তিনি ছিলেন ছবির কথক। যেমন ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ । কোন ঠাকুর? অবন ঠাকুর… যে ছবি লেখে? তেমনই বোধ হয়, কোন তপন… যে গল্প দেখায়? তরুণ মজুমদার বলেছিলেন, যখন ত্রিমূর্তি অর্থাৎ, সত্যজিৎ, মৃণাল ও ঋত্বিক পূর্ণ শক্তিতে সৃজনশীল, তখনও রোদের মধ্যে, বৃষ্টির মধ্যে, হলের বাইরে কাতার দিয়ে দর্শক দাঁড়িয়ে থাকতেন তপন সিংহের ছবি দেখতে। এই দর্শকরাই কিন্তু ঐ ত্রিমূর্তির কোর দর্শক মন্ডলী। কিন্তু তাঁদের বৃহৎ অংশ ত্রিমূর্তিকে অবিমিশ্র শ্রদ্ধাশীলতায় গ্রহণ করেছেন মেধার মঞ্চে। তপন সিংহের জন্য আলাদা করে হয়তো হৃদয়ের কোনও একটা কোণ সংরক্ষিত থেকে গিয়েছিলো। মানুষের চিরকালীন আবদার ‘গল্প ভালো আবার বলো’। সমস্ত ফলিত শিল্প তো গল্পই বলে। এমনকি গল্পহীন যে প্রতিগল্প, তারো তো গল্প লাগে, নয়তো সে স্রোতের বিপরীতে যাবে কী করে?
ঊনিশ শো পঞ্চাশে পশ্চিমে গিয়ে ছবির কারিগরী কুশলতার সব পাঠ নিয়ে ছিলেন তিনি। নিও রিয়ালিস্টদের কাছ থেকে ছবি করতে দেখেছেন তিনি। প্রিয় ছবিকর, বিলি ওয়াইল্ডার, জন ফোর্ড, ক্যারল রীড বা ফ্র্যাংক কাপরা। ছোটবেলায় ভাগলপুরে হলে বসে দেখা রনাল্ড কোলম্যানের আ টেল অফ ট্যু সিটিজ, তাঁর কাছে চিরকাল ছবি তৈরির আদর্শ প্রতিবিম্ব হয়ে থেকে গেছে। অথচ সবার উপরে তাঁর চিত্তাকাশ আবৃত ছিলো রবীন্দ্রনাথ নামে এক সৃষ্টিপর মূল্যবোধে, যা তিনি আজীবন কারণে অকারণে বারম্বার উচ্চারণ করে গেছেন। এজন্যই হয়তো বিংশ শতকের বাঙালির মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ও পরিপ্রেক্ষিতকে তিনি অতো সহজে ছবিতে নিয়ে আসতে পারতেন। তা বলে তাঁর সৃষ্টিশীলতা সীমাবদ্ধ ছিলো, একথা তাঁর অতি বড়ো শত্রুও বলতে পারবে না। ভাবা যায় ১৯৫৫ র আগে ১৯৫৪তে ছবি করলেন অঙ্কুশ, একটি হাতি যার নায়ক। কিন্তু তারও একটি গল্প আছে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের। আমার বিচারে বিষয়বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তাঁর তুলনা তিনি নিজে। অন্তত এই ডিপার্টমেন্টে সত্যজিৎও তাঁর থেকে ঈষৎ পিছনে। যদিও সে বিষয়ে হয়তো কেউ কেউ অন্যমতও হবেন। যাঁরা চলচ্চিত্রের আপোসহীন ভিজ্যুয়াল শুদ্ধতায় আস্থাধারী, তাঁরা অবশ্যই স্বীকার করবেন না যে এই চলচ্ছবি শুধু গল্প পৌঁছে দেবার মাধ্যম। সেটা অবশ্যস্বীকার্যও বটে। কিন্তু প্রাচ্যের আবহমান সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে এপিক মাত্রার প্রভাব এতো বেশি যে সব ধরণের কলামাধ্যমই কোনও না কোনও প্রোটাগোনিস্ট কেন্দ্রিক। সে রাম বা গোরা বা সাগিনা মাহাতো, যেই হোকনা কেন। সিনেমার মূল উদ্দেশ্য যদি উপযুক্ত দর্শকের কাছে নিজের বোধকে সঞ্চারিত করার আকাঙ্ক্ষা থেকে আসে, তবে তপন সিংহের সাফল্যকে কেউ খর্ব করতে পারবে না। যতই তাঁকে লিনিয়ার ট্রিটমেন্ট দোষে অভিযুক্ত করা হোকনা কেন।
তপন সিংহ সম্পর্কে বলা হয় তিনি ছিলেন একজন quintessential বাংলা ছবিকর। এই বিশেষণটি প্রয়োগের কারণ এমন নয় যে তাঁর ছবি গ্রাম বাংলা বা তৎকালীন নাগরিক বাঙালির কথাই শুধু বলে। তিনি বাঙালি ছিলেন তাঁর সংবেদনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে ও রবীন্দ্র-সহজাত ন্যায়-অন্যায়বোধে। তাঁর আন্তর্জাতিকতার ভিত্তি ছিলো একজন গড় বাঙালির বিশ্ববীক্ষার মাপদন্ড যা সত্যজিতের থেকে খানিকটা ভিন্ন। ছবির বিষয় বৈচিত্র্যে তিনি অনন্য, আগেই বলেছি, কিন্তু গঠনকৌশল ও সৌন্দর্যবোধের নিরিখে তিনি ক্ল্যাসিসিস্ট। তিনি কেন ছবি করছেন সেই ধারণাটি খুব স্পষ্ট ছিলো তাঁর কাছে। দর্শককে তাঁর যেকথাটি বলার আছে সেটি তিনি এক গল্পের আধারে বলবেন। গল্পটিকে সঠিক মাত্রায় গ্রহণযোগ্য করতে যা যা প্রয়োগকৌশলের আশ্রয় প্রয়োজন, সব নেবেন তিনি সমস্ত উৎস থেকে, কিন্তু চমক লাগানো প্রয়োগকৌশলের মোহকে দূরে সরিয়ে রাখবেন এক সন্ন্যাসীর নির্লিপ্তিতে। একটি নির্মাণ যখন সৃষ্টি হয়ে ওঠে, তখন তার নিবেদন (dedication) ও বিনোদনের (entertainment) কোনও পৃথক মাত্রা (dimension) থাকেনা। একই সঙ্গে একটি ছবি সিরিয়াস ও বিনোদন-উচ্ছল হয়ে উঠতে পারে। একজন প্রকৃত চলচ্চিত্র শিল্পীকে আলাদা করে exploitation আর entertainment এর ছবি করতে হয়না। প্রকৃষ্টতম উদাহরণ চ্যাপলিন। অবশ্যই তপন চ্যাপলিন নন, কিন্তু ঘরানাটি একই। এই জাদুটিই তপনকে এতো জনবরেণ্য শিল্পী করে তুলেছিলো। তিনি গৌতম বুদ্ধ কথিত চিরন্তন ভারতীয় মধ্যপন্থার পথিক।
সংবেদনশীলতায় তিনি দৃঢ়, অশ্রুসজল সেন্টিমেন্টকে বর্জন করেন , আবার প্রতিবাদে তিনি কঠোর, কিন্তু উচ্চকিত স্ট্রীটফাইটার নন। যখন পিরিয়ড ছবি বানাচ্ছেন, তখন তিনি তাঁর প্রিয় ছবিকর কোলম্যানের মডেলটি অনুসরণ করছেন, অনেক বেশি জনপ্রিয় ও উচ্চকিত সিসিল ডি’মেল তাঁর অভীষ্ট নন। ‘ঝিন্দের বন্দী’ বা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ তৈরি করার সময় তিনি জাঁকজমকের চেয়ে বঙ্গীয় sensibilityকেই অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়েচেন। এর সব চেয়ে বড়ো উদাহরণ আমরা দেখি রবি’ছবি বানাবার সময় তাঁর অবস্থান থেকে। সে সব ক্ষেত্রে আমরা দেখি তাঁর ক্যামেরা মূলতঃ কাঁধের উচ্চতায় থাকছে। সেখানে তিনি গল্পটি বলছেন একজন কথক হয়ে এবং দর্শক ভাগ করে নিচ্ছেন কথকের দৃষ্টি। পরিচালক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ভরতের মতো, যে জানে দর্শকের হৃদয়ের সিংহাসনে তিনি নেই, আছে সেই মূল স্রষ্টার পাদুকা। তিনি শুধু তাঁর গুরুর নামে এই ছবিটি তৈরি করেছেন। শিল্পী হিসেবে নিজের সব অহমিকা তিনি ডুবিয়ে দিয়েছেন দর্শককে আরও কাছে পেতে। তাঁর অতি উচ্চকোটীর সৃজনশীলতার ফুলঝুরিকে সংযত করে রেখেছেন যাতে তা সাধারণ দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে না দেয়। তাঁর একান্ত কামনা ছবিটির অধিরাজ যেন রবীন্দ্রনাথই থাকেন, তপন নয়। এই সৃষ্টির আনন্দে পরিচালক ও দর্শক একাত্ম হয়ে পড়েন। এখানেই তাঁর সিদ্ধি। এখানেই তিনি সত্যজিতের থেকে পৃথক হয়ে যান। কারণ সত্যজিতের ‘রবীন্দ্রনাথ’ তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। একান্ত ও ব্যক্তিগত।
যাবতীয় বৈচিত্র্য সত্ত্বেও তাঁর প্রকৃত খেলার মাঠ ছিলো আমাদের চারপাশের জীবন থেকে উঠে আসা ঘটনা-দুর্ঘটনার ভাসমান জলছবিগুলি। জলছবির অনুপ্রেরণা থেকে অজন্তা বা আলতামিরার গুহাচিত্র সৃষ্টি করে ফেলা তাঁর ক্ষমতার রাজপাট । লৌহকপাট, হাটে বাজারে,আরোহী, আপনজন, সাগিনা মাহাতো, রাজা, আদালত ও একটি মেয়ে, আতঙ্ক, এক ডক্টর কি মৌত, অন্তর্ধান, হুইলচেয়ার, সব তো এই সূত্রেই আমরা পেয়েছি। এই প্রসঙ্গে কেউ বুনুয়েলের নাম করে, কিন্তু আমি ডি’সিকার নামও নেবো। এমনকি আমাদের নিজেদের মৃণাল সেনও অবশ্য স্মর্তব্য। একই ঘটনাক্রম যখন বিভিন্ন বড়োমাপের শিল্পী নিজেদের মতন করে ভিজ্যুয়ালাইজ করেন, তা সব ভিন্ন ভিন্ন রাগরাগিণী হয়ে ওঠে। আমাদের মতো ইতর দর্শকদের এটাই বৃহৎ প্রাপ্তি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, যদি বিষয়বৈচিত্র্যের কথা বলা হয়, তবে তপন সিংহের সঙ্গে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের নামই নেওয়া যেতে পারে। তিনি কখনও পুনরাবৃত্তি করেননি। সর্বদা নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন আদ্যন্ত, গভীর মানবতাবাদী। তাই ‘স্টোরিটেলার’ হিসেবে শুরু করেও তিনি একজন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ছবিনির্মাতা হয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি সচেতনভাবেই তাঁরা স্বভাবসিদ্ধ সরলরৈখিক ন্যারেটিভ শৈলিকে চিরকাল আশ্রয় করে থেকেছেন। কোনও ‘আভাঁ-গার্দ’ আঙ্গিককে আমল দেননি। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো সরাসরি দর্শকের হৃদয়ের তন্ত্রীকে স্পর্শ করা। কোনও শৈল্পিক ঘোরা পথে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। একেবারে চলিত নাটকীয় টেকনিকগুলিকে সফলভাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সূক্ষ্ম শিল্পমুহূর্ত তৈরি করে ফেলার সিদ্ধি তাঁর আয়ত্ত ছিলো।
তপন যখন ব্যক্তিমানুষের গভীরতম অনুভূতি থেকে উঠে আসা ছোটো বড়ো তরঙ্গগুলিকে নিয়ে ছবি করেন, সেখানেও কেন্দ্র থেকে পরিধির বৃত্তে দোলাচলিত সূক্ষ্মতম অনুভবগুলিকে অবলীলায় পর্দায় তুলে আনেন নির্জন সৈকতে, জতুগৃহ, এখনই বা শতাব্দীর কন্যায়। মৃণাল সেন ব্যাপারটি খুব গভীর তাৎপর্যের সঙ্গে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তপন সিংহ আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ ‘মধ্যপন্থী’ চিত্রকার। একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি, ” We differed in many ways and I did not agree with him all the time, but that does not mean that I do not consider him one of the finest directors in India. I have also never found a human being as good and as powerful as Tapan Sinha,”
বাংলা ছবির ফ্যান্টাসি শাখার এখনও পর্যন্ত সফলতম স্রষ্টা তপন সিংহ। গল্প হলেও সত্যি, এক যে ছিলো দেশ, বাঞ্ছারামের বাগান, আজব গাঁয়ের আজব কথা, তো এখনও বেঞ্চমার্ক। এর আগে যমালয়ে জীবন্ত মানুষ বা এ জাতীয় দুচারটে ছবি ছাড়া এই শাখায় বাংলা ছবিতে উল্লেখ্য কিছু নেই। সবার শেষে নাম নিচ্ছি আদমি অওর আওরতের। এই ছবিটি পৃথক উল্লেখ দাবি করে। যদিও এটি টেলিছবি, তবু একটি অনন্য সৃষ্টি।
তাঁদের যাবতীয় স্ববিরোধ, মূর্খামির কথা মনে রেখেও বাঙালি সমাজের চালিকাশক্তি যথারীতি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। তাঁদের মানসিক গঠনটি সম্বন্ধে বিনয় ঘোষ মশাই একসময় লিখেছিলেন ‘মেট্রোপলিটান মন, মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ’ নামক সন্দর্ভটি। ইংরেজের নিয়ে আসা সংস্কারমনস্কতার সঙ্গে মধ্যবিত্তের ক্রোমোজোমে প্রকট যে সামন্তবাদিতা, উভয়ের সংঘর্ষের ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত সংস্কারের প্রতিই পক্ষপাত দেখিয়ে থাকেন। উত্তম-সুচিত্রা মাথায় থাকলেও সামন্ততান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে তৈরি করা বাংলা বাজারধন্য ছবিগুলির ঊর্ধে গিয়ে তাঁদের অন্য কোথাও একটা পৌঁছোনোর টান চিরকাল থাকে। তপন সিংহ এই টানটিকে তাঁর সৃষ্টির মূলস্রোত করে তুলেছিলেন। মধ্যবিত্তের মধ্যচিত্তে তোলপাড় সাধ ও সাধ্যের টানাপড়েন, যার নিয়ন্ত্রণ থাকে তাঁদের উদারনৈতিক সংস্কারী প্রবণতাগুলিতে, চিরকাল তপনকে ভাবিয়েছে। তাই সে অর্থে কখনও আপোস না করেও তাঁর ছবি দর্শকের অনাবিল আনুকূল্য লাভ করেছে চিরকাল। নিছক বিনোদন বা মেধাচর্চার মাঝখানে যে বিপুল সিনেমাটিক স্পেস, সেটিকে তিনি খুব সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন। সিনেমা যে শুধুমাত্র মেধাচর্চার আখড়া নয়, তা একটি গণমাধ্যম, সে বিষয়ে তাঁর ধারণাটি খুব স্পষ্ট ছিলো। সিনেমার হিস্ট্রি বইয়ের থেকে মানুষের মগজের মহাফেজখানাটা যে অনেক বড়ো আশ্রয়, তাও তিনি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। এই উপলব্ধিটি তাঁকে কখনও ছেড়ে যায়নি। তাঁকে অনুসরণ করে অন্যান্য বাঙালি পরিচালকদের কাফিলা বহুদিন ধরে এগিয়ে গেছে। সফলও হয়েছে। দর্শকদের ঝুলিও কখনো খালি যায়নি।
তাঁর বাড়ির ঠাকুর তৈরি করতে আসত গোপাল বৈরাগী। তাঁর গোপালদা। গোপালদা গুন গুন করে গান গেয়েই যেত। তাঁর একটা গান ছিল— ‘মুন বলে আমি মুনের কথা জানি না’। বোন গীতাকে নিয়ে তন্ময় হয়ে ঠাকুর গড়া দেখতে দেখতে আর গান শুনতে শুনতে কেমন যেন ঘোর লাগত তখন তাঁর।
অনেক পরে যখন ‘হারমোনিয়াম’ ছবি করছেন তপন সিংহ, কৈশোরের ওই গোপালদার গানটাই ঝেড়েমুছে সিনেমায় লাগিয়েছিলেন। কত যে ছবিতে গান নিজেও লিখেছেন আর সুর দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। তার জন্যও বোধ হয় এই ছেলেবেলাটা দায়ি।
তাঁর বাড়ি বলতে ভাগলপুর। আদি বাস ছিল বীরভূমে। মুরারই স্টেশনের কাছে হিলোরায়। বাবা ত্রিদিবেশচন্দ্র ছিলেন মাঝারি মাপের জমিদার। মা প্রমীলাদেবী লর্ড সিনহার পরিবারের মেয়ে। তপনের জন্মের সময় নাকি লর্ড সিনহা নিজে এসেছিলেন তাঁর মুখ দেখতে।
ছেলেবেলা থেকেই তপন সিংহ দেখেছিলেন বাড়ি গমগম করছে লোকজনে। সে প্রায় জনা চল্লিশেক। মা-ই ছিলেন একমাত্র মহিলা-কর্ত্রী। বাড়ি আঁটোসাটো নিয়মে বাঁধা। দুপুরে বারোটার মধ্যে সক্কলকে খেয়ে নিতে হত। কাজের লোকজন খেত একটার ভেতর। এর পর মা সোজা ওপরে গিয়ে ‘ভারতবর্ষ’, নয় ‘প্রবাসী’ খুলে বসতেন। বেলা আড়াইটে হলেই এসে পড়়ত পোস্টাপিসের ডাক পিওন হরেনদা। তার খাবারও রাখা থাকত। হরেনদা খেয়েদেয়ে চিঠি বিলি করতে ছুটত।
তাঁর বাবার চোখে তাঁর মায়ের ছিল দুটি দোষ। এক, লোকজন ডেকে ডেকে খাওয়ানো। আর দুই, যদি কোনও মেয়ে মাথায় করে মাছ বা সবজি বিক্রি করতে আসত, তার সবটাই কিনে নেওয়া। তাঁর মা বলতেন, একটি মেয়ে মাথায় বোঝা নিয়ে রোদ-বৃষ্টিতে পাঁচগ্রাম ঘুরে বেড়াবে, অসভ্য দেশ হলেই এমনটা হয়। যারা কলেজে পড়ত, তাঁরা গাঁয়ে পুজোয় কী গরমের ছুটিতে এলে তপন সিংহের মা তাঁদের রাজবংশী পড়াতেন নাইটস্কুলে। আবার কারও বাড়িতে উনুনের ধোঁয়া না উঠতে দেখলে তাঁকে ডেকে চাল-ডালও হাতে দিতেন। গরমকালে গাঁ-ঘরে বড্ড গরম লাগত। তাই বিকেল থেকেই বালতি বালতি জল ঢালা হত ছাদে। রাতে লম্বা লম্বা বিছানা করে ছাদেই শোওয়া হত।
বাবাকে কোনও দিন ভেতর-বাড়িতে শুতে দেখেননি তপন। তাঁর বাবার তদারক করতেন ফণিদা আর হাকিমদা। সঙ্গে আরও ক’জন ছিল। তারা ভরা আকাশের নীচে শুয়ে তাঁর মা গান গাইতেন, ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই/নিভে যায় বারে বারে।’ মায়ের কাছেই তপন শিখেছিল ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না।’ রবিঠাকুরের গান।
তাঁর বাবা ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। জমিদারি মেজাজ ছিল বটে কিন্তু তার আড়ালে একটা কাব্যিক মনও লুকোনো ছিল। সেটা তপন বুঝেছিলেন, যখন বাবা তাঁকে নিয়ে সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। বাবা-ই তাঁকে প্রকৃতি চিনতে শেখাতেন। রাতে পাশে শুইয়ে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, ‘মেঘদূত’ শোনাতেন। বাবা ছিলেন গান্ধীবাদী। পনেরো-বিশটা চরকা ছিল বাড়িতে। সারা দুপুর সবাই চরকা কাটত। গান্ধীজি মারা যেতে তাঁর বাবা অশৌচ পালন করেছিলেন।
গোপালদার হাতে প্রতিমার দু-মাটির প্রলেপ লাগলে কলকাতা রওনা দিতেন তাঁর বাবা। জওহরলাল পান্নালাল থেকে বাড়ির সকলের পুজোর জামাকাপড় কিনে তবেই ফিরতেন। তপন সিংহের কথায়, ‘বাবা ফিরলেই মনে হত, পুজো এসে গেল।’
তাঁদের পুকুর ছিল অনেক ক’টা। তার প্রত্যেকটার আবার আলাদা-আলাদা নাম। বাড়ির লাগোয়া পুকুরটার যেমন নাম ছিল ‘রানা’। তার পরেরটার নাম ‘সিদাগড়’। তার পরেরটা ‘ব্রজের পুকুর’। গ্রামের একেবারে শেষ সীমানায় ছিল ‘ময়দান দিঘি’। ভরা ভাদরে ভাগীরথীর জল উপচে ভেসে যেত গোটা গাঁ। লোকে বলত বান এসেছে। তেমনই এক বানের জলে এক বার কুমির এসে পড়ল পুকুরে। তাঁর বাবা উঠে পড়ে লাগলেন কুমিরটাকে মারতে হবে! নিমতিতা থেকে কুমির-ধরা বঁড়শি এল। লম্বা বাঁশে মোটা দড়ি বেঁধে বঁড়শি লাগানো হল। তাতে টোপ দেওয়া হল পাঁঠার নাড়িভুঁড়ি। বন্দুকে টোটা ভ’রে দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁর বাবা। গোটা গাঁ ভেঙে পড়ল পুকুরপাড়ে। মরণকালে জল থেকে লাফিয়ে উঠে হাঁ মুখ করে তাঁর বাবার দিকে এমন তেড়ে এসেছিল কুমির, সে-স্মৃতি তপনের কোনও কালে যায়নি।
ন’বছর বয়স হলেই তপনকে ভর্তি করে দেওয়া হয় ভাগলপুরের দুর্গাচরণ এম ই স্কুলে। এম ই মানে, মিডল স্কুল। ক্লাস সেভেন অবধি। ওই পর্যন্ত পড়া হলে বিহারের যত এম ই স্কুল ছিল তার সবগুলোকে নিয়ে পরীক্ষা হত। পাশ করলে হাই স্কুল। ইস্কুলের হেড মাস্টারমশাই ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের দূর সম্পর্কের মামা। সাদা শনের মতো আধা বাবরি চুল। ধবধবে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে সোনার পাঁসনে চশমা নীল সিল্কের সুতো থেকে ঝুলত গলায়। হেড মাস্টারমশাই বেহালা বাজাতেন। স্কুলে প্রতিদিন প্রার্থনাসভায় যে-গানটি গাওয়া হত, সেটিও তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন— ‘জীবনে যত পূজা হল না সারা।’ ছাত্ররা গাইত। সঙ্গে বেহালা বাজাতেন তাঁদের হেডস্যার। হেডস্যার স্বপ্ন দেখতেন এমই স্কুলকে একদিন হাইস্কুল বানাবেন। হলও তাই। বছর কয়েক বাদে দুর্গাচরণ হাই ইংলিশ স্কুল থেকে পরীক্ষা দিল প্রথম ব্যাচের জনা কুড়ি ছাত্র।
বাংলা স্কুলের পুরনো বিল্ডিং-এর পাশেই বিরাট খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল। সংক্ষেপে, সিএমএস। তার প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন মিস্টার হার্ডফোর্ড। ছাত্রদের তিনি ক্রিকেট শেখাতেন। ক্রশ-ব্যাটে খেললে খুব রেগে যেতেন। স্কুলের কাজ সারা হলে সারাটা শহর চক্কর মারতেন সাইকেলে।ইহুদি কোহেন সাহেবের অনেক সম্পত্তি ছিল ভাগলপুরে। বিরাট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা তাঁর আমবাগান। টাকা ধার দেওয়ারও কারবার ছিল তাঁর। সাহেবের তিন কন্যা ছিল। অতীব সুন্দরী ছিলেন তাঁরা — সেরা, ডোরা, ফ্লোরা। ওদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী তাই নিয়ে তর্ক লেগে যেত বন্ধুদের মধ্যে। ডোরার টিকালো নাক, আয়ত চোখ। কোনও মেকআপ ছাড়াই তাঁকে সুন্দর লাগত তপনের। খুব ইচ্ছে হত পরিচয় করার, সে আর হয়ে ওঠেনি। স্কুলে ইতিহাস আর ইংরিজি পড়াতেন গুরুদাসবাবু। বড় সুন্দর ছিল তাঁর পড়ানোর ধরন। এক দিন ফরাসি বিপ্লব পড়াতে পড়াতে চলে এল চার্লস ডিকেন্সের ‘এ টেল অব টু সিটিজ’-এর প্রসঙ্গ। কারণ ওই সময়ই ভাগলপুরে এক সিনেমা হলে ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ ছবিটি এসেছিল। পাঠ্য বই ছেড়ে ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ পড়াতে লাগলেন স্যার। দিন দুয়েক বাদে বললেন, ‘‘যাও এ বার ছবিটি দেখে এসো।’’ ওই ছবি দেখাতেই বোধহয় প্রথম বারের মতো ওর মধ্যে বীজ পুঁতে গিয়েছিল সিনেমার। এর মধ্যে ঘটেছিল কত কাণ্ড!
গান্ধীজি এলেন ভাগলপুরে। তপন তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। ভিড়ের মাঝে গান্ধীকে দেখতে গিয়ে ঠেলাঠেলিতে পাঁজরের তাঁর হাড় ভাঙল। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে আসতে হয়েছিল চিকিৎসার জন্য। তিন মাস লেগেছিল সুস্থ হতে। সুভাষচন্দ্রও এসেছিলেন। ঝলমলে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় বড় সুন্দর লেগেছিল তাঁকে।
কলেজের পাঠ শেষ করে ভাগলপুর ছাড়েন তপন ’৪৩ সালে। কলকাতা শহর তাঁর অপরিচিত ছিল না। তাঁর জন্মই তো কলকাতায়। বছরে দু’তিন বার আসাও হয়ে যেত এখানে। কিন্তু ’৪৩ থেকে ’৪৬ কলকাতার ছাত্রজীবন যেন দুঃসহ হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর কাছে।এক দিকে তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রকোপ। অন্য দিকে দুর্ভিক্ষ। ম্যালেরিয়া, মহামারী। কলকাতার রাস্তায় অনাহারে মৃত মানুষের লাশ। ’৪৬ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি শেষ করে ঢুকলেন নিউ থিয়েটার্সে। আজ থেকে ঠিক চুয়াত্তর বছর আগে। তার পর থেকে প্রায় শেষ দিন অবধি নাগাড়ে মনের গভীরে বয়ে গিয়েছে ছায়া আর ছবির খেলা। গুনগুন করে একটানা। ঠিক যেন শৈশবের সেই গোপাল বৈরাগীর মতো।
তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ দেখে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়! কিন্তু তত দিনে কিন্তু ছবিটা নিয়ে হই হই পড়ে গিয়েছে সারা ভারতে। পরিচালক তপন সিংহর নামে ধন্য ধন্য করছেন সকলে। তখনই একদিন হঠাৎ সত্যজিৎ রায় ফোন করেন পরিচালককে, ‘‘নিজে একজন টেকনিশিয়ান হয়ে এত খারাপ টেকনিকাল কাজ করলেন কী করে?’’ রাগের কারণ শুনে ফোনেই প্রায় হাতজোড় করেছিলেন তপন সিংহ। অসহায়তার কথা স্বীকার করেছিলেন। তাতে আরওই ক্ষিপ্ত হয়ে বহুকালের সুহৃদ সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘‘এত ভালমানুষ সাজবার দরকার নেই। কাজের সময় কোনও দিন কমপ্রোমাইজ করবেন না।’’ কিন্তু তাঁর অপরাধ কী ছিল?ছবি বিশ্বাসের মতো অমন মাপের এক জন শিল্পী, কিছুতেই স্পিরিট গাম দিয়ে দাড়ি লাগাতে দিতেন না। ফলে কাবুলিওয়ালার দাড়িটি হয়েছিল প্রায় কদাকার।বার্লিন ফেস্টিভ্যালে ছবিটি দেখে এক বিদেশি সাংবাদিক পরিচালকের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, ‘‘অভিনয়টি এতই ভাল যে, আপনাকে উনি ওঁর দাড়ির ব্যাপারটা ভুলিয়ে ছেড়েছেন।’’ কিন্তু ছবি বিশ্বাসকে বোঝায় কার সাধ্যি! এমন এমন সব বিশ্বাস ছিল ওঁর, খুব কড়া ধাঁচের মানুষ না হলে, তা থেকে তাঁকে বের করে আনা ছিল রীতিমতো ঝকমারি ব্যাপার।
‘কাবুলিওয়ালা’-তে আরও দু’বারের কাণ্ড যেমন। কাকে করবেন ‘কাবুলিওয়ালা’, তখনও ভেবে পাচ্ছেন না তপন সিংহ। ছবি বিশ্বাস শুনে বললেন, ‘‘কাবলেদের সম্বন্ধে আমাকে একজন অথরিটি ভেবে নিতে পারো। ওদের সঙ্গে অনেক মেলামেশা করেছি।’’ —তা’হলে তো ওদের পুশতু ভাষাও একটুআধটু জানেন। কিছু সংলাপ পুশতুতে দিতে চাইছি। এ বার যেন একটু ঘাবড়ে গেলেন ছবি বিশ্বাস। বললেন, ‘‘শুধু শুধু পুশতু-মুশতু আনতে গেলে কেন? বুঝবে কে?’’ —না বুঝলেও চলবে। এতে অভিনয়ের একটা ডায়মেনশন আসতে পারে। ভেবে বললেন, ‘‘তা ঠিক। একটা কাবলেকে ধরে শিখে নিলেই চলবে। বাদবাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। কেমন পোশাক-পরিচ্ছদ, মেকআপ, চলাবলা…।’’ —প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটা বাড়িতে অনেক কাবুলিওয়ালা থাকে। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সে মাঝে মাঝে আপনার কাছে যাবে। এর পরের গল্প তপন সিংহ নিজেই লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘মনে পড়ে’ গ্রন্থে।
সেখানে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘সেটটি ছিল মেটিয়াবুরুজের একটা মুসলমান হোটেলের অংশবিশেষ। …আমরা যখন সেট লাইট প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত, হঠাৎ ছবি বিশ্বাস কাবুলিওয়ালার বেশে প্রবেশ করলেন। চমকে উঠলাম। এ কাকে দেখছি? অতি দরিদ্র মলিন বেশধারী হিং বিক্রেতা কোনও কাবুলিওয়ালা, না সদ্য কবর থেকে বেরিয়ে আসা স্বয়ং মহম্মদ বিন তুঘলক? মাথায় জরির পাগড়ি। গায়ে সিল্কের আচকানের ওপর জরির কাজ করা হাতকাটা জ্যাকেট। পায়ে সোনার জরির কাজ করা নাগরা। তখন আমি তিনশো টাকা মাইনের এক জুনিয়র পরিচালক। আর ছবি বিশ্বাস হলেন সে যুগের অজেয় দুর্দান্ত অভিনেতা। সুতরাং ইগনোর্যান্স ইজ্ ব্লিস কথাটি ভেবে কাজ শুরু করে দিলাম।’’
বিকেল বেলা প্রযোজক অসিত চৌধুরী হাজির। দেখে শুনে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বাদেই তাঁর প্রস্থান। তিন চার দিন বাদে অসিতবাবু মুখ খুললেন, ‘‘দেখুন মশায়, ছবিদাকে ওই ঔরঙ্গজেবের পোশাক ছেড়ে গরিব কাবুলিওয়ালা সাজতে হবে। যতটা কাজ হয়েছে ফেলে দিন।’’ ঠিক হল দু’জনে মিলে গিয়ে বলা হবে। বেশ ভয়ে ভয়েই ছবি বিশ্বাসের কাছে কথাটা পাড়লেন ওঁরা। শুনে প্রথমে চমকে উঠলেও পরে অবশ্য যুক্তিটা মেনে নেন তিনি। তখন আবার নতুন করে পোশাক তৈরি। নতুন করে শ্যুটিং।
দ্বিতীয় কাণ্ডটি আরও মারাত্মক। ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তপন সিংহ বলেছেন, ‘‘যেমন সুদক্ষ অভিনেতা তেমনি আবার ফাঁকিবাজও ছিলেন।’’ ঘটনাটি অনেকটা সেই ধাঁচেরই বটে। সে বার শ্যুটিং কাশ্মীরে। শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁওয়ের পথে বেশ কিছু ভেতরে সুন্দর একটা উপত্যকায়। অনেকটাই কাবুলের সঙ্গে মিলে যায় তার গড়ন। নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে শ্যুটিং করে তপন সিংহর শরীর তখন বেশ কাহিল। রোজ রাতে জ্বর আসছে।শ্যুটিঙের দিন ভোরবেলা ছবি বিশ্বাসকে তিনি বললেন, ‘‘শরীরটা আর দিচ্ছে না। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আজকেই কাজ শেষ করে নেব।’’ —দশ মিনিটের মধ্যে আসছি। তপন সিংহ লিখছেন, ‘‘শ’খানেক ভেড়া ও লোকজন জড়ো করে অপেক্ষা করছি। এমন সময় ওঁরা এলেন। দূর থেকে দেখছি জিপ থেকে কাবুলিওয়ালা নামলেন, কিন্তু তার পর যিনি নামছেন, তিনি কে? স্যুট পরা লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক! কাছে আসতে চমকে উঠলাম, উনি তো ছবি বিশ্বাস! তা’হলে কাবুলিওয়ালা কে? এসেই বললেন, দারুণ জায়গা বেছে নিয়েছ তো! এত সুন্দর জায়গায় কি আর আমার ক্লোজ-আপ নেবে? তাই তোমার সহকারী বলাইকে কাবুলিওয়ালার মেকআপ করালাম। একটু লং-এ ট্রিট করলে কেউ ধরতে পারবে না।’’ তপন সিংহ নির্বাক! বলেন কি ভদ্রলোক! কিন্তু আর তো উপায়ান্তরও নেই। অতএব? শ্যুটিং হল। ওই বলাইকে দিয়েই! বলাই বাহুল্য, ছবিতে কাবুলের দৃশ্যে আজও কাবুলিওয়ালা বেশে যাঁকে দেখা যায়, তিনি ছবি বিশ্বাস নন। বলাই সেন।
মানুষ যে কত বিচিত্র হয়! কত বৈপরীত্যে ভরা তার যে আচার-আচরণ! আবার এই ছবি বিশ্বাস কে নিয়েই সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ঘটনার উল্লেখও পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। সময়টা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর। আউটডোরে যেতে তখন অল্প ক’দিন বাকি। পোস্টমাস্টারের চরিত্রটি তখনও কে করবেন, ঠিক নেই পরিচালক তপন সিংহর।ছবি বিশ্বাসের কাছে গিয়ে কথায় কথায় বললেন, ‘‘কাকে নিই বলুন তো?’’ উত্তর এল, ‘‘একজনই আছে।’’ —কে? —তার নাম ছবি বিশ্বাস। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না তখন। তপনবাবু বললেন, ‘‘মাত্র দু-তিন দিনের কাজ। রাত বারোটায় ফ্লাইট। সেখান থেকে গাড়ি। আপনার শরীর অত ধকল নিতে পারবে?” —খুব পারবে। ঘাবড়াচ্ছ কেন? তখন উনি স্টার থিয়েটার-এ। নিয়মিত স্টেজ করছেন। প্রাণান্তকর পরিশ্রম। তার মধ্যেই তিন দিন ‘ম্যানেজ’ করে কাজ করতে ছুটলেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর।
কাবুলিওয়ালা-র মিউজিক করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ছবিতে আফগানিস্তানের দৃশ্য আছে। এ সব জায়গায় যা হয়, তাই-ই মনে মনে ভাবছিলেন তপন সিংহও। ‘অ্যারাবিউন টিউন’ জাতীয় কিছু লাগিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। এই ভাবাভাবির মধ্যেই একটা অদ্ভুত যোগাযোগ ঘটে গেল। রবিশঙ্কর হঠাৎই আফগানিস্তানে ‘কাবুলি রেডিয়ো’-তে বাজাতে যাবার সুযোগ পেয়ে গেলেন। পরিচালককে বললেন, ‘‘দেখা যাক ওখানে কী পাওয়া যায়?’’ যথাসময়ে রবিশঙ্কর ফিরলেন টেপ রেকর্ডারে ভর্তি পুশতু ভাষার গান নিয়ে। এমন অযাচিত স্বর্গ এত অনায়াসে পেয়ে যাওয়ায় অভিভূত হয়ে যান সকলেই। সারা রাত কাজ করতেন পণ্ডিতজি। সেই ভোরের আলো না-ফোটা অবধি। চোখ বুজে গুনগুন করতে করতে যখনই সুর খুঁজতেন মৃদু হাসি খেলে যেত তাঁর মুখে। কোনও দিন এক তিলও মেজাজ খারাপ করতেন না। বারবার হয়তো একই ‘মিউজিক্যাল ফ্রেজ’ দেখাচ্ছেন। যাঁরা বাজাচ্ছেন, তাঁরা কেউই তুলতে পারছেন না। ক্লান্তিতে ঘেমেনেয়ে একশা পণ্ডিতজি। তাও হাসিটা ধরা ঠোঁটে। চাউনি উদাস। মুখে শুধু বলতেন, ‘‘আর পেরে উঠছি না কিন্তু।’’ কাজে তার ছাপ ছিল না কোনও।
দিলীপকুমারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাটাও তপন সিংহর কাছে বেশ শোনার মতো। মানুষ হিসেবে দিলীপকুমার এমনিতেই বেশ অদ্ভুত ছিলেন। অভিনয় যদি তাঁর প্রথম প্রেম হয়, দ্বিতীয় প্রেম ছিল খেলা। তিনি রোভার্স কাপে ফুটবল খেলেছেন। ছাত্রজীবনে কলেজে বরাবরের দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। সকালে ব্যাডমিন্টন খেলা ছিল নিয়মিত। বিকেলে ঘুড়ি ওড়াতেন। ইনিই আবার ঊর্দু ভাষার সুপণ্ডিত। এক সঙ্গে নাকি দুটো ছবিতে কাজ করেননি কোনও দিন। তপন সিংহ লিখেছেন, ‘‘বদনাম একটাই। শ্যুটিঙের দিন কখন যে তিনি আসবেন, কেউ জানে না। আর সিন যদি পছন্দ না হয়, তা হলে কোনও রকম টালবাহানা করে বিদায় নেবেন। শ্যুটিং আর হবে না। এই ধরনের কথাবার্তা সিনেমা মহলে প্রচলিত ছিল। ফলে ‘সাগিনা মাহাতো’ করার সময় প্রমাদ গুনেছিলাম।’’ কার্শিয়াঙে আউটডোরে প্রথম দিন সকালে চার-পাঁচ ঘণ্টা কাজ করার পর যখন শুনলেন, বিকেলেও আবার কাজ, সহকারী বলাই সেনকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে দিয়ে যদি এত কাজ করাও, কালই পালাব বম্বে।’’ বলাই সেন নাকি সবার সঙ্গেই একটু গুরুগম্ভীর চালে কথা বলতেন। দিলীপকুমারকেও তেমন করে বলতে গিয়েছিলেন, ‘‘পরিশ্রম করতে হবে দাদা, নইলে জীবনে কিছু পাওয়া মুশকিল।’’ শোনা মাত্র এক চড় কষিয়েছিলেন দিলীপকুমার। বলাইবাবু আর দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ পাননি। তার পর অবশ্য ধীরে ধীরে কাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন দিলীপকুমার। কাজও এগোচ্ছিল তর তর করে। কিন্তু যে দিন কাজ করতে ইচ্ছে করত না, সে দিন তাঁকে দিয়ে কাজ করানো ছিল মারাত্মক ব্যাপার।
এক দিন, শ্যুটিং জোনে সবাই তৈরি। কেবল দিলীপকুমারের দেখা নেই। বেলা এগারোটা নাগাদ অধৈর্য হয়ে বাড়িতে ফোন করলেন তপনবাবু। শোনা গেল, বেরিয়ে পড়েছেন। তবে শরীর খুব খারাপ। শুধু পরিচালকের কথা ভেবেই নাকি আসছেন। এলেন অল্প পরেই। কিন্তু সোজা গ্রিনরুমে গিয়ে আরামকেদারায় শুয়ে পড়লেন। কাঁধে গরম জলের ব্যাগ। আতঙ্কিত হয়ে তপন সিংহ গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর কাছে, ‘‘কী হয়েছে?’’ —বড় ব্যথা। সত্যিই প্রমাদ গুনলেন তপনবাবু। কিন্তু এর পরেও দমে গেলে চলবে না! একটা গোটা দিন যাওয়া মানে অনেক টাকার ধাক্কা। পরের পর শিডিউল লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া। ফলে যে করে হোক অবস্থা সামাল দিতে হবে। ভাবতে ভাবতে শুধুমাত্র উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সে দিন শ্যুটিংটা করতে পারলেন তপন সিংহ। বেশ খানিকটা সহানুভূতি দেখানোর পর বললেন, ‘‘ব্যথা তো একটু হবেই। নার্গিস, মীনাকুমারী, বৈজয়ন্তীমালা… কত কত নায়িকা ওই কাঁধে মাথা রেখে অভিনয় করেছে বলো?’’ এ কথা শুনেই প্রায় লাফিয়ে উঠলেন এতক্ষণের ‘অসুস্থ’ দিলীপকুমার। মুখে চওড়া হাসি। বললেন, ‘‘চলো বাবা, শ্যুটিং করবে চলো। এখুনি মেকআপ করে নিচ্ছি। বাঙালিদের সঙ্গে পেরে ওঠা দায়।’’ আধ ঘণ্টার মধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেল।
অথচ ঠিক উল্টো কাণ্ড হয়েছিল অশোক কুমারের বেলায়। ‘হাটেবাজারে’-র হচ্ছিল শ্যুটিং। ভুটানে। পাহাড়ঘেরা একটা ছোট্ট বস্তি। নাম শাম্চি। সেখানেই কাজ হবে। এ দিকে কঠিন হাঁপানিতে ধরল অশোক কুমারকে। দু’দিন দু’রাত শোওয়া নেই। ঘুম নেই। বিছানায় বসে বসে একটানা নিঃশ্বাস ফেলছেন। কষ্টটা চোখ চেয়ে দেখা দেখা যায় না। এত করুণ অবস্থা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রফুল্ল সেন। তাঁর কাছে খবর গেল। তিনি ডাক্তার মণি ছেত্রীকে পাঠালেন সরকারের নিজস্ব প্লেনে। তাঁর ওষুধেই হাঁপানি কমল। কিন্তু শরীর খুব দুর্বল হয়ে রইলো। বাধ্য হয়ে তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলে অন্যদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন তপন সিংহ। পর দিন ভোর। কাজে যাবার জন্য সবাই রেডি। হঠাৎ দেখা গেল তৈরি হয়ে বসে আছেন অশোক কুমারও। তপনবাবু দেখেই আঁতকে উঠলেন, ‘‘আরে, এ কী! আপনার তো বিশ্রাম নেওয়ার কথা!’’ উত্তরে অশোক কুমার বললেন, ‘‘সবাই কাজ করবে, আর আমি হাঁ করে বসে থাকব? হয় কাজ করতে দাও, নইলে বম্বে ফেরত পাঠাও।’’ নাছোড় অশোক কুমার কোনও কথা শুনবেন না। ফলে কাজ করতে দিতেই হল ওঁকে। ধীরে ধীরে সেরেও উঠলেন তিনি। অশোক কুমার মানুষটি ছিলেন এমনই! এর আগেরই ঘটনা যেমন। ওই ছবিতেই বৈজয়ন্তীমালাকে পরিচালকের নেওয়ার ইচ্ছে। এক বার সে কথা শুনে অশোক কুমারই টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেন তপন সিংহর। বৈজয়ন্তীমালা আবার বাংলা জানতেন না। তপনবাবু তাই অন্য বুদ্ধি করলেন। সংলাপগুলো তিন ভাবে রেকর্ড করে পাঠাতেন তাঁকে। স্লো স্পিড। মিডিয়াম। নর্মাল। তাই শুনে শুনে সংলাপ মুখস্থ করেছিলেন বৈজয়ন্তী।
উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর প্রথম কাজ ‘উপহার’-এ। ’৫৪ সাল। মহানায়ক হওয়া থেকে অনেক দূরে। কিন্তু নায়ক হিসেবে তখন তিনি ক্রমেই উঠছেন। এমন সময় তপন সিংহর ডাকে একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করলেন উত্তমকুমার। এক তরুণ অধ্যাপকের চরিত্র। —চিত্রনাট্য আমার খুব ভাল লেগেছে তপনদা। শুনে তপনবাবু বললেন, ‘‘তোমার যদি মনে হয়, সংলাপের কিছু কিছু জায়গা বদল করে নিয়ো। অভিনয় আর ডায়লগ ব্যাপারটা তো একদম আলাদা, তাই বলছি।’’ এ কথায় খুব খুশি হয়েছিলেন উত্তমকুমার। বলেছিলেন, ‘‘তোমার কাছে প্রথম শুনলাম জানো! সব ডিরেক্টর যা ডায়লগ লেখে, সেটাকেই বলতে বলে। এতে কি অভিনয় হয়, বলো?’’ ‘উপহার’-এর পর খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায় দু’জনের। যত বার একে অন্যের সঙ্গে মোলাকাত করেছেন কোথায় যেন আস্থার জমিটা পোক্ত হতে হতে গিয়েছে।
ভাল বিদেশি ছবি দেখলেই উত্তমকুমারকে তপনবাবু বলতেন, ‘‘যাও যাও দেখে এসো।’’ মার্লন ব্র্যান্ডোর ‘গডফাদার’ এল। তাঁর ‘তপনদা’র কথায় দেখে এলেন উত্তমকুমার। পর দিন কোনও এক ছবির শ্যুটিং। গেছেন স্টুডিয়োয়। সে সময়ই কোনও এক কাজে তপন সিংহও গিয়েছেন সেখানে। তাঁকে দেখে উত্তমকুমার ছিটকে বেরিয়ে এলেন ফ্লোর ছেড়ে, ‘‘দূর দূর শ্যুটিং-ট্যুটিং হবে না এখন। চলো তো তোমার ঘরে গিয়ে বসি। ওফ্ কী ছবি দেখলাম!’’
‘ঝিন্দের বন্দি’ করবেন তপন সিংহ। এ বার নায়ক উত্তমকুমার। ছবির কাজ শুরু করার আগে তাঁর নায়ককে বললেন, ‘‘তোমাকে একটু ঘোড়ায় চড়া শিখতে হবে।’’ উত্তমকুমার শুনে বললেন, ‘‘জানতাম, জানো। অনেক দিন চড়ি না, এই যা। প্র্যাকটিস করতে হবে।’’ ব্যবস্থা করে দিলেন পরিচালক। ভোর পাঁচটায় উঠে ময়দানে ঘোড়া চড়তেন তাঁর নায়ক। একেবারে নিয়ম করে। সে যত কাজই থাকুক। তাতে ফলও মিলল হাতেনাতে। শ্যুটিং-এর সময় তাঁকে দেখে তপন সিংহর মনে হয়েছিল, এ নায়ক উত্তমকুমার নয়, পোড়খাওয়া কোনও এক ঘোড়-সওয়ার। ছবির জন্য তরোয়াল খেলাও শিখতে হবে। তাতেও রাজি হলেন নায়ক। ম্যাসি টেলর বলে একজন বিদেশিকে আনলেন তপন সিংহ। অলিম্পিক বিজয়ী।চেয়ারে বসে ম্যাসির অসিচালনা দেখে দেখে তাঁকে হুবহু কপি করে ফেললেন নায়ক। পরিচালক তো বটেই, চমকে গিয়েছিলেন স্বয়ং ম্যাসিও।
‘ঝিন্দের বন্দি’র সঙ্গীত করেছিলেন উস্তাদ আলী আকবর খান। সেখানেও একটি বেশ কষ্টকর সঙ্গীত-বিন্যাসকে রীতিমতো কসরত করে তাঁর নায়কের ধরার ভঙ্গিতে হতবাক হয়ে যান পরিচালক। হঠাৎ তপনবাবুর মনে হয়েছিল, মদ্যপান করলে অনেক সময় যেমন লোকে ভুলভাল বলে, গানেও যদি সে রকম রাখা যায়। উস্তাদকে বলতেই আলী আকবর বলেছিলেন, ‘‘ভারী ভাল ভেবেছেন তো! আমি তৈরি করি।’’ সুর হল। কোনও একটি রাগ নয়, রাগের সমাহার। এক রাগ থেকে অন্য রাগে চলে যাচ্ছে সুরের চলন। গাইতে ডাকা হল প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রেকর্ডিং হল। উত্তমকুমার সবটা শুনে বললেন, ‘‘তুমি আমায় রেকর্ডিংটা দাও। আমি বাড়িতে রেওয়াজ করি।’’ এ বারও যেন ম্যাজিক দেখলেন তপন সিংহ, তাঁর নায়কের কাছে। ফ্লোরে যখন এলেন উত্তমকুমার, এতটাই তৈরি যে, প্রথম টেক-এই ওকে! ক্যামেরার ও পাশে দাঁড়িয়ে তখন কথা সরেনি পরিচালকের মুখে। উত্তমকুমারের ‘স্ত্রী’ রিলিজ করল। গেলেন তপন সিংহ। দেখে উত্তমকে বললেন, ‘‘খুব ভাল অভিনয় করেছ।’’ সেই শুনে নাকি থমকে গিয়েছিলেন উত্তমকুমার, ‘‘তুমিও এ কথা বলছ?’’ —কেন গো?—”দেখলে না, আগাগোড়া ছবিদাকে (বিশ্বাস) নকল করে গেলাম। জমিদারের রোল করছি, ছবিদা ছাড়া তো আর উপায় নেই।’’
আরেক বারের কথা। সে বার ছবি প্রযোজনা করবেন ঠিক করেছেন উত্তমকুমার। পরিচালনা করার আব্দার নিয়ে গেলেন তপন সিংহর কাছে। তখন সুবোধ ঘোষের ‘জতুগৃহ’ কাহিনিটা মাথায় ঘুরছে তপন সিংহর। গল্পটা ওঁকে পড়ার কথা বললেন। উত্তর এল, ‘‘আমি কী পড়ব তপনদা! ও তুমি যা ভাল বুঝবে, তাই করবে।’’ এতটাই বিশ্বাস, এতটাই বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওঁদের। উত্তমকুমার এমনও এক বার বলেছিলেন ওঁকে, ‘‘তপনদা, আমি তো ভবানীপুরের রকে আড্ডা মেরে বড় হয়েছি, উচ্চারণ খুব একটা ভাল নয়। ছবিদার মতো মার্জিত ডায়লগ বলতে পারি না।’’ তারও নাকি দাওয়াই বলে দিয়েছিলেন তপন সিংহ। ‘‘রোজ সকালবেলা একটা করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করবেন।’’ অক্ষরে অক্ষরে নাকি এ পরামর্শও মেনে চলতেন তাঁর নায়ক। এমন একটা ভরসার সম্পর্কে কোথায় যেন তাল কেটে গেল ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ করতে গিয়ে। চ্যালেঞ্জিং রোল। কোনও দিন অমন চরিত্র করেননি। সানন্দে রাজি হলেন উত্তমকুমার। ডেটও দিলেন। শ্যুটিং-শিডিউল সে ভাবেই ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু তার পরে কী যে হল!
তপন সিংহ লিখেছেন, ‘‘হঠাৎ ডেট বদলাতে চাইল উত্তম। বম্বেতে কী একটা হিন্দি ছবির কথা চলছিল। ওই ছবির জন্য আমাকে দেওয়া ডেটগুলোর দরকার হয়ে পড়ল! পরের মাসে শ্যুটিং করতে চাইল …ওকে বললাম, হতে পারে অন্যরা ছোট আর্টিস্ট। কিন্তু তাঁদেরও তো একটা সম্মান আছে। পরের মাসে শ্যুটিং করা যাবে না। তুমি বরং ছবিটা ছেড়ে দাও।’’
এর পর সব চুপচাপ। একটা ঠান্ডা ঝড় এত দিনের একটা সম্পর্ককে ছারখার করে দিল! উত্তমকুমারের জায়গায় দীপঙ্কর দে-কে নিলেন তপনবাবু। শ্যুটিং করে কলকাতায় ফিরে শুনলেন সুপ্রিয়া চৌধুরী মামলা করেছেন। সে-মামলা অবশ্য ধোপে টিকল না। আসলে ছবিতে সময়টা দেখাতে চেয়েছিলেন শীতকাল। সেই অনুযায়ী বাগানে ফলমূল, সবজি লাগিয়েছিলেন। অপেক্ষা করলে তা শুকিয়ে যেত। এই কথটাটা ঠারেঠোরে লেখা ছিল চুক্তিপত্রে। তাই মামলায় হেরে যান উত্তমকুমার। কিন্তু সম্পর্কে সেই যে চিড় ধরল, সে আর ফেরেনি। পরে বহু দিন তপনবাবু ভেবেছিলেন, সব মিটিয়ে নেবেন। হয়ে ওঠেনি। আর তার পরেই তো সব শেষ। সমস্ত জাগতিক সম্পর্কের ইতি টেনে চিরকালের জন্য চলে গেলেন মহানায়ক। নিথর উত্তমকে শেষ দেখা দেখতে গিয়ে ভাই তরুণকুমারের সঙ্গে দেখা। তপনবাবুর হাতটা ধরে তরুণকুমার বলেছিলেন, ‘‘দাদাও খুব চেয়েছিল, সম্পর্কটা আবার ফিরে আসুক। খুব দুঃখও করত এ নিয়ে। একটা ছবি করতে গিয়ে এত দিনের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেল!’’ হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বর শোক যেন তখন দ্বিগুণ হয়ে বিঁধে গিয়েছিল বুকে।
‘ঝিন্দের বন্দি’ করার সময় ঘোড়া চড়ার অভ্যাস করান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও। সে ’৬০-’৬১ সালের কথা।তার পর প্রায় পঁচিশ বছর কোনও কাজে ডাকেননি সৌমিত্রবাবুকে। এক সময় নিজেই আপসোস করতেন এ নিয়ে। বলতেন, ‘‘ও যে নিজেকে কতটা পরিণত করেছে, জানাই ছিল না আমার। টের পেলাম ‘আতঙ্ক’ করতে গিয়ে।…সঞ্জীবকুমার যেমন ধরনের অভিনেতা, সৌমিত্র
ঠিক তেমনই। কিংবা তার চেয়ে বেশি বলে আমার মনে হয়।’’ সৌমিত্রবাবুকে নিয়ে ‘হুইলচেয়ার’ করার সময় আরেক ধরনের অদ্ভুত তালিমের কথা বলেছিলেন তপন সিংহ। বলেছিলেন, ‘‘তোমাকে অন্তত এক মাস হুইল চেয়ারে বসে ঘুরে বেড়ানো রপ্ত করতে হবে।’’ বনহুগলিতে এক পরিচিত ডাক্তার ছিলেন, দুর্ঘটনায় তাঁর পা দুটি বিকল হয়ে যায়। হুইলচেয়ারে বসেই তিনি গোটা হাসপাতাল চক্কর দিতেন। এমন এক জন ব্যস্ত মানুষ কী করে এই ব্যাপারটা করেন, দেখতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও। দু-তিন বার তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে।
‘ঝিন্দের বন্দি’র শেষটা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনির থেকে বদলে দিয়েছিলেন তপন সিংহ। পরে এ নিয়ে আক্ষেপ করতেন। তারই কাছাকাছি আক্ষেপ ছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ ছবিটিকে ঘিরে। ‘হাঁসুলি…’ সিনেমা হবে শুনে তারাশঙ্কর অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। তা নিয়ে যে কাণ্ড করেছিলেন, রীতিমতো অদ্ভুত। মূল কাহিনির পটভূমি ছিল বীরভূমের লাভপুর। তপন সিংহকে নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন সেখানে।মাইলের পর মাইল হাঁটতেন। লোকেশন দেখে বেড়াতেন। অন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়ত। তারাশঙ্করের ক্লান্তি নেই। চোখের দৃষ্টি যেন মাঝে মাঝে দিগন্ত ছাড়িয়ে কোথায় উধাও হয়ে যেত। ধ্যানমগ্ন ঋষি যেন! এক বার বলেছিলেন, ‘‘জানো তপন, এই লাভপুরের আশেপাশে পাঁচ-ছখানা গ্রামে ক’খানা গাছ আছে, তা’ও বলে দিতে পারি আমি।’’ সেই কোপাই নদী। গাঁ-ঘর। তার লোকজন। এমনকী করালীর পিসতুতো ভাই নসুবালা, যে মেয়ে সেজে ঘুরে ঘুরে বেড়াত, তাকেও চিনিয়ে দিয়ে ছিলেন তারাশঙ্করই। দিনের শেষে কাজের পর লাভপুরের বাংলোয় বসে মহাভারতের গল্প শোনাতেন তারাশঙ্কর।
তেমনই এক দিন। তপন সিংহ লিখছেন, ‘‘হঠাৎ এক জন বৃদ্ধা এসে তাঁকে প্রণাম করল।…‘কেরে নসু নাকি… আয় আয়।’ সাদরে আহ্বান জানালেন তারাশঙ্কর। ‘হ্যাঁ বাবু, ভাল আছেন তো?’ বৃদ্ধাটি বলল। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে কেমন যেন মনে হল। তারাশঙ্কর আমার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে এই বাবু এসেছেন, তোদের নিয়ে সিনেমা করতে।’ আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এ হচ্ছে হাঁসুলিবাঁকের উপকথা-র নসুবালা। এ বার ভাল করে দেখলাম— যাকে বৃদ্ধা ভেবেছিলাম সে আসলে একজন পুরুষ। …. নসুবালা নাচে, গান গায়, তামাক খায়, মদ খায়, ঢোল বাজায়।… হঠাৎ তারাশঙ্কর বললেন, ‘এই নস্যে, বাবুকে একটা গান শোনা।’ কানে এক হাত দিয়ে দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে নসুবালা শুরু করলে— ‘আহা—আমায় এ হিদি মাঝারে আঁকা হয়ে গেলা শ্যামের চরণখানি।’’’ নসুকে এত কাছ থেকে দেখেও সিনেমায় তাকে ‘মেয়ে’ হিসেবে দেখিয়েছিলেন তপন সিংহ। পরে ভুল বুঝেছিলেন। তখন আপসোসের অন্ত ছিল না!
যে বছর সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’ মুক্তি পেল, সেই বছরই (১৯৬২) মুক্তি পেয়েছিল তপন সিংহর পরিচালনায় ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’। শুটিং-এর জন্য লাভপুর পৌঁছেছেন তপন সিংহ। বর্ষাকাল। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। জল-কাদা মেখে কাজ করছে সবাই। হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে তপন দেখলেন ওয়াটাররপ্রুফ পরে স্বয়ং তারাশঙ্কর। চোখাচুখি হতেই হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘‘এ হে হে দেখো দেখো! শহরের সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়েগুলো জল কাদা মেখে কী চেহারা করেছে দেখো।’’ লেখকের ছোটভাই এক ধামা তেলমাখা মুড়ি আর এক হাঁড়ি বেগুনপোড়া এনে হাজির। লেখক বললেন় , ‘‘নাও হে, অনেক কাজ হয়েছে, এবার সকলে একটু খেয়ে নাও। এরপর চা আসবে।’’ তারাশঙ্কর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বারবার নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন তপন সিংহ। একজন মানুষ গ্রামকে যে কী নিখুঁতভাবে চিনতে পারেন তার প্রমাণ তারাশঙ্কর। গ্রামের ক’টা গাছ আছে, তাও তাঁর কণ্ঠস্থ। ঘরে ঘরে লোকজনকে নাম-নামে চেনেন। সবার শখ-আহ্লাদ-স্বভাব-অভাব যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পান।যত দূরেই যান, গাঁ-ঘরটা তাঁর মনে যেন ছবি হয়ে ভেসে থাকত!
‘হাঁসুলি বাঁক…’ করতে গিয়ে অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করেছিলেন রবি ঘোষকে। এলটিজি-র ‘অঙ্গার’ নাটকে তখন অভিনয় করছেন রবি ঘোষ। এর পর তাঁকে ‘নির্জন সৈকত’-এও নিলেন। ওড়িশাবাসী এক পাণ্ডার চরিত্রে। সে অভিনয় এতই জীবন্ত যে, শ্যুটিং-এর সময় রেলস্টেশনে পাণ্ডারাই ধোঁকা খেয়ে গিয়ে রবি ঘোষকে এই মারে তো সেই মারে! এর পরেই তাঁকে নিয়ে তপন সিংহর অন্যতম সেরা চমক ‘গল্প হলেও সত্যি’। উত্তম-সুচিত্রার গ্ল্যামারের ভিড়েও যা আজকের কথায় প্রায় ‘ব্লকবাস্টার’ হয়ে গেল! এ ছবিতে আবার গানও গাইলেন তপনবাবু।
সাহিত্যিক বনফুল থাকতেন ভাগলপুরে। তিনি তখন ওখানকার নামকরা ডাক্তার-প্যাথোলজিস্ট। তপন সিংহের শৈশব-কৈশোর কেটেছে ওই ভাগলপুরেই। কিন্তু তখন গম্ভীর প্রকৃতির সেই মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস হয়নি। প্রায়ই দেখা যেত লাঠি হাতে সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি গায়ে, ধুতিটা লুঙ্গির মতো পরে নিজের ল্যাবরেটরিতে চলেছেন বনফুল। অনেক পরে সেই বনফুলের ছোট গল্প ‘অর্জুন কাকা’-কে নিয়ে ছবি করার খুব ইচ্ছে হল। ভয়ে ভয়ে চিঠি লিখে ফেললেন ভাগলপুরে। উত্তরও এল। তাতে লেখা, কোনও এক কাজে কলকাতায় আসছেন বনফুল। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এ তাঁর ছেলের ফ্ল্যাটে দেখা করতে হবে।জড়সড় হয়ে দুরু দুরু বুকে গেলেন সে-ফ্ল্যাটে। দেখা হল। কিশোরবেলায় দেখা বনফুলের সেই গাম্ভীর্য ভাবটা তখন কই! বনফুল বললেন, ‘‘কথা পরে হবে। আগে ভাগলপুর থেকে আম এনেছি, জর্দালু আম, একটু খেয়ে নাও। এ রকম আম কলকাতায় আর কোথায় পাবে?’’ এই এক কথাতে ভয়ের প্রাচীরটা যেন ভেঙে গেল। ‘অর্জুন কাকা’ নিয়ে ছবি হবে শুনে তার নামও ঠিক করে দিলেন বনফুল—‘আরোহী’। চিত্রনাট্য আগে শোনাতে চাইলে হেসে বললেন, ‘‘কিছু দরকার নেই। মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করে যাও।’’ টাকাপয়সা নিয়ে একটি কথাও বললেন না। ছবি তৈরি হল। কিন্তু মুক্তি নিয়ে নাটকীয় কাণ্ড!
রিলিজের আগে পশ্চিমবঙ্গের সব প্রেক্ষাগৃহের কর্মীরা হরতাল ডেকে বসলেন। খবরটা কানে যেতেই তপনবাবু ধরেই নিয়েছিলেন ছবির দফারফা! কিছুতেই আর রক্ষা পাওয়ার নয়। ছবির মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল মিনার-বিজলী-ছবিঘরে। তার আগে ছবিটা এক বার চালিয়ে শব্দ আর প্রজেক্টরের আলো প্রিন্ট অনুযায়ী ঠিক করা হবে। মুক্তির ঠিক দু’দিন আগের কথা। শূন্য হলে তপন সিংহ আর তাঁর কিছু সহকর্মী বসে। ছবি চলল। ওঁরা দেখলেন। সবার অজান্তে ইউনিয়নের কিছু লোকও দেখলেন। সেই যাঁরা হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু ছবি শেষে তাঁরা এত খুশি যে, হরতাল কিছু দিনের জন্য বন্ধ রেখে দিলেন। বাংলা ছায়াছবির ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কবে ঘটেছে, জানা নেই।
’৭০ সালের পর বেশ কিছু হিন্দি ছবি করেছেন তপন সিংহ। ‘সাগিনা মাহাতো’-র হিন্দি। ‘ক্ষণিকের অতিথি’-র হিন্দি ‘জিন্দেগী জিন্দেগী’, ‘সফেদ হাতি’, ‘আজ কা রবিনহুড’, ‘এক ডক্টর কী মওত’, ‘আনোখা মতি’। সেখানেও কারা না কারা সব অভিনয় করলেন— সায়রা বানু-ওয়াহিদা রহমান-শাবানা আজমি…।
’৭৮-এ ‘সফেদ হাতি’ তৈরির সময় সে আরেক অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটে। গল্পের নায়ক ঐরাবত নামে একটি শ্বেত হস্তি। অতএব সাদা হাতি চাই-ই চাই। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে তেমন হাতি? রেওয়াতে নাকি সাদা বাঘ আছে। লোকমুখে শোনা গেল, সেখানে সাদা হাতিও পাওয়া যায়। পরে খবর নিয়ে জানা গেল, বাজে কথা। কারা যেন বলল, বর্মায় সাদা হাতি পাওয়া যায়। সেটিও বাজে কথা। এর পরও হাতি কিন্তু ছবিতে সাদাই। কী করে এমনটা সম্ভব হল। রহস্য! তবে সমাধানটি হয়েছিল অতি সহজে। একটি বিখ্যাত রঙের কোম্পানি এক বিশেষ ধরনের সাদা রং তৈরি করে দিয়েছিলেন। যা দিয়ে হাতিকে রং করলেও তার শরীরের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। সাদা হাতির সমস্যা তো মিটল। কিন্তু একটি ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যের শ্যুটের সময় ঘটে গেল অদ্ভুত কাণ্ড।
ছবিতে একটি দৃশ্যে দেখানো হবে শিশু অভিনেতা শিবু গভীর জঙ্গলে হেঁটে যাচ্ছে, এমন সময় একটা চিতা বাঘ তার পিছু নেবে। হঠাৎ শিবুর নজরে আসে চিতাবাঘ তার পিছনে। সে প্রাণপণে দৌড়তে থাকে। চিতাবাঘও তার পিছনে পিছনে ছোটে। শ্যুটিং-এর জন্য ক্যামেরা নিয়ে জঙ্গলে ঢোকা শুরু হল। একটু বাদেই বিরাট হুঙ্কার। ফরেস্ট গার্ড হেসে বললেন, ‘‘বুনো হাতি! আমাদের এগোতে বারণ করছে।’’ শুনে ইউনিটের লোকজনের বুক শুকিয়ে কাঠ। তখনও কি জানা ছিল, আরও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটতে চলেছে একটু বাদেই। শ্যুটিঙের জন্যই খাঁচায় রাখা ছিল দুটো চিতা বাঘ। তার মধ্যে একটি আবার বেশ ‘দুষ্টু’। শিশু অভিনেতার বয়স মাত্র সাত-আট বছর। তার সঙ্গে চিতার শ্যুটিং। যথেষ্ট ভয়ের। তার ওপর একটা দৃশ্য আছে, যেখানে চিতাটা শিবুর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ক্যামেরা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে চিতাটাকে রাখা হল। শিবু বিশ গজ দূরে। দুজনেই ক্যামেরার দিকে ছুটবে, এই আশায়। ক্যামেরা চলল। ইশারায় চিতাকেও ছাড়া হল। চিতা এক বার এ দিকে তাকাল। তার পর ও দিকে। হঠাৎ লোকজনের মাথার ওপর দিয়ে এক বিরাট লাফ। সোজা গভীর জঙ্গলে ধাঁ। আর তাকে ফেরানো যায়নি।
‘আজ কা রবিনহুড’ করতে গিয়ে তো প্রাণেই মারা পড়ছিলেন। হাতির লাথি খেয়ে পাঁজর ভাঙল। তার পরও হাতিটা ছাড়েনি ওঁকে। পিষে মেরে ফেলার চেষ্টায় ছিল। কোনও ক্রমে বাঁচিয়েছিল মাহুত।
এমন এক বর্ণময় জীবনের শেষকালটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। স্ত্রী অরুন্ধতী চলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। এক সময় ছেলে রানা এলেন বিদেশ থেকে। তার স্ত্রী রয়ে গেলেন ও-বাড়িতেই। ছেলে যাতায়াত করতে লাগলেন। এর মাঝেই ‘দাদা সাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড’, স্বাধীনতার ষাট বছরে ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’…! পুরস্কার, সম্মান, তখন তাঁর জীবনে কতটুকু!
নিউ আলিপুরের তিন তলা বাড়িতে তখন তিনি প্রায় বন্দিই। শ্বাসের সমস্যা তো ছিলই। পেসমেকার বসানোর পর অদ্ভুত এক সমস্যা দেখা দিল। শরীর নিতে পারছিল না যন্ত্রটা। ভীষণ একা লাগত। পুরনো ছবি, পুরনো কথা ঘুরে বেড়াত চারপাশে। নিউ থিয়েটার্স… পঙ্কজ মল্লিক… রাইচাঁদ বড়াল… বিমল রায়ের সঙ্গ…! আর শৈশবের ভাগলপুর…। যে এক-দু’জন মাঝে মাঝে আসত-যেত তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন ছেঁড়া ছেঁড়া সেই স্মৃতির খেয়া। সে সময়েরই এক সাক্ষাৎকারে এক বার বলেছিলেন, ‘‘এখন কী ভাল লাগে জানো, বিকেলবেলা একান্তে বসে শুধু ‘গীতবিতান’-এর পাতা উল্টে যেতে। বারান্দায় বসে গীতবিতানের গান গুনগুন করি। কোনওটায় সুর আসে, কোনওটায় আসে না।…এখন যে রবীন্দ্রনাথই আমার আশ্রয়।’’
২০০৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি, সমস্ত আশ্রয়ের ঊর্ধ্বে উঠে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ‘আপনজন’।
(তথ্যসূত্র:
১- মনে পড়ে, তপন সিংহ, আনন্দ পাবলিশার্স।
২- কিছু ছায়া কিছু ছবি, তপন সিংহ, এম. সি. সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ (২০০৯)।
৩- চলচ্চিত্র আজীবন, তপন সিংহ, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত, দে’জ পাবলিশিং।
৪- তপন সিংহ: সার্বিক চলচ্চিত্র বীক্ষা, আবেশ কুমার দাস, সৃষ্টিসুখ প্রকাশন (২০১৬)।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ই মে ২০১৬ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা ২৬শে মার্চ ২০১৬ সাল।
৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে মার্চ ২০১৬ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত