গ্যালারি ভর্তি দর্শক ছিল। মোহন–ইস্টের ঝগড়া ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতীয় দলকে সমর্থন ছিল। টিফো থেকে শুরু করে ভাইকিং ক্ল্যাপ সবই ছিল। কিন্তু ছিল না সুনীল ছেত্রীদের খেলায় সেই সাবলীল ছন্দ। আর তাই ঘরের মাঠে ফুটবলের মক্কায় ১–১ গোলেই ড্র হল ভারত–বাংলাদেশের ফুটবল ম্যাচ।
দোহায় বাছাই পর্বের ম্যাচে কাতারের বিরুদ্ধে ড্র করে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন উস্কে দিয়েছিল ভারতীয় ফুটবল দল। কিন্তু মঙ্গলবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে র্যাঙ্কিংয়ে প্রায় একশো ধাপ পিছনে থাকা বাংলাদেশের কাছে আটকে গিয়ে সেই স্বপ্নের সমাধি ঘটল। তিন ম্যাচে মাত্র দু’পয়েন্ট সংগ্রহ করে গ্রুপ-ই’র চতুর্থ স্থানে ভারত। ম্যাচ শেষে স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় সমর্থকদের আফশোসের রিংটোনেই কেটে গেল উৎসবের আবহ। ম্যাচের ৪২ মিনিটে গোলরক্ষক গুরপ্রীতের অমার্জনীয় ভুলে গোল হজম করে ভারত। জামালের ফ্রি-কিকের ফ্লাইট মিস করেন তিনি। অরক্ষিত সাদ উদ্দিনের হেড জালে জড়ায় (১-০)। বিরতির পরও স্টিম্যাচ-ব্রিগেডের পারফরম্যান্সে তেমন উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি। ৮৮ মিনিটে ব্রেন্ডনের কর্নার থেকে আদিল খানের হেডে মানরক্ষা হয় ভারতের (১-১)।
তবে কাতার ম্যাচের পরে ‘মহানায়ক’ হয়ে যাওয়া গুরপ্রীত সিংহ সাঁধুকে শেষ পর্যন্ত ‘খলনায়ক’ হয়ে মাঠ ছাড়তে হল না। তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল আদিল খানের অসাধারণ একটি হেড। খেলা শেষ হওয়ার দু’মিনিট আগে ব্র্যান্ডন ফার্নান্ডেজের কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে গোল করে ভারতের হার বাঁচালেন তিনি। পাশাপাশি নিজেদের গোললাইনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের একটি নিশ্চিত গোলও রুখলেন গোয়ার এই ডিফেন্ডার।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৬৩ হাজার দর্শক খেলা দেখতে এসেছিলেন এ দিন। প্রথমার্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পিছিয়ে গিয়েও শেষ মুহূর্তে সমতায় ফেরা ভারতের। জিততে না পারার দুঃখ ছিলই যুবভারতীতে এ দিন খেলা দেখতে আসা দর্শকদের। কিন্তু তা সত্ত্বেও ম্যাচের পরে ‘ভাইকিং ক্ল্যাপ’ দিয়ে সুনীল ছেত্রীদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন তাঁরা। সাংবাদিক সম্মেলনে যে ঘটনার কথা উল্লেখ করে ভারতীয় কোচ ইগরও কলকাতার দর্শকদের এই সমর্থন নিয়ে আপ্লুত। বললেন, ‘‘দারুণ দর্শক। ভুলতে পারব না ওঁদের। এ রকম সমর্থন! সত্যিই হৃদয় নাড়া দিয়ে গেল। জীবনে অনেক বড় ম্যাচ বড় স্টেডিয়ামে খেলেছি। কিন্তু কলকাতার এই স্টেডিয়াম ও সমর্থকেরা হৃদয়ে থেকে যাবেন।’
ভারতের খেলা দেখতে এ দিন সুনীল ছেত্রীর এগারো নম্বর জার্সি পরে ভারতের আট থেকে আটান্নর ফুটবলপ্রেমীরা এ ভাবেই স্টেডিয়াম ভরিয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে বাদ যাননি মহিলা ও শিশুরাও। গোটা স্টেডিয়াম মোড়া ছিল তেরঙ্গা পতাকা দিয়ে। খেলা শুরুর আগে দুই নম্বর গেটের দিকের গ্যালারিতে বড়সড় একটা টিফোও (বিশাল কাপড়ের ব্যানার) দেখা গেল। যেখানে সবুজ-মেরুন, লাল-হলুদ, সাদা-কালো জার্সি গায়ে তিন খেলোয়াড়ের প্রতিকৃতি। নেপথ্যে বার্তাটা স্পষ্ট— জাতীয় দলের ম্যাচে আজ আর কোনও ক্লাবতুতো বিভেদ নয়। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান সকলেই আজ মিলেমিশে একাকার। কিন্তু খেলা শেষে সবাই মুখ কালো করেই বাড়ি ফিরলেন। দুঃখ একটাই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জেতা হল না।
অন্য দিকে, তখন যুবভারতীর পাঁচ নম্বর গেটের দিকের গ্যালারিতে শুরু হয়ে গিয়েছে উৎসব। সেখানে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে হাজির ছিলেন শ’দুয়েক সমর্থক। এদেরই একজন মহম্মদ মাহবুবুর রহমান। বাংলাদেশে জ়ামাল ভুঁইয়ার ক্লাব সইফ স্পোর্টিং ক্লাবের সচিব। সকালবেলা ঢাকা থেকে পঁচিশ জনের বিশাল দল নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। বিয়াল্লিশ মিনিটে সাদ উদ্দিনের গোলে যখন বাংলাদেশ এগিয়ে গেল তখন লাফিয়ে উঠে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় মুখ ঢেকে আবেগে কেঁদেই ফেলেছিলেন। গর্ব করে বলছিলেন, ‘‘আমার ক্লাবের ফুটবলার জ়ামাল দলের অধিনায়ক। আর ওর ফ্রি-কিক থেকেই গোল করল সাদ। দারুণ আনন্দ হচ্ছে।’’