তিনি সচরাচর কোনও সভা-সমিতিতে যেতেন না। সে বার ‘কলিকাতা সাহিত্যিকা’-র অধিবেশনে গিয়েছেন নতুন গল্প পড়তে। পড়তে উঠে ব্যাগ খুলে হঠাৎ বললেন, ‘‘ওই যাঃ! আমার গল্পটা ঠিক রাস্তায় পড়ে গেছে! আজই লিখেছি। ব্যাগে ভরেওছি! কোথায় যে পড়ে গেল! এখন… কী পড়ি!’’ তাঁর কথা শুনে সবাই ভাবছেন, ‘আশাপূর্ণা দেবী পথে গল্প হারিয়ে ফেললেন। তা হলে কি ওঁর গল্পপাঠ শোনা যাবে না!’ সংস্থার সভাপতি স্বপনবুড়ো মানে অখিল নিয়োগী বললেন, ‘‘আজই যখন গল্পটা লিখেছেন, তখন গরম-গরম মনে আছে নিশ্চয়। মুখে মুখেই বলে দিন না।’’ শ্রোতাদের নিরাশ করেননি। আশাপূর্ণা দেবী সে দিন স্মৃতি থেকে মুখে মুখেই পুরো গল্পটা শুনিয়েছিলেন!
তাঁর পুত্রবধূ শ্রীমতী নূপুর গুপ্ত তখন ক্লাস নাইনে পড়েন। মা-মাসিদের সঙ্গে একদিন পাড়াতে তাঁর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। পাড়া মানে, তখন বেলতলা। সে সময় সপরিবার আশাপূর্ণা দেবী ভাড়া থাকতেন ৭৭ বেলতলা রোডে। তখন তাঁর বেশ নাম। নূপুর দেবী খুব অবাক হয়েছিলেন। প্রথম আলাপেই আশাপূর্ণা দেবী আত্মীয়তা করে নিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে। তিনিনি নিজের হাতে সাধারণ মেয়েদের মতো আতিথেয়তা করেছিলেন।
সেই নূপুর দেবী যখন আঠারো হলেন, তাঁর বাবা-মা আশাপূর্ণাদেবীর ছেলে সুশান্তর সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। তিনি এককথায় রাজি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, মেয়েটিকে তো আমি দেখেছি।’’ সেই ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয়েছিল আশাপূর্ণা পুত্র সুশান্তের সাথে নূপুর দেবীর। লেখিকা আশাপূর্ণা তাঁর শাশুড়ি মা হলেন। নূপুর দেবী তখন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়ছিলেন। তাঁর চিন্তা ছিল, যৌথ পরিবারে বিয়ের পরে পড়তে দেবেন তো? আশাপূর্ণা তাঁকে বিন্দুমাত্র বাধা দেননি। বরং উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ওই বাড়িতে স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের নিয়ে নূপুর দেবীর খুড়শ্বশুরও থাকতেন। আর তাঁরা চারজন। আশাপূর্ণা খেয়াল রাখতেন, কেউ যেন নূপুর দেবীর কোন ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা না করতে পারেন। পুত্রবধূ নূপুর গুপ্তের ভাষ্যে, “বিয়ের পরে যত দেখেছি, মনে হয়েছে আর পাঁচজন সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের মতো গিন্নিই ছিলেন উনি। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ।”
কী শোকে, কী আনন্দে, কী অভাবে আশ্চর্যরকম স্থির থাকতেন আশাপূর্ণা। বাইশ-তেইশ বছরের ছেলের মৃত্যুও তাঁকে সইতে হয়েছিল! শোক তাঁকে বহু দিন বিপর্যস্ত করে রেখেছিল। কিন্তু তাতে সংসারে দৈনন্দিন কাজে কখনও অবহেলা করেননি। যে দিন তাঁর স্বামী চলে গেলেন, তখনও ভাঙা মন নিয়েও নিত্যদিনের কাজে ফিরে এসেছেন দ্রুত! তাঁর জীবন জুড়ে গভীর আধ্যাত্মিকতা ছিল। দুঃসহ শোকেও তিনি বলতেন, ‘ঠাকুর, তোমার কত দয়া’!
তিনি ছোটতে খুব ডাকাবুকো ছিলেন। ঘুড়ি যেমন ওড়াতেন, তেমনই বাধ্য মেয়েও ছিলেন। আশাপূর্ণার জন্ম হয় উত্তর কলকাতায়, পটলডাঙায় তাঁর মামাবাড়িতে। বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন সে যুগের শিল্পী। মা সরলাসুন্দরীর ছিল বই-অন্ত প্রাণ। বৃন্দাবন বসু লেনের শরিকি বাড়ি থেকে হরেন্দ্রনাথ যখন তাঁর পরিবার নিয়ে আপার সার্কুলার রোডে উঠে এলেন, আশাপূর্ণার বয়স তখন সাড়ে পাঁচ বছর। ভাইবোন মিলিয়ে ঘরে নয়জন। তিনি ছিলেন পঞ্চম।
বৃন্দাবন বসু লেনের বাড়িতে ছেলেদের জন্য মাস্টারমশাই আসতেন। মেয়েদের অবশ্য নিষেধ ছিল সেই পাঠে যোগ দেওয়ায়। কখনও উল্টো দিকে বসে, কখনও পাশের ঘরে থেকে সেই শুনতে শুনতেই বালিকা আশাপূর্ণার পড়া শেখা। সঙ্গে চলত মায়ের বইয়ের তাক থেকে বই টেনে-টেনে পড়া। তাতে কোনও নিষেধ ছিল না। আশাপূর্ণা বলতেন, ‘‘সব পড়তাম। সে বুঝতে পারি বা নাই পারি।’’
সে সময় সাধনা, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী প্রভৃতি পত্রিকা বাড়িতে আসত। সরলাসুন্দরী ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, জ্ঞানপ্রকাশ লাইব্রেরি ও চৈতন্য লাইব্রেরির সদস্য। মায়ের সেই পড়ার জগতেই বুঝি বালিকা আশাপূর্ণার মনের তার সাহিত্যের ভুবনে বাধা হয়ে গিয়েছিল। ১৫৭/১, আপার সার্কুলার রোডের এই বাড়ি থেকেই কয়েক বছর পরে তিনি ডাকে লেখা পাঠাবেন। ভাইবোনেদের মধ্যে সর্বক্ষণের মেলামেশা ছিল দিদি রত্নমালা ও বোন সম্পূর্ণার সঙ্গে। তাঁর কথায় যেন, ‘একটি অখণ্ড ট্রিলজির অংশ। এক মলাটে তিনখানি গ্রন্থ।’
বাংলা ১৩২৯, আশাপূর্ণার যখন তেরো বছর বয়স, বোনেদের সঙ্গে লেখা নিয়েই একবার প্রতিযোগিতা। ‘বাইরের ডাক’ নামে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিলেন ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায়। প্রকাশিতও হল। সে দিন গোটা পাড়া জুড়ে আনন্দ। তখন তো এমনই ছিল। দুঃখ-আনন্দ সবাই পড়শির সঙ্গে ভাগ করে নিত। সহ-সম্পাদক রাজকুমার চক্রবর্তী চিঠি দিয়েছিলেন প্রশংসা করে। লিখেছিলেন, ‘‘তুমি গল্প লেখো। আমাদের পাঠাও।’’ সেই উনি লিখতে শুরু করলেন।
সে সময় আশাপূর্ণা ও সম্পূর্ণার পছন্দের খেলা ছিল পদ্য মুখস্থ। কার কত আগে হয় মুখস্থ, সেই নিয়ে জোর প্রতিযোগিতা। বাড়ির লোকজনের কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড় হত। এই ‘গান্ধারীর আবেদন’ তো ওই শোনা গেল ‘কর্ণ কুন্তী সংবাদ।’
একদিন এক কাণ্ড! দুই বোন সবার চোখ এড়িয়ে শান্তিনিকেতনের ঠিকানায় চিঠি পাঠালেন রবীন্দ্রনাথকে! আবদার, “নিজের হাতে আমাদের নাম লিখে একটি উত্তর দেবেন।” চিঠি পাঠিয়েছিলেন রবিঠাকুর। সাদা, বড় খামে নিজের হাতে দুই বোনের নাম লিখেই!
সারা জীবনই আশাপূর্ণা কবিকে শ্রদ্ধা করেছেন। তাঁর প্রিয় ছিল মোহর, সুচিত্রা, হেমন্তর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান। খুব প্রিয় ছিল ওই গানটা, ‘যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি।’ শুনতে চাইতেন ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা’, ‘জড়ায়ে আছে বাধা ছাড়ায়ে যেতে চাই’। কেউ এলেই গাইতে বলতেন উনি। ইচ্ছে ছিল, ফিরবেন শান্তিনিকেতনেই। শেষ সময় থাকবেন। হয়নি!
আশাপূর্ণার যখন ১৫ বছর বয়স, কৃষ্ণনগরের কালী দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রথমে ওঁর খুব মন ভেঙে যায়। কলকাতাই যে প্রাণ! এ দিকে শ্বশুড়বাড়ি কৃষ্ণনগর। ভেবেছিলেন, বই পড়া-লেখালিখির বুঝি ইতি টানতে হবে। গিয়ে দেখলেন, বাড়িতে বই বলতে কেবল পঞ্জিকা! তিনি বলতেন, ‘‘মনের দুঃখে আমি সেই পঞ্জিকাখানি উল্টে-পাল্টে দেখতাম!’’ তাঁর স্বামী শ্রী কালী দাশগুপ্ত তাঁর আগ্রহ দেখে কলকাতা থেকে বই, পত্র-পত্রিকা কিনে-কিনে নিয়ে যেতেন।
এক সময় সংসার উঠিয়ে নিয়ে তিনি কলকাতায় চলে এলেন। প্রথমে রমেশ মিত্র রোডে ভাড়ায় উঠলেন। পরে ঠিকানা বদলে গেল বেলতলা রোডে। আর সে বাড়িতেই দীর্ঘ ৪০ বছর ছিলেন।
স্বামীর উৎসাহেই সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন তিনি। দুই ছেলে প্রশান্ত-সুশান্ত আর এক মেয়েকে নিয়ে ওঁদের তখন ভরা সংসার। তবুও লেখা থামেনি। সারা দিন সংসারের কাজ করতেন। রাত্তিরে অন্তঃপুরের মেয়েদের কথা, নারীমুক্তির কথা লিখে যেতেন।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ভিজে হাতখানি আঁচলে মুছতে-মুছতে লিখতে যেতেন। তাঁর লেখার ভঙ্গিটি ঠিক ছবির মতো ছিল। আধশোয়া। উপুড় হয়ে ছোট্ট একটা কাঠের ডেস্কে নিজের প্যাডে লিখে যেতেন। কতবার হয়েছে, লিখতে লিখতে ভোর।
লিখেওছেন, ‘‘লেখা শেষ করে যখন শুতে যাচ্ছি, রাস্তায় জল দিচ্ছে।’’ নাগাড়ে লিখেছেন। হয়তো কেউ এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন লেখা থামিয়ে। চলে যেতেই ফের লিখতে বসলেন। কখনও পড়তেন। বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্রনাথের লেখা। বলতেন, ‘‘ওঁদের প্রণাম করে লেখা শুরু করি।’’ কেউ যদি জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘আপনি প্লটের কথা ভাবেন কখন?’’ উনি বলতেন, ‘‘লেখার ভাবনা সব সময়ই চলে।’’
এক সময় বেলতলা রোড থেকে গোলপার্কের ফ্ল্যাটবাড়িতে তিনি সপরিবারে উঠে এলেন। তারপরে গোলপার্ক থেকে উঠে আসেন গড়িয়ার বাড়িতে, ১৭ কানুনগো পার্কে। সেও এক গল্প। তিনি চাইতেন রাস্তার ধারের বাড়িতে থাকতে। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর কাছে একদিন জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘গোলপার্ক থেকে গড়িয়ায় কেন?’’ উত্তরে আশাপূর্ণা বলেছিলেন, ‘আমার বরাবরের ইচ্ছে বড় রাস্তার উপরে থাকব। লোকজন দেখব। গাড়ি ঘোড়া দেখব।’ ঘরেও বলতেন, রাস্তার দিকের ঘরের জানলায় বসে থাকতে ইচ্ছে করে।
গৃহপ্রবেশে এলেন বিখ্যাত সব সাহিত্যিকরা। হাজার স্মৃতি। রবিবাসরের সভা বসেছে বহুবার। কে আসেননি সেই সভায়। তারাশঙ্কর থেকে বনফুল। তিনি তো কোনও অতিথিকে না বলতেন না। বলতেন, ‘‘লোকই লক্ষ্মী।’’
একবার এলেন নাকতলার বাড়ি থেকে স্ত্রী প্রতিভা বসুকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধদেব বসু। গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কাটিয়ে গিয়েছিলেন। ওঁর জন্মদিনে অনেকে দেখা করতে আসতেন। কেউ হয়তো বলল, ‘‘আশাদি দেখা করতে যাব।’’ তিনি বলতেন, ‘‘ঠিক আছে ভাই। দুপুরে খেয়ে যেয়ো।’’ খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন আশাপূর্ণা! কেউ বেগুনি খাবেন। নিজেই রান্নাঘরে ঢুকতেন। খাওয়ানোটা যেন নেশার হয়ে গিয়েছিল তাঁর।
একসময় পর্যন্ত তাঁকে রান্নাঘরের লেখক হিসাবেই মনে করা হয়েছে। কেন না, উনি মেয়েদের ঘরোয়া জীবনকে ছুঁয়েই কেবল লিখতেন। ১৯৭৫ সালে তাঁর জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রাপ্তির সেই গল্প তো অনেকেরই জানা। ‘দেশ’-এ লিখেছিলেন সদ্য প্রয়াত নবনীতা দেবসেন।
সে বার বাংলাভাষার কমিটিতে ছিলেন অধ্যাপক প্রতুল গুপ্ত এবং অধ্যাপক অমলেন্দু বসু আর নবনীতা দেবসেন। নবনীতা দেবসেন সেখানে আশাপূর্ণার ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র কথা বললে, তাঁরা দু’জনেই অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘‘অনেক লিখলে বা মুখরুচিকর জনপ্রিয় লিখলেই মহৎ সাহিত্য হয় না।’’ শেষে নবনীতা দেবসেন তাঁদের পড়তে দিয়েছিলেন আশাপূর্ণার উপন্যাসটা। পরে তাঁরা সিদ্ধান্ত বদলেছিলেন।
সারা জীবনে আশাপূর্ণা পুরস্কার তো কম পাননি। কিন্তু কোনও দিন নিজের সাদামাঠা জীবন থেকে সরে যাননি।
তাঁকে ‘ডি লিট’ দিয়েছে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়। পেয়েছেন পদ্মশ্রী, জ্ঞানপীঠ, দেশিকোত্তম … আরও অজস্র সম্মান, পুরস্কার। কিন্তু কখনও নিজেকে ‘সেলিব্রিটি’ মনে করেননি। খুব সাধারণ পোশাকেই অভ্যস্ত ছিলেন। পোশাকের মধ্যে সাদা শাড়ি পরতে পছন্দ করতেন। বাইরে গেলে কুঁচি দিয়ে পড়তেন। নইলে আটপৌরে করেই পড়তেন। অথচ, খুব পরিচ্ছন্ন থাকতেন। গুছিয়ে রাখতেন ঘরদোর।
তাঁর একটা বাড়িও ছিল, শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লিতে। কবি নরেন্দ্র দেব বাড়ির নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন ‘উজ্জয়িনী’। বলেছিলেন, ‘‘বাড়িটি কালিদাসের, অতএব উজ্জয়িনীই হবে উপযুক্ত নাম।’’
তাঁর নিজের লেখা গল্প নিয়ে এত ছায়াছবি হয়েছে, কিন্তু একা ছবি দেখতে যেতেন না। তবে সিনেমার জগতের বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। যেমন কাননদেবী। টেলিফোনে প্রায়ই কথা হত দু’জনের। তাঁরা একে অপরকে ফুল পাঠাতেন। খুব যোগাযোগ ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও। হেমন্ত তাঁর বাড়িতে এসে রবীন্দ্রনাথের গানও শুনিয়েছিলেন। হেমন্ত যখন ‘অনিন্দিতা’ ছবি করলেন, চিত্রস্বত্ব নিতেও এসেছিলেন আশাপূর্ণা দেবীর বাড়িতে। সেই ছবির মহরতেও গিয়েছিলেন আশাপূর্ণা।
৭৭ বেলতলার বাড়িতে উত্তমকুমার এসেছিলেন। তিনি তখন ‘অগ্নিপরীক্ষা’র হিন্দি ছবি করছেন। চুক্তি হল ‘ছোটিসি মুলাকাত’-এর। উত্তমকুমারকে দেখতে গোটা পাড়া ভেঙে পড়েছিল।
তাঁর জীবনের শুরুটা কিন্তু অদ্ভুতভাবে।
আর মেয়ে না। মেয়ের স্বাদ মিটেছে। তাই আশাপূর্ণা!
নামটি তাঁর ঠাকুমার দেওয়া। হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ও সরলাসুন্দরীর ন’টি সন্তানের পঞ্চম এবং কন্যা হিসেবে তৃতীয় হওয়ায় ঠাকুমা অমনটাই চেয়েছিলেন।
কালে কালে এই কন্যাই কিনা স্বয়ং রবিঠকুরের স্বীকৃতি আদায় করলেন।— ‘আশাপূর্ণা তুমি সম্পূর্ণা’!
অবহেলা নিয়ে জন্ম। অক্ষর-পরিচয়ও সেই অবহেলা দিয়েই। বাড়ির পড়ুয়া ছেলেদের, দাদা আর ভাইয়ের উল্টো দিকে বসে তাদের পাঠ্য বইয়ের পড়া দেখতে দেখতে।
ঘোর রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ইস্কুলের ভেতর যাওয়া দূরে থাক, চৌকাঠেও পা রাখতে পারেননি। কিন্তু পরে তিনিই আবার তিন হাজার ছোট গল্প, আড়াইশো উপন্যাস, ষাটেরও বেশি ছোটদের কাহিনি, অসংখ্য প্রবন্ধ লিখে গেলেন।
বিশ্বভারতীর শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘দেশিকোত্তম’ থেকে অজস্র সম্মানিক ডক্টরেট আর সোনার মেডেল পেলেন। এমনকী সর্বভারতীয় স্বীকৃতি ‘জ্ঞানপীঠ’ও হাতে নিলেন। এমন মানুষই বোধ হয়, নিজেকে অনায়াসে আখ্যা দিতে পারেন—‘‘আমি মা সরস্বতীর স্টেনোগ্রাফার।’’
বহু জায়গায় বলে গেছেন, মায়ের কারণেই তাঁর সাহিত্যর নেশাটা পেয়ে বসেছিল। সরলাসুন্দরীর ছিল বই পড়ার প্রবল নেশা। তাই বাড়িতে প্রচুর বই আসত। তখনকার দিনের প্রায় সমস্ত গ্রন্থাবলী, যত পত্র-পত্রিকা, প্রায় সব। এ ছাড়াও ছিল তিনটি গ্রন্থাগার, সেখান থেকেও নিয়মিত বই-এর জোগান ছিল।
আশাপূর্ণা লিখছেন, ‘‘মায়ের বই পড়া মানে সে প্রায় কুম্ভকর্ণের খিদের মতোই। আর আমাদেরও স্কুলের বালাই নেই। সেইসব বইগুলো আমরা তিন বোনে নির্বিচারে পড়ে ফেলতাম অতি বাল্য থেকেই… বই পড়াটা ভাতের মতোই অপরিহার্য ছিল।’’
বই পড়তে পড়তেই লেখার সাধ। তেরো বছর বয়েসে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন তাঁর প্রথম কবিতা ‘বাইরের ডাক’। পত্রিকার সম্পাদক রাজনারায়ণ চক্রবর্তী। তিনি সে কবিতা তো নিলেনই, জানতে চাইলেন আরও অনেক কিছু। — ‘‘আরও লেখা দিতে পারবে? গল্প লিখতে জানো।’’ প্রথম লেখা। প্রথম স্বীকৃতিও। রাজনারায়ণ চক্রবর্তীর কাছে আজীবন কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না আশাপূর্ণার। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘সেই প্রথম কালে উৎসাহে ঘৃৎসি়ঞ্চন না করে যদি বরফজল ঢালতেন, সুনিশ্চিত আমার লেখিকা হওয়া হত না।’’
নিজের জীবনস্মৃতির ঝাঁপ খুলতে বসে তিনি বলছেন এক্কেবারে এক সাধারণ মেয়ের গল্প। —‘‘ছিল অত্যন্ত সাধারণ জীবন… মনে হয় যদি খুব গরিব ঘরের মেয়ে হতাম বা বিশিষ্ট কোনও বড়লোকের মেয়ে… তাহলেও বা তা নিয়ে কিছু বলার মতো উপাদান পাওয়া যেত। দুঃখ দুর্দশা অভাব অথবা ঐশ্বর্যের ঝলক। সে দিক দিয়ে তো কিছু বলার নেই। স্রেফ মধ্যবিত্ত ব্যাপার। মধ্যচিত্তও। শুধু বাবা ছবি আঁকতেন আর মার ছিল অত্যধিক সাহিত্যপ্রীতি। সেই হেতুই হয়তো অন্যান্য আত্মীয়জনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের মানসিকতার কিছু তফাত ছিল।’’
ওই তফাতটুকুর কারণে ছোট থেকে চাওয়া-পাওয়ার ভাবনাগুলো যেন বয়স ধরে পাশাপাশি হাঁটেনি। কিশোরীবেলায় যেমন আশাপূর্ণা ভেবেছে, আহা, তার বরটা যদি লাইব্রেরিয়ান হয়, বেশ হয়। অনেক বই পড়তে পাবে সে। আবার মনে হয়েছে, যদি রেলে কাজ করে তবেও মন্দ হয় না। খুব বেড়াতে পারবে।
কোনওটাই হয়নি। স্বামী ছিলেন ব্যাঙ্কের কর্মচারী। সাধ থাকলেও সাধ্য কম ছিল। ফলে শুধু লেখা আর পড়ার ওপরই ছিল একমাত্র নির্ভর। —‘‘সব সময় চেষ্টা করেছি আমার এই শখটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। এবং অবশ্য সফলও হয়েছি। অন্য কোনও কিছুর ওপর আর তেমন আকর্ষণ ছিল না।’’
বলতেন, বড়দের ছোটগল্প লেখাটা তাঁর প্রেম। উপন্যাসটা তাঁর কাজ। কিন্তু যাই-ই লিখেছেন, সবটাতেই মনে হয়েছে, তিনি যেন একজন অসামান্য ফটোগ্রাফার। তাঁর কলম আদর্শের কথা হয়তো তেমন করে বলে না। বলে না, এমনটা হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁর কলম জীবনের ছবি তুলে তুলে কেবল দেখিয়ে দিয়েছে, এমনটা হয়। বারবার বলেছেন, ‘‘যা হয় আমি তাই লিখি, কী হয় সেটাই বলবার, উচিত বলার আমি কে?’’
তাঁর কলমে ছবির মতো উঠে আসে, ‘চিরদিনের সত্য সহসাই কী অদ্ভুতভাবে মিথ্যে হয়ে যেতে পারে। আবার বর্ণহীন একটা মাটির ঢেলাও সহসা হীরকখণ্ডের দ্যুতির চমক দিয়ে বসে।’
গায়ে কাঁটা দেয় তাঁর ‘ছিন্নমস্তা’ গল্পটি। যেখানে নতুন যুবতী বউয়ের ছেলেকে ক্রমশ দখল করে নেওয়ার আক্রোশে একমাত্র সন্তানের মৃত্যুকামনা করে বসে বিধবা মা জয়াবতী। সেটিই ফলে গেলে কী ভয়ঙ্কর চাপা উল্লাসে আর নিষ্ঠুরতায় ‘চকচকে কালো পাথরের বড়ো থালায় পরিপাটি করিয়া সাদা ধবধবে আতপ চালের অন্ন বাড়িয়া রাখিয়া জয়াবতী ডাকেন— বৌমা, অ বৌমা, নেবে এসো মা, দুটো মুখে দিয়ে যাও।’ কিংবা, ‘পাখা হাতে করিয়া কল্পিত মাছি তাড়াইতে তাড়াইতে বলেন— খেতে পারছি না বললে চলবে কেন মা?… ভালো জিনিস খাওয়ার বরাত তো ঘুচিয়েছেন ভগবান, পোড়া বিধবার গুচ্ছির শাক-পাতা-ডাল-চচ্চড়ি না খেয়ে উপায় কি?’
মর্মমূল ধরে টান মারে ‘স্থিরচিত্র’ গল্পটি। প্লেনক্র্যাশে সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়া একমাত্র ছেলের মৃত্যুসংবাদে শোকে পাথর মা। নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণা আর যত্নে জননী সতী সেন তিল তিল করে বানায় মৃত সন্তান দিব্যকুমারের ‘স্মৃতিমন্দির’। সেখানে নতুন বিছানা-বালিশে ঠেস দেওয়া ছেলের দৃপ্ত উজ্জ্বল ছবির সামনে ভেঙে পড়েন তিনি— ‘খোকা, খোকা রে, তুই ওপর থেকে দ্যাখ… তোর বোকা হাবা মা তোর জন্য কী করে তুলেছে… এ সব তোর! খোকা সব তোর। আমরা শুধু মন্দিরের সেবাইত।’
কিন্তু যখন ছেলের চিঠি আসে, ‘তার একদা বলিষ্ঠ চারখানা হাতপায়ের তিন-তিনখানাই হারিয়ে ফেলে অবশিষ্ট অপটু হাতটা দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখে জানিয়েছে বহুদিনের আপ্রাণ চেষ্টায় এই চিঠিটা পোস্ট করতে পেরেছে সে…যেন তাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়’— তখন সতী সেন যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পান ‘অথৈ সমুদ্রের তলা থেকে উঠে আসা একটা অপরিচিত অদ্ভুত জীব, নির্মল শুভ্র ‘দিব্যস্মৃতি’র মন্দির-ঘরের মাঝখানে পাতা সরু খাটের ওপর থেকে তার ঝকঝকে টগবগে খোকার ছবিখানাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে নিজের জায়গাটা দখল করে নিতে চাইছে।’ … ‘আলোটা নিভিয়ে দিল সতী। গেটের যে আলোটা সারা রাত জ্বালিয়ে রাখার কথা ছিল’— এক ফুঁয়ে এ কোন আলো নিভিয়ে দেন আশাপূর্ণা?
তেমনই জর্জরিত করে ‘পরাজিত হৃদয়’ গল্পটি। বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে বাইরে বেড়াতে যাওয়া একমাত্র আদরের মেয়ে গণধর্ষণের শিকার। বাঁচতে চেয়ে বাড়ি ফেরার জন্য মা অমলাকে লেখা তার প্রথম চিঠি মা তক্ষুনি চুপিচুপি ‘জ্বলন্ত উনুনের আগুনে গুঁজে দেয়’। বাবা সোমেশ্বর তার অফিসের ঠিকানায় আসা দ্বিতীয় চিঠিটি নিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েও পারে না। চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে উদ্ধারের ঠিকানা দেওয়া শেষ হদিশটুকু টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে, মেয়েকে বরাবরের মতো নিশ্চিহ্ন করে বাড়ি ফিরে আসে অপরাধীর মতো। কারণ ‘যে মেয়ে বন্ধুদের দলে জুটে জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে ‘দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে’ এখন ফুলের মালা গলায় দুলিয়ে দেওয়ালে ঝুলে আছে, সেই মেয়েকে হঠাৎ আবার রক্তমাংসের আধারে ভরে ফেলে নিয়ে এসে কোথায় জায়গা দেবে?…’ এমনি করেই আশাপূর্ণা তাঁর ‘কসাই’, ‘পদাতিক’, ‘ভয়’, ‘ইজিচেয়ার’… নামের ছোটগল্পগুলোতে অতি চেনা সম্পর্কের ওপরে সাঁটা অদৃশ্য মুখোশগুলোয় যেন এক হ্যাঁচকায় টান মারেন। চারপাশকে নিয়ে, হাজারটা সম্পর্ক নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন তুলে দিতে থাকেন।
ছোট গল্পের আশাপূর্ণা বড় আখ্যানে গিয়ে কিছুটা হলেও কি ভিন্ন গোত্রের? নারীর পক্ষ নিয়ে, তাঁর অধিকারের দাবি নিয়ে এখানেই কি তিনি বেশি সোচ্চার?
বলছেন, ‘‘মেয়েদের কথাই বেশি করে ভেবেছি। কারণ তাদের অসহায় অবস্থা চোখে পড়েছে বেশি… তাদের অবরোধ সমস্যাই আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করত। ছোটবেলা থেকে দেখছি তো সেই বন্ধনদশাগ্রস্ত অবস্থা। তাছাড়া মেয়েদের সর্ববিষয়েই তো ছিল অনধিকার।’’
এই অনধিকারের প্রশ্ন থেকেই তিনি লেখেন ট্রিলজি— ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সুবর্ণলতা’, ‘বকুলকথা’।
প্রথমটির নায়িকা সত্যবতী। যে মেয়ে ছোটবেলা থেকেই ‘মেয়েমানুষের’ দাবি নিয়ে কথা বলে। —‘এত যদি না দরকারের কথা তো মেয়েমানুষের জন্মাবারই বা দরকার কি…?’ কিংবা ‘বলি স্বয়ং মা সরস্বতী নিজে মেয়েমানুষ নয়? সকল শাস্তরের সার শাস্তর চার বেদ মা সরস্বতীর হাতে থাকে না?’
‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’-র পরের বিন্যাস ‘সুবর্ণলতা’। সত্যবতীর মেয়ে সুবর্ণলতা। সুবর্ণলতা সোচ্চার, সুবর্ণলতা অলজ্জ, সুবর্ণলতা তীব্র। মেয়েমানুষের অসম্মানের লাঞ্ছনায় সে এই হতভাগা দেশের মেয়েদের জন্য ‘মড়ক’ প্রার্থনা করে—‘বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর এমন কোনো মড়ক আসে না গো, যাতে দেশ মেয়ে-শুন্যি হয়ে যায়? তখন দেখি তোমরা মহানুভব পুরুষসমাজ কোন সিংহাসনে বসে ক্রীতদাসী সংগ্রহ কর? এ অহঙ্কার, ফুরোবে তোমাদের। তোমাদেরই জুতোর শুকতলা ক্ষয়াতে হবে, এই আমি অভিশাপ দিচ্ছি।’’
‘বকুলকথা’ আশাপূর্ণার নিজের কথায়, ‘সুবর্ণলতা’র পরিপূরক। সুবর্ণলতার এই সবচেয়ে ছোট মেয়ে তার মা ও দিদিমার অদ্ভুত কনট্রাস্ট। সে মুখচোরা, চুপচাপ, নিজের মধ্যে গোটানো। অথচ এই বকুলই একদিন হয়ে ওঠে খ্যাতনামা লেখিকা ‘অনামিকাদেবী’। সত্যবতী ও সুবর্ণলতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় তারই মধ্যে দিয়ে।
বকুল রাস্তায়ও নামে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে—‘মা, মা গো! তোমার পুড়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া লেখা, না-লেখা সব কথা আমি খুঁজে বার করবো। সব কথা আমি নতুন করে লিখবো। দিনের আলোর পৃথিবীকে জানিয়ে যাবো অন্ধকারের বোবা যন্ত্রণার ইতিহাস।’’
আশ্চর্য, এই আশাপূর্ণাই আবার ‘মেয়েমানুষী’-কে রেয়াত করেননি। এক জায়গায় লিখছেন, ‘‘মেয়েরা সবের প্রতিই বড় বেশি আসক্ত। তুচ্ছ বস্তুর প্রতিও আসক্তি। আবার মানুষের প্রতিও এক ধরনের তীব্র আসক্তি। স্বামী-সন্তান এরা একান্তই ‘আমার হোক’। …যত দিন না তারা এই ‘আসক্তি’ ত্যাগ করতে পারবে, ততোদিন মুক্তি আসবে না।’’
নারীকে এমন শাসন করে আবার সোহাগ করেছেন তিনি। বলছেন, ‘‘পুরুষেরা ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারে। মেয়েরা কি তা পারে?… পুরুষরা যখন সংসার উপেক্ষা করে লেখেন তখন তিনি মহান ব্যক্তি। মেয়ে যদি তাই করে তখন সে অপরাধিনী’’… তিনি প্রশ্ন করছেন, ‘‘এমন কোনও লেখিকা আছেন কি যিনি বলেন ‘আমি সংসারের কিছু জানি না, সব উনি জানেন।’ কিন্তু পুরুষরা সেটা সর্বদাই বলেন।’’ তাঁর বড়ই আক্ষেপ যে মেয়েরা ‘সময়ের গণ্ডিতে বড্ড বেশি বন্দী’। তিনি চান সেই অচলায়তনের ভাঙতে।
গড়িয়ার কানুনগো পার্কে ছিল তাঁর বাড়ি। যে দোতলা বাড়ি তাঁর নিজেরই তৈরি ছিল। ’৬৯ সাল থেকে আমৃত্যু থেকেওছেন ওখানে। সেই বাড়ির দোতলার দরজা পেরিয়ে ঢুকতেই ছিল হল ঘর। বাঁ ধারে বসার ঘর। ঘরের চার পাশে সাজানো থাকত অজস্র স্মারক, পুরস্কার, ট্রফি, ছবি। সামনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর কাছ থেকে নেওয়া ‘পদ্মশ্রী’। রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডির হাত থেকে ‘জ্ঞানপীঠ’ ও প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর থেকে বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ পাওয়ার ছবি দু’খানি পাশাপাশি।
তিনিই ঠিক করে দিয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে তাঁর পুত্রবধূর বিএ পড়া। দূরত্বের কারণে ট্র্যাডিশনাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন কাছাকাছি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়তে। সেই সময় নিজের হেফাজতে নিতেন তিন মাসের শিশু ছোট নাতনিকে। কোনও আয়াও ছিল না দেখভাল করার।
“কোনও দিন রাগতে দেখিনি। খুবই মিষ্টি স্বভাব। অথচ সব সময়ই যে আদর দিয়ে গেছেন, এমনটাও নয়। কখন কী করতে হবে, সবই বোঝাতেন সংযত হয়ে। এ দিকে নিজে কিন্তু তাঁর শাশুড়ির যত রকম কঠোর নিয়ম-নির্দেশ আজীবন পালন করেছেন। নির্বিবাদে। শাশুড়ির নির্দেশেই স্বামীর সঙ্গে কাশীর যোগাশ্রমে দীক্ষা নেন তিনি। সেখানে খুব কড়াকড়ি। দীক্ষার পর থেকে দু’জনেই নিরামিষ খেয়ে গেছেন বরাবর,’’ সংবাদমাধ্যমে আশাপূর্ণার স্মৃতিচারণে জানিয়েছিলেন নুপূরদেবী।
স্ত্রীর লেখালেখির জন্য সব সময় অবশ্য পাশে থাকতেন স্বামী। সব জায়গায় স্ত্রীকে সঙ্গ দেন, বলে তাঁকে বিদ্রুপ শুনতে হত। জবাব দিতেন, ‘‘স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে সব জায়গায় যেতে পারে, উল্টোটা হলে ক্ষতি কী, সম্পর্কটা তো একই!’’
নুপূরদেবী জানিয়েছিলেন, ‘‘বাইরে যেমন নরম, ভেতরে ততটাই শক্ত ছিলেন উনি। এক মেয়ে দুই ছেলের মা। সবার বড়, মেয়ে পুষ্পরেণু। পর পর দুই ছেলে প্রশান্তকুমার, সুশান্তকুমার। আর্ট কলেজে পড়া তেইশ-চব্বিশ বছরের অতি গুণী ছেলে প্রশান্তকুমারের আকস্মিক মৃত্যুতে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন, কিন্তু সেখানেও কতটা যে শান্ত, সংযত ছিলেন, সে ওঁর কাছের লোকেরাই শুধু জানেন।’’
অসম্ভব সরল। সাদাসিদে। কিন্তু ‘টিপটপ’ বলতে যা বোঝায়, ঘরের আশাপূর্ণা ছিলেন তেমন। বিকেলে চুল বেঁধে গা ধুয়ে পাটভাঙা শাড়ি পরা। সুগন্ধি চন্দন সাবান মাখা। মাথায় জবাকুসুম, নয়তো মহাভৃঙ্গরাজ তেল দেওয়া। মুখে হিমানী স্নো, ওটিন ক্রিম।
খুব পছন্দ ছিল তাঁতের শাড়ি। তাতে হালকা কমলা বা হালকা সবুজ বা হালকা নীল পাড়। — ‘‘বাইরে বেরনোর সময় আমিই কাপড় পরিয়ে দিতাম। কোনও দিন কিন্তু রঙিন শাড়ি পরতে দেখিনি,’’ স্মৃতিচারণে বলেছিলেন নুপূরদেবী।
আশাপূর্ণা দেবী চলে যাওয়ার দু’তিন মাস আগেও লিখেছেন। হঠাৎ করেই শরীরটা ভেঙে পড়েছিল। বোঝা যেত, লিখতে কষ্ট হচ্ছে। তবু লিখতেন। কোলের উপর প্যাড নিয়ে লেখার চেষ্টা করতেন। লাইনগুলো ছেড়ে ছেড়ে যেত। অক্ষর কেঁপে যেত। শেষ করলেন একটা গল্প ওইভাবেই। শেষের দিকে শুয়েই থাকতেন।
১৯৯৫ সালের যে দিন চলে গেলেন, সেটা ছিল ১৩ই জুলাই। গহন রাতে ঘুমের মধ্যেই কখন যে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল!
(তথ্যসূত্র:
১- শতবার্ষিকী সংকলন, আশাপূর্ণা দেবী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
২- স্মারকগ্রন্থ, আশাপূর্ণা দেবী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৩- আশাপূর্ণা দেবী জন্মশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ।
৪- আশাপূর্ণা দেবী ঘরোয়া জীবন ও সাহিত্যে, শতরুপা সেনগুপ্ত, নিউ এজ পাবলিশার্স (২০১২)।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯শে আগস্ট ২০১৫ সাল।
৬- ২২শে এপ্রিল ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় আশাপূর্ণা দেবীর স্মৃতিচারণে পুত্রবধূ শ্রীমতী নূপুর গুপ্তের লিখিত নিবন্ধ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত