ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। বয়স্ক রাতটা তারাদের হাত ধরে পুরানো বাসায় ফেরার তোড়জোড় করছে। কুয়াশায় ভেজা ফুটপাতে কৃষ্ণচূড়া ফুলের অলস শয্যা। ৭০নং পার্ক স্ট্রিট। বাড়ির দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। সুপ্ত শহরবাসীকে উদ্বিগ্ন না করে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত। কুড়ির কাছাকাছি বয়স। পরনে সামরিক সজ্জা। নিকুঞ্জ সেনের তত্ত্বাবধানে উঠে পড়লেন একটা ট্যাক্সিতে। ফাঁকা রাস্তায় ঝড়ের বেগে ছুটলো গাড়ি। খানিক বাদে পৌঁছলেন খিদিরপুর পাইপ রোডের নির্দিষ্ট স্থানে। অন্যদিকে, মেটিয়াব্রুজের রাজেন গুহের বাড়ি থেকে পথে নামলেন বিনয় বসু। রসময় শূরের সঙ্গে চলে এলেন পাইপ রোডে। তারপর বিনয়, বাদল, দীনেশ একসঙ্গে শুরু করলেন সেই ঐতিহাসিক যাত্রা। যা আজও শিহরণ জাগায় মনের অন্দরমহলে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উধাও ঠাণ্ডার আমেজ। সময় গড়াচ্ছে। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনে সেই পরিচিত ব্যস্ততা। গাড়ি-ঘোড়ার দুড়দাড় দৌড়। অজস্র মানুষের হাঁকডাক। লালমুখো সাহেবরা লালবাড়িটাতে ঢুকছেন বেরোচ্ছেন। প্রতি গেটে সিপাহীদের কড়া পাহারা। অপরিচিতদের দেখলেই হাজারো জিজ্ঞাসাবাদ। এগারোটা নাগাদ মহাকরণের সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে এলেন তিনজন। ধীরে সুস্থে এগিয়ে গেলেন। রাস্তা পেরিয়ে চলে এলেন পশ্চিম গেটের সামনে। সান্ত্রীরা কোনো প্রশ্ন করলো না। তাদের সাহেবী পোশাক এবং চলন বলন দেখে কারো মনে কোনো সন্দেহ জাগেনি। মাথায় সুন্দর টুপি, গলায় ঝোলানো মাফলার। ইউরোপীয়দের মতো গটগট করে ঢুকে গেলেন। বিল্ডিংয়ে ঢোকামাত্রই তাঁদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। চোখের দৃষ্টিতে প্রতিশোধের আগুন। অলস ভঙ্গি নিমেষে উধাও। তড়িৎগতিতে সিঁড়ি পেরোতে লাগলেন। তাঁদের লক্ষ্য বড় বড় আমলাদের ঘরের দিকে। কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন এক মনে নিজের কাজ করছিলেন। ঘরে বসেছিলেন জ্ঞান গুহ। ঘূণাক্ষরেও টের পাননি কী ভীষণ বিপদ তাঁর সামনে। কক্ষের ভিতরে এসে দাঁড়ালেন তিনজন। প্রত্যেকের হাতেই ঝকমকে রিভলভার। গগনভেদী আওয়াজ আর এক টুকরো লালাভ আলো ছিটকে বেরুলো ধাতব নল দিয়ে। ঢলে পড়লেন সিম্পসন। গুলি বুক ফুটো করে বাইরে বেরিয়ে গেছে। বারুদের গন্ধ মেখে রাইটার্সে শুরু হলো এক ঐতিহাসিক অভিযান। …
মাসিক ‘বেণু’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা নিয়ে বসেছিলেন সুভাষচন্দ্র। যে কেউ দেখলে অবাক হয়ে যেত। বই খোলা অবস্থায় কোলের ওপর রাখা – অবিরাম ধারায় জল ঝরছে তাঁর চোখ দিয়ে। মেজদা শরৎচন্দ্র এসেছিলেন একটা খবর দিতে। ভাইকে দেখে খুব চমকে গেলেন। আলতো করে হাত রাখলেন কাঁধে। নিজেকে সামলে সুভাষচন্দ্র তাকালেন দাদা’র দিকে। তাঁর সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে বললেন, “এবারের ‘বেণু’ পড়েছ? দীনেশের লেখা কয়েকটা চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে এত পরিণত! এ তো চিঠি নয়, জ্বলন্ত জীবন-দর্শন!” কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। পত্রিকার কয়েকটা পাতা উলটে একজায়গায় থামলেন সুভাষ। বললেন, “দীনেশ তাঁর বউদিকে লিখেছে –
‘ভারতবাসী আমরা নাকি বড় ধর্মপ্রবণ। ধর্মের নামে ভক্তিতে আমাদের পণ্ডিতদের টিকি নাকি খাড়া হয়ে ওঠে। তবে আমাদের মরণের এত ভয় কেন? বলি ধর্ম কি আছে আমাদের দেশে? যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দেওয়া উচিত। সবার চাইতে বড় ধর্ম মানুষের বিবেক। সেই বিবেককে উপেক্ষা করিয়া আমরা ধর্মের নামে অধর্মের স্রোতে গা ভাসাইয়াছি……এতে কি ভগবান আমাদের জন্য বৈকুণ্ঠের দ্বার খুলিয়া রাখিবেন, না খোদা আমাদের বেহস্তে স্থান দেবেন? যে দেশকে ইহজন্মের মত ছাড়িয়া যাইতেছি, যাহার ধূলিকণাটুকু পর্যন্ত আমার কাছে পবিত্র, আজ বড় কষ্টে তাহার সম্বন্ধে এসব কথা লিখিতে হইল।’ (১৮ই জুলাই, ১৯৩১, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল)
দেখ, আজ এই দূর্দিনে দেশের তারুণ্যই আমাদের সত্য পথের দর্শন দিচ্ছে, আর প্রবীণরা চোখ বুজে আছে।”
বলতে বলতে আরো কিছু পাতা উল্টে গেলেন সুভাষ। অন্য একটা চিঠি খুলে বললেন, “ওর এক দিদিকে কি লিখেছে শোনো –
‘ভালবাসা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় জিনিস…মানুষের বড় বড় কাজ দেখে আমরা অপরিসীম বিস্ময়ে অবাক হয়ে থাকি। ভাবি, এ কাজ সে করল কি করে? কিন্তু মূল খুঁজলে পাওয়া যাবে ভালবাসার প্রস্রবণ। তারই রসে সিঞ্চিত হয়ে মানুষ দিতে পারে হাসিমুখে আত্মবিসর্জন…ভালবাসার সাধনা করতে হয়। স্বার্থত্যাগ সে সাধনার প্রথম কথা। স্বার্থ আমাদের বড় জড়িয়ে ধরে, তাই কিছু করতে পারিনা।’
এই ছেলেগুলো আজ ভালবাসার সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছে বলেই দেশ আজ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে সাহস পাচ্ছে। আমরা সবাই যেদিন এই নিঃস্বার্থ ভালবাসার আগুনে নিজেদের স্বার্থকে বলি দিতে পারব সেদিনই দেশ সত্যিই স্বাধীন হবে। আমাদের প্রবীণ নেতারা এই তরুণদের বলেন অস্থিরমতি, বলেন এরা ভ্রান্ত পথের পথিক। এদের পরিণতিবোধ যদি অস্থিরচিত্তের প্রতিফলন হয় তাহলে সেই অস্থিরতা পুরো দেশের আজ একান্ত প্রয়োজন।” বলতে বলতে খোলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন সুভাষচন্দ্র। কিছুক্ষণ বসে থেকে আস্তে আস্তে উঠে গেলেন মেজদা শরৎচন্দ্র।
নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাইয়ের কথাগুলো তাঁকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। সেই ১৯২৮ সালের বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের জন্মলগ্ন থেকেই সুভাষচন্দ্রের সাথে সাথে তিনিও এদের সাথে যুক্ত। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সাম্প্রতিকতম কর্মকাণ্ড এবং তার সাথে জড়িয়ে থাকা তিনটে ছেলে সত্যিই বাংলা তথা পুরো দেশকে বিস্ময়ে অবাক করে দিয়েছে। ঢাকার মুন্সীগঞ্জ জেলার যশলঙ গ্রামে ২০ বছর আগে ১৯১১ সালের ৬ই ডিসেম্বর দীনেশের জন্ম। কলেজে পড়ার সময়ই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল এই ছেলেটি, আর তার ফলশ্রুতিস্বরুপ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের ঢাকা শাখায় নাম লেখানো। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিল তারুণ্যে ভরপুর, দুঃসাহসী ছেলেটি। অপূর্ব সংগঠনীপ্রতিভাসম্পন্ন এই ছেলেটিকে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল মেদিনীপুরে যাওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার পাট চুকিয়ে দীনেশ এসে ভর্তি হয় মেদিনীপুরের কলেজে। দীনেশের হাতেই জন্মলাভ করল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের মেদিনীপুর শাখা। ইতিমধ্যে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের উচ্চস্তরের নেতারা প্ল্যান করেছেন এক দুঃসাহসিক অভিযানের। ব্রিটিশ দম্ভের প্রতীক কলকাতা শহরের বুকে রাইটার্স বিল্ডিং। ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ব্রিটিশের এই দুর্ভেদ্য দূর্গে এবার আঘাত হানার পরিকল্পনা করা হল। পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া হল তিনজন নির্ভীক তরুণকে। নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হল বিনয় বসুকে। বিনয় তখন ডাক্তারির শেষ বর্ষের ছাত্র। গোয়েন্দা পুলিশের বড়কর্তা লোম্যানকে হত্যার অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেলেঘাটায় রাজেন গুহ’র বাড়িতে আত্মগোপন করে আছে। মেজদার মনে আছে বিনয়ের সন্ধানে যখন পুলিশের তৎপরতা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখন তিনি আর সুভাষ দুজনেই পরামর্শ দিয়েছিলেন বিদেশে চলে যেতে। কারণ চিরকাল গা ঢাকা দিয়ে থাকা সম্ভব না, আর বিনয়ের মত ছেলে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়া মানে দলের জন্য নিঃসন্দেহে বিরাট ধাক্কা। কিন্তু এই রাইটার্স বিল্ডিং অপারেশনের পরিকল্পনা শুনে বিনয় নিজেই দেশ ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে। বিনয়ের সুযোগ্য সহকারী হিসাবে এই অভিযানে বেছে নেওয়া হয়েছিল দীনেশ গুপ্ত আর বাদল গুপ্ত’র নাম। অদ্ভুত সমাপতন, তিন তরুণ ঢাকার তিন পাশাপাশি গ্রামের ছেলে।
পরের দিন সকালে নিজের কর্মক্ষেত্রে যেতে যেতে গাড়িতে বসে শরৎচন্দ্র সেদিনের কেসের কাগজপত্র দেখতে দেখতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। মনে পড়ছিল এই তো সেদিনের কথা যেদিন রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। প্রধান লক্ষ্য ছিল কারাবিভাগের সর্বময় কর্তা কর্নেল সিম্পসন। জেলে থাকাকালীন সুভাষচন্দ্রের ওপর দৈহিক অত্যাচার করেছিলেন এই শ্বেতাঙ্গ। অনেক রক্ত সেদিন ঝরেছিল। ব্রিটিশ শাসনের এই দাম্ভিক অফিসারকে বুঝিয়ে দিতে হবে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের তরুণ স্কোয়াড কখনো এই অত্যাচার নীরবে মেনে নেবে না। নিজের রক্ত দিয়ে সেই ঋণ শোধ করতে হয়ছিল কারাবিভাগের কর্তাকে। গত বছর, ১৯৩০ সালের ৮ই ডিসেম্বর রাইটার্স বিল্ডিং শব্দমুখর হয়ে উঠেছিল এই তিনটি ছেলের অগ্নিবর্ষী রিভলভারের শব্দে। ব্রিটিশ দম্ভের ভিত্তি নড়ে উঠেছিল তিন তরুণের বিক্রমে। কর্নেল সিম্পসনের মত অনেককেই সেদিন এদের বীরত্বের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছিল। কেউ প্রাণ দিয়ে, আর কেউ পালিয়ে, প্রাণে বেঁচেছিল। অবশেষে ‘সুসভ্য’ ব্রিটিশ সরকার তিনজন রিভলভারধারী তরুণকে সামলানোর জন্য ডাক দিয়েছিল রাইফেলধারী গোর্খাবাহিনীকে। শুরু হল বিখ্যাত অলিন্দযুদ্ধ। দীনেশের পিঠে আঘাত লাগে। আহত অবস্থাতেও সে সমান বিক্রমে লড়াই করে। অবশেষে সেই চিরন্তন সমস্যা – কার্তুজ শেষ। বিনয় আর দীনেশের তাও একটা করে গুলি অবশিষ্ট ছিল কিন্তু বাদলের তাও ছিল না। পরিকল্পনামত একটা খালি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মুখে পটাশিয়াম সায়ানাইডের ট্যাবলেট দিয়ে দেয় তিনজন। বিনয় আর দীনেশ অবশিষ্ট একটা গুলিও চালিয়ে দেয় নিজেদের ওপর। তার ফলেই হয়তো সায়ানাইডের অ্যাম্পুল ভাঙা যায়নি। বাদল ঘটনাস্থলেই মারা যায়। অত্যন্ত আহত অবস্থায় বিনয় আর দীনেশকে নিয়ে যাওয়া হয় মেডিক্যাল কলেজে। সেখানকার উজ্জ্বল ছাত্র বিনয় জানত কি করে ব্রিটিশের চিকিৎসাকে অস্বীকার করা যায়। নিজের ক্ষতস্থানে আঙ্গুল চালিয়ে বিষাক্ত করে দিয়েছিল সে। অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে আঘাত বিষাক্ত হয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই যোদ্ধা। ধীরে ধীরে সুস্থ হওয়ার পর আলিপুর জেলে পাঠানো হয় দীনেশকে। যথাসময়ে বিচারপতি গার্লিক রায় দিলেন মৃত্যুদন্ডের। অনেক অ্যাপীল, আবেদনেও কোনো সাড়া দেয়নি ব্রিটিশ সরকার। তবে এ তো জানাই ছিল। দীনেশ কন্ডেমড সেলে থাকার সময়ে সুভাষচন্দ্র আলিপুর জেলে ছিলেন কিছুদিন আইন অমান্য আন্দোলনের সময়। সেইসময় জেলর ছিলেন মিস্টার সোয়ান। আইরিশ এই ভদ্রলোক ব্রিটিশ জেলের কর্মচারী হলেও সুভাষকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখেই দেখতেন। সুভাষ পরিকল্পনা করেছিলেন সরস্বতী পুজোর। জেলর তারও অনুমতি দিয়েছিলেন। এই সুযোগে কন্ডেমড সেলের বন্দি দীনেশকেও কিছুক্ষণের জন্য বাইরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল। ৮ই ডিসেম্বর ১৯৩০ থেকে ৭ই জুলাই ১৯৩১ – কদিনই বা আর? ভোররাতে দীনেশের ফাঁসির সাথে সাথে যবনিকা পড়ে গেল স্বাধীনতার ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের। কন্ডেমড সেলে থাকার সময় নিজের পরিচিত মানুষদের বেশ কিছু চিঠি লিখেছিল দীনেশ, যা আজ তাঁর ভাইকে সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যিই, মাত্র ২০ বছরের একটি তরুণের এই জীবনবোধ বিস্ময় সৃষ্টি করে বৈকি! দীনেশ তাঁর একটা চিঠিতে লিখেছিল,
“যার প্রাণ আছে, শ্রেয়কে বরণ করবার জন্য যার আছে শ্রদ্ধা – সে কি কখনো তার মহাশঙ্খের আহবান শুনে স্থির থাকতে পারে? কি শক্তি আছে সংসারের এই মিথ্যা মোহের যে তাকে আটকে রাখবে? তার আহবানে কি শক্তি আছে জানিনা –
শুধু জানি – যে শুনেছে কানে
তাহার আহবান গীত, ছুটেছে সে নির্ভীক পরাণে
সংকট-আবর্ত মাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন,
নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি; মৃত্যুর গর্জন
শুনেছে সে সঙ্গীতের মত…”
রবীন্দ্রভক্ত দীনেশের পক্ষে কবির এই ‘আহবান গীত’ মর্মে উপলব্ধি করার ক্ষমতা অনেকের চেয়েই বোধহয় বেশি ছিল। সত্যিই তাই। এই দামাল ছেলেগুলো সে ‘আহবান গীত’ শুনেছে বলেই এদের নির্ভীক এবং দুঃসাহসিক পদক্ষেপ দেশমাতৃকাকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে পারে। দীনেশের হাতে যে মেদিনীপুর তৈরি হয়েছিল সেখানকার ছেলেরা ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে তাদের দীক্ষাগুরুর এই ফাঁসি তারা নীরবে মেনে নেবে না। মেদিনীপুরের কুখ্যাত জেলাশাসক পেডি’কে প্রাণ হারাতে হয়েছে দীনেশের সুযোগ্য ছাত্র বিমল দাশগুপ্ত’র হাতে। দীনেশের ফাঁসির তিনমাস আগেই ৭ই এপ্রিল ১৯৩১-এ এই অভিযান চালানো হয়। দীনেশের হাতে গড়া মেদিনীপুর আরো অনেক বলিদানের জন্য অবিচল চিত্তে প্রস্তুত। আর কত তরুণ তাজা প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা আসবে কে জানে!
হঠাৎ তন্ময়তা ভেঙে গেল মেজদার। গাড়ি এসে থেমেছে কোর্টের দরজায়…কাগজপত্র গুছিয়ে এগিয়ে চললেন নিজের অফিসের দিকে। ভবিষ্যত ভারত যেন ভুলে না যায় এই ছেলেদের কথা যারা নিজের আদর্শের জন্য অবিচলচিত্তে প্রাণ দিচ্ছে। অনাগত ভবিষ্যতের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, যারা আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে তাদের নামে রাস্তা, তাদের মূর্তিস্থাপন না করে দেশের মানুষ তাদের নিজেদের মনে স্থান দিক। স্বাধীন ভারতে এই ডালহৌসি স্কোয়ার পরিচিত হবে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামে। কিন্তু শুধু একটা রাস্তার নাম না। দীনেশ যেন একটা জ্বলন্ত আদর্শরূপে বেঁচে থাকে বাংলার যুবসমাজের কাছে।
তিন বাঙালী যুবকের সেই সংগ্রাম আজও আমাদের অবাক করে। কতটা সাহসী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে এইরকম আক্রমণ শানানো যায় তা ভাবার বিষয়। পুলিসের তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে রাইটার্সে ঢোকা এবং বেরোনোর পথ রুদ্ধ জেনেও হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মানসিকতা দেখে উদ্বুদ্ধ হয় বিপ্লবীরা।
দীনেশচন্দ্র গুপ্ত বা দীনেশ গুপ্তের জন্ম ১৯১১সালের ৬ই ডিসেম্বর। বাবা সতীশচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী। পূর্ব বাংলার নেত্রকোণায় দীনেশের জন্ম। তাঁর বাবা সেই সময় চাকরিসূত্রে এখানে ছিলেন। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন তৃতীয় সন্তান। মা বিনোদিনী দেবী ও পরিজনরা তাঁকে ভালোবেসে ডাকতেন নসু নামে। বাবার বদলির সূত্রে দীনেশ চার বছর বয়সে চলে আসেন গৌরপুরে। সেখানে জমিদারের ঠাকুর দালানের পাঠশালায় প্রবেশ। ছাত্রসংখ্যা খুবই স্বল্প। নয় বছর বয়সে ঢাকা গ্যান্ডারিয়াতে দাদুর বাড়িতে থাকতে যান। সেখানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পড়তে শুরু করলেন। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও প্রচুর পড়তেন। বিশেষত ডিটেকটিভ গল্প। তাঁর বন্ধুস্থানীয় বিপ্লবী বঙ্গেশ্বর রায় বলেছেন—
‘চাল চলতিতে কথাবার্তায় স্কুল গণ্ডির বাইরে পড়াশোনায় দীনেশদা বয়সের মাপের চেয়ে আরও বড় ছিলেন। মনে পড়ে, পাড়ার সরকার বাড়ির মাঠে বিকাল-সন্ধ্যায় যখন খেলাধুলা বা বিশ্রাম করতাম দীনেশদাকে পাশের রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলেই টেনে এনে বসাতাম গল্প বলার জন্য। পীড়াপীড়ি করলেই শুরু করতেন সেকালে বিখ্যাত ডিটেকটিভ উপন্যাসের মিঃ ব্ল্যাক ও মিঃ ব্যাটের কাহিনী। দীনেশদা’র বয়স তখন বারো, কিন্তু গল্প বলার ক্ষমতা ছিল অদ্ভুত।’
যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর ছিল অনিবার্য উপস্থিতি। বক্তৃতা করতেন সাবলীলভাবে। সমবয়সীদের যা কল্পনার অতীত। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভক্ত দীনেশের মন ছিল মমত্বপূর্ণ। তিনি সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
‘পুজোর একটি দিনে আমার বড় কষ্ট হতো। সেটা অষ্টমীর দিন। জমিদার বাড়ির প্রথামত একশ আটটা পাঁঠা সেদিন বলি দেওয়া হত। পাঁঠাগুলো যেন আগের থেকে বুঝতে পারতো। তাদের সে কাতর চাউনি আর ভয়ার্ত কম্পন এখনও আমার চোখে ভাসছে। সে কী দৃশ্য, একটির পর একটি বলি হচ্ছে। চারিদিকে জয়ঢাকের বাদ্য আর সমবেত ভক্তবৃন্দের চিৎকার। চিৎকারটা ভক্তিতে না মাংসের লোভে বলতে পারি না, কিন্তু আমি সেখানে দাঁড়াতে পারতাম না।’ নিপীড়িতের যন্ত্রণা দেখে তাঁর হৃদয় কাঁদলেও তিনি কিন্তু দুর্বল চিত্তের ছিলেন না। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ছিলেন সোচ্চার।
বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে দেশের যুবসমাজের একাংশ সশস্ত্র আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মহারাষ্ট্রের শিবাজী উৎসবকে ঘিরে বাংলা ও মহারাষ্ট্রের চরমপন্থীদের মধ্যে যোগাযোগ নিবিড় হয়। বাংলার যুবকরা বারুদমাখা পথে চলতে শুরু করে। দীনেশও সেই সরণি ধরলেন। যুক্ত হলেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স গুপ্ত সংগঠনে। ১৯২৬সালে ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করে মেদিনীপুরে বেড়াতে যান। সেখানে তাঁর দাদা যতীশচন্দ্র গুপ্ত ওকালতি করতেন। কিছুদিন থেকে আবার ঢাকায় এসে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। যদিও সংগঠনে অতিরিক্ত সময় দেবার জন্য আই এস সি পাস করেননি সেবার।
এরপর দলের নির্দেশে মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি হন। শিক্ষালয়ের কাছাকাছি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স এর শাখা স্থাপন করতে তিনি উদ্যোগী হন। মেদিনীপুরে বড়বাজারে অভয় আশ্রম নামের একটি দেশীয় পোশাকের দোকান ছিল। এছাড়া তিলক পাঠাগার নামক একটি গ্রন্থাগারে প্রচুর দেশপ্রেম মূলক বইপত্র আসতো। বিপ্লবী মতাদর্শে বিশ্বাসী কিশোর যুবকরা ভিড় জমাতেন সেখানে। দীনেশ গুপ্তও সেখানে যাতায়াত করতেন। উদ্দেশ্য ছিলো উপযুক্তদের দলে টেনে আনা। বল্লভপুর মহল্লায় একটি আখড়া বানিয়ে দেহচর্চার কাজও শুরু করেছিলেন। কিছুদিন বাদে মেদিনীপুর কলেজ থেকে আই এ পাস করে পুনরায় ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন বি এ পড়ার অভিপ্রায়ে।
রায় কোম্পানি নামে একটি মদের দোকান ছিল ঢাকার রায়পুরে। স্বদেশীরা তখন পিকেটিং করছিল দোকানের সামনে। হঠাৎ সেখানে হাজির হয় পুলিস সুপার হডসন। এসেই বিক্ষোভকারীদের মারধর শুরু করেন। চারপাশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। ঝামেলার সময় সাইকেলে চেপে আসেন দীনেশ। রক্তাক্ত কর্মীদের দেখে অত্যন্ত উত্তেজিত স্বরে হডসনকে বলেন— ‘ওকে মারধর করা আপনার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না।’ শোনামাত্রই সাহেব রিভলভার তাক করে। অসীম সাহসী দীনেশ এগিয়ে এসে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় বন্দুকের নলের সামনে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অস্ত্র খাপবদ্ধ করে চম্পট দিলেন সাম্রাজ্যবাদের অনুচরটি।
সুভাষচন্দ্র বসুকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন দীনেশ গুপ্ত। তাঁর বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের কাজে আরো গভীর মনোনিবেশ করেন। অচিরেই মেদিনীপুরের শাখা সংগঠনটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পরিমল রায়, ফণিভূষণ কুণ্ডু, হরিপদ ভৌমিক, রামকৃষ্ণ রায়, শচীন কানুনগো প্রমুখরা যোগ দিলেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে। দল করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন ধর্মীয় ভেদাভেদ অনেক ক্ষেত্রে শত্রুদের সুবিধা পাইয়ে দেয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারকে তিনি ঘৃণা করেছেন।
১৯২৯ সালের শেষ দিকে তিনি আবার ঢাকায় যান। সেই সময় ‘বিউলি ইনস্টিটিউটে’ গিয়ে শরৎচন্দ্রের ‘ষোড়শী’ নাটকটি দেখেন। বিপ্লবী নেতা সুপতি রায়ের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল। সুপতি রায় কলকাতা থেকে নির্দেশ পাঠান— বাংলার গভর্নরের ওপর নেপাল নাগ ও দীনেশ গুপ্ত আক্রমণ চালাবে। পরে সে প্রস্তাব বাতিল হয়। পরে রাইটার্স অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন নেতারা।
১৯৩০সালের ৮ই ডিসেম্বর বিনয়, বাদল, দীনেশ ট্যাক্সি চেপে রওনা দিলেন মহাকরণের পথে। লালবাড়ির সামনে নেমে নিজেদের শেষবারের মতো প্রস্তুত করে নিলেন। কোটের নিচে রিভলভার গোঁজা। গলায় মাফলার থাকায় কোমরে সাঁটানো আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যাচ্ছে না। বিপ্লবী প্রফুল্ল দত্ত আগেই রাইটার্স বা মহাকরণের ভিতরের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। দোতলায় উঠে একবার থামলেন বিনয়। বারান্দা দিয়ে দেখলেন চারদিকে সবুজের সমারোহ। আলোয় দুনিয়া ভেসে যাচ্ছে। নিচে দাঁড়িয়ে জীতেন সেন। ডালহৌসির দিঘির ধারে অপেক্ষা করছেন। গুলির আওয়াজ পেলেই তিনি চলে যাবেন আলিপুর চিড়িয়াখানার নির্দিষ্ট স্থানে। যেখানে রসময় শূর ও অন্যান্যরা অপেক্ষা করছেন। একবার চোখাচোখি হলো জীতেন ও বিনয়ের। তারপর এগিয়ে চললেন সিম্পসনের ঘরের দিকে। তাকে খতম করে এগোলেন বিচার বিভাগের সেক্রেটারি নেলসনের ঘরের দরজায়। নেলসন গুলির আওয়াজ পেয়ে বাইরে উঁকি মারতেই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি। পায়ে আঘাত পেয়ে গড়িয়ে যান নেলসন। বিপ্লবীরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বারান্দা দিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। আহত হলেন বাংলা সরকারের প্রধান সেক্রেটারি টাউসেন্ড সাহেব, অ্যালবিয়ান, প্রেস্টিস। চার্লস টেগার্ট, মিস্টার গর্ডন, মিস্টার বার্ট বিরাট পুলিস বাহিনী নিয়ে হাজির হয়। উপস্থিত হলো গোর্খা বাহিনী।
মহাকরণের অলিন্দ সেদিন রণক্ষেত্রের চেহারা। গুলির হুঙ্কার আর বারুদের তীব্র গন্ধে রুদ্ধশ্বাস কেরানিকুল ও তাঁদের সাহেববর্গ। বিদেশী শোষকদের কাঁপন ধরিয়ে দেন বিনয়, বাদল, দীনেশ। পুলিস একসময় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে প্রতিরোধ শুরু করে। বিপ্লবীদের গুলিও প্রায় নিঃশেষ। তাঁরা একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আর দেরি করলে বিপদে পড়ে যাবে বিপ্লবী আন্দোলন। কোনোমতেই জ্যান্ত ধরা দেওয়া চলবে না। বাদল মুখে পুরে দিলেন বিষের প্যাকেট। বিনয় কালবিলম্ব না করে জিভে ঢেলে দিলেন পটাশিয়াম সায়ানাইড। কিন্তু বিষে যদি প্রাণ না যায় সেই ভেবে রিভলভারটা চেপে ধরলেন গলার ঠিক নিচে। অবিচলভাবে ট্রিগার দাবালেন। গলার মাংস ছিঁড়ে গুলি মাথায় পৌঁছালো। রণক্লান্ত বীর রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে। তার আগে দীনেশ জ্ঞান হারিয়েছে। তিনিও বিষপান করেছেন, গুলি চালিয়েছেন নিজের দেহে। বাদল ঘটনাস্থলেই মারা যান। বিনয় আর দীনেশকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৩ই ডিসেম্বর বিনয় বসু মারা যান। নিজের ক্ষতস্থান দু’হাতে খুঁচিয়ে বিষাক্ত করে চলে গেলেন বীর বিপ্লবী। কিন্তু বেঁচে উঠলেন দীনেশ গুপ্ত।
কিঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাঁকে পাঠানো হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। আলিপুর আদালতে গার্লিক সাহেবের এজলাসে বিচার শুরু হয়। ফাঁসির আদেশ হয়। দেশবাসী দীনেশকে বাঁচানোর জন্য জয়েন্ট ডিফেন্স কমিটি গড়ে হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলা চালায়। কিন্তু স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল পুরানো আদেশই বহাল রাখে। জেলে থাকার সময় তিনি বেশ কিছু চিঠিপত্র লিখেছিলেন। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ নামে একটি গল্প লেখেন। যা ১৩৩৭বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ফাঁসির আগের দিন মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বীর পুত্রের। চোখের জল বাঁধ মানে না বৃদ্ধার। বুক মোচড়ানো হাহাকার ওঠে মায়ের হৃদয়জুড়ে। কাল আবার সূর্য উঠবে, পাখি ডাকবে, শুধু জাগবে না তাঁর প্রিয় ‘নসু’। সে তো হারিয়ে যাবে অন্য কোনোখানে। সাম্রাজ্যবাদীর বিষাক্ত ছোবলে নীল হয়ে লোপ পাবে তাঁর সন্তান। ছেলে জেলে বসে মাকে লিখেছিলেন— ‘মনে করিও তোমার এক পুত্রের পরিবর্তে ভারতের সমস্ত ছেলেকে তুমি পুত্ররূপে পাইয়াছ। তুমি তাদের সকলের মা। তুমি তাদের সকলকে তোমার ‘নসু’র মতো ভালবাসো। আপন হৃদয়কে যদি বিস্তার করিতে পার, তবে শান্তি পাইবে। ভালবাসো দুঃখী, কাঙাল, অনাথ, আতুরকে। আপন সন্তানের মতো ভালবাসো। ক্ষুদ্র সংসারের গণ্ডির বাইরে ভালবাসা বিলাইয়া দাও, অপার আনন্দ পাইবে।’
চারপাশে গাঢ় অন্ধকারের প্রলেপ। মাঝে মাঝে নিশাচর প্রাণীদের চলাফেরার শব্দ। কাছের কোনো বুনো ঝোপ থেকে হালকা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। রাত বাড়লে কবরের স্তব্ধতা নেমে আসে আলিপুর জেলজুড়ে। খানিক দূরে দূরে লাগানো দেওয়াল লণ্ঠনের ঝাপসা আলো কেমন যেন মায়া ছড়ায়। কয়েদীরা কেউ ঘুমায়নি। ৭ই জুলাই ১৯৩১। আজ আরেকটি নক্ষত্র পতন ঘটবে। খানিকবাদে পাথর ঢাকা বারান্দায় শোনা গেলো ভারী বুটের সদম্ভ উপস্থিতি। একসঙ্গে একাধিক। রাত শেষ হতে আরো খানিকটা বাকি। ফাঁসির মঞ্চের সন্নিকটের কুঠরিটা খুলে গেল। উর্দিধারী পুলিসসহ এলেন আইরিশ জেলার মিস্টার সোয়ান। দ্রুত স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলেন দীনেশ গুপ্ত। তারপর এগিয়ে চললেন শেষ যাত্রায়।
কোনো কিছুর লোভে এই মানুষগুলি জীবনপণ করেনি। কেবলমাত্র দিনবদলের স্বপ্ন দু’চোখে মেখে নেমেছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে। অর্থ নয়, স্বচ্ছলতা নয়, গদি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নয়। শুধুমাত্র মানুষের প্রতি ভালোবাসার অমোঘ টানে ছুটেছিলেন অগ্নিঝরা পথে। বন্দীদশায় লিখেছিলেন, ‘যে যাকে ভালোবাসে তার জন্য প্রাণ দিতেও কি সে কুণ্ঠিত হয় কখনও? মানুষের বড় বড় কাজ দেখে আমরা অপরিসীম বিস্ময়ে অবাক হয়ে থাকি। ভাবি, একাজ সে করলো কেমন করে? কিন্তু মূল খুঁজলে পাওয়া যাবে ভালোবাসার প্রস্রবণ। তারই সরস রসে সিঞ্চিত হয়ে মানুষ দিতে পারে হাসিমুখে আত্মবিসর্জন।’
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট অনেক রক্ত ঘাম অশ্রুর বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। প্রফুল্ল চাকী, ক্ষুদিরাম বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কানাইলাল দত্ত, বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্তের মতো বিপ্লবীদের আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি আমরা। তাঁরা আছেন আমাদের হৃদয়ে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শহীদদের প্রতি রয়েছে আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভালোবাসা। লড়াই আজও শেষ হয়নি। সাম্রাজ্যবাদের থাবা এখনও উদ্যত। মুক্তির যুদ্ধে আজও প্রেরণা জোগায় এই অমর শহীদরা।
(তথ্যসূত্র:
১- শ্রী শৈলেশ দে’র লেখা “আমি সুভাষ বলছি”র প্রথম খণ্ড থেকে প্রাপ্ত অলিন্দযুদ্ধের শহিদ শ্রী দীনেশ গুপ্ত’র জীবনের বিভিন্ন উপাদান দ্বারা এই নিবন্ধ লিখিত। কিছু চিঠি এবং বইটিতে বর্ণিত কিছু ঘটনার আধারে এই রচনায় জেনেশুনে কোথাও ইতিহাসকে অতিক্রম করা হয়নি।
২- মুক্তির মন্দির সোপান তলে, দীপক কুমার রায় ও অরুণা চৌধুরী।
৩- বৃটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জীবনকথা, তপন কুমার দে, জাগৃতি প্রকাশনী।
৪- যা ইতিহাসে নেই, বিমল মিত্র, বিপ্লবীদের কথা (২০১৪)।
৫- শহীদ দীনেশ গুপ্তের জীবন, অসিতাভ দাশ, সাহিত্য ও পত্রাবলী।
৬- মনে রেখো, বঙ্গেশ্বর রায়।
৭- গণশক্তি পত্রিকা, ১৯শে জুন ২০১১ সাল।
৮- বিনয়-বাদল-দীনেশ, শৈলেশ দে।
৯- আমাদের গর্ব বিনয় বাদল দিনেশ, চিন্ময় চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত