একবার দেশের অর্থনীতি ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর জাঁতাকলে পড়লে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। মোদী সরকারকে আগেই এই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কেন্দ্রকে সতর্ক করতে তিনি বলেছিলেন, এখনও ‘স্ট্যাগফ্লেশন’-এর পরিস্থিতি আসেনি। কিন্তু তার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সাবধান থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে সেসময় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ তাতে কর্ণপাত না করলেও এবার স্ট্যাগফ্লেশন সম্পর্কে সাবধান করলেন বাংলার অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। শুধু সাবধান করেই থেমে না থেকে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন, ভারতের অর্থনীতি কখনও যে বিপদের মুখোমুখি হয়নি, আগামী বাজেট করতে গিয়ে নির্মলা দাঁড়িয়ে তারই সামনে। যার নাম ‘স্ট্যাগফ্লেশন’।
অবশ্য শুধু নির্মলাই নয়। অমিত মিত্র যখন বোঝাচ্ছেন ‘ফিলিপস কার্ভ’ কী? মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে বেকারত্বের সম্পর্ক। স্বাভাবিক নিয়মে প্রথমটি বাড়লে দ্বিতীয়টি কমে। তখন মনোযোগী ছাত্রদের মতো বাকি রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা শুনলেন তাঁর কথা। আসলে বাজেটের প্রস্তুতি পর্বে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের মত জানতে বৈঠক ডেকেছিলেন নির্মলা। কিন্তু সেখানে তাঁকেই কার্যত অর্থনীতির তত্ত্ব শেখালেন অমিতবাবু। সঙ্গে যোগ দিলেন অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক, কেরালার অর্থমন্ত্রী টমাস আইজ্যাক। আর অর্থনীতির ঝিমুনি কাটাতে বাংলা, কেরালার পাশাপাশি বিহারের অর্থমন্ত্রীও দাবি তুললেন, আগামী অর্থবর্ষে রাজ্যের রাজকোষ ঘাটতি ৪ শতাংশ পর্যন্ত আলগা করতে দেওয়া হোক। বড় সংখ্যক রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা সমর্থন করেন তাঁদের।
প্রসঙ্গত, বাজেট শৃঙ্খলা সংক্রান্ত এফআরবিএম আইন অনুযায়ী, রাজ্যের রাজকোষ ঘাটতি ৩ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে হয়। কিন্তু অমিত মিত্রর যুক্তি, ‘কেন্দ্রের তো ইচ্ছেমতো ধার করার ক্ষমতা আছে। টাকা ছাপানোর সুযোগ আছে। কিন্তু রাজ্যের ভাঁড়ারে টান পড়ছে। অর্থনীতির শ্লথ গতির ফলে কেন্দ্রের কর আদায় কমছে। ফলে কেন্দ্রীয় করের ভাগ হিসেবে রাজ্য যে টাকা পায় কমছে তা-ও। বাংলাই এপ্রিল-নভেম্বরে কেন্দ্রীয় করের ভাগ বাবদ ৮৯৩ কোটি কম পেয়েছে। এতে সামাজিক পরিকাঠামো খাতে ব্যয় কমছে।’ শুধু রাজ্যগুলির রাজকোষ ঘাটতি নয়, কেন্দ্রের ঘাটতিও লক্ষ্যমাত্রা ছোঁবে কি না, তা নিয়ে সংশয় গভীর হয়েছে। এই অর্থবর্ষে ওই লক্ষ্য ৩.৩ শতাংশ। অথচ কর্পোরেট কর ছাঁটায় সরকার হারাবে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব আয়।
উল্লেখ্য, দিন দুয়েক আগেই মোদী সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে এসেছে আইএমএফের মুখ্য অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথের হুঁশিয়ারি, আরও কমানো হতে পারে ভারতের বৃদ্ধির পূর্বাভাস। অন্যদিকে, সরকারি পরিসংখ্যান জানিয়েছে, নভেম্বরে খুচরো মূল্যবৃদ্ধি ৫.৫৪ শতাংশ হয়েছে। অক্টোবরে শিল্পোৎপাদন কমেছে ৩.৮ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে বৃদ্ধি ৪.৫ শতাংশে নেমে ছুঁয়েছে ছ’বছরের তলানি। এই পরিস্থিতিতে অমিত মিত্র নির্মলাকে এটাই বুঝিয়েছেন যে, সাধারণত মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়লে বেকারত্ব কমে। কারণ মূল্যবৃদ্ধি বাড়ছে মানে বাজারে চাহিদা বহাল। যা মেটাতে কারখানায় বেশি উৎপাদন হবে। বেকারত্ব কমবে। কিন্তু দেশে এখন মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়লেও, কারখানায় উৎপাদন কমছে। বৃদ্ধির হার কমছে। ফলে বেকারত্বের হার আরও বাড়বে। এটাই ‘স্ট্যাগফ্লেশন’। তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘দরজায় যখন স্ট্যাগফ্লেশন কড়া নাড়ছে, তখন সামাজিক খাতে খরচ কমে গেলে আরও বিপদ।’