মাথার ওপরে ড্রোন, নিচে ক্যামেরা-মোবাইল-ল্যাপটপ-ট্যাবে লাগাতার ডিজিটাল তৎপরতা এভাবেই আকাশ আর মাটিকে একাকার করে দিল কলকাতার পুজো কার্নিভাল। শহরের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সমারোহ এই কার্নিভালে শনিবার উপস্থিত হয়েছিলেন ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, টানজানিয়া, ফিজি, সুদান, ভুটান থেকে শহরে আসা বিদেশি অতিথিরা। দূতাবাসগুলির লোকজনেরা তো ছিলেনই। ভাবনা ও প্রয়োগের এই বিস্ফোরণ, সমন্বয় ও শৃঙ্খলার এত নিখুঁত আয়োজন শহর এর আগে কোন দিন দেখেনি। অনেকে আমাকে অতি কথনের দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেন, তবু আমি বলব গোয়ার বহু বিজ্ঞাপিত কার্নিভাল তো বটেই বিদেশের বহু কার্নিভাল দর্শক সমাগম ও বৈচিত্রে এর ধারেকাছে আসতে পারবে না।
আকারে প্রকারে বর্ণে বৈচিত্রে চার বছরে এই আয়োজন এতটা বাড়ার সুবাদে বিদেশি ট্যুর অপারেটর এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত পরম্পরা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা কলকাতা কার্নিভাল সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাদের অনেকে কার্নিভালে হাজিরও ছিলেন। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তো কলকাতার দুর্গোৎসব সহ এই কার্নিভালকে হেরিটেজ ট্যুরিজমের আওতায় আনতে চাইছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজ হোক বা কাল এ ঘটনা ঘটবেই। শহরের খ্যাতির মুকুটে যুক্ত হবে আরেকটি আন্তর্জাতিক পালক। পর্যটনের সুবাদে বাড়বে রাজ্যের অর্থনীতি, হবে কর্মসংস্থান।
আমার মনে পড়ছে এই কার্নিভাল শুরুর ইতিহাসের কথা। অনেকেই বলেছিলেন, পুজোর পর রেড রোডের মত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা আটকে এই মোচ্ছবের কী দরকার! সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। সব সমালোচনা অগ্রাহ্য করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থেই কার্নিভালের সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, কলকাতার দুর্গা পুজোর মত এত বড় উৎসব নিয়ে দেশ তো বটেই এমনকি বিদেশেও বিরাট আগ্রহ রয়েছে। তিনি বুঝেছিলেন, এই আগ্রহকে পর্যটনে পরিণত করতে চাই সংহত পরিকল্পনা এবং একটা নিটোল প্যাকেজ। পুজো কার্নিভালের সাফল্য তার ভাবনার সত্যতা প্রমাণ করেছে।
সত্যি বলতে কি, গতকাল কার্নিভালে আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে বিদেশি পর্যটক ও অতিথিদের মুখগুলি লক্ষ্য করেছি। কার্নিভাল চলাকালীন সময়ে তাদের চোখে মুখে লাগাতার খেলা করে যাচ্ছিল বিস্ময়। মাতৃমূর্তির নানা রূপ ও বিভিন্ন ক্লাবের বিচিত্র উপস্থাপনা দেখে তারা যাকে বলে চমকে গেছেন। অবাক হয়েছেন বাংলার রাজ্যপালও। এমন জিনিস এর আগে তারা কোন দিন দেখেননি। একই কথা খাটে এই সমারোহের নাচ গান ও আলোকসজ্জা সম্পর্কে। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, কীভাবে এটা করা হল, কতদিন সময় লাগলো, খরচ কত হল এসব কথা। এককথায় এর উত্তর দেওয়া কঠিন। তবুও বলি, নানাভাবে বাংলা ও বাঙালিদের খাটো করার চেষ্টা হলেও একমাত্র কলকাতাই এভাবে ভাবতে পারে, এ জিনিস একমাত্র কলকাতাতেই সম্ভব!
শুধু বাংলা, শুধু কলকাতায় আটকে না থেকে পুজো কার্নিভাল ধরতে চেয়েছে গোটা দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে। বিভিন্ন পুজো কমিটির উপস্থাপনায় গুজরাটের ডান্ডিয়া থেকে রাজস্থানের গারবা নাচ, পুরুলিয়ার ছৌ নাচের পাশাপাশি দর্শকরা দেখেছেন দার্জিলিঙের কুকরি নাচ। সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ, রবীন্দ্র সঙ্গীত, বাংলা আধুনিক এবং হিন্দি গান কী ছিল না এই কার্নিভালে? বাংলায় প্রাদেশিকতার কোন জায়গা নেই। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ–শিখ-খ্রিষ্টান সবাইকে মিলিয়ে এমন একটা আয়োজন প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিল একটা সর্বভারতীয় উপস্থাপনা।
বাংলার উৎসব কোন সময়েই সামাজিকতার দায় থেকে মুক্ত হতে চায়নি। উৎসবের আনন্দেও আমরা মনে রাখি অবহেলিত মানুষদের কথা। তাদের ডেকে নিই উৎসবের প্রাঙ্গনে। উত্তর কলকাতার ন-পাড়ার দাদাভাই সঙ্ঘের উপস্থাপনার সঙ্গে ছিলেন হুইলচেয়ারে বসা বৃদ্ধারা। এ দৃশ্য দেখামাত্র মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চ থেকে নেমে গিয়ে সরাসরি তাদের সঙ্গে কথা বললেন। আরেকটি ক্লাবের উপস্থাপনায় ছিলেন সমাজ এখনও যাদের অস্তিত্ব অগ্রাহ্য করে চলেছে সেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও। পরিবেশ চেতনা, জল সংরক্ষণ থেকে শুরু করে নারী পাচার, সেভ ড্রাইভ সেভ লাইফের মত বিচিত্র বিষয় যে পুজোর থিম হয়ে উঠতে পারে তা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিদেশি দর্শকরা। এরই পাশাপাশি পুজোর থিমে এসেছে বিদ্যাসাগরের মত মনীষী, হেমন্তের মত সুরকার, জহর রায়ের মত অভিনেতা। প্রতিটি ক্লাবের উপস্থাপনায় নারী ও শিশুদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।
কলকাতার পুজো কার্নিভাল ভারত তো বটেই বিশ্ব পর্যটনের মানচিত্রে যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের দুর্গা পুজো নিয়ে সারা বিশ্বে পরম্পরাগত ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ যারা করেন তাদের আগ্রহ বাড়ছে। এবারও তাদের প্রতিনিধিরা কলকাতায় এসে এব্যাপারে খোঁজখবর করেছেন। এই কার্নিভাল বাংলার দুর্গা পুজোকে একদম সঠিকভাবে পৌঁছে দিয়েছে বিদেশি পর্যটক সহ এসব বিশেষজ্ঞদের কাছে। কার্নিভাল যেন তাদের কাছে কলকাতার দুর্গা পুজোর বৈচিত্রের একটা ক্যাপসুল। আমার বিশ্বাস, এই কার্নিভালের হাত ধরেই বাংলার দুর্গা পুজো একটা পরম্পরাগত ঐতিহ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত