নবীন প্রজন্মের একের পর এক অভিনেতা অভিনেত্রীরা সরব হচ্ছেন মোদি-অমিতদের ধর্মান্ধ ও বিভেদের রাজনীতি এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষায়তনে বিজেপির গুণ্ডাদের হামলার বিরুদ্ধে। এই প্রতিবাদে নবতম সংযোজন দীপিকা পাড়ুকোন। এর আগে বলিউডের নবীন প্রজন্মের আলিয়া ভাট, ফারহান আখতার, তাপসী পান্নু, দিয়া মির্জা, অনুরাগ কাশ্যপ, বিশাল ভরদ্বাজ, জোয়া আখতার, রিচা চাড্ডারাও সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। এনআরসি, ক্যা, এনপিআরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বলিউডের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই সামিল হলেও পুরনো ও পরিচিত মুখগুলি এখনও নীরব। বচ্চন পরিবার সহ তিন বিখ্যাত খানেরা এমন একটা জলন্ত প্রশ্নে নীরব কেন তা আমার জানা নেই! এখনও যদি দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের পরিচিত ব্যাক্তিত্বরা মুখ না খোলেন তবে তাদের সংবেদনশীলতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।
আমি জানি পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বহু পরিচিত সৃজনশীল মানুষ বিজেপির দেশ পরিচালনার নীতির প্রবল বিরোধী তবুও তারা প্রতিবাদ করতে ভয় পাচ্ছেন। পাছে চিহ্নিত হয়ে যান এই ভয় পাচ্ছেন তারা। সরকারি প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হওয়ারও ভয় আছে, তাই জল মাপছেন। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা! এই ঘটনা আমরা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বেও দেখেছি। বহু বুদ্ধিজীবী তখন চরম অমানবিক অন্যায় হচ্ছে দেখেও শাসকদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে মুখ খোলেননি। আজ কিন্তু আপনাদের স্পষ্ট করে জানাতে হবে কোন পথে আপনারা হাঁটতে চান? বিজেপির দেশবিরোধী, জনবিরোধী দেশের অর্থনীতি-ইতিহাস-ভূগোল গুলিয়ে দেওয়া পথ না দেশের সব ধর্ম –বর্ণ-জাতির মানুষদের নিয়ে সুস্থ বিকাশের রাস্তায় হাঁটার পথ? দেশ আজ এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর আপনাদের কাছে চাইছে। তা না হলে মানুষ আপনাদের সুবিধাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করবে।
আমি কিন্তু বিশেষ কোন দলের সমর্থন বা বিরোধিতা করার কথা বলছি না। বলছি যে কোন ইস্যুতে মানুষ হিসেবে একটা সামাজিক অবস্থান নেওয়ার কথা। তা না হলে আপনি নিজেকে মানুষ হিসেবেই প্রমাণ করতে পারবেন না। যেমন করেছেন দীপিকা পাড়ুকোন। জেএনইউতে এভিবিপির গুণ্ডামির প্রতিবাদে তিনি ছাত্রছাত্রীদের অবস্থানে তিনি হাজির হয়েছিলেন। এটাই হল স্পষ্ট করে নিজের অবস্থান জানানো। আপনি সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি, আরবান নকশাল যা কিছু হতে পারেন কিন্তু নিজের বিশ্বাসটা স্পষ্ট করে জানাতে ভয় পেলে চলবে না। আমার অনেক সাংবাদিক বন্ধুরও এই সমস্যা আছে। যেন সাংবাদিকতা মানে শুধুই কিছু লেখা বা ছবি তোলা বা বুম ধরে মানুষকে কিছু জানানো। তারা যেন সমাজ বহির্ভূত জীব, সামাজিক প্রশ্নে তাদের কোন আগ্রহ নেই। এই মানসিকতা থেকে তাদেরও বেরিয়ে এসে আজ স্পষ্ট করে বিভিন্ন প্রশ্নে নিজের মত জানাতে হবে তাদের।
অমর্ত্য সেনের মত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদও যখন আমার নিজের কোন বার্থ সার্টিফিকেট নেই বলে এনআরসি, ক্যা’র বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন তখনও আপনারা চুপ করে আছেন কেন? কীসের ভয় আপনাদের? দেশটাই যদি না থাকে তাহলে আপনাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, কবিতা, গান, নাটক, সিনেমা থাকবে কোথায়? আর কোন আমলে দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের ব্যাক্তিত্বদের একটা বড় অংশকে এমন ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকায় দেখা যায়নি।
গোটা দেশের মানুষ স্পষ্টতই দুভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। একদল বিজেপির বিরুদ্ধে নীরব আরেকদল সরব। আপনাকে একটা পক্ষ নিতেই হবে। কোন পক্ষ নেবেন সেটা আপনিই ঠিক করুন। মনে রাখবেন, নিরপেক্ষ বলে কিছু হয় না, সেটাও একটা পক্ষ। পথে ঘাটে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গ্রামে, শহরে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি ও গুণ্ডামির শিকার যারা হচ্ছেন তারা আপনার আমারই মা, বোন, বন্ধু, দাদা, ভাই যে কেউ হতে পারেন। এখন নীরব থাকলে আগামীকাল এই আক্রমণ নিশ্চিতভাবে আপনার, আমার ওপর আসবে। তাই পক্ষ আপনাকে নিতেই হবে।
আরেকটা মজার ঘটনা ঘটছে যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের বলা হচ্ছে এই প্রতিবাদ স্রেফ লোক দেখানো, স্রেফ পাবলিসিটির জন্য। দীপিকা পাড়ুকোনের বিরুদ্ধেও এই হাস্যকর অভিযোগ করা হয়েছে। আমি বলি, জোর গলায় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা বা প্রকাশ্যে কিছু জানানো যদি পাবলিসিটি হয় তাহলে তা করার অধিকার দেশের প্রতিটি মানুষের আছে। কারণ প্রতিবাদ না থাকলে দেশের আজকের শাসকরা ‘পাবলিক’ কথাটাকেই অভিধান থেকে তুলে দেবেন।
প্রাপ্তিযোগের আশায় খ্যাতির শীর্ষে ওঠা দেশের বেশ কিছু পরিচিত নাম এখনও মুখ খুলছেন না স্রেফ ব্র্যান্ড ভ্যালু নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে। নীরবতা ও সুবিধাবাদ কিন্তু আপনাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু ইতিমধ্যেই কতটা কমিয়ে দিয়েছে তা আপনারা নিজেরাই জানেন না! তাই বলছি, পক্ষ নিন, বলুন আপনি কোন পথ চান? বিজেপির সন্ত্রাস, গুণ্ডামি আর ধর্মান্ধতা না সব মানুষকে নিয়ে দেশের সুস্থ বিকাশ?
ছাত্র রাজনীতি করার সময় শেখা একটা গান মনে পড়ে গেলঃ
“বন্ধু কোরো না দেরি উত্তর দাও, বলতে হবে তুমি কোন পথ চাও?
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত