বুম্বাদা আর ঋতুদি মান অভিমান কাটিয়ে এত্তো বছর পরে চলচ্চিত্রে এলো একসাথে, তুমি তখন “প্রাক্তন” হয়ে গেছো। প্রিমিয়ারে যাওয়া হলো না, কতো ছবি দেখা হলো না। যীশু এখন মুম্বাইয়ে কাজ করে।যীশুর মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে। পটরপটর কথা বলে। উমা ছবিটা পারলে দেখিস। ইশ অনির্বাণকে কাজে লাগাতে পারলে না গো ঋতু দা। জানো চূর্ণী আর কৌশিকের ছেলেটা ও অভিনয় করছে এখন। সৃজিত ফেলুদা বানাচ্ছে আর বাবুদা প্রফেসর শঙ্কু। মণি আর শ্রীকান্ত মিলে একটা হৈচৈ কান্ড ঘটিয়েছে। তুমি থাকলে ওখানে টেলিছবি বানিয়ে দারুণ আনন্দ পেতে। জানো ইরফান মারা গেছে। দেখা হয়েছে?
খুব ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেছে গোটা দেশকে ইরফানের খবরটা। যেভাবে একটা বৃষ্টির সকালে তোমার খবরটা এসেছিল। দুটো এসি চালিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে তুমি শুয়ে ছিলে আর বাকিরা বাইরে দাঁড়িয়ে। ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়ির সামনে ওরকম ভীড় বোধহয় ঐশ্বর্য আসার সময় হয়েছিল। ও ঐশ্বর্য আর অভিষেকের মিষ্টি মেয়েটা অনেকটা বড় হয়ে গেছে। বচ্চন সাহাব সেই এক আছে। কাজপাগল।
ঋতুদা, বেশ তো ছিলে। third sex বলে কিছু একটা খায় ও মাথায় দেয়, সেই ফান্ডা মধ্যবিত্তের ড্রইংরুমে এনে ফেলেছিলে।অভিনয় করলে, বেঁচে ও নিলে নিজের মতো করে কয়েক বছর কি সুন্দর মাথা কামিয়ে, কানে দুল, সুন্দরী সেজে, গয়না পরে। বলা হয়নি, সমকামিতা ভারতে অপরাধ নয় আর। হ্যাঁ গো। সত্যি সত্যি সত্যি।
জানো তোমার ঝাঁকড়া চুল, বাঁ কাঁধে নক্সা করা উত্তরীয় পাঞ্জাবীর সাথে, দারুণ লাগতো। মা এর সামনে বিয়েবাড়ি যাওয়ার আগে ওরকম ভাবে সেজে দাঁড়ালে মা দাঁত খেঁকিয়ে বলতো, ঋতুপর্ণ ঘোষ হবি নাকি?
তোমার মত হয়ে ওঠা হলো কই? তোমার ছবি দেখে আমিও মনে মনে ভেবেছি ছবি বানাবো। বাথরুমে বসে কতবার নিজের ছবির ছক কষেছি, কাস্টিং করেছি, জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করেছি। তোমার ছবিকে দীর্ঘ কাঁটাছেড়া ও করেছি।
Multiplex যাওয়া, Texus এ বাটি চচ্চড়ি রান্না করা রুচিসম্মত বাঙালির কত আপন ছিলে তুমি। তোমার থেকেই তো পরের প্রজন্মের শেখা শহুরে ছবির রেসিপি। ইসস “নেটফ্লিক্স” এ কি ভালো ভালো ছবি আসে জানো। আচ্ছা ওই এত্তো এত্তো ডিভিডিগুলো কি করলে? সই করে দেবে? যেভাবে ঘোষ এন্ড কোম্পানির শেষে দিতে?
“বেদের মেয়ে জোছনার” পেরিয়ে, বাঙালি যে একটা ‘দহন’, একটা ‘উৎসবে’ মেতে উঠতে পারে, সেই ভাবে আমাদের ভাবিয়ে তো ছিলে। তবু কেন যেন তোমাকে সর্বকালের সেরা পরিচালকের আসনে বসাতে পারিনি। কেন বলতো? আমাদের কি রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ সীমাবদ্ধ করে দেয় অন্যদের hero worship করার ক্ষেত্রে?
জানো তো, তোমার set design, ছবির ছোটো ছোটো নান্দনিকতা, সাজসজ্জা, তোর অদ্ভুত dubbing করিয়ে নেওয়া মুগ্ধ করতো আমাদের মতো মধ্যমেধার মানুষকে।
করবে নাই বা কেন? সবাই তো মফস্বল শহরের বড় পর্দায় সবসময় Autumn Sonata র মতো ছবি নিজের ভাষায় দেখতে পারেনা। আর দেখতে পেলেও বা। ‘উনিশে ত্রপ্রিল’ এর তাতে বয়েই গেল। তোমার ছবি তোমারই মত।
আজ থেকে পাক্কা সাত বছর আগে সকালে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, তা থামলো কই? চোখগুলো দেখ আমাদের।
সেদিন সকালে নাকি তুমি দুটো AC চালিয়ে, লেপের তলায় ঘুমিয়ে ছিলে। আগের রাতে জানতে যে সকালে আর রেনকোটের দরকার পরবে না?
রোববার হলেই First person টা পড়তাম। সেখানেই জেনেছিলাম তোমার পরপর মা ও বাবার চলে যাওয়া তোমার কাছে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। আসলে মা এর কাছে যাওয়ার ফন্দি ছিল না তাই না?
তাই কি অতৃপ্ত ইচ্ছেগুলো এক এক করে পূর্ণ করা? তাই কি হাতে গোনা যে কয়েকটি কৃতী কে নিয়ে বাঙালি উদ্বাহু নৃত্য করে তাদের মধ্যে থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে?
শুনেছি একলা ঘরে alzolam বন্ধু পাতিয়ে ফেলে। তোমার তো অনেক ওষুধ কিনতে হত, না? অনেক ওষুধের মাঝে মা কে স্বপ্নে আঁকড়ে ধরতে চাইতে কি?
আচ্ছা ঋতু দা, যখন তুমি নিথর শুয়ে, সেদিন ঝাপসা চোখ কি কৃষ্ণ কে খুঁজে বের করতে পেরেছিল? সিরিটি শ্মশানে একরাশ ছাতা তোমাকে আগলে আর তুমি ফন্দি এঁটে ওপারে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরার অপেক্ষায়।
পরজন্ম যদি থাকে তবে খুব সুন্দর সেজেগুজে, রাধার মতো ফিরে এসো। বনমালী সবাই হতে পারে না। হলেও তোমার মত বাঁচতে পারে না। তুমি রোজ বেঁচে ছিলে যে।
আমরা তোমার হ্যাংওভার নিয়ে এগিয়ে চলি বারিষওয়ালা। বঙ্গ জীবনের অঙ্গহানির এই দিনটা নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি। ওই যাদের ‘ছক্কা’ বলা হতো তারা তোমার আঁকা রামধনুতে বাঁচুক, যে মেয়েটা বাংলাকে জাপ্টে ধরতে চায় মায়ের মতো, সে গানের ওপারে বাঁচুক। তুমি প্রতি বছর এই দিনটা বৃষ্টি ভিজতে ফিরে ফিরে এসো। মথুরানগরপতির মতো, সীমন্তিনীর মতো, অলকানন্দার মতো।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত