চিত্তরঞ্জন দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭০ সালের ৫ই নভেম্বর, অধুনা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের তেলিরবাগ গ্রামে। তাঁর বাবা ভুবনমোহন দাশ। মা নিস্তারিণী দেবী। চিত্তরঞ্জন দাশের পূর্বপুরুষের আদিনিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের তেলিরবাগ গ্রামে। শিক্ষিত পরিবার হিসেবে তাঁদের পরিবারের যথেষ্ঠ সুনাম ছিল। চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা একজন আইনজীবী ছিলেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাটর্নী ছিলেন। তিনি উচ্চ সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি শ্লোক ও স্তোত্র গীত রচনা করতেন, যা প্রতিদিন সকালে গাইতেন। ‘ব্রাক্ষ্ম জনমত’-এর সম্পাদক হওয়ায় কলকাতার সাংবাদিকতা জগতে বেশ পরিচিত ছিলেন তিনি। রাজনীতি সচেতন ও দাতা স্বভাবের এই মানুষটি সবসময় মানুষের কল্যাণে কাজ করতেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ছোটবেলা থেকেই বাবার গুণগুলো নিজের জীবনে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মা নিস্তারিণী দেবী উচ্চ শিক্ষিত না হলেও, তিনি ছিলেন উচ্চমনের অধিকারী। তিনি সহজ-সরল, অতিথিপরায়ন ও নীতিবান ছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশের বাবা দাতা স্বভাবের হওয়ার কারণে তাঁদের পরিবারে একসময় অভাব-অনটন দেখা দেয়। কিন্তু তাঁর মা পরিবারের এই অভাব সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেন। কোনো প্রতিকূল পরিবেশ এলে তিনি ঘাবড়ে যেতেন না। চিত্তরঞ্জন দাশরা আট ভাই-বোন ছিলেন। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।
চিত্তরঞ্জন দাশের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ হওয়ার পূর্বে চিত্তরঞ্জন দাশ শৈশবে তাঁর বাবার সাথে কলকাতার ভবানীপুরে চলে আসেন। কারণ তখন তাঁর বাবা কলকাতার ভবানীপুরে বসবাস শুরু করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯৭৯ সালে ভবানীপুর লন্ডন মিশানারি স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের পাঠ্যবই পড়ার চেয়ে পাঠ্যতালিকার বাইরের বই পড়তে বেশী পছন্দ করতেন তিনি। যে কারণে তাঁর পরীক্ষার ফলাফল খুব ভাল হতো না।
চিত্তরঞ্জন দাশ শৈশবে বিপিন চন্দ্র পালের সংস্পর্শ আসেন। বিপিন চন্দ্র পাল সেই সময়ের একজন নামকরা রাজনীতিবিদ ও বাগ্মী ছিলেন। তাঁর প্রভাবে চিত্তরঞ্জন দাশ দেশাত্মবোধক গান ও কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেন।
চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯৮৬ সালে লন্ডন মিশানারি স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। এই কলেজে পড়ার সময় তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। কলেজ জীবনে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজের সুরেন্দ্রনাথ প্রবর্তিত স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য হন। একপর্যায়ে তিনি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৮৯০ সালে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য বিলেত যান। বিলেতে থাকার সময় রাজনৈতিক ব্যাপারে সক্রিয় ছিলেন এবং অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৮৯৩ সালে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসেন এবং আইন পেশা শুরু করেন। ১৮৯৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে তাঁর নাম তালিকাভুক্ত হয়। পেশা জীবনের শুরুতে তাঁর সামান্য আয় হত। যা দিয়ে তাঁর দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ট্রামভাড়ার সামান্য পয়সা বাঁচানোর জন্য তিনি হাইকোর্ট থেকে ভবানীপুর হেঁটে যেতেন।
এসময় তাঁর বাবাও ঋণে ডুবে যান। এই কঠিন দুরাবস্থার সময় তাঁর বাবা কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। এই নির্বাচনে প্রচুর টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু তিনি নির্বাচনে জিততে পারেননি। পরোপকার ও উদারতার কারণে তাঁর এই ঋণ বাড়তেই থাকে। এসময় তাঁর অফিসের এক ক্লার্কের অনুরোধে এক ব্যক্তির জামিন হন তিনি। কিন্তু ওই ব্যক্তিটি আত্মগোপন করার কারণে ভুবনমোহনের কাঁধে ৩০,০০০ টাকা পরিশোধের দায়িত্ব পড়ে। অনেক ঋণদাতা তাদের টাকা ফিরে পাওয়ার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত ১৮৯৬ সালের ১৬ জুন ভূবনমোহন ও চিত্তরঞ্জনকে দেউলিয়া হিসেবে ঘোষণা করে।
এসব ঘটনার পর চিত্তরঞ্জন দাশ হতাশ না হয়ে পুনরায় নুতন উদ্যমে আদালতে যাওয়া শুরু করেন। কিছুদিন পর তিনি মামলা পেতে শুরু করেন। এসময় তাঁর যা আয় হয়, তা দিয়ে মোটামুটি স্বচ্ছলভাবে চলতে পারেন এবং তাঁর জীবনের মোড় ঘুরতে থাকে। ১৮৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি বিজনী রাজকোর্টের বরদাপ্রসাদ হাওলাদারের কন্যা বাসন্তী দেবীকে বিয়ে করেন।
আইন পেশার পাশাপাশি তিনি গোপনে গোপনে বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯০৩ সালে কলকাতায় প্রমথ মিত্র ও চিত্তরঞ্জন দাস প্রথমে ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি এই সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল।
১৮৯৭-১৯০৪ সাল পর্যন্ত চিত্তরঞ্জন দাশকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তবে পারিবারিক অবস্থান তাঁর পেশা জীবনের উন্নয়নে কিছুটা ভূমিকা রাখে। কারণ তাঁর পিতামহ ছিলেন সরকারী আইনজীবী। দুই কাকা ছিলেন নামকরা আইনজীবী। এছাড়া তাঁর পরিবারের তিনজন ছিলেন জজ। সুধীররঞ্জন দাশ ছিলেন তাঁদের পরিবারের একজন, যিনি পরবর্তীতে ভারতের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন।
আইনজীবী হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশ সিভিল কোর্টের প্র্যাকটিসের পরিবর্তে ক্রিমিনাল কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। এজন্য তাঁকে প্রায়ই মফস্বলে যেতে হত। তিনি কঠোর পরিশ্রম করতেন কিন্তু যে কোনে ব্যারিস্টারের চেয়ে ফি নিতেন কম। গরীব মক্কেলের কাছ থেকে কোনো টাকা নিতেন না। তিনি সব সময় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষ নিতেন। অনেক সময় দেখা যেত যার পক্ষ নিয়েছেন তিনি দোষী, তখন ওই দোষী ব্যক্তিকে দোষী প্রমাণ করে দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না। যে ব্যক্তিই তাঁর কাছে মামলা নিয়ে এসেছেন তিনিই সবার কাছে তাঁর মহত্বের কথা, বুদ্ধিমত্তার কথা, সততা ও সেবার কথা প্রচার করে বেড়িয়েছেন। এভাবে তাঁর নাম ও পরিচিতি গণমানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আইনজীবী হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করার পর চিত্তরঞ্জন দাশ মফস্বল ছেড়ে কলকাতায় প্রাকটিস শুরু করেন এবং পুনরায় সিভিল কেসগুলো পরিচালনা করে বেশ সাফল্য পান। সাথে সাথে রাজনীতিতেও পূর্বের চেয়ে বেশী সময় দেন। যার ফলে ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের কলকাতা প্রতিনিধি নির্বাচিত হন তিনি।
‘কুতুবদিয়া রাজবন্দী মামলা’ দেশবন্ধুকে প্রথম জীবনে একজন আইনজীবী হিসাবে তাঁর দক্ষতা প্রমাণ করতে সহায়তা করেছে। অন্তরীণ-স্থল ত্যাগ করে চট্টগ্রাম যাওয়া ছিল এই মামলায় ১৭ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁদের জন্য বিনা ফি’তে কাজ করেন। মামলাটি পরিচালনার জন্য এ সময় তিনি প্রায় পক্ষকালব্যাপী চট্টগ্রামে অবস্থান করেন । দেশবন্ধু যুক্তি দেখান যে, রাজবন্দীরা পালিয়ে যাননি বরং জেলা ম্যাজিট্রেটের কাছে কিছু যুক্তিসঙ্গত ও আইনগত দাবীর জন্যে গিয়েছিলেন। তাঁর চমৎকার কৌশলের কারণে বন্দীদের মাত্র দুই মাসের সাজা হয়েছিল।
আইনজীবী হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশের জন্য ১৯০৭ সাল ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময় তিনি সিভিল ও ক্রিমিনাল উভয় কোর্টেই একজন সফল আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিস্থাপন করেন। এ সময় কলকাতা কোর্টে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের যত মামলা এসেছে তিনি সেগুলোর বিরুদ্ধে অবিরাম লড়েছেন।
১৯০৮ সালে মুরারিপুকুর বোমা মামলায় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ বিনা পারিশ্রমিকে এই মামলায় লড়েন। তখন তাঁর মাসিক আয় ছিল পাঁচ হাজার টাকা। আর এই মামলা পরিচালনা করতে তাঁকে চল্লিশ হাজার টাকা দেনা করতে হয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন। দু’শর বেশী সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ ৯ দিন ধরে তাঁর সওয়াল জওয়াবের সমাপ্তি বক্তব্য দেন । এই মামলায় তিনি যে সওয়াল জওয়াব দেন তা ছিল জ্ঞান ও দেশপ্রেমের অপূর্ব নিদর্শন। বিচারের রায়ে অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান।
চিত্তরঞ্জন দাশ অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনৈতিক মামলার পাশাপাশি মাঝে মাঝে জমিদার, মহাজনদের মামলাও পরিচালনা করতেন। উপার্জিত অর্থ তিনি গরীব-অসহায় জনগণকে দিতেন এবং তা দিয়ে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের মামলা পরিচালনা করতেন। একবার ডুমরাওনের মহারানীর মৃত্যুর পর রাজা কেশোপ্রসাদ তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকার না হতে পেরে মামলা করেন। এই মামলায় চিত্তরঞ্জন দাশ প্রতি মাসে ১০,০০০ টাকা পেতেন। আর মামলায় জয়ী হওয়ার পর রাজা কেশোপ্রসাদ খুশি হয়ে চিত্তরঞ্জন দাশকে ৫০,০০০ টাকা দেন।
১৯১০ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ‘ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা’ পরিচালনা করেন। এই মামলার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার অনুশীলন সমিতির প্রধান পুলিন বিহারী দাশ এবং সঙ্গীদেরকে নির্বাসন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে কারদণ্ড দিয়েছিল। কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশ এই রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। তাঁর আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে ৬ মাসের শাস্তি এবং ৩৩ জনের মধ্যে ১১ জনের তুলনামূলক কম শাস্তি হয়েছিল।
১৯১৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলা’ পরিচালনা করেন। এটাও ছিল একটি রাজনৈতিক মামলা। এই মামলার মাধ্যমে তিনি ভারতবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ১৪ জন বিপ্লবীকে লর্ড হার্ডিঞ্জ হত্যা প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত করে। কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশের তীক্ষ্ম যুক্তির কাছে ইংরেজ সরকার হেরে যায় এবং তিনি জয়ী হন।
আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদেরকে ব্রিটিশদের অত্যাচার-নির্যাতন ও জেল-জুলুমের হাত থেকে বাঁচানো ছিল তাঁর প্রথম কাজ। আর দ্বিতীয় কাজ ছিল সরাসরি স্বদেশী রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা এবং পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করার জন্য কাজ করা। যে কারণে তিনি ১৯১৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।
১৯১৮ সালে ‘আলিপুর ট্রাঙ্ক মার্ডার কেস’ মামলা থেকে তিনি পাঁচ জন ব্যক্তিকে মুক্ত করেন। এই মামলাটি ‘আলিপুর ট্রাঙ্ক মার্ডার কেস, ১৯১৮’ নামে পরিচিতি। ওই বছর চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা হল ‘অমৃতবাজার পত্রিকা মামলা’। কলকাতা হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ অভিমত প্রকাশ করে যে, কলকাতা উন্নয়ন ট্রাস্ট কোনো ব্যক্তিগত জমি রাখতে পারবে না। একই সময় হাইকোর্টে অন্য একজন বিচারক রায় দেন যে, কলকাতা উন্নয়ন ট্রাস্ট সেই ক্ষমতা রাখে। এরকম বিপরীতধর্মী মতামতের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ গঠন করা হয়। প্রধান বিচারপতি Sir Lancelot Sanderson, বিচারপতি Jonh Woodroffe এবং Mr. Chitty নিয়ে এই বেঞ্চ গঠন করা হয়। কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা অমৃতবাজার এ ব্যাপারে মন্তব্য করে সম্পাদকীয় ছাপে। পত্রিকাটি স্পেশাল বেঞ্চের গঠন সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলে। এই অবস্থায় প্রধান বিচারপতি অমৃতবাজারকে শোকজ করেন এবং আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন।
‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ তখনকার কলকাতা বারের প্রখ্যাত আইনজীবীদের নিযুক্ত করে। মি. জ্যাকসন, মি. নরটন, ব্যোমকেশ চক্রবর্ত্তী এবং চিত্তরঞ্জন দাশ এই মামলায় নিযুক্ত হন। স্বাভাবিকভাবেই মামলা শুরু করেন মি. জ্যাকসন। কিন্তু পরবর্তিতে একমাত্র চিত্তরঞ্জন দাশ ছাড়া আর কেউই মামলা পরিচালনা করার জন্য ছিলেন না। তিনি একাই অমৃতবাজার পত্রিকার পক্ষে লড়েন এবং বিচারকদের রায় চিত্তরঞ্জন দাশের পক্ষে অর্থাৎ অমৃতবাজার পত্রিকার পক্ষে যায়।
১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ব্রিটিশ সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড চালায়। এ হত্যাকাণ্ডে ৩৭৯ জন নিহত এবং প্রায় ১১০০ জন আহত হয়েছিল। ইতিহাসে এটাই ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশের নানা টালবাহানার পর এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচারের জন্য সর্ব-ভারতীয় কংগ্রেস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, সদস্য ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু, আব্বাস তৈয়্যবজী এবং ড. জাকির হোসেন। তদন্ত কমিটির অধিকাংশ খরচ বহন করেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তিনি তদন্ত কমিটিতে তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। যে কারণে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ তদন্ত বের করে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল।
এছাড়াও তিনি মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার এবং পাঞ্জাবে সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইনসভা বর্জন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি নিজেই অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব কংগ্রেস অধিবেশনে উত্থাপন করেন এবং গান্ধীজীর ডাকে ব্যারিস্টারি পেশা ত্যাগ করে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বয়ং ভারত সরকার প্রখ্যাত মিউনিশনস বোর্ড ঘটিত মামলায় প্রচলিত নজীর উপেক্ষা করে সাহেব এডভোকেট জেনারেল অপেক্ষা অধিক পারিশ্রমিক দিয়ে তাঁকে সরকারি কৌসুলী নিযুক্ত করেন। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি এ দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন। এই অসামান্য ত্যাগের জন্য ভারতবর্ষের জনগণ কর্তৃক তিনি ‘দেশবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯২১ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য তিনি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯২১ সালে কারাগারে থাকার কারণে আমেদাবাদ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও উপস্থিত থাকতে পারেননি তিনি। পরের বছর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গয়া কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করেন। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে সাংগঠনিক বিষয়ে বিরোধ দেখা দেওয়ায় তিনি ১৯২২ সালে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ত্যাগ করেন। এরপর তিনি স্বরাজ্য দল গঠন করেন। মতিলাল নেহেরু এবং দেশবন্ধুর নেতৃত্বে এই দল ভারতের অন্যতম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯১৯-২২ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন তিনি।
১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলার জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেন। বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক ঐক্যের আহ্বান সমগ্র বাঙ্গালীকেই প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখ্য প্রতিনিধি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের লক্ষ্যে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন যা বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। এ চুক্তিতে মুসলমান মধ্যবিত্তের অনগ্রসরতা দূর করার বিশদ পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়। সম্ভবত এ চুক্তির কারণেই ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত আইন সভা নির্বাচনে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বাধীন নবগঠিত রাজনৈতিক দল স্বরাজ্য বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। আর বিজয়ী আইনসভা সদস্যদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে স্বরাজ্য দল তখন একটি প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২৩ সালের নির্বাচনে স্বরাজ্য দল বিশেষ সাফল্য লাভ করে। চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন কলকাতা করপোরেশনের প্রথম মেয়র।
১৯২৪ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার ‘১ নং বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল-রাজনৈতিক কারজকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা। ওই সময় কলকাতা থেকে সুভাষ চন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রমোহনসহ প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার। তখন চিত্তরঞ্জন দাশ নিজ বাড়িতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের আহ্বান করেন। গান্ধীজী উপলব্ধি করেন স্বরাজ্য দলকে দমনের জন্যেই এই অর্ডিন্যান্স পাশ করা হয়েছে। এরপর থেকে গান্ধীজী দেশবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৪ ও ১৯২৫ সালে পরপর দুবার মেয়র নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি চাকরির ক্ষেত্রে অবহেলিত মুসলমানদের অধিক হারে সুযোগদানের নীতি গ্রহণ করেন।
রাজনীতির মধ্যে থেকেও তিনি নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করতেন। সে সময়ের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘নারায়ণ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘মালঞ্চ’, ‘সাগর সঙ্গীত’ ও ‘অন্তর্যামী’ গ্রন্থের জন্য তিনি কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ সালের ১৬ই জুন, দার্জিলিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর পৈতৃক বসতবাড়িটি জনসাধারণের জন্য দান করে যান। সেখানে ‘চিত্তরঞ্জন সেবাসদন’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) পরিচয় প্রধানত একজন ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় দেশনেতা হিসেবে। দেশবাসী ভালোবেসে তাঁকে ‘দেশবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন (১৯২০), তাঁর আসল নামটি আজ প্রায় যার আড়ালে চলে গেছে। উপমহাদেশ বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের এতখানি শ্রদ্ধা ও সম্মান তাঁর আগে বা পরে বোধ করি আর কোনো রাজনৈতিক নেতার ভাগ্যে জোটেনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মৃত্যুতে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত পংক্তি দুটি:
“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ,
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।”
আর বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর মৃত্যুকে তুলনা করেছিলেন ইন্দ্রপতনের সঙ্গে। লিখেছিলেন:
“পয়গাম্বর ও অবতার-যুগে জন্মিনি মোরা কেহ,
দেখিনি ক মোরা তাঁদের, দেখিনি দেবের জ্যোতির্দেহ।
কিন্তু যখনি বসিতে পেয়েছি তোমার চরণ-তলে,
না জানিতে কিছু না বুঝিতে কিছু নয়ন ভরেছে জলে।
…বুদ্ধের ত্যাগ শুনেছি মহান, দেখিনি কো চোখে তাহে
নাহি আফসোস, দেখেছি আমরা ত্যাগের শাহানশাহে।…” ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, নজরুলের ‘চিত্তনামা’ (১৩৩২) কাব্যগ্রন্থের সবকটি কবিতা ও গানই চিত্তরঞ্জন দাশের অকালমৃত্যুর শোক থেকে লেখা। বইটি উৎসর্গও করেন নজরুল চিত্তরঞ্জন – পত্নী শ্রীমতী বাসন্তী দেবীকে। এর ‘ইন্দ্রপতন’ নামক দীর্ঘ কবিতাটি যখন প্রথম আত্মশক্তি পত্রিকায় ছাপা হয় (১২ আষাঢ় ১৩৩২) তখন এতে এমন কয়েকটি পংক্তি ছিল যাতে চিত্তরঞ্জন দাশকে পয়গম্বরদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পরে কারো কারো আপত্তি-সমালোচনার মুখে গ্রন্থভুক্ত করার সময় নজরুল কবিতাটি থেকে উক্ত পংক্তি কটি বাদ দেন।
মনে করা হয়, মাত্র ৫৫ বছর বয়সে, দার্জিলিংয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে গিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের আকস্মিক মৃত্যু (১৯২৫) না ঘটলে, কিংবা তাঁরই উদ্যোগে বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দের দ্বারা স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (১৯২৩) কংগ্রেসের কোকোনদ অধিবেশনে (ডিসেম্বর ১৯২৩) কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত না হলে, এবং আরও পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে চিত্তরঞ্জন-শিষ্য সুভাষ বসুর রহস্যজনক অন্তর্ধান না ঘটলে, বাংলার তথা ভারতের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পরের বছরই কলকাতায় একাধিকবার দাঙ্গা সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক পরিবেশে ক্রমে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। আকরম খাঁর মতো বাংলার মুসলমান নেতাদের অনেকে যাঁরা ইতিপূর্বে চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টির সদস্য ছিলেন তাঁরাও অতঃপর স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে থাকেন, এবং বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে মুসলিম লীগ রাজনীতির ক্রোড়াশ্রিত হয়ে পড়েন। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মননচর্চায়ও এর অনিবার্য প্রভাব পড়ে। এভাবে হিন্দু-মুসলমানের যে মিলিত বাংলার স্বপ্ন চিত্তরঞ্জন দেখেছিলেন তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে তা দূর পরাহত হয়ে ওঠে।
চিত্তরঞ্জনের রাজনীতিক বা দেশনেতা পরিচয়টি পরবর্তীকালে তাঁর অন্য সব পরিচয়কে ছাড়িয়ে গেলেও, তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, মাত্র ছয়-সাত বছরের। পিতা ভুবনমোহন কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাটর্নি হিসেবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও, আপন দানশীলতা ও পরোপকার প্রবৃত্তির মাশুল জোগাতে গিয়ে তাঁকে শেষাবধি দেনার দায়ে আদালতে ঘোষণা দিয়ে দেউলিয়া হতে হয়। এ অবস্থায় লন্ডনের মিডল টেম্পল থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে ফেরার (১৮৯৪) পর চিত্তরঞ্জনকে যে শুধু হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দিতে হয় তাই নয়। পিতা তথা পরিবারের আর্থিক দায়মুক্তির জন্য তাঁকে এ-সময় কলকাতার বাইরে প্রত্যন্ত মফস্বলেও টাকার জন্য মোকদ্দমা লড়তে যেতে হতো। এরই পাশাপাশি তিনি কিছুকাল কলকাতা সিটি কলেজে আইন পড়িয়েছেন। ছাত্রজীবনের কোনো পর্যায়েই কৃতিত্বের পরিচয় না দিলেও, এমনকি বিলাতে গিয়ে দু-দুবার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হলেও, তিনি ব্যবহারজীবী হিসেবে চূড়ান্ত সাফল্যের পরিচয় দেন। অর্থ ও খ্যাতি উভয় অর্থে কথাটা প্রযোজ্য। দেওয়ানি ও ফৌজদারি দু-ধরনের মামলায়ই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। অসহযোগ আন্দোলন শুরুর আগে তিনি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেননি। যদিও স্বদেশী আন্দোলনকালীন দু-চারটি সভা-সমাবেশে যোগদান ও বক্তৃতা করেছিলেন। এ-পর্যায়ে কংগ্রেস রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা ছিল নেপথ্যচারীর। দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও বিপিনচন্দ্র পালের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ মামলায় তাঁদের এবং পরে বিখ্যাত আলিপুর বোমার মামলায় অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীদের পক্ষ সমর্থন করে। এসব মামলায় সশস্ত্র উপায়ে দেশকে মুক্ত করার প্রচেষ্টারত বিপ্লবীদের সপক্ষে চিত্তরঞ্জন দাশের অব্যর্থ যুক্তি ও জোরালো সওয়াল কেবল তাঁকে মোকদ্দমা জিততেই সহায়তা করেনি, স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের হৃদয়েও তাঁর আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেয়। জীবনের এ-পর্যায়ে রাজনৈতিক বা সামাজিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সেভাবে যুক্ত না হলেও, তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন।
সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ বিষয়টি চিত্তরঞ্জন দাশ বলা যায় উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। তাঁর পিতামহ জগদ্বন্ধু দাশ ও পিতা ভুবনমোহন দাশ উভয়েই আইন ব্যবসার পাশাপাশি কাব্যচর্চা করতেন। চিত্তরঞ্জনেরও সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত কবিতা দিয়ে। নিতান্ত কিশোর বয়সেই তাঁর লেখালেখির শুরু। তাঁর স্কুল জীবনের সহপাঠী শরৎচন্দ্র রায় চৌধুরীর ভাষায় ‘চিত্ত ছোটোবেলা থেকেই কবিতা লিখত – পকেট ভরতি করে ছোটো ছোটো কাগজে সে কবিতা লিখে আনত।… টিফিনের ছুটির পর বাইরে এসে আমাদের সে লেখা দেখাত…।’ (অপর্ণা: ২১) তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রাবস্থায়, বিলাতে অবস্থানকালে, এমনকি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সক্রিয় রাজনীতিতে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত, তিনি যখন অত্যন্ত ব্যস্ত ও সফল ব্যবহারজীবী, তখনও তাঁর সাহিত্যচর্চা অব্যাহত ছিল। এই পর্বে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি-সম্পাদিত সাহিত্য ছাড়াও নির্মাল্য, মানসী প্রভৃতি পত্রিকায় চিত্তরঞ্জনের লেখা প্রকাশিত হয়।
এ পর্যায়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির খামখেয়ালি ক্লাবের সভ্য ছিলেন চিত্তরঞ্জন। সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, প্রমথ চৌধুরী, জগদিন্দ্রনাথ রায় প্রমুখের সঙ্গে তিনি সাহিত্যপাঠ ও সংগীতচর্চায় অংশ নেন। ১৯১১ সালে চিত্তরঞ্জন যখন দ্বিতীয়বার পরিবার-পরিজনসহ বিলেত যান তখন রবীন্দ্রনাথ একদিন ইয়েটস ও রদেনস্টাইনকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথ সেখানে ‘সোনার তরী’ সহ তাঁর কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে চিত্তরঞ্জন দাশও তাঁর সাগর-সঙ্গীত-এর পাণ্ডুলিপি থেকে কয়েকটি কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। এমনকি সাগর-সঙ্গীত নিয়ে দুজনের মধ্যে কিছু আলোচনাও হয়। (অপর্ণা: ৫৯) কলকাতায় চিত্তরঞ্জনের রসা রোডের বাড়িতে অনুষ্ঠিত সাহিত্য ও সংগীত আসরে খোদ রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুরবাড়ির অনেকেরই, যেমন সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী প্রমুখের আসা-যাওয়া ছিল। এই আসরেই মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ বসুর পাখোয়াজ সংগতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও অমলা দাশ (চিত্তরঞ্জনের চিরকুমারী বোন ও পরবর্তীকালের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী) একসঙ্গে গানও গেয়েছেন। (অপর্ণা: ৬৭) চিত্তরঞ্জন-কন্যা অপর্ণার হিন্দুরীতিতে বিয়েদানের (১৯১৬) ঘটনায় ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মসমাজের নেতারা সে-বিবাহ অনুষ্ঠান বর্জন ও চিত্তরঞ্জনকে একঘরে করার আহ্বান জানানোর পরও ব্রাহ্মসমাজের যাঁরা সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। (অপর্ণা: ১০৬) সুতরাং রবীন্দ্রনাথ-চিত্তরঞ্জনের পারস্পরিক বিরূপতার যে সংবাদটির সঙ্গে আমরা পরিচিত, নিঃসন্দেহে বলা যায়, তার সূত্রপাত আরও পরে।
চিত্তরঞ্জন দাশের কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় সম্ভবত তাঁর ১৯ বছর বয়সে, নব্যভারত পত্রিকার ফাল্গুন ১২৯৫ সংখ্যায়। কবিতাটির নাম ছিল ‘বন্দী’। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মালঞ্চ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে। ৫০টি কবিতা নিয়ে এই কাব্য-সংকলনটির প্রকাশক ছিলেন সুরেশচন্দ্র সমাজপতি। মালঞ্চের অধিকাংশ কবিতারই বিষয়বস্তু প্রেম। মানবিক প্রেম। যেমন:
“তোমার ও প্রেম, সখী! তোমারি মতন,
অনন্ত রহস্যময় সৌন্দর্যে মগন
অধর প্রশান্ত ধীর,
আঁখি কৃষ্ণ সুগভীর,
পুষ্পিত হৃদয় তীর, সৌরভ স্বপন।
এই কাছে এসে যাও,
ওই দূরে চলে যাও,
এ সকল ক্ষণিকের অর্ধ আলিঙ্গন।”
এরই পাশাপাশি ‘ঈশ্বর’, ‘বারবিলাসিনী’, ‘সোহং’ ও ‘অভিশাপে’র মতো কয়েকটি ভিন্নধর্মী কবিতাও রয়েছে তাঁর এ-বইটিতে। এর মধ্যে প্রথমোক্ত কবিতা দুটি সমকালে কিঞ্চিৎ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে বাসন্তী দেবীর বিয়ের সময় ব্রাহ্মসমাজের তরফ থেকে এ ব্যাপারে আপত্তি তোলা হয়। আপত্তির একটি প্রধান কারণ ছিল চিত্তরঞ্জনের সাহিত্যচর্চা, তাঁর রচনার বিশেষ প্রবণতা। প্রসঙ্গটির উল্লেখ করতে গিয়ে চিত্তরঞ্জন-কন্যা অপর্ণা দেবী লিখেছেন, ‘বাবা ‘ঈশ্বর-বিদ্রোহী’ ও ‘মাতাল’ আখ্যা এই সমাজ থেকে পেয়েছিলেন তাঁর মালঞ্চতে প্রকাশিত ‘ঈশ্বর’ ও ‘বারবিলাসিনী’ কবিতার জন্য।’ (অপর্ণা: ২৮) শুধু তাই নয়, চিত্তরঞ্জনকে এ-সময় এ মর্মে একটি লিখিত স্বীকারোক্তিও দিতে হয়েছিল যে, তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। (অপর্ণা: ২৯) তো কী লিখেছিলেন চিত্তরঞ্জন তাঁর ‘ঈশ্বর’ কবিতায়? এখানে পুরো কবিতাটিই উদ্ধৃত করছি:
“ঈশ্বর! ঈশ্বর! বলি অবোধ ক্রন্দন,
প্রচণ্ড ঝটিকা বহি’ গগন ভরিয়া
আমাদের সুখ-শান্তি নিতেছে হরিয়া,
বাড়াইয়া আমাদের বিজন বেদন !
জীবন-যাতনা তরে সজল নয়ন,
জুড়াইতে চাই হৃদে ঈশ্বর সৃজিয়া
আপনার হৃদয়ের ধূমরাশি দিয়া,
সত্য বলে’ পূজা করি অলীক স্বপন !
হায়! হায়! মিথ্যা কথা; ঈশ্বর! ঈশ্বর!
করুণ ক্রন্দন উঠে অনন্ত গগনে ঠেলে’ ফেলি’ জীবনের বিনীত নির্ভর,
ধরণীর আর্ত্তনাদ শুনি না শ্রবণে!
ঊর্দ্ধ মুখে চেয়ে থাকি, ডাকি নিরন্তর
শতবার প্রতারিত কাঁদি, মনে মনে।”
চিত্তরঞ্জনের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মালা’ প্রকাশিত হয় ১৯০২, মতান্তরে ১৯০৪ সালে। এরও বেশির ভাগ কবিতার বিষয় মানবিক প্রেম। যদিও ঈশ্বরানুভূতির প্রকাশও ঘটেছে কয়েকটি কবিতায়। তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সাগর সঙ্গীত’ প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। দ্বিতীয়বার বিলাত যাত্রাকালে সমুদ্রবক্ষে এর কবিতাগুলো লেখার সূত্রপাত। এই পর্বে এসে তাঁর কবিতার ভাব বা বিষয়বস্তুতে লক্ষযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। তিনি এখানে প্রকৃতির বিশালত্বে মুগ্ধ, সম্মোহিত। তার কাছে সমর্পিতচিত্ত হতে আকুল। সমুদ্র এখানে অসীমের প্রতীক হয়ে তাঁকে হাতছানি দেয়, যার মুখোমুখি হয়ে কবির উচ্চারণ:
“আমি যে হয়েছি তব হাতের বিষাণ !
আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী!…
ওগো যন্ত্রী! বাজাও আমারে।”
কিংবা,
“হে মোর আজন্ম সখা! কাণ্ডারি আমার
আজ মোরে লয়ে যাও অপারে তোমার।”
চিত্তরঞ্জন নিজেই তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটির একটি ইংরেজি গদ্যানুবাদ ও শ্রী অরবিন্দ পদ্যানুবাদ করেন। শ্রী অরবিন্দের অনুবাদটি ১৯২৩/৪ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয়। চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ অন্তর্যামীতে (১৯১৪) এসে চিত্তরঞ্জনকে আমরা পাই বৈষ্ণব কবিদের উত্তর-সাধক হিসেবে, পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনের আকাক্সক্ষাই যার কাব্যসাধনার মূল প্রেরণা। জীবনের এই পর্ব থেকে বৈষ্ণবোচিত জীবনদর্শনই তাঁর সাহিত্যচর্চা, রাজনীতি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর পরবর্তী ও সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ কিশোর-কিশোরীতে (১৯১৫) যার একরকম পরিণতি আমরা দেখতে পাই। দেহাতীত, কাম-গন্ধহীন এক প্রেমের জন্য আকুতি ব্যক্ত হয়েছে এ-পর্বের কবিতায়, যেমন:
“কাছে কাছে নাই-বা এলে, তফাত থেকে বাসব ভালো
দুটি প্রাণে আঁধার মাঝে প্রাণে প্রাণে পিদিম জ্বালো!
এপার থেকে গাইব গান, ওপার থেকে শুনবে বলে;
মাঝের যত গণ্ডগোল ডুবিয়ে দেব গানের রোলে।”
এই শেষ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর চিত্তরঞ্জন কাব্যচর্চা প্রায় ছেড়ে দেন এবং রাজনীতি বা দেশের কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। একপর্যায়ে তিনি যে তাঁর বিরাট পশারের ওকালতি পেশা ত্যাগ করেন (১৯২০) কিংবা পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে এতদিনের শৌখিনতা ছেড়ে সস্তা ও মোটা খদ্দরের ফতুয়া ও খাটো ধুতি পরতে শুরু করেন, শুধু তাই নয়। তাঁর কলকাতা রসা রোডের পৈতৃক বাড়িটিও এ-সময় তিনি লিখিতভাবে জাতির সেবায় দান করেন (পরে যেখানে মহাত্মা গান্ধীর উদ্যোগে চিত্তরঞ্জন সেবা সদন প্রতিষ্ঠিত হয়)। ইতিমধ্যে তাঁর উদ্যোগে ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাংলা সাহিত্যপত্র নারায়ণ। তাঁর শেষদিকের রচিত অনেক কবিতা, কিছু গান, দুটি গল্প (‘ডালিম’ ও ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’) এবং কয়েকটি প্রবন্ধ ও বাংলা অভিভাষণ এ-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। নারায়ণে প্রকাশিত এসব প্রবন্ধ ও অভিভাষণে চিত্তরঞ্জনের সাহিত্যদৃষ্টি ও দেশ ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ পায়। এ রকম কিছু প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর মৃত্যুর পর ইন্ডিয়ান বুক ক্লাব থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর দেশের কথা প্রবন্ধ পুস্তকটি। অবশ্য দেশমাতৃকার আহ্বানে তিনি যখন রাজনীতিতে পুরোপুরি আত্মনিবেদিত তখনও তাঁর সাহিত্যপ্রীতি অবসিত হয়নি। বরং এ-বিষয়ে আপন আক্ষেপ ব্যক্ত করে পাটনা সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন:
“আপনারা রাজনীতি ক্ষেত্রে আসিতে পারেন নাই বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিতেছেন। কিন্তু ক্ষোভের কোন কারণ নাই। আমিও সাহিত্য সেবায় জীবনাতিবাহিত করিব বলিয়া ঠিক করিয়াছিলাম, ঘটনাচক্রে এক্ষেত্রে আসিয়া পড়িয়াছি। নতুবা সেই পথই অবলম্বিত হইত।”
(উদ্ধৃত: দেশবন্ধু রচনাসমগ্র, পৃ ৫)
চিত্তরঞ্জনের প্রিয় লেখক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বিশেষ করে আনন্দমঠ ও কমলাকান্তের দপ্তর বই দুটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। তাঁর কন্যা অপর্ণা দেবীর লেখা জীবনী থেকে জানা যায়, পারিবারিক সান্ধ্য সাহিত্য বৈঠকে তিনি প্রায়ই এ দুটি বই থেকে সবাইকে পড়ে শোনাতেন। কমলাকান্তের দপ্তর পড়তে গিয়ে যেখানে বঙ্কিম কমলাকান্তের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন,
“পিয়াদার শ্বশুরবাড়ী আছে তবু সপ্তদশ অশ্বারোহী মাত্র যে জাতিকে জয় করিয়াছিল, তাহাদের পলিটিকস নাই। ‘জয় রাধে কৃষ্ণ, ভিক্ষা দাও গো’ ইহাই আমাদের পলিটিক্স, তদ্ভিন্ন অন্য পলিটিক্স যে গাছে ফলে তাহার বীজ এদেশের মাটিতে লাগিবার সম্ভাবনা নাই।”
সে অংশটুকু পড়ে চিত্তরঞ্জন মন্তব্য:
“বাঙালি জাতির পরাধীনতার ব্যথা ও ধিক্কার এমনভাবে আর কেউ লেখেনি।”
(অপর্ণা : ৬১-৬২)
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি এই গভীর অনুরাগ বা শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটেছিল নারায়ণের একটি বিশেষ বঙ্কিম সংখ্যা বের করার মধ্য দিয়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি তাঁর এই প্রীতি বা পক্ষপাত এবং উদ্ধৃত মন্তব্যটি থেকে চিত্তরঞ্জনের স্বাজাত্যবোধের স্বরূপ এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর বিরূপতার কারণ অনুমান করা যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া তাঁর প্রিয় অন্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র প্রমুখ। কিন্তু সবচেয়ে বেশি তাঁকে যা মুগ্ধ করত তা হলো বৈষ্ণব সাহিত্য। কন্যা অপর্ণা দেবীর বক্তব্য অনুযায়ী, চিত্তরঞ্জন – পত্নী শ্রীমতী বাসন্তী দেবীই প্রথম চিত্তরঞ্জনকে বৈষ্ণব পদাবলির ‘রস আস্বাদন করান’। (অপর্ণা: ৬৭)
পরবর্তীকালে এই বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তাঁর মনে এতটাই দৃঢ়মূল হয় যে তা শুধু তাঁর সাহিত্যদৃষ্টিকেই প্রভাবিত করেনি, অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন যখন তিনি ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেন, ঘরের সব বাতি নিভিয়ে তাঁকে ‘মাধব বহুত মিনতি করুঁ তোয়’ এই বৈষ্ণব পদটি গেয়ে শোনাতে হতো। কন্যা অপর্ণা দেবীকে বলেছিলেন, মৃত্যুশয্যায় তাঁকে যেন এ-গানটি শোনানো হয়। (অপর্ণা: ২৩০)
‘বাংলার গীতিকবিতা’ নামক তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধটিতে চিত্তরঞ্জন দাশ চণ্ডীদাসকেই বাংলার সর্বপ্রধান কবি আর চণ্ডীদাসের কবিতাকেই ‘বাংলার যথার্থ গীতিকাব্য’ বলে অভিমত প্রকাশ করেন। কী অর্থে তিনি চণ্ডীদাসকে বাংলার যথার্থ গীতিকাব্য রচয়িতা মনে করতেন? তাঁর নিজের ভাষায়,
“এই কবিতাগুলির মধ্যে যে প্রাণের সাড়া পাওয়া যায় তাহাই বাঙ্গলার গীতিকবিতার প্রাণ।’ এবং ‘যে দেশের কথা চণ্ডীদাস গাহিয়াছেন, সেই দেশের কাহিনী গানে না ফুটাইলে গানের সার্থকতা কই?”
কবি, গল্পকার কিংবা প্রাবন্ধিক চিত্তরঞ্জন দাশকে বাংলা সাহিত্য তেমন মনে রাখেনি। যদিও একসময় পাঠ্যপুস্তকভুক্ত হওয়ার সুবাদে তাঁর ‘মোছ আঁখি’ (‘মোছ আঁখি মনে কর এ বিশ্বসংসার/ কাঁদিবার নহে শুধু বিশাল প্রাঙ্গণ/ রাবণের চিতাসম যদিও আমার/ জ্বলিছে জ্বলুক প্রাণ, কেন গো ক্রন্দন?/ অপরের দুঃখ জ্বালা হবে মিটাইতে…’) কিংবা অন্য কোনো কোনো সূত্রে ‘ওফিলিয়া’র মতো আরও দু-চারটি কবিতা কমবেশি পাঠকপরিচিতি লাভ করেছিল। এমনকি শরৎচন্দ্রের মতো লেখকও তাঁর গল্প পড়ে আপন মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চিত্তরঞ্জনের উল্লেখ ও আলোচনা প্রধানত তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত নারায়ণ পত্রিকা (১৯১৪) ও তাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্র-বিরোধিতা প্রসঙ্গে। সেকালের প্রায় সব বিশিষ্ট লেখকই নারায়ণের পাতায় লিখতেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বিপিনচন্দ্র পাল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জলধর সেন, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিজাশঙ্কর রায় চৌধুরী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, কালিদাস রায়, প্রিয়ংবদা দেবী, হেমন্তকুমার সরকার, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলা সাহিত্যে প্রবলভাবেই উপস্থিত। তাঁর নোবেল জয়ের ঘটনাটিও ততদিনে ঘটে গেছে। কে বড় কবি, রবীন্দ্রনাথ নাকি ডি এল রায় – অন্তত এ বিতর্ক আর তখন বাংলার সাহিত্যামোদীদের মাতায় না। অথচ জানামতে রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনাই নারায়ণে প্রকাশিত হয়নি। শুধু তাই নয়, নারায়ণই হয়ে দাঁড়ায় রবীন্দ্র-বিরোধিতার অন্যতম বাহন। চিত্তরঞ্জন নিজে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সরাসরি সমালোচনা করে বেশি কিছু লেখেননি। এ ব্যাপারে কাণ্ডারির ভূমিকা নেন আরেক দেশনেতা, বাগ্মী ও লেখক বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২)। আরও পরবর্তী সময়ে (কংগ্রেসের বরিশাল কনফারেন্স, ১৯২১) বিপিন পালের সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক মতান্তর ও বিচ্ছেদ ঘটলেও, এই পর্যায়ে বিপিন পালই ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক গুরু। তাঁদের দুজনের স্বদেশভাবনাই ছিল, সমকালীন অন্য অনেক লেখক-মনীষী-দেশনেতার মতো, কতক পরিমাণে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের আদর্শে সঞ্জীবিত (যদিও বাংলা যে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত দেশ এ সত্যটা তাঁরা দুজনই বরাবর বিশ্বাস করতেন)। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যিক ও দার্শনিক ভাবধারার দ্বারা উভয়েই তাঁরা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। নারায়ণ পত্রিকা ও তাতে বিপিন পালের ভূমিকা সম্পর্কে অধ্যাপক ভবতোষ দত্তের মন্তব্য এ-প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য :
“দাশ সাহেব (চিত্তরঞ্জন দাশ) নিজে সম্পাদক হইয়াও নারায়ণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন কথা বলিলেন না। কাহাকেও দিয়া সেকথা লিখাইলেনও না। তিনি শিষ্য। শ্রীযুক্ত বিপিনচন্দ্র পাল তাঁহার গুরু। তিনি গুরুকে দিয়া একটা লম্বা প্রবন্ধ লিখাইলেন – ‘নূতনে পুরাতন’। সেই পুরাণ কথা, সেই ‘হিন্দু রিভাইভ্যাল, সেই হিন্দু ধর্মের নবজীবন। বঙ্গদর্শনের শেষকালে যাহার অঙ্কুর বাহির হইয়াছিল।… দাশ-পালের কাগজে ইহা খুব জোরের সহিত বলা হইয়াছে। আমাদের পুরানো যাহা ছিল ভালই ছিল।” (ভূমিকা, দেশবন্ধু রচনাসমগ্র, ১৩৮৫, পৃ ২৪)
নারায়ণের সমসাময়িককালেই, কয়েক মাস আগে, প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক ‘সবুজপত্র’। কি ভাষা কি সাহিত্যাদর্শ সব ব্যাপারেই নারায়ণের অবস্থান ছিল সবুজপত্রের বিপক্ষে। সবুজপত্রের শ্রাবণ ১৩২১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পটি। নারায়ণের প্রথম সংখ্যায়ই প্রকাশিত হয় এই ‘স্ত্রীর পত্রে’র জবাবে লেখা বিপিনচন্দ্রের গল্প ‘মৃণালের কথা’। এতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে নারীমুক্তি বা প্রগতির যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাকে অবাস্তব ও বিজাতীয় অর্থাৎ বিলেত থেকে ধার করা বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়। আর তা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তিগতভাবেও আক্রমণ করা হয়। যা এমন কি শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়। রবীন্দ্রসাহিত্যের ব্যাপারে বিপিন পালের একটি বড় অভিযোগ ছিল, তাতে বাস্তবতার অভাব আছে। এ ব্যাপারে চিত্তরঞ্জনের মূল্যায়নও ছিল বিপিন পালের অনুরূপ। ফলে দুজনের মিল ঘটেছে সহজেই। মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যকেই চিত্তরঞ্জনের কাছে খাঁটি বাংলা সাহিত্য বলে মনে হয়েছে। তাঁর ‘বাঙ্গলার গীতিকবিতা’, ‘কবিতার কথা’, ‘রূপান্তরের কথা’ প্রভৃতি প্রবন্ধে তিনি বিশদভাবে তাঁর এই মত ব্যাখ্যা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসাধনা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য:
“রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও প্রতীচ্য এই উভয়কে মিলাইয়া মিশাইয়া কাব্য সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিয়াছেন।”
বলা বাহুল্য, এই প্রবণতাটিকে তিনি ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক হিসেবে দেখেছেন। সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই প্রচেষ্টার সফলতা সম্পর্কে। ‘বাঙ্গলার গীতিকবিতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের শিশু কাব্যের ‘জন্মকথা’ কবিতাটি উদ্ধৃত করে চিত্তরঞ্জন লিখেছেন, ‘মাতা তাহার সন্তানকে বলিতেছে,/ ‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।’/ কোন খোকা আজও পর্যন্ত/ ‘এলেম আমি কোথা থেকে/ কোন খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।’ বলিতে পারে কি না জানি না। … আমি যাহাকে ইংরাজী গীতি-কবিতার কথা বলিয়াছি, ইহা সেই বিলাতী ছাঁচে তৈরী।’
বাঙলার শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি সবকিছুর জন্যই পাশ্চাত্য প্রভাবকে চিত্তরঞ্জন ক্ষতিকর ও সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য মনে করেছেন। ব্রিটিশ আগমনের পূর্বে বাঙালি জীবনের সবকিছুই ভালো ছিল, ব্রিটিশ শাসনের ফলে সবকিছুতেই পচন বিভ্রান্তি ও বিকৃতি দেখা দিয়েছে, তা শেকড়বিচ্ছিন্ন ও বাস্তবসম্পর্কশূন্য হয়ে পড়েছে, এমনই একটি ধারণা পোষণ করতেন তিনি। নারায়ণের ৬ষ্ঠ বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে লেখা সম্পাদকীয়তে তাঁর মন্তব্য এ-প্রসঙ্গে উদ্ধৃতিযোগ্য:
“বাঙ্গালীর জীবন ও সাহিত্যকে আমরা স্ব-ভাবে ফিরাইয়া আনিতে চাহি। কৃত্রিমতা ও সর্ব্বপ্রকার পরাণুকরণের মোহ, পলাশীর যুদ্ধের পর হইতে, আমাদের জীবনকে বিষে বিষে জর জর করিয়া দিয়াছে। বিষ পরিপাক হয় না। পাশ্চাত্যের বিষ আমাদের গত শতাব্দীর সাহিত্যের সর্ব্বাঙ্গে ফুটিয়া বাহির হইয়াছে। কাজেই এই শ্রেণীর সাহিত্য ও জীবনকে আমরা ‘নারায়ণে’র পৃষ্ঠায় প্রতিবাদ করিতে ত্র“টি করি নাই, ভীতও হই নাই।”
পক্ষান্তরে সাহিত্য-শিল্পে পুরানোর অনুবর্তন, বস্তুতন্ত্র, বিদেশি প্রভাব ইত্যাদি সম্পর্কে প্রায় সমসময়েই, খুব সম্ভব নারায়ণের পাতায় প্রকাশিত মতামতের প্রতি ইঙ্গিত করেই, রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্রে (জ্যৈষ্ঠ ১৩২২) লিখছেন:
“…আকবরের রাজত্ব গেছে একথা আমাদের মানতেই হবে। খুব ভালো রাজত্ব, কিন্তু কী করা যাবে – সে নেই। অথচ গানেতেই যে সে বহাল থাকবে এ কথা বললে অন্যায় হবে। …আজ পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যদি কবিকঙ্কন চণ্ডী, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসানের পুনরাবৃত্তি নিয়ত চলতে থাকত তা হলে কী হতো? পনেরো-আনা লোক সাহিত্য পড়া ছেড়েই দিত।… নিছক খাঁটি বস্তুতন্ত্রকে মানুষ পছন্দ করে না। মানুষ তাকেই চাই যা বস্তু হয়ে বাস্তু গেড়ে বসে না, যা তার প্রাণের সঙ্গে চলে, যা তাকে মুক্তির স্বাদ দেয়। …বিদেশের সোনার কাঠি যে জিনিসকে মুক্তি দিয়েছে সে তো বিদেশী নয়- সে যে আমাদের আপন প্রাণ। …সমুদ্রপারের রাজপুত্র এসে মানুষের মনকে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে জাগিয়ে দেয় এটা তার ইতিহাসে চিরদিন ঘটে আসছে। আপনার পূর্ণ শক্তি পাবার জন্যে বৈষম্যের আঘাতের অপেক্ষা তাকে করতেই হয়। কোনো সভ্যতাই একা আপনাকে আপনি সৃষ্টি করেনি। … য়ুরোপীয় সভ্যতায় যে-সব যুগকে পুনর্জন্মের যুগ বলে সে সমস্তই অন্য দেশ ও অন্য কালের সংঘাতের যুগ। মানুষের মন বাহির হতে নাড়া পেলে তবে আপনার অন্তরকে সত্যভাবে লাভ করে এবং তার পরিচয় পাওয়া যায় যখন দেখি সে আপনার বাহিরের জীর্ণ বেড়াগুলোকে ভেঙে আপনার অধিকার বিস্তার করছে।”
না, রবীন্দ্রনাথ এটুকু বলেও থেমে যাননি, আরও এগিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এই অধিকার বিস্তারকে একদল লোক দোষ দেয়, বলে ওতে আমরা নিজেকে হারালুম – তারা জানে না নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া নিজেকে হারিয়ে যাওয়া নয় – কারণ বৃদ্ধি মাত্রই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া।’
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, সবুজপত্র-নারায়ণই বলি কিংবা চিত্তরঞ্জন-রবীন্দ্রনাথ, বিরোধ বা লড়াইটা একতরফা ছিল না। বাদানুবাদ দুদিক থেকেই হয়েছে।
প্রমথ চৌধুরীর প্রস্তাবিত মুখের ভাষাকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার যে নীতি সবুজপত্র গ্রহণ করেছিল তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে নারায়ণ সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য এক সাধারণ লেখ্যভাষার প্রস্তাব করে। এ বিষয়ে নারায়ণের বক্তব্য ছিল: ‘ভাষা এমন হওয়া চাই, যাহা সমগ্র বাঙ্গালীজাতি ব্যবহার করিতে পারে।’ একথার দ্বারা নারায়ণ কার্যত প্রচলিত লেখ্যভাষারই একটি সহজরূপের পক্ষে মত ব্যক্ত করে। এ সম্পর্কে পত্রিকাটির আষাঢ় ১৩২৪ সংখ্যায় ‘একটি মোকদ্দমার রায়, চলতি ভাষা বনাম সাধু ভাষা’ নামে যতীন্দ্রমোহন সিংহের একটি রম্য-নিবন্ধ ছাপা হয়, চিত্তরঞ্জন যার ‘খুব প্রশংসা’ করেছিলেন বলে তাঁর কন্যার লেখা থেকে জানা যায়। (অপর্ণা: ১০২)
উক্ত প্রবন্ধে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত লোকের মুখের ভাষাও যে একরকম নয়, উদাহরণ দিয়ে তা দেখানো হয়।
নারায়ণের এই রবীন্দ্রবিরোধিতার পেছনে স্পষ্টতই চিত্তরঞ্জন দাশের প্রণোদনা ছিল। পত্রিকার প্রায় প্রতি সংখ্যায়ই রবীন্দ্র-সমালোচনামূলক এক বা একাধিক রচনা প্রকাশই যার প্রমাণ। এভাবে পত্রিকার তিন বছরের আয়ুষ্কালে রবীন্দ্র সমালোচনামূলক অনেকগুলো লেখা নারায়ণে প্রকাশিত হয়। শুধু চিত্তরঞ্জন, বিপিন পাল, যতীন্দ্রনাথ রায়, গিরিজাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, যদুনাথ সরকারের মতো লেখকরাই যে রবীন্দ্র-বিরোধিতায় কলম ধরেছেন তা নয়; এমনকি শরৎচন্দ্রও পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৮ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধের বিরোধিতা করে লেখেন ‘শিক্ষার বিরোধ’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘পশ্চিমের লোকে যে বিদ্যার জোরে বিশ্ব জয় করেছে সেই বিদ্যাকে গাল পাড়তে থাকলে দুঃখ কমবে না, কেবল অপরাধ বাড়বে।… এখনো যারা বিশ্বব্যাপারে জাদুকে অবিশ্বাস করতে ভয় পায় এবং দায়ে ঠেকলে জাদুর শরণাপন্ন হবার জন্যে যাদের মন ঝোঁকে, বাইরের বিশ্বে তারা সকল দিকেই মার খেয়ে মরছে, তারা আর কর্তৃত্ব পেল না।’ এ প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্রের মন্তব্য: ‘ইউরোপের জয়গান করতে আমি নিষেধ করিনে, কিম্বা যে হাতী দয়ে পড়ে গেছে তাকে নিয়ে আস্ফালন করারও আমার রুচি নেই, কিন্তু তাই বলে ভূতের ওঝা ও মারণ উচাটন মন্ত্র-তন্ত্রের ইঙ্গিতও নির্বিবাদে হজম করতে পারিনে।’
প্রথম মহাযুদ্ধের কাল থেকে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনা স্পষ্টতই স্বাদেশিকতার সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বমানবিকতা বা আন্তর্জাতিকতার, ঈশ্বরচিন্তার পর্যায় অতিক্রম করে বৃহত্তর মানবপ্রেমের দিকে অগ্রসর হয়। তাঁর ‘বলাকা’ (১৯১৬) কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা এবং সবুজপত্রে প্রকাশিত ‘লড়াইয়ের মূল’ (১৩২১) প্রবন্ধ বিশেষভাবে সে-পালাবদলের সাক্ষ্য বহন করছে। এ-পর্যায়ে এসে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদকে একটি সংকীর্ণ ও সভ্যতা-বিধ্বংসী মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর আমেরিকা সফরকালে সেখানে ন্যাশনালিজম বিষয়ে একটি লিখিত ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণের ‘কোনো কোনো অংশ’ মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় ছাপা হলে তা পড়ে চিত্তরঞ্জন তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এভাবে:
‘এই জাতিত্বের ভাব পোষণ করিলে নাকি জাতিতে জাতিতে সংগ্রাম ও সংঘর্ষ বাড়িয়া যাইবে ও সমগ্র মানবজাতির অমঙ্গলের কারণ হইয়া উঠিবে।… ইউরোপের এই মত ইউরোপে অনেক বড় বড় পণ্ডিত অনেকবার খণ্ডন করিয়াছেন…। কিন্তু সূর্যের চেয়ে বালির তাপ বেশী; আমাদের দেশে এই সব নকল পণ্ডিতদের পাণ্ডিত্য এত বেশী যে তাহাদের কোন মতকে কিছুতেই খণ্ডন করা যায় না! এমন কি, যে রবীন্দ্রনাথ সেই স্বদেশী আন্দোলনের সময় বাঙ্গলার মাটি বাঙ্গলার জলকে সত্য করিবার কামনায় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথ এখন স্যার রবীন্দ্রনাথ – এবার আমেরিকায় ঐ মতটি নাকি খুব জোরের সঙ্গে জাহির করিয়াছেন।…’ (‘বাঙ্গালার কথা’, ১৯১৭)
শুধু জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেই নয়, শিক্ষা, ধর্মচিন্তা, শিল্পনীতি ইত্যাদি আরও নানা বিষয়ে এ-পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ যেখানে শিক্ষায় প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সহযোগ বা আদান-প্রদানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন সেখানে চিত্তরঞ্জনের অভিমত ছিল: ‘বাঙ্গলার মাটিতে, বাঙ্গলার ভাষায় যে শিক্ষা সহজে দেওয়া যায় এবং যে শিক্ষা বাঙ্গালী তাহার স্বভাবগুণে সহজেই আয়ত্ত করে সেই শিক্ষাই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।’ এবং ‘উচ্চশিক্ষাই হউক, কি নিচুশিক্ষাই হউক, সকল রকমের শিক্ষাকেই বাঙ্গালী জাতির যে শিক্ষা-দীক্ষার আদর্শ, তাহার উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।… ধার-করা বিজ্ঞানের অহঙ্কার হইতে তাহাকে মুক্ত করিতে হইবে।’ (‘আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার কথা’, ১৯১৭)
ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হয়েও চিত্তরঞ্জন কিন্তু ব্রাহ্মধর্মকে কখনো মন থেকে গ্রহণ করতে পারেননি। বলা যায় ব্রাহ্মধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি বরাবরই এক রকম বিরূপতা ছিল তাঁর। আর সেটা তিনি কখনো গোপন করেননি। শুধু যে আপন পুত্র-কন্যাদের তিনি সনাতন হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে দিয়েছিলেন তাই নয়, সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করে বলেছিলেন, বাঙালির ধর্ম সাধনার ঐতিহ্যের সঙ্গে ব্রাহ্মধর্ম মেলে না। রামমোহন প্রবর্তিত আধুনিকতাও তাঁর মতে উপনিবেশায়িত আধুনিকতা। একাধিক প্রবন্ধে একাধিকবার তিনি তাঁর এ মত ব্যক্ত করেন। যেমন ‘বাঙ্গলার গীতিকবিতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘রামমোহন প্রতিভাশালী মহাপুরুষ হইলেও বাঙ্গলার প্রাণের সঙ্গে তাঁহার পরিচয় ছিল না।… খৃষ্টান পাদরীদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের হইয়া তিনি যতই তর্ক করুন না কেন, এই ফেরঙ্গ আসিত না, – কখনই আসিত না, বাঙ্গলার ভাষাকে ইংরাজী করিতে পারিত না, বাঙ্গলার ভাবকে কখন ফেরঙ্গ করিতে পারিত না, – যদি তিনি আমাদের দেশের সাধনাকে ভালভাবে উপলব্ধি করিতেন ও করিয়া ইংরাজী সভ্যতা সাধন এমন করিয়া দুই হাতে বরণ করিয়া গৃহে না তুলিতেন।… রামমোহন বাঙ্গলা দেশের ধর্ম্মসাধনাকে বুঝিতে পারেন নাই – তাঁহার ব্রহ্মসঙ্গীত বাঙ্গালীর গান হইতে পারে নাই…।’
চিত্তরঞ্জনের রবীন্দ্রবিরোধিতার পেছনে কি তাঁর সে ব্রাহ্মবিরূপতারও কমবেশি ভূমিকা ছিল?
চিত্তরঞ্জন কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রবিদ্বেষের অভিযোগ অস্বীকার করেন বলে তাঁর কন্যা চিত্তরঞ্জন-জীবনীকার অপর্ণা দেবী আমাদের জানাচ্ছেন। এ-প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জনের মন্তব্য ছিল: ‘কথাটা ঠিক হল না, আমি রবিবিদ্বেষী একেবারেই নই, অলৌকিক প্রতিভা আমি কখনও অস্বীকার করি না, তবে তাঁর সব লেখাই যে ভাল লাগে তা বলতে পারি না।’ অর্থাৎ রবীন্দ্র-প্রতিভার বিরাটত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নয়, দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যই চিত্তরঞ্জনকে রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিতে প্ররোচিত করে। আর, চিত্তরঞ্জন-কন্যার দাবি অনুযায়ী, নারায়ণে রবীন্দ্রবিরোধী লেখা ছাপা হওয়ার পরও চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সৌহার্দ্যে ঘাটতি পড়েনি। (অপর্ণা: ৬৭)
অন্তত দেশব্রতী চিত্তরঞ্জনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা কত গভীর ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে লেখা রবীন্দ্রনাথের বহু-উদ্ধৃত কাব্যপঙ্ক্তি দুটি ছাড়াও নিম্নোক্ত গদ্যবাণীতে:
“আপন দানের দ্বারাই মানুষ আপন আত্মাকে যথার্থভাবে প্রকাশ করে। চিত্তরঞ্জন তাঁহার যে সর্বশ্রেষ্ঠ দান দেশকে উৎসর্গ করিয়াছেন তাহা কোনও বিশেষ রাষ্ট্রিক বা সামাজিক কর্ত্তব্য পালনের আদর্শমাত্র নহে; তাহা সেই সৃষ্টিশক্তিশালী মহাতপস্যা যাহা তাঁহার ত্যাগসাধনের মধ্যে অমৃতরূপ ধারণ করিয়াছে।”
(তথ্যসূত্র:
১. দেশবন্ধু রচনাসমগ্র, মণীন্দ্র দত্ত ও হারাধন দত্ত-সম্পাদিত , ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ।
২. মানুষ চিত্তরঞ্জন, অপর্ণা দেবী (২০০৭)।
৩. রবীন্দ্র বিদূষণ ইতিবৃত্ত, আদিত্য ওহদেদার (২০০৮)।
৪- সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ২২৩-২৪।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত