হিন্দু স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। গালে সর্বদা অযত্নে লালন করা দাঁড়ি। ছিলেন বাংলার শিক্ষক। বিষয় হিসেবে নন, বাংলা পড়াতেন ভালোবাসা হিসেবে। বাংলা পড়ানো তাঁর কাছে ছিল একটা উৎসব উদযাপন। বলতেন সাহিত্যের কোনো সিলেবাস হয় না। তিনি বলতেন, ‘সাহিত্যকে ভালোবেসে পড়লে তবেই সাহিত্য তোমায় ধরা দেবে।’
তিনি শ্রী অপূর্ব বিশ্বাস। অনেক যন্ত্রনার পর কাল রাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ছাত্রদের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি ছিলেন সব ছাত্রের আশ্রয়, নিজস্ব অভিভাবক। সবার সব ব্যক্তিগত সমস্যার মুশকিল আসান। সবার প্রিয় এবং সবার আদরের অপুদা। শাসন নয়, স্নেহ দিয়েই কাছে টেনে নিয়েছিলেন স্কুলের পড়ুয়াদের।

তাঁরই এক কৃতী ছাত্রের কথায়, ‘বহুদিন আগের কথা। দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন ক্লাস নিতেন সদ্য যুবা অপূর্ব বিশ্বাস। সেইসময় ওই বিদ্যালয়ের সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক। অপুদা ক্লাস নিতে এই বললেন, মানুষের কবর আর মানুষের ঘরে একটাই তফাৎ। কবরের কোন জানালা থাকেনা। তেমনি সাহিত্যের কোন বুকলিস্ট হয় না। পাঠক্রমের মধ্যে আনতে হবে সেরা লেখকদের সেরা বই। লিখতে বললেন ছাত্রদের। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক, পথের পাঁচালি। রবীন্দ্রনাথের গোরা, গল্পগুচ্ছ। এভাবেই একের পর এক বইয়ের নাম বলে গেলেন। আমরাও বইগুলো কিনে একেবারে গোগ্রাসে গিলে ফেললাম।’
সেই অপূর্ব বিশ্বাসই গতকাল রাতে যাত্রা করেছেন অচিনপুরের উদ্দেশ্যে। বইয়ের প্রতি ছাত্রদের ভালোবাসা গড়ে দিয়েছিলেন যে শিক্ষক, তাঁকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ তাঁর ছাত্রকুলও। যাওয়ার আগে লিখে গিয়েছেন কয়েকটি লাইন। হয়তো তাঁর হাতে গড়া ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর উদ্দেশ্যেই। সেই লাইনগুলি এখানে উদ্ধৃত রইল। –
‘আমার মৃত্যুর পর, মুখখানি ঢেকে দিও সাদা কবিতায়।
আমার মৃত্যুর পর স্কুল খানিক খুলে রেখো, আমি আসব বলে।
আমার মৃত্যুর পর ব্ল্যাকবোর্ড ঢেকে দিও সাদা চকগুড়ায়।
আমার মৃত্যুর পর রজনীগন্ধা দিও ,
যোজনগন্ধা স্টিকারে আটকে।
আমার মৃত্যুর পর দেহে দিও শুভ্র গুগ্গুলের ধোঁয়া।
আমার মৃত্যুর পর আমাকে ভুলতে দিও আমাকেই।
আমার মৃত্যুর পর নতুন বছরে নতুন পটালিতে নাম লিখো আমার।’
ভাল থাকুন নতুন প্রজন্মের ‘ডিরোজিও’। ভাল থাকুন ছাত্রদের আদরের অপুদা।