তাঁর প্রয়াণের বারো বছর না পেরোলে যেন তাঁর জীবনচরিত লেখা না হয়! এমনই এক নির্দেশ জারি করে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেন? খুব সম্ভবত তাঁর ধারণা ছিল কোনও ব্যক্তি মারা যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই জীবনী লিখলে সব কথা খোলাখুলি বলা যায় না। এই বিশ্বাসের কথা তিনি বলেছিলেন তাঁর বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী লিখতে বসে। নিজের বন্ধুর জীবনের রূপরেখাটুকুও দাঁড় করতে তিনি অপেক্ষা করেছিলেন তিন-চার বছর।
একশো পঞ্চান্ন বছর আগে বিষ্ণুপুর থেকে মান্দারনের পথে বাংলা উপন্যাসের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। বাঙালির অনেক প্রত্যাশার দায় এই বৃহৎ বাঙালিটিকে নিতে হয়েছে। প্রতি বছর তাঁর জন্ম-মৃত্যুদিন আসে আর চলে যায়। কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমের জন্মস্থান, দু’-চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা তাঁর নাম-জড়িয়ে-থাকা স্কুল-কলেজে তাঁর মূর্তিতে নিয়মরক্ষার মাল্যদান ছাড়া, বিশেষ কিছুই হয় না। অথচ, রবীন্দ্রনাথের আগে আধুনিক বাঙালি চিন্তাবিদ সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া, আর কেউ ছিলেন না।
বঙ্কিমচন্দ্র কেবল ঔপন্যাসিক বা প্রাবন্ধিক নন, এক গভীর চিন্তক। ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর একটি নিজস্ব দর্শন ছিল। হিন্দুত্বে আস্থা রেখেও, সে দর্শন গভীর ও ব্যাপক। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই হিন্দুত্বও নিছক কোনও দেবতার জয়ধ্বনি নয়, কোনও সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসটির কারণে বঙ্কিমচন্দ্রকে সঙ্কীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রকট মূর্তি হিসেবে দেখার একটা ‘ট্র্যাডিশন’ আজও সমানে চলছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তা তার চেয়েও বড় কিছু। বস্তুত, ভারতীয় ইতিহাসে বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তার অন্যতম স্রষ্টা। সে জাতীয়তার বোধ যতটা হিন্দু, তার চেয়েও বেশি আর্য। যে কোনও জাতীয়তারই মূলে থাকে গোষ্ঠীচেতনা, বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়তারও ছিল। আর তার প্রধান নির্ভর ছিল বাঙালি ও বাংলা ভাষা। আরও বিশদে বললে, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির গোষ্ঠীকে ভর এবং লক্ষ করেই ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তার বোধ তৈরি করতে চেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। সফল কতটা হয়েছিলেন, সে বিচার ইতিহাস করবে। কিন্তু এ কথা মনে রাখা ভাল, যে ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই দ্বিতীয়ার্ধে ভারতবর্ষে বাঙালির এই কোণঠাসা অবস্থা হয়নি। তখনও বাংলার ভাবনা আর সমগ্র ভারতের ভাবনার মধ্যে আজ আর কালের তফাত ছিল।
বঙ্কিমের ইতিহাস-চিন্তা তাই রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রথমশিক্ষা বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১২৮১) বইটির সমালোচনা-সূত্রে প্রকাশিত হয় বঙ্কিম সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। ওই সমালোচনায় বঙ্কিম লিখেছিলেন,
“সাহেবেরা যদি পাখী মারিতে যান, তাহারও ইতিহাস লিখিত হয়, কিন্তু বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। গ্রীন্লণ্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে, মাওরি জাতির ইতিহাসও আছে, কিন্তু যে দেশে গৌড়, তাম্রলিপ্তি, সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, যেখানে নৈষধচরিত, গীতগোবিন্দ লিখিত হইয়াছে, যে দেশ উদয়নাচার্য্য, রঘুনাথ শিরোমণি ও চৈতন্যদেবের জন্মভূমি, সে দেশের ইতিহাস নাই। মার্শমান্, স্টুয়ার্ট্ প্রভৃতি প্রণীত পুস্তকগুলিকে আমরা সাধ করিয়া ইতিহাস বলি; সে কেবল সাধ-পুরাণ মাত্র।”
কিন্তু শুধু ইতিহাসের জন্য ইতিহাস নয়,
