লাল মলাটের মোটা একটা খাতা। সেটা বাগিয়ে ধরে ক্লাস সিক্সের মেয়ে অনুনয় বিনয় করছে ভাইবোনেদের— এই একটু শোন না…। কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই বেমালুম হাওয়া।— ‘‘এই রে, দিদি আবার গল্প শোনাবে!’’ কিন্তু খুদে গল্পকারও নাছোড়। শেষে লজেন্স, মিষ্টি, এমনকী পাঁচ-দশ পয়সার মরিয়া ঘুষ। গল্প সে শোনাবেই। তবু শ্রোতা পালায়, দিদি যে বড্ড দুঃখের গল্প লেখে। শুনলেই কান্না পায়।
তাঁর মনের কল্পনাগুলো কলম বেয়ে পাতা ভরিয়ে তোলা শুরু সেই ছোট্ট বয়স থেকেই। ইউনাইটেড মিশনারি গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীর প্রথম লেখা বেরোয় স্কুল ম্যাগাজিনে। ছড়া, ‘চড়ুই’। তার দু’টো লাইন,
‘‘কিচিরমিচির তোমার ডাকে মুগ্ধ হয়ে থাকি,
বড় ভাল লাগে আমার তোমাদের এই দল।’’
তারও আগের কথা। তাঁর বয়স তখন বছর ছয়। শিশুতীর্থে দুই মেয়েকে নাচ-গানের নানা অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিয়েছিলেন তাঁর দাদামশাই। সেখান থেকেই ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমায় মিনির বন্ধুর চরিত্রে প্রথম পর্দায় এসেছিলেন তিনি। তার পর ‘হারানো সুর’-এ, সীতাহরণ পালা। তাঁর মুখ থেকেই জানা গিয়েছিল, শুটিংয়ের ফাঁকে তাঁরা খেলছিলেন। হঠাৎ সামনের একটা বড় গাড়ি থেকে ‘উফ্ কী গরম’ বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন দুই অভিনেত্রী। সুচিত্রা সেন আর চন্দ্রাবতী দেবী। নেমেই তাঁদের দেখে আলাপ করতে গিয়ে বললেন, ‘‘নাম কী তোমাদের?’’ তিনি বলতেন, “যেই বলেছি আমার নাম সুচিত্রা, ওনার সে কী হাসি!”
খুব ভাল নাচতেন তিনি। দক্ষিণীর ছাত্রী ছিলেন। পাড়ার বিজয়া সম্মেলনী হোক বা ভাইবোনেদের ঘরোয়া অনুষ্ঠান, বাকিদের নাচ শেখানো ছিল ‘বুড়ি’র দায়িত্ব। তাঁর ডাকনাম। তবে সবটাই থাকত একটা লক্ষ্মণরেখার মধ্যে। একবার পুজোয় সালোয়ার কামিজ পরতে দেখে তাঁর জ্যাঠামশাই করুণাশঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘‘এ সব কী? বাড়ির মেয়েরা এ বার সিনেমায় নামবে নাকি?’’ তাঁর বাড়ি ছিল এতটাই রক্ষণশীল।
অথচ সেই বাড়ি থেকেই কি না বুড়ি প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করল!
তাঁর বয়সটা তখন সতেরো। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। খুব ঘনিষ্ঠ ক’জন বন্ধু, জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো পাঁচ বোনের জোট ছাড়া কাকপক্ষীতে টের পায়নি সে কথা। অথচ পাত্র ছিল পাড়ারই ছেলে। কনের বাড়ি থেকে তাকালেই দেখা যায় তাঁদের বাড়ি। তিনি ক্লাস এইট থেকেই শাড়ি পড়তেন। তাই একটু ঝকঝকে শাড়ি পরে বেরনোটা বাড়ির কারও তেমন নজর কাড়েনি। বরং তাঁর হবু স্বামীকেই বন্ধুর পাঞ্জাবি ধার করে পরতে হয়েছিল। রেজিস্ট্রির পর দু’জনে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু মেয়ের এমন দুঃসাহস তাঁর বাবা মেনে নেননি। পালিয়ে বিয়ে করলে যা হয়, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল।
বিয়ের পর নিদারুণ দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে একটা সময় গিয়ে উঠেছিলেন নাজিরবাগানে। এক কামরার চিলতে ঘর। দরমার পার্টিশন করা বারান্দায় রান্না। আর বাথরুম কিছুটা দূরে। ইট পাতা উঠোন পেরিয়ে টিনের চালের তলায়। সেই যে লেক প্লেস ছেড়ে ঢাকুরিয়ায় ঢোকা, এলাকাটা আর ছাড়া হল না। এর পর একটা সময় মুকুল আর কল্পা নামে দুই বন্ধুর সঙ্গে প্রত্যেক দিন শ্মশানে গিয়ে বসে থাকাটা নেশার মতো হয়েছিল। কেন? জানতে চাইলে বলতেন, ‘‘আমার ভাল লাগে।’’ জীবনকে আরও কাছ থেকে জানার চেষ্টা ছিল হয়তো।
কেমিস্ট্রি নিয়ে লেডি ব্রেবোর্ন ভর্তি হলেও খুব অল্প বয়সে মাতৃত্ব সামলাতে গিয়ে কলেজ ছাড়তে হয়েছিল। তবে নির্বাসন ঘুচে তৈরি হয়েছিল বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ। পরে যোগমায়ায় বাংলা নিয়ে পড়তে ঢোকেন। কিন্তু কলেজে ব্যাগ থেকে খাতার বদলে মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে পড়ত মেয়ের মোজা বা ফিডিং বোতল। এক দিন ক্লাসে ঢুকতে ফের দেরি হওয়ায় অধ্যাপিকা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘সুচিত্রা, তোমার কন্যা কি আজও মলত্যাগ করেছে?’’
তাঁর কাণ্ডকারখানা বলে শেষ করার নয়। একদিন হঠাৎ একটা ব্লাড সার্কুলেটরি ম্যাসাজার কিনে ফেলেছিলেন। মেশিনটায় উঠে দাঁড়ালে থরহরি কাঁপে। তাতে শরীরের রক্ত চলাচল নাকি ভাল হবে। হার্টের ইজেকশ ফ্যাক্টর বাড়বে। সে তো হল। একদিন এক তরুণ ডাক্তার বাড়িতে এসেছেন। তাঁকে সেই যন্ত্রে উঠিয়ে মেশিন চালিয়ে দিলেন। বেচারি তো আচমকা পায়ের তলার জমি কেঁপে ওঠায় ভয়ে শুকিয়ে কাঠ। খালি বলছিলেন, ‘‘সুচিত্রাদি বন্ধ করুন।’’ আর তিনি তত বলেছিলেন, ‘‘না না অন্তত তিরিশ সেকেন্ড না হলে কোনও উপকারই হবে না।’’
চাকরি জীবন শুরু করেন পরপর কয়েকটা ছোটখাট কাজ দিয়ে। তার পর ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে। সেই অফিসে এক বার ‘শাহজাহান’ নাটক হবে। পরিচালনা করবেন গীতা দে। তাতে পেয়ারি বাঈয়ের চরিত্র করেছিলেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। এর পর থেকে গীতা দে বলতেন, ‘‘সুচিত্রা আমার ছাত্রী।’’
ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ’৭৯-তে ‘ওজন ও পরিমাপ’ দফতরে চাকরি পেয়েছিলেন। ২০০৩-এ স্বেচ্ছা অবসর নেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার হয়ে। প্রথম পোস্টিং ছিল ব্যারাকপুর। সে জীবনও ঘটনাবহুল। একটি ঘটনার কথা জানানো যাক। তাঁর দায়িত্বে ছিল সল্ট লেক থেকে কাঁচরাপাড়া। এক দিন সোদপুরের কাছে একটা তেলের ট্যাঙ্কার ‘সিজ’ করেন সুচিত্রা। মাস দুই পরে ট্যাঙ্কারের পঞ্জাবি মালিক গাড়ি ছাড়ানোর সরকারি অর্ডার নিয়ে হাজির হলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই রিলিজ-সই করে দিলেন। কিন্তু সেই পঞ্জাবি ভদ্রলোক কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, বিনা খরচায় কাজটা এত সহজে কী করে হয়ে গেল! শেষে বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘দু’মাসে আমার খরচ কম হয়নি ম্যাডাম। বাঙালিরা বলে হাঁস ডিম পাড়ে, খেয়ে যায় দারোগাবাবু। কিন্তু আপনি এমনি এমনি ছেড়ে দিলেন? দিদি এটা আপনার লাইনই নয়। আপনার স্কুলে পড়ানো উচিত!’’
জাল বাটখারা চক্র ধরায় তাঁকে গুন্ডারা শাসিয়েছিল। বেআইনি লাইসেন্স দিতে রাজি না হওয়ায় চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন এক সিনিয়র। কিন্তু টলানো যায়নি। মানুষটা সেই তখন থেকে নির্ভীক, আপসহীন।
সাহিত্যিক বিমল কর এক বার ‘গল্পপত্র’ পত্রিকায় তাঁর লেখা দেখে বলেছিলেন, ‘‘সুচিত্রা তোমার কলমের জোর আছে। নিজের চেনা জগৎটা নিয়ে লেখো। না হলে কিন্তু আমি হাত ভেঙে দেব।’’ তিনি বলতেন, ‘‘ওটাই আমার টার্নিং পয়েন্ট।’’
তাঁর সব লেখালেখির ভিতটা বাস্তব অভিজ্ঞতা। তারই পরত থেকে উঠে আসা বলে চরিত্ররা এত জীবন্ত। প্রতিটা লেখার নেপথ্যে আছে কোনও না কোনও সত্যি কাহিনি।
যেমন চাকরিজীবনের প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘আমি রাইকিশোরী’। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, চিনা, তিব্বতী, যে সব মেয়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন, তাঁদের জীবন যুদ্ধের গল্প। তার সঙ্গে নিজের কথাও।
একবার লেখা শেষ করে পাণ্ডুলিপি জমা দিলেন এক পত্রিকা দফতরে। কিন্তু লেখাটা মনোনীত হয়নি। পাণ্ডুলিপিটা হাতে করে বাড়ি ফিরে বলেছিলেন, ‘‘মরা বাচ্চা কোলে করে ফিরলাম।’’ উপন্যাসটা পরে অবশ্য অন্য এক পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল।
লেখালেখি, সাহিত্য, এ সবের বাইরে সুচিত্রার আরেকটা জগৎ ছিল। তিনি অসম্ভব ভালবাসতেন গীতা দত্তের গান। গন্ধরাজ, জুঁই ফুল। আর সমুদ্র। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন রীতিমতো ভোজনরসিক। নিরামিষ নয়। মটন, চিংড়ি, বিরিয়ানি, রাবড়ি, চাইনিজ। ভালবাসতেন রাঁধতে। একবার পাঁচতারা রেস্তোরাঁর শেফ-এর থেকে ইয়াখনি পোলাও শিখে এসেছিলেন। কিন্তু সেটা বাড়িতে রেঁধে সবাইকে না খাওয়ানো পর্যন্ত শান্তি হয়নি। অথচ অদ্ভুত, তার পরই টিভিতে একটা রান্নার শো-এ ডাক পেয়েছিলেন। তখন তিনি ভেবে অস্থির হয়েছিলেন, কী রাঁধবেন!
সারপ্রাইজ দিতে খুব ভালবাসতেন। দুষ্টু হেসে ভুরু নাচিয়ে কাছের মানুষদের বলতেন, ‘‘কী রে, কেমন দিলাম, বল!’’
তাঁর হঠাৎ করে বিদায় নেওয়া নিয়ে তাঁর সহোদরা কন্যা মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, “বারো তারিখও দফায় দফায় ফোনে আড্ডা হয়েছে। ভূমিকম্প নিয়ে, লেখা নিয়ে, বেড়ানো নিয়ে। রাত সাড়ে ন’টায় শেষ বারের মতো হোয়াটস অ্যাপে লিখল, ‘‘বেশি ইয়ার্কি মেরো না, মাটি যে দিন সত্যিই কাঁপবে, বুঝবে।’’ — এক ঘণ্টার মধ্যে সত্যিই এমন কম্পন, আমাদের চারপাশটা পাল্টে গেল পাকাপাকি! তা-ও এখনও কেমন মনে হচ্ছে, মুনা-মা এই বুঝি দরজা ঠেলে বেরিয়ে বলবে, ‘‘কেমন দিলাম, বল! …’’
সুচিত্রা ভট্টাচার্যকে নিয়ে কথা বলতে গেলে, আমাদের অবশ্যম্ভাবী বিশ্বে লেখিকাদের সংগ্রামের ইতিহাস ও প্রবণতা জানতে হয়। তাঁর সাহিত্যকীর্তির বিচারের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। খুব সংক্ষেপে বুঝাতে গলে অন্তত দু’টি উদাহরণ এখানে দেওয়া প্রয়োজন।
এক) বিপ্লবপূর্ব চীনের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মাও জে দং একবার বলেছিলেন, অন্যান্য দেশ বিপ্লবের জন্য যেখানে তিনটি স্তর (সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ) অতিক্রম করতে হয়, আমাদের সেখানে আরো একটি স্তর পার হতে হয়েছে। এই চতুর্থ স্তরটি হলো পুরুষতন্ত্র। কথাটা সাহিত্যের ময়দানেও সত্য। এখানে নারী-পুরুষ কোনো প্রসঙ্গ নয়, বরং সাহিত্যগুণই প্রধান বিবেচ্য হওয়ার কথা। যদিও সাহিত্য হচ্ছে সমাজের অগ্রবর্তীতার পরিচয়। তথাপি, ভাল লেখার পরও লেখিকাদের পুরুষ লেখকদের সঙ্গে লড়তে হয়। অনেক সাহিত্যিককে শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে লেখালেখিতে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। যে কারণে আমার দেখি, বিশ্বসাহিত্যে অনেক বিখ্যাত নারী সাহিত্যিক সুবিচার পাওয়া জন্য, কৌশল হিসেবে নিজের নাম আড়াল করে পুরুষের ছদ্মনামে লিখছেন।
ঊনবিংশ শতকের লেখিকাদের মধ্যে ‘ব্রাইড অ্যান্ড প্রিজুডিস’, ‘সেন্স অ্যান্ড সেনসিবিলিটি’র লেখিকা জেন অস্টেন লিখেন ‘আ লেডি’ নামে। ‘ভ্যালেন্টাইন’, ‘ইন্ডিয়ানা’ গ্রন্থের রচয়িতা আমানতিনে-লুসিল-অররে দুদেভান লিখেন ‘জর্জ স্যন্ড’ নামে; ঊনবিংশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত উপন্যাস ‘মিডেলমার্চ’-এর লেখিকা ও সাংবাদিক মেরি আন ইভাস লিখেন ‘জর্জ এলিয়ট’ নামে। আবার ‘জেন আয়ার’, ‘অথারিং হাইটস’ গ্রন্থের লেখিকা শার্লট এমিলে আনে (সংক্ষেপে শার্লট ব্রন্টি) নামের প্রতিটি শব্দে লুকিয়ে আছে তিন বোনের নাম। শার্লট= কারার বেল, এমিলি =এ্যালিম বেল এবং আনে =এ্যাকটন বেল। সাহিত্যের ইতিহাসে তারা ‘দ্য ব্রন্টি সিস্টার’ বলে খ্যাত। বিশ শতকে এসেও এই আঁধার কাটে না। ফলে ‘ম্যারি পুপেল’ ও বহু ধারাবাহিকের রচয়িতা পালেমা ল্যান্ডন ট্র্যাভারস-এর নাম হয়ে যায় পি এল ট্র্যাভারস; বিপুল জনপ্রিয় ‘ইন ডেথ’ (১২ খণ্ডে লেখা) লেখিকা নোরা রবার্টসের কলমি নাম হয়ে যায় জে ডি রব; ‘ফিপটি শেডস অফ গ্রে’ উপন্যাস ত্রয়ীর লেখিকা এরিকা লিওনার্দ লেখেন ই এল জেমস নামে। এমনকি হালেও, হ্যারিপটার সিরিজের লেখিকার জে কে রাওলিংয়ের নামের নিচে ঢাকা পরে জোয়ান রাউলিং নাম। নামের মাঝে ‘কে’ অক্ষরটিও প্রকাশকের অনুরোধে বসিয়ে দেয়া। ‘রবার্ট গ্যালব্রেইথ’ নামেও লিখেছেন তিনি।
দুই) আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমনই, যেখানে পরিবারে একজন পুরুষ সদ্য খ্যাতিমান হয়ে উঠলে নিচে চাপা পড়ে যায় সেই পরিবারের নারী সদস্যের কীর্তি। এই উদাহরণ খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারেই দেখতে পাই। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের কীর্তির পাশে ঢাকা পড়ে গেছেন তাঁর বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী(১৮৫৫-১৯৩২)। অথচ তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক লেখিকা। যিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি, সংগীতকার ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। অথচ তার খবর আমরা কতটুকুই বা রাখি! একইভাবে বাংলা সাহিত্যে আমরা যে ক’জন বিশ্বমানের সাহিত্যিকের দেখা পাই, সে অনুপাতে লেখিকা দেখতে পাই না। সমাজের অগ্রবর্তী বা ক্ষমতাশালী অংশের মানুষ হিসেবে পুরুষরা একটু এগিয়ে থাকবে এটা স্বাভাবিক বলা যায়। কিন্তু তাদের ঔজ্জ্বল্যের পাশে নারীরা ম্লান হয়ে যান। যে কারণে নারী সাহিত্যিকরা দ্রুতই বিস্মৃত হন। আবার আজকের দিনে শুধুমাত্র ‘নারী সাহিত্যিক’ এই পরিচয়ে অনেককে পাঠক-সমালোচকের করুণা পাওয়ার চেষ্টা করতেও দেখা যায়।
এইটুকু আবশ্যিক তথ্য মনে রেখে আমরা যখন সুচিত্রা ভট্টাচার্যের দিকে তাকাই দেখি তখনো নারী সাহিত্যিকরা নিপাট সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। সুচিত্রা ভট্টাচার্য যখন থেকে লেখালেখি শুরু করেন, তখন সময় বা সমাজ নারী সাহিত্যিকদের স্বাগত জানানোর জন্য কতটা প্রস্তুত ছিল এ প্রশ্ন একেবারে অবান্তর নয়। অবশ্য আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, নবনীতা দেব সেনের হাত ধরে তা অনেকটাই শক্ত ভীতের উপর দাঁড়িয়ে গেছে। সুতরাং সুচিত্রা ভট্টাচার্য যখন নিজ নামে, সাহিত্য বিচারেই প্রতিষ্ঠা পান তখন এ কথা ভাবার অবকাশ আছে, তিনি সুসাহিত্যিকই ছিলেন।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য সাহিত্যিক অবস্থান এতটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, অনেক সৌভাগ্যবান লেখকের মতো লেখালেখিতে পূর্ণ সময় দেয়ার জন্য তিনি ২০০৪ সালে কাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে পেরেছিলেন। এ বিষয়টি অনুধাবনের জন্য আমাদের মনে রাখতে হয় যে, সুচিত্রা ভট্টাচার্য ভারতের একজন বাঙালি লেখিকা। যেখানে প্রত্যাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে জীবন ধারণই কঠিন। এটাও ঠিক যে, আর্থিক অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকি দূর করার জন্য তাঁকে যথেষ্ট জনপ্রিয় ধারার দিকে ঝুঁকতে হয়েছিল। এটা ঠিক, এই জনপ্রিয়তা নিশ্চিত রাখতে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট ট্র্যাকে আটকে গিয়েছিলেন তিনি। ফলে জীবন-সম্পর্ক ও উপন্যাসের আঙ্গিক নিয়ে ভাষা ও গণ্ডির বাইরে বের হতে পারেননি। আবার তাঁর জনপ্রিয়তা যখন ‘দেশ’ পত্রিকা বা ‘আনন্দ’ পাবলিকেশন্সে আটকে পড়ে, তা তাঁর সাহিত্যিক মর্যাদাকে অনেকটা খাটো করে।
ভারতের বিহারের ভাগলপুরে মামার বাড়িতে সুচিত্রা ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ১০ই জানুয়ারি। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক থাকলেও পরিণত বয়সেই তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হন। এ সময় বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার কারণে সাহিত্যে কিছুটা ছেদ পড়ে। তবে ফিরে আসতে সময় লাগে নি। তার আগে তিনি কলকাতা শহরের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে স্নাতক করেন। মূলত কলকাতা শহরে তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবন কাটে। ফলে তাঁর সাহিত্যের অন্যতম উপজীব্য হচ্ছে শহুরে জীবনের নানা দিক। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের দেখা কলকাতা বুঝতে হলে তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু ও তৎকালের কলকাতার অবস্থা বুঝতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে কলকাতার মন্বন্তর, ’৪৭-এ দেশ ভাগ উত্তর সময়ে দারিদ্র, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রেশ তখনো কাটেনি। তার ওপর কলকাতাতে শুরু হওয়া ভারত কাঁপানো ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’-এর রেশটুকু তখন কঠোর হাতে দমন করেছে রাষ্ট্র। ফলে রাষ্ট্রে স্থিতি আসেনি। সামাজিক অবক্ষয় যথেষ্ট গভীর। এমন এক প্রেক্ষাপটে সমকালীন সামাজিক ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের গল্প গড়ে ওঠে। শহুরে মধ্যবিত্তদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে নৈতিক অবক্ষয়, যুগের পরিবর্তনশীল নীতিবোধ হয়ে ওঠে তার গল্পের বিষয়বস্তু।
সাহিত্যে নারী-ভাষ্য তৈরির একটি তাগিদ ছিল সব সময়ই। সাহিত্যে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা অনুযায়ী নির্যাতিতার ভাষায় তৈরি হবে তার মুক্তির সনদ। তাই নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণা তাঁর রচনার মূল উপজীব্য বিষয়ে পরিণত হয়। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে তিনি বহু ছোটগল্প এবং চব্বিশটি উপন্যাস রচনা করেছেন। মূলত ছোটগল্প দিয়েই তিনি সাহিত্যে প্রবেশ করেন। সময়টা তখন সত্তরের দশকের শেষের দিক। ছোটগল্পে তাঁর বিপুল সাফল্য তাঁকে আশির দশকের মধ্যভাগে উপন্যাস রচনায় উৎসাহিত করে। তবে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তার শুরু নব্বইয়ের দশকে।
তাঁর উপন্যাসে প্রায়শ বহুস্বরের উপস্থিতি দেখা যায়। মেজাজের দিক দিয়ে তা বৈঠকি ঢঙের। মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত জীবন এবং এর টানাপোড়েন নিয়ে তাঁর অধিকাংশ লেখা হলেও মেয়েদের জীবনের নিজস্ব জগতের যন্ত্রণা, সমস্যার কথা ও সম্পর্কের জটিলতার চিত্রও তিনি বারবার তুলে এনেছেন। সুচিত্রা ভট্টাচার্য সব সময় সমাজ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কোনো তত্ত্বীয় আবর্তে নিজেকে আবদ্ধ না করে ঘাত-প্রতিঘাত আর বাস্তবতার মাঝে দেখিয়ে দিয়েছেন নারীর দৈন্য অবস্থান। সূক্ষ্ম প্রতীকি ব্যঞ্জনায় চরিত্র ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি ঘটনার নিবিড় বুনোট তাঁর কথাসাহিত্যের অন্যতম শক্তি। ‘অদ্ভূত আঁধার এক’ আধুনিক মধ্যবিত্ত সমাজকে নিয়ে লেখা তাঁর নাতিদীর্ঘ উপন্যাস। এই ছোট্ট পরিধির উপন্যাসটিতে নিঃসন্দেহে একটি গোটা জীবন আঁকতে চেষ্টা করেছেন। শেষপর্যন্ত তিনি বলতে চেয়েছেন, ব্যক্তি নয়, আসলে এক অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থাই অসামাজিক কাজের সৃষ্টি করে। গল্পের চরিত্ররা পরিস্থিতির শিকার মাত্র। তাঁর সাহিত্যে পরিমিতি বোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
তাঁর একই ধরনের উপন্যাস ‘দহন’। বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লিখিতি এই উপন্যাস একজন গৃহবধূ ও একজন সাবলম্বী স্কুল শিক্ষিকার জীবন সংগ্রাম এবং তাদের কেন্দ্র করে পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে লেখা। নারী-স্বাধীনতার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন, সমাজের নপুংসক আর ঠুনকো মুল্যবোধ সামনে এনে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এ উপন্যাসের জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর শাশ্বতী সংস্থা থেকে পেয়েছেন ননজনাগুড়ু থিরুমালাম্বা জাতীয় পুরস্কার। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষ ১৯৯৭ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যা বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া ‘ইচ্ছে’, ‘রামধনু’, ‘অলীক সুখ’-এর মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে তাঁর লেখা থেকে।
তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘কাছের মানুষ’ সবিস্তারে লিখেছেন তিনি। অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ চরিত্রায়ণের এই উপন্যাসই তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। ‘অন্য বসন্ত’ উপন্যাসে তাঁকে অনেক বেশি সমাজ ঘনিষ্ঠ হতে দেখা যায়। এ ছাড়া তাঁর গোয়েন্দা চরিত্র ‘মিতিন মাসি’ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বেশকিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলো হলো- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী মেডেল (২০০৪), কথা পুরস্কার (১৯৯৭), তারাশংকর পুরস্কার (২০০০), দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কার (২০০১), শরৎ পুরস্কার, ভারত নির্মাণ পুরস্কার, সাহিত্য সেতু পুরস্কার, শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি।
লেখালেখি ছাড়াও সমাজ সচেতনতার জায়গা থেকে রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনায় তাঁকে আমরা বহুবার সরব হতে দেখেছি। একটি ঘটনায় নির্যাতিত হয়ে শর্মিলা বসু ও দুই কন্যা স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করলে সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেন, ‘একজন মহিলাকে কোন পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছামৃত্যুর দাবি জানাতে হচ্ছে, …স্বেচ্ছামৃত্যু কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এটা পলায়নবাদী মানসিকতা।’ অর্থাৎ তিনি এই পলায়ন সমর্থন করতেন না। কিন্তু গত ১২ মে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এই গুণী লেখিকা চির প্রস্থানের পথে গমন করেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। জনপ্রিয়ধারার হলেও নারীদের একজন হয়ে তাদের নিজস্ব জগতের কথা, যন্ত্রণা, সমস্যা আর উপলব্ধির কথাই তিনি পাঠকদের শুনিয়েছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মিক সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে নারী কণ্ঠে নারী স্বরেরই প্রতিধ্বনি শুনেছি আমরা তাঁর লেখায়।
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী ও জনপ্রিয় কথানির্মাতা সুচিত্রা ভট্টাচার্য জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন কলকাতায়। শহরের মধ্যবিত্ত জীবন, সংসারের টানাপড়েন, দাম্পত্য সংকট ও সম্ভাবনা, নারীর সামাজিক অবস্থান, মানুষের মানুষে সম্পর্ক, নারীর সঙ্গে নারীর মিত্রত্ব-শত্র“তা, সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত, কিশোরদের রহস্যাচ্ছন্ন মন, নারী-পুরুষের প্রেম, জীবনের বিচিত্র জটিলতা, বয়স্কদের পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা তার কথাসাহিত্যের বিষয়-আশয়। লেখালেখি শুরু করেছেন কম বয়সে। আমৃত্যু চালিয়ে গেছেন সেই চর্চা। বিয়ের পর সামান্য বিরতি ছিল বটে।- এমনটা বাঙালি নারীর জন্য একেবারেই স্বাভাবিক। নতুন পরিবেশের মানুষদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে খানিকটা সময় লাগে। অনেককে আবার পড়তে হয় প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও। কিন্তু মনে-প্রাণে লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্য প্রাতিস্বিকতা থেকে দূরে সরে যাননি। ২০০৪ সাল থেকে তো সরকারি চাকরি ছেড়ে পূর্ণকালীন লেখকজীবন পার করেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। হয়েছিলেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও। কিন্তু লেখকসত্তা তাকে চাকরিতে স্থিত হতে দেয়নি। নব্বইয়ের দশকে কলকাতাসহ সারা ভারতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন কথাসাহিত্যিক সুচিত্রা। বাঁচতে চেয়েছেন সাহিত্য-সাধনার ভেতর দিয়ে। তবে মৃত্যুচিন্তা তার সাহিত্য ভাবনায় প্রবেশ করেছে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে। ‘আত্মজা’ নামক গল্পের শুরুটি পাঠ করে তার মৃত্যুচিন্তা সম্বন্ধে আমরা একটা ধারণা নিতে পারি- ‘মা আজ চলে গেল। একটু আগে বৈদ্যুতিক চুল্লির গহ্বরে ঢুকে গেছে মা। পুড়ছে। পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আমার যেন এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।’- সুচিত্রার মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ভারতের অনেক নামি-দামি শিল্পী-সাহিত্যিক-মিডিয়াকর্মী-অভিনেতা-নির্মাতা প্রায় একই সুরে বলেছিলেন- ‘তার মৃত্যুটা বিশ্বাস করতে পারছি না।’
মোট ২৪টি উপন্যাস এবং ২ শতাধিক ছোটগল্প লিখেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। পাঠকপ্রিয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘কাছের মানুষ’, ‘দহন’, ‘হেমন্তের পাখি’, ‘নীলঘূর্ণি’, ‘অলীক সুখ’, ‘ভাঙনকালে’, ‘তিনকন্যা’, ‘এখন হৃদয়’, ‘অন্য বসন্ত’, ‘ভালো মেয়ে খারাপ মেয়ে’, ‘পালাবার পথ নেই’, ‘অচিন পাখি’, ‘জোনাথনের বাড়ির ভূত’, ‘মেঘ পাহাড়’, ‘প্রেম-অপ্রেম’, ‘অর্ধেক আকাশ’, ‘গভীর অসুখ’, ‘চার দেয়াল’, ‘১০১ প্রেমের গল্প’, ‘কেরালায় কিস্তিমাত’, ‘পরবাস’, ‘ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য’, ‘জলছবি’, ‘আয়নামহল’, ‘একা’, ‘শেষবেলায়’। ‘তিন মিতিন’ তার জনপ্রিয় গোয়েন্দাকাহিনী। কাহিনীর গোয়েন্দা চরিত্র ‘মিতিন মাসি’ পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছে। সমকালের সরব কণ্ঠস্বর সুচিত্রা ভট্টাচার্যের রচনা ভারতের বিভিন্ন ভাষা- হিন্দি, তামিল, তেলেগু, মালায়লাম, ওড়িয়া, মারাঠী, গুজরাটি, পাঞ্জাবিসহ ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সাহিত্যিক জীবন দায় আর দায়িত্বের আবর্তে ঘেরা। লেখক পরিচিতি ধারণ করে তিনি কখনও কোনো সামাজিক সুবিধা নিতে চাননি। বরং সমাজে প্রবাহিত করতে চেয়েছেন ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া। প্রসঙ্গত, তুরস্কের কথানির্মাতা ওরহান পামুকের নোবেল ভাষণ থেকে খানিকটা অংশ উদ্ধৃত করছি-‘লেখক এমন একজন যে বছরের পর বছর ধৈর্য ধরে তার নিজের ভেতরের দ্বিতীয় সত্তা আবিষ্কারের চেষ্টায় থাকে এবং সেই সত্তাই তাকে নিরূপণ করে সে আসলে কে? কোনোকিছু লেখার কথা বলি যখন প্রথমেই যা মনে আসে আমার তা কোনো উপন্যাস, কবিতা বা সাহিত্যিক প্রথা নয়। বরং সেই লোকটিই আবির্ভূত হয় যে নিজেকে একটি ঘরে বন্দি রেখে টেবিলে বসে সব ধরনের অন্ধকারের মাঝে নিজের অন্তরটা আলগা করে, শব্দের পর শব্দ গেঁথে নতুন এক বিশ্ব সৃষ্টি করে।… মাঝে মধ্যে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা ছাড়িয়ে দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারে যেখানে হয়তো রাস্তায় ছেলেরা খেলা করছে বা ভাগ্যবান হলে গাছ-গাছালি বা অন্য কোনো দৃশ্য অথবা কালো কোনো দেয়ালের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারে।… লেখালেখির কাজ হচ্ছে অন্তর্নিহিত দৃষ্টিকে শব্দে রূপ দেয়া, বিশ্বকে নিরীক্ষণ করা যেখানে ব্যক্তি নিজেকে নিজের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ধৈর্য ও উৎফুল্ল মনে কাজটি করে।’ (‘বাবার সুটকেস’, অনুবাদ: ইরফান বাবুন, নোবেল ভাষণ: বাক্ থেকে পামুক: পাঁচ মহাদেশের দশ সাহিত্যরথী, ভূমিকা ও সম্পাদনা: হায়াৎ মামুদ, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ২০০৮, পৃষ্ঠা- ১১৮) – পামুকের এ চিন্তার সঙ্গে সুচিত্রার সাহিত্য-সাধনার যোগসূত্র রয়েছে। তিনি জীবনকে দেখেছেন একটি বিশেষ দর্শন থেকে এবং তা প্রকাশ করতে চেয়েছেন নিজের অনুভবকে সচেতন পাঠকের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। সাধারণের কাছে চিন্তার শক্তি পৌঁছে দেয়াও তার একটি অভিলক্ষ্য বটে। পরিচিতি-সুনাম কিংবা পুরস্কারের মোহ তার ছিল না। কেবল ছিল সমাজকে ঠিকঠাকমতো কাজ করতে দেয়ার রাস্তা বাতলে দেয়ার অভিপ্রায়।
বৈঠকী মেজাজ আর হাসিখুশি মুখের মানুষ সুচিত্রা ভট্টাচার্য রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাতেও সরব ছিলেন। এটি ছিল তার সামাজিক দায়বোধের প্রকাশ। তিনি কলম ও মুখ চালিয়েছেন সমানতালে- সাহসের সঙ্গে। আমরা তাকে পেয়েছি কাগজে ও রাস্তায়- চরিত্রসৃষ্টির উন্মাদনায়, মিছিলে-সমাবেশে, মানববন্ধনে কিংবা আলোচনার টেবিলে ও টেলিভিশনের পর্দায়। নারী সমাজের প্রতিনিধি হয়ে নারীর জীবনকে সুচিত্রা সাহিত্যে তুলে ধরেছেন শৈল্পিক আবহে। ভারতে নারীর অবস্থান এখনও ঠিক মর্যাদার জায়গাটা খুঁজে পায়নি। নানানভাবে নারীরা বঞ্চনার শিকার। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে কোনো কোনো নারী ভারতে বেশ প্রভাবের সঙ্গে বিচরণ করলেও প্রান্তিক পর্যায়ে নারীসমাজ ভয়ানকভাবে অনগ্রসর। বিশেষ করে পরিবারে নিজের অবস্থান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর সামাজিক স্থান আজও নির্ধারিত হয়নি। তারা যেন পুরুষের হাতের ক্রীড়নক মাত্র। নারীর সামাজিক মর্যাদা-বিষয়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সরব সাহিত্য ‘দহন’, ‘রামধনু, ‘অলীক সুখ’ প্রভৃতি পাঠকপ্রিয় কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে চলচ্চিত্রও। ধর্ষণের শিকার এক নারীর জীবন-যন্ত্রণার সাহিত্যিক-শৈল্পিক দলিল তার ‘দহন’। ভারতে ধর্ষণ একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাড়িতে, চলন্ত বাসে, পথে-ঘাটে নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। এ চিত্র সুচিত্রাকে ভাবিয়ে তুলেছে। ‘আমি রাই কিশোরী’ সুচিত্রার নারীবাদী চিন্তার উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ। ‘কাঁচের দেয়াল’ আরেকটি পাঠকপ্রিয় রচনা, যেটি কলকাতার বিখ্যাত নাটকের দল ‘থিয়েটারওয়ালা’ প্রথম নাট্য-প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চস্থ করেছে। মানুষের দিকে সুচিত্রার আন্তরিক নিবিড় দৃষ্টি সবসময়ই নিবদ্ধ ছিল। জীবনের বাঁক আর উত্থান-পতনের ছবি তাকে আকৃষ্ট করেছে। তার সমগ্র সাহিত্যে নাটকীয়তা একটি বিশেষ গুণ। কাহিনীগুলো প্রায় সবই মঞ্চায়নের দাবি রাখে। জীবননাট্যের এক জীবন্ত শিল্পী যেন তিনি। সুচিত্রার দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশশৈলী অত্যন্ত সরল ও প্রাণবন্ত। এ-প্রসঙ্গে কলকাতার স্বনামখ্যাত নাট্য-অভিনেত্রী বিদীপ্তা চক্রবর্তী মন্তব্য করেছিলেন – ‘ওঁর যে কোনো লেখা পড়েই মনে হতো, এটা থেকে নাটক হতে পারে।’ (সূত্র: ‘শেষযাত্রায় সুচিত্রা, আনন্দবাজার পত্রিকা,১৩ই মে ২০১৫) প্রখর চোখে মানুষের জীবন-নাটক থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন সুচিত্রা। মানুষকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে নিয়োজিত এ শিল্পী সাহিত্যচর্চার জন্য জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
নিজের কালের এক নীরব বিপ্লবী প্রতিনিধি সুচিত্রা সমকালকে সমালোচনা করেছেন তীব্রভাবে। পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য একেবারেই লেখেননি সুচিত্রা। তিনি তার সময়ের মানুষের চিন্তার উঠানে বিচরণ করেছেন চেতনা ও পরিবর্তনের বারতা নিয়ে। মানুষকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। উপলব্ধির জায়গাটায় টানতে চেয়েছেন একটা মৃদু কিংবা প্রবল আঁচড়। আধুনিকতার সব মাল-মশলার সরব-স্বচ্ছ উপস্থিতি ছিল তার চিন্তায় ও কর্মে। সাহসী এ নারীর কাহিনীতে মুখ্য চরিত্রও নারী। অশিক্ষা, অনগ্রসরতা আর অসচেতনতা যে মানুষের জীবনে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়, তা সুচিত্রা অনুভব করেছেন। সুন্দরভাবে সেই অনুভূতি সবার জন্য লিখে প্রকাশও করেছেন। ‘আত্মজা’ গল্পটি শেষে কথক তার মৃত মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। কাহিনীর শেষটা তুলে দিচ্ছি –
‘বাবলু…? মার গলা। মারই গলা! এও কি বিভ্রম? আমার পা মাটিতে গেঁথে গেল। সম্মোহিতের মতো বলে উঠেছি- কী হল মা? কিছু বলবে! চেনা স্বর কেমন দুলে দুলে গেল, আমায় মাপ করে দিস বাবলু! মৃত্যুটা যে আমার হাতে ছিল না রে!’
সুচিত্রার গলা আর আমরা কোন দিন শুনতে পাব না, আর কোন পুজো সংখ্যায় তাঁর কোনো লেখা প্রকাশ হবে না। হয়তো কিছু অপ্রকাশিত লেখার খোঁজখবর পাওয়া যাবে। চেনা স্বরের এ মানুষটিকে কি আমরা কেবল মাপ করেই ক্ষান্ত হব?- নাকি মনেও রাখব কিছুকাল? মরণ কি চিরতরে থামিয়ে দেবে তাঁর সারা জীবনের সাধনা ও সংগ্রাম?
(তথ্যসূত্র:
১- ২৩শে মে ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রীমতী সুচিত্রা ভট্টাচার্যের স্মৃতিচারণে সহোদরা কন্যা শ্রীমতী মহাশ্বেতা ভট্টাচার্যের লিখিত প্রবন্ধ।
২- যুগান্তর পত্রিকা, ১৫ই মে ২০১৫ সাল।
৩- শেষযাত্রায় সুচিত্রা, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ই মে ২০১৫ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত