১৯৫২-৫৩ সাল। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রেকর্ডিংয়ের জন্যে এসেছেন কলকাতায় এইচএমভি স্টুডিয়োতে। রিহার্সাল রুমে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। মুখোমুখি পরিচয় সেই প্রথম। এর আগে থেকেই সলিলের গান কণিকার ভীষণ প্রিয়। সে দিন কণিকা বলেই ফেললেন, সলিলের গান গাইতে তাঁর খুব ইচ্ছে করে। এ কথা শুনেই সলিল চৌধুরী দিন দুয়েকের মধ্যেই কণিকার জন্যে দুটো গান তৈরি করে ফেললেন। রেকর্ডিংও হয়ে গেল। এর পরেই গন্ডগোলের শুরু।
খবর গেল শান্তিনিকেতনে। কণিকা লিখছেন, ‘সলিলের গান করেছি, এ খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছল যথারীতি। অনেকে আপত্তি করলেন, কেন আমি রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে আবার আধুনিক গান গাইব? রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়লাম কোথায়! সে গান তো আমার সারাজীবনের আশ্রয়। কিন্তু তর্কে আমি কুঁকড়ে যাই। লড়াই চালাতে ইচ্ছে করে না। ফলে আপত্তি মেনে নিলাম। সলিলকে জানালাম, বের করা যাবে না ওই রেকর্ড। দুঃখ পেয়েছিল সলিল। আমিও কম দুঃখ পাইনি।’ শেষে উৎপলা সেনকে দিয়ে রেকর্ডে গাওয়ালেন সলিল চৌধুরী। ১৯৫৩ সালের পুজোয় প্রকাশিত সেই গানদুটি হল ‘প্রান্তরের গান আমার’ এবং ‘আমার কিছু মনের আশা’। কণিকার গলায় গানদুটির আর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি পরে। এর কয়েক বছর পরে আবারও দুটি আধুনিক গান রেকর্ড করেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়— ‘পত্র লিখি কাজল মেঘে’ এবং ‘সুরের পথে ঘুরে বেড়ায় আমার মন’ (কথা: শ্যামল গুপ্ত, সুর: মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়)। কিন্তু এই রেকর্ডদুটিও প্রকাশিত হল না, কণিকারই অনুরোধে। কারণ হিসেবে তাঁর প্রথম রেকর্ডকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের দুঃখ পাওয়ার কথা বলেছিলেন কণিকা। সলিল-সংক্রান্ত পূর্ব অভিজ্ঞতাও হয়তো একই সঙ্গে তাঁর ভেতরে কাজ করেছিল। যদিও কণিকার প্রয়াণের পর একটি অ্যালবামে মানবেন্দ্র-সুরারোপিত গানদুটি সঙ্কলিত হয়।
রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির মনে কণিকার সঙ্গে সঙ্গেই থাকেন সুচিত্রা মিত্র। আর কী আশ্চর্য, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়-সলিল চৌধুরীর এই ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন তিনিও! সুচিত্রা প্রথমে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র সেখানেই সীমাবদ্ধ না থেকে, নিজেকে মেলে ধরেছিলেন নানান ক্ষেত্রে। যার মধ্যে ছিল ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’-র সঙ্গে যুক্ত হওয়াও। সেখানেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা সলিল চৌধুরীর সঙ্গে।
১৯৫০-এ সলিলের কথায়-সুরে সুচিত্রা রেকর্ডে গাইলেন ‘সেই মেয়ে’। রবীন্দ্রনাথের ময়নাপাড়ার কৃষ্ণকলি পরবর্তী কালে দেশভাগের বলি হয়ে কোন অবস্থায় পৌঁছেছে, তার আন্তরিক চিত্র এঁকেছিলেন সলিল চৌধুরী ‘সেই মেয়ে’ গানে, সুচিত্রা মিত্রের অসামান্য পরিবেশন যাকে পূর্ণতা দিয়েছিল। এ গান নিয়েও কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার উল্লেখ আছে সলিল চৌধুরীকে নিয়ে লেখা সুচিত্রা মিত্রের ‘পুরনো আখরগুলি’ নামে লেখায়। লিখেছেন, এ গান বেরোনোর পর ‘রবীন্দ্রভক্ত’রা তাঁকে ‘আক্রমণ করলেন’, ‘অপমান করলেন’, তাঁর সামনে গানের ডিস্কটি ভাঙাও হল। কারণ হিসেবে লিখেছেন, ‘আমি কেন এক দাগি কমিউনিস্টের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির parody গাইলাম।’ তাঁর বক্তব্য, ‘আমি সেদিনও বলেছি, আজও বলছি— “সেই মেয়ে” কৃষ্ণকলির parody নয়। সলিলের প্রতিভাকে আমি ঠিকই চিনেছিলাম। ওঁরাই চেনেননি।… রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সলিলের সঙ্গীতপ্রতিভাকে সম্মান জানাতেন, স্বীকৃতি দিতেন, এতে আমার সন্দেহ নেই।’
একই লেখায় সুচিত্রা মিত্র উল্লেখ করেছেন কণিকা-সলিল সংযোগের ঘটনার কথাও— কী ভাবে গানদুটির টেস্ট-প্রিন্ট পেয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তা বাজারে বেরোতে পারেনি। তিনি আরও বলেছেন, ‘চোখের জলে অর্ধেক মুছে যাওয়া একটি চিঠিতে’ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সলিল চৌধুরীকে লিখেছিলেন, ‘কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে। কাজেই আমাকে ক্ষমা কোরো ভাই।’
উল্লেখ্য, শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া প্রথম রেকর্ডের গানদুটি কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, ছিল আধুনিক গান। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত ওই রেকর্ডে নীহারবিন্দু সেনের কথায় ও হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে কণিকা গেয়েছিলেন ‘ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার’ ও ‘গান নিয়ে মোর খেলা’। রবীন্দ্রনাথ তখন বেঁচে। এ ঘটনায় তিনি একটু দুঃখ পেয়েছিলেন। কণিকার ভাষায়, ‘আমার আধুনিক গানের রেকর্ড বের হওয়ায় দুঃখ পেলেন গুরুদেব।…গুরুদেব দুঃখ পাওয়ায় আমারও মন খারাপ হয়ে গেল।’ খুবই স্বাভাবিক। যে ছোট্ট মেয়েটার মিষ্টি গান শুনে তাঁকে আশ্রমে টেনে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যাঁর পিতৃদত্ত ‘অণিমা’ নাম পালটে ‘কণিকা’ করে দিয়েছিলেন, সেই মেয়েটি প্রথম রেকর্ডে তাঁর গান ছাড়া অন্য গান গাইলে দুঃখ তো পেতেই পারেন কবি। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। কিন্তু সেই জিনিসই ঘটল কবির প্রয়াণের বেশ কয়েক বছর পর।
সালটা ১৯৫৮। সাধারণ পোশাক পরা ৩৫-৩৬ বছর বয়সের যুবকটি যখন দোকানে ঢুকল, দোকানের কর্মী ক্রিস্টিনা শুরুতে তেমন আমল দেননি। এ রকম বহু কৌতূহলী মানুষই আসেন তাঁদের দোকানে, বেশির ভাগই এটা-ওটা দেখেন, প্রশ্ন করেন, তার পর চলে যান। যে সমস্ত বাদ্যযন্ত্র এই দোকানে রাখা আছে, তা বোঝার মতো মানুষ কমই আছেন এই পৃথিবীতে।
সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের এই দোকানটি ইন্ডিয়ান মিউজিকের কার্যত একমাত্র প্রামাণ্য দোকান সারা আমেরিকায়। মালিক ডেভিড বার্নার্ড সেই সমস্ত জিনিস রাখেন যা দুনিয়ার ধ্রুপদী সংগীতের সমঝদাররা কদর করবেন। সেখানে এই সমস্ত সাধারণ এলেবেলে লোকেদের কোনও রকমে হাই-হ্যালো করে পাশ কাটিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
তাই এক রকম নিমরাজি হয়েই ওই যুবককে ‘‘এক্সকিউজ মি, স্যর, আপনাকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি?’’ জিজ্ঞেস করলেন ক্রিস্টিনা। আনমনা তরুণটি সেতার দেখতে চাইলেন। ক্রিস্টিনা বুঝলেন, এ নির্ঘাত শখের বাজনদার, কোথাও সেতারের শো দেখে তারও মাথায় সেতার বাজানোর শখ চেপেছে। দোকানের সংগ্রহের সাধারণ সেতারগুলো দেখানো শুরু করতেই লোকটা নিজে থেকেই নানান সেতার নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করল। কিছু ক্ষণ পর ক্রিস্টিনা বিরক্ত হয়ে গেলেন। প্রায় সব রকম সেতার দেখানোর পরও লোকটার যেন কিছুই পছন্দ হয় না। এ রকম একটা সাদামাটা লোক সেতারের বোঝেটা কি? এমন দারুণ দারুণ সেতারের কোনওটাই পছন্দ হচ্ছে না?
হঠাৎ একেবারে ওপরের তাকের দিকে আঙুল দেখিয়ে যুবকটি বললেন, ‘‘ওই সেতারটা মনে হচ্ছে কাজে লাগতে পারে, বাজিয়ে দেখি একটু? যদি দেখান…’’ সেতারটা অত্যন্ত দামি, নামানোও কঠিন, তা ছাড়া ওটা সাধারণের বাজানোর সেতার নয়, একমাত্র কোনও বিরাট মাপের সেতার-বিশারদ ওটা ঠিকঠাক বাজাতে পারেন। ক্রিস্টিনা গলায় একটু ঝাঁঝ মিশিয়েই বললেন, ‘‘ওটা সাধারণ সেতার নয়, নামানো যাবে না। তা ছাড়া ওটা বাজানোর অনুমতিও আপনি পাবেন না, কারণ ওটা ‘বস সেতার’। অত্যন্ত দামি, আর ও বাজানোও সহজ কাজ নয়। ও রকম একটা দামি আর জটিল সেতার নামী সেতারবাদকরা শুধুমাত্র বড় বড় অনুষ্ঠানেই বাজিয়ে থাকেন। আপনি বরং অন্যগুলোর মধ্যে থেকে একটা পছন্দ করুন।’’
কিন্তু যুবকটি নাছোড়বান্দা, সে ওই সেতারটাই দেখবে। এবং নিজে বাজিয়েই দেখবে। উপায় না দেখে ক্রিস্টিনা তাকে পাঠালেন মালিক ডেভিড বার্নার্ডের কাছে। এক প্রকার নিশ্চিত হয়েই যে ডেভিড তাকে পত্রপাঠ বিদেয় করবেন।
যুবকের কথায় কী মনে হল কে জানে, ডেভিড সেতারটা নামিয়ে বাজানোর অনুমতি দিলেন তাকে। সেতারের তার টিউন করতে করতে যুবকটি বললেন, ‘‘আপনারা একে ‘বস সেতার’ বলেন, আমাদের দেশে একে ‘সুরবাহার সেতার’ বলা হয়।’’ তার পর চোখ বুজে শুরু করলেন সেতার বাজানো।
বাজনা যখন শেষ হল, তখন দোকানের ভিতরে-বাইরে ভিড় জমে গেছে। ডেভিড এগিয়ে এসে যুবকটির হাত ধরে বললেন, ‘‘অসামান্য, অভূতপূর্ব! এ রকম বাজনা আমি শুধু পণ্ডিত রবিশঙ্করের শো-তে শুনেছি। হলফ করে বলতে পারি, আপনি ওঁর চেয়ে কম প্রতিভাধর নন। কে আপনি? দয়া করে আপনার পরিচয় দিন, আর বলুন আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।’’
যুবকটি বললেন, ‘‘এই সেতারটি আমি কিনব, আপনি শুধু বিলটুকু করে দিন।’’ দোকানের মালিক বললেন, কিনতে হবে না, আমি আপনাকে এই সেতারটা উপহার হিসেবে দিলাম।’’ ক্রিস্টিনা সেতারের সুর শুনে আবেগে কাঁদছিলেন, এগিয়ে এসে যুবকটির হাতে একটা ডলারের নোট গিয়ে বললেন, ‘‘আমি ভারতীয়দের একটু নিচু নজরে দেখতাম, গুরুত্ব দিতাম না, কিন্তু আপনার বাজনা যেন আমাকে চাবুক মারল। জানি না ভবিষ্যতে আমাদের দেখা হবে কি না, আমি এই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই। যদি অনুগ্রহ করে এই নোটে আপনার একটা অটোগ্রাফ দেন, আমি সারা জীবন এটা আমার সঙ্গে রাখতে চাই— এমন এক জন অসাধারণ প্রতিভার স্মৃতি হিসেবে।’’
যুবকটি সেতার নিয়ে ফিরলেন। সে বছরই, রাগ খাম্বাজের উপর তৈরি করলেন একটা গান, ব্যবহার করলেন সেই সুরবাহার সেতারটি। লতা মঙ্গেশকর গাইলেন সেই গান: ‘না যেয়ো না, রজনী এখনও বাকি…’। সুপারহিট সেই গান পরের বছর তৈরি করলেন হিন্দিতেও।
ক্রিস্টিনার নোটে সেই যুবক সে দিন লিখে এসেছিলেন নাম – সলিল চৌধুরী।
যাদবপুরে একটা কলেজের অনুষ্ঠানে বহু নামী শিল্পী এসেছেন। হাজির সলিলের গানের দলও। জলসায় শেষ শিল্পী হিসেবে গান গাওয়ার কথা ছিল পঙ্কজ মল্লিকের। তাঁর আগেই গাইবে সলিলের দল।
তত দিনে গড়চা রোডে গায়িকা গীতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ‘গণনাট্য সংঘ’-র শাখা তৈরি হয়েছে। সেখানে তখন নক্ষত্র সমাবেশ। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায়…।
ওঁদের যেখানেই ডাক পড়ছে, গাইতে হচ্ছে, ‘মানব না বন্ধনে’, ‘ও মোদের দেশবাসী’…। লোকজন হইহই করে সে-গান শুনছেন। যাদবপুরে তেমনই এক অনুষ্ঠান।
পঙ্কজ মল্লিক ডেকে পাঠালেন সলিলকে। অনুরোধ করলেন, ‘‘সলিল, আমি আগে মঞ্চে উঠব, তার পর তোমরা যদি গাও তো ভাল হয়। তোমাদের ওই সব হইচই গানের আগেই আমি গাইতে চাই।’’ সলিল এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন।
কিন্তু তখনও সলিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর সেই অধরা গান, যা তাঁকে রাতারাতি পৌঁছে দেবে শ্রোতাদের বসার ঘরে। এই খোঁজই ওঁকে এক দিন পৌঁছে দিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি।
১৯৪৯ সালের পুজোয় এইচএমভি-র হয়ে ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ রেকর্ড করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। রেকর্ডিংয়ের দিনে সলিল স্টুডিয়োয় হাজির হতে পারেননি। তিনি তখন আন্ডারগ্রাউন্ড।
এর পর থেকে পুজো মানেই সলিল-হেমন্ত জুটির একের পর এক কালজয়ী গান।
সলিলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কবি সুকান্ত। দু’জনে হরিহর আত্মা। সুকান্তের কবিতায় সুর করার আগে কবিতাগুলো যে কত বার পড়তেন! বলতেন, ‘‘কবিতাকে যদি সুরে ছাপিয়ে যেতে না পারি, তা হলে আমার কৃতিত্বটা কোথায়?’’
কলকাতা থেকে মুম্বই যাওয়ার পথে একবার আমাদের প্লেন ঝড়ের মুখে পড়েছিল। টালমাটাল অবস্থা। ভয়ে বুক কাঁপছে ‘কী হবে, কী হবে’ ভেবে। পরে ঝড়ের সেই ভয়ঙ্কর অভি়জ্ঞতা থেকেই লিখেছিলেন, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পুজোর গানে সলিলই সুর করতেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অ্যালবামের জন্য ও-সবই ছিল ‘ডিজাইনার’ গান। এইচএমভি-র নির্দেশে সলিলকে তাঁর সেরাটা সরিয়ে রাখতে হত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা লতা মঙ্গেশকরের জন্য।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর রসায়ন ছিল দেখবার মতো। যত গান তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্য তৈরি করেছেন — শ্যামল মিত্র, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জন্য তাঁর অর্ধেকও নয়। কিন্তু ১৯৬৩ সালে সলিলের কথায়-সুরে বাঙালি শ্রোতারা পেয়েছিলেন দুটি অনবদ্য গান। একটি ‘দূর নয় বেশি দূর ওই সাজানো সাজানো বকুলবনের ধারে’। গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। আর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন ‘পল্লবিনী গো সঞ্চারিণী, মন না দিয়ে আর পারিনি’। দুটি গানই ফিরত শ্রোতাদের মুখে মুখে।
আর লতা মঙ্গেশকর? তিনি বলতেন, ‘আমার সরস্বতী’। লতা মঙ্গেশকর একদিন বাংলা গান গাইতে চাইলেন। ১৯৫৯-এ লতা মঙ্গেশকরের জন্য জন্য দুটি গান বাঁধলেন— ‘না যেও না, রজনী এখনও বাকি’ আর ‘বাঁশি কেন গায়’। রেকর্ডের দু’পিঠে দুটি গান।
বাংলা আধুনিক গানে ওটাই ছিল লতা মঙ্গেশকরের প্রথম রেকর্ড। এর পরে ২৪টি গান লতা মঙ্গেশকর গেয়েছেন ওঁর সুরে। গানে অসম্ভব সব কঠিন সুর বসালেও সে-গান তুলে নিতেন লতা মঙ্গেশকর। তবে যতক্ষণ না গানটি পুরোপুরি তুলে নিতে পারছেন, বাংলা উচ্চারণ প্রায় নির্ভুল ভাবে না করতে পারছেন, ততক্ষণ তিনি মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়াতেন না।
লতা মঙ্গেশকরের মতোই খুঁতখুঁতে ছিলেন মান্না দে’ও। গান নিয়ে তিনি কোনও কম্প্রোমাইজ করতেন না। বলতেন, ‘‘দাঁড়ান সলিলবাবু, আর একটু বাকি আছে। যাবেন না।’’ গান শেষ হলে সলিলকে নিয়ে মান্না দে ঢুকে পড়তেন কোনও একটি ঘরে। সলিলের ‘জোকস’-এর ভাঁড়ার ছিল অফুরন্ত। শুনতেন সে সব। আর ফেটে পড়তেন হাসিতে।
উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’র মতো গান সলিল তুলে রেখেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্যই। সুরের ওঠাপড়ায় এমন গান বাংলায় খুব কমই হয়েছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মনে করতেন, তাঁর বাড়িতে সলিলকে ডেকে যদি কোনও ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া যায়, তবেই সলিল পারবে সেরা কোনও সুর সৃষ্টি করতে।
আসামের চা বাগানে বেড়ে ওঠা। কাছ থেকে দেখেছেন শ্রমিক মেহনতি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। তাই গণসংগীতে জন্মেছিলো এক অন্যরকম ভালোলাগা। তো চল্লিশের দশকে একদিন নতুন কয়েকটি গণসংগীত নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গেলেন। গানগুলো শোনালেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন যেহেতু রাজনৈতিক গান, এগুলো তো আর রেকর্ড করা যাবে না বরং অন্য গান শোনাও। কিছুটা মন খারাপ করে ফিরে আসছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়লো একটা কবিতার কথা। আবার ফিরে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। গিয়ে কবিতার খাতা খুলে অর্ধেক লেখা কবিতাটা সুর করে শোনালেন।
শুনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন, “আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম এ এক আশ্চর্য কীর্তি। বলা যায় সেই মুহূর্তেই জন্ম নিলো রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলার সেরা কাব্যগীতি: ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’।”
উনি সাধারণত কখনও একটা গান পুরোপুরি শেষ করতেন না। অর্ধেক করে রেখে দিয়ে অন্য গানে চলে যেতেন বা কবিতা লিখতে বসে যেতেন। যখন রেকর্ডিংয়ের জন্য শিল্পী গানটা শিখতে আসতেন, তখন বাকি গানটা লিখে দিতেন। বাসায় ফিরে শেষ করলেন ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো’ গানের বাকি অংশ। গানের রেকর্ড বেরোলো পুজোতে। বাকিটা ইতিহাস।
সলিল চৌধুরীকে বুঝতে হলে গণসঙ্গীতকে জানাটা জরুরি। আমরা জানি, বাংলা গণসঙ্গীতের সূচনা হয় ১৯৪৩ সালে গণনাট্যসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ সঙ্ঘের সাঙ্গীতিক কার্যক্রমের একটি বিশেষ ধারাই ছিল গণসঙ্গীত। বিনয়কৃষ্ণ রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখ তাঁদের অনন্যসাধারণ প্রতিভাবলে গণসঙ্গীতের এ নতুন ধারার যথার্থ ভিত্তিস্থাপন করেন এবং এ ধারাকে সম্প্রসারিত ও জনপ্রিয় করে তোলেন। তাঁরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসঙ্গীত এবং রাবীন্দ্রিক ও পাশ্চাত্য সুরধারাকে গণসঙ্গীতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। গণসঙ্গীতের মুখ্য উদ্দেশ্য শ্রমজীবী মানুষকে সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের সংগঠিত ও সংগ্রামশীল হতে উদ্বুদ্ধ করা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার আদায়ের মাধ্যমে একটি সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ জোগানো। বিশ শতকের মধ্যভাগে গণসঙ্গীতের দুটি বিশেষ চরিত্র লক্ষ করা যায়। এ সময় জাতীয় মুক্তি অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে এমন কিছু গান রচিত হয় যা ইংরেজ শাসন থেকে ভারতের মুক্তির আন্দোলনে প্রচন্ড শক্তি জোগায়। সেসব গান শুনে দেশের মুক্তিকামী যোদ্ধারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হন। এর পাশাপাশি কিছুটা ভিন্ন ধরনের অনেক গান রচিত হয় যার বক্তব্য ছিল একটি শোষণহীন সমানাধিকারসম্পন্ন সমাজ গঠন করা। এ প্রসঙ্গে চারণ কবি মুকুন্দদাস এবং নজরুলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের দুজনের গানেই ভারতের রাজনৈতিক মুক্তি এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার ধারণা প্রকাশ পায়। নজরুল যখন সৈনিক হিসেবে করাচি ব্যারাকে ছিলেন তখন তিনি রুশ বিপ্লবের সাফল্য ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা জেনেছিলেন। তাই তাঁর গানে বিশেষভাবে দেশের স্বাধীনতা এবং শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে গণসঙ্গীতে আন্তর্জাতিক ধ্যান-ধারণা যুক্ত হয়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শোষিত মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ এবং সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি অকল্যাণকর প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করা এ গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।
সলিল চৌধুরী বলতেন – “I want to create a style which shall transcend borders – a genre which is emphatic and polished, but never predictable.”
একবার সলিল চৌধুরী সপরিবারে দক্ষিণে গেলেন বেড়াতে। হঠাৎ এক নারী এসে সলিল চৌধুরীর স্ত্রী সবিতা চৌধুরীর হাত ধরে বললেন, “খুব সাবধানে আর যত্নে রাখবেন সলিল বাবুকে। কারণ উনার হাতে আমাদের গোটা সভ্যতার সুর রয়েছে। উনার সুরে আমরা বাঁচি, আমরা হাসি, আমরা কাঁদি।”
পশ্চিমা দেশের সংগীতের প্রতি যেমন অনুরক্ত ছিলেন, ঠিক তেমনি আবার লোকগীতি থেকে প্রেরণা পেয়েছেন সুর সৃষ্টিতে। প্রচণ্ড জেদি আর একরোখা মনের এই মানুষটির জীবন ছিলো বৈচিত্র্যে ভরপুর।
সলিল চৌধুরী, প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার এবং গল্পকার। গণমানুষের রাজনীতিবিদও ছিলেন সলিল চৌধুরী। তিনি মূলত বাংলা, হিন্দি, এবং মালয়ালাম চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা হিসেবে এবং গণসংগীতের প্রণেতা হিসেবে তিনি একজন স্মরণীয় বাঙালি। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সকল গুণগ্রাহীদের কাছে তিনি সলিলদা বলেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা মূলত ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। তিনি একজন আয়োজক ছিলেন এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন বাঁশি, পিয়ানো, এসরাজ ইত্যাদি বাজাতে জানতেন। তাঁর মৌলিক কবিতাগুলোর জন্যেও তিনি ব্যাপকভাবে নন্দিত এবং প্রশংসিত। ‘সুরের এই ঝরঝর ঝরনা’য় ‘দখিনা বাতাসে মন কেন কাঁদে’ সলিল চৌধুরীর গান শুনতে বসলেই! সলিল চৌধুরী আমাদের প্রত্যেকের কাছেই এক অনন্যসাধারণ সাংস্কৃতিক আশীর্ব্বাদ, এক পরম প্রাপ্তি। মহান স্রষ্টা সলিল চৌধুরী শিল্পকে শুধুমাত্র শিল্পের জন্য ব্যবহার না করে, তাকে করে তুলেছিলেন সংগ্রামের হাতিয়ার। আর তাই একদিকে সমাজের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা, অন্যদিকে ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’ – এই রীতির এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছিল তাঁর সৃষ্টিতে।
আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা ও গণসংগীতের প্রণেতা সলিল চৌধুরী গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক জুড়ে একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ছিলেন। কবিতা, গান, সুর দেয়া- সব ক্ষেত্রেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। বিটোভেনের সিম্ফনি, মোৎসার্টের জি-মাইনর ফর্টিএথ সিম্ফনি, ই-মাইনর, জি-মাইনর কর্ডের প্রতি তাঁর অনুরাগ থেকেই বাংলা ও হিন্দি ভাষায় উপহার দিয়েছেন অনেক ভালোলাগার গান ও সুর। এছাড়াও তিনি একজন কবি এবং চিত্রনাট্যকার। তার মৌলিক কবিতাগুলোর জন্য তিনি ব্যাপকভাবে নন্দিত এবং প্রশংসিত। তাঁর কবিতা গ্রন্থ: প্রান্তরের গান, সলিল চৌধুরীর গান (১৯৮৩)। তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। গান আর সুর নিয়েই জন্মেছিলেন সলিল চৌধুরী। পৃথিবী তাঁকে মনে রাখে তাঁর সুরের জন্য। কিন্তু তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল নানা ধারায়। সেই অন্য দিকগুলো নিয়ে তেমন চর্চা হয় না। ‘সুরকার’ সলিল চৌধুরীর প্রতিভার দীর্ঘ ছায়ায় বারবার ঢাকা পড়ে যান কবি সলিল, গল্পকার সলিল, চিত্রনাট্যকার সলিল।
সলিল চৌধুরী ১৯২৩ সালের ১৯শে নভেম্বর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার রাজপুর সোনারপুর অঞ্চলের গাজিপুরে এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী, আসামের লতাবাড়ি চা বাগানে ডাক্তারি করতেন। বাবার কাছেই সলিল চৌধুরীর সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি। পিতৃব্য নিখিল চৌধুরীর কাছেও সংগীতের তালিম গ্রহণ করেন তিনি। মূলত নিখিল চৌধুরীর ঐক্যবাদন দল ‘মিলন পরিষদ’-এর মাধ্যমেই গানের জগতে শৈশবেই সম্পৃক্তি। তাঁর শৈশবের বেশির ভাগ সময় কেটেছে আসামের চা বাগানে। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুভাষগ্রামে, (পুরাতন নাম কোদালিয়া) মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেন। হারিনাভি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন এবং উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাশ করেন। এরপর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর পিতার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তাঁর পিতা চা বাগানের কুলি এবং স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের সাথে মঞ্চ নাটকের জন্য সুখ্যাতি সম্পন্ন ছিলেন। তিনি কলকাতায় অবস্থিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং এ সময়েই তার সঙ্গীত জ্ঞানে পরিপক্কতা লাভের পাশাপাশি দ্রুত তার রাজনৈতিক ধারণা জন্মায়। তিনি দারুণ মেধা সম্পন্ন ছিলেন।
তাঁর প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র “পরিবর্তন” মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। তাঁর ৪১টি বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল “মহাভারতী” যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। ১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত ‘দো বিঘা জামিন’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সলিল চৌধুরীর হিন্দি চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে। সলিল চৌধুরীর ছোট গল্প “রিকসাওয়ালা” অবলম্ভনে এই চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল। এই চলচ্চিত্রটি তার কর্মজীবনকে নতুন মাত্রা যোগ করে যখন এটি প্রথমে ফিল্মফেয়ার সেরা চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়। বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে ২০ বছর কাজ করার পরে সলিল চৌধুরী ১৯৬৪ সালে ‘চিম্মিন’ দিয়ে মালয়ালাম চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। চলচ্চিত্র সফলতা পাক বা না পাক তাঁর মালয়ালাম গানগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি প্রায় ৭৫টির বেশি হিন্দি চলচ্চিত্র, ৪০টির বেশি বাংলা চলচ্চিত্র, প্রায় ২৬টি মালয়ালাম চলচ্চিত্র, এবং বেশ কিছু মারাঠী, তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসামীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
১৯৪৪ সালে যখন তরুণ সলিল তাঁর স্নাতক পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন, তখনই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক দল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-এ (Indian Peoples Theater Association) যোগ দেন। এ সময় তিনি গান লিখতে এবং এর জন্য সুর করা শুরু করেন। আইপিটিএ এর সাংস্কৃতিক দলটি বিভিন্ন শহর এবং গ্রামগঞ্জে ভ্রমণ করতে থাকে, যা এই গানগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে। ‘বিচারপতি’, ‘রানার’ এবং ‘অবাক পৃথিবী’র মত গানগুলো তখন সাধারণ জনতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘গাঁয়ের বধূর’ মতো গান তখন বাংলা সংগীতে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছিল, যা মাত্র ২০ বছর বয়সে সুর করেছিলেন সলিল। পশ্চিমবঙ্গে তখনকার প্রায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এসব গান গেয়েছেন। এর মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
সমালোচকগণ বলেছেন, সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতে পশ্চিমা এবং ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সমান মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। সলিল চৌধুরীর পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সরাসরি অভিযোজনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘ছায়া’ চলচ্চিত্রে মোৎজার্টের সিম্ফোনি নং ৪০ এর উপর ভিত্তি করে “ইতনা না মুঝে তু পেয়ার বাড়া” এবং ‘অন্নদাতা’ চলচ্চিত্রে চোপিন এর কাজের উপর ভিত্তি করে -“রাতো কি সায়ে ঘানে”।
আগেই জেনেছি, বাংলা গানে নতুন দিগন্ত নিয়ে এসেছিল সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গীত! পঞ্চাশের মন্বন্তরে সলিল সৃষ্টি করলেন একের পর এক গান, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’,‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’। তাঁর লেখা গণসংগীত অনুপ্রেরণা দিল ছাত্র-মজুর-কৃষকসহ সব অধিকার বঞ্চিতদের। ‘এদেশ তোমার আমার/ আমরা ভরি খামার/ আমরা গড়ি স্বপন দিয়ে সোনার কামনায়’ কথা ও সুরের আবেদনে আর হেমন্ত মুখোপাধ্যেয়ের কন্ঠে সকলের গান হয়ে উঠল। গণসঙ্গীতের সর্বজনীন আবেদন বার বার এসেছে তাঁর গানের কথা আর সুরের মূর্ছনায়। ‘মর্জিনা আবদাল্লা’র বাণিজ্যিক ছবির গ্ল্যামারাস গল্পেও কাঠুরিয়াদের গানে মাটির মানুষের টান- ‘ও ভাইরে ভাই/ হে হে, আয় রে আয়/ আয়রে কুড়ুল করাত নিয়ে/ পোড়া বরাত নিয়ে/ জঙ্গলে জঙ্গলে আয় রে/ আয় রে কাটি কাঠ, কাটি কাঠ, কাটি কাঠ।’ চাঁদ ফুল জোছনা ছাড়াই, প্রেমের গুন গুন গুঞ্জন বাদ দিয়েও, যে পথে নেমে মানুষের হাতে হাত রেখে বলা যায় ‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি’ দেখালেন সলিল চৌধুরী। আরও পরে বলেছেন, ‘আমি পথ খুঁজি না তো, পথ মোরে খোঁজে।’ তাঁর সুরে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায় গলায় ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ কিংবা ‘উজ্জ্বল, এক ঝাঁক পায়রা/ সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে/ চঞ্চল পাখনায় উড়ছে’ শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়। সলিল চৌধুরীর সুরে- ‘ঝির ঝির ঝির ঝির বরষা/ আমার হয় কি গো ভরসা/ আমার ভাঙা ঘরে তুমি বিনে’-তে খুঁজে পাই যেন অন্য ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে।
আসলে অনেক কাজ একসঙ্গে করতে জানা অসীম প্রতিভাবানদের আমরাই হয়তো ঠিকমত বুঝে উঠতে পারি না। সলিল চৌধুরীকে অনেকেই বলতেন ইনটেলেকচুয়াল কম্পোজার। গান লেখা, সুর করা আর অ্যারেঞ্জ করা এই তিনটি কাজ এক সঙ্গে তিনি করেছেন। তিনটিতেই তিনি শ্রেষ্ঠ। আশ্চর্য সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন সুর নিয়ে, গায়ক-গায়িকাদের কণ্ঠ নিয়ে। একই গান হয়তো তিনটে ভাষায় গাওয়া হবে। মিউজিক কম্পোজ করার সময় সলিল তিনটে আলাদা অ্যারেঞ্জমেন্ট করতেন। বাংলা গানের সুরে হয়তো ফোকের ছোঁয়া। সেই একই গানের হিন্দি রূপান্তর হল ভীষণ সিডাকটিভ। আবার সেটাই যখন মালয়ালম হচ্ছে, পাল্টে গিয়ে হল সেখানকার মেছুনিদের লোকগান। তাঁর প্রত্যেকটি গানের ইন্টারলিউড একেবারে একটা আলাদা গান। সলিলের আকর্ষণ সুরের জটিল বিন্যাসে। তাঁর সুরের আরেক বৈশিষ্ট্য নোটেদের চলন- এই হয়তো রয়েছে তার সপ্তকের সা-তে, এই নেমে এল মধ্য সপ্তকের রে-তে। সুরের এই জটিলতার জন্যই সলিলের প্রয়োজন ছিল অনুশীলিত গলার। সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকর এমন কিছু গান গেয়েছিলেন, যেগুলো বাংলা বা হিন্দি গানের অবয়ব বদলে দিয়েছিল। আবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠমাধুর্যের ও গলার টিম্বারের খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে কতটা অনুরাগী ছিলেন সলিল চৌধুরীর সুরের, তার প্রমাণ মেলে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তিতে, যখন বলেন- ‘যাঁদের সুরে আমি গান গেয়েছি, তাঁদের মধ্যে আমার গলাটাকে সব থেকে সার্থক ভাবে ব্যবহার করেছে সলিল।’ রবীন্দ্রশতবর্ষে, ১৯৬১-তে সলিল চৌধুরী সৃষ্টি করলেন- ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।’ পরে বলেছেন, ‘গানটাতে নিজের জীবনের ছোঁয়াই একটু রাখতে চেয়েছি, যখন বলছি ‘আমি আবার কাঁদব হাসব এই জীবন জোয়ারে ভাসব/আমি বজ্রের কাছে মৃত্যুর মাঝে/রেখে যাব নিশানা।’
মধ্য পঞ্চাশের পর ভারত কাঁপাতে বোম্বে যেতে আগ্রহী হলেন সলিল। তারপরই খুলে গেল আরেক সুরের দুয়ার। সর্বভারত দেখল বাঙালির প্রতিভা। আগেই অবশ্য শাস্ত্রীয় সংগীতের জগতে আলাউদ্দীন খাঁ, রবিশঙ্কর প্রমুখের বাদনে মুগ্ধ হয়েছিল। এবার দেখল এক বাঙালি সুরকারের ফিল্মি গানের চমক। বোম্বের জীবনে প্রথম প্রথম মনে হয় খানিকটা স্ট্রাগল ছিল সলিলের। বাঙালি-বিদ্বেষ রাহুল দেববর্মনের জীবনকে কীভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল, সেসব কথা আমরা অনেকেই জানি। যাক। সেসব অবশ্য আরো পরের কথা।
বোম্বে যাওয়ার পর সলিল শুনলেন এক প্রডিউসার নতুন ছবিতে হাত দেবেন। সলিল কাজ চাইলেন। প্রডিউসার আমতা আমতা করলেন। দুজনে নাকি সন্ধ্যার পর সাদা রঙের অ্যাম্বাসাডর গাড়ির ভেতরে বসেছিলেন। তখন বর্ষাকাল। ঝরঝর বৃষ্টি। গাড়ির জানালার কাচে বৃষ্টি। সলিল কৌতুক করে বললেন, ‘আমি তো আপনার ছবি হিট করাব বলে আগেভাগেই সুর তৈরি করে রেখেছি।’ প্রডিউসার অবাক হয়ে বললেন, ‘বলেন কী? সুর তৈরি করে রেখেছেন! আচ্ছা, শোনান তো।’ সলিল সুর ভাঁজলেন। প্রডিউসার কেঁপে উঠলেন। অভিভূত। সলিলের হাত ধরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘গানটা আর কাউকে দিয়েন না প্লিজ…।’ সলিল হেসে বললেন, ‘আরে, আপনার গান অন্যকে দেবো কেন?’ কোন গানটা? লতার গাওয়া ‘না যেও না/ রজনী এখনও বাকি…’ তারপর সবটুকু ইতিহাস।
সঙ্গীতের ব্যাকরণ গুলে খেয়েছিলেন সলিল। কেবলই বলতেন, ‘‘গ্রামার না-জানলে ভাল মিউজিক কম্পোজ করা যায় না।’’ গানের এই দখলদারির কারণেই সলিল গড়ে নিতে পেরেছিলেন নিজস্ব ঘরানা।
‘অ্যায় মেরে প্যায়ারে ওয়াতন’ গানে নিচু স্কেলে শুরু হওয়া মান্না দে’র গাওয়া এই গান কখনই কি ভোলার? অথচ গানটা কী করে যে একজন কাবুলিওয়ালার লিপে বসিয়েছিলেন সলিল, আজও অবাক লাগে ভাবতে!
পর্দায় ছবিটি দেখলে কোত্থাও মনে হয় না, এ গান মানাচ্ছে না! বরং কাবুলিওয়ালার বেদনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি আমরা।
এক সময় রটে গিয়েছিল, এ গানের জন্য নাকি সলিল কাবুলিওয়ালার ডেরায় গিয়ে সুর খুঁজে বেড়াতেন। কোনও কোনও সাংবাদিকও তাঁদের লেখা বইয়ে এমন কথা লিখেছেন। গল্পটা পুরো বানানো বলে পরে জানিয়েছিলেন সবিতা চৌধুরী।
সলিল বলতেন, ‘‘সঙ্গীতের ব্যাকরণ যে জানে, সেই পারে ভাঙতে-গড়তে।’’ এ-গানও তারই ফসল।
আমরা জানি, দেশাত্মবোধক গান দেশ ও জনগণের প্রতি নিবেদিত গান, যা স্বদেশী সঙ্গীত নামেও পরিচিত। জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে এ গান রচিত হয়। গানের বিষয় যখন হয় দেশ তখন তাকে বলা হয় দেশাত্মবোধক গান, আর জনগণ হলে তাকে বলা হয় গণসঙ্গীত। দেশাত্মবোধক গানের এ দুটি ধারা। বাংলা দেশাত্মবোধক গানের সূচনা হয় উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ঈশ্বর গুপ্ত ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গীতের মাধ্যমে। পরে উনিশ শতকের মধ্যভাগে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এর পর্যায়ক্রমিক বিকাশ ঘটে। বাংলা গানের সেই ধারায় রবীন্দ্রনাথসহ পঞ্চকবির পর এমন প্রতিভা আর আসেনি বাংলা গানে তাঁর আগে। আধুনিক বাংলা গানের নতুন ধরার প্রবর্তন হয়েছে তাঁরই হাত ধরে। তাঁর কবিতা অসামান্য সুরে কথা বলে উঠেছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুরের মিশেলে, ঘন স্ট্রিংস আর বাঁশির বুনিয়াদে সঙ্গীতের প্রাসাদ গড়েছেন সলিল চৌধুরী। সঙ্গীতের ব্যাকরণ গুলে খেয়েছিলেন সলিল। কেবলই তাই বলতেন, ‘গ্রামার না-জানলে ভাল মিউজিক কম্পোজ করা যায় না।’ গানের এই দখলদারির কারণেই সলিল গড়ে নিতে পেরেছিলেন নিজস্ব ঘরানা। সলিল বলতেন, ‘‘সঙ্গীতের ব্যাকরণ যে জানে, সেই পারে ভাঙতে-গড়তে।’’ তার গানও তারই ফসল। সলিল চৌধুরী’ গনসঙ্গীতকে বলতেন, “জাগরনের গান”, “চেতনার গান”। আসলে সামাজিক বৈষম্য কিছুতেই সইতে পারতেন না মহৎ হৃদয়ের ওই মানুষটি। তাঁর ছিল সাম্যবাদী শিক্ষা। এ ক্ষেত্রে বাবা ছিল পথপ্রদর্শক। সঙ্গীতেও। সলিলের বিরল সৌভাগ্য যে হাতেখড়ি ঘরেই হয়েছিল শৈশবে। অন্যত্র যেতে হয়নি।
‘ছায়া’ ছবিতে ‘ইতনা না মুঝসে তু প্যার বড়া’ গানটির কথাই ধরা যাক। সুরটি নেওয়া মোৎজার্টের সিম্ফনি থেকে। কিন্তু তাতেও ছিল সলিল-ঘরানার ছোঁয়া। নিজের মতো করে মোৎজার্টকে ভেঙে ভৈরবী ধাঁচের সুরে তালাত-লতার ডুয়েটে মাত হয়ে গিয়েছিলেন শ্রোতারা।
হিন্দি-বাংলা-সহ ভারতের চোদ্দোটি ভাষায় গান বেঁধেছিলেন সলিল। দক্ষিণ ভারতে তাঁকে সবাই বলত ‘মিউজিক গড’।
একদা সলিল – সবিতা একটি মন্দির দর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের দু’জনের নামের আদ্যক্ষর ‘স’ শুনে স্থানীয় মানুষরা লাফিয়ে উঠলেন।
পুরাকালে নাকি ওখানে এমন দু’জন স্বামী-স্ত্রী গান গাইতেন, যাঁদের নামের আদ্যক্ষরও ছিল একই। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, সলিল – সবিতা সেই দম্পতি!
গান আর জীবন— কোথায় তাঁর মধ্যে মিশে ছিল তা বোঝা বড়োই জটিল বিষয়।
বম্বেতে স্টুডিয়ো যাওয়ার পথে এক জায়গায় জুতো পালিশ করাতেন সলিল। পালিশওলার ছেলে বসে থাকত তাঁর বাবার পাশে। তাঁর নাম ছিল পান্ডুরং।
একটা ভাঙা ম্যান্ডোলিন বাজাত পান্ডুরং। সলিল তাঁর আগ্রহ দেখে তাঁকে নতুন একটা ম্যান্ডোলিন কিনে দিলেন। যত্ন করে তাঁকে শিখিয়েওছিলেন। শেষে তাঁকে নিজের মিউজিক ইউনিটের সদস্যও করে নেন।
‘পরখ’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘মিলা হ্যায় কিসিকা ঝুমকা’ গানের সঙ্গে ওই পান্ডুরংই ম্যান্ডোলিন বাজিয়েছিল। ছেলেটি অকালে মারা যায়।
মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্টের প্রতি কারও কোনও আগ্রহ দেখলে যেন কেমন পাগল-পাগল হয়ে যেতেন তিনি। একদা রাশিয়া থেকে ফেরার সময় এক বার সুরকার সুধীন দাশগুপ্তের জন্য একটা অ্যাকোর্ডিয়ান কিনে নিয়ে এসেছিলেন সলিল।
মিউজিশিয়ানদের জন্য তাঁর যে কতটা দরদ ছিল, তা আজও অনেকে স্মরণ করেন। বম্বেতে সুরকারদের নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘মিউজিক ডিরেক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন’। কোনও দিন নিজের জন্য তেমন করে ভাবেননি, কিন্তু অন্য সুরকারদের সঙ্গে প্রযোজকরা বেচাল কিছু করলে কিছুতেই ছাড়তেন না।
সলিল চৌধুরী মানুষের জন্য রাজনীতিও করেছেন। তার রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশের গোড়া থেকেই সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন। তেভাগা আন্দোলন শুরুর বেশ আগেই ১৯৩৯ সালে তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। নদীর বানে কৃষকের দুরবস্থায় তিনি গান লিখলেন, ‘দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে, ‘কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলে আকাশে’। পঞ্চাশের মণ্বন্তরে তিনি লিখে যান একের পর এক গান, ‘তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে’,‘পৌষালি বাতাসে পাকা ধানের বাসে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে’। তার লেখা গণসংগীত অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে ছাত্র-মজুর-কৃষকসহ সব অধিকার বঞ্চিতদের।তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারাণের নাতজামাই’ গল্প নিয়ে সলিল চৌধুরী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন কার্তিক পাইক। সেখানে তিনি নিজেই সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তেভাগা ও কৃষক জীবন নিয়ে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল ‘ছিন্নমূল’, ‘দো বিঘা জমিন’ (কাহিনীকার সলিল চৌধুরী), ‘রিকসাওয়ালা’ ও ‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’।
সলিল চৌধুরীর প্রয়ানের পরে চলে যাওয়ার পর নৌশাদসাব একটা কথা বলেছিলেন,
‘‘ফ্রম আওয়ার সেভেন নোটস, ওয়ান ইজ নো মোর।’’
এর চেয়ে সত্যি কথা আর হয় না!
গানের জগতের জাদুকর তিনি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে অকাতরে নাড়াচাড়া করে, তার সার্থক যুগলবন্দী ঘটিয়ে পৃথিবীর যে কোনও দেশের মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে একমাত্র তিনিই তো পারতেন! অথচ সলিল চৌধুরীর মতো এক জন জিনিয়াস গীতিকার-সুরকার সেই অর্থে কোনও রাজ্য বা রাষ্ট্রীয় স্তরের সম্মান পাননি। অসম্ভব পজিটিভ ছিল তাঁর দৃষ্টি, মন, আবেগ। হেসে বলেছেন,
“আমার কোনও খেদ নেই জানো। গান আমাকে বিশ্বজুড়ে ভালাবাসা পাইয়ে দিয়েছে। কত কিছুই পাইনি, শেষে সব ভুলে যাই যখন কেউ আমার গান শুনে বলে আপনি চোখে জল এনেছেন। আমি কোথাকার কে ভাই, ঈশ্বরের যিনি বরপুত্র সেই মোৎজার্ট সারা জীবনে কী পেয়েছিলেন- বঞ্চনা, বঞ্চনা আর বঞ্চনা।”
আজও সলিল চৌধুরীর প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি। তাঁর অসামান্য সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে যে পরিপূর্ণ শিল্পীসত্তার ছোঁয়া তিনি রেখে গেছেন, উত্তরসূরিদের জন্য যথার্থ ভাবে তার সংরক্ষণ করা দরকার।! তাঁর সব গান ছিল মানুষের জন্যে, মানবতার জন্যে। নাই বা রইল বড় মাপের কোনও পুরস্কারের তকমা। মানুষের হৃদয়ে তিনি অবিনশ্বর। মানুষের ভালোবাসায় তিনি অবিস্মরণীয়।
(তথ্যসূত্র:
১- সলিল চৌধুরী প্রথম জীবন ও গনসংগীত, সমীরকুমার গুপ্ত, মিলেমিশে (২০১২)।
২- রচনাসংগ্রহ, সলিল চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং (২০১৩)।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল (শ্রী সলিল চৌধুরী স্মরণে শ্রীমতী সবিতা চৌধুরী’র স্মৃতিচারণ)।
৪- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭শে আগস্ট ২০১৭ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ই মার্চ ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত