সোমবার লোকসভায় প্রায় ৭ ঘণ্টার হই-হট্টগোলের পর মধ্যরাতে পাশ হয়েছিল বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল(ক্যাব)। আর তারপর দীর্ঘ বিতর্ক-আলোচনা চলার পর অবশেষে বুধবার রাতে রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে যায় তা। আর তারপর থেকেই জ্বলছে আসাম। কার্ফু, সেনা-আধাসেনার টহলদারি, প্রধানমন্ত্রীর টুইট আর্জি— সব উপেক্ষা করে আসামের বিভিন্ন প্রান্তে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন হাজার হাজার মানুষ। এই পরিস্থিতিতে সেনা নামিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ রাজ্যের বিজেপি সরকার।
যার ফলে বৃহস্পতিবার বিকেলে গুয়াহাটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার পুরোপুরি ভাবে তুলে দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর হাতে। তবে বৃহস্পতিবার সকালে কার্ফু উপেক্ষা করেই হাজার হাজার মানুষ ক্যাব–এর বিরোধিতায় গুয়াহাটির রাস্তায় নামেন। খোদ মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের বাসভবনেও ঢিল পড়ে। ডিব্রুগড় ও পানিটোলায় রেল স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আন্দোলন রুখতে পুলিশ গুলি চালালে তাতে মৃত্যু হয় ৫ জনের। সরকারি সূত্রে অবশ্য তিন জনের মৃত্যুর কথা জানিয়ে বলা হয়, তিনসুকিয়ায় আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছেন নারায়ণ নামে এক প্রৌঢ়।
আদতে বিহারের বাসিন্দা নারায়ণ হিজুগুড়ি এলাকায় বাঙালি মালিকানাধীন একটি হোটেলে কাজ করতেন। বিক্ষোভকারীরা হোটেলে আগুন লাগানোয় তাঁর মৃত্যু হয়। গুয়াহাটির লাচিতনগরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে দীপাঞ্জল দাস নামে সেনা ক্যান্টিনের কর্মী এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গুয়াহাটিরই হাতিগাঁও শঙ্কর পথে পুলিশের গুলিতে এক জন মারা গিয়েছেন। তাঁর নাম জানা যায়নি। যদিও বেসরকারি সূত্রের দাবি, শঙ্কর পথে মৃতের সংখ্যা দুই। বশিষ্ঠ নতুন বাজার এলাকাতেও এক জন পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন।
বুধবার রাতে রাজ্যসভায় ক্যাব পাশ হতেই ডিব্রুগড়ে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল এবং কেন্দ্রীয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী রামেশ্বর তেলির বাড়িতে হামলার চেষ্টা হলে পুলিশের লাঠি ও গুলিতে বেশ কয়েক জন বিক্ষোভকারী জখম হন। দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।মুখ্যমন্ত্রীর নিজের এলাকা ছাবুয়ার বিধায়ক বিনোদ হাজরিকার বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। আক্রান্ত হন মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা শান্তনু ভরালি, বিজেপির মন্ত্রী রঞ্জিত দত্ত, বিধায়ক আঙুরলতা ডেকার বাড়িও। মারমুখী জনতাকে ঠেকাতে পুলিশ বহু জায়গায় লাঠি চালায় ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। গুয়াহাটি-সহ বেশ কিছু জায়গায় গুলিও চালায় তারা।
যার ফলে লালুংগাঁওয়ে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন জখম হন। তিন জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। রবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস চলে আদাবড়ি, হেঙেরাবাড়ি, উজানবাজার, গুয়াহাটি ক্লাব, চাঁদমারি, গণেশগুড়ি, চচল-সহ বিভিন্ন স্থানে। চাঁদমারিতে রেলপথে আগুন জ্বালানো হয়। গুয়াহাটিতে পাথর ছোঁড়া হয় ডিজিপি ভাস্করজ্যোতি মহন্তের গাড়ি লক্ষ্য করে। ডিব্রুগড়ের চাবুয়ায় সার্কল অফিস, পোস্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, জেলা পরিষদ কার্যালয় পোড়ানো হয়। আসাম গণ পরিষদের গুয়াহাটির আমবাড়ি সদর দফতরেও ভাঙচুর হয়।
রাজ্যবাসীর উদ্বেগ দূর করতে অসমিয়া ভাষায় টুইট করে আসাম চুক্তির ষষ্ঠ ধারার রূপায়ণ ও অসমিয়াদের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পরে মুখ্যমন্ত্রীও বলেন, ‘হিংস্র আন্দোলন ঠিক নয়। নেতাদের একাংশ ইচ্ছাকৃত ভাবে মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন।’ কিন্তু কোনও আবেদনেই কান দেয়নি মারমুখী জনতা। কার্ফু-ব্যারিকেড উড়িয়ে, লাঠি-কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট অগ্রাহ্য করে লতাশিলের মাঠে আসুর ডাকা সভায় হাজির হন অসংখ্য মানুষ। উপস্থিত ছিলেন আসামের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী জুবিন গর্গও।
গুয়াহাটি শহর থেকে ৩০ কিমি দূরে বিমানবন্দর। শহরে কার্ফু জারি থাকায় যাত্রীরা বিমানবন্দরে পৌঁছোতেই পারছেন না। বিভিন্ন বিমানসংস্থা তাদের উড়ান বাতিল করেছে। ফলে অনেকেই বাংলায় ফিরতে পারছেন না। ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে তাঁদের জন্য। সব মিলিয়ে আসাম ফিরে গেছে আটের দশকে। স্বাভাবিক হওয়ার আপাতত কোনও লক্ষণ নেই। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। গুয়াহাটিতে জারি হয়েছে ইউনিফায়েড কমান্ড। অর্থাৎ সেনাবাহিনীই এই আন্দোলন মোকাবিলায় মুখ্য ভূমিকা নেবে।