হাঁটা-পথে বাড়ি দশ মিনিটও নয়। ছ’দিন আগে প্রাণ বাঁচাতে মহল্লা থেকে বৌ-ছেলে নিয়ে পালিয়ে সরকারি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন উত্তর দিনাজপুরের মহম্মদ আজাদ। বাড়ির কী হাল, প্রাণের ভয়ে এখনও দেখতে যেতে পারেননি। ‘‘কখন কে মেরে দেবে, কে বলতে পারে!’’ হিংসার পরে যখন শান্ত হচ্ছে দিল্লী তখনও চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এরকমই আতঙ্কের চিত্র।
বছর ১৫ আগে পেটের টানে ঘর ছেড়ে দিল্লী পৌঁছেছিলেন ইটাহারের বাসিন্দা মহম্মদ আজাদ। উত্তর-পূর্ব দিল্লীর পুরনো গড়হি মেন্ডু গ্রামে থাকতে শুরু করেন। স্ত্রী-সন্তানও পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গেই থাকতেন। সম্প্রতি একদিন আজান চলাকালীন মসজিদে হামলা চলে। এলোপাথাড়ি ইট, পাথর ছোঁড়ে একদল। তখনই কোনওরকমে স্ত্রী-ছেলের হাত ধরে ভাড়াবাড়ি ছেড়ে শ্রীরাম কলোনি এলাকায় আশ্রয় নেন আজাদ। সেখানে ৩ বেলা খাবার আসছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে। ছেলের দুশ্চিন্তায় ঘুম উড়েছে আজাদের পরিবারের। গলার স্বরটুকু শুনতে গোয়ালপোখর থেকে বারবার ছেলেকে ফোন করছেন আজাদের মা। প্রতিমুহূর্তে ভয় তাড়া করছে তাঁকে।
গোয়ালপোখরের ঠাকুরতোলা গ্রাম থেকে ছেলের দুশ্চিন্তায় আম্মি বার বার ফোন করছেন। আজাদ বলেন, ‘‘আম্মি বাড়ির কী হাল, জানতে চাইছে। আমি তো নিজেই জানি না, কী অবস্থা। হিন্দুদের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। তাই ঘরে আগুন লাগায়নি। কিন্তু ওখানেই দর্জির কারখানা ছিল। সব লুট করে নিয়েছে শুনেছি। কত লোকসান হয়েছে জানি না।’’ বলতে বলতেই যেন আতঙ্ক ঘিরে ধরে আজাদকে। ছোট ছেলেকে জল খাইয়ে কোলে তুলে নেন।
আজাদের সঙ্গে এই শিবিরেই মাথা গুঁজেছে আব্দুল সাত্তারের পরিবার। আব্দুল ও তাঁর ছেলেরা করোল বাগে আসবাবের দোকানে কাজ করেন। ছোট মেয়ে আলিশার পরীক্ষা চলছে। আলিশার বৌদি আজরা বললেন, ‘‘মেয়েটার সব বই-খাতা পুড়ে ছাই। যেটুকু মনে আছে, লিখে আসছে। ওর মাধ্যমিকের মার্কশিট, সার্টিফিকেট পুড়ে গিয়েছে।’’
একই পরিণতি হয়েছে দিল্লীবাসী উত্তর দিনাজপুরের বহু বাসিন্দার। গোয়ালপোখর ছেড়ে জীবিকার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দিল্লীতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকলেও বর্তমানে আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই হয়েছে মহম্মদ আনিফ, আবদুল সাত্তারের। কারণ, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কারও বাড়ি। কোথাও আবার ভাঙচুর চালানো হয়েছে। কতদিনে শান্ত হবে দিল্লি, সেই অপেক্ষাতেই আবদুল সাত্তার, মহম্মদ আজাদের মতো বহু শ্রমিক।