“অহঙ্কার অনেক স্থলে মনুষ্যের উপকারী; এখানেও তাই। জাতীয় গর্ব্বের কারণ লৌকিক ইতিহাসের সৃষ্টি বা উন্নতি; ইতিহাস সামাজিক বিজ্ঞানের এবং সামাজিক উচ্চাশয়ের একটি মূল। ইতিহাসবিহীন জাতির দুঃখ অসীম। এমন দুই একজন হতভাগ্য আছে যে, পিতৃপিতামহের নাম জানে না; এবং এমন দুই এক হতভাগ্য জাতি আছে যে, কীর্ত্তিমন্ত পূর্ব্বপুরুষগণের কীর্ত্তি অবগত নহে। সেই হতভাগ্য জাতিদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য বাঙ্গালী।”
ইতিহাস, অনেক জায়গায় আবেগ এবং কিছুটা অনৈতিহাসিকতা-মিশ্রিত ইতিহাসও তাই বঙ্কিমসাহিত্যের প্রধান অবলম্বন। বাংলা উপন্যাসের জন্মও তাই হল ইতিহাসের হাত ধরে, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে, বিষ্ণুপুর থেকে মান্দারনের পথে। নির্জীব, এলানো বাংলা ভাষার প্রবাহকে ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়ে শুরু হল ‘দুর্গেশনন্দিনী’, বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক উপন্যাস,
“৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। দিনমণি অস্তাচলগমনোদ্যোগী দেখিয়া অশ্বারোহী দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। কেন না, সম্মুখে প্রকাণ্ড প্রান্তর; কি জানি, যদি কালধর্মে প্রদোষকালে প্রবল ঝটিকা বৃষ্টি আরম্ভ হয়, তবে সেই প্রান্তরে, নিরাশ্রয়ে যৎপরোনাস্তি পীড়িত হইতে হইবে। প্রান্তর পার হইতে না হইতেই সূর্যাস্ত হইল; ক্রমে নৈশ গগন নীলনীরদমালায় আবৃত হইতে লাগিল। নিশারম্ভেই এমন ঘোরতর অন্ধকার দিগন্তসংস্থিত হইল যে, অশ্বচালনা অতি কঠিন বোধ হইতে লাগিল। পান্থ কেবল বিদ্যুদ্দীপ্তিপ্রদর্শিত পথে কোন মতে চলিতে লাগিলেন।”
বাংলা ভাষার এই দীপ্তি দেড়শো বছরেরও বেশি আগে সম্ভব হয়েছিল। নিছক উপন্যাস লেখার জন্য উপন্যাস লিখলে তা সম্ভব হত বলে মনে হয় না। বঙ্কিমচন্দ্র সে পথে যাননি। বাংলা ভাষাকে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার প্রকাশযোগ্যতাকে বিস্তার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিস্তারকে আমরা মনে রাখিনি। ‘সাহিত্যসম্রাট’ তকমা লাগিয়ে আদর করে শিকেয় তুলে রেখেছি বঙ্কিম রচনাবলিকে। আর, প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেছি তাঁকে। ব্যবহার করার সময়, নিজেদের স্বার্থেই মনে রাখিনি সমগ্র বঙ্কিমকে। ‘আনন্দ মঠ’-এর প্রথম দিককার সংস্করণগুলি উল্টে দেখিনি, দেখলে চোখে পড়ত, সেখানে সন্তানদলের প্রতিপক্ষ ইংরেজ। ভাল করে তাঁর প্রবন্ধগুলি পড়িনি। পড়লে খুঁজে পেতাম এই বঙ্কিমকেও, যিনি বলছেন, ‘মনুষ্যজাতিমধ্যে কাহারই বহুবিবাহে অধিকার নীতিসঙ্গত হইতে পারে না’। এর সঙ্গে যোগ করছেন পাদটীকা,
“কদাচিৎ হইতে পারে বোধ হয়। যথা অপুত্রক রাজা, অথবা যাহার ভার্যা কুষ্ঠাদি রোগগ্রস্ত। বোধ হয় বলিতেছি, কেন না, ইহা স্বীকার করিলে পুরুষের বিপক্ষেও সেইরূপ ব্যবস্থা করিতে হয়।”
আর যেহেতু আমরা বঙ্কিমচন্দ্র কে জানার বা বোঝার কোনও চেষ্টাই করি নি, তাই তাঁর সম্বন্ধে সিংহভাগ তথ্যই আমাদের অজানা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন সম্পর্কে আমরা যতটা আগ্রহী, তার সিকি ভাগও আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন সম্পর্কে নয়, তাঁকে আমরা ‘সাহিত্য সম্রাটের’ শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছি আর সেই ভাবেই রেখে দিয়েছি। অথচ তাঁর জীবনও কম বর্নময় নয়।
অদ্ভুত এক ছেলেবেলা ছিল তাঁর। তাঁর ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি। শোনা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার আগে পাঠ্যপুস্তকের খোঁজ পড়ত। এক দিনে এক একটা গোটা বই পড়ে ফেলতে পারতেন! কাঁটালপাড়ার বাড়ির কাছেই ছিল তাঁর পিতা যাদবচন্দ্রের পাঠশালা। বঙ্কিম অবশ্য পাঠশালায় যেতেন না, গুরুমশাই আসতেন বাড়িতে। পাঁচ বছর বয়েসে বঙ্কিমের হাতেখড়ি হয় গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকারের কাছে। গুরুমশাই বুঝেছিলেন, মেধাবী ছাত্র বঙ্কিম যে দ্রুততার সঙ্গে পাঠ নিচ্ছে, তাতে তাঁরর কাজ আর বেশি দিন থাকবে না। এ’ও শোনা যায়, শিশু বঙ্কিম নাকি একদিনেই আস্ত বর্ণপরিচয় শেষ করে ফেলেছিল!
পড়াশুনোয় ভাল তো বটেই, সঙ্গে তাঁর আত্মসম্মানবোধও ছিল প্রখর।
আসা যাক তেমনই একটি ঘটন়ায়।
বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা যাদবচন্দ্র যখন মেদিনীপুরের ডেপুটি কালেক্টর, বঙ্কিম বছর চার-পাঁচ টানা বাবার কাছে যেতেন, আসতেন। ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে যাদবচন্দ্রের বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। মাঝেমধ্যে সাহেবের বাংলোয় যেতেন তিনি। সঙ্গে যেতেন বঙ্কিমও। সেখানে সমবয়েসিদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন বঙ্কিম। এক দিন ম্যাজিস্ট্রেটের অন্দর থেকে চা-পানের ডাক এল। তাতে গেলেন কেবল সাহেবের ছেলেমেয়েরা। বঙ্কিম বাদ পড়লেন। ঘটনাটি খুব মানে লেগেছিল তাঁর। অপমানে তারপর থেকে আর যাননি সে-বাংলোয়।
মাথার ওপর তেমন শক্ত কোনও অভিভাবক বঙ্কিমচন্দ্রের বহিল না। পিতা কর্মসূত্রে থাকতেন দূরে। মা ছিলেন অতিরিক্ত স্নেহকাতর। ফলে যা হবার, তাই-ই হল। বাইরের কোনও খেলাতেই তেমন মন ছিল না তাঁর। নেশা ধরল তাস-এ। সঙ্গী জুটিয়ে নিতেন নিজেই। ফুরসত পেলেই তাস খেলতে বসে পড়তেন।
তিনি না জানতেন সাঁতার, না ঘোড়ায় চড়া। তার মধ্যেই এক উদ্ভট ঘটনা বাধিয়ে বসলেন। লোক ডেকে কী এক খেয়ালে নিজের দাদার সাধের ঘোড়াটাকে দিলেন বেচে!
কৈশোরে দাদাদের সঙ্গে বসে একসঙ্গে ধূমপান করতেন। দাদারাও তেমন, কেউই আপত্তি করতেন না। বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে আড্ডা বসত নিয়ম করে। ওখান থেকেই তামাকু সেবনের শুরু করেন তিনি। সেই আড্ডাতে যে সবাই মোটেও সাধু গোছের সঙ্গী ছিল না। বরং বখাটে ছেলেপুলে জুটিয়ে নিয়ে আড্ডা দেওয়া ছিল তাঁর মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রের দস্তুর। অদ্ভুত বিষয় হল, সেই কাঁচা বয়সেও দাদার এই ব্যাপারটি কিন্তু তেমন ভাল মনে নেননি বঙ্কিম! বঙ্কিম দেখতেন, ধীরে ধীরে উচ্ছন্নে যেতে বসেছে তাঁর দাদাটি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সঞ্জীব পরীক্ষার দিনেও কলেজমুখো না হয়ে দাবা খেলে খেলে দিন কাটিয়েছেন, এমনও হয়েছে। এ নিয়ে বঙ্কিমের প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। রাগের চোটে দাদার এই আড্ডাধারীদের তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘বানর সম্প্রদায়’।
দাদাদের সঙ্গে তিনি আড্ডায় বসতেন বটে, কিন্তু এই ভিড়ের বাইরে ছোট থেকেই বঙ্কিমের একটি নিজের জগৎও ছিল।
পড়াশুনোতে ধারালো ছিলেন কলেজেও। ভাল ফল করতেন। বৃত্তিও পেতেন। বৃত্তির টাকায় তিনি নিজে বাড়িতে একটা ছোট বাগান বানিয়েছিলেন। চাটুজ্জে পরিবারের ছিল অনেক পুকুর। তার এক-একটির নাম ছিল এক এক রকম — অর্জুনা, ভীমা, ঠাকুরপুকুর, সরের পুকুর ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে পদ্মপাতায় ঢাকা পদ্মফুলের শোভায় মোড়া অর্জুনার কদরই ছিল বেশি। অর্জুনার চার পাশে ছিল আমবাগান। বঙ্কিমচন্দ্রের দাদা শ্যামাচরণ খুব যত্ন করে গড়ে তুলেছিলেন জায়গাটিকে। এই অর্জুনার ধারেই একটি ছোট বাগান তৈরি করেছিলেন বঙ্কিম। কলেজের মালিকে ডেকে নানা রকম ফুলের চারা লাগিয়েছিলেন। অবসর পেলে মাঝে মাঝেই পুকুর ধারের এই ঘাসজমিতে পায়চারি করতেন বঙ্কিম। নয়তো অর্জুনা-বাগানে একাকী বসে থাকতেন। নির্জনতা ছিল এতই প্রিয়! এক এক সময় নিজেকে নিয়েই থাকতে ভালবাসতেন।
১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তার এক বছর পরেই শুরু হল বিএ পরীক্ষা। সিলেবাস ছিল বেশ কঠিন। পরীক্ষা দিলেন তেরো জন। ডিগ্রি পেলেন মাত্র দু’জন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর যদুনাথ বসু। তবে ষষ্ঠ পত্রে এঁদেরও পাশ নম্বরে ঘাটতি ছিল। ৭ নম্বর ‘গ্রেস’ দেওয়া হল দু’জনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য জে ডবলিউ কোলভিল কৃতী ছাত্র দু’জনকে সমাবর্তনে উপস্থিত করলেন বিশেষ পোশাকে। ১৮৫৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর শনিবার টাউন হলে সমারোহ করে অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে প্রথম গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পেলেন দুই বাঙালি। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ঘটনাটি ফলাও করে লিখলেন। তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। আসলে এই কৃতীদের একজন যে অল্প বয়েসে তাঁর পত্রিকায় কবিতা লিখতেন! যাঁর ছিল নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
শুধু ইস্কুল-কলেজের ভাল ছাত্র বলে নয়, পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বঙ্কিম বরাবরই ভাল পড়ুয়া ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলেজ-বইয়ের তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় রাশি রাশি বই তখন ছাত্রদের পড়তে হতো। চসার, স্পেন্সার, শেক্সপিয়র, স্কট, শেলি, বায়রন, মিলটন, টেনিসনের পাশাপাশি কালিদাস, ভারবি, বাণভট্ট…! বঙ্কিমকেও এ সব পড়তে হয়েছে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের চেয়ে বাইরের বই পড়াতেই যেন তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। নৈহাটির ভাটপাড়ার জয়রাম ন্যায়ভূষণের কাছে বসে বঙ্কিম রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, শকুন্তলা পড়েছিলেন। তাঁর দাদা সঞ্জীবচন্দ্রর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও প্রচুর ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের বই ছিল। সে গুলি আসত সে কালের প্রসিদ্ধ ‘থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি’ থেকে। সে সবের মধ্যেও ছিল বঙ্কিমের নিরন্তর বিচরণ।
কাঁটালপাড়ার দক্ষিণে হাঁটাপথে চার কিলোমিটার গেলেই ছিল নারায়ণপুর। সমৃদ্ধ গ্রাম। গ্রামের এক গৃহস্থ-কর্তা ছিলেন নবকুমার চক্রবর্তী। তাঁর পাঁচ বছরের কন্যার নাম ছিল মোহিনী। মোহিনী ছিলেন রূপসী। তাঁকে পছন্দ করে ভাই বঙ্কিমের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন বড়দা শ্যামাচরণ। বিয়েতে বাপের বাড়ি থেকে মোহিনী পেয়েছিলেন অনেক গহনা। বঙ্কিমের পিতা যাদবচন্দ্রও পুত্রবধূকে অলঙ্কারে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। দিন যেতে না যেতেই বালিকা বধূ মোহিনী হয়ে উঠেছিলেন শ্বশুরবাড়ির সকলেরই স্নেহের পাত্রী। বঙ্কিম তখন কলেজ-পড়ুয়াও হন নি। তাঁর বয়স সবে দশ পেরিয়েছিল। পরীক্ষায় ভাল ফল করে অর্জিত বৃত্তির টাকা ছিল বঙ্কিমের একমাত্র উপার্জন। সেই বৃত্তির টাকায় যেমন বাগান করেছিলেন, তেমন স্ত্রী মোহিনীকে ওই টাকা থেকেই দিতেন নানান উপহার। তার মধ্যে অলঙ্কারও ছিল, দুটি কানের দুল আর সোনার একটি চুলের কাঁটা স্ত্রী কে কিনে দিয়েছিলেন তিনি। মোহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গোড়ার থেকেই নিবিড় ছিল। কিন্তু তা শুধু যে উপহার দেওয়া-নেওয়ার মতো সোহাগে-আহ্লাদে মোড়া ছিল, তা নয়। নতুন কিছু লেখা হলে এই মোহিনীই হতেন বঙ্কিমের প্রথম শ্রোতা। সারাক্ষণ মোহিনীকে যেন চোখে হারাতেন বঙ্কিম। মোহিনী মাঝে মধ্যে নারায়ণপুরে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতেন। বঙ্কিমের তখন কিছুতেই বাড়িতে মন বসত না। লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে সোজা চলে যেতেন নারায়ণপুর। শুধু মোহিনীর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য। তাঁকে চোখের দেখা দেখতে পাবেন বলে। মাঝে মাঝে রাতও কাটাতেন শ্বশুরালয়ে। ভোরে ফিরে আসতেন কোনও এক সময়। এই ঘটনাক্রমের বর্ণনা এক জায়গায় পাওয়া যায় —
‘‘… (বঙ্কিম) বাড়িতে উপস্থিত হইয়া পড়িতে বসিতেন। সঞ্জীবচন্দ্র বঙ্কিমকে পড়িতে দেখিয়া (রাত্রে) শুইতে যাইতেন। আর ভোরে আসিয়াও পাঠ নিমগ্ন দেখিতেন। আশ্চর্য হইয়া তিনি প্রায়ই জিজ্ঞাসা করিতেন—বঙ্কিম কি সারারাত জেগে পড়েছে?’’
মোহিনী-বঙ্কিমের এমন ঘন মধুর সম্পর্কের করুণ পরিণতি হয়েছিল! বঙ্কিম চাকরি নিয়ে তখন যশোরে রয়েছেন। সেই প্রথম দীর্ঘদিন স্ত্রীকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা তাঁকে অসম্ভব পীড়ায় রেখেছিল। একলা প্রবাস-জীবন বছর খানেক এ ভাবে চলছিল। শেষে আর থাকতে না পেরে ঠিক করলেন, যাই-ই হোক, এ বার মোহিনীকে তিনি নিয়ে আসবেন। চিঠি লিখলেন প্রাণপ্রিয়াকে। চিঠি পেয়ে মোহিনী উৎফুল্ল হলেন। বাড়ির সবাইকে স্বামীর দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন। নিজের সংসার পাতার আনন্দে তিনি তখন বিভোর। গুরুজনরাও মত দিলেন যশোরে যাওয়ার। ধীরে ধীরে যাবার দিন গড়িয়ে আসছিল। মোহিনী আনন্দে উত্তেজনায় হাওয়ার গায়ে ভাসছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন বিধাতা নিজে। মোহিনী’র সামান্য জ্বর হল। অসুখের খবর পেয়ে বঙ্কিম রওনা দিলেন যশোর থেকে। কিন্তু তিনি বাড়ি পৌঁছবার আগেই সব শেষ হয়ে গেল! বাবা আর দাদার কাছ থেকে তিনি খবর পেলেন মোহিনী আর নেই! মাত্র ষোলো বছর বয়সে এ পৃথিবীর যাবতীয় মায়াবন্ধন কাটিয়ে তিনি তখন দূর নক্ষত্রের কোলে ঠাঁই নিয়েছেন! শোকস্তব্ধ বঙ্কিম বাড়ি আর গেলেন না, মাঝপথ থেকেই ফিরে গেলেন। এর পর দীর্ঘদিন তিনি কাঁটালপাড়ার বাড়িতেই যাননি। শুধু দাদা সঞ্জীবচন্দ্রকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, মোহিনীকে উপহার দেওয়া সেই দুটি কানের দুল আর চুলের সোনার কাঁটাটি যেন তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মোহিনীর মতোই আরেকটি মৃত্যু বঙ্কিমকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। সেটা অবশ্য বেশ কিছু কাল পরে। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের বিয়েরও অনেক পরে। কিন্তু সেই মৃত্যুশোকও ছিল পাহাড়সম। সে বারে ছিলেন হৃদ্নন্দিনী স্ত্রী, আর এবারে সন্তান!
‘পলা’। বঙ্কিমচন্দ্রের আদরের ছোট মেয়ে। ভাল নাম ছিল ‘উৎপলকুমারী’। তাঁর স্বামীর নাম ছিল মতীন্দ্র। মতীন্দ্রর ছিল চরিত্রের দোষ। থিয়েটার পাড়ায় নটীদের বাড়িতে রাতদিন পড়ে থাকা ছিল তাঁর নেশা। ফুর্তির জন্য পলার কাছে একদিন তিনি পলার মায়ের দেওয়া গয়নাও চেয়ে বসেন। পলা দিতে রাজি হননি। আর তারপরই ক্ষিপ্ত মতীন্দ্র স্ত্রীকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেন। শোনা যায়, ওষুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে তাঁকে মেরে ফেলেন স্বামী। এরপর পলার মৃত শরীর ঝুলিয়ে দেন কড়ি-বর্গার গায়ে। এই কুকর্মে তাঁকে সাহায্য করেছিল তাঁর পাড়ার বিনোদডাক্তার। এর পর থানা পুলিশ। ময়না তদন্ত।
প্রশ্ন উঠল এটা হত্যা, না আত্মহত্যা? ডাক্তারি রিপোর্টে প্রমাণ মিলল যে ঘটনাটি খুন! শুরু হল মামলা।
আদালতের বিচারে মতীন্দ্রর প্রাণদণ্ডের রায় বেরনো যখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, আশ্চর্যজনক ভাবে সওয়ালে নীরব থাকলেন দুঁদে আইনজ্ঞ বঙ্কিমচন্দ্র! প্রাণে বেঁচে গেলেন মতীন্দ্র। কিন্তু কেন মতীন্দ্রকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্কিম? এই প্রশ্নের উত্তর আজও কারও জানা নেই। এ ঘটনা কি বঙ্কিমের কোমল মনের কিংবা ক্ষমা-প্রবণতার পরিচয় দেয়? শোনা যায়, বৃদ্ধ ঠাকুর্দার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন ছিলেন মতীন্দ্র। তাঁর অনুরোধেই নাকি বঙ্কিম মেয়ের হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেন।
তখন চুঁচুড়ার ষাঁড়েশ্বরতলায় প্রতিবছর বৈশাখ মাসে খুব জাঁকজমক করে মেলা বসত। মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হত। তখন বঙ্কিম চুঁচুড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে বহাল। মেলা চলাকালীন এক দিন তিনি গঙ্গার তীরে বেড়াতে বেড়াতে দেখলেন একটি ছোট নৌকায় অনেক যাত্রী নিয়ে মাঝি গঙ্গা পার হচ্ছে। বঙ্কিম মাঝিকে বারণ করলেন। এ ভাবে ঠাস বোঝাই করা যাত্রী নিয়ে পারাপার ঠিক নয়। না মানলে পুলিশের ভয় দেখালেন। কিন্তু তাতেও মাঝি শুনল না। বঙ্কিমের চোখের সামনে যাত্রীসুদ্ধ নৌকা মাঝগঙ্গায় ডুবে গেল। মাঝি রক্ষা পেয়ে গেল। বিচারে তাকে তিন মাসের জেল-বন্দির সাজা দিয়েছিলেন বঙ্কিম। এ দিকে সাজা ভোগ করতে করতে জেলখানাতেই মাঝি মারা যায়। তাঁর মৃত্যুর কথা কানে গিয়েছিল বঙ্কিমের। তার পর, তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে মাঝির বিধবা স্ত্রীর জন্য আজীবন মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
এমনিতে স্বভাবে সংযমী, স্পর্শকাতর, নম্র হলেও তাঁর শরীরে রাগ যে কম ছিল, তা নয়। রেগে গেলে নাকি চুল ছিঁড়তেন বঙ্কিম। অপছন্দের কিছু ঘটলে সহজে কাউকে ছাড়তেন না, সে অন্যের কাছে যতই তুচ্ছ ঘটনা মনে হোক।
বঙ্কিমের প্রিয় হারমোনিয়ামে হাত দেওয়ার জন্য একবার ভাইপো জ্যোতিশ্চন্দ্র বেধড়ক বকুনি খেয়েছিলেন কাকার কাছে। হারমোনিয়াম বাজানোয় সিদ্ধহস্ত বঙ্কিম সইতে পারেননি তাঁর প্রিয় যন্ত্রটির প্রতি এই অনধিকার চর্চা।
সঞ্জীবচন্দ্রর একমাত্র ছেলে জ্যোতিশ্চন্দ্রকে বঙ্কিম নিজের ছেলের মতো মানুষ দেখতেন। জ্যোতিশ্চন্দ্র পড়াশুনোয় একেবারেই ভাল ছিলেন না। প্রবেশিকা পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করেছিলেন। বাড়িতে বসে বড়দের সঙ্গে তাস খেলে, আড্ডা দিয়েই দিন কাটাতেন। তাঁর মতিগতি ছিল অনেকটাই তাঁর বাবার ধাঁচে গড়া। জ্যোতিশ্চন্দ্রের বিয়ের ঠিক হয়েছিল রাজা নন্দকুমারের বংশধরের পরিবারে। পাত্রের বয়স তখন মাত্র চোদ্দো বছর। পাত্রী মোতিরানী ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। রাজ পরিবারে বিয়ে। তাই ধুমধাম তো করতেই হবে। এমনিতেই তখন সঞ্জীবচন্দ্রের ঋণজর্জর অবস্থা। তা সত্ত্বেও ছেলের বিয়ে দিতে আরও ঋণ নিয়েছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র। এলাহী আয়োজন হয়েছিল। ধুমধাম ঘটার যেন সীমা ছিল না। কাঁটালপা়ড়া থেকে হাতির পিঠে চাপিয়ে বরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সালকিয়ার শ্বশুরবাড়ি তে। পুরো ব্যাপারটিতে বেজায় চটেছিলেন বঙ্কিম। বিয়ের জন্য আবার টাকা ধার চাইতে গেলে প্রচণ্ড রেগে যান তিনি। কড়া ভাষায় দাদাকে বলেছিলেন, ‘‘যে ঋণ পরিশোধ করিতে পারিবেন না মনে জানিয়াছেন, তাহা গ্রহণ করা পরকে ফাঁকি দিয়া টাকা লওয়া হয়।’’
বঙ্কিমের বড়দাদা শ্যামচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে শচীশচন্দ্রের বিয়ের সময়ের একটি ঘটনার কথাও জানা যায়। শচীশচন্দ্রের বিয়ে ঠিক হয়েছিল সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের সঙ্গে। পাত্রীর নাম ছিল সুরেশ্বরী। ভাইপো পাইকপাড়ার জমিদারদের কাছ থেকে পোশাক ধার করে একেবারে রাজপুত্র সেজে এসেছিলেন। বিয়েবাড়িতে রাজবেশে বর নামছেন। বিবাহে উপস্থিত ছিলেন পন্ডিত বিদ্যাসাগর নিজে। বিদ্যাসাগর বরের হাত ধরতে গেলেন। তাতে রাজপোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে মনে করে শচীশচন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। থতমত খেয়ে বিদ্যাসাগর চকিতে পিছু হটলেন। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভাইপোর এমন আচরণ দেখে তিনি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছিলেন! কড়া গলায় বলেছিলেন — ‘‘তুমি জানো ইনি কে? ইনি বিদ্যাসাগর! এক্ষুনি ক্ষমা চাও।’’ সেখানেই মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন শচীশচন্দ্র।
তবে রাগান্বিত বঙ্কিমের যত ঘটনার কথা জানা যায়, সেগুলো সবই প্রায় তাঁর পরিবারের লোকজনকে ঘিরে। বাইরের মানুষের কাছে তিনি প্রায় বিপরীত ছিলেন।
তবে নিজের বিশ্বাস জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি সচরাচর পিছু হটেননি। ছিলেন অকুতোভয়ও। সে ঘরেও যেমন, তেমন বাইরেও। আর আপস? তা বোধহয় বঙ্কিমের ধাতে ছিল না। এমন লৌহমনা বঙ্কিমের পরিচয় নিতে তাঁর চাকরি জীবনে তাকানো যেতে পারে।
বঙ্কিম তখন খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট। এক নীলকর সাহেব হাতির শুঁড়ে মশাল বেঁধে একটা আস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেন। তখনও বেঙ্গল পুলিশের সৃষ্টি হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে পুলিশ কাজ করত। দারোগারা কোনও ভাবে সাহেবকে ধরতে পারল না। তার কারণ, সাহেবের কাছে সব সময় গুলি ভরা পিস্তল থাকে। কিন্তু বঙ্কিম পিস্তলের তোয়াক্কা না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সাহেবকে ঠিক গ্রেফতার করেছিলেন।
আরেকটি ঘটনার কথা জানা যায়। তখন বঙ্কিমচন্দ্র যশোরে। সেখানে তিনি পঞ্চম শ্রেণির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। উল্লেখ্য যে, পঞ্চম শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণি অবধি উঠতে তাঁর লেগেছিল দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর। মাঝে কিছু দিনের জন্য পেয়েছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদ। তবে দ্রুতই সেই পদটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। বঙ্কিম ফিরে যান বা ফিরে যেতে বাধ্য হন ডেপুটির পদে। এর কারণ ছিল তাঁর লেখা উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’! বঙ্গদর্শন-এ উপন্যাসটি বেরনোর সময় প্রকাশ বন্ধর হুকুম জারি হয়। বঙ্কিম সেটা মানেননি। আবার এই অবজ্ঞার কারণে তাঁর মতো দক্ষ অফিসারকে পদচ্যুত করা, সে’ও কঠিন কাজ ছিল! তাহলে উপায় কি? পদটিই লুপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল।
বঙ্কিম অবশ্য তাতেও নিস্তার পাননি। ক্রমাগত তাঁকে বদলির চক্করে ফেলে হয়রান করা হয়েছিল। তাঁকে বছরে দু’তিন বার করে বদলি করা হত। কখনও আলিপুর বা বারাসাত, তো আবার কখনও জাজপুর বা ভদ্রকে। কর্তৃপক্ষের এমন আচরণে বিরক্ত হয়ে শেষে স্বেচ্ছা-অবসর নিয়ে নেন বঙ্কিমচন্দ্র। সভাসমিতিতেও বিশেষ যেতেন না। তিনি ভীষণ রাশভারী মানুষ ছিলেন। বলতেন, ‘‘যে সময় বৃথা সভাসমিতিতে কাটাব, সে সময়টা বসে লিখলে কাজ দেবে।’’
বঙ্কিমচন্দ্র দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন হালিশহরের সীতারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা রাজলক্ষ্মীকে। সেটা তাঁর প্রথম স্ত্রী মোহিনী মারা যাওয়ার আট মাস পরে। রাজলক্ষ্মীও গুণবতী এবং সুন্দরী ছিলেন। বিয়ের চার বছর পরে তাঁদের প্রথম সন্তান শরৎকুমারীর জন্ম হয়। এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। মোহিনীদেবীর সেই যে দুল, কাঁটা — ও দু’টি বঙ্কিম বহুকাল রাজলক্ষ্মীকে দিতে পারেননি। অন্য অনেক অলঙ্কার দিলেও মোহিনীকে দেওয়া গহনা কিছুতেই তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী কে দেন নি। নববধূ রাজলক্ষ্মীকে বলেছিলেন, ‘‘এগুলি এখন আমার কাছেই রইল। যে দিন তোমায় ভালবাসিব, সে দিন দিব।’’ শরৎকুমারীর জন্মের তিন মাস পর সেই অলঙ্কার রাজলক্ষ্মীর হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন বঙ্কিম। সে তুলে দেওয়ার মধ্যে সে এক অপূর্ব প্রেমাতুর ভঙ্গি ছিল! নৌকায় পাড়ি দিতে দিতে নিজে হাতে স্ত্রীর কানে দুল আর চুলে কাঁটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বঙ্কিম বড় চাকরি করতেন, কিন্তু ধনী ছিলেন না। এর মূল কারণ ছিল একান্নবর্তী পরিবার। ভাইদের সংসারও বঙ্কিমকে সামলাতে হতো। মেজদাদা সঞ্জীবের সংসারের পুরো দায়িত্বই ছিল বঙ্কিমের ওপর। সঙ্গে পরিজনদের চিকিৎসা, অন্নবস্ত্র, সব কিছুর কথাই ভাবতে হতো তাঁকে।
স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দিনে দিনে যে কেবল চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ‘কল্যাণস্বরূপা’ হয়ে উঠেছিলেন, তা নয়, বঙ্কিমের সাহিত্যিক বন্ধুদের কাছেও ছিল তাঁর অসীম গুরুত্ব। তাঁদের আপ্যায়নও তাঁকেই করতে হত। স্বভাবগম্ভীর রাজলক্ষ্মী ভাল রান্না জানতেন। অতিথি এলে রাজলক্ষ্মীর হাতের রান্না না খাইয়ে বঙ্কিম পারতপক্ষে কাউকে ছাড়তেন না। বঙ্কিম ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর কাছে খরচপত্রের দায়দায়িত্বও তুলে দেন। এমনকী নিজে চিঠিপত্র লেখারও যখন সময় পেতেন না, লিখে দিতেন রাজলক্ষ্মীদেবী। বঙ্কিম কেবল সই করে দিতেন। রাজলক্ষ্মীর প্রতি তাঁর এত নির্ভরতা ছিল যে, তিনি বলতেন, ‘‘তিনি না থাকিলে আমি কী হইতাম, বলিতে পারি না।’’ রাজলক্ষ্মীর প্রতি এত টান, অথচ শেষ দিন পর্যন্ত মোহিনী যেন বঙ্কিমের অবচেতনে ডানা মেলে ভেসে বেড়াতেন তাঁরই গহীন অতলে। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুশয্যায় যখন অর্ধচেতন অবস্থা, তিনি যন্ত্রণায় কাতর, তখন রাজলক্ষ্মী নয়, বারবার বলেছিলেন একটিই নাম— মোহিনী, মোহিনী! বলেছিলেন, ‘‘আমি এ বার তার কাছে যাব।’’
এমনিতে স্বভাবে বঙ্কিম সংযমী ছিলেন। কিন্তু খাবার বেলায় মাংস খেতেন অপরিমিত। অল্পবিস্তর মদ্যপানও করতেন। চেষ্টা করেও যে মদ খাওয়া ছাড়তে পারেননি, তার জন্য অবশ্য তাঁর গ্লানিও ছিল। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, ডায়াবেটিক মানুষ মদ্যপান করলে শারীরিক সমস্যা বাড়ে। বঙ্কিমেরও বেড়েছিল। কিন্তু তাতেও তিনি সুরা ছাড়তে পারেননি। বঙ্কিমের বাড়িতে নিয়মিত পোর্ট ওয়াইন আসত। নিজে পরিমিত খেতেন, কিন্তু অন্যে অপরিমিত খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়লে সামালও দিতেন তিনি।
(তথ্যসূত্র:
১- বঙ্কিমচন্দ্র, সুনির্মল বসু, আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৯৬)।
২- বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুক্তদেশ প্রকাশন (২০১৬)।
৩- দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ (২০১২)।
৪- বঙ্কিমচন্দ্র সেই সময়ে, ভবতোষ দত্ত, দীপ প্রকাশন।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬শে নভেম্বর ২০১৬ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬শে জুন ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত