সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দেশের বহুত্বকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছা মিলিয়ে দিল ভারতের দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রের দুই বিশিষ্ট নেত্রীকে। এরা হলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী শাবানা আজমি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শাবানার এই প্রথম দেখা। কিন্তু দেখা হতেই যেভাবে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছে টেনে নিলেন তা যেন সম্প্রীতির সুর বেঁধে দিল। কলকাতার ২৫তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের মঞ্চে দুজনেই বললেন, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে স্বীকার করে নেওয়ার কথা। প্রথম দেখা, দুজনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিন্নতাও রয়েছে কিন্তু দুজনেই প্রমাণ করলেন বিশ্বাসের ভিন্নতা কোন মূল রাজনৈতিক লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে কোন অন্তরায় হতে পারেনা। বরং সাম্প্রদায়িকতা, বিভেদপন্থা, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করাটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ।
নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য সত্বেও একসঙ্গে এই অবস্থা বদলানোর জন্য লড়াই এর ডাক দিয়ে যে দৃষ্টান্ত তারা তৈরি করলেন তা থেকে আজকের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের শিক্ষা নিতে হবে। ডান-বাম নির্বিশেষে দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের এই বোধটারই বড় অভাব! শাবানা খোলাখুলি বললেন, লোককে কথা বলতে দিতে হবে, ঠোঁট সেলাই করে দিলে চলবে না। তাহলে তার অন্তরে বিদ্রোহের ঝড় উঠবে। সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। তার মতে ভারতের সংস্কৃতি সবসময় বহুত্ব ও বৈচিত্রকে স্বীকার করে নেয়। আমাদের সংবিধানও এটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্পিরিটটা নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। শিল্পীদের দিতে হবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কারণ, বিতর্কিত বিষয়গুলিকে নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় উৎসাহ দিলে বিতর্কটা অনেক কমে যায়।
আমার একটা কথা মনে হয়েছে, যখন সাম্প্রদায়িক বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই না করে রাজ্যের বাম-ডান সব নেতারা একজোট হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে জোট বাঁধছেন ঠিক সেই সময়ে শাবানা আজমি কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসবের সাফল্য এবং সকলকে নিয়ে চলার মত মানসিকতার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাধুবাদ জানাতে কোন দ্বিধা বোধ করলেন না। আমার মতে, চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে এই দুজনের বক্তব্য থেকে রাজ্য তথা দেশের সব বিরোধী দলগুলির শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। সেই শিক্ষাটা হল নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও বিভেদপন্থার বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করা ছাড়া এখন আর কোন উপায় নেই।
আজ বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে সবাইকে এক হয়ে লড়তে হবে নইলে রাজনীতি, সংস্কৃতি কিছুই বাঁচবে না। সত্যি বলতে কি ভারতীয় সিনেমা সবসময় বহুত্ববাদের স্বপক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোন ব্যানার পোস্টার ছাড়াই লড়াই চালিয়ে এসেছে। শাবানা আজমির বাবা বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার কাইফি আজমি এই ধারারই এক উজ্জ্বল নাম। তাঁর কবিতা আর গানও বলেছে মানুষকে শুধু মানুষ বলেই বিচার করার কথা। এবছর তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে। উৎসবের মঞ্চে শাবানা ও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছিল এভাবেই ভাল কাজগুলির উত্তরাধিকার পরবর্তী প্রজন্ম বহন করে নিয়ে যান। শাবানা যেভাবে দেশের ঐক্য ও বৈচিত্র রক্ষার কথা তার বক্তৃতায় বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, তা যেন হয়ে উঠছিল কাইফি আজমির কবিতার লাইন।
সমাপ্তি অনুষ্ঠানের সন্ধ্যায় এই দুজনকে দেখে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেকদিন আগে পড়া একটি কবিতার লাইন – দোঁহে দোঁহাকার প্রতীক্ষায় ছিল, সাক্ষাৎ মিলনে সেই বাসনা পূরিল। এটা যেন দুটি ভাবনার মিলন, যা বিভেদপন্থা বিরোধী লড়াইকে শক্তিশালী করবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত