আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনীতিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার বুলি আউড়িয়ে দেশবাসীকে যে স্বপ্নের ফানুসে চড়িয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, এক বছর পেরনোর আগেই যে তা ফুটো হয়ে গিয়েছে, সে কথা স্পষ্ট। কারণ প্রায় রোজদিনই তলানিতে নামার নতুন নতুন রেকর্ড করে চলেছে দেশের অর্থনীতি। এই আবহেই বাজেট পেশ করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। কিন্তু চলতি বছরের বাজেটে অন্তত দেশবাসীকে ‘আনন্দ’ দেওয়ার বদলে ‘হতাশ’ই বেশি করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, দাবি বাজার সমীক্ষা এবং পরামর্শদাতা সংস্থা ক্যান্টার ফরোলের।
ক্রেতা চাহিদার অভাব এবং নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল ক্ষেত্রের আর্থিক সঙ্কটের কারণেই ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধি চলতি অর্থবর্ষে তেমন তেজি হবে না বলে সম্প্রতি তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল আইএমএফ। দেশের অর্থনীতির এই বিবর্ণ ছবির ছায়া দেখা গিয়েছিল প্রাথমিক ক্রেতা মনোভাব সূচকেও। বাজার সমীক্ষা সংস্থা ইপসোস ও থমসন-রয়টার্সের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত জানুয়ারি মাসের সূচকে দেখা যাচ্ছে, আগের মাসের তুলনায় দেশের ক্রেতাদের মধ্যে হতাশা ৭.৩ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট বেড়েছে।
এমন একটি অবস্থায় দেশের মানুষের মনে ‘ম্যাজিকের’ কাজ করতে পারত ২০২০-২১ অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেট- দাবি ক্যান্টার ফরোলের। কিন্তু তা দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশবাসীর আস্থা ফেরৎ আনার সোনার সুযোগ নষ্ট করেছে কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে এমনটাই জানানো হয়েছে। যে বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে আইএমএফ মুখপাত্র গ্যারি রাইসের কথাতেও।
রাইসের দাবি, ‘যে যে ক্ষেত্রে প্রয়োজন রয়েছে, সেইসব ক্ষেত্রগুলিতে চলতি বাজেটে নির্দিষ্ট প্রস্তাব করা হলেও, দেশবাসীর আস্থা অর্জনে কেন্দ্র সরকারের উচিৎ ছিল আরও উচ্চাকাঙ্খী ভাবে পরিকাঠামো এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারি পদক্ষেপ করা। কিন্তু তা না করে সাবধানী পদক্ষেপ করায়, ভারতের অর্থনীতি অদূর ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াবে, এমন ভাবাটা শক্ত।’
ক্যান্টার ফরোলের সমীক্ষকদের দাবি, তাদের রিপোর্টের স্যাম্পল সাইজের অর্ধেকের বেশি মানুষই জানিয়েছেন, গত ১২ মাসে তাদের আর্থিক পরিস্থিতি আগের থেকে খারাপ হয়েছে। যে সংখ্যাটা গত বছরের সমীক্ষায় প্রাপ্ত সংখ্যার দু’গুণেরও বেশি। রিপোর্টে আরও জানানো হয়েছে, সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৪৮ শতাংশ গৃহবধূ এবং ৫৩ শতাংশ পরিবারের মূখ্য রোজগেরে ব্যক্তি তাদের জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
ক্যান্টার ফারোল দেশের মানুষের সামাজিক অবস্থান ও ক্রেতা-মনোভাব সূচক প্রকাশ করে থাকে। চলতি বছরের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, আগে ভারতে যখন অর্থনীতিতে ভাটার টান এসেছে, তখন শহরের ক্রেতারা গ্রামাঞ্চলের ক্রেতাদের তুলনায় বেশি ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছিলেন। কিন্তু চলতি বছরে সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, এ বার ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টে গিয়েছে।
তবে শুধু গ্রাম বা শহরের মানুষের মধ্যে ভাগ না করে সামগ্রিক ভাবে ক্রেতা মনোভাব বিচার করলে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে সার্বিক ভাবে ৩ গুণ বেশি মানুষ সাম্প্রতিক আর্থিক পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছেন। কোন ক্ষেত্রে কার হতাশা বেশি, সেটাও খতিয়ে দেখেছেন ক্যান্টার ফরোলের সমীক্ষকদল। তাদের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, টিয়ার-১ শহরে মানুষের মনে, প্রত্যক্ষ করে ছাড় না বাড়ানো, খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি কমানো এবং কেন্দ্রের আগে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলি শেষ না করাতেই ‘ক্ষোভ’ সবথেকে বেশি।
অন্য দিকে, টিয়ার-২/৩ শহরের বাসিন্দারা কর্মসংস্থান বাড়ানোয় কেন্দ্রের তরফে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ না করা এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বরাদ্দ প্রত্যাশামতো না বাড়ানোয় বেশি হতাশ হয়েছেন। যার ফলে, সার্বিক ভাবে বাড়ি-গাড়ি-দামি আসবাবের মতো বড় অঙ্কের কেনাকাটা এবং বেড়াতে যাওয়া-বাইরে খাওয়ার মতো খরচ আপাতত বেশ কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে দিয়েছেন।