বাঙালির ‘পরিচয়’কে ‘বর্ণ’হীন করার চেষ্টায় অমিত শাহের রোড শোয়ের দিন কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে বাংলা নবজাগরণের পথিকৃত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিল বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা। যা নিয়ে শুধু শাসক দল তৃণমূলই নয়, সোচ্চার হন বাংলার প্রতিটা মানুষই। এছাড়াও বারংবার কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির নিশানায় পড়তে হয়েছে বাংলার একের পর মনীষিকে। বাদ যাননি খোদ বিশ্বকবি তথা বাঙালির গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। এবার রবি ঠাকুরের সম্পদ নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থেকেও মুখ ফেরাল কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ। শান্তিনিকেতনে কবির স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্য ভবনগুলির ধারাবাহিক সংস্কারের দায়িত্ব আর নিতে রাজি নয় কেন্দ্রের মোদী সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ (এএসআই)। অগত্যা বাড়িগুলি রক্ষায় বিশ্বভারতী হেরিটেজ কমিটির তত্ত্বাবধানে স্থানীয় ভাবে সংস্কারের কাজে উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রসঙ্গত, বিশ্বভারতীর আশ্রম প্রাঙ্গনে উপাসনা গৃহ, শান্তিনিকেতন গৃহ ছাড়াও উত্তরায়নে কবির স্মৃতিবিজড়িত উদয়ন বাড়ি, পুনশ্চ, উদীচি, কোনার্ক, শ্যামলীর মতো ঐতিহ্য গৃহগুলির বয়স অনুপাতে নিয়মিত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করে বিশ্বভারতীর হেরিটেজ কমিটি। কবির অত্যন্ত প্রিয় শতবর্ষ প্রাচীন উত্তরায়নের প্রথম বাড়ি ‘কোনার্ক’ আজ রুগ্ন। ছাদে জল জমে স্যাঁতসেঁতে ভাব। ড্যাম্প ধরে গিয়েছে। বর্ষায় ছাদ চুইয়ে ঘরে জল পড়ে। আশ্রমিকদের কথায়, ১৯১৯ সালে এই বাড়িটি আশ্রম সীমানার বাইরে প্রথম তৈরি করান রবীন্দ্রনাথ। ওই বছরই নভেম্বর মাসে উত্তর-পশ্চিম দিকে ‘উত্তরায়ন’ নাম দিয়ে মাটির বাড়িতে কবি বসবাস শুরু করেন। পরে বাড়িটি পাকা করে তোলা হয়। কবি তার নাম দেন ‘কোনার্ক’।
কবি চেয়েছিলেন, যে ঘরে বসে তিনি লিখবেন, সেখান থেকে যেন চার দিকেই দিগন্ত অবধি দেখা যায়। তাই উঁচু ভিতের উপরে একটি ঘর উঠল, যার চার কোনে চারটি থাম। এই ‘কোনার্ক’-এর বারান্দায় বসে কবি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটক ও নৃত্যের মহড়া দিতেন। ১৯২৭ সালে ‘নটীর পূজা’ প্রথম অভিনয় হয় এই ‘কোনার্ক’-এর ভিতরের ঘরটিতে। কিন্তু শতবর্ষ প্রাচীন ১৬ ছাদের এই বাড়িটি বয়সের ভারে আজ ক্লান্ত। নিয়মিত যার সংস্কার প্রয়োজন। একই অবস্থা আরও একটি ঐতিহ্য গৃহ ‘উদয়ন’-এর। শান্তিনিকতেনের উত্তরায়ন প্রাঙ্গনের ‘উদয়ন’ বাড়ি রবীন্দ্রনাথের বাসভবনগুলির মধ্যে সর্বাধিক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও শিল্পী-স্থপতি সুরেন্দ্রনাথ করের পরিকল্পনা ও নৈপুণ্যে তৈরি এই বাড়ির দোতলার ঘরই পৃথিবীর রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের কাছে ‘কবিকক্ষ’ বলে সমাদৃত। কারণ এ ঘরেই দীর্ঘ দিন কবি বসবাস করেছেন। অসুস্থ অবস্থায় সেখান থেকেই কলকাতার উদ্দেশ্যে শেষযাত্রা করেন কবি।
সেই উদয়ন বাড়িরই বৈঠক খানা, যেখানে কবি মিলিত হতেন দেশ বিদেশের বিদগ্ধজনদের সঙ্গে, তারই পেছন দিকের দু’ধারের বারান্দার সিলিং থেকে খসে পড়ছে চাঙর। বেরিয়ে পড়েছে লোহার বিম। কঙ্কালসার দশা বললে বিন্দুমাত্র ভুল বলা হয় না। নষ্ট হতে বসেছে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের নিজে হাতে গড়া কারুশিল্পের অমূল্য সব নিদর্শনও। বেশ কয়েক মাস আগেই এগুলি নজরে এসেছে বিশ্বভারতীর। সেই সব আসবাবের কোনওটিতে ঘুণ ধরেছে, তো কোনওটিতে উঁই লেগেছে, আবার কোনওটির অংশবিশেষ ভেঙে পড়েছে। রুগ্ন চেহারা ধামাচাপা দিতে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠছে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা রবীন্দ্রভবনের কর্মীদের। ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে তাঁরা বলেন, ‘এমন ঐতিহ্য এভাবে কত দিন সামাল দেওয়া যায়? বছর তিনেক আগেই এএসআই সংস্কার করল। অত্যন্ত নিম্নমানের কাজ করে দায় সেরেছে তারা। আসাবাবের অংশ বিশেষ ঝুলে পড়ছে। পাটাতনের কাঠ এমন দেওয়া হয়েছে, যা সব ছেড়ে যাচ্ছে। কার্পেট দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে।’
গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত সরকারে পুরাতত্ত্ব বিভাগের (এএসআই) দায়িত্বে সংস্কারের নামে অবরুদ্ধ ছিল ‘শ্যামলী’ বাড়ি। শেষমেশ চলতি বছরের অগস্ট মাসে তার কাজ সম্পূর্ণ হয়। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার পর উভয় সংকটে পড়ে বিশ্বভারতী। রবীন্দ্র ভবনের তত্ত্বাবধানে থাকা শান্তিনিকেতেনের ঐতিহ্যবাহী একের পর এক বাড়ির এই দশা বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রভবনের উদ্বেগকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। কারণ এই বাড়িগুলির সিংহ ভাগই সেই সময় খুব সাধারণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয়েছিল। ফলে তার আয়ুও শেষের দিকে। আবার নিজের উদ্যোগে এই বাড়িগুলির সংস্কারের কাজ করতে গিয়ে কোনও খুঁত তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে তাঁদের। ফলে বিপাকে রবীন্দ্র ভবনও। শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যের এই ভবনগুলি নিজেদের উদ্যোগে সংস্কার না করে, ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগের (এএসআই) তত্ত্বাবধানেই নিয়মিত সংস্কারের জন্য চিঠি …