ওই যে নীল প্রোটেকশন সুট পরে লোকটাকে দেখছেন, ভারতের পরিকাঠামোর নিরিখে যা যা পাচ্ছেন, তাই পরে রোগী দেখছেন, ওনার বয়স ৬৪ বছর। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে করোনা অতিমারীর ডে বা নাইট ডিউটি করছেন যে ডাক্তারেরা, তাদের একজন। ডাক্তার আশীষ দত্ত। যে বয়সের লোকেদের সাধারণত বাড়ি থাকতে বলা হচ্ছে কারণ তাদের সংক্রমণ ও কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়ার চান্স সবচেয়ে বেশী, সেই বয়সীই ডাক্তার দত্ত। জীবাণুর কেন্দ্রবিন্দুতে বসে রোজ লড়াই করছেন৷ এরপর বাড়ি ফিরবেন। ভাগ্যিস ভাড়াবাড়ি না, বাড়ির মালিক বলছে না চলে যেতে, ডাক্তার দত্তদের থেকে সংক্রমণের ভয় থাকে নাকি, আপনারা ভাবছেন। পারলে আপনারা এই স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রায় অগ্নিস্নাত করে ঘরে তুলতে চান, তারপর তাদেরই জন্য থালা বাজান। তোমার সুযোগ আছে তোমার জ্যেঠুকে বাড়ি থাকতে বলতে, আমার নেই।
সবুজ প্রোটেকশন সুট পরে যে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, সে ও ডাক্তার। ৬১বছর বয়স। চার বছর পরে রিটায়ারমেন্ট। মুর্শিদাবাদ জেলার এক প্রত্যন্ত এলাকায় রোজ সরকারি হাসপাতালে রোগী দেখছেন। সৌদি, দুবাই, কুয়েত থেকে শ্রমিকেরা ঘরে ফিরেছে। ভীড় করে তারা পরিক্ষা করাতে চায়। এর সাথে সাথে অন্য রোগীও তো আছে। প্রসূতি মায়েদের বা ডায়েবিটিস রোগীদের এসময় তো অসুখের লকডাউন হবে না৷ ওগুলো ও দেখতে হবে। ঠান্ডা মাথায় সব্বাইকে বোঝাতে হবে। একটু মাথা গরম করেছো কি ভিডিও ভাইরাল হবে, তারপর জনতার বিচারসভা বসবে! এই ভদ্রলোকের ও বাড়িতে স্ত্রী, অশীতিপর মা, ছেলেমেয়ে আছে৷ চিন্তার তো লকডাউন হয় না। ডাক্তার, পুলিশ, দমকলবাহিনীর বাড়ির লোক ও আর পাঁচটা পরিবারের মতো চিন্তা করে, বাড়ি না ফেরা অবধি ফোন করে ঘন ঘন, কয়েক সেকেন্ডের কথা বলেই রেখে দেয় কারণ বেশীরভাগ সময়ই অন ডিউটি প্রবল প্রেশার থাকে৷ উৎকন্ঠার লকডাউন হয় না। এই ডাক্তারেরা ও জানে যে কোন সময় অসুস্থ হয়ে যেতে পারে এরা High risk diameter এ কাজ করতে করতে। প্রথম বিশ্বের ডাক্তারেরা ও Hazmat suit, lazer helmet, গ্লাভস আর N95 মাস্ক নিয়ে হচ্ছে। এদের বাড়ির লোক এদের বলতে পারে না, বাড়ি থাকো, কোথাও বেরোবে না। আমি ও এই ডাক্তারটিকে বলতে পারছি না। ঘটনাচক্রে এই ৬১বছরের মানুষটির পুত্র আমি। আমি বাড়িতে খিল এঁটে বসে থাকতে বলতে পারছি না, অন্যান্য রোগ আছে জানার পরে ও। ২১দিনের এই লড়াই এ Avengers তো এরাই। ক্যাপ্টেন আমেরিকা বা আয়রন ম্যানকে End Game এ বাড়ি বসে চিপস আর কোলা খেতে খেতে সিরিয়াল দেখতে বলা সাজে!
তোমার সুযোগ আছে, আমার সুযোগ নেই। পুলিশের বউ, রেশন ডিলার বা বিদ্যুৎ দপ্তরে কাজ করে যে লোকটি তার মেয়ের সুযোগ নেই, জরুরি পরিষেবার সাথে যুক্ত প্রায় সিনিয়র সিটিজেন হতে চলেছে বা হচ্ছে যারা তাদের পরিবারের লোকের সুযোগ নেই, কিন্তু আপনার তো আছে। আপনার ষাটোর্ধ বরকে বা বাবাকে বা জেঠু কাকাকে প্লিজ বোঝান বাড়ির বাইরে এক পা না ফেলতে। চায়ের দোকানে না, বাজারে না, দোরগোড়ায় রোয়াকে বিকেলের আড্ডা না। আমাদের রাজ্যে যে মানুষটি মারা গেলেন, তার বয়স ছিল ৫৯। প্লিজ পোস্ট রিটায়ার্ড লাইফটা এবার ঘরে বসে কাটাতে বলুন। ২১দিন। তারপর আবার লাফিং ক্লাব, দৌড় ঝাপ, চায়ের দোকান, বাজারের দরদাম চলুক।
কিচ্ছুটি না করে ও যুদ্ধে অংশীদার হওয়া, আরামকেদারায় বসে পা নাচাতে নাচাতে সুমন দে বা শ্রীময়ী, জবাকে দেখা বা পছন্দের বইটি পড়া বা অষ্টাদশীর মতো টানা ফেসবুক, ইউটিউব করা, টাইমে টাইমে খাবার, হালকা ঝিমিয়ে নেওয়া – আঃ এরই তো নাম কোয়ারেন্টাইন্ড জীবন কালীদা!
আপনার হাতে সুযোগ আছে সংক্রমণ থামানোর। প্লিজ আপনার বাবা জরুরি পরিষেবার সাথে যুক্ত না থাকলে বাড়িতে থাকতে বলো। আমার বাবা কে ২১দিন পর বাড়ি ফেরার সুযোগটা প্লিজ করে দিন ।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত