‘‘দ্বিজেন্দ্রলাল যখন বাংলার পাঠকসাধারণের নিকট পরিচিত ছিলেন না তখন হইতেই তাঁহার কবিত্বে আমি গভীর আনন্দ পাইয়াছি এবং তাঁহার প্রতিভার মহিমা স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হই নাই। দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ সত্য, অর্থাৎ আমি যে তাঁর গুণপক্ষপাতী, এইটেই আসল কথা এবং এইটেই মনে রাখিবার যোগ্য। আমার দুর্ভাগ্যক্রমে এখনকার অনেক পাঠক দ্বিজেন্দ্রলালকে আমার প্রতিপক্ষশ্রেণীতে ভুক্ত করিয়া কলহের অবতারণা করিয়াছেন। অথচ আমি স্পর্ধা করিয়া বলিতে পারি এ কলহ আমার নহে এবং আমার হইতেই পারে না। পশ্চিম দেশের আঁধি হঠাৎ একটা উড়ো হাওয়ার কাঁধে চড়িয়া শয়ন বসন আসনের উপর এক পুরু ধুলা রাখিয়া চলিয়া যায়। আমাদের জীবনে অনেক সময়ে সেই ভুল-বোঝার আঁধি কোথা হইতে আসিয়া পড়ে তাহা বলিতেই পারি না। কিন্তু উপস্থিতমতো সেটা যত উৎপাতই হোক্ সেটা নিত্য নহে এবং বাঙালি পাঠকদের কাছে আমার নিবেদন এই যে, তাঁহারা এই ধুলা জমাইয়া রাখিবার চেষ্টা যেন না করেন, করিলেও কৃতকার্য হইতে পারিবেন না। কল্যাণীয় শ্রীমান দেবকুমার তাঁহার বন্ধুর জীবনীর ভূমিকায় আমাকে কয়েক ছত্র লিখিয়া দিতে অনুরোধ করিয়াছেন। এই উপলক্ষে আমি কেবলমাত্র এই কথাটি জানাইতে চাই যে, সাময়িক পত্রে যে-সকল সাময়িক আবর্জনা জমা হয় তাহা সাহিত্যের চিরসাময়িক উৎসব-সভার সামগ্রী নহে। দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি এবং আমার লেখায় বা আচরণে কখনো তাঁহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করি নাই। – আর যাহা-কিছু অঘটন ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র, তাহার সম্পূর্ণ কারণ নির্ণয় করিতে আমি তো পারিই না, আর কেহ পারেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না।’’ – কথাগুলো লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির দেওয়ান ছিলেন কার্তিকেয়চন্দ্র রায়। তাঁর স্ত্রী প্রসন্নময়ীদেবী ছিলেন শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্য পরিবারের মেয়ে। ৪ঠা শ্রাবণ ১২৭০ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯শে জুলাই ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এই দম্পতির সপ্তম পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। নাম রাখা হয় দ্বিজেন্দ্রলাল। পরবর্তী জীবনে এই দ্বিজেন্দ্রলালই বাংলা-সহ সারা ভারতবর্ষে নিজ কীর্তিতেই খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। পেশায় সরকারি আমলা ছিলেন, কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতোই তাঁর সৃষ্ট গান ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ এখনও উৎসাহের সঙ্গেই চর্চিত হয় বঙ্গ সমাজে। পেশাগত কারণে সরাসরি জাতীয়তা আন্দোলনে অংশ নিতে না পারলেও নাটক ও দেশাত্মবোধক গান লিখে তিনি পরোক্ষ ও স্পষ্ট ভাবে এই আন্দোলনকে পুষ্ট করেছেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাঁর পরিচিতির গণ্ডি ছিল খুবই ছোট। আসলে কবি-নাট্যকার-গীতিকার-সুরকার-গায়ক – হিসেবেই আপামর বাঙালির কাছে তিনি ‘ডিএল রায়’, এক অতি গুণী ব্যক্তিত্ব।
পারিবারিক ভাবে দ্বিজেন্দ্রলালদের পরিচিতি ছিল ‘চক্রবর্তী দেওয়ান’ হিসেবে। তবে বংশ গৌরব ও আভিজাত্যের পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এই পরিবারের ছিল পুরুষানুক্রমিক খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা কার্তিকেয়চন্দ্র নিজে ছিলেন একজন সুপণ্ডিত, সাহিত্যিক এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী। তিনি ইংরেজি, সংস্কৃত ও পার্সি ভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। লিখেছিলেন কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের ইতিহাস। কার্তিকেয়চন্দ্র আত্মজীবনীও লিখেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে প্রথম দিকের আত্মজীবনীগুলির মধ্যে তাঁর লেখাটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করা হয়। ‘গীতমঞ্জরী’ কাব্যগ্রন্থ রচনাও তাঁর অসামান্য এক কীর্তি।
দ্বিজেন্দ্রলালের বড় দাদা রাজেন্দ্রলাল ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের এক পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর আর এক দাদা হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনীদেবী ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যস্রষ্টা। তা ছাড়া ডিএল রায়ের অন্যান্য দাদারাও বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।
আর এ সবের ফলেই এই দেওয়ান পরিবারের সঙ্গে তত্কালীন বঙ্গদেশের বিশিষ্ট ও খ্যাতনামা মানুষ – বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের সঙ্গে ছিল নিবিড় যোগাযোগ। কাজেই এমন পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা দ্বিজেন্দ্রলালের পক্ষে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ‘আর্যগাথা’ নামের একটি গানের বই প্রকাশ করাটা মোটেই আশ্চর্যের নয়। বারো থেকে সতেরো বছর বয়সে লিখেছিলেন এই লেখাগুলি। এবং পরবর্তী কালে তাই, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা সম্পাদনা করাও তাঁর কাছে খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিল।
কৃষ্ণনগরের পাঠশালাতেই দ্বিজেন্দ্রলালের পড়াশোনার সূত্রপাত। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিলেন। দু’বছর পর অর্থাৎ ১৮৮০ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন তিনি। পরে হুগলি কলেজ থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল বিএ এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করেন। এর পর কিছু দিন ছাপড়ায় ‘রাভেলগঞ্জ মুখার্জী সেমিনারি’তে শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি পেয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেন। ‘রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ’ এবং ‘রয়্যাল এগ্রিকালচারাল সোসাইটি’ থেকে কৃষিবিদ্যায় ‘এফআরএএস’ এবং ‘এমআরএসি’ ও ‘এমআরএএস’ ডিগ্রি নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন ১৮৮৬ সালে। লন্ডনে থাকাকালীনই তাঁর বাবা ও মায়ের প্রয়াণ-সংবাদ পেয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল।
১৮৮৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ও ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম ব্যক্তিত্ব প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালাদেবীর সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিবাহ হয়। তাঁদের দুই সন্তান – দিলীপকুমার রায় ও মীরা রায়। কিন্তু দাম্পত্য জীবন ১৫ বছর পেরোতে না-পেরোতেই ১৯০৩ সালে আচমকাই চলে গিয়েছিলেন সুরবালা। একা হয়ে পড়েছিলেন ডিএল রায়। তার ঠিক ১০ বছর পর সেই একাকীত্ব ঘোচে তাঁর, হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর!
ছোটবেলা থেকে যে চর্চার মধ্যে বড় হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল, বিলেত গিয়ে সে ঘরানাটা একটু বদলে গিয়েছিল। লন্ডনে থাকার সময় দ্বিজেন্দ্রলাল ইংরেজিতে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। ১৮৮৬ সালে সেগুলি একত্রে গ্রন্থ রূপে প্রকাশ পায় – ‘দ্য লিরিক্স অফ ইন্ড’, এটাই তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি পাশ্চাত্যসঙ্গীত শিক্ষাও শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল লিখছেন, ‘‘আমি সলজ্জে স্বীকার করি যে এককালে আমার ইংরাজি গানে বিশুদ্ধ ও আন্তরিক ঘৃণা ছিল। … ক্রমে বিলেতে প্রবাসে নানা বন্ধুর নিকট ছোটখাটো ইংরাজি গান শুনিতে শুনিতে ভাবিলাম ‘বাঃ এ মন্দই বা কি?’ … শেষে আমার ইংরাজি গান শিখিবার প্রবৃত্তি হইল ও পয়সা দিয়া গান শিখিতে আরম্ভ করিলাম।’’
পরে তিনি দেশে ফিরে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের শৈলী বাংলা গানে প্রয়োগ করেছিলেন চমৎকার ভাবে। অনুবাদ করেছেন বহু ইংরেজি ও আইরিশ গান। তবে পাশ্চাত্য সুরেই শুধু আটকে থাকেননি। ঢপ-খেয়াল, বাউল-কীর্তনের সুর-তাল প্রয়োগ করেছেন সুচারু ভাবে। কাব্যসঙ্গীতে প্রাচ্য সুরের সঙ্গে পাশ্চাত্য রীতি হাল্কা ভাবে মিশিয়ে এক ধরনের গায়নরীতি সৃষ্টি করেছিলেন।
ডিএল রায় নাট্যকার হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করলেও কবি ও গীতিকার হিসেবে মোটেও পিছিয়ে ছিলেন না। তিনি গদ্যের প্রাণভোমরাকে স্থাপন করেছিলেন কাব্যের শরীরে। তাঁর সামগ্রিক কাজকে তিনটি ভাবে ভাঙা যায় – ব্যঙ্গ, সঙ্গীত ও কাব্য এবং নাটক। এগুলিও আবার তিন রকমের – পৌরাণিক-কাব্যিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক। তবে, মৌলিক লেখালেখির বাইরে দ্বিজেন্দ্রলাল শেক্সপিয়রের ‘ট্রাজেডি’কে অনুকরণ করতে গিয়ে তেমন সাফল্য পাননি।
দ্বিজেন্দ্রলাল প্রায় তিন বছর বিদেশে কাটানোর পর ফিরে এসেছিলেন নিজের দেশে। শোনা যায়, বিলেত থেকে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ জাতিচ্যুত প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘চীন গেলে জাতি যায় না, গোপনে অখাদ্য খাইলে জাতি যায় না প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় না, তখন বিদ্যা শিক্ষার্থে বিলাত গেলে জাতি যাইবে কেন?”
যাই হোক, বিলেতের কৃষিবিদ্যার ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও তিনি এ বার নিয়েছিলেন জমি জরিপ ও কর মূল্যায়ণের প্রশিক্ষণ। তার পর যোগ দিয়েছিলেন সরকারি দফতরে, কর্মস্থল হল মধ্যপ্রদেশ। পরে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন দিনাজপুরে। কিন্তু স্বাদেশিকতায় বিশ্বাসী হওয়ায় তাঁকে ক্রমাগত বদলি করা হয়েছিল। ফলে তাঁর সাহিত্য নির্মাণে বাধা পড়তে শুরু করেছিল। মনের চাপা কষ্ট থেকে সৃষ্টি হতে শুরু করেছিল নানা রকমের সঙ্গীত।
১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটলমেন্ট অফিসার হিসেবে আসেন দ্বিজেন্দ্রলাল। কৃষকদের জমির অধিকার নিয়ে বাংলার তৎকালীন ইংরেজ গভর্নরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। কাজেই সরকারি সুনজর থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন আবার।
স্ত্রী সুরবালার মৃত্যুর পর ১৯০৫ সালে বদলি হয়ে এসেছিলেন খুলনায়। বঙ্গভঙ্গের পর ফের দুই বাংলা এক করার দাবিতে সেখানে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন ডিএল রায়। আর এই সময়েই তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছিল প্রচুর দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। সে গানগুলো আজও সমান ভাবে জনপ্রিয় বঙ্গবাসীর কাছে। দ্বিজেন্দ্রলাল মেয়েদের উন্নতির জন্য তো বটেই, হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধেও কলম ধরেছিলেন।
১৯০৬ সালে গয়াতে বদলি হয় তাঁর। আর এখানেই রচিত হয়েছিল, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার…’, নির্মাণ হয় দু’টি বিখ্যাত নাটক – ‘মেবার পতন’ ও ‘নুরজাহান’।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে কর্ম জীবন থেকে অবসর নিয়েছিলেন। আর তার দু’মাসের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯১৩ সালের ১৭ই মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।
বাঙালির প্রাণের গান রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল। বাঙালির প্রাণের এই দুই কবির জন্মকালও খুব কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে, দ্বিজেন্দ্রলালের ১৮৬৩ সালে। দুই কবির মধ্যে বন্ধুত্বও ছিল নিবিড়, তবু কাঁটা লুকিয়ে ছিল কোথাও। বন্ধুত্বে ভাঁটা, ভালবাসায় বিচ্ছেদ। কিন্তু কেন?
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চমৎকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল অনেক দিন। শেষের দিকে তা একেবারে বিষিয়ে যায়। এই বন্ধুবিচ্ছেদের কথা অনেকে জানে। কিন্তু প্রথম দিকের অনেক ঘটনা, যাতে দেখা যায় দু’জন বড় লেখকের মধ্যে গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার কাহিনি, তা অনুধাবন করলে এই প্রশ্ন জাগবেই, কেন সে সুসম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল, কেন এমন একটা অত্যন্ত কুরুচিকর কাণ্ড ঘটল? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর সম্ভবত আজও পাওয়া যায়নি। এর কারণ কি শুধু ঈর্ষা? দু’জন সমসাময়িক লেখকের মধ্যে বন্ধুত্ব যেমন হয়, তেমনই ঈর্ষার সম্পর্কও স্থাপিত হতে পারে। সেটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। লেখকরা স্পর্শকাতর প্রাণী। যে কোনও শিল্পীই তাই। প্রায় একই বয়সী অন্য কোনও লেখকের সার্থকতা এবং খ্যাতি বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে আর এক জন লেখকের মন ঈর্ষায় জ্বলে, কিন্তু তিনি সেই জ্বালা মনে মনেই চেপে রাখেন। এমনকী সেই ঈর্ষার জ্বালায় তাঁর সৃষ্টি আরও বিকশিত হতে পারে। কিন্তু প্রকাশ্যে সেই ঈর্ষার নগ্নরূপ দেখানো কি কোনও লেখককে মানায়? আপাতদৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথকে ঈর্ষা করার কোনও কারণই ছিলনা দ্বিজেন্দ্রলালের। তাঁর জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাননি। তাঁর সুনাম বাংলার বাইরে ছড়ায়নি। দু’জনেই কবি ছিলেন। দু’জনেই গান সৃষ্টি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও নাটক লিখতেন, কিন্তু নাট্যকার হিসাবে দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন অনেক বেশি জনপ্রিয়। দু’জনেই ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। রবীন্দ্রনাথের দিক থেকে ঈর্ষা বা বিদ্বেষের সামান্যতম উপাদানও খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। সারা জীবনে রবীন্দ্রনাথ কখনও নিন্দুকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে যাননি। কোনও আক্রমণেরই তিনি প্রতি আক্রমণ-অস্ত্র শানাননি। তা বলে কি তিনি আঘাত পেতেন না? সামান্যতম আক্রমণেই তিনি আহত হতেন। তিনি নিজেই লিখেছিলেন, কটাক্ষ যতই ক্ষুদ্র হউক, তাহারও বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে, কিন্তু সেই সব আঘাতের কথা তিনি অতি সন্তর্পণে গোপন রেখেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল যখন থেকে রবীন্দ্র-বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন, তখনও একাধিক বার রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রশংসা করেছিলেন।
শৈশবে রবি দুষ্টুমি করছেন, তাঁকে একটু সামাল দেবার জন্য মাস্টারমশাই বোর্ডে একটা ছড়া লিখে দিলেন। ‘রবি করে জ্বালাতন আছিল সবাই। বরষা ভরসা দিল তার ভয় নাই।’ বললেন, লেখো তো তুমি এর পরে দুটি লাইন। কী আশ্চর্য, শিশু রবি তক্ষুনি লিখে ফেললেন ‘মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে। এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।’ ঠিক এই সময়ে ছোট দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর প্রথম কবিতা লিখেছেন ‘গগন-ভূষণ-তুমি জনগণ মনোহারী। কোথা যাও নিশানাথ হে নীল নভোবিহারী’ – যা শুনে তাঁর পিতা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় মন্তব্য করেছিলেন – এই ছেলে যশস্বী হবে। আবার দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আর্য্যগাথা’ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের ‘সন্ধ্যাসংগীত’ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে। বিলেত থেকে ফিরে এসে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকাশ করলেন আর্য্যগাথা দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৯৩ সালে। ইতিমধ্যে দশটি বছর পার হয়ে গিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মানসী কাব্য, মায়ার খেলা, চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য এবং আরও অনেক অসাধারণ রচনা। তত দিনে কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যজীবনের প্রথম লগ্ন। তখন তো কেউ তাঁর নামই জানত না। এগিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি হিসেবে বরণ করে নিলেন দ্বিজেন্দ্রলালকে। তাঁর ‘আর্যগাথা’ কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ কবিতাগুলির ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। আর তার পরেই কৃতজ্ঞতায় দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর ‘বিরহ’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে দুজনের পরিচয় আর ভালবাসা।
প্রথম জীবনে ঠাকুরবাড়ির অনেকের সঙ্গেই দ্বিজেন্দ্রলালের বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বিলেত থেকে ফিরে আসার পর দ্বিজেন্দ্রলাল (তখন তিনি পরিচিত ছিলেন দ্বিজুবাবু হিসাবে, যেমন রবিবাবু)। কিছু দিন আবগারি বিভাগের পরিদর্শকের কাজ করেছিলেন। সেই সুবাদে তাঁর একটি বজরা ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও শিলাইদহের বজরায় গিয়ে অনেক সময় কাটাতেন। এই বজরাটি একেবারে কলকাতার গঙ্গায় থাকত। দ্বিজুবাবু প্রায়ই কয়েক জন বন্ধু নিয়ে এই বজরায় সান্ধ্য বিহার করতেন। সেই আড্ডায় প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন রবিবাবু। দু’জনেই পর পর গান গাইতেন। একদিন সেই বজরাটিতে সাহিত্যিক বন্ধুদের তিনি একটি পার্টি দিলেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি লিখেছেন – ‘কথা ছিল এখান থেকে বরাবর খড়দা পর্যন্ত গিয়ে সেখানে একটা বাগানে আহারাদি করা যাবে এবং তারপর ধীরে সুস্থে ফেরা যাবে। বজরা রওনা হল। রবিবাবুও এ পার্টিতে ছিলেন। হঠাৎ খুব মেঘ করে এল ঝড় এবং বৃষ্টি। এ দিকে বাজে তখন প্রায় এগারোটা। শ্যামবাবু জানালেন, আমরা ব্যারাকপুরে লাটসাহেবের বাড়ির বাগানে নেমেছি। সেখানেই নেমে পড়া সাব্যস্ত হল। কিন্তু রাতের ওই দুর্যোগে একখানিও গাড়ি পাওয়া গেল না। অনন্যোপায় হয়ে সেই ঘোর অন্ধকারে পদব্রজে খড়দহ যাত্রা এবং সেই বাগানের আবিষ্কার। রাত্রে যৎসামান্য আয়োজন। প্রত্যুষে উঠেই যে যার সব ট্রেনে করে কলকাতায় ফিরে আসা গেল। দুজন মহাকবি অম্লান বদনে এই সব অসামান্য কষ্ট সহ্য করেছিলেন এবং হাস্যামোদ, কবিত্ব ও রসিকতার অফুরন্ত প্রবাহে সেই দারুণ দুশ্চিন্তা ও ক্লেশকে আনন্দময় করে রেখেছিলেন। দুই কবির মধ্যে এ সময় খুব সম্প্রীতি ছিল এবং তাঁদের বন্ধুত্ব সম্বন্ধটাও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।’
রবীন্দ্রনাথ নিজে দ্বিজেন্দ্রনাথের একাধিক গ্রন্থের সমালোচনা করেছেন। তার মধ্যে ‘মন্দ্র’ নামে কাব্য গ্রন্থটির এত প্রশংসা করেছেন, যাকে বলা যায় অতিশয়োক্তির চূড়ান্ত। দ্বিজেন্দ্রনাথের কবিতা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা পাঠ্যপুস্তক শান্তিনিকেতনে পড়াবার জন্য সুপারিশ করেছেন। এ সবের উত্তরে দ্বিজেন্দ্রলাল শুরু করছেন প্রকাশ্যে বিষোদ্গার। একাধিক প্রবন্ধে দ্বিজেন্দ্রলাল রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রতি যে দুটি অভিযোগ এনেছেন, তা হল দুর্বোধ্যতা এবং অশ্লীলতা। দ্বিজেন্দ্রলালের মতে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা অস্পষ্ট এবং অস্বচ্ছ। তাই তার মধ্যে চিন্তার গভীরতা নেই। আর তাঁর কবিতার নীতিহীনতা দিয়ে তিনি কলুষিত করছেন এই সমাজকে। দুই কবির মধ্যে নীতিগত বিরুদ্ধ মত থাকতেই পারে। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের সেই প্রতিবাদের ভাষাই যে কুৎসিত। “তাঁহার ‘তুমি যেও না এখনই’ ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’ ইত্যাদি গান লম্পট বা অভিসারিকার গান।” সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মাঝে মাঝে ছোট ভাইয়ের কবিতা আবৃত্তি করতেন, সেটা নাকি তিনি ভাইয়ের কবিতা অ্যাডভার্টাইজ করার ভার নিয়েছিলেন বলে। ঠাকুরবাড়িতে যে নাটকের অভিনয় হত, সেগুলোও নাকি আত্মবিজ্ঞাপন ইত্যাদি। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে,
‘‘… রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতার দ্বিজেন্দ্র-কৃত যে সমালোচনা তা বাংলা সাহিত্যে একটি শ্রেষ্ঠ হাউলারের মতন। এই কবিতা একেবারে অর্থশূন্য ও স্ববিরোধী তো বটেই, এটা যে কত অবাস্তব তার প্রমাণ “কৃষক আউস ধান কাটিতেছেন বর্ষাকালে, শ্রাবণ মাসে। বর্ষাকালে ধান কেহই কাটে না, বর্ষাকালে ধান্য রোপণ করে। ধান তিন প্রকার,
১) হৈমন্তিক, তাহাই কৃষকের আসল ধান্য কাটে হেমন্তকালে, অগ্রহায়ণ মাসে;
২) আউস (নিজে খাইবার জন্যই প্রায় করে) কাটে শরৎকালে, ভাদ্র মাসে;
৩) বোরো (উড়িষ্যা অঞ্চলেই অধিক হয়) কাটে গ্রীষ্মকালে, বৈশাখ মাসে। … ক্ষেত্রখানি তবে একটি দ্বীপ। তবে এ চর জমি। এ রূপ জমিতে ধান করে না। এ সব জমি শ্রাবণ ভাদ্র মাসে ডুবিয়া থাকে …।
এ সমালোচনায় দ্বিজেন্দ্রলালকে একজন কৃষি বিশেষক হিসাবে অবশ্যই গণ্য করা যায়। কাব্য বোদ্ধা হিসাবে বোধহয় ততটা যায় না।’’
যখন পূর্ণিমা মিলন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করলেন দ্বিজেন্দ্রলাল, কে না যোগ দিয়েছিলেন সেই সাহিত্যবাসরে। তাঁর ৫ নং সুকিয়াস্ট্রিটের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথও এসেছিলেন। ফাগ খেলা চলেছে। দ্বিজেন্দ্রলাল মুঠো মুঠো করে ফাগ মাখিয়ে কবিকে লাল রং-এ রঞ্জিত করলেন। রবিবাবু বললেন, ‘আজ দ্বিজুবাবু শুধু যে আমাদের মনোরঞ্জন করেছেন তা নয়, তিনি আজ আমাদের সর্বাঙ্গ রঞ্জন করলেন। এর পরে রবিবাবু গান ধরলেন – সে যে আমার জননী রে।’
১৩১০ সালে মোহিতচন্দ্র সেন রবীন্দ্রনাথের ‘কাব্যগ্রন্থ’ নামে ২৬টি কবিতা সম্পাদিত ও সংকলিত করে প্রকাশ করেছিলেন। তার ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যের মধ্যে কোনও অদৃশ্য নির্দেশ অনুভব করার কথা বলেছিলেন। ভূমিকাতে ছিল ‘আমারে কর তোমার বাণী’ গানটি। ১৩১১ সালে বঙ্গবাসী পত্রিকা থেকে সংকলিত ‘বঙ্গভাষার লেখক’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। তাতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের স্বলিখিত আত্মজীবনী। যার মধ্যে তিনি তাঁর কোনও কোনও রচনা সম্বন্ধে জীবনদেবতা – ঐশ্বরিক প্রেরণা কথাটি উল্লেখ করেছিলেন। লেখাটি পড়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল এবং চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। তিরস্কার করে তিনি কবির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, রবিবাবু কি ডিভাইন ইন্সপিরেশনের দাবি করেছেন? করে থাকলে তার ব্যাখ্যা কী? রবিবাবু উত্তরে জানিয়েছিলেন, তিনি যা ভাল বুঝেছেন তা লিখেছেন। এ সম্বন্ধে কারও কাছে জবাবদিহি করবার কোনও প্রয়োজন অনুভব করছেন না। দ্বিজেন্দ্রলাল উত্তরে বলেছিলেন, রবিবাবু যদি তাঁর লেখাগুলি সম্পর্কে ডিভাইন ইন্সপিরেশন দাবি করতে লজ্জিত ও সংকুচিত না হন, তবে তিনি প্রমাণ করে দেবেন যে ওই রচনাগুলি দৈবশক্তি প্রণোদিত তো নয়ই বরং লালসাপূর্ণ। প্রমাণস্বরূপ তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন, রবিবাবুর প্রেমের গানগুলি চোখ বুলিয়ে নিন। ‘সে আসে ধীরে’ ‘সে কেন চুরি করে’ ইত্যাদি গানগুলি সবই ইংরাজি কোর্টশিপের গান। তাঁহার ‘তুমি যেওনা এখনই’ ‘কেন যামিনী’ প্রভৃতি অভিসারিকার গান।
এরপরে ‘সোনার তরী’ যখন প্রকাশিত হল, তখন সেই আত্মভাব-নিমগ্ন কল্পচারণা, সংকেত ব্যঞ্জনার আলোছায়া ও অন্তরের আধ্যাত্মিক অনুভূতি অনেক কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচকের মর্মমূলে পৌঁছেছিল। সোনার তরী কবিতাটিকে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা রূপে গণ্য করলেন। ‘তাঁহার সোনার লেখণী অক্ষয় হউক’ এই ভাবে কবিতাটিকে শীর্ষে স্থান দিলেন। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল কবিতাটিকে আক্রমণ করলেন। তাঁর মতে, ‘রবীন্দ্রসাহিত্য অস্পষ্ট’। দ্বিজেন্দ্রলাল বলেছিলেন, ‘যদি স্পষ্ট করিয়া না লিখিতে পারেন সে আপনার অক্ষমতা। … অস্পষ্টতা একটা দোষ, গুণ নহে’ (কাব্যের অভিব্যক্তি প্রবাসী ১৩১২ কার্তিক)।
আসলে, দ্বিজেন্দ্রলালের মত ছিল, রবি খালি ‘প্রেম’ নিয়ে লিখতে বসেন। নাটক নভেলও তাই। ‘কেন পৃথিবীতে মাতা নাই, ভ্রাতা নাই, বন্ধু নাই – সব নায়ক আর নায়িকা? তাও যদি কবিরা দাম্পত্য প্রেম লইয়া কাব্য লেখেন, তাহাও সহ্য হয়। ইহাদের চাই হয় বিলাতি কোর্টশিপ নয়ত টপ্পার প্রেম। নহিলে প্রেম হয় না। অবিবাহিত পুরুষ ও নারী চাই-ই। ফল দাঁড়ায় এই যে এরূপ প্রেম হয় ইংরাজি (অতএব আমাদের দেশে অস্বাভাবিক) না হয় দুর্নীতি মূলক’ (কাব্যে নীতি সাহিত্য ১৩১৬ জৈষ্ঠ সংখ্যা)।’
বঙ্গদেশে তখন রবীন্দ্রভক্ত ও রবীন্দ্রবিরোধী সুস্পষ্ট দুটি দল। ‘বাংলাদেশের সাহিত্যিক মহলে পত্রিকার অফিস হইতে কলেজের হস্টেল পর্যন্ত লেখাপড়া জানা ভদ্রসমাজ যেন দুই দলে বিভক্ত হইয়া গিয়াছিল। ‘দ্বিজুবাবুর দল’ ও ‘রবিঠাকুরের দল’। (রবীন্দ্রজীবনী দ্বিতীয় খণ্ড প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)
১৩১১ সালে দুই সাহিত্যিকের মনোমালিন্য কোন জায়গায় পৌঁছেছিল, তা বোঝা যাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি চিঠি থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আপনার নিন্দুকের দলে আমি যোগ দিতে পারব না।’
অথচ এমন নয় যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্র সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন না। অনেকগুলি উদাহরণ দেওয়া যায় যেখানে তিনি রবীন্দ্ররচনার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটি পড়ে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল দু’জনেই সমসাময়িক অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। যখন রবীন্দ্রনাথের যশ মধ্যাহ্ন সূর্যের দীপ্তির মতো ছড়িয়ে পড়েছিল, যখন তাঁর প্রতিভার অনুরাগীর সংখ্যা সীমাহীন হয়ে উঠেছিল, তখন কি কোনও ঈর্ষার কাঁটা বিদ্ধ করেছিল দ্বিজেন্দ্রলালকে?
মনুষ্য চরিত্রে এ রকম একটি দিক আছে যে, তোমাকে যদি কেউ অনবরত আঘাত করে, বিদ্রুপ ও গঞ্জনা দেয়, তুমি যদি তার প্রতিবাদ না কর, চুপ করে সব সহ্য করে যাও, তা হলে আঘাতকারীর রাগ ক্রমশ বাড়তে থাকে, সে একটা কিছু চরম আঘাত হানতে চায়।
দ্বিজেন্দ্রলালের ক্ষেত্রেও তাই হল, তিনি তাঁর প্রাক্তন বন্ধুর বিরুদ্ধে আরও কুৎসিত ইঙ্গিত দিয়ে একটি নাটিকা লিখে ফেললেন এবং স্টার থিয়েটারে সেটি অভিনয়েরও ব্যবস্থা হল। নাম – ‘আনন্দ বিদায়’। সেটা ১৯১২ সালের নভেম্বর মাস, তখন রবীন্দ্রনাথের তুলনায় দ্বিজেন্দ্রলালের খ্যাতি, অর্থ-উপার্জন কিছুই কম ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তখন গড়ে উঠেছিল বেশ বড় একটি অনুরাগীমণ্ডলী। দ্বিজেন্দ্রলালের তেমন ভক্তমণ্ডলী ছিল না। এক একজন লেখককে ঘিরেই এ সব হয়। সব লেখকের ক্ষেত্রে হয় না। দ্বিজেন্দ্রলালের পক্ষেও কিছু মানুষ ছিলেন অবশ্যই, তবে তাঁরা যতটা রবীন্দ্রবিরোধী তার চেয়ে বেশি দ্বিজেন্দ্রভক্ত কি না তাতে সন্দেহ আছে। ‘আনন্দ বিদায়’-এর প্রথম রাত্রির অভিনয় তো বন্ধ করে দিতে হয়ই, নাট্যকারকে স্টার কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার খাতিরে পিছনের দরজা দিয়ে বার করে দিতে বাধ্য হন। সে নাটক আর দ্বিতীয় বার মঞ্চস্থ হয়নি। বিশিষ্ট দ্বিজেন্দ্রজীবনী লেখক দেবকুমার রায়চৌধুরী এ সম্পর্কে লিখেছেন ‘আমি বন্ধুবরের কাছে গিয়া এ ব্যাপার হইতে নিরস্ত হওয়ার জন্য তাঁকে বারবার অনুরোধ করি, হাসিতে হাসিতে দ্বিজেন্দ্রলাল বলিলেন ‘ওহে আগে অভিনয়টা দেখ, তারপরই না হয় অত গালাগাল দিও। এখনই অত চটছ কেন? অভিনয় দেখিতে দেখিতে আমার এত দুঃখ ও বিরক্তি বোধ হইতে লাগিল যে, আমি তখন বিশেষ করিয়া বারংবার অভিনয়টা বন্ধ করাইয়া দিবার জন্য দ্বিজেন্দ্রলালকে বলিয়াছিলাম, যতক্ষণ অভিনয় চলিয়াছিল এবং যখন সব শেষ হইয়া গেল তখনও। দ্বিজেন্দ্রলালের মুখের দিকে আমি যতবারই চাহিলাম দেখিলাম উহা অস্বাভাবিক বিকৃত ও বিবর্ণ হইয়া পড়িয়াছে, বোধ হইল, যেন তৎকালে তাঁহার অন্তরে দারুণ অনুশোচনার উদয় হইতেছে। দেবকুমার আরও লিখছেন দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁকে বলেছেন, ‘সত্যি এটা আমার অত্যন্ত ভুল হয়ে গেছে। আমি আর এমন কাজ করব না। সেই থেকে, বলব কী তোমায়, আমার ভিতরটা জ্বলছে।’
দ্বিজেন্দ্রলালের এই রুচিহীন কাজের জন্য তাঁর বেশ অপযশ হয়। এমনকী দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনীকারও এর জন্য তাঁকে নিন্দে করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের ছেলে দিলীপকুমার যাঁকে রবীন্দ্রনাথ খুবই স্নেহ করতেন, তিনিও বাবার এই কাজকে সমর্থন করতে পারেননি পরবর্তী কালে। দ্বিজেন্দ্রলাল যিনি এক এক সময় রবীন্দ্রনাথকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি বলে মেনে নিয়েছেন, আবার তাঁরই ওপর বার বার কেন এমন আঘাত হানতে উদ্যত হয়েছেন, তা যেন এক মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার মতন। ‘আনন্দ বিদায়’-এর পর দ্বিজেন্দ্রলাল সম্ভবত অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তিনি খুব বিমর্ষ হয়ে থাকতেন। যদিও লিখিত ভাবে কিছু জানাননি। এই ঘটনার মাত্র এক বছর পরেই এই শক্তিশালী নাট্যকার ও সঙ্গীতস্রষ্টার অকালপ্রয়াণ ঘটে। এখানে একটা অত্যন্ত কৌতূহলজনক ঘটনারও উল্লেখ করা যেতে পারে। দ্বিজেন্দ্রলালের মাথায় নাকি বাজ পড়েছিল একদিন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন যে, দ্বিজেন্দ্রলাল একদিন রবীন্দ্রনাথের প্রতি একটি চিঠি লেখায় ব্যস্ত ছিলেন, একটু পরেই তাঁর মাথায় বজ্রাঘাত হয়। স্ত্রীলোকেরা তাঁর মাথায় ঘড়া ঘড়া জল ঢালতে থাকেন, তাতে সব কাগজপত্র ভিজে যায়। একটি চিঠিতে শুধু রবীন্দ্রনাথের নামটি পড়া যাচ্ছিল। তাতেই অনুমান করা যায় যে, দ্বিজেন্দ্রলাল সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সব বিবাদ মিটিয়ে আবার পুনর্মিলনের আশাই ব্যক্ত করেছিলেন।
এত দিন পর আমরা এই সব ঘটনাকেই ইতিহাসের অন্তর্গত করে দিয়ে দু’জনেরই গুণমুগ্ধ হতে পারি। রবীন্দ্রনাথের এত বড় প্রতিভার পাশেও কী অনবদ্য সব গান সৃষ্টি করে গেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল। তাতে তাঁর নিজস্বতা স্পষ্ট। তাঁর ‘সাজাহান’ নাটক তো আজও অভিনীত হয়।
যৌবন বয়সে যখন দু’জনের মধ্যে খুবই সৌহার্দ্য ছিল, তখন দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর কোনও পরিচিত ব্যক্তির জন্য চাকরির উমেদারি করে একটি কৌতুকপূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন। তখনকার দিনে অনেক এ ধরনের চিঠিই কবিতায় লেখা হত। চিঠিটি এ রকম –
‘‘শুনছি নাকি মশায়ের কাছে
অনেক চাকরি খালি আছে
দশ-বিশ টাকা মাত্র মাইনে
দু’একটা কি আমরা পাইনে?
ইন্দ্রভূষণ সান্যাল নাম
আগ্রাকুন্তা গ্রাম ধাম
চাপড়া গ্রামের অপর পাড়ে
এক্কেবারে নদীর ধারে।
নাইবা থাকুক টাকা কৌড়ি
চেহারাটা লম্বা চৌড়ি
কুলীন ব্রাহ্মণ, মোটা পৈতে
ইংরাজিটাও পারেন কৈতে …’’
সম্পর্কের এতটা ফাটল, তবুও অন্তরে দুই কবির যে মহামিলন ছিল একটি ঘটনায় তা প্রমাণিত হয়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে দ্বিজেন্দ্রলাল বলেছিলেন – আমাদের দেশ, আমাদের সরকার যদি সত্যকার সমঝদার হত, তবে রবীন্দ্রনাথকে তারা নাইট উপাধি দিত। ‘আমাদের শাসনকর্তারা যদি বঙ্গ সাহিত্যের আদর জানিতেন তাহা হইলে রবীন্দ্রনাথ আজ নাইট উপাধিতে ভূষিত হইতেন।’ এই লেখাটি লেখবার পরে যদি তিনি তিনটি মাসও জীবিত থাকতেন তা হলে দেখতে পেতেন রবীন্দ্রনাথের জয় ঘোষণায় বিশ্বলোক মুখরিত হয়েছে। তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের উক্তি সার্থক হয়েছিল।
আর দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের উক্তি ছিল – ‘সাময়িক পত্রে যে সকল সাময়িক আবর্জনা জমা হয়, তাহা সাহিত্যের চিরসাময়িক উৎসব সভার সামগ্রী নহে। দ্বিজেন্দ্রলালের সম্বন্ধে আমার যে পরিচয় স্মরণ করিয়া রাখিবার যোগ্য তাহা এই যে আমি অন্তরের সহিত তাঁহার প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করিয়াছি। আর যা ঘটিয়াছে তাহা মায়া মাত্র।’
(তথ্যসূত্র:
১- দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: অপ্রচলিত, বিতর্কিত ও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রচনা-সংকলন, শ্যামল মৈত্র, একুশ শতক।
২- দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: স্মরণ বিস্মরণ, সুধীর চক্রবর্তী, এম. সি সরকার এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড (২০০৮)।
৩- The Music of Nationhood: Dwijendralal Roy of Bengal, Sarvani Gooptu, Primus Books (২০১৮)।
৪- দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পূর্বাপর পরম্পরা: দিলীপকুমার রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়; বাবু রহমান সম্পাদিত, শোভা প্রকাশ।
৫- স্মৃতিচারণ, দিলীপকুমার রায়, আনন্দ পাবলিশার্স।
৬- সুভাষিত রবীন্দ্রনাথ, দিলীপকুমার রায়, এন. ই. পাবলিশার্স।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত