তারকারা বরাবরই পছন্দ করেন বড় মঞ্চে জ্বলে উঠতে। আর সেই কারণেই হয়তো রবিবারের চিন্নাস্বামীকে বেছে নিয়েছিলেন রোহিত শর্মা। প্রথম দু’টি ম্যাচে নামের প্রতি সেভাবে সুবিচার করতে পারেননি ‘হিটম্যান’। নিন্দুকেরা অনেক কথা বলছিলেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজের নির্ণায়ক ম্যাচে দুরন্ত শতরান হাঁকিয়ে নায়ক সেই রোহিতই। দুরন্ত ৮৯ রানের ইনিংস উপহার দিলেন বিরাট কোহলিও। পেলেন সিরিজের সেরা পুরস্কার। রোহিত-বিরাটের যুগলবন্দিতে অস্ট্রেলিয়াকে তৃতীয় ম্যাচে ৭ উইকেটে দুরমুশ করে ‘টিম ইন্ডিয়া’ ২-১ ব্যবধানে সিরিজে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করল।
আসলে বেঙ্গালুরুতে রাতটাই ছিল ওলটপালট করে দেওয়ার রাত। না হলে টসে জিতে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলেন! দেখে মনে হল, ফয়সালার ম্যাচে, স্নায়ুর লড়াইয়ের ম্যাচে রান তাড়া করার ঝক্কি নিতে চাইছেন না। আগে থেকেই কেমন যেন মিইয়ে থাকার মতো। রাতের দিকে যে শিশির পড়তে পারে, সেই কথাটাও কি ভুলে গেলেন ফিঞ্চ? শোনা গেল, দল প্র্যাক্টিস না করলেও অস্ট্রেলীয় ম্যানেজমেন্টের সদস্যরা নাকি শনিবার রাতে চিন্নাস্বামী অভিযানে এসেছিলেন, শিশির কেমন পড়ে তা দেখতে। তা দেখে তাঁদের মনে হয়েছে, শিশির কোনও প্রভাব ফেলবে না। যাই হোক চেজমাস্টারকে তাঁর আইপিএল ‘হোমে’ কেউ রান তাড়া করার সুযোগ করে দেয়? টসের পরেই দেখা গেল, কোহালির মুখে তখনই এক গাল হাসি।
অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস যখন থিতু হওয়ার দিকে এগোচ্ছে, ফিঞ্চ রান আউট হলেন স্টিভ স্মিথের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে। তখন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ককে এতটাই ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল, ইনিংস শেষে ড্রেসিংরুমে না গৃহযুদ্ধ বেধে যায়! স্মিথ সেখান থেকে লাবুশেনকে সঙ্গে নিয়ে ইনিংস গড়তে থাকলেন। সাধকের মতো তিনি যা করে যান। ১৩২ বলে ১৩১ করলেন তিনি। ধোনির কায়দায় হেলিকপ্টার শটে ছক্কা মারলেন। কিন্তু শেষ দশ ওভারে ২১ বলে ৩৬ রানের বেশি করতে দিলেন না ভারতীয় বোলাররা। এর পরে অস্ট্রেলীয় শিবিরে জোর আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল এবং মার্কাস স্টোয়নিস, দুই সেরা অলরাউন্ডারকে দেশে রেখে কেন খেলতে এসেছ তোমরা?
সাত উইকেটে জয়ের জন্য অবশ্য সবার আগে জয়ধ্বনি দেওয়া উচিত বোলারদের নামে। স্লগ ওভারে বুমরা এবং শামি যে রকম বোলিং করে গেলেন, তাতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার। ৪৩তম ওভারে বুমরা দিলেন মাত্র ১ রান। সব মিলিয়ে দশ ওভারে দিলেন মাত্র ৩৮। অন্য দিকে শামি নতুন, পুরনো সব রকম বলেই উইকেট নিয়ে গেলেন। চতুর্থ ওভারে যে বলে তিনি ওয়ার্নারকে তুললেন, যে কোনও ফাস্ট বোলারের স্বপ্নের ডেলিভারি। বাঁ-হাতি ওয়ার্নারের দিকে প্রথমে হাওয়ায় সুইং করে ভিতরের দিকে আসছিল। পিচে পড়ার পরে কাট করে বাইরের দিকে গেল। ওয়াংখেড়েতে ওয়ার্নার মারছিলেন, শামি অসহায় ভাবে দেখছিলেন। এখানে শামির জাদুর সামনে ওয়ার্নার সম্মোহিত ভাবে ব্যাট বাড়িয়ে দিলেন। স্লগ ওভারে তাঁর এবং বুমরার ইয়র্কার বৃষ্টি মনে করিয়ে দিচ্ছিল ওয়াসিম আক্রম-ওয়াকার ইউনিস জুটিকে। তখন পাকিস্তানের হাতে ফাস্ট বোলার ছিল, ইয়র্কার ছিল। রিভার্স সুইং ছিল। এখন ভারতের হাতে সে সব অস্ত্রই এসে গিয়েছে।
২৮৭ রানের টার্গেট তাড়া করতে ওপেনিং জুটিতে রোহিতের সঙ্গী হন লোকেশ রাহুল। গত তিনটি ম্যাচে লোকেশ তিনটি পজিশনে ব্যাট করে সফল হয়েছিলেন। এদিন অবশ্য ১৯ রানেই তাঁকে থামতে হয়। ভুলের পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামেন বিরাট কোহলি। দ্বিতীয় উইকেটে রোহিত-কোহলি জুটি ১৩৭ রান যোগ করে দলের জয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেন। ১১০ বলে শতরান পূর্ণ করার সঙ্গে ওয়ান ডে ফরম্যাটে ৯ হাজার রানের মাইলস্টোনও স্পর্শ করেন ‘হিটম্যান’। ওয়ান ডে ফরম্যাটে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ২১৭টি ইনিংসে এই নজির গড়লেন রোহিত। ভেঙে দিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি, শচীন তেন্ডুলকরের রেকর্ড। এই তালিকায় শীর্ষে আছেন বিরাট। ১৯৪ ইনিংস খেলে তিনি ওয়ান ডে’তে ন’হাজার রান পূর্ণ করেছিলেন।
রোহিত শর্মা ব্যাট করার সময়েও বার বার এমন শটের ফুলঝুরি দেখা গেল। ১২৮ বলে ১১৯। আটটা চার, ছ’টি ছক্কা। স্টিভ স্মিথের লড়াইকে টেক্কা দিয়ে সিরিজ নিশ্চিত করে দিল রোহিতের ব্যাট। ফের সেই বেঙ্গালুরু এবং ফের সফল হিটম্যান।
যদিও অজিরা মোটামুটি ভাবে তাদের সেরা দলই নিয়ে এসেছিল। ওয়ার্নার, ফিঞ্চ, স্মিথ রয়েছেন। দুর্ধর্ষ বোলিং আক্রমণ রয়েছে। আর কী চাই? কিন্তু ওই যে বেঙ্গালুরুতে রাতটাই আসলে শামিদের প্রত্যাঘাতের রাত ছিল