা বাদ দিলে গানটা সম্পূর্ণ নয়! কিংবা ‘নাগিন’ ছবিতে সাপুড়ে বিনটা! সে সুরে কে কে বাজিয়েছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সুর-সঙ্গীতায়োজনের ভাবনাটা হেমন্তেরই। তার জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, গুজব ছড়ায়, সে গানে নাকি প্রেক্ষাগৃহে সর্পাগমন ঘটত! আসলে, সাপ শুনতে না পেলেও সাপুড়ে তো পান! তাই উপমহাদেশ জুড়ে আজও সাপুড়ের বিনে হৈমন্তী ধুন! ‘সিগনেচার’!
মোটরবাইকে সওয়ার সুচিত্রা-উত্তম। দর্শক-শ্রোতার সামনে গুপ্ত শরীরী টান। ছুঁয়ে থাকতে দেখার কাঁপুনি এবং হিংসাও। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, নিশ্চিত ভাল হয়! কত বার যে উত্তমের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে সুচিত্রার স্পর্শ চাওয়া! কত বার যে সুচিত্রাকে বাইক থেকে ফেলে দিয়ে উত্তমের বাহুলগ্ন বাঙালি মেয়ের মন! আসলে, ম্যাজিকটা সুরের রোমান্টিকতায়, যা নিখাদ বাঙালির। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ পর্যন্ত গেয়েই কৃষ্ণচন্দ্র দে গীত ‘অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে’ গাইলে যে কারণে উত্তম-সুচিত্রা মনের মোটরবাইক থেকে নামেন না!
বাংলার মাঠনদীর সুরের স্নাতক হেমন্ত।
উদাহরণ অজস্র। যেমন, কিশোরকুমার আর সুধা মলহোত্রের গাওয়া ‘কস্তি কা খামোশ সফর’ গানটা। এ সুরের সাম্পান একান্ত ভাবে বঙ্গীয়। সুরে দাঁড় উঠছে, দাঁড় পড়ছে।
‘বন্ধু তোমার পথের সাথিকে চিনে নিয়ো’, ‘কোয়েল পুকারে’, ‘এই রাত তোমার-আমার’, ‘ও রাতকে মুসাফির’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়’— দীর্ঘ মেলডিপথের পাশাপাশি হেমন্ত আরও অনেক কিছু করেছিলেন। অর্থহীন সমালোচনাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন রবীন্দ্রগান, সলিল-জাদুতে গেয়েছেন ইতিহাসপ্রতিম গণগান। এবং বাংলা উচ্চারণ শিখিয়েছেন বাঙালিকে।
কিন্তু বাঙালিয়ানার রোল-মডেল, বহির্বঙ্গের কাছে কার্যত প্রথম ‘দাদা’কে বাঙালি নেবে না ফেলে দেবে, বুঝতে পারে না আজও। ধরা যাক, কোনও এক বাঙালির এক চনমনে বিকেলে মনে হল, ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’ গানটার সুরে গদগদ প্রেম আছে এবং সেটা তাঁর আপন আদরকাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে না। আবার বিরহলাঞ্ছিত রাতে একা ছাদে দাঁড়িয়ে তাঁরই ওই সুরটিকে প্রার্থনার শান্তির মতো আপন মনে হল! এই ভাবেই সমস্যা বাড়িয়েছেন হেমন্ত! দেখনদারি বাদ দিয়ে, অসাধারণত্বকে আত্মস্থ করে আপাত-সাধারণ করে তোলার জাদুতে! তিনি রবীন্দ্র-প্রভাবিত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে কী এল গেল! রসের ভিয়েনে তো খামতি পড়েনি! আসলে, কোন বন্ধনীতে রাখা যাবে হেমন্ত মুখুজ্জে নামের জীবটিকে, গণগানের বয়ানে, প্রাণের আরামের রবীন্দ্রগেহে, না কি রোমান্টিক গোত্রে— সিদ্ধান্ত করে ওঠা যায়নি! হেমন্তকে ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালি না পেরেছে গিলতে, না পেরেছে ওগরাতে। তা ছাড়া বর্জনের অভিপ্রায়ে গ্রহণ করাও তো সুস্থ রেচনতন্ত্রের সহায়ক নয়! তাই বাংলা গান শোনার অভ্যাস ক্রমশ ধূসর হয়েছে। কবীর সুমন নামের আর এক সিগনেচার-অলা সঙ্গীতকার না এলে হয়তো সেই ধূসরিমাই দীর্ঘায়িত হত!
‘নিঝুম সন্ধ্যা’র পাখিরা মেনকা সিনেমার উল্টো দিকের বাড়ির পাশের গাছগুলোয় আজও ফিরে আসে, থাকে। ভোরে মানুষজন লেক থেকে বাড়িটার তলার চায়ের দোকানে জড়ো হন আজও। দোকানটা চালাতেন ‘সুকুমার ভুঁইয়া’, যাঁকে পড়াশোনা আর ফুটবল খেলার জন্য টাকা-পোশাক দিতেন ধুতি-শার্ট। তিনি গানের স্বরলিপি ফেলে চলে যাওয়ার দিন সুকুমার লেক মার্কেট থেকে বরফ এনেছিলেন তাঁর মরদেহের জন্য। সেই দোকানে ভিড় জমাতেন ‘ইন্দ্র শীট’ও, যাঁর দাদু পরেশের দোকানে তিনতলা থেকে নেমে চা খেতেন ধুতি-শার্ট। ধুতি-শার্টের দরজার সামনে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে পুরসভার বাতিল বাতিস্তম্ভটা। সেই কচুরির দোকানের ‘ভরত পাল’ যাঁর তলায় ছোটবেলায় পড়তেন আর বাবা বিশ্বনাথ মশলামুড়ির দোকান চালাতেন। মশলামুড়ি তিনতলায় উঠত লতা মহড়ায় এলে, কিশোর এলে, দেশের তাবড় শিল্পী বা আত্মীয়বন্ধু এলে। তাঁর দেওয়া নতুন শার্ট বড় হয়েছিল বলে কী লজ্জা পেয়েছিলেন ধুতি-শার্ট আর মাপসই নতুন জামা কিনে এনে দিয়েছিলেন, সেই ঘটনা একসময় সবাইকে বলতেন উল্টো-ফুটের চা-দোকানের ‘তারাপদ দে’। এঁদের সবারই ধুতি-শার্টের কথা মনে আছে। মনে আছে খুব কাছের এক জন ‘ভালমানুষ’কে।
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দধারা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন (২০১৩)।
২- বাংলা গানের গতিপথ, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, ডি. এম. লাইব্রেরি (২০১৩)।
৩- বাংলা গানের ধারা: হাজার বছরের বাংলা গান, ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী, প্যাপিরাস।
৪- বাংলা গানের বর্তমান ও আরো, ড. করুণাময় গোস্বামী, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স (২০১৪)।
৫- আমার স্বামী হেমন্ত, বেলা মুখোপাধ্যায়।
৬- আজকাল পত্রিকা, ২রা জুন ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত