তিনি নিজেকে ভাবতেন তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর নায়ক বেজুকভ। নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাইরে নরম-কোমল মানুষটি কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ শক্তই ছিলেন। প্রয়োজনে খুব কাছের মানুষদের ব্যাপারেও অনায়াসে উদাসীন হয়ে যেতেন। অনেক দিনের বন্ধু বিভূতিভূষণ সম্পর্কে এমনই ধারণা ছিল নীরদ চন্দ্র চৌধুরী-র।
স্বাধীনতার বছর তিনেক আগের কথা। কলকাতায় মাঝেমধ্যেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছে। একবার রাস্তায় দাঙ্গার মধ্যে পড়ে বিভূতিভূষণ একটি বালির বস্তার আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। ভয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে বস্তার পিছন থেকে কেবলই বন্ধু নীরদচন্দ্রকে বলছিলেন, ‘‘আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, ট্রামে তুলে দিয়ো।’’ কিন্তু যে মুহূর্তে ট্রাম এল, নীরদচন্দ্র দেখলেন, তাঁকে রাস্তায় প্রায় ঠেলে ফেলে দিয়ে বিভূতিভূষণ ট্রামে উঠে চলে গেলেন। একবার পেছন ফিরেও তাকালেন না।
তাঁর বয়স তখন চার কী পাঁচ। বাবার হাত ধরে প্রথম কলকাতায় এলেন। বাবা দরিদ্র ব্রাহ্মণ। তখন তাঁদের কলকাতা শহরে ভাল পাড়ায় বাড়ি ভাড়া করে থাকার মতো রেস্ত নেই। তাই তাঁর পিতা মহানন্দ বন্দ্যাপাধ্যায় বাধ্য হলেন শিশুপুত্রকে নিয়ে এক ‘নিষিদ্ধ’ পাড়ায় বস্তিতে ঘর ভাড়া নিতে। সে ঘরের পাশেই এক মহিলা প্রায়ই ছোট্ট বিভূতিকে ডেকে গল্প করতেন। কখনও টফি দিয়ে আদর করে গালও টিপে দিতেন। মা-ছাড়া বাড়িতে খুব তাড়াতাড়ি শিশু বিভূতি মহিলার স্নেহের কাঙাল হয়ে উঠলেন। একদিন সন্ধেবেলায় তিনি জেদ ধরলেন, ঘরে যাবে না, তাঁর কাছেই রাতটা থাকবেন। মহিলা যত বুঝিয়েছিলেন, বিভূতি তত নাছোড় হয়েছিলেন।
মধ্যবয়সে মেসে থাকার সময় আবার একদিন বিভূতির মনে পড়েছিল ওই মহিলার কথা। ঠিক করেছিলেন সেই পুরনো পাড়ায় মহিলাকে খুঁজতে যাবেন তিনি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সেখানে গিয়ে তিনি যত বলেন খুঁজতে এসেছেন সেই মহিলাকে, এ ছাড়া আর অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই, অল্পবয়সি যুবতী মেয়েরা শুনতে নারাজ। একসঙ্গে চার-পাঁচ জন মেয়ে নাকি তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকলেরই আবদার তাঁকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার। শেষে ছুটে, দৌড়ে, পালিয়ে কোনও ক্রমে সে যাত্রা রক্ষা পান বিভূতিভূষণ। এ কথা মেসে এসে প্রাণের সখা নীরদচন্দ্রকে বলতে তিনি নাকি প্রথমে একচোট হাসেন। তারপর বিভূতিভূষণের কোনও আক্কেল নেই বলে তাঁকে খুব ভর্ৎসনা করেন।
অবশ্য তাতেও তাঁর ‘আক্কেল’ হয়নি।
একবার এক বন্ধু বলেছিলেন সন্ধ্যাবেলা ওয়েলিংটন স্ক্যোয়ারে গেলে নাকি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বেশ্যাদের দেখা যায়।— ‘‘তুমি যাবে, আমিও থাকব।’’ বিভূতিভূষণের বয়স তখন চল্লিশের বেশি। কথা মতো নির্দিষ্ট সময়ে তিনি সেখানে গিয়ে হাজির হলেন। তখন নভেম্বর মাস। শীতকাল। বাতাসে ঠান্ডা বেশ। বহু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখলেন, সব ভোঁ ভাঁ। বন্ধুও নেই, ‘তারা’ও নেই। রাগে গজগজ করতে করতে মেসে ফিরেছিলেন। নীরদচন্দ্রর মতে, আসলে লেখার রসদ খুঁজতে তিনি জীবনটাকে এমন করেই চেখে দেখতে চাইতেন। তাই-ই এ সব করে কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতেন মাঝেমধ্যে।
বিএ পাশ করার পর প্রথম চাকরি পেলেন হরিণাভির একটি স্কুলে। ক্লাসের ফাঁকে একদিন স্টাফরুমে বসে আছেন। একটি অল্পবয়সি ছেলে এসে বলল, ‘‘চলুন,আমরা দু’জনে মিলে একটা বই লিখি।’’ বিভূতিভূষণ কমবয়সি ছোকরার চাপল্য ভেবে কথাটার কোনও গুরুত্বই দিলেন না। মনে মনে ভাবলেন, ‘‘বই তো দূর অস্ত, কোনও দিন কোনও গল্প, প্রবন্ধ লেখার কথাও আমার মনে আসেনি।” পরের দিন স্কুলে পৌঁছে দেখেন, যেখানে-সেখানে সাঁটা বিজ্ঞাপন।
‘‘শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে….শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে উপন্যাস।’’
ভাবলেন নিশ্চয় ওই ডেঁপো ছোকরার কাজ, উপন্যাসের নামকরণও করে ফেলেছে সে — চঞ্চলা! এ দিকে সহকর্মীরা বিভূতিভূষণের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘‘বাঃ, মশাই! আপনি তো বেশ গোপন রসিক দেখছি। তা কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস?’’ পরে বিভূতিভূষণ তাঁর বন্ধু এবং ভ্রমণসঙ্গী যোগেন্দ্রনাথ সিংহকে বলেছিলেন, উপন্যাস তো দূর অস্ত, এমনকী তিনি যে আদৌ লেখক নন, বিজ্ঞাপনটা পুরো মিথ্যে, এ কথাও কাউকে বলতে পারেন নি। ছেলেটাকে কার্যত কলার চেপে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এইসব রসিকতার মানে কী? কোন প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেয় সে এ সব করল! তাতে ছেলেটি একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলেছিল, ভেবেছিল দু’জনে মিলে লিখে ফেলবে, আর ‘চঞ্চলা’ নামটাও তো মন্দ নয়। তাঁর এই ভাবলেশহীন উত্তরে বিভূতিভূষণ আর কিছু বলতে পারেননি। এদিকে রাস্তায়, বাজারে, স্কুলে, সকলের একই প্রশ্ন শুরু হয়েছিল — কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস? রাগের চোটে কাগজ-কলম নিয়ে বসে একটি ছোট গল্প লিখেছিলেন। তারপরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতার একটি মাসিক পত্রিকায়। পত্রিকার নিয়ম অনুযায়ী সঙ্গে একটি ঠিকানা লেখা খাম স্ট্যাম্প সেঁটে পাঠিয়েছিলেন।তিন দিন পর থেকেই অপেক্ষা। দুরু দুরু বুকে স্কুলে বসে ভাবতেন এই বুঝি খাম ভর্তি অমনোনীত গল্প ফেরত এল! সপ্তাহ তিনেক বাদে এল সেই খাম। দেখামাত্র বিভূতিভূষণ খামটা পকেটে চালান করে দিয়েছিলেন।বিভূতিভূষণ ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘‘দুঃখ তো হল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই আনন্দও হল যে রোজকার দুশ্চিন্তা তো কাটল। আমার মনের অবস্থা এমন হল যে কোনও প্রিয়জন অসাধ্য রোগে মারা গিয়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল।’’ বাড়ি ফিরে খাম খুলে দেখেছিলেন, লেখা তো নেই! বদলে একটি চিঠি। সম্পাদক মশাই লিখেছেন, “আপনার রচনা মনোনীত হয়েছে, শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।” পরবর্তী কালে বিভূতিভূষণ তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন, ছেলেটি বোধহয় ঈশ্বরের দূত হয়ে সে দিন তাঁর কাছে এসেছিল। ওই বিজ্ঞাপন কাণ্ডটি না ঘটলে তিনি কোনও দিন লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না। সেই ছোকরার আসল নাম ছিল যতীন্দ্রমোহন রায়। ১৩২৮, মাঘ মাসের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’। এই গল্পটি সেই বছর শ্রেষ্ঠ গল্পের পুরস্কারও ছিনিয়ে নেয়।
প্রায়শই বিভূতিভূষণ তাঁর মুগ্ধ পাঠিকাদের থেকে প্রেমপত্র গোছের চিঠি পেতেন এবং বন্ধু নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতে, তিনি এ সব বেশ ভালই উপভোগ করতেন। সেই সব গল্প বেশ রসিয়ে রসিয়ে প্রাণের সখা নীরদচন্দ্রকে বলতেন। মির্জাপুর স্ট্রিটের মেসে আসার আগে হরিণাভির স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দেন বিভূতিভূষণ। চাকরিটি ছাড়ার পেছনে একটা রোম্যান্টিক ঘটনা জড়িয়ে। ওই সময় তিনি স্কুলের কাছে একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। তাঁদের একটি বিবাহযোগ্যা তরুণী কন্যা ছিল। সে আড়ালে-আভাসে বিভূতিভূষণকে খেয়াল রাখত।বিভূতি স্কুলে চলে গেলে প্রায়শই মেয়েটি এসে তাঁর এলোমেলো ঘরদোর গুছিয়ে দিত। বিভূতিভূষণ সে সব বুঝতে পারতেন। কিন্তু কিছু বলতেন না। কারণ, মেয়েটিকে তাঁরও বেশ লাগত। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কখনওই তাঁর মন-মেজাজ ভাল থাকত না। ঠিক তখনই না চাইতেই অমন যত্ন –আত্তি! মেয়েটি নিজেকে ‘আমি আপনার দাসী’ সম্বোধন করে বেশ কয়েকটি চিঠিও লিখেছিল তাঁকে। সে-চিঠি নীরদচন্দ্র দেখে বলেছিলেন, ‘‘এমন পবিত্র পত্র তিনি দেখেননি আগে।’’ কিন্তু হঠাৎই বিভূতিভূষণ ওই চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন। কারণ ওই মেয়েটির উপর তিনি যতই মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলেন ততই বুঝতে পারছিলেন, তাঁরা কুলীন ব্রাহ্মণ, মেয়েটি তাঁদের সমগোত্রীয় নয়। কাজেই কোনও সম্পর্ক হলে তাঁর পরিবার খুশি হবে না। আশেপাশেও অনেক কথা হবে।এই সব ভেবে তিনি কাউকে না জানিয়ে প্রায় লুকিয়েই কলকাতায় চলে আসেন। ফিরে এসে স্কুলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। এই ঘটনা পেরিয়ে প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার তেইশ বছর পর বিভূতিভূষণ দ্বিতীয় বিবাহ করেন।
ইছামতী নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে তাঁর বোন জাহ্নবীর মৃত্যু হয়। আকস্মিক এই ঘটনায় বিভূতি যেন দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিলেন। তার দু’দিন পর, একটি অল্পবয়সি মেয়ে এসেছিল বিভূতির কাছে অটোগ্রাফ চাইতে। মেয়েটিকে খুব ভাল লেগে গেল তাঁর। ধীরে, ধীরে দুই অসমবয়সির বন্ধুত্বও বেশ গাঢ় হল। এক বছরের মাথায় দু’জনে বিয়ে করলেন। পরবর্তী কালে বিভূতিভূষণ কল্যাণী দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘এখন মনে হচ্চে হয়তো অনেক জন্মের বন্ধন ছিল তোমার সঙ্গে— নয় তো এমন হবে কেন? কল্যাণী, তুমি আমার অনেক দিনের পরিচিতা, এ বার এত দেরীতে দেখা হল কেন জানি নে, আরও কিছুকাল আগে দেখা হলে ভাল হতো।”
আমাদের মধ্যে কমবেশি অনেকেই লেখক হতে চান। অনেকে হয়তো নিভৃতে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেন- লেখক হয়ে ওঠার কি সেই জাদুমন্ত্র? যা একবার আওড়ালেই লেখক হয়ে উঠবেন তিনি। মন্ত্র আওড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লেখক হয়ে ওঠা প্রত্যাশী ব্যক্তিটি হয়তো কিঞ্চিৎ কায়িক পরিশ্রম করতেও প্রস্তুত থাকেন কখনো-সখনো। পশ্চিমবঙ্গের ‘দেশ’ নামক স্বনামধন্য পত্রিকাটির প্রয়াত সম্পাদক সাগরময় ঘোষ, লেখক হওয়ার জাদুমন্ত্র সম্পর্কে বলেছেন, লেখক হতে গেলে বিশেষ করে তিনটি ক্ষমতার অধিকারী হওয়া প্রয়োজন,
প্রথমত, প্রচুর পড়াশোনা, অর্থাৎ বিদ্যা-বুদ্ধি থাকা চাই।
দ্বিতীয়ত, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।
আর তৃতীয়ত, কতখানি সিমেন্টের সঙ্গে কতখানি বালি মেশালে ইমারত গাঁথা যায়, সে কলাকৌশলটুকুও জানতে হবে। অর্থাৎ কতখানি বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কতটুকু কল্পনার মিশেল দিলে সেটি যে লেখা সাহিত্যে পদবাচ্য হবে সে বিষয়ে অবশ্যই টনটনে জ্ঞান থাকা চাই।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর, নদীয়া জেলার কল্যানির কাছে মুরাটিপুর গ্রামের ঘোষ পাড়ায় মাতুলালয়ে। উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগ্রামে (বনগাঁ) তাঁর পিতার কাছে কাটে তাঁর শৈশব। পিতা মহানন্দের পেশা ছিল কথকতা, পৌরোহিত্য ও কবিরাজি। জন্মস্থান এবং পিতার চরিত্র বিভূতিভূষণের সাহিত্যজীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিভূতিভূষণের বাল্যকাল ও কৈশোর কেটেছিল অভাব, দারিদ্র্যের মধ্যে। তবে বিভূতিভূষণের মনে লেখক হওয়ার বীজ রোপিত হয়েছিল সেই সময় যখন তিনি সবেমাত্র পাঠশালায় যাতায়াত শুরু করেছেন। পাঠশালায় কিছুতেই মন বসত না ছোট্ট বিভূতির। বিভূতির পিতা সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লেই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালির জগতে, চলে যেতেন ইছামতির পাড়ে। এতে সুবিধাই হয়েছিল বিভূতির। বনমরিচের জঙ্গলটার মধ্য দিয়ে পুত্রের হাত ধরে প্রকাণ্ড প্রবীণ এক বৃক্ষের কাছে এসে দাঁড়াতেন মহানন্দ। বিভূতিকে উদ্দেশ করে বলতেন, ‘এই হলো সপ্তপর্ণ জুনিপার গাছ। বুঝেছিস বিভূতি, তোর দাদু ওষুধ তৈরি করতেন এর বাকল দিয়ে। আর আমি এটা ছেঁচে-বেটে দিতাম।’ মাঝে মধ্যে হঠাৎ দাঁড়িয়ে আশ্চর্য হয়ে বিভূতি মহানন্দকে প্রশ্ন করতেন, ‘দেখ বাবা এই লতাটি দেখতে কেমন? এই গাছটি বেয়ে কিভাবে উপরে তরতর করে উঠে গেছে। একই রকম লতা অথচ দুরঙের ফুল।’ বিভূতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর বাবার কাছে জানতে চাইতেন লতাটির নাম। পিতা মহানন্দ দৌড়ে লতাটির কাছে এসে বলতেন, ‘একি! তোকে না দুদিন আগেই এই লতাটিকে চিনিয়ে দিলাম! এর নাম হলো অপরাজিতা। এই তো সেদিন তোর মায়ের গলা ভেঙে গেল, এই লতাপাতা থেঁতলে রস করে তোর মাকে খাইয়ে দিলাম আর অমনি তার গলা ভাঙা সেরে গেল।’ বিভূতি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলতেন, আসলেই এটাই তো সেই অপরাজিতা গাছ!’ এভাবে কিছুদিন চলার পর বিভূতির কী মতি হলো কে জানে। নোটবুকের মতো একটি খাতা তৈরি করেছিলেন তিনি। নতুন চেনা গাছ, লতা, পাখির নাম পেলে পেন্সিল দিয়ে টোকা হত তাতে। পাঠশালার পাঠ শেষ করে সবেমাত্র বিভূতি হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছেন। ঠিক তখনই পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারালেন। বিভূতির মা তাঁদের পরিবারের অন্য ছোট ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে সুরাতিপুর বাপের বাড়ি চলে গেলেন। বড় ছেলে বিভূতি কি করবে? পড়ার পাঠ সাঙ্গ করে ফিরে যাবে গ্রামে? না কিছুতেই না। তখন তাঁর বোর্ডিংয়ের খরচ চালাচ্ছেন সহৃদয় প্রধান শিক্ষক চারুবাবু। চারুবাবু জানতেন অতি মেধাবী ছাত্র বিভূতি। কিন্তু চারুবাবু বিভূতিকে পছন্দ করতেন অন্য কারণে। নানাবিধ বই পড়তে পছন্দ করতেন বিভূতি। চারুবাবু বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন এই ছেলে জীবনে সফল হবেই। চারুবাবুর সুপারিশে ডাক্তার বিধুভূষণ বন্দ্যোপাধ্যয়ের বাড়িতে বিভূতির আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়েছিল, তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, বিভূতিকে ডাক্তার সাহেবের ছেলে জামিনীভূষণ এবং মেয়ে শিবরানী এই দুজনকে পড়াতে হবে। বিভূতিভূষণ সানন্দে সেই সব শর্তে বাড়িতে থাকতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। বিধু ডাক্তারের বাড়ির পাশেই ছিল মন্মথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। আর এই বাড়ির একটি নতুন আকর্ষণ ছিল সেখানকার একটি ক্লাব, নাম- ‘লিচুতলা ক্লাব’। এই ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মন্মথ চ্যাটার্জি। তিনি বৃত্তিতে একজন মোক্তার হলেও আসলে মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন সাহিত্য সাধক। বিভূতির প্রথমেই দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, মন্মথ দা নিজেই কেবল সাহিত্য রচনা করেন না, উপরন্তু ‘বালক’ ও ‘যমুনা’ নামক দুটি সাহিত্য পত্রিকার তিনি নিয়মিত গ্রাহক। বিভূতিও অবিলম্বে সেগুলোর অনুগ্রাহক হয়ে গেলেন। একেকটি সংখ্যা লিচু ক্লাবে আসতেই গোগ্রাসে তার প্রতিটি লেখা পাঠ, আলোচনা, বিচার চলতে থাকত পুরোদমে। এই লিচুতলায় বসেই যমুনা পত্রিকায় বার্মা প্রবাসী জনৈক বাঙালির একটি ধারাবাহিক উপন্যাস পড়ে বিস্মিত হয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। বিভূতি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, কে এই লেখক, যার নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়? কি জাদুময় তার লেখনীশক্তি! তিনিও কি পারবেন শরতের মতো করে লিখতে? এভাবেই লেখক হওয়ার দুর্বার আকর্ষণ তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত। তবে বিভূতির প্রথম লেখার সূত্রপাত অবশ্য হয় যখন তিনি রিপন কলেজের ছাত্র ছিলেন (রিপন কলেজের বর্তমান নাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। বিশিষ্ট সাহিত্যিক রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী তখন রিপন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর প্রেরণায় কলেজে তখন পুরোদমে চলত বিতর্ক সভা, সাহিত্যচক্র, সাহিত্যপত্র প্রকাশ প্রভৃতি। আর এই সাহিত্যচক্রের একটি অনুষ্ঠানে বন্ধুদের উৎসাহে ‘নতুন আহ্বান’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে সেটি পাঠ করেছিলেন বিভূতি। সবার কাছ থেকে অকুণ্ঠ বাহবা ও সুখ্যাতি পেয়ে একদিন কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন তিনি কলেজের ম্যাগাজিনে। দারিদ্র্যের সীমাহীন কশাঘাতের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ তাঁর লেখাপড়া শেষ করেন। বিভিন্ন সময়ে বৃত্তি হিসেবে এখানে ওখানে নানাবিধ কর্মের পর কলকাতার একটি স্কুলে মাস্টারি জুটিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও পোষালো না বেশি দিন। অগত্যা শেষমেশ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিটোলায় খেলাত ঘোষদের জমিদারির সেরেস্তায় নায়েবের কাজ নিয়ে ভাগলপুরে চলে আসেন।
পাঠকদের এখানে একটি বিষয় জানিয়ে রাখছি, বিভূতিভূষণ তখনো অবধি লেখালেখি শুরু করেননি। পথের পাঁচালী লেখার মধ্য দিয়ে ভাগলপুরেই তাঁর লেখক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। পথের পাঁচালী লেখার আগে বিভূতিভূষণ ‘স্মৃতির রেখা’ নামে তার নিত্যদিনের খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যক্তিগত জার্নালের মতো কিছু একটা লিখতেন। এই ভাগলপুরের বাঙালিটোলায় লেখক বিভূতিকে আবিষ্কার করেন যে মানুষটি তাঁর নাম উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এখানে বলা বেশ প্রাসঙ্গিক হবে যে, এই উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন দুজন বিখ্যাত সাহিত্যিককে আবিষ্কার করার কারণে। তাঁদের মধ্যে প্রথমজন হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর দ্বিতীয়জন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে আইন পাস করে উপেন্দ্রনাথ চলে এসেছিলেন ভাগলপুরে আইন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কলকাতায় লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সময়ই তিনি সাহিত্যের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওই সময়ের বিখ্যাত সব পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’, ‘সাহিত্য’ ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরিয়েছিল। ওকালতি করতে এসে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর নিজ বাসভূম ভাগলপুরে একটি সাহিত্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন তাঁর চারপাশে। উপেন্দ্রনাথ একদিকে সাহিত্যপাগল অন্যদিকে মজলিশি। তাঁর বাড়ির কাছারি ঘরে নিত্যদিন জমজমাট সাহিত্য আড্ডা বসত। সেই আড্ডায় একটি অপরিচিত যুবকের ছিল নিত্য যাওয়া-আসা। পরনে হাঁটু ছুঁই ছুঁই খাটো একটি ধুতি। গায়ে নিজ হাতে কাচা ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবি। এক হাতে থাকত লণ্ঠন, অপর হাতে থাকত একটি লাঠি। মানুষটি সেই জমাট সাহিত্যিক জলসায় যেন শুধু একজন মনোমুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। যেমন নিঃশব্দে আসতেন তেমনি নিঃশব্দে চলে যেতেন। বৈঠকখানার সেই আড্ডায় কতজন কত রকম সাহিত্যিক আলোচনা ও মন্তব্যে মেতে উঠতেন। কিন্তু সেই যুবকটি কোনো আলোচনায়ই অংশগ্রহণ করতেন না। অথচ গোপনে এই মানুষটিই লিখে চলেছিলেন পথের পাঁচালীর মতো এক কালজয়ী উপন্যাস, সেটা কে বিশ্বাস করবে? এই অতি সাধারণ মানুষটির পেটে যে এত বিদ্যে ও সাহিত্যজ্ঞান তা বোধকরি সবার ধর্তব্যের বাইরে ছিল। এভাবে শীত বসন্ত অতিক্রান্ত হয়ে এক সময় আবির্ভাব ঘটলো গ্রীষ্ম ঋতুর। বৈশাখ মাসের এক বিকালে হঠাৎ সব আকাশ পিচকালো রং ধারণ করে বইতে শুরু করল বৃক্ষরাজির মাথা ভেঙে নেওয়া কালবৈশাখী ঝড়। আর সেই ঝড়-জল ভেঙে সেদিনকার আড্ডায় উপস্থিত হলো না কেউ? উপেন্দ্রনাথ কাছারি ঘর থেকে নেমে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলেন কেউ আসছে কি না। বাইরে রাস্তার দিকে তাকাতেই দূরে একটি লণ্ঠনের আলো তার দৃষ্টিগোচর হলো, সঙ্গে একটা ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি এসে হাজির হলো তাঁর বৈঠকখানায়। তিনি একেবারে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন। উপেন্দ্রনাথ বললেন – ‘একি আপনি পেছনে বসলেন কেন?’ প্রতিউত্তরে বিভূতি বললেন – ‘আরও অনেকে আসবে যে, আমি কিভাবে সামনের বেঞ্চটিতে বসি?’ উপেন্দ্রনাথ বললেন, ‘ঝড় জল ভেঙে আজকে মনে হচ্ছে আর কেউ আসবে না। আসুন আপনি সামনের চেয়ারটাতে এসে বসুন।’ নানাবিধ গালগল্পের মধ্যে উপেন্দ্রনাথ হঠাৎ বিভূতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ‘তা আপনার কবিতা কিংবা গল্প উপন্যাস লেখার বাতিক-টাতিক আছে না কি কিছু?’ বিভূতি বলেছিলেন – ‘না তেমন কিছু নয়, একটা উপন্যাস লিখেছি। কিন্তু লেখাটি আদৌ মানসম্পন্ন হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না।’ উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বিভূতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন – ‘তাহলে উপন্যাসের খাতাটি একবার নিয়ে আসুন। দেখি কেমন উপন্যাস লিখেছেন আপনি?’ এ ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই বিভূতি তাঁর পথের পাঁচালী উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিখানা জমা দিয়ে গিয়েছিলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। একদিন দু’দিন করে কেটে গিয়েছিল পুরো দুই মাস। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে কিছুই বলছিলেন না। বিভূতিভূষণ মনে মনে ভেবেছিলেন তাহলে কী তাঁর উপন্যাসখানা সাহিত্য দণ্ডে মানসম্পন্ন হয়নি?
যা হোক, এমনই একদিন মজলিস শেষ করে একে একে সবাই যখন উঠে চলে যাচ্ছেন ঠিক সেই মুহূর্তে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে বলেছিলেন, ‘আপনি এখনই যাবেন না। আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।’ সাহিত্য আসর থেকে সবাই বিদায় নেওয়ার পর উপেন্দ্রনাথ বিভূতিকে বলেছিলেন – ‘ভাই আপনার হবে। হবে বলছি কেন? আপনার হয়েছে। কী এক অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন আপনি। পড়েই মনপ্রাণ দুটোই জুড়িয়ে গেছে আমার। যা হোক এবার আসল কথা বলি, আমি ভাগলপুরে আর থাকছি না। কলকাতায় চলে যাচ্ছি। তবে আমার কলকাতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সেখান থেকে একটি পত্রিকা বের করব ‘বিচিত্রা’ নামে। সেখানেই আমি ছাপাব আপনার এই উপন্যাসটি। আপনার এই উপন্যাস দিয়েই যাত্রা শুরু করবে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকাটি।’ এর কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে বিচিত্রা পত্রিকাটি এবং বিভূতিভূষণের উপন্যাসও কিস্তিতে কিস্তিতে বের হতে শুরু হয়। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যরসিক পাঠক মহলে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল – কে এই লেখক? যে এত দরদ দিয়ে সমাজ ও দেশ গ্রামের তুচ্ছ তুচ্ছ জিনিসগুলো এত মনোমুগ্ধ করে তাঁর লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। হঠাৎ একদিন সেই বিখ্যাত পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনী কান্ত দাস অনেক খোঁজখবর করে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এসে উপস্থিত হন। নব্বইটি টাকা তাঁর হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন – ‘বিভূতি বাবু আপনি যদি অনুমতি দেন তবে পথের পাঁচালী উপন্যাসটি বই আকারে আমি ছাপবো।’ এরপর বিভূতিভূষণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পথচলা কেউ আর থামাতে পারেনি। দু’হাতে লিখেছেন এবং যা লিখেছেন মোটামুটি সবই বিখ্যাত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – আরণ্যক, অপরাজিতা, অশনি সংকেত, ইছামতি, দেবযান ইত্যাদি।
বিভূতিভূষণের প্রিয় ফল ছিল আম আর কাঁঠাল। ভালবাসতেন চাঁপা, বকুল, শেফালি ফুল। বন্য ফুলের মধ্যে পছন্দ ছিল ঘেঁটু আর ছোট এড়াঞ্চি। ঋজু বনস্পতিতেও আকর্ষণ ছিল তাঁর। গাছ আর মেঘমুক্ত রোদের দিনে দিগন্ত— এ সব নিয়েই চলত তাঁর পড়াশোনার নেশা। সাহিত্য পড়তেন। সঙ্গে পড়তেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান আর উদ্ভিদবিদ্যা। শেষ জীবনে নাকি পরলোকতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন। তাই সারা বাড়িতে বইপত্র ছড়ানো থাকত। আলমারিতে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন না।
বিভূতিভূষণের দৈনন্দিন রুটিনটাও ছিল ভারী মজার। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। প্রবল গরম হোক বা প্রবল শীত, স্নান করতে যেতেন ইছামতীতে। ফিরে লিখতে বসতেন। প্রথমে দিনলিপি। তার পর চিঠিপত্রের উত্তর। ৭টা নাগাদ প্রাতরাশ। ৯টা নাগাদ স্কুলের পথে যাত্রা। শোনা যায়, গোপালনগর উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে যাওয়ার সময় সদ্য-ভাঙা গাছের ডাল বা বাঁশের কঞ্চি জাতীয় কিছু একটা নিয়ে যেতেন বিভূতিভূষণ। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে জলযোগ। ইছামতী অথবা বাওড়ের ধারে শক্তপোক্ত গাছের ডালের উপরে গিয়ে বসতেন। খানিক বাদে আবার পড়ানো। প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আসত তাঁর কাছে। পড়াতেন, গল্প বলতেন। রাতের খাওয়ার পরে কোনও কোনও দিন আড্ডা দিতে বাইরে যেতেন। বাড়ি ফিরতে হয়তো একটা বেজে যেত। আর এই পুরো সময়টাই প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করতেন। বিশেষত, বিকেল আর বেশি রাতে। গাছের ডালে বসে আকাশের বদলাতে থাকা রং দেখতেন। গভীর রাতে দেখতেন গভীর কালো আকাশ।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘‘বিভূতিভূষণ আর সমস্ত সার্থক-কর্মা দিব্যদৃষ্টি লেখকের মত এই দুইটি প্রধান বিষয় বা বস্তু নিয়েই যা কিছু বলবার তা ব’লে গিয়েছেন।’’ সেই দু’টি প্রধান বিষয় হল প্রকৃতি আর মানুষ। প্রকৃতির কথা কিছু হল। মানুষ নিয়ে আরও ভয়ের কিছু বাস্তব এঁকেছিলেন বিভূতিভূষণ।
‘তালনবমী’র আগের রাত জুড়ে গোপাল স্বপ্ন দেখেছিল— ‘‘খোকা, কাঁকুড়ের ডাল্না আর নিবি? মুগের ডাল বেশি করে মেখে নে… খোকা যাই তাল কুড়িয়ে দিয়েছিলি, তাই পায়েস হল! …
খা, খা,—খুব খা—আজ যে তালনবমী রে…’’ বিভূতিভূষণের অনেক চরিত্রই এমন অভুক্ত।
‘পথের পাঁচালী’তে ছিল অপু-দুর্গার আশ-শ্যাওড়ার ফল খাওয়ার গল্প। বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, জন্মে থেকে তারা কোনও ভাল জিনিস খেতে পায়নি। অথচ তারা তো পৃথিবীতে নতুন। তাই মিষ্টি রসের স্বাদ পেতে চায় তারা। কিন্তু মিষ্টি কিনে খাওয়ার অবস্থা তাদের নেই। তবে বিশ্বের সম্পদ অনন্ত। সেখান থেকেই সামান্য বনের গাছ থেকে, তারা নিজেদের ভাল লাগার জিনিস সংগ্রহ করে। লেখকের কলমে: ‘‘…লুব্ধ দরিদ্র ঘরের বালকবালিকাদের জন্য তাই করুণাময়ী বনদেবীরা বনের তুচ্ছ ফুলফল মিষ্টি মধুতে ভরাইয়া রাখেন।’’ তার পরে এক দিন নিশ্চিন্দিপুরের পাশের গ্রামে আদ্যশ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে গিয়ে ব্রাহ্মণদের দেখাদেখি ছাঁদা বাঁধে অপু। সেই ছাঁদা দেখে বড় খুশি হয় তার মা সর্বজয়া।
‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ উপন্যাসের একেবারে গোড়ায় জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে জিতুর দাদা বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সমান ভাগে খাবার না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিল— ‘‘মাছ তো কম কেনা হয়নি, তার ওপর আবার মাঠের পুকুর থেকে মাছ এসেছিল—এত মাছ সব হারু আর ভুন্টিরা খেয়ে ফেলেচে! বাবারে, রাক্কোস্ সব এক-একটি! একখানা মাছও খেতে পেলাম না।’’
‘সই’, ‘পুঁইমাচা’ বা ‘অনুবর্তন’-এ বারবার খিদে উঠে এসেছে বিভূতিভূষণের কলমে। বড় বেশি দারিদ্র্য দেখেছেন লেখক। সাহিত্যে তার ছাপ থাকবে না, তা-ও কি হয়? লেখালেখির প্রাণ পায় সেখান থেকেই। ‘পথের পাঁচালী’ প্রসঙ্গে দিলীপকুমার রায়কে এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘‘দৈনন্দিন ছোটখাটো সুখ-দুঃখের মধ্যে দিয়ে যে জীবনধারা ক্ষুদ্র গ্রাম্য নদীর মত মন্থর বেগে অথচ পরিপূর্ণ বিশ্বাসের ও আনন্দের সঙ্গে চলেছে—আসল জিনিসটা সেখানে… নভেল কেন কৃত্রিম হবে?’’
বিভূতিভূষণের ভালবাসাও ছিল অকৃত্রিম। দিনলিপিতে লিখেছিলেন, ‘‘ভালবাসা Pity নয়, করুণা নয়, Charity নয়, সহানুভূতি নয়, এমন কি বন্ধুত্বও নয়— ভালবাসা ভালবাসা। এখন সেই জিনিসের সূক্ষ্ম মহিমা ও রসটুকু না বুঝে যে নষ্ট করে ফ্যালে অযাচিতভাবে দিয়ে, অপাত্রে দিয়ে— তার চেয়ে বড় মূর্খ আর কে?’’ প্রকৃতি আর মানুষ পছন্দ করতেন বলেই মন দিয়ে দেখতেন জগতের সৃষ্টি। ভালবাসা দিয়েও। নিজে সৃষ্টি করতেন তার থেকে রস আহরণ করে। ভালবাসা সেখানেও ছিল কানায় কানায়।
পুজোর ঠিক কয়েক দিন আগে ঘাটশিলা চলে যেতেন বিভূতিভূষণ। ফিরতেন মাঘের শেষে অথবা ফাল্গুনের গোড়ায়। আসলে তিরিশের দশকের শুরু থেকেই ঘাটশিলা আর গালুডির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। পরে ঘাটশিলায় একটি বাড়ি কেনেন, গৌরীদেবীর নামে নাম দেন ‘গৌরীকুঞ্জ’। ১৯৪২ সালে ব্যারাকপুরে পুরোদস্তুর সংসারি হওয়ার পরেও ঘাটশিলায় গিয়ে মাসকয়েকের অবসর যাপন চলত। বছরের এই সময়ে সেখানে যেতেন তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুরা। প্রমথনাথ বিশী, বিশ্বপতি চৌধুরী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, প্রবোধকুমার সান্যাল, বাণী রায়, সুমথনাথ ঘোষ, নীরদরঞ্জন দাশগুপ্তদেরও ছুটিটা ঘাটশিলাতেই কাটত। ফলে আড্ডা জমত। আর চলত প্রকৃতি দেখা। নির্জন এলাকায় একা একা বেড়াতেন বিভূতিভূষণ। এঁদেলবেড়ের জঙ্গল, সুবর্ণরেখা নদী, পাণ্ডবশীলা, কাছিমদহ রাত-মোহনা ছিল তাঁর প্রিয় ভ্রমণের জায়গা। শোনা যায়, ফুলডুংরি পাহাড়ের পিছনে একটি পাথরের উপরে বসে উপাসনা করতেন তিনি। বাড়ির সামনেও তেমন একটা পাথরখণ্ড ছিল। কূর্মাকৃতি বলে বিভূতিভূষণ নাম দিয়েছিলেন, ‘কূর্মকূট’। ঘাটশিলা তাঁর এতই পছন্দ হয়েছিল যে গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সুমথনাথ ঘোষ এবং বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়কে সেখানে বাড়ি কিনিয়েছিলেন।
তত দিনে বেরিয়ে গিয়েছে ‘আরণ্যক’। সময়টা ১৯৪৩ সালের শেষ দিকে। শীত কাল। বন আধিকারিক যোগেন্দ্রনাথ সিংহের আমন্ত্রণে সারান্ডার জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। সেই জঙ্গলে ভ্রমণ করার সময়ে লিখলেন ‘দেবযান’। মুগ্ধ হয়েছিলেন এতটাই যে, এক দিন রাত দেড়টা অবধি জেগে ছিলেন। মাথার উপরে দ্বিতীয়ার চাঁদ, পাশে কোয়না নদী— তার মধ্যে বসে বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন, ‘‘অরণ্যই ভারতের আসল রূপ, সভ্যতার জন্ম হয়েচে এই অরণ্য-শান্তির মধ্যে, বেদ, আরণ্যক, উপনিষদ জন্ম নিয়েচে এখানে— এই সমাহিত স্তব্ধতায়— নগরীর কোলাহলের মধ্যে নয়।’’
ঠিক এত দূরই দেখার ক্ষমতা ছিল বিভূতিভূষণের। তাই এইচএইচ জনস্টন, রোসিটা ফোর্বস-এর মতো কয়েক জন বিখ্যাত পর্যটকের বই পড়ে আফ্রিকার ভূপ্রকৃতি নিখুঁত বর্ণনায় সাজিয়েছিলেন ‘চাঁদের পাহাড়’-এ। আসলে প্রায় সাধকের মতোই লিখতেন বিভূতিভূষণ। জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত। শেষ দশ বছর, ব্যারাকপুরে থাকাকালীন লিখেছেন ‘অশনি সংকেত’ বা ‘ইছামতী’র মতো কালজয়ী উপন্যাস। মৃত্যুর ঠিক পাঁচ-সাত দিন আগে পুজোর ছুটিতে শেষ করেছিলেন জীবনের শেষ গল্প ‘শেষ লেখা’। পরে বিভূতিভূষণের লেখার বাক্স থেকে উদ্ধার হয়েছিল সেই গল্প।
বিভূতিভূষণ তখন হরিনাভিতে। বন্ধু ‘বালক-কবি’ পাঁচুগোপাল ওরফে যতীন্দ্রমোহন রায় এক দিন তাঁকে বললেন, ‘‘আপনার সঙ্গে ঘুরতে হলে, পা-দু’খানি লোহার করতে হবে।’’ স্কুল থেকে ফিরে খানিক বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন বিভূতিভূষণ। কখনও বসতেন ছ’আনি চৌধুরীদের ভাঙাবাড়ির দোলমাচার সামনে, কখনও ময়রা পাড়ার খোঁড়া গুরুর পাঠশালে। সেখানে ছাত্ররা সুর করে ধারাপাত পড়ত। শুনতে ভালবাসতেন বিভূতিভূষণ। এক এক দিন যতীন্দ্রনাথের আসতে দেরি হলে একাই বেরিয়ে পড়তেন। তখন সন্ধে হলে বোসপুকুর কিংবা নিশ্চিন্দিপুরের ফাঁকা, মেঠো রাস্তায় তাঁকে খুঁজতে বেরোতে হত। প্রায়ই খগেন বোসের বাড়ির সামনে কাঁঠালিচাঁপা বনের ধারে খুঁজে পাওয়া যেত বিভূতিভূষণকে। এ রকমই এক দিন হাঁটতে হাঁটতে বোড়াল পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন তিনি। রাজনারায়ণ বসুর বাড়ি দেখতে। আবার এক দিন বোড়াল থেকে ফেরার পথে রাজপুর বাজারে গঙ্গার ধারে এসে বিভূতিভূষণ বললেন, “এত দূর ঘুরে দেখে এলাম মন্দিরটার কাছে না বসলে, কর মশাই রাগ করবেন।” যতীন্দ্রনাথ প্রবল অবাক হলেন। কারণ সেই ব্যক্তি তখন প্রয়াত হয়েছেন। তবু বিভূতিভূষণ বললেন, “তাঁর দেহ নেই কিন্তু আত্মা আছে তাঁর কীর্তিগুলি ঘিরে, তুমি টের পাও না, আমি কিন্তু টের পাই।” যতীন্দ্রমোহনের লেখা থেকে পাওয়া যায়— “ভবিষ্যতে ‘দেবযান’ নির্মাতার তখনকার এই কথাগুলি মনে পড়্লে আজও দেহ রোমাঞ্চিত হ’য়ে ওঠে।”
ঠিক যেমন, ছ’আনি চৌধুরীদের ভাঙা বাড়ি থেকেই গড়ে উঠেছিল ‘কেদার-রাজা’র পটভূমিকা।
এখানেই শুরু বিভূতিভূষণের লেখালেখিও। ১৯২০ সালের জুন মাসে হরিনাভির দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ অ্যাংলো সংস্কৃত বিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজে যোগ দিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। সেখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল যতীন্দ্রমোহনের। সে সময়ে কলকাতার এক প্রকাশক ‘ছয় আনা গ্রন্থাবলী’ নামে এক সিরিজ বার করত। তাদের গ্রন্থাবলি প্রকাশ শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা দিয়ে। স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে তেমনই একটি বই বিভূতিভূষণকে দিয়ে যতীন্দ্রমোহন প্রস্তাব করেছিলেন— ‘‘আসুন আপনাতে আমাতে এইরকম একটা উপন্যাস সিরিজ বের করা যাক।’’ তার পরে বিভূতিভূষণের নামে স্কুলের নোটিস বোর্ড, দেওয়াল, নারকেল গাছের গায়ে পোস্টার পড়ল। বাধ্য হয়ে গল্প লিখলেন বিভূতিভূষণ— ‘পূজনীয়া’। সে নামে অবশ্য বেরোয়নি। প্রকাশিত হয়েছিল ‘উপেক্ষিতা’ নামে।
সে-ই হল লেখার শুরু। তার পর আর কলম থামেনি। দু’চোখ ভরে জগৎকে দেখেছেন। দুনিয়ার পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছেন। এবং লিখেছেন।
(তথ্যসূত্র:
১- আমাদের বিভূতিভূষণ, রমা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌসুমী পালিত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (১৯৯৭)।
২- আমার শিক্ষক বিভূতিভূষণ, আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১০)।
৩- বিভূতিভূষণ রচনাবলী।
৪- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যা (দিবারাত্রির কাব্য): আফিফ ফুয়াদ (সম্পাদিত)।
৬- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্ধানে: রুশতী সেন (সম্পাদিত)।
৭- বিভূতিভূষণের অপ্রকাশিত দিনলিপি: সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত)।
৮- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ সাল।
৯- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯শে নভেম্বর ২০১৬ সাল।
১০- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ই জুলাই ২০১৬ সাল।
১১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৫ই মার্চ ২০১৯ সাল।
১২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ঠা মার্চ ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত