১৯৬৪ সালের জুন মাসে যখন মাত্র ৫ ফুট উচ্চতার এক ব্যাক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে বসেছিলেন তখন অনেকে কল্পনাও করতে পারেনি যে ভারত একজন মহান ও প্রগতিশীল প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতের মহানতম প্রধানমন্ত্ৰীদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি দুই বছর সামান্যতম সময় অপচয় না করে ভারতের জন্য কাজ করেছিলেন। ভারতকে স্বনির্ভর ও আত্মবিশ্বাসী করার জন্য কাজ করতেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। ভারতের সর্বকালীন সাহসী প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী যিনি ‘জয় জওয়ান, জয় কিষান, জয় বিজ্ঞান’ স্লোগান দিয়ে নতুন যুগের জন্য ডাক দিয়েছিলেন।
যখন ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে তখন পাকিস্তান হাইটেক কামান ও ট্যাংক এ সমৃদ্ধ ছিল যা তারা তাদের মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে লাভ করেছিল। পাকিস্তানের কাছে অত্যাধুনিক প্যাটন ট্যাঙ্ক ছিল যার মধ্যমে পাকিস্তান সহজেই ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে ভারতীয় সৈনিকদের উপর আক্রমণ করতে পারতো। এই কারণে পাকিস্তান ভারতের সাথেও যুদ্ধ নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী হয়েও ছিল। অন্যদিকে ভারতের কাছে তখন ছিল ইউরোপিয়ান ট্যাঙ্ক যেগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রাক্কলে ব্যবহৃত হয়েছিল।
যাই হোক, তা সত্বেও ভারতীয় সেনা পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিল। দুই দেশের দ্বন্দ শুরুর প্রথম দিকে ভারত যুদ্ধ এড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল যার জন্য পুরো বিশ্ব ভাবতে শুরু করেছিল পাকিস্তান ভারতকে হারিয়ে দিচ্ছে। যার জন্য পাকিস্তান আরো উৎসাহিত হয়ে ভারতের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল। এরপরেই প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতীয় সেনা অফিসারদের সাথে তৎকালীন বৈঠক ডাকেন। শাস্ত্রী বলেছিলেন,
”অনেক হয়েছে! পাকিস্তান লাগাতার আমাদের এলাকায় অনুপ্রবেশ করছে, এবার সময় হয়েছে পুরো বিশ্বকে ভারতের শক্তি দেখানোর। আমরা লাহোর চাই যা তোমরা আমাকে এনে দেবে।”
এরপরই ভারতীয় সেনা এ.বি তারাপোরের নেতৃত্ব ১৯৬৫ এর যুদ্ধ জয়লাভ করে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী রাজস্থান ও পাঞ্জাব অঞ্চল দিয়ে ভারতীয় সেনাকে আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তান। পাকিস্তানের বহু প্যাটন ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে দেয় ভারতীয় সেনা এবং একই সাথে ২৮টি ট্যাঙ্ক দখল করে নেয়।
শিয়ালকোটে একটা বড়ো যুদ্ধের সাথে সাথে ভারতীয় সেনা লাহোর পর্যন্ত ঢুকে যায় এবং পাকিস্তান একটা বড়ো হারের সম্মুখীন হয়। শেষে পাকিস্থানের রাষ্ট্রপতি যুদ্ধ বিরামের ঘোষণা করে এবং রাষ্ট্রসংঘের দখলদারির জন্য পাকিস্থান সেবার ভারতের রুদ্ররূপ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৫ সালে ভারত খুবই আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল কারণ ভারত তখন শুধুমাত্র খাদ্য আমদানির উপর দাঁড়িয়ে ছিল এবং দুই বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬২ সালে ভারত চীনের সাথে এক যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। এই আর্থিক সংকটের মোকাবিলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী দেশবাসীকে একদিনের জন্য উপবাস থাকার অনুরোধ করেছিলেন যাতে ভারতের আর্থিক ভারসাম্য ঠিক থাকে। উল্লেখ্য শাস্ত্রী নিজেও সপ্তাহের প্রত্যেক সোমবার উপবাসে থাকতেন।
শুধুমাত্র কিছু কথার মাধ্যমে লালবাহাদুর শাস্ত্রীজির অবদান উল্লেখ করা অসম্ভব।
শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী-
৯ ই জুন ১৯৬৪ সাল থেকে ১১ ই জুন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী,
৯ ই জুন ১৯৬৪ সাল থেকে ১৮ ই জুলাই ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ভারতের বিদেশ মন্ত্রী,
৪ঠা এপ্রিল ১৯৬১ সাল থেকে ২৯শে আগষ্ট ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী,
১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভারতের রেল মন্ত্রী
ও
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ভারতের পুলিশ ও পরিবহন মন্ত্রী ছিলেন।
কিন্তু তাঁর পদই তাঁর পরিচয় নয়। কথায় বলে মানুষ বড় হয় তাঁর কর্মে।
১) তিনি গাঁন্ধীজির ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম ব্রিটিশ সরকারে হাতে বন্দী হন। কিন্তু নাবালক হবার জন্য ছাড়া পেয়ে যান।
২) ১৯৩০ সালে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগদানের জন্য তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন ও তাঁর আড়াই বছরের (২ বৎসর ৬ মাস) জেল হয়।
৩) এর পরে তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন ১৯৪০ সালে ও তার পরে আবার ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি জেলে বন্দী ছিলেন।
৪) স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের জন্য তাঁকে মোট ৯ বছর জেলে কাটাতে হয়।
৫) তিনি দেশের প্রথম পরিবহন মন্ত্রী যিনি সরকারী পরিবহনে প্রথম বারের জন্য মহিলা কন্ডাক্টর নিয়োগ চালু করেন।
৬) তিনি প্রথম বারের জন্য ক্ষিপ্ত জনতাকে ছত্রভঙ্গের জন্য পুলিশের লাঠি চালানোর পরিবর্তে জল কামানের ব্যাবহার শুরু করান (পুলিশ মন্ত্রী হিসাবে)।
৭) তিনি দেশের প্রথম রেল মন্ত্রী যিনি কোন রেল দূর্ঘটনার নৈতিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন (১৯৫৬ সালের মেহবুব নগরের রেল দূর্ঘটনার পরে)।
৮) কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি প্রথম বারের জন্য দেশে দূর্নীতি নিরোধক কমিটি নিয়োগ করেন।
এখানেই শেষ নয়।
ধারের টাকায় খাচ্ছি ঘি! প্রবাদ দীর্ঘদিনের। বাস্তবেও বারবার ফিরে আসছে এরকম ‘ঘি’-খাইয়েদের অবতার। বর্তমানে সেই ‘ঘি খাইয়েদের খবর’ আমরা সংবাদমাধ্যমে অহরহ দেখেছি। সকলেরই নজরে এসেছে দেশজুড়ে তোলপাড় করা ব্যাংক জালিয়াতির সংবাদগুলো। কিন্তু সকলে যে এক নন, তার বড় প্রমাণ দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও তাঁর স্ত্রী ললিতাদেবী।
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (পিএনবি) থেকে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন লালবাহাদুর। তাঁর মৃত্যুর পর পেনশন বিক্রি করেই সেই ঋণ শোধ করেছিলেন স্ত্রী ললিতা।
প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর তখন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ছিল অতি সাধারণ জীবনযাবন। কৃচ্ছসাধন তাঁর জীবনের ব্রত। কম যেতেন না তাঁর স্ত্রী ললিতাও। কৃচ্ছসাধন আর সততার ব্রত থেকেই স্বামীর মৃত্যুর পরও ঋণ শোধ করা থেকে পিছিয়ে আসেননি তিনি। সেজন্যই নিজের পেনশন বিক্রি করেছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী।
গোটা ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী’র পুত্র অনিল শাস্ত্রীর বক্তব্যে,
“তখন আমরা রোজ টাঙ্গায় চড়ে স্কুলে যেতাম। সেন্ট কলম্বাস স্কুলে পড়তাম। ভাগ্য ভালো থাকলে কখনও সখনও সরকারি গাড়িতে স্কুল পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ পেতাম। কিন্তু বাবা তা পছন্দ করতেন না। পরিবারের সদস্যরা ব্যক্তিগত কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করবে, তা মোটেই চাইতেন না তিনি। তাই একটা নিজস্ব গাড়ি কেনার দাবি ক্রমেই বাড়িতে তীব্র হয়ে উঠতে থাকে।”
তখন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ছিলেন ভি এস বেঙ্কটরামন। খোঁজখবর করার পর তাঁর কাছ থেকে শাস্ত্রী পরিবার জানতে পারে, একটা নতুন ফিয়েট গাড়ি কিনতে খরচ হবে ১২ হাজার টাকা। কিন্তু শাস্ত্রী পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তখন মাত্র সাত হাজার টাকা রয়েছে। তাই বাকি পাঁচ হাজার টাকার জন্য লালবাহাদুর ব্যাঙ্ক ঋণের আবেদন জানান। ওইদিনই সেই ঋণ মঞ্জুরও হয়ে যায়। শাস্ত্রী পরিবারে এল ক্রিম কালারের নতুন ফিয়েট গাড়ি। ১৯৬৪ সালের মডেল। গাড়ির নম্বর ডিএলই ৬।
কিন্তু শাস্ত্রী পরিবারের উপর বিপর্যয় নামতে দেরি হল না। ১৯৬৬ সাল। পাক যুদ্ধের প্রেক্ষিতে একটি শান্তি চুক্তি করতে লালবাহাদুর তখন তাসকন্দে। সেখানে ১১ই জানুয়ারি মৃত্যু হল তাঁর। পিএনবি থেকে নেওয়া ঋণ তখনও শোধ হয়নি।
অনিল শাস্ত্রী জানিয়েছিলেন, “বাবার মৃত্যুর পর মা যে পেনশন পেতেন, তা থেকেই তিনি সেই ঋণ শোধ করেছিলেন।”
আর শাস্ত্রী পরিবারের সেই ক্রিম রঙা ফিয়েট গাড়ির বর্তমান ঠিকানা দিল্লির ১, মতিলাল নেহরু মার্গের লালবাহাদুর শাস্ত্রী মেমোরিয়াল।
উত্তর প্রদেশের বারাণসী থেকে সাত মাইল দূরে মোঘলসরাই রেল স্টেশন সন্নিহিত এক ছোট্ট শহরে শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জন্ম হয় ১৯০৪ সালের ২রা অক্টোবর। তাঁর পিতা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর বয়স যখন মাত্র দেড় বছর তখনই তাঁর বাবা মারা যান। তাঁর মায়ের বয়স তখন মাত্র ২০। তিনি তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে পিতৃ গৃহে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন।
ছোট্ট শহরে লাল বাহাদুরের স্কুল জীবন খুব একটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। কিন্তু দারিদ্র্যের মধ্যেও তাঁর শৈশব কেটেছে হাসি-খুশি ও খেলাধূলার মাধ্যমে।
হাইস্কুলে পড়াশোনার জন্য তাঁকে পাঠানো হয় বারাণসীতে এক কাকার কাছে। তখন তাঁর ডাকনাম ছিল নানহে, অর্থাৎ ছোট্ট খোকা। তখন তাঁদের পায়ের জুতো কেনারও সামর্থ্য ছিল না। তাই ছোট্ট লাল বাহাদুরকে প্রখর গ্রীষ্মেও খালি পায়ে অনেক মাইল হেঁটে স্কুল যাতায়াত করতে হত।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্য ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি লাল বাহাদুর আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থন করার জন্য মহাত্মা গান্ধী ঐ সময় ভারতীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে যে কোন ধরণের সংশ্রব ত্যাগ করেন। এই ঘটনা লাল বাহাদুরের মনে বিশেষ দাগ কেটেছিল। তাঁর বয়স ছিল তখন মাত্র ১১। কিন্তু দেশের জাতীয় প্রেক্ষাপটে তাঁর ভবিষ্যৎ ভূমিকার সূচনা কিন্তু তখনই দেখা দিয়েছিল।
মহাত্মা গান্ধী যখন অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের জন্য দেশবাসীর উদ্দেশে আহ্বান জানিয়েছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। গান্ধীজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখাপড়া ছেড়ে তিনি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মায়ের সমস্ত আশা তখন বিলীন হয়ে গেলেও কোনভাবেই লাল বাহাদুরকে আর ফিরিয়ে আনা গেল না। কারণ, তিনি তখন মনস্থির করেই ফেলেছেন যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করবেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন যে লাল বাহাদুরকে কোনভাবেই আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বাইরে খুব নরম প্রকৃতির মানুষ হলেও মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা।
লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বারাণসীর কাশী বিদ্যাপীঠে যোগ দিলেন। ব্রিটিশ শাসনকে অগ্রাহ্য করে যে ক’টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল কাশী বিদ্যাপীঠ ছিল তারই অন্যতম। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি দেশের চিন্তাবিদ, মনস্বী ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের সংস্পর্শে এলেন। এই বিদ্যাপীঠ থেকে ‘শাস্ত্রী’ অর্থাৎ এক স্নাতক ডিগ্রি তিনি লাভ করলেন। পরে, তাঁর নামের সঙ্গে ‘শাস্ত্রী’ কথাটি অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে যায়।
১৯২৭ সালে লাল বাহাদুরের নিজের শহরের অদূরেই মির্জাপুরের মেয়ে ললিতা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ের সম্বন্ধ হয় এবং সেখানেই তিনি ললিতার সঙ্গেই বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। যাবতীয় সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি মেনেই বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। বরপণ হিসেবে তাঁকে দেওয়া হয় একটি চরকা ও তাতে বোনা কাপড়। কারণ, এর থেকে বেশি কিছু গ্রহণ করতে লাল বাহাদুর অসম্মত হন।
১৯৩০ সালে সাম্রাজ্যবাদী লবণ আইন ভঙ্গ করতে মহাত্মা গান্ধী ডান্ডি অভিযান করেন। সারা দেশ তাঁর এই প্রতীকী প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। কোনরকম পিছুটান না রেখেই লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য দীর্ঘ সাত বছর তাঁকে ব্রিটিশের কারাগারে কাটাতে হয়। এই সমস্ত ঘটনা তাঁর মনকে আরও দৃঢ় ও শক্তিশালী করে তোলে বিদেশী অপশাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার সঙ্কল্প নিয়ে।
স্বাধীনতার পরেই ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। আপাত শান্ত লাল বাহাদুরের মধ্যে যে এক তেজস্বী ও দীপ্ত মানসিকতা রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই দেশের নেতারা তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই, ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস সরকার গঠিত হওয়ার পর দেশের শাসন ব্যবস্থায় এক গঠনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ডাক দেওয়া হল তাঁকে। নিজের রাজ্য উত্তর প্রদেশে তাঁকে সংসদীয় সচিব নিযুক্ত করা হয়। অচিরেই তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হল। তাঁর কঠোর শ্রম ও দক্ষতার কথা উত্তর প্রদেশের দিনগুলি থেকেই লোকের মুখে মুখে ফিরত। ১৯৫১ সালে নয়াদিল্লিতে এসে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকটি দপ্তর একে একে সামলাতে শুরু করলেন। রেল, পরিবহণ ও যোগাযোগ, শিল্প ও বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী থাকার সময় তাঁর দক্ষতা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন তিনি। পণ্ডিত নেহরুর অসুস্থতার সময় তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। আর, এইভাবেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তাঁর গুরুত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। এক রেল দুর্ঘটনায় বহু প্রাণহানির ঘটনার দায় স্বীকার করে নিয়ে তিনি রেলমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। তাঁর এই নজিরবিহীন ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা সংসদ তথা সমগ্র দেশবাসীর ভূয়সী প্রশংসা এনে দিয়েছিল। এই ঘটনা সম্পর্কে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সংসদে ভাষণদানকালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সংহত মানসিকতা ও মহান আদর্শবাদের কথার সপ্রশংস উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, লাল বাহাদুরের রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগপত্র তিনি খুশি মনেই গ্রহণ করছেন। কারণ, সাংবিধানিক দিক থেকে তা খুবই যুক্তিপূর্ণ যদিও সকলেই অবগত যে রেল দুর্ঘটনার জন্য লাল বাহাদুরজি কোনভাবেই দায়ী নন। রেল দুর্ঘটনার ওপর দীর্ঘ বিতর্কের জবাবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বলেছিলেন, “সম্ভবত আমি খর্বকায় ও মৃদুভাষী হওয়ায় দেশবাসী মনে করেন আমি হয়তো দৃঢ়চেতা নই। শারীরিক দিক থেকে বলবান না হলেও আমি মনে করি ভেতরে ভেতরে কিন্তু আমি মোটেই দুর্বল নই।”
মন্ত্রীত্বের কাজে যুক্ত থাকার অবসরেও লাল বাহাদুর শাস্ত্রী কংগ্রেসের সাংগঠনিক দিকটি দেখাশোনা করে গেছেন। ১৯৫২ , ১৯৫৭ এবং ১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের ব্যাপক জয়ের পেছনে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও নিরলস শ্রমের যে এক বিরাট অবদান ছিল একথা দেশবাসী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।
লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর দীর্ঘ কর্মজীবন ছিল ৩০ বছরেরও বেশি। এই সময়কালে একজন দক্ষ ও দৃঢ় মানসিকতার মানুষ বলেই তিনি পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন সাধারণের প্রতিভূ। অথচ আচার-আচরণে তিনি ছিলেন খুবই বিনয়ী ও সংযমী। কিন্তু মনেপ্রাণে এবং সংকল্পে তিনি ছিলেন খুবই শক্তিশালী ও অবিচল। সাধারণ মানুষকে বোঝার ক্ষমতা তাঁর ছিল অসাধারণ। দেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন এক কাণ্ডারী। মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক শিক্ষাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। “কঠোর পরিশ্রম প্রার্থনারই সমতুল্য” – একথাই মনে করতেন তিনি। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও ঐতিহ্য অনুসরণ করেই লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ভারতীয় সংস্কৃতিতে আজও অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
ভারতের একমাত্র যে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে মারা গিয়েছিলেন, তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রী। জওহরলাল নেহরুর পর তিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু, দায়িত্ব নেওয়ার দু’বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও সেই মৃত্যু নিয়ে নানা জল্পনা ছড়িয়েছিল সেই সময়ে। আজও যে সে সব রহস্য উন্মোচিত হয়েছে, এমনটা নয়।
১৯৬৪ সালের ৯ই জুন লালবাহাদুর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেন। তার ঠিক কয়েক দিন আগেই ২৭শে মে জওহরলালের মৃত্যু হয়। দীর্ঘ দিনের কংগ্রেস কর্মী এবং জওহরলালের মন্ত্রিসভার সদস্য লালবাহাদুর সম্পর্কে দলের মনোভাব ভালই ছিল। কিন্তু, গোল বাধে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে। জওহর-কন্যা ইন্দিরা গাঁধীর সঙ্গেও তাঁর ভাল সম্পর্ক ক্রমে কেবল সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছিল বলে শোনা যায়।
১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে তাসখন্দ চুক্তি সম্পন্ন করতে সেখানে গিয়েছিলেন লালবাহাদুর। আর সে মাসের ১১ তারিখ রাতে হোটেলের ঘরেই তাঁর মৃত্যু হয়। সরকারি ভাবে জানানো হয় তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। কিন্তু, তাঁর পরিবারের সদস্যরা এই মৃত্যুর পিছনে রহস্য আছে বলে দাবি করেন। আজও সেই দাবি থেকে তাঁরা সরে আসেননি। বারে বারেই তাঁরা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু-রহস্যের ‘গোপন’ ফাইল প্রকাশের দাবি তুলেছেন।
লালবাহাদুর পুত্র অনলি শাস্ত্রী কয়েক বছর আগেও সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তাঁর বাবার দেহ যখন দিল্লি বিমানবন্দরে নামানো হয় তখন গোটা শরীরটা নীল হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। লালবাহাদুরের মুখটা পর্যন্ত নীল হয়ে গিয়েছিল। কপালের দু’পাশে স্পষ্ট সাদা ছোপও দেখেছিলেন অনিল। তাঁর মা ললিতাদেবী নাকি তখনই বলেছিলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।
লালবাহাদুর প্রথমে মুঘলসরাইয়ে পূর্ব-মধ্য রেলের আন্ত-কলেজে এবং পরে বারাণসীতে হরিশচন্দ্র হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে গান্ধীজি বারাণসীতে উচ্চশিক্ষার জন্য কাশী বিদ্যাপীঠের উদ্বোধন করেন। সেই বিদ্যাপীঠেরই প্রথম পর্যায়ের ছাত্র ছিলেন লালবাহাদুর। প্রথম শ্রেণীর স্নাতক হওয়ার পর বিদ্যাপীঠ তাঁকে শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত করে। সেই থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে শাস্ত্রী জুড়ে যায়। আর কখনও তিনি শ্রীবাস্তব বা কায়স্থ হিসাবে বর্মা পদবী ব্যবহার করেননি। এরই পাশাপাশি কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়া। গান্ধীজি এবং জওহরলালের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা। শেষে জওহরলালের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নেওয়া।
কিন্তু, মৃত্যু নিয়ে এত জলঘোলা বোধহয় আর কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে হয়নি। অনিল শাস্ত্রী যেমন দাবি করেছিলেন, ‘‘আমিও ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যে বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না। খুব জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়, কিন্তু মনে হয় তদন্তে যথেষ্ট গাফিলতি হয়েছে। কেউই তো শাস্তি পায়নি।’’
কেন স্বাভাবিক নয়? অনিলের দাবি ছিল, তাঁর বাবা নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। সেখানে অনেক খুঁটিনাটি কথা লেখা থাকত। কিন্তু লালবাহাদুরের মৃত্যুর পর থেকে ওই ডায়েরিরও কোনও হদিশ মেলেনি। যেমন খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁর সঙ্গে যে ফ্লাস্কটি ছিল সেটিরও। হতে পারে সেখানেই এমন কিছু মেশানো হয়েছিল যার জেরে লালবাহাদুরের মৃত্যু হয়। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং সচিবও দুর্ঘটনার শিকার হন। দুইজনেরই দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু হয়। ওই দু’জনকেও তদন্ত কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল। দু’-দু’বার এমন সমাপতন খুবই আশ্চর্যজনক বলে মত দিয়েছিলেন অনিল।
ওই ঘটনার পর তাসখন্দের হোটেলে লালবাহাদুরের যে খানসামা ছিল, তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনিও ছাড়া পেয়ে যান। পরে অনিলের মা তাসখন্দে গিয়ে সেই খানসামার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁকে নাকি জানানো হয়, ওই খানসামাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হোটেলে লালবাহাদুর যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরে তাঁর খাটের পাশেই একটা ছোট্ট টেবিলে সেই রাতে রাখা ছিল একটা থার্মোফ্লাস্কও। অনিলের কথায়, ‘‘বাবার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার আর এন চুঘ রাতে বাবাকে দেখতে গিয়ে টেবিলে ওই থার্মোফ্লাস্কটি দেখেছিলেন। বাবার রাতে গরম দুধ খেয়ে ঘুমোনোর অভ্যাস ছিল। হয়তো সেই জন্যই ওই থার্মোফ্লাস্কটি রাখা হয়েছিল। কিন্তু, ওই থার্মোফ্লাস্কটিরও আর হদিশ পাওয়া যায়নি। তাই, ওই থার্মোফ্লাস্কে দুধই ছিল নাকি অন্য কিছু, এখনও পর্যন্ত আমরা তা জানতে পারিনি। আমার তো মনে হয়, বাবার মৃত্যু-রহস্যের কারণ লুকিয়ে রয়েছে ওই থার্মোফ্লাস্কেই!’’
নিয়মিত ডায়েরি লেখারও অভ্যাস ছিল প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর। অনিল বলেছেন, ‘‘বাবার সেই ডায়েরিও পরে আর পাওয়া যায়নি। ওই দিনই সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বড় একটি চুক্তি হয়েছিল। বাবা হয়তো সেই চুক্তির কথা তাঁর ডায়েরিতে লিখেও রেখেছিলেন। কিন্তু, কী লিখেছিলেন, তা আজও আমরা কেউ জানতে পারিনি।’
কেউ কেউ দাবি করেন তাসখন্দে শাস্ত্রীর দেখা হয়েছিল নেতাজির সাথে। কেউ আবার দাবি করেন যে নেতাজি কোথায় রয়েছেন তা শাস্ত্রী জানতেন। কেউ আবার বলেন যে তাঁর মৃত্যুর পিছনে রয়েছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার ষড়যন্ত্র ও হাত।
নেতাজির মতন তাঁরাও জীবনের শেষ মুহুর্ত নিয়ে কুয়াশা ঘনীভূত হয়েছে। এবং সময়ের সাথে সাথেই সেই কুয়াশা আরও গাঢ় হচ্ছে। প্রশ্ন একটাই, নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য ও শাস্ত্রী মৃত্যু রহস্য কি কোনও দিন উন্মোচিত হবে? হয়ত সময়ই সেই উত্তর দিতে পারবে।
(তথ্যসূত্র:
১- Modern Thought Leaders, New Delhi Lal Bahadur Shastri Institute Of Management, Mcgraw Hill Education (২০১৫)।
২- Lal Bahadur Shastri: Prime Minister of India 1964-1966: A Life of Truth in Politics, C.P Srivastava, Oxford University Press (১৯৯৫)।
৩- lal Bahadur Shastri: Lessons in Leadership, Pavan Choudary and Anil Shastri, Wisdom village publications (২০১৫)।
৪- Political Mysteries, K. R. Malkani, Prabhat Prakashan (২০১১)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত