ধর্মের ভাঁওতা আর নয় উন্নয়নের নিরিখেই দ্বিতীয় বিকল্পকে বেছে নিল রাজধানীর জনগণ। তৃতীয়বারের জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসবেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আসন সংখ্যা সামান্য কমলেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসছে আম আদমি পার্টি (আপ)। বিজেপির আসন বাড়লেও এ বারও ধর্মীয় মেরুকরণ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-এর ধাক্কায় এ বারও দিল্লির মসনদ অধরাই থেকে গেল বিজেপির কাছে। কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল কংগ্রেস।
বুথ ফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত ছিলই। সকালে ইভিএম খোলা শুরু হতেই দিকে দিকে আপের জয়জয়কার। গণনার যা প্রবণতা তাতে ৫৫টির কাছাকাছি আসন পেয়ে দিল্লিতে ফের ক্ষমতায় আসতে চলেছে আপ। বিজেপি পেতে পারে কম-বেশি ১৫টি আসন। ভরাডুবির মধ্যে বিজেপির কাছে একমাত্র সান্ত্বনা, গত বারের চেয়ে আসন বাড়ানো। হারের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ হতে পারে বর্তমান উপ-মুখ্যমন্ত্রী তথা শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়া হারলে। গণনার গোড়া থেকেই তিনি বিজেপি প্রার্থীর কাছে পিছিয়ে রয়েছেন।
কিন্তু কী এমন ম্যাজিক দেখিয়েছেন কেজরিওয়াল? প্রথম বার ৪৫ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কেজরিওয়াল কার্যত বোকামিই করেছিলেন বলে অনেকেই কটাক্ষ করেছিলেন সে সময়। কিন্তু সেটা যে লম্বা দৌড়ের প্রস্তুতি ছিল, তা বোঝা গিয়েছে গত পাঁচ বছরে কেজরিওয়ালের উন্নয়নের রাজনীতিতে। দিল্লিবাসীর জন্য বিদ্যুতের বিল প্রায় মকুব করে দেওয়া, মহিলাদের জন্য বিনামূল্য বাসযাত্রা, বিনা পয়সায় ২০ লিটার পর্যন্ত জল দেওয়ার মতো জনমুখী প্রকল্পের উপর আস্থা রেখেছেন দিল্লিবাসী। তার সঙ্গে ছিল প্রায় দুর্নীতিহীন সরকার উপহার দেওয়া।
অথচ কয়েক মাস আগের লোকসভা ভোটেও ভরাডুবি হয়েছিল আপের। দিল্লির সাতটি আসনের একটিতেও জিততে পারেনি আপ। সব কটি আসন ঝুলিতে পুরেছিল বিজেপি। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিধানসভা নির্বাচনে যে ভাবে আপ ফের ক্ষমতায় ফিরল, তার কৃতিত্ব একমাত্র উন্নয়নের রাজনীতি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তার সঙ্গে সিএএ, এনআরসি নিয়ে বিজেপির একগুঁয়েমি, শাহিন বাগ, জেএনইউ-তে হামলার মতো ঘটনাও দিল্লির ভোটে প্রভাব ফেলেছে বলেই মত পর্যবেক্ষকদের।
কিন্তু কেজরিওয়ালের যাত্রা এতটা কুসুমাস্তীর্ণ। এমনকী, ঘনিষ্ঠ মহলে কেজরিওয়াল স্বীকার করেছেন, সরাসরি রাজনীতিতে আসার কথা কেরিয়ারের শুরুতে কখনওই ভাবেননি। কিন্তু ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের নিশ্চিন্ত সরকারি চাকরি ছাড়ার পর থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে ভাবে ঘটনা প্রবাহ এগিয়েছে, তাতে ধীরে ধীরে রাজনীতির গণ্ডিতে কার্যত নিজের অজান্তেই পা দিয়ে ফেলেছিলেন খড়গপুর আইআইটির প্রাক্তনী কেজরিওয়াল।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, কেজরিওয়ালের অজান্তেই সেই পথের সূচনা হয়েছিল ২০১১ সালে সমাজকর্মী আন্না হজারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে টানা অনশন-ধর্না আন্দোলন। লোকপাল বিলের দাবিতে যে ভাবে দিনের পর দিন অনশন ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন করেছিলেন কেজরিওয়াল, তাতে তাঁর মধ্যে এক নতুন নেতার স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলেন দেশবাসী। সেই ‘মাফলার ম্যান’ কেজরিওয়ালের হাত ধরেই দেশবাসী স্বপ্ন দেখেছিলেন এক নতুন ভারতের। এক দুর্নীতিমুক্ত ভারতের।